হারানো পৃথিবী: ১৪. প্রত্যেক দিনের ঘটনা আমি লিখে চলেছি

হারানো পৃথিবী: ১৪. প্রত্যেক দিনের ঘটনা আমি লিখে চলেছি

১৪. প্রত্যেক দিনের ঘটনা আমি লিখে চলেছি

প্রত্যেক দিনের ঘটনা আমি লিখে চলেছি। শেষ করার আগে যেন লিখতে পারি যে, আমাদের মাথার উপর থেকে কালো মেঘ কেটে গেছে, মুক্তির আলো দেখতে পাচ্ছি আমরা, মনে প্রাণে সেই কামনাই করি। তবে এমন দিনও আসতে পারে যেদিন এই অদ্ভুত দেশে কোন আশ্চর্য ঘটনা বা জন্তু জানোয়ার সম্পর্কে নতুন তথ্য জেনে আমরা আমাদের অনিচ্ছা-বন্দী দশায় খুশিই হব। তখন ইচ্ছার বিরুদ্ধে এখানে আটকা পড়ে থাকার জন্যে আমাদের কোনো অনুতাপ আর থাকবে না।

বনমানুষদের একেবারে বিলুপ্ত করে ইন্ডিয়ান লোকেদের এই বিজয় আমাদের ভাগ্যে আমূল পরিবর্তন এনে দিল। আমরা এখন মালভূমিতে রাজার সম্মান পেয়ে আসছি। স্থানীয় বাসিন্দারা আমাদের শ্রদ্ধা আর ভয় মিশ্রিত চোখে দেখতে আরম্ভ করেছে। ওদের ধারণা আমরা কোন অলৌকিক শক্তির সাহায্যেই ওদের বিজয়ে সাহায্য করেছি। নিজেদের ভালর জন্যেই ওদের উচিত ছিল এমন শক্তির অধিকারী মানুষগুলোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় দেয়া—কিন্তু আজ পর্যন্ত ওরা মুখ ফুটে বলেনি যে কি উপায়ে আমরা নিচে নামতে পারি।

ওদের ভাবভঙ্গির ভাষা থেকে যতটা বোঝা গেছে তা হচ্ছে একটা গুহা ছিল (আমরা তার নিচের অংশটা দেখেছি, কিন্তু গত বছর প্রবল ভূমিকম্পে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা নিচে নামার ইচ্ছা প্রকাশ করলেই ওরা মাথা নাড়ে অথবা কাঁধ ঝাকায়। হয়তো বা ওরা চায় না যে আমরা ওদের ছেড়ে চলে যাই।

বিজয়ের পরে যে সব বনমানুষ বেঁচে ছিল, নিজেদের গুহার কাছেই ওরা তাদের বসবাসের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। মালভূমি পার হয়ে এপাশে আসার সময়ে তাদের বিলাপ সত্যিই বড় করুণ। এখন থেকে ওরা বেড়ে উঠবে ওদের প্রভুর তত্ত্বাবধানে। রাতের অন্ধকারে এখনও আমাদের কানে আসে মেয়ে বনমানুষের হু হু কান্না। কাঠ কাটা আর পানি টানাই এখন ওদের প্রধান কাজ।

দুদিন পর আমরা স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে ওদের গুহায় ফিরে এলাম। ওরা ওদের গুহাতেই থাকার জন্যে আমাদের অনেক অনুরোধ করল, কিন্তু লর্ড জন কিছুতেই রাজি হলেন না। কারণ গুহায় থাকলে আমরা ওদের আওতার মধ্যে থাকব, তখন শক্তিশালী আর বিপজ্জনক মনে করে আমাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে পারে ওরা।

আমরা তাই স্বাধীন ভাবে বাইরে থাকলাম। আমাদের রাইফেল সব সময়েই প্রস্তুত, কিন্তু ওদের সাথে বেশ ভাল সম্পর্কই বজায় রাখলাম আমরা। মাঝে মাঝে ওদের গুহা পরিদর্শন করেছি—অদ্ভুত জায়গা ওগুলো। প্রাকৃতিক নাকি মানুষের তৈরি তা আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি। সবগুলো গুহাই আড়াআড়িভাবে সমান্তরাল একটা অপেক্ষাকৃত নরম স্তরে প্রায় একই উচ্চতায় রয়েছে; উপরে আগ্নেয় বেসন্ট আর নিচে শক্ত গ্র্যানিট।

গুহাগুলোর মুখ মাটি থেকে প্রায় আশি ফুট উঁচু। ছোট ধাপের লম্বা সিঁড়ি রয়েছে উপরে ওঠার। সিঁড়ি এত সরু যে ভারি কোন জন্তুই ওটা বেয়ে উপরে উঠতে পারবে না। গুহার ভিতরটা মোটামুটি গরম আর শুকনো। কোনটা অল্প কোনটা বা বেশি গভীরে প্রবেশ করেছে পাহাড়ের গায়ে। মসৃণ দেয়ালে অদ্ভুত সব জীবজন্তুর ছবি; ইগুয়েনোডন, ডাইনোসর, ফিউনা ইত্যাদি; সবই কাঠ কয়লা দিয়ে আঁকা।

যখন ভাল মত জানলাম যে ইগুয়েনোডনগুলো আমাদের গরু ছাগলের মতই এই স্থানীয় বাসিন্দাদের গৃহপালিত পশু তখন উপলব্ধি করতে বাকি রইল না যে কেবল প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্র হাতে থাকলেও মানুষই শ্রেষ্ঠ জীব।

তিনদিনের মাথায় আমরা আবিষ্কার করলাম যে শ্রেষ্ঠ জীব মানুষেরও মাঝে মাঝে বিপদ আসে। চ্যালেঞ্জার আর সামারলী গেছেন লেকের পাড়ে। কয়েকজন ইন্ডিয়ান তাদের নির্দেশে হারপুন দিয়ে তাদের দেখিয়ে দেয়া প্রাণীগুলো শিকার করছে। জন আর আমি আছি গুহার পাশে আমাদের ক্যাম্পে। হঠাৎ বিভিন্ন কাজে রত ইন্ডিয়ানদের মধ্যে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার উঠল, সাবধান! সাবধান! সবার মুখে একটাই কেবল শব্দ স্টোয়া! তৎক্ষণাৎ ছেলে মেয়ে জোয়ান বুড়ো সবাই একসাথে ছুটল নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে। উন্মত্তের মত সবাই সিড়ি দিয়ে গুহার মুখের দিকে দৌড়াচ্ছে।

উপরে চেয়ে দেখলাম সবাই হাতের ইশারায় আমাদের দ্রুত উপরের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলছে। আমরা রাইফেল আর গুলির ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে ছুটলাম বিপদের পরিমাণ যাচাই করতে।

হঠাৎ জঙ্গলের গাছের ভিতর থেকে দশ বারোজন ইন্ডিয়ান ছুটে বেরিয়ে এল। জানপ্রাণ নিয়ে দৌড়াচ্ছে ওরা। ওদের ঠিক পিছনেই ধাওয়া করে আসছে দুটো জন্তু। আমাদের ক্যাম্পে যে হানা দিয়েছিল আর সেই রাতে আমাকে যে তাড়া করেছিল—ঠিক তেমনি জন্তু। জানোয়ার দুটো দেখে আমরা বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। দিনের বেলা আর কোন দিন দেখিনি, আজ সূর্যের আলোয় দেখলাম ওদের ব্যাঙের মত মাথার আবগুলো অনেকটা মাছের আঁশের মত দেখাচ্ছে; রামধনুর মত বিভিন্ন রঙ ছড়াচ্ছে ওগুলো।

হাঁ করে শোভা দেখার আর সময় নেই আমাদের। মুহূর্তের মধ্যে ওরা পলাতক ইন্ডিয়ানদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পায়ের নিচে যারা চ্যাপ্টা হলো তাদের রেখে আবার লাফ দিল। বোঝা যাচ্ছে, ওদের শিকার পদ্ধতিই হচ্ছে প্রকান্ড দেহের তলে শিকারকে পিষে মারা। অন্যান্য পলাতক ইন্ডিয়ানরা ভয়ে চিৎকার করতে করতে ছুটছে। এই দুটো দানবের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একেবারেই অসহায় ওরা; একের পর এক মারা পড়ছে ওরা প্রচন্ড আক্রমণে। ছোট্ট ইন্ডিয়ান দলটার ছয়জন মাত্র জীবিত এখন। আমরা দুজন এগিয়ে এলাম ওদের সাহায্যে, কিন্তু তাতে কেবল আমাদের বিপদই বাড়ল। একশো গজ দূর থেকে আমরা দুজনই ম্যাগাজিনের সবকটা গুলি শেষ করলাম জানোয়ার দুটোর ওপর। কিন্তু আমাদের গুলি যেন কাগজের তৈরি! কোন প্রতিক্রিয়াই পরিলক্ষিত হলো না জন্তু দুটোর মাঝে। ওরা যে সরীসৃপ প্রকৃতির সেটাই হয়তো জখমের প্রতি ওদের এই বেপরোয়া ভাবের প্রধান কারণ। আমরা দুজনেই ওদের বুক লক্ষ্য করে এতগুলো গুলি করার পরেও ওদের যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব। ওদের কোন মগজ নেই, পুরো মেরুদন্ড জোড়া বুদ্ধি আর স্নায়ু। আধুনিক অস্ত্র দিয়ে ওদের ঘায়েল করা খুবই শক্ত—প্রায় অসম্ভব।

তবে একটা কাজ হলো। শব্দ আর রাইফেলের আগুন দেখে ওরা ইন্ডিয়ানদের ছেড়ে এবার আমাদের দিকে ধাবিত হলো। তাতে ইন্ডিয়ানরা এবং আমরা দুজন সবাই নিরাপদে সিড়ি পর্যন্ত যাবার সুযোগ পেলাম।

আমাদের কনিকাল বিস্ফোরক বুলেটও যেখানে কিছু করতে পারল না, সেখানে স্থানীয় লোকদের তীরে কিছুটা কাজ হলো। তীরের মাথায় স্ট্রোফেনবাস বিষ মাখানো, সেটা আবার পচা মাংসের মধ্যে রেখে বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত। কিন্তু তীর দিয়ে সাথে সাথে কোন কাজ হলো না, কারণ সরীসৃপের দেহের রক্ত সঞ্চালনের সাথে বিষ মিশতে বেশ দেরি হয়। তবে তীরের বিষক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত তারা মারা যাবে এটা ঠিক।

জন্তু দুটো গুহার নিচে বিফল আক্রোশে হুঙ্কার দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতি মুহূর্তেই প্রত্যেক গুহার মুখ থেকে শিস ছেড়ে তীর বিঁধছে ওদের গায়ে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে একেবারে সজারুর কাঁটার মত তীর বেরিয়ে রয়েছে ওদের দেহ থেকে—কিন্তু তবু কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ওদের। তখনও সমানে হুঙ্কার ছেড়ে চলেছে। যে পথে শত্রু পালিয়েছে সেই সিড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ উঠেই একটা জন্তু ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে; শেষ পর্যন্ত বিষ কাজ করেছে।

ইন্ডিয়ানদের একজন ভারি গলায় একটা ডাক ছেড়ে তার চ্যাপ্টা মাথাটা মাটিতে ঠেকাল। অপর জন্তুটা চক্রাকারে কিছুক্ষণ ঘুরল, চড়া গলায় আর্তনাদও করল, তারপরে সে-ও ধরাশায়ী হলো। খানিকক্ষণ ছটফট করে দ্বিতীয়টাও স্থির হয়ে এল।

লেখার জন্যে আমার ডেস্ক হচ্ছে একটা খালি মাংসের টিন, আর বাকি অন্যান্য উপকরণ হচ্ছে একটা ভোতা পেনসিল আর অবশিষ্ট একটা দুমড়ানো নোট বই। কোনদিন যদি এর চেয়ে ভাল সুযোগ সুবিধা পাই তবে এই আক্কালা ইন্ডিয়ানদের সম্পর্কে বিশদ ভাবে লিখব। ওদের সাথে আমাদের কেমন কাটল, আর অদ্ভুত এই মেপল হোয়াইট ল্যান্ডের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার কথা। প্রায় এক মাস হয়ে এল আমরা এখানে আছি। ছোটকালের বিশেষ ঘটনাগুলো যেমন মনে গেঁথে থাকে, এখানকার প্রতি ঘণ্টার বিস্ময়কর আর উত্তেজনাময় ঘটনাগুলোও আমার মনে ঠিক তেমনি উজ্জ্বলভাবে গেঁথে রয়েছে—ভুলে যাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই।

সময় এলে বিশদ ভাবে আমি বর্ণনা করব সেই জোছনা রাতে বাচ্চা ইচিথিওসরাসটা কেমন করে ইন্ডিয়ানদের জালে ফেঁসে সরু নৌকাটা উল্টে দেয়ার জোগাড় করেছিল। দেখতে ওটা অর্ধেক সীল আর অর্ধেক মাছের মত। দুটো চোখ মাথার দুপাশে অনেকটা বাইরে, যেন খুঁড়ে বের করা হয়েছে, আর তৃতীয় চোখটা ঠিক মাথার মাঝখানে।

সেই একই রাতে লেকের একটা সবুজ সাপ নলখাগড়ার ভিতর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসে চ্যালেঞ্জারের মাঝিকে লেজে পেঁচিয়ে নিয়ে গেল। আরও লিখব আমি সেই বিরাট সাদা জিনিসটার কথা–ওটা জন্তু নাকি সরীসৃপ আজও জানি না আমি। লেকের পুব দিকের জলায় থাকে। রাতের বেলায় সেটার গা থেকে আলো বের হয়, অন্ধকারে জ্বলে ওটা। ইন্ডিয়ানরা ওকে ভীষণ ভয় পায়, কিছুতেই ওদের কাছে নেয়া গেল না। দুবার আমরা নিজেরাই অভিযান চালিয়ে ওকে দেখেছি কিন্তু জলা যায়গার ঘন আগাছা আর শ্যাওলার মধ্যে দিয়ে অনেক চেষ্টা করেও কাছে যেতে পারিনি। আমি এটুকু বলতে পারি যে আকৃতিতে একটা গরুর চেয়ে কিছু বড় হবে, আর ওটার শরীর থেকে মৃগনাভির মত একটা অদ্ভুত সুগন্ধি আসে।

সেদিন চ্যালেঞ্জারকে তাড়া করেছিল উটপাখির চেয়েও বড় একটা ছুটন্ত পাখি। দৌড়ে কোনমতে একটা উঁচু পাথরে চড়ে বসলেন চ্যালেঞ্জার, কিন্তু তার আগেই পাখিটা তার পায়ে ঠোকর দিল, বুটের গোড়ালিটা কেটে রয়ে গেল ওর ভয়ঙ্কর বাঁকা ঠোঁটে। যেন বাটাল দিয়ে কেউ কেটে নিয়েছে জুতোটা। শকুনের মত গলা, মাথাটা দেখতে বিকট, ঠিক যেন একটা চলন্ত যম। লর্ড জনের গুলি খেয়ে পাখিটা মাটিতে পড়ে পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে ডানা ঝাপটাল কিছুক্ষণ। হয়তো একদিন পাখির ওই চ্যাপ্টা ভীষণ দর্শন মাথাটা আলবেনির বৈঠকখানায় অন্যান্য জীবজন্তুর মাথার মাঝে দেখার সৌভাগ্য আমার হবে।

ফোরোরেকাস! চ্যালেঞ্জার হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রায় বারো ফুট লম্বা।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে আমরা দেশে ফেরার চেষ্টা না করে মিছে এখানে কেন সময় নষ্ট করছি। এর উত্তর হচ্ছে আমরা প্রত্যেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করছি, কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাদের সব চেষ্টাই বিফল হয়েছে।

একটা জিনিস আমরা খুব স্পষ্টভাবেই টের পেয়েছি, সেটা হচ্ছে এই ইন্ডিয়ানরা আমাদের জন্যে সব কিছু করতে প্রস্তুত, কিন্তু আমাদের এখান থেকে চলে যাবার ব্যাপারে ওরা বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে রাজি নয়।

যখনই আমরা বড় একটা গাছ কেটে সেটা বয়ে নিয়ে গিয়ে পুল তৈরি করার কথা কিংবা চামড়ার ফিতে দিয়ে দড়ি তৈরি করে দেয়ার কথা বলেছি তখনই ওরা কেবল হেসে মাথা নেড়েছে। এমন কি বুড়ো চীফ পর্যন্ত আমাদের সাহায্য করতে নারাজ।

কেবল মারিটাস-চীফের ছেলের হাবেভাবে বোঝা যেত যে আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদের আটকে রাখায় সে সত্যিই ব্যথিত। বনমানুষের সাথে যুদ্ধে জয় হওয়ার পর থেকেই ওরা আমাদের অতিমানব বলে ধরে নিয়েছে। ওদের ধারণা আমাদের বিশেষ কোন অলৌকিক শক্তি আছে এবং আমরা যতদিন ওদের সাথে থাকব ততদিন ওদের আর কোন দুর্ভোগ সইতে হবে না। আমাদের প্রত্যেককে অবাধে একটা করে বউ আর একটা করে নিজস্ব গুহা নেয়ার জন্যে অনেক সাধাসাধি করছে ওরা—তবু যদি নিজের আত্মীয় স্বজনের কথা ভুলে ওদের সাথে মালভূমিতে থেকে যাই! আমাদের সাথে অত্যন্ত ভাল ব্যবহার করলেও ওদের ভাবগতিক দেখে আমরা ঠিক করলাম যে মালভূমি ছাড়ার পরিকল্পনা ওদের কাছ থেকে গোপন রাখব। আমাদের ভয় যে ওরা শেষ পর্যন্ত না আমাদের জোর করে ধরে রাখার চেষ্টা করে।

ডাইনোসরের ভয় থাকা সত্ত্বেও আমি গত তিন সপ্তাহে দুবার আমাদের পুরানো ক্যাম্পে গেছি। অবশ্য ডাইনোসরেরা রাতের বেলাই সাধারণত বের হয় শিকারে। দেখলাম, জাম্বাে নিষ্ঠার সাথে আমাদের মালপত্র পাহারা দিচ্ছে নিচের ক্যাম্পে। দূরে বিশাল সমতল ভূমির দিকে চেয়ে থেকে থেকে আমার চোখে জ্বালা ধরে গেল কিন্তু কোন সাহায্য আসার চিহ্ন চোখে পড়ল না।

শিগগিরই এসে পড়বে ওরা, মাসসা মালোন, বলল জাম্বাে, এক সপ্তাহ পার হবার আগেই দড়ি নিয়ে ফিরে আসবে লোক ইন্ডিয়ান গ্রাম থেকে। আপনাদের আমরা নামিয়ে আনব। জাম্বাের গমগমে গলায় অভয়বাণী শুনে মনটা অনেক হালকা হয়ে গেল আমার।

দ্বিতীয়বার ফেরার পথে আমার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো। এবারে সারা রাত একাই কাটিয়েছি আমি ফোর্ট চ্যালেঞ্জারে। সকালে চেনা পথ ধরে ফিরে চললাম আমি। টেরাড্যাকটিলের ডেরার কাছাকাছি আসতেই দেখলাম এক অদ্ভুত জিনিস এগিয়ে আসছে আমার দিকে। একটা বেতের ঘণ্টার আকারের খাঁচার ভিতরে একটা মানুষ। আরও আশ্চর্য হলাম আমি কাছে গিয়ে যখন দেখলাম যে ব্যক্তিটি আর কেউ নয়, স্বয়ং লর্ড জন। আমাকে দেখে তিনি তার আবরণের ভিতর থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলেন। কেমন যেন গোলমেলে ঠেকল আমার কাছে ব্যাপারটা।

এই যে, ম্যালোন, তোমার সাথে এখানে হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি, বললেন জন।

ঘটনাটা কি, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি। ওর ভিতরে ঢুকে কি করছেন আপনি?

টেরাড্যাকটিল বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।

কিন্তু কেন? মাথায় কিছুই ঢুকল না আমার।

আশ্চর্য জীব ওরা, তাই না? কিন্তু মিশুক নয় মোটেও! অপরিচিতদের সাথে খুব দুর্ব্যবহার করে মনে নেই তোমার? তাই আমি এটার আশ্রয় নিয়েছি, এখন আর ঠোকর দিতে পারবে না।

কিন্তু ওই জলাতে আপনার কি কাজ?

আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন তিনি। চেহারায় একটু দ্বিধা প্রকাশ পেল।

তোমার কি ধারণা যে প্রফেসররা ছাড়া আর কারও কিছু জানার থাকতে পারে না?

আমি ওদের একটু কাছে থেকে দেখতে চাই।

আপনার ব্যাপারে নাক গলানোর জন্যে কিছু মনে করবেন না আবার।

না হে, তরুণ বন্ধু। প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের জন্যে একটা বাচ্চা টেরাড্যাকটিল সংগ্রহ করতে হবে আমাকে। না, তোমাকে আসতে হবে না সঙ্গে, এই খাঁচার ভিতরে আমি নিরাপদ, কিন্তু তোমার কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। আসি তাহলে, রাত্রে ক্যাম্পে দেখা হবে।

আমি ফিরে চললাম, জন খাঁচা নিয়ে রওনা হলেন তার পথে।

জনের ব্যবহার সেদিন আমার কাছে একটু অদ্ভুত মনে হয়েছিল, কিন্তু প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের আচরণ যেন আরও বেশি অস্বাভাবিক। দেখা গেল ইন্ডিয়ান মেয়েদের প্রতি তার বেশ দুর্বলতা। ইদানীং সবসময়েই তার পিছনে একদল ভক্ত ইন্ডিয়ান মেয়ের ভিড় দেখা যায়। ব্যঙ্গ নাটকের সুলতানের মত আগে আগে দৰ্পের সাথে হাঁটেন চ্যালেঞ্জার আর বিস্ফারিত চোখে সামান্য গাছের বাকল পরা ইন্ডিয়ান মেয়েদের মিছিল চলে তার পিছনে।

সামারলী তার পুরো সময়টা মালভূমির পোকামাকড় আর পাখি নিয়ে কাটান। যেটুকু অবসর পান তা কাটান চ্যালেঞ্জারের সাথে ঝগড়া করে—কেন আজ পর্যন্ত নিচে নামার ব্যবস্থা করতে পারলেন না।

প্রতিদিন সকালে চ্যালেঞ্জার তার ভক্তের দল নিয়ে একা একা কোথায় চলে যান। যখন ফেরেন তখন ভাব দেখে মনে হয় গোটা পৃথিবীর সব দায়িত্ব যেন তাঁরই কাঁধে। একদিন দলবল সহ আমাদের সবাইকে নিয়ে গেলেন তিনি তাঁর গোপন আস্তানায়।

একটা ছোট্ট ফাঁকা জায়গা, পামগাছে ঘেরা। পাশেই একটা গ্যাস-বুদ্বুদের জলা, ওটার চারদিকে ইগুয়েনড়নের চামড়ার পাতলা পাতলা ফালি; কাছেই রয়েছে লেকের সেই বিরাট মৎস্য-সরীসৃপের পাকস্থলীর তৈরি চুপসান আবরণ। বিরাট ছালার মত জিনিসটা সেলাই করে চারদিক আটকানো, কেবল একদিকে একটা ছোট ফাঁক রাখা হয়েছে। লম্বা নলখাগর নল দিয়ে জলা থেকে গ্যাস সংগ্রহ করে ওই ছোট ফাঁকটা দিয়ে থলেতে ভরা হচ্ছে। অল্পক্ষণ পরেই দেখা গেল থলেটা ধীরে ধীরে ফুলে উঠছে। আকাশে উড়ে যাবার উপক্রম হতেই চ্যালেঞ্জার লাফিয়ে ওটাকে ধরে চামড়ার ফিতে দিয়ে মজবুত করে গাছের সাথে বেঁধে দিলেন। আধ ঘণ্টার মধ্যেই থলেটা বেশ বড় হয়ে ফুলে উঠল। গাছের সাথে বাঁধা চামড়া ফিতেয় বেশ জোর টান পড়ছে, বোঝা গেল বেশ ভারি ওজনও এখন সহজেই তুলতে পারবে ওটা। চ্যালেঞ্জার তার নতুন তৈরি কীর্তির দিকে চেয়ে গর্বিত পিতার মত হাসি হাসি মুখ করে দাড়িতে আঙুল চালাতে লাগলেন। সামারলীই প্রথমে নীরবতা ভাঙলেন।

তীক্ষ্ণ গলায় তিনি বললেন, ওতে চড়িয়ে আমাদের নিয়ে যাবার মতলব নিশ্চয়ই করেননি আপনি?

এর ক্ষমতা আমি সবাইকে প্রদর্শন করার পরে আর কারও মনে কোন দ্বিধা থাকবে না বলেই আমার বিশ্বাস, জবাব দিলেন চ্যালেঞ্জার।

এখনি, এই মুহূর্তে আপনি আপনার মাথা থেকে এই পাগলামির ভুত নামাতে পারেন। দুনিয়ার অমূল্য কোন জিনিসের লোভ দেখিয়েও কেউ আমাকে ওতে চড়াতে পারবে না। বলে জনের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন সামারলী, তোমার কি মত?

এটা কিরকম হয় দেখতে চাই আমি, জবাব দিলেন জন। তাঁর চোখে অবিশ্বাস।

সবাই দেখবে, বললেন চ্যালেঞ্জার। কিছুদিন ধরেই নিচে নামার সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আমি মাথা খাটাচ্ছি। আমরা সবাই নিশ্চিত যে বেয়ে নিচে নামা আমাদের পক্ষে অসম্ভব, আর কোন সুড়ঙ্গ পথও নেই। যেদিক দিয়ে আমরা উপরে উঠেছি সেখানে ফিরে যাবার মত ব্রিজ তৈরিও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং বেলুন ছাড়া উপায় কি? হ্রদের বিশাল জন্তুর পাকস্থলী আর মালভূমির প্রাকৃতিক গ্যাস আমার সমস্যার সমাধান এনে দিয়েছে, ফলাফল দেখুন!

একহাতে হেঁড়া জ্যাকেটের সামনের দিক ধরে অন্য হাতে গর্বভরে বেলুনটার দিকে দেখালেন চ্যালেঞ্জার।

বেশ গোল হয়ে ফুলে উঠেছে বেলুনটা, বাঁধা চামড়ার দড়িতে জোর টান পড়ছে।

নেহাত পাগলামি, ফুঁসে উঠলেন সামারলী।

জন বেশ উৎসাহিত। আমার কানে কানে বললেন, বুদ্ধি আছে বটে বুড়োর। তারপর চ্যালেঞ্জারকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের জন্যে ঝুড়ি বা বাস্কেটের কি হবে?

এর পরেই আমি সেদিকে মনোযোগ দেব। কি দিয়ে তৈরি হবে, কেমন করে বাঁধা বা ঝুলানো হবে, সেসব পরিকল্পনা আমার তৈরিই আছে। আপাতত আমি দেখাতে চাই বেলুনটা আমাদের প্রত্যেকের ভার নিতে কতখানি সক্ষম।

সবাই একসাথে যাব না আমরা? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

না, আমরা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা ভাবে প্যারাসুটের মত করে নামব। প্রতিবারই বেলুনটাকে নিচে থেকে টেনে উপরে তোলা হবে। একজনের ভার নিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে হালকা ভাবে মাটিতে নামিয়ে দিলে তখন আর কি চাই? এর ভার নেয়ার ক্ষমতা নিজের চোখেই দেখুন আপনারা।

বেসল্টের একটা বড় চাক নিয়ে এলেন চ্যালেঞ্জার। পাথরটার মাঝের দিকটা একটু সরু–দড়ি বাঁধতে সুবিধা। চামড়ার দড়ি বাঁধলেন প্রফেসর পাথরের সাথে। আমাদের সাথে আনা দড়ি দিয়ে জালের মত তৈরি করে বেলুনের উপর বিছিয়ে দড়ির মাথা নিজের হাতে তিন পাক ঘুরিয়ে বেঁধে দিলেন। এখন যে কোন চাপই এক জায়গায় না পড়ে অনেকটা জায়গার উপর সমান ভাবে ভাগ হয়ে বেলুনের ওপর পড়বে।

প্রীত হাসি হেসে চ্যালেঞ্জার বললেন, এইবার আপনাদের আমি আমার বেলুনের বহন ক্ষমতা দেখাব। বলে ছুরি দিয়ে চামড়ার দড়িগুলো কেটে দিলেন তিনি।

বেলুনটা ভীষণ বেগে উপরের দিকে উঠল। মুহূর্তে প্রফেসর চ্যালেঞ্জারকে টেনে শূন্য করে নিয়ে চলল বেলুন। ঝাপিয়ে পড়ে কোনমতে তার কোমর জড়িয়ে ধরলাম আমি। প্রফেসরের সাথে আমিও শূন্যে উঠে গেলাম। জন ছুটে এসে জাপটে ধরলেন আমার পা। আমার মনে হলো তিনিও যেন শূন্যে উঠে আসছেন।

পুরো অভিযানে এমন বিপর্যয় আর ঘটেনি। চারজন অভিযানকারী এ। দড়িতে ঝুলতে ঝুলতে চলেছে শূন্যে, কল্পনায় এরকম ছবি ভেসে উঠল আমার।

ভাগ্য ভাল বেলুনটার ভার তোলার অসীম ক্ষমতা থাকলেও দড়িটার ভার সহ্য করার ক্ষমতা সীমিত ছিল, ছিড়ে গেল ওটা। আমরা স্তুপাকার হয়ে মাটিতে পড়লাম, দড়ির জালটা পড়ল আমাদের ওপর। যখন টলতে টলতে আবার উঠে দাঁড়ালাম ততক্ষণে বেলুনটা পাথরের চাকসহ অনেক উপরে উঠে গেছে এবং তখনও মহা বেগে উপরেই উঠছে। নীল আকাশে বেসল্টের চাকটাকে একটা কালো বিন্দুর মতই দেখাচ্ছে।

চমৎকার! চেঁচিয়ে উঠলেন চ্যালেঞ্জার, একটা পুরোপুরি সন্তোষজনক প্রদর্শনী! এতখানি সাফল্য আমি নিজেও আশা করতে পারিনি। চিন্তা নেই, অল্প সময়ের মধ্যেই আর একটা বেলুন তৈরি করে ফেলব আমি। সেই বেলুনে চড়েই আমরা একে একে সবাই নিরাপদে নিচে নামব।

ঘোঁৎ করে একটা শব্দ তুলে সামারলী তার অসন্তোষ আর অবজ্ঞা জানালেন।

সেদিনই সন্ধ্যায় আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন হলো। আমাদের নিচে নামার চেষ্টায় একমাত্র তরুণ চীফেরই কিছুটা সহানুভূতি আছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদের এখানে আটকে রাখার পক্ষপাতি নয় সে। অন্ধকার হবার পরপরই চীফের ছেলে আমার হাতে গোল করে মোড়ানো একটা গাছের বাকল দিল। কেন জানি না হয়তো আমরা প্রায় সমবয়সী বলেই সব সময়েই কিছু বলতে হলে আমার সাথেই যোগাযোগ করে সে। বাকলটা আমার হাতে দিয়ে উপরে একসারি গুহার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল তারপরে নিজের ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে ইশারায় ঘটনাটা গোপন রাখতে বলে আবার চুপি চুপি ফিরে গেল সে নিজের গুহায়।

আগুনের আলোর সামনে নিয়ে ওটা খুললাম আমরা। এক বর্গ ফুট মত হবে গাছের ছালটা। ভিতরের পিঠে কয়েকটা লম্বা দাগ কাটা। বেশির ভাগই সোজা দাগ, কয়েকটা মাথার দিকে দুভাগ হয়ে গেছে, কোনটা আবার ডানে বা বামে বেঁকে গেছে।

কাঠ কয়লা দিয়ে ভিতরের সাদা পিঠে পরিচ্ছন্নভাবে আঁকা হয়েছে দাগগুলো।

আমি বললাম, এটা আমাদের জন্যে নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা হবে। দেয়ার সময়ে ওর মুখের ভাব থেকেই বোঝা গেছে।

যদি সে ঠাট্টা না করে থাকে, বললেন সামারলী, মানুষের প্রাথমিক উন্নতিগুলোর মধ্যে ঠাট্টাও একটা।

স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে এটা একটা সঙ্কেত, গভীর ভাবে বললেন চ্যালেঞ্জার।

ধাঁধার আসরের মতই মনে হচ্ছে, নাক চুলকাতে চুলকাতে মন্তব্য করলেন জন। ঘাড় লম্বা করে দেখছিলেন তিনি সামনে বিছানো বাকলটা, হঠাৎ উত্তেজিতভাবে খপ করে ওটা হাতে তুলে নিলেন।

আশ্চর্য! চিৎকার করে উঠলেন জন, আমি বোধহয় বুঝতে পেরেছি ধাধার উত্তর। এখানে দেখুন, কয়টা দাগ আছে? আঠারোটা, আমাদের মাথার ওপরও ঠিক আঠারোটা গুহাই আছে।

মারিটাস আমার হাতে ওটা দিয়ে গুহাগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে কি যেন বোঝাবার চেষ্টা করছিল, আমি জানালাম। কিন্তু তাতে কি?

তাহলে আর সন্দেহ নেই যে এটা ওই গুহাগুলোরই নক্সা। কোনটা বেশি গভীর কোনটা কম। কিন্তু এই যে, একটার নিচে একটা কাটা চিহ্ন। সবচেয়ে গভীর গুহা বোঝাবার জন্যেই হয়তো চিহ্নটা দেয়া হয়েছে।

লাফিয়ে উঠলাম আমি, কিংবা এটার মুখ খোলা এমনও হতে পারে!

আমার মনে হয় আমাদের তরুণ বন্ধুই ঠিক ধরেছে, বললেন চ্যালেঞ্জার। নইলে আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী এসে এটা দিয়ে যাবে কেন? গুহাটা যদি ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে থেকে থাকে তাহলে ওটা এদিকের মুখের সমান উঁচুতে হলেও একশো ফুটের বেশি নামতে হবে না আমাদের।

একশো ফুট! ঠোঁট বাকিয়ে বললেন সামারলী, এতদূর নামব কি করে আমরা?

আমাদের এখনও একশো ফুটের বেশি দড়ি আছে, আমি বলে উঠলাম। দড়ি বেয়ে নামতে কোন অসুবিধা হবে না।

কিন্তু গুহার ইন্ডিয়ান বাসিন্দাদের ব্যাপারে কি করা হবে? আপত্তি জানালেন সামারলী।

এসব গুহায় কেউ থাকে না, বললাম আমি। গুদাম হিসাবে এগুলো ব্যবহার করে ওরা। এখনই একবার গিয়ে তদন্ত করে দেখে আসলে কেমন হয়?

এক ধরনের বিটুমিন যুক্ত শুকনো কাঠ আছে মালভূমিতে। এরাউকারিয়া জাতের। ইন্ডিয়ানরা মশাল হিসাবে ব্যবহার করে ওগুলো। প্রত্যেকে ওর একটা করে ডাল সাথে নিয়ে সেই গুহার শ্যাওলা পড়া সিড়িতে পৌঁছলাম আমরা। উপরে উঠে দেখলাম বিরাট কয়েকটা বাদুড় ছাড়া সত্যিই আর কোন প্রাণী নেই গুহায়। ইন্ডিয়ানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার কোন ইচ্ছা ছিল না আমাদের, তাই বেশ কিছু দূর ভিতরে ঢুকে তারপরে মশাল জ্বালালাম। বেশ সুন্দর শুকনো গুহাটা, মসৃণ দেয়ালে এই অঞ্চলের নানান ধরনের ছবি আঁকা। তাড়াতাড়ি এগিয়ে চললাম আমরা। কিছুদূর যেতেই সবাইকে হতাশ করে শেষ হয়ে গেল গুহা। একটা পাথরের দেয়াল পথ আটকে দাঁড়িয়েছে আমাদের। পাথরে এমন একটা ফাটল বা গর্ত নেই যে কোন ইদুরও পার হতে পারবে। অপ্রত্যাশিত বাধাটার সামনে আমরা ব্যথিত হৃদয়ে দাঁড়িয়ে, কোন কিছু ধসে পড়ে যে বন্ধ হয়েছে এই গুহা তা নয়; আদৌ খোলাই ছিল না এটা কোনদিন।

হতাশ হবার কিছু নেই, বললেন আমাদের অদম্য প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। এখনও আমাদের বেলুনে চড়ে নামার পথ খোলা রয়েছে।

চ্যালেঞ্জারের কথায় ককিয়ে উঠলেন সামারলী।

আমরা ভুল গুহায় ঢুকিনি তো? বললাম আমি।

চার্টের ওপর আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন জন, না, এটাই ডান দিক থেকে সতেরো নম্বর আর বাম দিক থেকে দুই নম্বর গুহা, কোন ভুল নেই।

আমি ওঁর আঙ্গুলের তলার দাগটার দিকে চেয়ে উৎফুল্ল হয়ে চিৎকার করে উঠলাম, পেয়েছি। সবাই আমার পিছন পিছন আসুন।

তাড়াতাড়ি ফিরে চললাম আমরা। এইখানেই আমরা মশাল জ্বেলেছি, তাই না? দিয়াশলাইয়ের পোড়া কাঠিগুলো দেখলাম আমি।

ঠিক, সমর্থন করলেন জন।

নক্সায় গুহাটাকে দুটো শাখায় ভাগ হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। আমার বিশ্বাস একটু এগিয়ে গেলেই ডান হাতে পাব গুহার অন্য লম্বা শাখাটা।

আমার কথামত ঠিকই ডানদিকে অপেক্ষাকৃত বড় শাখাটা পাওয়া গেল। ডানদিকের গুহা ধরে দ্রুত এগিয়ে চললাম। হঠাৎ কালো আঁধার ভেদ করে দূরে একটা গাঢ় লাল রঙের আলোর ঝিলিক দেখতে পেলাম। সবাই প্রায় ছুটে এগিয়ে গেলাম ওটার দিকে। কোন শব্দ, কোন তাপ বা কোন গতি নেই, তবু জ্বলছে। গুহার তলায় বালুকণাগুলো আলোর ছটায় অমূল্য মণিমাণিকের মত চকচক করছে।

চাঁদ! চিৎকার করে উঠলেন জন, এপারে এসে পড়েছি আমরা, চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে।

সত্যিই পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যাচ্ছে গুহার মুখে। গুহার মুখটা বেশ ছোট, একটা জানালার চেয়ে বড় হবে না। নিচে উঁকি দিয়ে দেখলাম ওখান থেকে মাটি বেশি দূরে নয়-নামা খুব সহজ হবে। মাটি থেকে কিছুটা উপরে বলেই নিচে থেকে এটা আমাদের চোখে পড়েনি। সবাই উল্লসিত মনে ফিরে এলাম। পরদিন সন্ধ্যায় নিচে নামার উদ্যোগ করব।

আমাদের যা কিছু করার গোপনে আর জলদি করতে হবে। কারণ শেষ মুহূর্তে হয়তো ইন্ডিয়ানরা আমাদের আটকে রাখতে পারে। জিনিসপত্র সবই ফেলে যাব আমরা, কেবল সঙ্গে নেব আমাদের রাইফেল আর গুলি। কিন্তু প্রফেসর চ্যালেঞ্জার গো ধরলেন তাঁর ভারি বাক্সটা অবশ্যই নিতে হবে।

ধীরে ধীরে সারাটা দিন কেটে সন্ধ্যা নামল। আমরা যাবার জন্যে তৈরি হলাম। বাক্সটা অনেক কষ্টে ওই ছোট সিঁড়ি বেয়ে ওপরে তুললাম। উপরে উঠে শেষবারের মত চাইলাম আমি এই অদ্ভুত জায়গাটার দিকে। হয়তো শিগগিরই এটা আর এমন থাকবে না; শিকারী আর অনুসন্ধানকারীর দল এসে এখানকার পবিত্রতা নষ্ট করবে। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের কাছে এটা থাকবে ভালবাসায় ভরা এক অপরূপ স্বপ্ন রাজ্য। এখানে আমরা অনেক সাহস দেখিয়েছি, অনেক ভুগেছি আর শিখেছি। বামদিকের গুহাগুলো রাতের আঁধারে প্রফুল্ল লালচে আভা ছড়াচ্ছে। একটু দূরে দেখা যাচ্ছে লেকটা। থিরথির করে কাঁপছে পানি। অন্ধকার জঙ্গল থেকে একটা জন্তু প্রচন্ড হুঙ্কার দিল। মেপল হোয়াইট ল্যান্ডের পক্ষ থেকে ওই কণ্ঠ যেন আমাদের বিদায় সম্ভাষণ জানাল ঘুরে দাঁড়িয়ে আমরা গুহা পথে এগিয়ে চললাম। এবার বাড়ি ফিরব।

দুঘণ্টা পরে আমরা সব মালসহ মালভূমির নিচে জড় হলাম। চ্যালেঞ্জারের মালটা নামাতেই আমাদের যা একটু বেগ পেতে হলো। মালপত্র সব ওখানেই রেখে আমরা রওনা হলাম জাম্বাের ক্যাম্পের উদ্দেশে। ভোরের দিকে সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম। দূর থেকে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম একটা নয় প্রায় গোটা বারো আগুন জুলছে ওখানে। উদ্ধারকারী দল ইন্ডিয়ান গ্রাম থেকে পৌঁছেচে। বিশজন ইন্ডিয়ান এসেছে, সাথে এনেছে প্রচুর দড়ি আর পুল তৈরির সরঞ্জাম। যাক, আমাদের জিনিসপত্র বয়ে নেয়ার লোকের আর অভাব হবে না। কালই রওনা হবো আমরা আমাজনের দিকে।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত