হারানো পৃথিবী: ১৫. আমাদের আমাজনের বন্ধু

হারানো পৃথিবী: ১৫. আমাদের আমাজনের বন্ধু

১৫. আমাদের আমাজনের বন্ধু

এখানে আমি আমাদের আমাজনের বন্ধুদের–বিশেষ করে সিনরপেনালোসা আর ব্রাজিলের সরকারী কর্মচারীদের আমাদের ফিরতি পথে বিশেষ সুযোগ সুবিধা করে দেয়ার জন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

দক্ষিণ আমেরিকায় আমাদের নিয়ে যে সব কথাবার্তা আর ঔৎসুক্য দেখা গেল তাতে মনে করেছিলাম যে লোক মুখে ছড়িয়ে পড়া গল্প শুনেই ওরা এতটা উৎসাহী। কিন্তু ব্যাপারটা যে এতদূর ছড়িয়েছে, সারা ইউরোপে আমাদের নিয়ে তর্ক বিতর্কের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝলাম আমরা অনেক পরে। আমাদের জাহাজ আইভেরিনা যখন সাউদাম্পটন থেকে পাঁচশো মাইলদূরে, তখন থেকেই নানা পত্র পত্রিকা থেকে আমাদের কাছে রেডিও বার্তা আসতে লাগল। আমাদের অভিজ্ঞতা সংক্রান্ত যে কোন ছোট্ট ফিরতি খবরও ওরা অনেক টাকা দিয়ে কিনে নিতে রাজি। এতেই বোঝা গেল যে শুধু বিজ্ঞান জগত নয়, সাধারণ জনগণও আমাদের খবর জানতে অত্যন্ত আগ্রহী। কিন্তু আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম যে জুওলজিক্যাল ইন্সটিটিউটের সভার আগে আমরা কেউ মুখ খুলব না।

সাউদাম্পটনে নামার পর বহু সাংবাদিকই আমাদের কাছ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করল, কিন্তু আমরা তাদের জানালাম নভেম্বরের সাত তারিখে জুওলজিক্যাল হলের সভার আগে আমরা কেউ কিছু বলব না। কিন্তু পরে যখন দেখা গেল সব লোক ওই ছোট জায়গায় আঁটবে না তখন কুইনস হলের ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু সেখানেও যে জায়গা হবে না তা আগে বুঝতে পারলে এলবার্ট হলেই হয়তো এই অনুষ্ঠান করার ব্যবস্থা নেয়া হত।

এবার আমাদের খবরের কাগজের ভাষাতেই শুনুন মীটিঙে কি ঘটেছিল। হেড লাইন সহ পুরো খবরটাই তুলে দিলাম এখানে:

হারানো পৃথিবী

কুইনস হলে ঐতিহাসিক সভা

ভীষণ হট্টগোল

আশ্চর্য ব্যাপার-ওটা কি?

রিজেন্ট স্ট্রীটে রায়ট!

(বিশেষ রিপোর্ট)

বহু আলোচিত জুওলজিক্যাল ইন্সটিটিউটের সভা গত সন্ধ্যায় কুইনস হলে অনুষ্ঠিত হয়। প্রাগৈতিহাসিক জীবের অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্সটিটিউটের তরফ থেকে পাঠানো কমিটির রিপোর্টই এই সমাবেশের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। সভায় যা ঘটেছে তা সেখানে যারা উপস্থিত ছিল তারা কেউ কোনদিনও ভুলতে পারবে না।

টিকিট কেবল বিজ্ঞানী আর তাদের বন্ধু বান্ধবদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। রাত আটটায় মীটিং শুরু হবার কথা কিন্তু তার অনেক আগেই হল ভরে গিয়েছে। বিক্ষুব্ধ জনতাকে অযৌক্তিকভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে এমন একটা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা পৌনে আটটায় ধাক্কাধাক্কি করে ভিতরে ঢুকে পড়ে। এই ঠেলাঠেলিতে পুলিশের এইচ বিভাগের ইন্সপেক্টার স্কোবল সহ কয়েকজন আহত হয়। হতভাগ্য ইন্সপেক্টরের পা ভেঙে গেছে বলে হাসপাতালের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

এইভাবে জনতার গেট ভাঙার ফলে কুইনস হলে আর তিল ধারণের ঠাই রইল না। এমন কি প্রেসের জন্যে নির্ধারিত খালি জায়গার উপর হামলা করে সেই জায়গা দখল করে নেয় জনতা।

অনুষ্ঠানের চারজন প্রধান তারকার জন্যে আনুমানিক হাজার পাঁচেক লোক অধীরভাবে অপেক্ষা করছিল। শেষ পর্যন্ত ঠিক সময় মতই দেখা দিলেন তারা হলের মঞ্চে। শুধু ইংল্যান্ডের নয়, ফ্রান্স এবং জার্মানীর সব বড় বড় বৈজ্ঞানিকগণও উপস্থিত ছিলেন হলে। সুইডেন থেকেও এসেলিন সেখানকার সুবিখ্যাত প্রাণিতত্ত্ববিদ প্রফেসর সেরজিয়াস, উপসালা ইউনিভার্সিটি থেকে।

চার নায়ক হলে ঢোকার সাথে সাথেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তিন চার মিনিট ধরে চিৎকার করে তাদের সম্বর্ধনা জানায়। তবে চুলচেরা বিচার করলে ঠিকই ধরা পড়ত যে যারা তালি দিচ্ছিল তারা সবাই এঁদের সম্মানার্থে দিচ্ছিল না।

হাততালি, উত্তেজনা আর চিৎকার একটু শান্ত হতেই চেয়ারম্যান, ডারামের ডিউক খুব অল্প কথায় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করলেন।

তার পরেই এলেন প্রফেসর সারলী। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কোথায় কি ঘটেছিল কেমন করে ঘটেছিল তার একটা মোটামুটি বিবরণ দিলেন তিনি। (এই রিপোর্টে বিবরণ ছাপা হলো না; আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির এই অভিযান সম্পর্কে বিশদ বিবরণ এই কাগজেই ছাপা হবে তার নিজস্ব লেখনীতে)। বিভিন্ন ধরনের প্রাণী যেগুলো আমরা পৃথিবীর বুক থেকে লোপ পেয়েছে বলে ধরে নিয়েছিলাম তাদের অনেকগুলোই তিনি ওই মালভূমিতে নিজের চোখে দেখে এসেছেন বলে জানালেন।

আশা করা গেছিল যে প্রাণীত কমিটির নেতা হিসাবে প্রফেসর সামারলীর বক্তৃতার পরে প্রফেসর সেরজিয়াসের ধন্যবাদ জ্ঞাপন আর একজনের সমর্থনের পরেই সভার কাজ শেষ হবে; কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল।

প্রথম থেকেই কিছু কিছু বিরোধিতার আভাস পাওয়া গেছে। ঠিক এই সময়ে এডিনবারার ড. ইলিংওয়ার্থ হলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চেয়ারম্যানের কাছে জ্ঞাপন করলেন যে শেষ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একটা সংশোধনীর প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন।

চেয়ারম্যান তাকে তার বক্তব্য পেশ করার অনুমতি দিলেন।

প্রফেসর সামারলী সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে জানালেন যে ওই ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত শত্রু। ত্রৈমাসিক বিজ্ঞান পত্রিকায় তার ব্যাথিবিয়াসের আসল প্রকৃতি সম্বন্ধে লেখাটা বের হবার পর থেকেই তাদের এই মতবিরোধ।

চেয়ারম্যান জানালেন যে ব্যক্তিগত বিষয় এখানে আলোচনা করা যাবে না। ইলিংওয়ার্থকে বলতে দেয়া হলো সামারলীকে থামিয়ে। তার বক্তব্যের সারাংশ হলো :

বছর খানেক আগে একজন কিছু অদ্ভুত কথা শুনিয়েছিলেন আমাদের। আজ চারজন লোক বলছেন আরও অদ্ভুত সব কথা। কিন্তু কথা হচ্ছে মুষ্টিমেয় চারজন লোকের কথাতে কি আমরা বিজ্ঞানে যুগান্তকারী এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ অবিশ্বাস্য কথাকে সত্য বলে মেনে নিতে পারি? ইদানীং অনেক বিদেশী ভ্রমণকারী এ ধরনের গল্প বানিয়ে বলছে আর তাদের কথা বোকার মত বিশ্বাসও করেছে লোকজন। লন্ডন জুওলজিক্যাল ইন্সটিটিউটও কি সেরকম বোকামির পরিচয় দেবে?

আমি অস্বীকার করছি না যে এরা চারজনই স্বনামধন্য সৎ ব্যক্তি। কিন্তু মানুষের চরিত্র বড় জটিল। এমনকি প্রফেসরগণও খ্যাতির লোভে ভুল পথে চালিত হতে পারেন। প্রজাপতির মত আমরা সব মানুষই আলোর মাঝে পাখা ঝাপটাতে চাই, অর্থাৎ মধ্যমণি হয়ে থাকতে চাই। আমি রূঢ় হব না, তবে এই চারজনেরই পরস্পরকে সমর্থন করার বিভিন্ন ব্যক্তিগত কারণ থাকতে পারে।

আমাদের শোনানো হয়েছে যে তাড়াতাড়ি দড়ি বেয়ে নেমে পালাতে হয়েছে বলে বড় কোন নমুনা তাদের পক্ষে আনা সম্ভব হয়নি। প্রফেসর সামারলী যে সব ছোট ছোট নমুনা এনেছেন সেগুলো প্রাগৈতিহাসিক যুগের বলে কোন প্রমাণ নেই। লর্ড রক্সটন দাবি করেছেন যে তার কাছে ফোরোরেকাসের মাথা আছে, সেটা নিজের চোখে দেখলে সন্দেহমুক্ত হতে পারতাম।

এইখানে লর্ড জন লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে জানতে চাইলেন তাকে মিথ্যাবাদী বলা হচ্ছে কি না। হলের ভিতরে হৈ চৈ লেগে গেল। পিছনে মেডিক্যাল ছাত্রদের মধ্যে কিছু হাতাহাতিও হয়ে গেল। চেয়ারম্যান উঠে দাঁড়িয়ে বহু কষ্টে লোকজনকে একটু শান্ত করে ইলিংওয়ার্থকে অল্প কথায় তার বক্তব্য শেষ করার নির্দেশ দিলেন।

আমার আরও অনেক কিছুই বলার ছিল, কিন্তু মহামান্য চেয়ারম্যানের নির্দেশ শিরোধার্য করে এই বলেই আমি শেষ করতে চাই যে আজকের বক্তব্যগুলো প্রমাণ সাপেক্ষ বলেই রেকর্ড করা হোক। পরে সঠিক তদন্তের জন্যে আরও বড় এবং আরও বিশ্বাসযোগ্য কমিটিকে পাঠানো যেতে পারে।

এই মন্তব্যে হলের ভিতরে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হলো। শ্রোতাদের মতবাদ দুটো দলে ভাগ হয়ে গেল। দেখা গেল বিরোধী দলটিও নেহাত ছোট নয়। চিৎকার আর গোলমালের মধ্যে প্রফেসর চ্যালেঞ্জার এগিয়ে এলেন। তিনি দুহাত তুলে দাঁড়াতেই ধীরে ধীরে হট্টগোল কমতে কমতে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল।

এখানে উপস্থিত অনেকেরই হয়তো মনে আছে কয়েক মাস আগে প্রফেসর সামারলীও ঠিক এই রকমই বোকার মত প্রতিবাদ করেছিলেন। আজকের বক্তা যেসব জঘন্য নীচ শ্রেণীর মন্তব্য করেছেন তাতে বহু কষ্টে আমাকে তার সমপর্যায়ে নেমে এসে কথা বলতে হচ্ছে।

কমিটির তরফ থেকে প্রফেসর সামারলীই আজ তাঁর বক্তব্য পেশ করেছেন এই সভায়, তবে আমিই ছিলাম এই অভিযানের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি। আমিই তাদের সবাইকে নিয়ে গেছি অজানা জায়গায়, আমিই সব দেখিয়েছি আবার আমিই নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি।

যা হোক, গত সভার অভিজ্ঞতায় সাবধান হয়ে গেছি আমি। এবারে তাই যে কোন যুক্তিবাদী মানুষকে নিঃসন্দেহ করার মত প্রমাণ নিয়েই ফিরেছি।

ইলিংওয়ার্থ দাঁড়িয়ে উঠে দেখতে চাইলেন সেই প্রমাণ।

প্রফেসর সামারলীর বক্তৃতা, কীট পতঙ্গ আর প্রজাপতির নমুনা, ছবি, কোন কিছুই আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারল না। এবার আপনিই বলুন কিসে সন্তুষ্ট হবেন আপনি?

ইলিংওয়ার্থ জানালেন যে প্রাগৈতিহাসিক কোন প্রাণীর নমুনা দেখতে চান তিনি।

তা দেখালে সন্দেহ দূর হবে তো আপনার? ইলিংওয়ার্থ অবিশ্বাসের হাসি হেসে জানালেন যে হবে।

প্রফেসর চ্যালেঞ্জার হাত তুলে ইশারা করতেই দেখা গেল মিস্টার ম্যালোন চেয়ার ছেড়ে মঞ্চের পিছনে চলে গেলেন। একটু পরেই বিশালদেহী একজন নিগ্রোর সাথে ধরাধরি করে একটা ভারী বাক্স এনে প্রফেসরের পায়ের কাছে নামিয়ে রাখলেন। হলে অখন্ড নীরবতা বিরাজ করছে তখন। উত্তেজনায় শ্বাস ফেলতেও ভুলে গেছে দর্শকমন্ডলী।

বাক্সের ঢাকনা টেনে সরিয়ে ফেললেন প্রফেসর। কয়েকবার তুড়ি বাজিয়ে ডাকলেন। সাংবাদিকদের আসন থেকে শোনা গেল তিনি ডাকছেন, ওঠো সুন্দরী, চেহারা দেখাও!

এক মুহূর্ত পরেই নখের আঁচড় আর ঝটপটানির শব্দ তুলে বিদঘুটে বিকট কদাকার চেহারার একটা জীব বাক্সের কিনারায় চড়ে বসল।

দর্শকদের সব কটা চোখের ভীত সন্ত্রস্ত দৃষ্টি আঠার মত আটকে রইল জীবটার ওপর। চেয়ারম্যান ডিউক ভয়ে উল্টে অর্কেস্টার উপর পড়লেন। কিন্তু সেদিকে কেউ খেয়ালই করল না। প্রাণীটার মুখ এতই বীভৎস যে কল্পনাতেও কেউ এমন মুখ ভাবতে পারবে না। হিংস্র, ভীতিজনক মুখে দুটো লাল টকটকে চোখ, ঠিক যেন জলন্ত কয়লার দুই কণা। লোভী লম্বা হিংস্র মুখটা আধ খোলা; ভিতরে হাঙরের মত দুই সারি ধারাল দাঁত দেখা যাচ্ছে।

দর্শকদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। একজন ভয়ে চিৎকার করে উঠল। সামনের সারির দুজন মহিলা অজ্ঞান হয়ে গেলেন। দারুণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল সবাই। দিশেহারা জনতা কি করবে কিছুই বলা মুশকিল।

সবাইকে শান্ত করার জন্যে হাত তুললেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। কিন্তু তার এই হাত নাড়ায় ভয় পেয়ে জীবটা পাখা মেলল। রবারের মত বিশাল ডানা মেলে শূন্যে উড়ল সে। প্রফেসর প্রায় ধরে ফেলেছিলেন কিন্তু একটু দেরি হয়ে গেল। দশ ফুট পাখা মেলে চক্কর দিতে লাগল ওটা। তার গা থেকে ঝাঝাল একটা গন্ধ, বাতাসকে ভারি আর বিষাক্ত করে তুলল।

গ্যালারির লোকেরা এই খুনী রক্তচক্ষু আর ভীষণ ঠোঁটওয়ালা প্রাণীটি তাদের কাছে এলেই ভয়ে চিৎকার করে উঠছে। এত আওয়াজে ভয় পেয়ে প্রাণীটার ওড়ার বেগ বেড়ে গেল। দেয়ালে আর ঝালরে বাড়ি খেয়ে খেয়ে ভীত উন্মত্ত হয়ে উঠল সে।

প্রফেসর চ্যালেঞ্জার চিৎকার করে উঠলেন, শিগগির কেউ জানালাটা বন্ধ করুন! মঞ্চের উপরে মানসিক যাতনায় ছটফট করতে লাগলেন তিনি।

কিন্তু হায়! তার কথা মত কেউ জানালা বন্ধ করার আগেই জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল জীবটা।

ধপ করে নিজের চেয়ারে বসে পড়ে দুহাতে মুখ ঢাকলেন চ্যালেঞ্জার। আর দর্শকমন্ডলী হাঁপ ছেড়ে বাঁচল, ভয়ের কারণ দুর হয়েছে এখন।

এর পরের দৃশ্য বর্ণনাতীত। দুই ভিন্নমত পোষণকারী দলই এবার একত্র হয়ে একটা বিশাল ঢেউয়ের মত এগিয়ে গেল মঞ্চের দিকে। যতই এগিয়ে এল তাদের উল্লসিত চিৎকারও ততই জোরাল হলো। মঞ্চে উঠে তারা চার বীর নায়ককে মাথায় তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল। এটা অবশ্যই বলা যায় যে প্রথমে কেউ কেউ তাদের কথা অবিশ্বাস করে ত্রুটি করলেও এই সম্মান দেখিয়ে তা তারা সুদে আসলে পরিশোধ করল।

ল্যাঙহ্যাম হোটেলের ওপাশ থেকে অক্সফোর্ডসাকার্স পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য। প্রায় এক লক্ষ লোক জমা হয়েছিল হলের বাইরে। মহানায়ক চারজনকে দেখা মাত্রই উল্লসিত সম্বর্ধনার বিপুল রব উঠল জনতার মাঝে।

রাত বারোটার সময়ে বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে জনতা লর্ড রক্সটনের বাড়ির কাছে। এসে আনন্দের গান-দে আর জলি গুড ফেলোস-গেয়ে তবে মুক্তি দেয় ওঁদের।

গ্ল্যাডিসের কল্পনায় আকাশে বিচরণ করছিলাম আমি এতদিন। কিন্তু এবার যেন শক্ত মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়লাম। সে কি বেঁচেই আছে না মারা গেছে? তার কাছ থেকে সাউদাম্পটনে কোন চিঠি বা টেলিগ্রামই আমি পাইনি। হয়তো বা কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে তার;—থাকলে আবার কল্পনার আকাশে উড়ব আমি।

স্ট্রাদামের ছোট্ট ভিলায় পৌঁছলাম রাত দশটায়। এক ছুটে সামনের উঠান পেরিয়ে দুমাদুম কিল মারলাম দরজায়। ভিতরে গ্ল্যাডিসের গলার আওয়াজ শুনলাম। পরিচারিকা দরজা খুলতেই তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ড্রইংরুমে হাজির হলাম আমি। পিয়ানোর পাশে নিচু সোফায় বসে আছে গ্ল্যাডিস। তিন কদমে হাজির হলাম আমি তার পাশে।

গ্ল্যাডিসের হাত দুটো আমার হাতে তুলে নিয়ে ভাবাবেগে ডাকলাম, গ্ল্যাডিস! ওহ গ্ল্যাডিস!

অবাক হয়ে সে আমার মুখের দিকে চাইল। কোথায় যেন একটু বদলে গেছে ও। তার চোখের ভাষা, কঠিন ভাবে চোখ তুলে চাওয়া-চাপা ঠোঁট, সবই আমার কাছে নতুন লাগল। হাত টেনে নিল গ্ল্যাডিস।

এসবের মানে কি? জিজ্ঞেস করল ও।

গ্ল্যাডিস! আর্তনাদ করে উঠলাম আমি, কি হয়েছে তোমার? তুমি আমার গ্ল্যাডিস—ছোট্ট গ্ল্যাডিস হাঙ্গারটন নও কি?

না, জবাব দিল সে, আমি গ্ল্যাডিস পটস। এসো তোমার সাথে আমার স্বামীর পরিচয় করিয়ে দেই।

জীবন কত অযৌক্তিক, কত অবাস্তব! যন্ত্রচালিতের মত মাথা ঝুঁকিয়ে লাল চুলওয়ালা ছোট্ট মানুষটার সাথে হাত মেলালাম আমি। হাতাওয়ালা চেয়ারে গুটিসুটি হয়ে বসেছিলেন উনি এতক্ষণ।

বাবা আপাতত আমাদের এখানে থাকতে দিয়েছেন। আমাদের নতুন বাসা ঠিকঠাক করা হচ্ছে, মৃদু স্বরে বলল গ্ল্যাডিস।

ও, আচ্ছা?

তুমি পারায় আমার চিঠি পাওনি তাহলে?

কই, কোন চিঠি আমি পাইনি তো?

দুর্ভাগ্য-চিঠিতে সব পরিষ্কার করে লেখা ছিল।

যাকগে, এখন সবই পরিষ্কার হয়ে গেছে আমার।

আমি উইলিয়ামকে তোমার ব্যাপার সবই বলেছি- আমাদের মধ্যে কোন লুকোচুরি নেই, বলল গ্ল্যাডিস। আমি দুঃখিত—কিন্তু একটা খুব গভীর টান থাকলে কি তুমি আমাকে এখানে একা ফেলে পৃথিবীর অন্য মাথায় চলে যেতে পারতে? খুব চোট পাওনি তো তুমি?

আরে না—বিন্দুমাত্র না। আচ্ছা চলি।

একটু মিষ্টি মুখ করে যান, ছোটখাট লোকটি বললেন।

দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেই একটা অদম্য ইচ্ছা জাগল আমার মনে। ঝট করে আবার দরজা খুলে আমি ফিরে গেলাম আমার সফল প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে। একটু অপ্রতিভভাবে ভয়ে ভয়ে চাইলেন তিনি আমার দিকে।

আমার একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

সম্ভব হলে নিশ্চয়ই দেব, বললেন তিনি।

কি করেছেন আপনি, গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছেন, মেরু আবিষ্কার করেছেন নাকি চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন উড়ে-কি করে সম্ভব করলেন আপনি এটা?

প্রশ্নটা কি একটু বেশি ব্যক্তিগত হয়ে গেল না?

তাহলে অন্তত এটা বলুন, আপনার পেশা কি?

আমি একজন উকিলের কেরানী। জনসন আর মেরিডেইলস-এর দুই নম্বর লোক।

শুভরাত্রি জানিয়ে চলে এলাম ওখান থেকে। মনের ভিতরে আমার রাগ, দুঃখ আর অট্টহাসি যেন একসাথে টগবগ করে ফুটছে।

লর্ড জনের বাসা। আমরা চারজনই একসাথে হয়েছি, হাসি গল্পের মাঝে আমরা অভিযানেরই স্মৃতিচারণ করছি।

রাতের খাওয়ার পরে লর্ড জন জানালেন যে তাঁর কিছু বক্তব্য আছে। আলমারী থেকে ছোট্ট একটা বাক্স বের করে এনে আমাদের সামনে টেবিলের উপর রাখলেন তিনি।

একটা কথা, বললেন জন, হয়তো আপনাদের আগেই জানানো উচিত ছিল আমার, কিন্তু আমি নিজে নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলতে চাইনি। সবাইকে আশা দিয়ে পরে নিরাশ করার কোনই মানে হয় না। কিন্তু কেবল আশা নয় এবার আমি নিশ্চিত হয়ে নিয়েছি। মনে আছে আমরা টেরাড্যাকটিলের আস্তানায় যেদিন প্রথম যাই? ওটা ছিল একটা জ্বালামুখ, নীল কাদা ছিল ওখানে।

প্রফেসরেরা মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলেন।

ঠিক ওই রকম নীল কাদা আমি আর এক জায়গায় দেখেছি, সেটা হচ্ছে ডি বীয়ার্সে, কিম্বার্লির বিখ্যাত হীরা খনিতে। আমার মাথায় তখন কেবল হীরা ঘুরছিল। একটা বেতের খাঁচামত বানিয়ে আমি একদিন সারাদিন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এগুলো তুলেছি।

বাক্সটা খুলে টেবিলের ওপর উপুড় করে দিলেন জন। সিমের বীচির মত আকার থেকে কাজুবাদামের আকারের পর্যন্ত সব রকম হীরাই রয়েছে।

আগে জানাইনি কারণ হীরা বড় আকারের হলেও তার মূল্য খুব কম হতে পারে। কাটার ওপর নির্ভর করে হীরার দাম। তাই প্রথমদিন এসেই আমি স্পিঙ্কস এ একটা হীরা নিয়ে গিয়ে কাটিয়ে দাম যাচাই করতে দিয়েছিলাম।

আর একটা ছোট্ট বাক্স পকেট থেকে বের করে খুলে নিজের হাতের ওপর ঢাললেন তিনি। সুন্দর একটা ঝিলিক দেয়া হীরার টুকরো গড়িয়ে পড়ল। এত সুন্দর হীরা সচরাচর চোখে পড়ে না।

এটা দাঁড়িয়েছে তার ফল, বললেন জন, সবগুলোর দাম দুই লক্ষ পাউন্ড হবে বলেই জহুরীর ধারণা। আমি মনে করি এগুলো আমাদের সবার মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে নেয়া উচিত। এক একজনের ভাগে তাহলে পড়ছে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড।

চ্যালেঞ্জার বললেন, যদি সত্যিই তুমি সমান ভাগের জন্যে জোরাজুরি করো তবে আমার টাকা দিয়ে আমি একটা নিজস্ব যাদুঘর বানাব। এটা আমার অনেক দিনের স্বপ্ন।

আপনি কি করবেন, প্রফেসর সামারলী?

আমি শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে খড়ি মাটির ফসিলের চূড়ান্ত শ্রেণী বিভাগ শেষ করার কাজে মন দেব।

আমার টাকা আমি খরচ করব আবার একটা সুগঠিত দল নিয়ে মালভূমিতে ফিরে আরও অনুসন্ধানের কাজে, বললেন জন। আর আমাদের তরুণ বন্ধু নিশ্চয়ই বিয়েতে কাজে লাগাবে তোমার অংশ?

না, বিয়ে করছি না আমি এখন, একটু কাষ্ঠ হাসি হেসে বললাম আমি। আপনার আপত্তি না থাকলে আপনার সঙ্গী হয়ে আবার মালভূমিতে যেতে চাই আমি।

কোন কথা না বলে লর্ড রক্সটন টেবিলের উপর দিয়ে তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত