আপদ

আপদ

তিন বছর আগে আমি প্রথম দেখেছিলাম ছোট্টখাট্টো মেয়েটাকে। রোগা হাত পা, ফ্যাকাশে গাল আর বড় বড় নীল চোখ নিয়ে একটা ভীতু ইঁদুরের মত জড়সড় হয়ে বসে ছিল সে। শুধু কোন পছন্দের লেখককে দেখলেই লজ্জায় রাঙা হয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে ধরত মেয়েটা।

এই তিন বছরে কল্পবিজ্ঞান লেখক সঙ্ঘের একটাও মিটিঙও সে বাদ দেয়নি। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, কেউ তাকে আমাদের সঙ্ঘের মিটিঙে ডাকত না। তবে আমরা কেউ ওকে কোনদিন তাড়িয়েও দিইনি, সুতরাং এর ফলে যা ক্ষতি হয়েছে তার দায়িত্ব তো আমাদের উপরেই বর্তায়। যখন কোন লেখক মঞ্চে উঠে কথা বলতেন, মেয়েটি উত্তেজনায় চেয়ারের একেবারে ধারে এসে গলা উঁচু করে বসত। যেন কোনভাবেই একটা কথাও ওর কানের বাইরে দিয়ে না যায়! শুধু নামী লেখক কেন, যেকোন অচেনা নতুন লেখকের কথাই শোনার জন্যে ও যা আগ্রহ দেখাত, তেমন আগ্রহী শ্রোতা পেলে গ্রীক ইতিহাসের সুবক্তা সিসিরোও ধন্য হয়ে যেতেন।

ওকে চুপটি করে বসে থাকতে দেখতেই আমরা এতটা অভ্যস্ত ছিলাম যে প্রথম যেদিন ও কথা বলল, আমরা সবাই চমকে গেছিলাম। সেদিন একজন নতুন লেখকের উপন্যাস নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা চলছিল। বইটিকে মোটেই পদের বলা চলে না, একগুচ্ছ বৈজ্ঞানিক আলোচনা আর অবোধ্য শব্দের ব্যবহারে গল্পটি পাঠকের মনে কোনভাবেই দাগ কাটতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু লেখক নিজের লেখনশৈলীর উপর যথেষ্ট আস্থাশীল এবং আমাদের বিরূপ সমালোচনা তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতেই ব্যর্থ হচ্ছিল।

“ঠিক আছে! চলুন ওই বাচ্চাটিকে জিজ্ঞাসা করে দেখা যাক। বাচ্চারা নিষ্পাপ মনে সত্যি কথাটাই বলবে।” – অনুকম্পার হাসি হেসে লেখক ঘুরে তাকালেন তার দিকে। “কিগো মেয়ে, আমার গল্পের কিছুই কি তোমার ভালো লাগেনি?”

মেয়েটি খুব উৎসাহ ভরে উঠে দাড়িয়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, ভালো লেগেছে বইকি।”

“বাহ! বেশ বেশ! তা ঠিক কি কি ব্যাপার ভালো লেগেছে আমার উপন্যাসের?” – কান এঁটো করা হাসি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন লেখক।

“এন্তোকোলস্কির কবিতাটা! চোদ্দ নম্বর পাতায় নিচের দিকে যে আটটা লাইন আছে, সেই কটা আমার মনে হয়েছে বেশ ভালোই হয়েছে।”

আর সেইদিন থেকেই আমাদের সামনে যেন সেই বাচ্চা মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে গেল। তার জায়গা নিল এক খুদে শয়তান, যার সবুজ ফ্রক আর গোলাপি জ্যাকেটের পকেটগুলি ভর্তি থাকতো যত রাজ্যের কল্পবিজ্ঞান আর ফ্যান্টাসি বইয়ে। কালো কাজল মাখা চোখগুলো যেন সবসময় সুযোগ খুঁজত কি করে কোন লেখকের সমালোচনা করা যায়।

পরে একদিন আপদের প্রথম শিকার সেই লেখক বলেছিলেন, আমাদের সঙ্ঘের মিটিংটা যেন বারুদের স্তুপের উপর বসে সিগারেট খাওয়ার মত বিপদজনক হয়ে উঠল লেখকদের জন্যে। আর হ্যাঁ, মেয়েটিকে আড়ালে ‘আপদ’ নামেই ডাকা শুরু করলাম আমরা।

আপদের সবথেকে তীক্ষ্ণ সমালোচনাগুলো তোলা থাকত আমার জন্যেই, মিটিং এর শেষে আমার পিছু পিছু আমার বাড়িতে হানা দেবার সময়, আমারই গল্পের মুন্ডুপাত করাটা আপদের শখের মধ্যে পড়ত। কি কুক্ষণেই না একবার আমি ওকে আমার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিলাম! তারপর থেকে প্রতিদিন বিকেলে নিয়ম করে আমার ঘরে হানা দিত সে। তবে আমার সৌভাগ্য, কোনদিন সে আমায় জ্বালায়নি। আমার বই এর তাক থেকে একটা পছন্দমত বই বেছে নিয়ে সোফার এক কোনে বসে বই এর মধ্যে ডুবে যেত সে। শুধু মাঝে মাঝে নখ খাওয়া আর কিছু বিস্ময়সূচক অব্যয় ছুঁড়ে দেওয়া ছাড়া তেমন সাড়া শব্দও করত না। একবার খুব খুশি হয়ে অনেকক্ষণ শিষ দিয়েছিল সে, পরে জেনেছিলাম সেটা নাকি কোন কল্পবিজ্ঞান গল্পের কাঁকড়া-মাকড়শাদের ভাষা।

তবে এরপর তার পড়া শুধু কল্পবিজ্ঞানে আটকে রইল না। “বুঝলে, রোমিওটা একটা গাধা ছিল!” – শেক্সপিয়রের  রচনা সমগ্র নামিয়ে রেখে সে একদিন বলল, “শোনো, আমি বলছি কি করে জুলিয়েটকে খুব সহজেই ফুসলে বিয়ে করা যেত …”।

তবে কল্পবিজ্ঞানই ছিল তার প্রথম প্রেম। সবথেকে ওঁচা কল্পবিজ্ঞান পড়েও আপদ ঘটাখানেক কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে ভাবনায় ডুবে যেত। আমি জানতাম তখন ওকে ডেকে কোন লাভ নেই, তখন ও নিজেকে গল্পের নায়কের ভূমিকায় বসিয়ে নিজের মত করে গল্পটা আবার লিখছে। আর এই করতে গিয়ে ও ভুলেই যেত গল্পের কোন জায়গাটা ও পড়েছে আর কোনটা ওর নিজের কল্পনা।

যেমন একদিন আপদ খুব গম্ভীর মুখে ঘোষণা করল যে ও একটা অদৃশ্য বিড়াল খুঁজে পেয়েছে।

“জানো, আমি শব্দ শুনতে পারছিলাম, কিন্তু কোন বিড়াল দেখতে পারছিলাম না! তার মানেই সেটা ওই অদৃশ্য বিড়াল!”

“অ্যাঁ?”

“আরে গ্রিফিনের সেই বেড়ালটা, যার উপর সে অদৃশ্য হবার পরীক্ষাগুলো করত! অদৃশ্য মানুষকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- ‘সেই অদৃশ্য বেড়ালটার কি হল?’ গ্রিফিন উত্তর দিয়েছিল – ‘কেন সে আর পাঁচটা বেড়ালের মতই এই পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে’। এবার ভেবে দেখ, ওই অদৃশ্য বিড়ালটার নিশ্চয় অনেক অদৃশ্য বিড়ালছানাও হয়েছে এতদিনে? আর তারা নিশ্চয় সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছে? এবার বুঝতে পারছ তো?”

আপদের পর্যবেক্ষণ শক্তির সত্যি তুলনা ছিল না। আমরা গল্পে যে খুঁটিনাটিগুলোর কথা ভেবেও দেখিনা, সেইগুলো নিয়েই যত চিন্তা ছিল তার। যেমন ওয়েলসের টাইম মেশিনের মডেলের কি হল তাই নিয়ে গবেষণা। এখানে কিন্তু সে আসল টাইম মেশিনটার কথা ভাবছে না,গল্পে লেখা ছিল মডেল টাইম মেশিনটা ভবিষ্যতে পাঠানো হয়েছিল। তাই যদি হয় তবে আজ পর্যন্ত কেউ সেটাকে দেখতে পেল না কেন? এমনকি সেই মডেলটা নিয়েও কেন কেউ গল্প লিখল না সেটা ভেবেও আপদ যথেষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করত।

আরেকটা ব্যাপারে তার খুব উৎসাহ ছিল – “এখুনি কেন নয়?” এক নিঃশ্বাসে সে কথাটা একটানা উচ্চারণ করে যেত, “এখুনিকেননয়?” যেমন একটা গল্পে সে পড়েছিল এক বিজ্ঞানীর কাটা মাথা আবার জীবন্ত করে তোলা হয়েছে – “এখুনিকেননয়?”। অথবা কোন গল্পে নায়ককে কয়েকশো বছর ধরে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে কোন রহস্যময় আরকের মধ্যে – “এখুনিকেননয়?”

এইভাবে একদিন আপদ একটা কল্পবিজ্ঞানের পত্রিকাতে একটা গল্প খুঁজে পেল – গল্পের মধ্যে একজন মানুষ ইলেক্ট্রো-প্লাস্টিক পেশির পাখা ব্যবহার করে উড়তে শিখেছিল। সে অনেকক্ষণ ধরে বার বার পত্রিকাটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লো, গল্পের সাথের সব ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, তারপরে পত্রিকাটা সরিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল – “এখুনিকেননয়?”

আপদ পরের তিনটে দিন সব পড়াশুনো শিকেয় তুলে আমার পিছনে ঘুরে বেড়াল ওই একটাই প্রশ্ন নিয়ে -“এখুনিকেননয়?”

তৃতীয় দিনে আমি বাধ্য হয়ে তাকে আমার প্রযুক্তিবিদ বন্ধুর কাছে নিয়ে গেলাম। বন্ধুটির ধৈর্য তারিফ করার মত, সে দুনিয়ার যে কোন লোককে তার বক্তব্য খুব শান্তভাবে বোঝানোর ক্ষমতা রাখত। আমরা ঠাট্টা করতাম যে, চিরস্থায়ী গতি যন্ত্রের আবিষ্কর্তার সাথেও সে ঠাণ্ডা মাথায় আলোচনা চালাতে পারবে।

তা, আমাদের আপদটি সেই পত্রিকাটি প্রযুক্তিবিদ বন্ধুর নাকের সামনে নাচিয়ে প্রশ্ন করল, – “এখুনিকেননয়?” বন্ধু তার বইয়ের তাক থেকে উড়ানযন্ত্র সম্পর্কে একটি বই নামিয়ে সোৎসাহে তাকে উদাহরণ সহযোগে বোঝানো শুরু করলেন।

একটি জীবের আয়তন যত বড় হয়, ততই শক্তি ও ওজনের অনুপাত কমতে থাকে। তাই রাজহাঁসের মত বড় পাখিরা খুব একটা ভালো উড়তে পারেনা। আমরা যতই কল্পনা করিনা কেন, একটি ডানাওয়ালা ঘোড়া কোনদিনই উড়তে পারবে না। মানুষের ক্ষেত্রে এই শক্তি আর ওজনের অনুপাতটা খুব মাঝামাঝি জায়গায় থাকে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের উৎপন্ন শক্তি ৬০-৭০ কেজি ওজনকে আকাশে ওড়াতে সক্ষম। কিন্তু তার সাথে আমরা যদি কৃত্রিম পাখার ওজন যোগ করি, তাহলে আর পাখাওয়ালা মানুষের ওড়ার স্বপ্ন সফল হবার সম্ভাবনা থাকে না।

আমাদের প্রযুক্তিবিদ বন্ধু খুব মনোযোগ সহকারে আপদকে ছবি, মডেল আর উদাহরণ দিয়ে এই সব বোঝাতে লাগল। সেও কোন প্রশ্ন না করে সব শুনছিল, শুধু মাঝে মাঝে সন্দেহজনক ভাবে প্রযুক্তিবিদের দিকে তাকিয়ে নাক চুলকচ্ছিল। তখনও আমি আপদের এই অভ্যেসটার সম্পর্কে জানতাম না, তাই এই ভঙ্গীর মানেও বুঝতে পারিনি।

এরপরের দশ দিন আর তার কোন পাত্তা পাইনি। আবার এক বিকেলে সে আমার ঘরে এসে হানা দিল, হাতে দড়ি বাঁধা একটা পুরোনো সুটকেস। আমি ভাবলাম হয়ত কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে আপদ।

“এই হল ওড়ার উপযুক্ত পাখা!“ ঘোষণা করল সে।

সারা ঘরে উত্তেজিত হয়ে পায়চারি করছিল আপদ। আমি হতবাক হয়ে গেছিলাম, কখনো ভাবিনি আপদের দ্বারা কোন কাজ বাস্তবে সম্ভব হতে পারে! এতদিন তাকে শুধু পায়ের উপর পা তুলে বই পড়তেই দেখেছি, তার বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে তার কোন আগ্রহই ছিল না।

“ছেলেরা এই ডানাগুলো বানিয়েছে। আমি ওদের শিখিয়েছি আর সেইমত ওরা বানিয়েছে।”– খুব গম্ভীরভাবে কেটে কেটে কথাগুলো বলল সে। এও আরেক নতুন খবর! আপদের সাথে যে কোন ছেলের চেনা আছে এমন কথাও কোনদিন শুনিনি!

“দাঁড়াও, তোমায় বুঝিয়ে দিচ্ছি।”– সুটকেসটা আমার সামনে বসিয়ে দিয়ে আপদ বলল, “আমি আসার আগেই পরীক্ষা করে দেখেছি যে আমার যন্ত্র একদম ঠিকঠাক কাজ করছে।”

আমি ভেবেছিলাম আপদের যন্ত্র এমন অদ্ভুত কোন কল্পনার উপর ভর করে হবে যার কথা আমি কোনদিনই শুনি নি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখলাম ব্যাপারটা খুবই সরল আর বাস্তবিক। এমনকি আপদ খুব সংক্ষেপে সবকিছু বোঝানোর পর আমার মনে হল এমন যন্ত্র তো হতেই পারে!

পাখার সাহায্যে ওড়ার পক্ষে মানুষের ওজন বড্ড বেশি, তাই আপদ মানুষের থেকে অনেক হাল্কা প্রানীদের ওড়ার জন্যে যন্ত্র পাখা বানিয়েছে! সেটার নামও দেওয়া হয়েছে – পেশি-বিমান!

“আসলে এটা মানুষের অহঙ্কার ছাড়া আর কিস্যু নয়!”, ব্যখ্যা করল আপদ। “হাজার বছর ধরে মানুষ শুধু নিজের ওড়ার জন্যে পাখা বানাতে চেয়েছে। কিন্তু জন্তুদের জন্যে তো পাখা বানানো যেতই, তাই না?”

ঠিকই তো, বাস্তব তো দূরের কথা, গল্পেও কেউ জন্তুদের পাখা তৈরির কথা লিখেছে বলে মনে করতে পারলাম না। চুপ করে শুনে যাওয়া ছাড়া আপদের প্রশ্নের কোন উত্তর ছিলনা আমার কাছে।

সুটকেসটা খুলতেই তার ভিতর থেকে একটা মোটাসোটা বিড়াল দুলকি চালে বেরিয়ে এলো। বিড়ালটা এতক্ষণ একটা পুরোনো ভাঙ্গা ছাতার উপর বসে ছিল। ছাতা বলাটা ভুল হবে, সেটা এককালে হয়ত একটা ছাতা ছিল, কিন্তু এখন সেটা দিয়ে একটা ডানার মত অদ্ভুত জিনিস বানানো হয়েছে।

“এইবার মজাটা দেখ।” আপদ ডানাটা ভাজ খুলে বিড়ালটার পিঠে সেটা বাঁধতে লাগল। আশ্চর্য ব্যাপার, এতে বেড়ালটার কোন হেল দোল আমি দেখতে পেলাম না। খুব নিরাসক্ত মুখে সে পুরো সময়টা চুপ করে আমার সোফার উপর বসে রইল। ডানাটা বাঁধা হয়ে গেলে মনে হল আমার সামনে একটা ছোটখাটো প্রাগৈতিহাসিক টেরোড্যাক্টাইল বসে আছে! “পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম উড়ন্ত বিড়াল হিসেবে এর আরেকটু উত্তেজিত হওয়া উচিত ছিল” – আমি মনে মনে ভাবলাম।

বিড়ালটা উঠে দাড়িয়ে একটা লম্বা হাই তুলল, তারপর হেঁটে গিয়ে আমার ইজিচেয়ারটার উপর উঠে সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ল। ডানাদুটো ভাজ হয়ে বেড়ালটার পিঠেই লেগে রইল।

আমি মুচকি হেসে আপদের দিকে ফিরলাম। শুধু ডানা লাগালেই তো বেড়াল উড়তে শুরু করেনা। জন্তুটার চরিত্রের মধ্যেও তো ওড়ার কোন চেষ্টা নেই। ডানা থাকাটা শুধু প্রথম ধাপ ওড়ার, দ্বিতীয় ধাপে বেড়ালটাকে ওড়ার ইচ্ছে তো প্রকাশ করতে হবে।

আমি ভেবেছিলাম এই কথাগুলো শুনে আপদ রেগে যাবে। কিন্তু পুরো সময়টা সে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে নাক চুলকাতে লাগল।

“জন্তুর চরিত্র, হুম! বিড়ালের চরিত্র! এটা নিয়ে আমি যে ভাবিনি তা নয়…”। আপদ উঠে বাইরের ঘর থেকে তার ওভারকোটটা নিয়ে এলো। কোটের অসংখ্য পকেট হাতড়িয়ে সে একটা জ্যান্ত ইঁদুর বের করে টেবিলের উপর রাখল। এরপরের ঘটনাগুলো এতো দ্রুত ঘটল যে আমার শুধু বসে বসে দেখা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।

বিড়ালটা জ্যা মুক্ত তিরের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল টেবিলটার দিকে। কিন্তু বেচারা ডানাটার কথা ভুলেই গেছিল বোধহয়। শূন্যে ভাসমান অবস্থায় ডানাজোড়া খুলে গেল আর বিড়ালটা টেবিলের উপর দিয়ে ভেসে গিয়ে দূরের দেওয়ালটায় আছড়ে পড়ল। আমার ধারণা দেওয়াল না থাকলে খুব সহজেই তিরিশ মিটার পেরিয়ে যেত বেড়ালটা। কিন্তু দেওয়ালে গুঁতো খেয়ে মাটিতে পড়ে যাবার বদলে বেড়ালটা মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ছাদের কাছে উড়ে গেল। আমি অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম ঘরের মাঝের সুদৃশ্য ঝাড়বাতিটার চারপাশে গোল হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে একটা ভয় পাওয়া বিড়াল। দেওয়ালের ধাক্কায় একটা পাখা নিশ্চয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কারণ একটু পরেই ভারসাম্য হারিয়ে বেড়ালটা সোফার উপর আছড়ে পড়ল।

“হুম! আমাদের একটা বাদুড় ধরে আনা উচিত ছিল। তাহলে বিড়ালটা ওটার পিছনে সারা ঘরে উড়ে বেড়াতে পারত। আপদ এতক্ষনে বলে উঠল। “আচ্ছা উড়ন্ত বিড়াল কি আমাদের দেশের অর্থনীতিকে সাহায্য করতে পারবে?”

শুধু উড়ন্ত বেড়াল কেন, উড়ন্ত কুকুর ছাড়াও মাদার রাশিয়া দিব্বি বেঁচে থাকবে এই ব্যাপারে আমি তাকে আশ্বস্ত  করলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম এরপরে আপদ কুকুরদের ওড়ানোর বন্দোবস্ত করবে।

“উড়ন্ত কুকুর… হুম…”, আপদ চোখ বন্ধ করে নাক চুলকানো শুরু করল। “কিন্তু উড়ন্ত কুকুর কি কাজে লাগতে পারে? হুম… উড়ন্ত পাহারাদার কুকুর? হুম… কিন্তু তারথেকে ভালো যদি ওই জন্তু গুলো… হুম কি নাম যেন… নিজেরাই উড়ে উড়ে ঘাস খেতে পারে… ওদের পাহারা দেবার দরকারই পড়বে না।“

“তুমি কিসের কথা বলছো বলত?”

“ভেড়া!”, আমার নির্বুদ্ধিতায় বিরক্ত হয়ে বলে উঠল আপদ। “আরে ভেড়া বা ছাগল যাই ভাবো না কেন! ভাবো তো তারা পাহাড়ের গায়ে উড়ে উড়ে ঘাস খেয়ে বেড়াচ্ছে! তাদের পাহাড়া দেবারও দরকার পড়ছে না!”

সেই মুহূর্ত থেকে বুঝতে পারলাম যে আমায় খুব সাবধানে কথা বলতে হবে। আপদ আমার যে কোন কথা থেকে তার অসীম কল্পনাশক্তি খাটিয়ে নতুন কি অজানা বিভীষিকা তৈরি করে বসবে তার ঠিক নেই!

অনেক ভেবে চিন্তে আমি আপদকে বোঝাতে লাগলাম যে ডানা থাকা বা উড়তে না পারা কোন বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। জীবজগতে বহু কোটি বছরের চেষ্টায় আর পারিপার্শ্বিক কারনে কিছু প্রাণীর পাখা তৈরি হয়েছে। বাকিদের কাছে এই পাখা কিন্তু বোঝা ছাড়া আর কিছুই না।

আপদ চুপচাপ বেড়ালটাকে আবার তার সুটকেসে পুরে ফেলল।

“আমি কিন্তু তোমায় নিরুৎসাহ করতে চাইনি।”

“হুম, দেখা যাক।”

এক সপ্তাহ পরে শহরের খবরের কাগজের পাতায় একটা ছোট খবরে আমার চোখ আটকে গেল। “মুরগিরা কি উড়তে পারে?” – লেখক এক জীববিজ্ঞানী, তিনি লিখেছেন যে গত কয়েকদিনে নাকি তার এলাকায় মুরগীদের দীর্ঘ সময় ধরে আর অনেক উচুঁতে উড়তে দেখা গেছে। তিনি আরো লিখেছেন যে এতদিনের জীববিজ্ঞান মনে করত মুরগীদের পাখা ওড়ার জন্যে উপযুক্ত নয়। এখন বোঝা যাচ্ছে তা সম্পূর্ণ ভুল। এই নিয়ে আগে কখনো বিস্তারিত গবেষণা হয়নি। তিনি খবরটির শেষে লিখেছেন- “বিজ্ঞান একদিন না একদিন এই রহস্যের সমাধানও বের করবে।”

এসব যে আপদের হাতের কাজ সেই বিষয়ে আমার কোন সন্দেহই ছিল না। আর এর জন্যে কিছুটা হলেও আমিও দায়ী, আমিই ওর মাথায় পাখা কোন কোন প্রাণীর বোঝা – এই কথাটা ঢুকিয়েছিলাম, আর সেখান থেকেই ও মুরগীর ডানার কথা পেয়েছে। আমি আমার সেই প্রযুক্তিবিদ বন্ধুকে ফোন লাগালাম।

“ব্যাপারটা কিন্তু খারাপ বলেনি”, সব শুনে বন্ধু চিন্তিত মুখে বলল। “উহু, মজা করছি না। সত্যিই ওর আইডিয়াটা ভালো। বায়োনিক – মানে প্রকৃতি নির্ভর প্রযুক্তি অনেকদিন ধরেই চলে আসছে, তাহলে উলটোটাই বা হবে না কেন? মানে প্রযুক্তি নির্ভর প্রকৃতি ! মেয়েটা তো বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত খুলে দিলো হে ! ভেবে দেখ, এই যে ঘোড়ার নাল লাগাই আমরা, সেটা কি? প্রযুক্তিই তো? তাহলে উড়ন্ত ভেড়া… একটু বেশি বড় হয়ে যাবে, কিন্তু উড়ন্ত খরগোশ! নাহ! কিছু অংক কষতে হচ্ছে দেখছি … আমি তোমায় কাল ফোন করছি। বাই।”

পরের দিনের খবরের কাগজে আরেকটা অদ্ভুত খবর বেরোল। শহরের ঝিলের সব রাজহাঁসগুলো হঠাত ডানা মেলে কোন অজানার উদ্দেশ্যে উড়ে গেছে। মজার ব্যাপার হল গত আট বছর তারা ওই ঝিলেই থাকত এবং তাদের কেউ কখনো উড়তে দেখেনি!

আমি যখন এই খবরটা পড়ছিলাম তখনই দরজার ঘন্টা বাজল। আপদকে আমি কোনদিন এতটা খুশি দেখিনি। “একটা দারুণ পরিকল্পনার কথা ভেবেছি!”, আমার গোমড়া মুখকে কোন পাত্তা না দিয়েই বলল আপদ। “তোমাকে সবটা না বললে আমার রাতে ঘুম হবে না!”

“তুমি কি ওই মুরগীগুলোর কথা বলছ?”, আমি নিরাসক্ত মুখে জিজ্ঞাসা করলাম।

“ফুঃ! ওসব মুরগী হল ছেলেখেলা এর কাছে!” হাতের এক ইঙ্গিতে সে যেন মুরগীগুলোকেই আকাশে উড়িয়ে দিল।

“তাহলে কি রাজহাঁসের কথা?”

“নাহ! রাজহাঁসগুলো কেন যে এতদিন ওড়েনি তা কে জানে! হয়ত এই শহরটা ওদের পছন্দ হয়ে গেছিল। আমি শুধু ওদের পাখাটা একটু বড় করে দিয়েছিলাম। আর হ্যাঁ, কিছু পালকও জুড়ে দিয়েছিলাম, যাতে বড় পাখাগুলো অকেজো না হয়ে যায়। পায়রার ডানা বড় করলেও একই রকম ব্যাপার হবে মনে হয়। তবে ওসব ছাড়ো, আমি বলছি মাছের কথা।“

“মাছ! মানে?”, মনে মনে আমি প্রাণপণে ভেবে যাচ্ছিলাম কিভাবে এই পাগলামি থামানো যায়!

“আরে মাছেদের পাখাগুলো তো একধরনের ডানাই, তাই নয় কি?” আপদ বলে চলল, “ভেবে দেখো, ডলফিনগুলো যদি কাল আকাশে উড়তে শুরু করে, কেমন হবে? অথবা ধর তলোয়ার মাছ? ওরা নাকি ঘন্টায় আশি কিলোমিটার বেগে সাঁতার কাটতে পারে। তাহলে ভাবো বাতাসে ওরা কত তাড়াতাড়ি উড়বে? আচ্ছা আমাদের দেশের অর্থনীতিতে উড়ন্ত মাছ থেকে কি কি সুবিধে হতে পারে?”

আমি বেফাঁস কিছু বলে ফেলার ভয়ে চুপ করে থাকলাম। এই ছোট্ট রোগা মেয়েটা যেন হঠাত আজকে কল্পবিজ্ঞানের জীবন্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে, ফ্যান্টাসি জনরার সমস্ত সত্তা যেন আপদের মধ্যেই আবির্ভূত হয়েছে। আর এই সত্তা বড়ই চঞ্চল, সে কোন নিয়মে বাঁধা পড়তে রাজি নয়। সে আমার সামনে বসে জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে নাক চুলকাচ্ছে। আমায় যা করার এখুনি করতে হবে, তাই আমি বিবর্তনবাদের সাহায্য নিলাম। ডানা বা পাখা যাই বলনা কেন, তার সৃষ্টি হয়েছে বহু কোটি বছর ধরে বিবর্তনের মাধ্যমে। আজকে তাদের যে চেহারা দেখতে পাই তা তাদের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াবার জন্যেই তৈরি হয়েছে।

“ধুস, বিবর্তনবাদ দিয়ে আমার কি এসে যায়?” আপদ মাঝখানেই আমায় থামিয়ে দিল। “বিবর্তন তো আর শেষ হয়ে যায়নি, এখনও তা চলছে, শুধু খুব ধীরে ধীরে। তা সেটাকে একটূ দ্রুত করলে ক্ষতি কি? এখুনিকেননয়? তুমি যদি সবকিছুই আরো তাড়াতাড়ি আর সহজে করতে পারো, সেটাই কি বিবর্তনবাদ নয়?”

আমার মাথার মধ্যে ততক্ষণে এই দ্রুত বিবর্তনের দুনিয়ার ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যেখানে উড়ন্ত বেড়ালরা বাদুরের পিছনে ছুটে বেড়ায়, উড়ন্ত কুকুর উড়ন্ত খরগোশ ধরতে চায়, হাতিরা জলের নিচে আর ডলফিনরা জলের উপরে উড়ে বেড়ায়। আর জেলেরা বেলুনে চড়ে জাল ঝুলিয়ে আকাশে মাছ ধরে। আমি বুঝতে পারলাম আপদ প্যান্ডোরার বাক্স খুলে ফেলেছে আর তার জন্যে মানবজাতির কাছে চিরকাল আমি দায়ী থাকব।

আর তখনই আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ঠিক সময়ে দারুণ বুদ্ধি! আর এক মিনিট দেরী হলেও আপদকে আর থামানো যেতনা আর পৃথিবী চিরকালের মত পালটে যেত।

“ডানা, ধুর, ওটা আর কি এমন! ওই দিয়ে কি হবে!” আমি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে বললাম। “ডানা দিয়ে তো যে কেউ উড়তেই পারে। দুনিয়ায় এতরকম পাখি ডানা দিয়ে ওড়ে যে আমি ওটাকে ওড়াই বলি না। তবে বিপরীত মাধ্যাকর্ষন! এইটে একটা কাজের কাজ হবে। অনেকেই বলে যে এটা আবিষ্কার করতে এখনো অনেকদিন সময় লাগবে, কিন্তু আমি বলি, এখুনিকেননয়?”

আজ আমি যখন এই কথাগুলো লিখছি, তখন আপদ জানালার পাশের একটা চেয়ারে পা তুলে বসে আছে। সে এখন খুব মন দিয়ে ল্যান্ডাউ আর কিতাইগোরোদস্কির বইগুলো পড়ে যাচ্ছে। গত দু মাসে ও ফিজিক্স ছাড়া আর কিচ্ছু পড়েনি। খবরের কাগজেও কোন অদ্ভুত খবর প্রকাশ পায়নি এর মধ্যে। আপদ রোজ এসে বই এর মধ্যে ডুবে যায়, মাঝে মাঝে শুধু নোখ কামড়ায় আর যন্ত্রের মত মাথার চুলগুলো পাকাতে থাকে আঙ্গুলের মাঝে। সবকিছু এখন শান্ত আর চুপচাপ।

অন্তত আরো কিছুদিনের জন্যে।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত