তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে। দিনান্তে গোধূলির রক্তাভা পশ্চিমের আকাশ থেকে একেবারে মিলিয়ে যায়নি। প্রায় নির্জন মহাসড়কে ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাচ্ছিল এক তরুণ যুগল। তারুণ্যের বুনো গন্ধমাখা যুগল সদ্যবিবাহিত দম্পতি। কনে নীনা দেকোন্তে আর বর বিলি সানচেজ। মাদ্রিদ শহর থেকে যাত্রা শুরু করে তাদের বর্তমান গন্তব্য স্পেন সীমান্ত। সীমান্ত-চৌকিতে পৌঁছার আগে চালক বিলি সানচেজ ক্রমান্বয়ে গাড়ির গতি কমিয়ে আনল। নীনা দেকোন্তে তার হাতের উইডিং রিংটার দিকে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। উজ্জ্বল গোলাপি পাথরের আংটি। আংটির কিনার বেয়ে আঙুল থেকে বিন্দু বিন্দু রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল।
সীমান্তের জনমানবহীন প্রান্তর। চারদিক সাদা বরফের স্বচ্ছ চাদরে ঢাকা। পিরেনিজ পর্বতের দিক থেকে হাড়-কাঁপানো শীতল হাওয়া বয়ে চলেছে। সীমান্ত-চৌকিতে একজন মাত্র গার্ড। জড়সড় হয়ে অলস ভঙ্গিতে বসেছিল লোকটি। গাড়ির ব্রেক করার কর্কশ শব্দে মুখ তুলে তাকাল সে। চোখ-মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। লোকটির আপাদমস্তক ভারী চামড়ার কোটে ঢাকা। নরম বরফ ঠেলে গাড়ির কিনারে এসে দাঁড়াল সে। নীনা দেকোন্তে দুটি পাসপোর্ট এগিয়ে ধরল তার দিকে। গার্ড পাসপোর্টগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। পাসপোর্ট দুটিতে ডিপেস্নাম্যাটিক ছাপ মারা। ফলে গার্ড সতর্কদৃষ্টিতে একঝলক দেখে নিল তরুণ যুগলকে। অবশ্য যথানিয়মে পরীক্ষাশেষে ফেরত দিলো বিনাবাক্যে।
একটি অত্যন্ত দামি কালো রঙের ফার কোটে নীনা দেকোন্তের আপাদমস্তক ঢাকা। তাতে অবশ্য ক্যারিবিয়ানের সূর্যের উত্তাপ মাখা তার মুখাবয়বের উজ্জ্বল ত্বক ঢাকা পড়েনি। তাছাড়া পাখির ডানার মতো গভীর নীল চোখের কমনীয় সৌন্দর্য চোখ এড়িয়ে যায় না। সুঠাম ও সুদর্শন বিলি সানচেজের গায়ে সর্বাধুনিক ডিজাইনের স্পোর্টস জ্যাকেট। তাদের সামাজিক মর্যাদার ব্যাপারটি দৃশ্যমান। বিশেষ করে পস্নাটিনাম পেস্নট লাগানো সর্বশেষ মডেলের স্পোর্টস কারটি দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়। গাড়ির পেছনের আসনে রাংতায় মোড়ানো উপহারের অনেক প্যাকেট। ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় মালপত্র। সঙ্গে এক কোনায় পড়ে আছে একটি স্যাক্সোফোন। চকচকে স্যাক্সোফোনটি নীনা দেকোন্তের ভাবাবেগের নিত্যসঙ্গী। গার্ড পাসপোর্টগুলো ফেরত দেওয়ার পর বিলি সানচেজ তাকে বলল, ‘এই যে ভাই। এখানে কোনো ফার্মেসি আছে?’ নিস্পৃহ কণ্ঠে গার্ড উত্তর দিলো, ‘সীমান্তের ওপারে দেখতে পারেন।’
স্পেন সীমান্ত অতিক্রম করে ফরাসি চেকপোস্টে এসে গাড়ি থামল। কিছুটা অবাক হয়ে তারা দেখল সেখানে কোনো গার্ড নেই। পাশে সেন্ট্রিরুমে আলো জ্বলছিল। বিলি সানচেজ বন্ধ কাচের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল ভেতরে। কক্ষের মধ্যে উষ্ণ আরামে জনাকয়েক লোক। তারা হট্টগোল করে মদ্যপান করছিল। কর্তব্য হিসেবে লোকগুলো মাঝেমধ্যে মুখ তুলে তাকাচ্ছিল আগন্তুক গাড়িচালকদের দিকে। তারপর হাত নেড়ে নির্দেশ দিচ্ছিল সামনে যাওয়ার জন্য। বিলি সানচেজ তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বেশ কয়েকবার হর্ন বাজাল। একজন অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে তাকে সামনে যাওয়ার ইঙ্গিত করল। কিন্তু বিলি সানচেজ হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছিল তারপরেও। ফলে আসর থেকে একজন উঠে এসে জানালা খুলে দাঁড়াল। তারপর ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে চিৎকার করে গালাগাল দিতে লাগল। বিলি সানচেজ ঘাবড়ে গেল ব্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে। কারণ গার্ডটি কথা বলছিল ফরাসি ভাষায়। পরিস্থিতি বুঝে দ্রম্নত গাড়ি থেকে নেমে এলো নীনা দেকোন্তে। তারপর বিশুদ্ধ ফরাসি উচ্চারণে সুরেলা কণ্ঠে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না। এখানে কোনো ফার্মেসি পাওয়া যাবে?’ নিরুত্তাপ কণ্ঠে গার্ডটি জবাব দিলো, ‘সেটি আমার দেখার বিষয় নয়।’ গার্ড হঠাৎ খেয়াল করল যে, সুন্দরী তরুণী তার হাতের আঙুল ঠোঁটে চেপে ধরে আছে। আসলে নীনা দেকোন্তে হাতের আহত আঙুল থেকে রক্ত নিঃসরণ বন্ধ করার চেষ্টা করছিল। ফলে ঠোঁটের কিনারে রক্তের অস্পষ্ট দাগ লেগে আছে। গোধূলির আলো-আঁধারিতে সাদা বরফে ঢাকা প্রান্তর। অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটিকে গার্ডের মনে হলো ভৌতিক অপচ্ছায়ার মতো। গার্ড তার কথা বলার ভঙ্গিমা পরিবর্তন করল অজ্ঞাত কারণে। যথাসম্ভব শান্ত কণ্ঠে বলল সে, ‘এই জঘন্য আবহাওয়ায় বিয়ারিজে কোনো ফার্মেসি খোলা পাওয়া অসম্ভব। তবে কিছু দূরে বায়ত্তনিতে দু-একটা খোলা থাকতেও পারে। যদি কপাল ভালো থাকে।’ নীনা দেকোন্তের হতাশ মুখ দেখে গার্ড কিছুটা কোমল কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘কোনো সমস্যা হয়েছে কি?’ রক্তিম ঠোঁটে মস্নান হেসে নীনা দেকোন্তে বলল, ‘উহু, তেমন কিছু নয়।’ তারপর হাতের চাঁপাফুলের কলির মতো আঙুলগুলো তুলে দেখাল। উজ্জ্বল হিরের আংটি পরা হাত। অনামিকার কিনারে রক্তবিন্দু। গোলাপের কাঁটার খোঁচা লেগে সামান্য কেটে গেছে মাত্র।
বায়ত্তনিতে পৌঁছার আগে ঝিরিঝিরি তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে। তখনো সন্ধে ৭টার বেশি হয়নি। কিন্তু ইতোমধ্যে অধিকাংশ গৃহের দরজা-জানালা বন্ধ। রাসত্মাঘাটও প্রায় জনশূন্য। ছোট্ট একটি শহর। নীনা দেকোন্তে আর বিলি সানচেজ দ্রম্নত দুবার ঘুরে এলো শহরটি। কিন্তু কোনো ফার্মেসি খোলা পাওয়া গেল না। তখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল তারা। বিলি সানচেজের উদ্দাম ভাবাবেগের উৎস নিত্যনতুন মডেলের গাড়ি। ঝড়ের বেগে গাড়ি চালানো তার অভ্যাস। আর এভাবে সে তার প্রস্ফুটিত পৌরুষ জানান দিতে সচেষ্ট থাকে। অবশ্য এজন্য তার পিতার বিপুল বিত্ত-বৈভব ভূমিকা রেখেছে। যে নতুন স্পোর্টস কারটি সে এখন চালাচ্ছে, সেটি পিতার কাছ থেকে পাওয়া তার বিবাহের উপহার। গাড়ির চাকা ঘুরতে থাকে আর ভ্রমণের পথ যতই দীর্ঘ হয়, বিলি সানচেজের চেতনা থেকে ক্লামিত্মর ছায়া উড়ে যায়। চারদিকে ঘনায়মান দুর্যোগ। কিন্তু সে মনস্থির করে ফেলেছে। একটানা চালিয়ে বর্দ্যোতে গিয়ে থামবে।
মাদ্রিদ থেকে বিরামহীন দীর্ঘ ভ্রমণ। সঙ্গে হাড়-কাঁপানো শীত। নীনা দেকোন্তে কিছুটা ক্লান্ত। হাতের আঙুল থেকে বিন্দু বিন্দু রক্ত পড়ছে। ফলে একটা রুমাল শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে বিলি সানচেজ। মসৃণ মহাসড়কে ধাবমান গাড়ি। মৃদু দুলুনিতে একসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছে নীনা। আর একাগ্রচিত্তে গাড়ি চালাচ্ছে বিলি। মাঝরাতের কিছু পরে তুষারপাত বন্ধ হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে শীতল হাওয়াও উধাও। নিরেট কালো আকাশে অসংখ্য তারা ঝলমল করছে। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে নিমগ্ন বিলি সানচেজ। কখন বর্দ্যো ফেলে এসেছে, হয়তো খেয়ালই করেনি। নীনার ঘুমন্ত মুখের দিকে একঝলক তাকাল সে। ঠোঁটের কিনারে একটুকরো হাসির রেখা ফুটে উঠল। মনে মনে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। প্যারিস না পৌঁছানো পর্যন্ত যাত্রাবিরতি করবে না। অবশ্য গাড়িতে জ্বালানি নেওয়ার প্রয়োজনে স্বল্পসময়ের জন্য একবার থামতেই হলো। মহাসড়কের বিভাজন রেখার বিলীয়মান বিন্দুতে চোখ রেখে গাড়ি চালাচ্ছিল বিলি সানচেজ। পাশে ঘুমন্ত নীনা দেকোন্তে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু তাতে লেগে আছে কিঞ্চিৎ অনিশ্চয়তার ছোঁয়া।নীনা দেকোন্তের সঙ্গে বিলি সানচেজের আনুষ্ঠানিক বৈবাহিক সম্পর্ক মাত্র দুদিনের। তারা প্রায় ভিন্ন চরিত্রের মানুষ। ফলে উভয় পরিবারের কাছে তাদের সম্ভাব্য মিলন ছিল কিছুটা বিস্ময়কর ঘটনা। কারণ বিলি সানচেজের পিতা তার অস্থির আবেগপ্রবণ উড়নচ-ী ছেলেকে ভালো করেই চেনেন। এক সন্ধ্যায় পিতার কাছে এসে বিলি তার বিয়ের সিদ্ধান্তের কথা জানাল। তিনি অবাক হয়ে তার মুখের দিকের তাকিয়ে ছিলেন। অন্যদিকে নীনার মা-বাবা চরম আতঙ্কে হতবিহবল হয়ে একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। নীনা দেকোন্তে একেবারেই অন্তর্মুখী একটি মেয়ে। মেয়ের এমন ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তা পিতা-মাতা আগে কখনো দেখেননি। অবশ্য এ বিয়ের পেছনে অন্তর্নিহিত কিছু কারণ ছিল। নীনা ও বিলির একান্ত ঘনিষ্ঠ দু-একজন ছাড়া অন্যরা তা জানত না। একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনার রেশ ধরে উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার অনধিক তিন মাস আগে তাদের প্রথম দেখা। ক্যারিবিয়ানের কোনো এক সোনালি সৈকতে তখন পড়ন্ত বিকেল। নীনা দেকোন্তে আর তার তরুণী বান্ধবীরা সবেমাত্র সমুদ্রস্নান শেষ করেছে। মারবেলস্না বেথিং ক্লাবে মহিলাদের স্বতন্ত্র কক্ষ। নির্জন কক্ষক্ষ তরুণীরা স্নানের সিক্ত পোশাক পরিবর্তন করছিল। স্পর্শকাতর ওই মুহূর্তে অপ্রস্ত্তত নারীদের মাথায় হঠাৎ আকাশ ভেঙে পড়ল। বিলি সানচেজ আর তরুণ সাঙাতরা একযোগে হামলা চালিয়েছে। সুচিক্কণ স্বাস্থ্যের অধিকারী নীনা দেকোন্তের বয়স ১৮ বছরের বেশি নয়। সুইজারল্যান্ডের সেইন্ট বেলিজ বোর্ডিং স্কুলের উজ্জ্বল ছাত্রী। স্কুলের সাংবাৎসরিক ছুটিতে সম্প্রতি দেশে ফিরেছে সে। হিস্প্যানিসহ চারটি ভাষায় অবলীলায় কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করেছে। আর স্যাক্সোফোন বাজানোর প্রতিভা তো রয়েছেই। নীনা দেকোন্তে সংক্ষিপ্ত স্নানের পোশাকটি সবেমাত্র খুলে রেখেছিল। তারপর একটা তোয়ালে হাতে তুলে নিয়েছে। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো পাশের কক্ষ থেকে বিপন্ন নারীকণ্ঠের আর্তচিৎকার ভেসে এলো। সে সঙ্গে তরুণ পুরুষকণ্ঠের জলদস্যুসুলভ নাটকীয় অট্টহাসির শব্দ। তোয়ালে হাতে নীনা দেকোন্তে থমকে দাঁড়াল। সে বুঝতে পারছিল না বাইরে কী ঘটছে। এই হট্টগোলের মাঝে হঠাৎ তার কক্ষের দরজাটি খুলে গেল সশব্দে। ক্যারিবিয়ানের একঝলক উষ্ণ বাতাস ঢুকে পড়ল অপরিসর কক্ষক্ষ। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব নীনা দেকোন্তে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘদেহী এক তরুণ আগ্রাসী ভঙ্গিতে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে। পরনে ব্রাজিলিয়ান লেপার্ডের চামড়ার নকশা করা শর্টস। ক্যারিবিয়ানের মেঘভাঙা রোদে ঝলসানো শরীর। পাতিনা করা ব্রোঞ্জের ধ্রম্নপদী ভাস্কর্যের মতো। ইচ্ছানিরপেক্ষ প্রতিক্রিয়ায় নীনা দেকোন্তের হাতের তোয়ালেটি গায়ে না জড়িয়ে খসে পড়ল মেঝেতে। ভীতিগ্রস্ত নীনা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। পরস্পরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই মুহূর্তে নীনা দেকোন্তে থমকে দাঁড়াল। কারণ ব্যাপার হচ্ছে, বিলি সানচেজ যে নীনার একেবারে অপরিচিত ছিল তা কিন্তু নয়। অনেকদিন আগে স্কুলের প্রাথমিক শ্রেণিতে একসময় তারা সহপাঠী ছিল। দীর্ঘদিনের ব্যবধানের কারণে বিলি সানচেজ নীনাকে শনাক্ত করতে পারেনি। মুহূর্তের মধ্যে নীনা দেকোন্তের স্থবির ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। ভেতরের উৎকণ্ঠা গোপন করে তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল তাচ্ছিল্যের রেখা। বিলির দিকে তাকিয়ে বলল সে, ‘তোমার উদ্দেশ্য আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমাদের মতো দুর্বল ছোকরাদের সম্পর্কে আমার ঢের ধারণা আছে।’ বিলি সানচেজ থমকে দাঁড়াল। নীনা দেকোন্তে বলছে, ‘এই ছেলে, শোনো। আমাকে তৃপ্ত করার ক্ষমতা যে তোমার নেই তা কি তুমি বুঝতে পারছ?’ নীনার তাৎক্ষণিক বানানো এই অবিশ্বাস্য বিবৃতিতে হতভম্ব বিলি একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। বিশেষ করে পৌরুষ নিয়ে অপ্রত্যাশিত কটাক্ষ তার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিলো। মুহূর্তে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল বিলি সানচেজ। ক্ষিপ্ত হয়ে কক্ষের ধাতব দরজায় ঘুসি মেরে বসল বেশ জোরে। ফলাফল হলো এই, তার হাতের বেশ কয়েকটি হাড় গেল মচকে। হাত কেটে একটা রক্তাক্ত পরিস্থিতি তৈরি হলো। এই আকস্মিক দুর্ঘটনার খানিক পরে বিলি সানচেজকে নেওয়া হয়েছিল হাসপাতালে। বিলির এ-অবস্থার জন্য নীনা কিছুটা অনুতপ্ত বোধ করছিল। ফলে তার পাশে থেকে তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করল আন্তরিকভাবে। বন্ধু-বান্ধবরা মুখ টিপে হাসাহাসি করল। কিন্তু এই নাটকীয়তার ভেতর দিয়ে কখন যে অজান্তে নীনা দেকোন্তে আর বিলি সানচেজ পরস্পরের প্রেমে পড়ে গেল।
বিলি সানচেজ হাসপাতাল থেকে ফেরার পরও নীনা দেকোন্তের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রইল। তাদের ঘনিষ্ঠতাকে নিকটজন দেখল বাঁকা দৃষ্টিতে। তবে অনেকেই তাদের এই সম্পর্ককে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেনি। ক্যারিবিয়ানে অমিত্মম গ্রীষ্মের বিকেলগুলো ছিল বেশ অস্বসিত্মকর। এ-সময়ে প্রেমিক যুগল নীনাদের সমুদ্র তীরবর্তী বাড়ির ছাদের ঘরে কাটাত। খোলা ছাদটি ছিল চতুষ্কোণ নকশা কাটা। ছাদের কোনায় বসে নীনা দেকোন্তে তার স্যাক্সোফোনে কোনো সর্বাধুনিক সুর তুলত। সম্মুখে আরাম-কেদারায় গা এলিয়ে বিলি সানচেজ। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত নীনার দিকে। নীনা দেকোন্তের পারিবারিক বাড়িটি ছিল ম্যাংগা প্রদেশের একটি সুপ্রাচীন অট্টালিকা। তবে এখনকার মানুষের কাছে এটি একটি কদাকার স্থাপত্যকর্ম। ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি নীনাদের পাঁচ পুরুষের বসতবাড়ি। তার পূর্বপুরুষরা প্রত্যেকেই ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। বাড়ির সম্মুখভাগে বিশাল প্রাঙ্গণ। সেখানে কলা, পেয়ারা, আম প্রভৃতি ফলবান বৃক্ষের বাগান। বাগানের এক প্রান্তে নাম-নিশানাহীন ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের বেশ কয়েকটি পুরনো কবর। অট্টালিকার ছাদটি বিকেলের শীতল হাওয়া উপভোগ করার জন্য একটি উৎকৃষ্ট স্থান। বাড়িতে থাকলে নীনা দেকোন্তে অধিকাংশ সময় এখানেই কাটাত। সঙ্গে তার নিত্যসঙ্গী স্যাক্সোফোন। একদিকে সমুদ্রের ভেঙেপড়া ঢেউয়ের তীব্র গর্জন। অন্যদিকে স্যাক্সোফোনের তীক্ষন শব্দ। বাড়ির প্রবীণ সদস্যরা এই অদ্ভুত সংগীতের ব্যাপারে বিরাগ গোপন করত না। তাদের বয়ানে স্যাক্সোফোনের কর্ণবিদারী শব্দ এই ঐতিহাসিক বাড়ির সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। নীনা দেকোন্তের বুড়ি দাদিমা কানে হাত চেপে বিড়বিড় করতেন, ‘কী বিদ্ঘুটে শব্দরে বাবা!’ নীনার মায়ের আপত্তি অবশ্য এক ভিন্ন কারণে। ব্যাপার হচ্ছে, স্যাক্সোফোন বাজানোর সময় নীনা দেকোন্তে গভীর আবেগে তার পদ যুগলের এক বিশেষ ভঙ্গিমা তৈরি করত। এতে তার অনাবৃত মসৃণ ঊরুসন্ধিতে এক অপার্থিব কামনামদির দৈহিক ছন্দের সৃষ্টি হতো। নীনার মা তখন যারপরনাই বিরক্ত হয়ে চাপা গলায় বলতেন, ‘তুমি কী ছাইপাশ বাজাচ্ছ তাতে আমার কোনো আগ্রহ নেই। দয়া করে বাজানোর সময় পা দুটি গুটিয়ে রাখবে!’ কিন্তু নীনা দেকোন্তের মায়ের এই আশা ছিল নিতান্তই দুরাশা। কারণ তা অনিবার্যভাবে হওয়ার ছিল না। এ ছিল উত্তাল সমুদ্রে ছুটে চলা জাহাজের সুতীব্র বাঁশির মতো। যে-জাহাজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে অজানা বন্দরের দিকে ছুটে চলেছে।
বস্ত্তত নীনা দেকোন্তে হাসপাতালে এক ভিন্ন বিলি সানচেজকে আবিষ্কার করেছিল। বিলির অবয়বিক বৈশিষ্ট্যে ছিল এক সুকঠিন খোলস। অবাকবিস্ময়ে নীনা ভেতরে এক স্নেহবঞ্চিত নিঃসঙ্গ বালককে দেখতে পেল। বিলি সানচেজের কাছে জগৎ এক বন্ধনহীন চারণক্ষেত্র। ফলে নীনা দেকোন্তের ছায়াময় সুশীতল উপস্থিতি তার কাছে ছিল অজানা বিস্ময়ে ভরা। জৈবিক কামনার শারীরিক উত্তেজনা সে অনুভব করেছে। কিন্তু তার ভেতরে যে অপার্থিব কোমলতার ছোঁয়া আছে তা সে কল্পনাও করেনি।
অঝোরধারায় বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টিতে অবগাহন করা নীনা দেকোন্তের পূর্বপুরুষদের ঐতিহাসিক অট্টালিকা নিঝুম। ইতিহাসের সাক্ষী কক্ষগুলোর দেয়ালে ঝুলছে নানা রকমের তৈলচিত্র। সৈনিকের পোশাক-পরিহিত নীনার পূর্বপুরুষদের গুরুগম্ভীর প্রতিকৃতি। প্রাচীন মানুষগুলোর অশরীরী উপস্থিতিকে উপেক্ষা করে আদিম বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল নীনা দেকোন্তে আর বিলি সানচেজ। খোলা জানালা দিয়ে সাগরের লোনা গন্ধমাখা মাতাল হাওয়া বইছে। আর অজানা সমুদ্রমন্থনে মত্ত হয়ে উঠেছিল একজোড়া মানব-মানবী। অট্টালিকার প্রাঙ্গণে ক্লামিত্মহীন অবিরাম ডেকে চলেছে বৃষ্টিসিক্ত একজোড়া ব্যাঙ। গাছের তলায় নামহীন কবরের ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের ওপরে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। নীনা দেকোন্তের মা আর দাদিমা একসময় অবাকবিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন, প্রাচীন বাড়িটা কেমন নিশ্চুপ-নিঝুম হয়ে গেছে। কারণ স্যাক্সোফোনের কর্ণবিদারী শব্দ এখন থেমে গেছে। পাকা পেয়ারার গন্ধমাখা বৃষ্টির শব্দ ভেসে আসছে অবিরাম। অতঃপর নীনা দেকোন্তে আর বিলি সানচেজের পরিবারের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভরা একটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। তারপর নাটকীয় বৈবাহিক অনুষ্ঠানের মাত্র ৩৬ ঘণ্টা আগে নীনা ও বিলি সবিস্ময়ে অবগত হলো যে, নীনা দেকোন্তে অমত্মঃসত্ত্বা। অতএব মধুচন্দ্রিমায় প্যারিসের পথে মাদ্রিদ বিমানবন্দরে অবতরণের পর নবদম্পতির অবয়বিক বৈশিষ্ট্যে ফুটে উঠেছিল একজোড়া পরিতৃপ্ত প্রেমিক যুগলের।
নবদম্পতিকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে তাদের দেশের রাষ্ট্রদূত স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী এবং দূতাবাসের অধিকাংশ কর্মকর্তাও সেখানে হাজির। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রদূত নীনা দেকোন্তে এবং বিলি সানচেজের পারিবারিক বন্ধু। সহাস্যে রাষ্ট্রদূত উপস্থিত সবার জ্ঞাতার্থে জানালেন যে, নীনার জন্মের সময় তিনি হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী নবদম্পতিকে স্বাগত জানালেন আকর্ণবিসত্মৃত হাসি মেখে। তারপর তাজা লাল গোলাপের বড় একটা তোড়া এগিয়ে ধরলেন নীনা দেকোন্তের দিকে। রক্তের মতো উজ্জ্বল গোলাপের পাপড়িগুলো মৃদু আলো ছড়াচ্ছিল। নীনা উভয়ের গালে হালকা চুমু খেল ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি মেখে। প্রকাশ্যে নববধূর এই পোশাকি ভূমিকায় সে স্বসিত্মবোধ করছিল না। ফলে মুহূর্তের অসতর্কতায় গোলাপের তীক্ষন কাঁটার খোঁচা লেগে গেল হাতের আঙুলে। তীব্র ব্যথায় নীনা দেকোন্তে অস্ফুষ্ট শব্দ করে উঠল। তখন সবাই প্রায় ঘিরে ধরল উৎকণ্ঠিত হয়ে। ব্যাকুলভাবে জানতে চাইল খুব লেগেছে কিনা। নীনা মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল কিছুটা লজ্জিত হয়ে। তারপর আদুরে গলায় বলল, ‘না না, ও কিছু হয়নি! আসলে আমি ইচ্ছা করেই করেছি। না হলে তোমরা আমার ওয়েডিং রিংটা কিন্তু কেউ দেখছ না!’ তখন সবাই অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে ঝুঁকে পড়ল নীনা দেকোন্তের হাতের আংটির দিকে। তারপর আংটির সৌন্দর্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে লাগল।
নীনা দেকোন্তেকে নিয়ে এই ব্যস্ততার মধ্যে রাষ্ট্রদূত বিলি সানচেজকে ডেকে নিয়ে গেলেন একপাশে। তারপর বিস্মিত বিলির হাতে একটা সোনালি রঙের চাবির রিং ধরিয়ে দিলেন। রাষ্ট্রদূত মৃদু হেসে হাতের ইশারায় তার দৃষ্টিআকর্ষণ করলেন বিমানবন্দরের নির্গমন পথের দিকে। গাড়ি-বারান্দায় ঝকঝকে নতুন একটি স্পোর্টস কার অপেক্ষমাণ। বিলির বিবাহ উপলক্ষে তার পিতার চমক লাগানো উপহার। মোহাবিষ্ট বিলি সানচেজ প্রায় নিঃশব্দ পদক্ষিপে এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। গাড়িটি ছিল সর্বাধুনিক মডেলের বেন্টলি কন্ভার্টিবল স্পোর্টস কার। একটা সোনালি রিবন দিয়ে সুন্দর করে মোড়ানো। বিলি রিবনটা খুলে ফেলল একটানে। তারপর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। উপস্থিত সবাই উন্মুক্ত স্থানে বরফ-শীতল বাতাস উপেক্ষা করে উপভোগ করছিল তার এই শিশুসুলভ আগ্রহ। বিলি এবং গাড়িবিষয়ক এই ব্যস্ততার মধ্যে নীনা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল একপাশে। কারণ গোলাপের কাঁটার খোঁচা লাগা আঙুলটা ব্যথায় চিনচিন করছে তার। আর আহত স্থান থেকে বিন্দু বিন্দু রক্ত ঝরছে।
বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে নবদম্পতিকে নিয়ে গাড়িবহর যাত্রা শুরু করল শহরের দিকে। বিলি সানচেজ গাড়ি চালাচ্ছিল। রাষ্ট্রদূত পাশের আসনে। নীনা দেকোন্তে আর রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী পেছনের আসনে বসে আলাপ করছিল মৃদুস্বরে। রাষ্ট্রদূত সাগ্রহে শহরের ঐতিহাসিক স্থানের পরিচিতিমূলক ধারাবর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। বিলি সানচেজ নিশ্চুপ। কোনো কথা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছে কিনা সন্দেহ। কারণ সদ্যপ্রাপ্ত গাড়িতে মোহাবিষ্ট হয়ে সে গাড়ি চালাচ্ছিল একাগ্রচিত্তে। মাদ্রিদ শহরের অভিজাত স্থানে রাষ্ট্রদূতের অট্টালিকাসদৃশ বাসভবন। নবদম্পতির সম্মানে নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল একটি সংক্ষিপ্ত ভোজসভার। তবে নীনা দেকোন্তে ও বিলি সেখানে উপস্থিত ছিল স্বল্পসময়ের জন্য। ভোজসভার আনুষ্ঠানিকতা দ্রম্নত শেষ করে তারা বিদায় নিল সবার কাছ থেকে। তারপর স্পেন সীমান্তের দিকে উড়ন্ত গতিতে অভিযাত্রা। নবদম্পতির গন্তব্যস্থল আনন্দনগরী প্যারিস।
মাদ্রিদ থেকে যাত্রা শুরুর পর হঠাৎ আকাশ অন্ধকার করে তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে। গোটা শহরের ওপর সাদা বরফের চাদর। ধূসর বর্ণের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলছে দিনের বেলায়। মহাসড়কের দুপাশে পত্রহীন নিষ্প্রাণ বৃক্ষের সারি। বিলি সানচেজ গাড়ি চালাচ্ছিল শিস বাজিয়ে। ভ্রমণক্লান্ত নীনা দেকোন্তে নিশ্চুপ। একাকিত্বের যন্ত্রণা তাকে বিদ্ধ করছিল কোনো অজ্ঞাত কারণে। নিজ শহরের উষ্ণতা থেকে অন্য এক শহরের তুষারঢাকা প্রান্তর। অজানা কোনো আশঙ্কা তার চেতনায় ছায়া বিসত্মার করেছে। কারণ নীনা দেকোন্তে এখন কিছুটা শঙ্কিত। তার আঙুলের বিন্দু বিন্দু রক্ত পড়া বন্ধ হওয়ার লক্ষণ নেই। ব্যাপারটা বিলি সানচেজকে বলল সে। উদ্বিগ্ন বিলি বলল, সামনেই কোনো ফার্মেসিতে সে গাড়ি থামাবে।
গোধূলির শেষ আলো মিলিয়ে গিয়ে এখন অন্ধকার নেমেছে। নীনা দেকোন্তে আর বিলি সানচেজ স্পেন সীমান্ত অতিক্রম করেছে অনেক আগে। বিলি একাগ্রচিত্তে গাড়ি চালাচ্ছিল। নীনা ঘুমিয়ে। শীতল বাতাসের ঝাপটায় তার ঘুম ভেঙে গেল। তন্দ্রাচ্ছন্ন নীনা দেকোন্তে। তার মনে হলো নীলাভ জলের ভেতরে সে সাঁতার কাটছে। ধাতস্থ হতে কিছু সময় লাগল তার। গাড়ির ড্যাশবোর্ডে আলোকিত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, তিনটে বাজে। অর্থাৎ মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে অনেক আগে। একটা হিসাব কষে দেখল মনে মনে। বর্দ্যো নিশ্চয় পেছনে ফেলে এসেছে। সামনে অরলিয়েন্স, তারপরই প্যারিস। মহাসড়কের দুপাশে নিশ্চল পাইন বনের সারি। দূরে পাহাড়ের চূড়ায় প্রাচীন প্রাসাদের ভৌতিক ছায়া। নীনা দেকোন্তে আড়মোড়া ভেঙে গাড়ির আসনে সোজা হয়ে বসল। তারপর বিলির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ‘তুমি একটা বর্বর!’ বিলি সানচেজ অবাক হয়ে বলল, ‘আবার কী হলো!’ নীনা চেঁচিয়ে বলছে, ‘এগারো ঘণ্টা ধরে গাড়ি চালাচ্ছ। খেয়াল আছে? পেটে দানাপানি পড়েনি!’ নীনার দিকে তাকিয়ে বিলি হাসল। তারপর খোশমেজাজে বলল, ‘খিদে পাওয়ার প্রশ্নেই ওঠে না। রাষ্ট্রদূতের ওই ভূরিভোজের পর এখনো আমার খিদেই পায়নি।’ নীনা বুঝতে পারল সকালের আগে প্যারিস পৌঁছানো তার উদ্দেশ্য।
অরলিয়ন্সে পৌঁছার আগে কুয়াশার পর্দা সরে গেল আকাশ থেকে। পাকা শস্যের মাঠগুলো ঝলমল করছে চাঁদের আলোতে। গাড়ির গতি আরো বাড়াতে ইচ্ছা করছিল বিলির; কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ মহাসড়ক এখন আর নির্জন নয়। রাসত্মায় ছোট-বড় অনেক ট্রাক। ভোরের আগে ট্রাকগুলো প্যারিসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ধীরগতিতে। নীনা ভাবছিল বিলির কিছুটা বিশ্রাম দরকার। সে একনাগাড়ে গাড়ি চালিয়ে আসছে। সে নিজে গাড়ি চালাতে পারত; কিন্তু বলতে সাহস করল না। কারণ নীনা জানে, বিলি এসব একেবারে পছন্দ করে না। অবশ্য পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে নীনা এখন বেশ সুস্থবোধ করছিল। হঠাৎ কী মনে পড়ায় সে শিহরণ অনুভব করল। অনেকদিন পর একটি সম্পূর্ণ রজনী তারা একসঙ্গে বিছানায় কাটায়নি। বিলিকে সজাগ রাখার ছলে ব্যাপারটা বলল তাকে। অবাক বিস্ময়ে চোখ বড় করে বিলি বলল, ‘কী আশ্চর্য! এ মুহূর্তে আমিও ওই কথাই ভাবছিলাম!’ তারপর মৃদু হেসে বলল, ‘এক কাজ করা যায়। এখানে শহরতলিতে ভালো হোটেল আছে। তোমার আপত্তি না থাকলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া যায়।’ তার কথায় নীনা কৃত্রিম ভ্রম্ন কুঞ্চিত করে উত্তর দিলো, ‘উহু কোনো উপায় নেই জনাব। প্যারিস না পৌঁছানো পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে।’ হতাশামিশ্রিত অভিমানের সুরে বিলি বলল, ‘এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে।’ তার কথার ভঙ্গিমায় নীনা একচোট হেসে উত্তর দিলো, ‘এখন আমরা বিবাহিত দম্পতি কিনা!’
সূর্যোদয়ের আগে আকাশে হালকা গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়েছে। মহাসড়কের কিনারে একটা রেসেত্মারাঁয় গাড়ি থামাল বিলি সানচেজ। বিনিদ্র রজনীর ক্লামিত্ম কাটাতে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলো তারা। তারপর সংক্ষিপ্ত প্রাতরাশ সেরে নিল। ওয়াশরুমে নীনা দেকোন্তে সাবান দিয়ে রক্তমাখা হাতটা পরিষ্কার করল ভালো করে। রক্ত পড়া বন্ধ হলেও অস্বসিত্মকর ব্যথায় হাতটা অবশ হয়ে আছে। কিন্তু যাত্রা শুরুর কিছু পরই আবার বিন্দু বিন্দু রক্ত ঝরতে লাগল। রক্তের লাল দাগ লেগে গেল নীনা দেকোন্তের কালো ফার কোটে। নিরুপায় নীনা রক্তাক্ত হাতটা ঝুলিয়ে রাখল গাড়ির কিনারে। তার চেহারায় বিষণ্ণতার ছায়া পড়েছে। হঠাৎ কী কারণে নীনা দেকোন্তের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিছুটা উত্তেজিত ভঙ্গিতে বিলি সানচেজের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল সে, ‘বিলি, আমাদের যদি কেউ গোপনে অনুসরণ করতে চায়, তাহলে সহজেই খুঁজে পাবে!’ বুঝতে না পেরে নীনার মুখের দিকে তাকাল বিলি সানচেজ। নীনা দেকোন্তে সুরেলা কণ্ঠে বলছিল, ‘বরফের ওপরে রক্তের সরু রেখা। বিলি একবার ভাবো তো সাদা বরফের ওপরে লাল রক্তের রেখা, মাদ্রিদ থেকে প্যারিস পর্যন্ত! দারুণ একটা গানের কলি হবে, তাই না?’ নীনার মুখের দিকে সপ্রেম দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু হাসল বিলি সানচেজ। অবশ্য প্যারিসের সন্নিকটে পৌঁছে তাদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। কারণ নীনা দেকোন্তের আহত আঙুল থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে অবিরল ধারায়। রুমাল দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছিল না। শঙ্কিত এবং উদ্ভ্রান্ত বিলি সানচেজ তখন হন্যে হয়ে হাসপাতাল খুঁজছে।
অ্যাভিনিউ দ্য লেকলের্কে এসে তারা পড়ে গেল সকালের ট্রাফিক জ্যামে। বেপরোয়া চরিত্রের বিলি সানচেজের চেহারায় ফুটে উঠেছে অসহায় ভাব। চারদিকে নানা রকমের গাড়ির হর্নের শব্দ। এর মধ্যে চালকরা পরস্পরের দিকে তোপ দেগে চলেছে। সে এক বিশ্রী অবস্থা! এক পর্যায়ে বিলি সানচেজ মেজাজ হারিয়ে ফেলল! ঝাঁপিয়ে পড়ল এক চালকের ওপর। নীনা দেকোন্তে গাড়ি থেকে নেমে জাপটে ধরল তাকে। তারপর এক প্রকার টেনে নিয়ে এলো গাড়িতে। নীনা বিলিকে বুঝিয়ে বলল যে, ফরাসিরা যদিও বদরাগী জাতি, তবে সাধারণত তারা প্রকাশ্যে মারামারি করে না। প্যারিসের রাসত্মাঘাট নীনা দেকোন্তের নখদর্পণে। সে বিলি সানচেজকে নির্দেশ দিতে লাগল কোন পথে যেতে হবে। যথাসম্ভব উত্তেজনা দমন করে গাড়ি চালাল বিলি। নীনার নির্দেশিত পথে যেখানে এসে থামল, সেটা একটি সুরম্য অট্টালিকাসদৃশ হাসপাতালের সিংহদরজা।
এরপর আহত নীনা দেকোন্তের দায়িতব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই গ্রহণ করল। নার্স হুইলচেয়ারে বসিয়ে নীনাকে দিয়ে গেল জরুরি বিভাগে। হতভম্ব বিলি সানচেজ নীনা দেকোন্তের বাঁ হাতটি ধরে ছিল শক্ত করে। ওই হাতে নীনার বিয়ের আংটিটা বিদ্যুতের আলোতে উজ্জ্বল রং ছড়াচ্ছিল। জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত ডাক্তার সরাসরি এলো নীনা দেকোন্তের কাছে। তরুণ ডাক্তারটি ছিল কালো-চামড়ার আফ্রিকান। ডাক্তার আহত আঙুলটি পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। নীনা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল বিলির দিকে। তারপর কৃত্রিম অভিমানের স্বরে হিস্প্যানি ভাষায় বলল, ‘বিলি, ভয় পেয়ো না। এই জংলি কী আর করবে? হাতটা কেটে নিয়ে খেয়ে ফেলবে হয়তো। এর বেশি কিছু না।’ ডাক্তার নির্লিপ্তভাবে পর্যবেক্ষণ শেষ করল। উপস্থিত নার্সকে নির্দেশ দিলো নীনা দেকোন্তের চিকিৎসা সংক্রান্ত অতীত তথ্যাবলি লিপিবদ্ধ করতে। তারপর নীনা ও বিলিকে অবাক করে দিয়ে অনভ্যস্ত উচ্চারণে হিস্প্যানি ভাষায় বলল, ‘এই জংলি ক্ষুধার্ত থাকতে রাজি আছে। কিন্তু এমন সুন্দর হাত সে কখনো কাটবে না।’ ডাক্তারের কথায় তারা একেবারে অপ্রস্ত্তত হয়ে গেল। ডাক্তার শুধু মৃদু হাসল। তারপর নার্সকে বলল নীনা দেকোন্তেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বিলি নীনার হাত ধরে ছিল। তাতে অবশ্য নীনাকে আশ্বস্ত করার চেয়ে নিজের অসহায়ত্বই ফুটে উঠেছিল বেশি। বিলি সানচেজ হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ মনে করে ডাক্তারকে আগ্রহভরে বলল যে, তার স্ত্রী অমত্মঃসত্ত্বা। প্রত্যুত্তরে ডাক্তার অবশ্য কিছু বলল না। বিলি নীনার হাতটা আঁকড়ে ধরে ছিল। ডাক্তার হাতটা ছাড়িয়ে নিল আলতো করে। তারপর বিলি সানচেজকে বলল যে, রোগীকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। স্ট্রেচারে শায়িত নীনা দেকোন্তে, আশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল অসহায় বিলি সানচেজের দিকে। তার মুখের কমনীয়তা তখনো অসুস্থতার ছায়ায় ঢাকা পড়েনি। মানুষের কোলাহলে পূর্ণ হাসপাতালের লম্বা বারান্দা। স্ট্রেচার ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল বারান্দার শেষ প্রান্তে। বিলি সানচেজ পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। কতক্ষণ সেখানে ছিল তা সে বলতে পারে না। একসময় নিজের অজান্তে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো বিলি সানচেজ। তখন অন্ধকার নেমেছে। প্যারিসের রাজপথে আলো জ্বলছিল। আকাশ থেকে ঝিরিঝিরি হালকা বৃষ্টি পড়ছে। বিলি সব চিন্তাশক্তি বোধহয় হারিয়ে ফেলেছে। এখন সে কোথায় যাবে বা কী তার কর্তব্য। মনে হলো পৃথিবীর সব দায়িত্বের বোঝা তার ঘাড়ে চেপে বসেছে।
নীনা দেকোন্তেকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল ৭ জানুয়ারি। পরে জরুরি বিভাগের রোগীদের তালিকা দেখে তা জানা গিয়েছিল। ওইদিকে হতবিহবল বিলি সানচেজ। বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছিল হাসপাতালের সামনে রাখা গাড়িতে। পরদিন সকালে হাসপাতালের কাছে একটা ক্যাফেতে গেল সে। হিস্প্যানিমিশ্রিত ভাঙা ভাঙা ফরাসিতে কথা বলছিল বিলি। কোনো রকমে ছয়টি সেদ্ধ ডিম আর দু-কাপ কফি দিতে বলল তাকে। মাদ্রিদ থেকে যাত্রা শুরুর পর পূর্ণ আহার সে করেনি। দ্রম্নত আহার শেষ করে হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়াল। ভাষা ও পরিবেশের বিচ্ছিন্নতায় বেশ অসহায় বোধ করছিল বিলি সানচেজ। কেউ একজন তাকে যেতে বলল হাসপাতালের সদর দরজায়। সেখানে কর্মরত ব্যক্তিকে সে তার সমস্যাটা বোঝাল অনেক কষ্টে। তাকে যেতে বলা হলো জরুরি বিভাগে। অবশেষে বিলি সানচেজ অবহিত হলো যে, নীনা দেকোন্তেকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সে আরো জানতে পারল, নির্ধারিত দিন ছাড়া রোগীর সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্ভব নয়। তাকে পরবর্তী মঙ্গলবার আসতে বলা হলো। বিলি সানচেজের হঠাৎ মনে পড়ল তরুণ আফ্রিকান ডাক্তারটির কথা। কিন্তু তার বিকৃত উচ্চারণ এবং বিক্ষিপ্ত বর্ণনায় কেউ ওই ডাক্তারকে শনাক্ত করতে পারল না।
যা-হোক নীনা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে জেনে বিলি কিছুটা স্বসিত্ম বোধ করছিল। এখন তার চিন্তা একটা আবাসস্থল খুঁজে বের করা। এজন্য সে তার গাড়ির কাছে ফিরে এলো। বিলি সানচেজ দেখল সেখানে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন পুলিশ। তাকে দু-বস্নক পর গাড়ি পার্ক করার নির্দেশ দিলো সে। বিলির কাছে এ এক অবিশ্বাস্য পরিস্থিতি। কিন্তু বিনাবাক্যে পুলিশের নির্দেশ পালন করল সে। তারপর হাসপাতালের যথাসম্ভব সন্নিকটে একটা হোটেলের সন্ধান করতে লাগল। হাসপাতাল থেকে দশ মিনিটের দূরত্বে একটা হোটেল পাওয়া গেল। সরু গলির ভেতরে ছোট্ট একটি হোটেল। নাম হোটেল নিকোলে : একতারকা হোটেল। এই হোটেলের সুযোগ-সুবিধা বিলি সানচেজের জীবনযাপনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মূলত তার সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে মোটেই খাপ খায় না। নয়তলার চিলেকোঠায় সংযুক্ত দুই বিছানার একটি কক্ষ। অদ্ভুত ক্রিকোণাকৃতি ওই কক্ষক্ষ একটি মাত্র জানালা। অতিপ্রয়োজনীয় কিছু আসবাবপত্রে কক্ষটি একেবারে ঠাসা। ক্লান্ত বিলি সানচেজ সঙ্গের মালপত্র রাখল একপাশে। তারপর সে আবিষ্কার করল, কক্ষক্ষ অবস্থানের আদর্শ উপায় হচ্ছে সটান বিছানায় শুয়ে পড়া। একাকিত্বের যন্ত্রণা তার চেতনাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করেছিল। সে কল্পনা করতে পারছিল না নীনার সাহায্য ছাড়া আর একটা দিন কীভাবে কাটাবে। বুধবার অপরাহ্ণে প্যারিসের এক অদ্ভুত হোটেল কক্ষক্ষ বিলি সানচেজ। নীনা দেকোন্তের চিন্তায় একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল সে। তারপর কখন বিছানায় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
ঘুম ভাঙার পর বিলি সানচেজ প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিল না। সে কোথায়? এখন সকাল না বিকেল? আজ সপ্তাহের কোনদিন! কক্ষের একমাত্র জানালায় নোংরা পর্দা ঝুলছে। ওপাশে ঝাপসা আলো। মনে হয় সকাল হচ্ছে। ধাতস্থ হতে কিছু সময় লাগল তার। তারপর তড়িৎবেগে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বিলি সানচেজ। প্রাতঃকালীন প্রয়োজনীয় সব কাজ শেষ করল যথাসম্ভব দ্রম্নত। তারপর বেরিয়ে এলো হোটেল থেকে। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। গাছের পাতা থেকে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়ছিল টুপটাপ করে। রাসত্মায় এখানে-ওখানে জল জমে আছে। হোটেলের কাছে তার একমাত্র পরিচিত ক্যাফেতে এসে বসল সে। সেখানে প্রাতরাশ করার সময় বুঝতে পারল আজ বৃহস্পতিবার। যথাসম্ভব দ্রম্নত আহার শেষ করে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এলো বিলি সানচেজ। তারপর সরাসরি চলে এলো হাসপাতালের ফটকের সামনে। হাসপাতালের দু-একটি কক্ষক্ষ তখনো আলো জ্বলছে। সাদা ইউনিফর্ম পরিহিত নার্সরা কর্তব্যকর্মে ব্যস্ত। অন্যমনস্কভাবে ওইদিকে তাকিয়ে রইল বিলি। আসলে সে আশা করছিল আফ্রিকান তরুণ সেই ডাক্তারটির যদি দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু অপরাহ্ণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকেও হতাশ হতে হলো তাকে। ঠান্ডায় হাত-পায়ে প্রায় খিল ধরে যাওয়ার অবস্থা। সে আবার আগের ওই ক্যাফেতে এসে বসল। দুটো সেদ্ধ ডিম আর এক কাপ গরম কফি দিতে বলল তাকে। বস্ত্তত গত আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে ওই একঘেয়ে আহার করে যাচ্ছিল বিলি সানচেজ। সন্ধের পর হোটেলে ফেরার পথে সে থমকে দাঁড়াল। অবাক হয়ে দেখল রাসত্মার পাশে তার গাড়িটা আলাদা করে রাখা হয়েছে। গাড়ির ওয়াইপারে একটি পার্কিং টিকিট লাগানো। হোটেলের ডেস্ক-ক্লার্ক ধৈর্য ধরে তাকে পার্কিংয়ের নিয়মকানুন বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু এতসব আইনকানুনে বিলি সানচেজ অভ্যস্ত নয়। তার মনোভাব আঁচ করতে পারল লোকটি। সুপরামর্শ দেওয়ার ভঙ্গিতে জরিমানা পরিশোধ করে দেওয়ার জন্য বলল সে। হতবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বিলি সানচেজ।
হোটেলের শয়নকক্ষক্ষ বিলির চোখে ঘুম নেই। একাকিত্বের যন্ত্রণায় বিমর্ষ হয়ে পড়ে ছিল সে। এমনকি নীনা দেকোন্তের অসিত্মত্বও তার চেতনা থেকে হারিয়ে গেছে। মনে পড়ল তাদের শহরের কথা। এখানে রাত আর সেখানে সবে সন্ধ্যা নেমেছে। হঠাৎ বাড়ির কথা মনে পড়ল। তার পিতা কর্মস্থল থেকে ফিরে এখন সকালের কাগজ পড়ছে। বাকপটু ছলনাময়ী মায়ের কথাও মনে জেগে উঠল। বিলি সানচেজের শৈশব ছিল প্রাচুর্যময়। কিন্তু নিঃসঙ্গতায় ঢাকা। শৈশবের বিস্ময়কর কিছু অভিজ্ঞতা সে কঠোরভাবে গোপন রেখেছে। মনে পড়ল বন্ধুবান্ধবদের কথা। শহরের অভিজাত গণিকালয়ে মত্ত রজনী যাপনের স্মৃতি। কিন্তু এখন প্যারিসের এক জঘন্য হোটেলের বিষণ্ণ কক্ষক্ষ যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে। এ মুহূর্তে কী তার কর্তব্য তা বুঝে উঠতে পারছিল না বিলি সানচেজ।
শুক্রবার সকালে বিছানায় উঠে বসল বিলি। তাকে দেখাচ্ছিল এক বিধ্বস্ত মানুষের মতো। এ মুহূর্তের অর্থহীন জীবনে কিছু অর্থ যোগ করার সিদ্ধান্ত নিল সে। ত্রিকোণাকৃতি কক্ষের এক কোনায় তাদের ট্রাভেল ব্যাগগুলো রাখা ছিল। ব্যাগের চাবিগুলো নীনা দেকোন্তের ক্লাচের মধ্যে থাকায় ওগুলো এখনো খোলা হয়নি। ফলে ব্যাগের তালা ভাঙতে হলো। দ্বিপ্রহরের কিছু আগে হোটেল থেকে বের হলো বিলি সানচেজ। পোশাক পরিবর্তন করে ফ্রেশ হয়েছে সে। তার মধ্যে কিছুটা আত্মপ্রত্যয় ফিরে এসেছে। একমাত্র পরিচিত ক্যাফেতে এসে বসল বিলি। ইতোমধ্যে চালিয়ে নেওয়ার মতো কিছু শব্দ সে আয়ত্ত করেছে। অবশ্য গত তিনদিনে ক্যাফের মানুষগুলোর কাছে চেনা হয়ে গেছে সে। ফলে প্রয়োজনে যৎসামান্য সাহায্য-সহযোগিতা করছে তাকে। ক্রমান্বয়ে সার্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে ধাতস্থ হতে শুরু করেছে বিলি সানচেজ। বিফস্টেক এবং ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের জন্য বলল সে। সঙ্গে এক বোতল ওয়াইন দিতে বলল তাকে। আস্থার অনুভূতি নিয়ে আহার শেষ করল বিলি। তারপর ধীর পদক্ষিপে হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়াল। তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা – কীভাবে নীনা দেকোন্তের সঙ্গে দেখা করা যায়। আফ্রিকান ওই তরুণ ডাক্তারটির কথা শুধু মনে পড়ছে। একসময় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে এসে দাঁড়াল বিলি সানচেজ। তারপর ভেতরের লম্বা বারান্দা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। বারান্দার প্রবেশপথে বিশালদেহী একজন লোক দাঁড়িয়ে। গায়ে রক্তমাখা সাদা অ্যাপ্রোন। বিলির দিকে তাকিয়ে ফরাসি ভাষায় কী যেন বলল সে। তাকে উপেক্ষা করে সামনে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল বিলি সানচেজ। লোকটি খপ করে খামচে ধরল তার বাঁ হাত। এ-ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে অনভ্যস্ত সে। ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল বিলি। শক্তপোক্ত লোকটি তাকে কাঁধে তুলে নিল এক প্যাঁচ কষে। তারপর নিয়ে এলো হাসপাতালের সদর দরজায়। রাসত্মার নোংরা কাদাপানিতে তাকে ছুড়ে ফেলে দিলো পচা আলুর বসত্মার মতো।
এই মর্মামিত্মক অভিজ্ঞতা বিলি সানচেজের মনে গভীর ছায়া ফেলল। ক্ষোভ বা হতাশার পরিবর্তে তার মধ্যে দেখা গেল এক ধরনের দৃঢ় মনোভাব। সে চিন্তা করে দেখল এ-ধরনের পরিস্থিতিতে নীনা কী করত! সে প্যারিসে তাদের দেশের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের সিদ্ধান্ত নিল। এজন্য প্রথমে হোটেলে ফিরে এলো বিলি সানচেজ। হোটেলের তত্ত্বাবধায়ক কর্মচারীটি তার দিকে তাকাল করুণার দৃষ্টিতে। অবশ্য সবকিছু শুনে বিলিকে সহায়তা করল সে। টেলিফোন-নির্দেশিকা এবং হোটেলের একটি কার্ড বের করল লোকটি। তারপর কার্ডের পেছনে দূতাবাসের টেলিফোন নাম্বার এবং ঠিকানা লিখে দিলো। নির্দিষ্ট নাম্বারে কল করার পর অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো সুরেলা মেয়েলি কণ্ঠ। ওই কণ্ঠস্বরে বিলি খুঁজে পেল ক্যারিবিয়ানের অতিপরিচিত ধ্বনি। সে সিদ্ধান্ত নিল প্রথমেই মেয়েটিকে অবাক করে দেওয়ার। এজন্য বিলি সানচেজ বক্তব্য শুরু করল তার খ্যাতিমান পিতার পরিচয় উল্লেখ করে। অবশ্য অপর প্রান্তের কণ্ঠস্বরে বিশেষ পরিবর্তন হলো না। মেয়েটি প্রায় যান্ত্রিক কণ্ঠে বলল যে, রাষ্ট্রদূত এখন জরুরি কাজে ব্যস্ত আছেন। তাছাড়া পূর্বনির্ধারিত সময় ছাড়া রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎকার সম্ভব নয়। বিস্মিত বিলি অনেক কষ্টে উষ্মা সংবরণ করল। যথাসম্ভব মার্জিত কণ্ঠে মেয়েটিকে ধন্যবাদ দিলো সমস্ত তথ্যের জন্য। আর দ্বিতীয় চিন্তা না করে একটি ট্যাক্সি ডাকল সে। তারপর সরাসরি দূতাবাসের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল।
প্যারিসের অভিজাত এলাকায় দূতাবাস ভবন। যাওয়ার পথে ক্যাম্পস এলিজিতে বৃক্ষশোভিত সুদৃশ্য মহাসড়ক। চারদিকে রোদ ঝলমল করছে। বিলির মনে হলো এই পরিবেশ ক্যারিবিয়ানের মতো উষ্ণ ও উজ্জ্বল। অবশ্য দূতাবাসের অভ্যর্থনা কক্ষের দায়িত্বরত কর্মকর্তাটি বিলির দিকে তাকিয়ে ছিল অবাক হয়ে। সম্ভবত তাকে পাগল ভেবেছিলেন। কাপড়ে নোংরা কাদা আর উদ্ভ্রান্ত চেহারা। আগন্তুকের বিষণ্ণ চেহারা দেখে অবশ্য লোকটি কিছুটা কোমল হলো। বিশেষ করে বিলি সানচেজের গায়ে সুখ্যাত ব্র্যান্ডের মূল্যবান জ্যাকেট দেখে তিনি সতর্ক হলেন। তারপর ধৈর্য ধরে তার বক্তব্য শুনলেন। সবশেষে মাথা দুলিয়ে বললেন যে, তিনি সবকিছুই বুঝতে পেরেছেন। একই সঙ্গে বিলিকে বললেন যে, তিনি দেশের প্রতিনিধি। তার দায়িত্বের একটা সীমারেখা আছে। তারপর বিলি সানচেজকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, তারা পৃথিবীর অন্যতম সভ্য একটি দেশে আছেন। এখানকার সুসভ্য নিয়মকানুনগুলো প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। তাকে মনে রাখতে বললেন যে, অসভ্য বর্বর দক্ষিণ আমেরিকানদের নিয়মকানুন এখানে অচল। যেখানে আদর্শ নিয়ম হচ্ছে কর্তব্যরত ব্যক্তিকে ঘুষ দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে কার্য সমাধা করা। বিলির হতাশ চেহারা দেখে কর্মকর্তাটি মুখ টিপে হাসল। তারপর নিচু গলায় বলল, ‘ইয়াংম্যান! মাত্র এ কদিনেই স্ত্রীর জন্য এত উতলা হওয়ার কী আছে! প্যারিস অনেক মজার শহর। এখানে উপভোগ করার অনেক কিছুই আছে।’ লোকটির বলার ভঙ্গিতে আর কথা বলার উৎসাহ পেল না বিলি সানচেজ।
ভগ্নহৃদয়ে দূতাবাস থেকে রাসত্মায় নেমে এলো বিলি। দূরে অট্টালিকার পশ্চাদপটে আইফেল টাওয়ারের চূড়া দেখা যাচ্ছে। অন্যমনস্কভাবে ওইদিকে ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগল সে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর বিলি সানচেজ আবিষ্কার করল, টাওয়ারটি ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। একসময় সে বুঝতে পারল আসলে ওটি অনেক দূরে। সিন নদীর কিনারে শান-বাঁধানো গাছের সারি। একটা গাছের তলায় বসে পড়ল সে। নদীতে নানা ধরনের জলযানের আনাগোনা। ছিপ ফেলে নিশ্চল বসে আছে এক মৎস্য শিকারি। লোকটিকে দেখে মনে হয় যেন পাথরের মূর্তি। বিলি সানচেজ শূন্য-দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নীনা দেকোন্তের কথা ভাবতে লাগল। একসময় বুঝতে পারল বসে থাকার ক্লামিত্ম তার চেতনাকে গ্রাস করেছে। এদিকে আলোর নগরীতে তখন সন্ধ্যা নেমেছে। হোটেলে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল বিলি। তারপর আতঙ্কিত হয়ে আবিষ্কার করল, হোটেলের ঠিকানা সে জানে না। তাছাড়া হাসপাতালটির নাম বা অবস্থানও তার কাছে অজ্ঞাত। হতবিহবল বিলি স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। তারপর রাসত্মার পাশে একটি ক্যাফেতে গিয়ে বসল। শুষ্ক কণ্ঠে একটি কনিয়াক দিতে বলল তাকে। ক্যাফের ভেতরে অত্যুজ্জ্বল আলো। কারণ দেয়ালে লাগানো আয়না আলো ছড়াচ্ছিল। বিলি দেখল আয়নায় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব। সেখানে নিজেকে মনে হলো ভয়ার্ত এক প্রাণীর মতো। জীবনে এই প্রথম তার মধ্যে মৃত্যুচিন্তা উদিত হলো। কম্পিত হাতে গস্নাস থেকে দুই চুমুক গলাধঃকরণ করল সে। কনিয়াকের প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা সুস্থ বোধ করল বিলি। কাফের বিল পরিশোধ করার জন্য পকেটে হাত দিয়ে চমকে উঠল সে। দেখতে পেল সেখানে দূতাবাসের ঠিকানা লেখা হোটেলের কার্ডটি রয়েছে।
এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার পর একেবারে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল বিলি সানচেজ। পরবর্তী মঙ্গলবার নীনার সঙ্গে হাসপাতালে সাক্ষাৎকারের নির্ধারিত দিন। প্রয়োজন ছাড়া হোটেল থেকে বের না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। হোটেলের নিঃসঙ্গতা অসহ্য হয়ে উঠেছিল বিলির কাছে। কিছু একটা করার জন্য নীনার ব্যাগ খুলে একটা বই বের করল। পড়ার চেষ্টা করল উলটেপালটে। তার কাছে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। কিন্তু হতাশ হতে হলো তাকে। কারণ বইগুলো হিস্প্যানি ছাড়া অন্যান্য ভাষায় লেখা। ফলে বই রেখে হোটেল কক্ষের দেয়ালের নকশা দেখতে লাগল বিলি সানচেজ। ওয়ালপেপারে ময়ূরের আকৃতি পুনরাবৃত্তি করে ডিজাইন করা হয়েছে। ময়ূরের সংখ্যা গুনে দেখার সিদ্ধান্ত নিল সে। কিন্তু গুনতে গিয়ে ময়ূরের মাঝে বারবার ভেসে উঠছিল নীনা দেকোন্তের মুখশ্রী।
সোমবার সকালে বৃষ্টি পড়ছিল ঝিরিঝিরি। নতুন আরেকটি দিন। বিলি সানচেজ বিছানায় উঠে বসল উদ্যমী মন নিয়ে। সে তার হোটেল কক্ষটি যথাসম্ভব গুছিয়ে রাখতে সচেষ্ট হলো। নীনা দেকোন্তের কোটটি ভাঁজ করে রাখা ছিল টেবিলের ওপরে। কালো ফার কোটের গায়ে রক্তের দাগ শুকিয়ে চিকচিক করছে। বিলি সানচেজ একাগ্রচিত্তে পরিষ্কার করতে লেগে গেল রক্তের দাগ। বলতে গেলে সে সারাদিন ব্যস্ত রইল এ-কাজে।
মঙ্গলবারের সকাল ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। বৃষ্টি নেই, কিন্তু বাতাসে হিমশীতল স্পর্শ। নীনা দেকোন্তের চিন্তায় বিনিন্দ্র রজনী কাটিয়েছে বিলি সানচেজ। কিন্তু প্রাতঃকালীন কর্তব্যকর্মে তার উৎসাহে কোনো ভাটা পড়েনি। একপ্রস্থ নতুন কাপড় পরিধান করেছে সে। প্রাতরাশ শেষ করল যথাসম্ভব দ্রম্নততার সঙ্গে। তারপর হাসপাতালের সদর দরজায় চলে এলো বিলি সানচেজ। অনেকদিন পর নীনা দেকোন্তের সঙ্গে দেখা হওয়ার উত্তেজনা অনুভব করছিল সে। সকাল থেকেই সাক্ষাৎপ্রার্থীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। যথাসময়ে অন্যদের সঙ্গে হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করল বিলি সানচেজ। তার ডান হাতে ভাঁজ করা নীনার কালো রঙের ফার কোটটি। বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা চতুষ্কোণ চত্বর। তারপর সরু বারান্দার দুপাশে উন্মুক্ত জানালায় মহিলা ও পুরুষ রোগীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। সেখানে হাসপাতালের নির্দিষ্ট গাউন পরে রোগীরা সাক্ষাৎপ্রার্থীদের জন্য অপেক্ষা করছে। মহিলা রোগীদের নির্ধারিত সারিতে দুবার ঘুরে এলো বিলি সানচেজ। উদ্বিগ্ন হয়ে সে আবিষ্কার করল এখানে নীনা দেকোন্তে নেই। উদ্ভ্রান্ত বিলি জানে না, নীনাকে কোথায় পাওয়া যাবে। সে একান্তভাবে আশা করছিল আফ্রিকান তরুণ ডাক্তারটির যদি দেখা পাওয়া যায়। তারপর নিজের অজান্তেই পুরুষ রোগীদের জানালায় উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল সে। হঠাৎ চমকে উঠে থমকে দাঁড়াল বিলি সানচেজ। যাকে এতক্ষণ খুঁজছিল সে তাকে সেখানে দেখতে পেল। সেই ডাক্তার রোগী দেখছিল। প্রায় পাগলের মতো বিলি ছুটে গেল সেদিকে। সামনের কয়েকজনকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ডাক্তারের সামনে এসে দাঁড়াল সে। ডাক্তার তার মুখের দিকে তাকাল বিস্মিত হয়ে। বিধ্বস্ত চেহারার বিলি সানচেজকে তিনি প্রথমে শনাক্ত করতে পারেননি। তারপর বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘তুমি এতদিন কোথায় ছিলে!’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিলি উত্তর দিলো, ‘হাসপাতালের সামনে একটা হোটেলে।’
ডাক্তার বিলি সানচেজকে হাত ধরে নিয়ে গেল তার চেম্বারে। তারপর বিলি ক্রমান্বয়ে অবহিত হলো তার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া কয়েক দিনের ঘটনা। নির্বাক বিলি সানচেজ জানতে পারল যে, জানুয়ারির ৯ তারিখ ঠিক সন্ধে সাতটা দশ মিনিটে সবকিছুর অবসান হয়েছে। নীনা দেকোন্তে নামের অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটি চিরবিদায় নিয়েছে এ-পৃথিবী থেকে। মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। ডাক্তার তাকে আরো জানাল যে, নীনার চিকিৎসা করানো হয়েছিল প্যারিসের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ডাক্তারদের দিয়ে। জ্ঞান হারানোর আগে নীনা দেকোন্তে তাদের প্যারিসের ঠিকানা দিয়েছিল। পাঁচতারকা হোটেল পস্নাজা এথেনি। সেখানে স্যুইট রিজার্ভ করা ছিল নবদম্পতির জন্য। তাছাড়া সে তার মা-বাবার দেশের ঠিকানাও দিয়েছিল ডাক্তারকে।
নীনা দেকোন্তে ও বিলি সানচেজের জীবনের বিয়োগান্ত পর্বের ঘটনাগুলো পরে জানা গিয়েছিল বিসত্মারিতভাবে। নীনার মৃত্যুসংবাদ প্যারিস দূতাবাসে এসেছিল শুক্রবার সন্ধ্যায়। বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জরুরি ক্যাবল এসেছিল দূতাবাসে। সেখানে প্যারিসের হাসপাতালের নাম-ঠিকানাও ছিল। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে সার্বিক দায়িত্ব নিজেই গ্রহণ করেছিলেন রাষ্ট্রদূত। প্যারিস পুলিশপ্রধানের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন তিনি। মৃতদেহ নিয়ে হাসপাতালের দাফতরিক আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হলো যথাসম্ভব দ্রম্নতগতিতে। এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিলি সানচেজকে খুঁজে বের করা। শুক্রবার রাত থেকে একটি জরুরি বুলেটিন প্রকাশ করা হয়েছিল স্থানীয় রেডিও-টেলিভিশনে। বিলির একটি ছবি পাওয়া গিয়েছিল নীনা দেকোন্তের ক্লাচে, যা টেলিভিশনে প্রদর্শিত হয়। প্যারিস পুলিশ খুঁজে পেয়েছিল সর্বাধুনিক মডেলের তিনটি বেন্টলি কনভার্টিবল স্পোর্টস কার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গাড়িগুলোর কোনোটিই বিলি সানচেজের ছিল না।
এদিকে শনিবার মধ্যাহ্নের আগেই প্যারিস পৌঁছেন নীনা দেকোন্তের শোকাহত মা-বাবা। বিমানবন্দর থেকে তাঁরা হাসপাতালের গির্জায় চলে এসেছিলেন সরাসরি। দুর্ভাগ্যবশত বিলি সানচেজের পিতা-মাতা আসতে পারেননি। কারণ টেলিগ্রামের কোনো এক কারিগরি ত্রম্নটির কারণে যথাসময়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। রোববার অপরাহ্ণে হাসপাতালের গির্জায় নীনা দেকোন্তের অমেত্ম্যষ্টিক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।
প্যারিস দূতাবাসের অভ্যর্থনা কক্ষের কর্মকর্তাটি পরে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন নীনার পরিবারের কাছে। অনুশোচনার সঙ্গে স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি জরুরি ক্যাবলটি পেয়েছিলেন বিলি সানচেজ দূতাবাস থেকে চলে যাওয়ার কিছু পরে। বিলির খোঁজে তাৎক্ষণিক লোক পাঠানো হয়েছিল প্যারিসের সব অভিজাত হোটেলে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রদূত দূতাবাসের কর্মকর্তাদের কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন। বস্ত্তত অভ্যর্থনা কক্ষের কর্মকর্তাটি বিলি সানচেজকে বিশ্বাস করতে পারেননি। পোশাকে নোংরা কাদামাখা উন্মাদ চেহারার একজন লোক। তাদের দেশের অতি উচ্চবংশের সন্তান হিসেবে তাকে কল্পনাই করতে পারেননি।
সোমবার সকালে বিলি সানচেজকে খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা পরিত্যক্ত হয়েছিল। নীনা দেকোন্তের মা-বাবা মৃতদেহ কফিনে আবদ্ধ করার অনুমতি দিয়েছিলেন অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে। কফিনের ডালা বন্ধ করার সময় সেখানে অনেকে উপস্থিত ছিল। তারা একবাক্যে স্বীকার করেছিল যে, এমন অনিন্দ্যসুন্দর নারী তারা আগে দেখেনি। অতএব মঙ্গলবার কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে বিলি সানচেজ যখন হাসপাতালে উপস্থিত হলো, নীনা দেকোন্তে তখন আর সেখানে নেই। প্যারিস থেকে অনেকদূরে তাকে তখন সমাহিত করা সম্পন্ন হয়ে গেছে। লা ম্যাংগার সুপ্রাচীন সমাধিক্ষেত্রের নতুন কবরে উজ্জ্বল পাথরের ফলক। এই সেই সমাধি যেখানে আছে ম্যাংগা প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী কদাকার অট্টালিকাটি। যে-অট্টালিকার চিলেকোঠায় চতুষ্কোণ ছক কাটা ঘর। যেখানে নীনা দেকোন্তে তার সংক্ষিপ্ত জীবনের সুবর্ণ দরজা উন্মোচিত করেছিল।
বিলি সানচেজ যখন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো, তখন প্যারিসের আকাশে ঘন কুয়াশার মেঘ। আকাশ থেকে অঝোরে তুষারপাত হচ্ছিল। সাদা কবুতরের ছিন্ন পালকের মতো। আলোর নগরী প্যারিস ঢেকে গেছে সাদা বরফে। কিন্তু ওই বরফের ওপরে এখন আর কোনো রক্তের দাগ নেই। প্যারিসের আবহাওয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত মানুষজন কিছুটা বিস্মিত। তারা বলাবলি করছিল, বিগত দশ বছরে এমন দৃষ্টিনন্দন তুষারপাত দেখা যায়নি।