১৩. আমরা সবাই জেগে উঠলাম সকালে
আমরা সবাই জেগে উঠলাম সকালে। সকলেই গতদিনের উত্তেজনা আর স্বল্প খাবারের পরে বিপর্যস্ত, ক্লান্ত। সামারলী এত দুর্বল হয়ে পড়েছেন যে উঠে দাঁড়ানোও তার জন্যে কষ্টকর। কিন্তু বুড়ো সত্যিই বাপের ব্যাটা, আশ্চর্য মনোবল দিয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছেন। হার স্বীকার করা তাঁর চরিত্রে নেই।
সবাই মিলে ঠিক করা হলো অন্তত ঘণ্টা দুয়েক আমরা যেখানে আছি সেখানেই থেকে সকালের নাস্তা সেরে নেব। এরপর আমরা লেকের পাশ দিয়ে ঘুরে ইন্ডিয়ানদের পৌঁছে দিতে যাব ওদের শহরে। ধরে নিলাম উপকারের পরিবর্তে অপকার করবে না ওরা। এর পরেই আমাদের প্রধান কাজ হবে এখান থেকে বের হবার একটা রাস্তা খুঁজে বের করা। এমন কি প্রফেসর চ্যালেঞ্জারও স্বীকার করলেন যে এখানে আমাদের যতটুকু করার ছিল তা আমরা করেছি—এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আমরা যা জেনেছি সেই জ্ঞান সভ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া।
ইন্ডিয়ানদের ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগ অনেকটা কমে এসেছে। শক্ত সমর্থ তবে আকৃতিতে ওরা অনেক ছোট। ওদের চুল মাথার পিছনে চামড়ার ফিতে দিয়ে গোছা করে বাধা, পরনের সামান্য যে কাপড় তাও চামড়ার, মুখে দাড়ি গোফ নেই, সুদর্শন, স্বভাবও ভাল। কানের লতিগুলো রক্তাক্ত, ঝুলছে; কানের ফুটোয় কোন গয়না সভবত ছিল, কিন্তু বনমানুষরা তা ছিড়ে নিয়েছে। ওদের কথা যদিও বুঝতে পারলাম না তবু মনে হলো ভাষা বেশ উন্নত। আক্কালা শব্দটা অনেকবার উচ্চারণ করল ওরা। বুঝলাম ওটা ওদের জাতির নাম। মাঝে মাঝে হাত মুঠো করে বনের দিকে দেখিয়ে উচ্চারণ করল, ডোডো! ডোডা! অর্থাৎ শত্রু।
জন জিজ্ঞেস করলেন, এদের সম্পর্কে আপনার কি ধারণা, প্রফেসর চ্যালেঞ্জার?
আমার তো ধারণা ওই বেলমুন্ডা লোকটাই সর্দার গোছের কেউ হবে।
সেটা অবশ্য তাদের ব্যবহারেও স্পষ্ট ফুটে উঠছিল। তার সাথে কথা বলার সময়ে প্রত্যেকেই আগে সম্মানসূচক সঙ্কেত করে পরে কথা বলছিল। বয়সে সবচেয়ে ছোট দেখালেও একটা আভিজাত্য আছে তার চলাফেরায়। প্রফেসর তার মাথায় হাত রাখতেই সে প্রথমে আহত ঘোড়ার মত ছিটকে দূরে সরে গেল। পরে নিজের বুকে হাত রেখে কয়েকবার মারিটাস শব্দটা উচ্চারণ করল। একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে চ্যালেঞ্জার পাশের ইন্ডিয়ানটার কাঁধ ধরে লেকচার দেয়া আরম্ভ করলেন, যেন তার ক্লাসেরই একটা প্রদর্শনীর নমুনা সে।
এই প্রকার মানুষ, চ্যালেঞ্জার তার নিজস্ব ভঙ্গিতে আরম্ভ করলেন, এদের যেভাবে বা যে দৃষ্টিভঙ্গিতেই বিচার করা যাক না কেন, বলা যাবে না যে এরা নিম্ন শ্রেণীর। পক্ষান্তরে বলা যায় যে এরা দক্ষিণ আমেরিকার বহু উপজাতীয়দের চেয়ে অনেক উন্নত এবং ক্রমবিকাশে এরা বনমানুষ থেকে এতই ভিন্ন যে এরা এই মালভূমির অন্যান্য জীবজন্তুর সমসাময়িক হতেই পারে না।
তবে কি ওরা আকাশ থেকে পড়েছে? একটু ফোড়ন কাটলেন লর্ড জন।
খুব ভাল প্রশ্ন করেছেন, শান্ত ভাবেই জবাব দিলেন চ্যালেঞ্জার। এ নিয়ে ইউরোপ আমেরিকায় বিতর্কের ঝড় উঠবে একদিন। তবে আমার মতামত যদি জিজ্ঞেস করো, বুকভরে শ্বাস নিয়ে শিষ্যদের দিকে কৃপার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন চ্যালেঞ্জার, তবে আমি বলব যে এরা বাইরে থেকেই এসেছে। এমনও হতে পারে যে দক্ষিণ আমেরিকায়, এক জাতের এনথ্রোপয়েড যে বনমানুষ ছিল তারাই বহু যুগ আগে কোন এক সময়ে এখানে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু তাদের প্রবল সংগ্রাম করতে হচ্ছে বিভিন্ন জীবজন্তুর সাথে বিশেষ করে বনমানুষের সাথে। বনমানুষরা এদেরকে অনাহুত মনে করে নির্মম আঘাত হানতে চেষ্টা করছে সব সময়েই। এই কারণেই এদের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। ধাঁধাটার উত্তর কি সবার কাছে পরিষ্কার হয়েছে নাকি কারও কোন প্রশ্ন আছে?
সামারলীর মনের অবস্থা তখন এমন যে তিনি আর তার সহকর্মীর সঙ্গে বিতর্কে নামলেন না। প্রবল ভাবে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেন কেবল। জন মাথা চুলকে জানালেন যে দুজন সম-ওজনের না হওয়ায় তিনিও আর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামবেন না। পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনারচনার মাঝে ছন্দ পতন ঘটিয়ে আমি আমার স্বাভাবিক সরল পদ্ধতিতেই সবাইকে মনে করিয়ে দিলাম যে চারজনের মধ্যে মাত্র তিনজন ইন্ডিয়ান এখন আমাদের মাঝে আছে, আরেকজন নেই।
একটা খালি মাংসের টিনে করে পানি আনতে গেছে সে, জবাব দিলেন জন।
পুরানো ক্যাম্পে গেছে? না ঝর্নায়, ওই গাছগুলোর পিছনে, দুশো গজও হবে না এখান থেকে।
আমি দেখছি ও কোথায় গেল, রাইফেলটা তুলে নিয়ে পানির ধারার দিকে এগুলাম আমি। সঙ্গীরা ব্যস্ত রইলেন নাস্তা তৈরির কাজে।
সাহস করে একাই এগুলাম আমি। বনমানুষের আস্তানা থেকে আমরা এখন অনেক মাইল দূরে, তাই খুব একটা ভয়ের কারণ নেই। পানির ধারা বয়ে যাওয়ার শব্দ কানে আসছে আমার। কতগুলো গাছ আর ঝোপের ওপাশেই ধারাটা। ক্যাম্পের সবার চোখের আড়ালে চলে এসেছি আমি। হঠাৎ নজরে পড়ল একটা গাছের তলায় ঝোপের ভিতর লালচে কি যেন দলা পাকিয়ে পড়ে আছে। সামনে গিয়ে বুকটা ধড়াস করে উঠল আমার-ইন্ডিয়ান লোকটার মৃতদেহ পড়ে আছে।
কাত হয়ে পড়ে রয়েছে দেহটা, হাত পা দুমড়ানো। ঘাড় মটকে ভেঙে মাথাটা উল্টো দিকে ঘুরে রয়েছে। চিৎকার করে আমার সঙ্গীদের সাবধান করে দিলাম, কোথাও গোলযোগ আছে। ছুটে দেহটার কাছে গেলাম হঠাৎ এক অজানা কারণে ভয়ে চুপসে গেলাম আমি। পাতার শব্দে উপরের দিকে চেয়েই চক্ষু স্থির হয়ে গেল; আমার মাথার কাছে সবুজ লতা পাতার ভিতর থেকে লালচে লোমে ভরা দুটো হাত নিচে নেমে আসছে। আর একটু হলেই হাত দুটো গলা চেপে ধরত আমার। লাফিয়ে পিছনে সরে গেলাম, কিন্তু আরও দ্রুত নামল সেই হাত দুটো। হঠাৎ সরে যাওয়ায় ঠিক মত ধরতে পারল না আমাকে, একটা হাত পড়ল আমার মুখের উপর, আরেকটা হাত ঘাড়ে। গলা বাঁচাতে দুহাত উপরে ছুঁড়ে দিলাম কিন্তু তার আগেই আমার মুখ থেকে থাবাটা নিচে নেমে গলা চেপে ধরল। আমাকে শূন্যে তুলে ফেলেছে জানোয়ারটা—প্রচন্ড শক্তিতে আমার মাথা পিছন দিকে ঠেলছে সে। ঘাড়ে মারাত্মক চাপ অনুভব করছি আমি—অসহ্য যন্ত্রণা, জ্ঞান হারানোর অবস্থা হলো আমার। সর্বশক্তি দিয়ে আমার থুতনির উপর থেকে ওর হাতটা কোনমতে সরালাম। চেয়ে দেখলাম ভয়ঙ্কর একটা মুখের দুটো কঠিন নির্দয় হাল্কা নীল চোখ চেয়ে আছে আমার দিকে। অদ্ভুত সম্মােহনী ক্ষমতা ওই চোখের। শক্তি পাচ্ছি না। আর আমি, আমাকে শিথিল হয়ে আসতে দেখে ওর বীভৎস মুখের দুধারে দুটো সাদা কুকুরে দাঁত ঝিক করে বেরিয়ে এল; এবার আরও জোরে চেপে ধরল সে আমার চিবুক-পিছন দিকে ঠেলছে ক্রমাগত। সাদাটে কুয়াশার মত ঝাপসা হয়ে এল আমার চোখ, অসংখ্য ঘণ্টা বাজতে লাগল কানে। দূর থেকে একটা রাইফেলের শব্দ যেন আমার কানে এল। মাটিতে পড়ার একটা ঝাকি কতকটা অবচেতন ভাবে অনুভব করলাম।
জ্ঞান ফিরতে দেখলাম, আমি আমাদের গোপন আস্তানায় ঘাসের উপর চিত হয়ে শুয়ে আছি। কে একজন পানি নিয়ে এসেছে ঝর্না থেকে, জন আমার মাথায়, চোখে মুখে পানি ছিটাচ্ছেন। প্রফেসর চ্যালেঞ্জার আর সামারলী হুমড়ি খেয়ে উদ্বিগ্ন চোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে। এই প্রথম একটু আভাস পেলাম যে তাঁদের বিজ্ঞানের মুখোশের অন্তরালেও কোমল একটা মানুষের মন বিরাজ করছে।
এ যাত্রা জোর বেঁচে গেছ হে, বললেন জন, তোমার চিৎকার শুনে ছুটে গিয়ে তোমাকে কাটা মুরগীর মত শূন্যে দাপাতে দেখে ধরে নিয়েছিলাম বুঝি একজন সঙ্গী হারালাম আমরা। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে সই ঠিক না হলেও কাজ হয়েছে। গুলির শব্দ শুনেই তোমাকে ফেলে ছুটে পালিয়েছে ও। খোদার কসম বলছি পঞ্চাশজন রাইফেলধারী লোক যদি পেতাম তবে ওগুলোকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে জায়গাটাকে কলুষমুক্ত করে যেতাম।
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে কোন ভাবেই হোক বনমানুষগুলো আমাদের অবস্থান জেনে গেছে। দিনে অবশ্য খুব একটা ভয় নেই আমাদের, ওরা আক্রমণ করলে করবে রাতের অন্ধকারেই। সুতরাং ওদের থেকে যতদূরে সরে যেতে পারি ততই মঙ্গল। আমাদের তিন দিকেই বেশ ঘন জঙ্গল, ওখানে ওত পেতে আমাদের ফাঁদে ফেলা বনমানুষের পক্ষে খুবই সহজ। বাকি দিকটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে লেকের দিকে। এদিকটায় কেবল ছোট ছোট ঝোপঝাড়, বড় গাছ কম, মাঝে মাঝে ফাঁকা মাঠও আছে। এই পথেই সেই রাতে আমি লেকের পাড়ে পৌঁছেছিলাম। এই পথেই আমরা এখানকার স্থানীয় লোকদেরকে তাদের গুহায় পৌঁছে দেব।
আমাদের ক্যাম্প ফোর্ট চ্যালেঞ্জার থেকে আরও দূরে সরে যেতে হচ্ছে বলে মন খারাপ লাগছে। কেবল যে খাবার আর ফেলে আসা জিনিসপত্রের জন্যেই দুঃখ হচ্ছে তাই নয়, জাম্বাের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়াতে খারাপ লাগছে আরও বেশি। যা হোক, যথেষ্ট গোলাগুলি সাথে করে নিয়ে এসেছি—আপাতত আমরা নিশ্চিন্ত। সুযোগ পেলেই আমরা ওখানে ফিরে যাব আশা রাখি। বিশ্বস্ত জাম্বাে যখন প্রতিজ্ঞা করেছে, তখন সে ঠিকই ওখানে অপেক্ষা করবে আমাদের জন্যে।
দুপুরের পরেই রওনা হয়ে গেলাম আমরা। তরুণ চীফ আগে আগে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। বোঝা বইতে কিছুতেই রাজি হলো না সে। তার পিছনে পিছনে চলেছে ইন্ডিয়ান দুজন, তাদের পিঠে আমাদের সামান্য কিছু সামগ্রী। সবশেষে আমরা চারজন, প্রত্যেকেই রাইফেল হাতে তৈরি। আমরা রওনা হতেই পিছনের ঘন জঙ্গল থেকে বনমানুষের বিকট উলুধ্বনি উঠল। হয়তো আমাদের চলে যেতে দেখে বিজয় উল্লাস করছে ওরা। পিছনে ফিরে গাছের সবুজ পাতার পর্দা ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না। কিন্তু আওয়াজের জোর শুনে সহজেই অনুমান করলাম যে গাছের আড়ালে শত শত বনমানুষ এতক্ষণ ধরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল। তবে আমাদের আক্রমণ করার কোনো চেষ্টা দেখা গেল না ওদের মধ্যে।
আমি সবার পিছনে। অনেকটা ফাঁকা জায়গায় চলে এসেছি আমরা। এখন আর বিশেষ ভয় নেই। আমার সামনের তিনজনের চেহারার দিকে চেয়ে হাসিই পেল আমার। এই কি সেই লর্ড রক্সটন যিনি সেদিন তার বৈঠকখানায় গোলাপী আভার আলোতে আর ইরানী গালিচার মাঝে ফিটফাট সাহেব হয়ে বসে ছিলেন? আর এই কি সেই প্রফেসর যিনি এনমোর পার্কের বাসায় তার বিশাল পাঠাগারে বিরাট ডেস্কটার পিছনে বসে ছিলেন? আর সব শেষে, এই কি সেই তীক্ষ্ণ চেহারার প্রফেসর যিনি সেদিন প্রাণী বিজ্ঞানীদের সভায় প্রতিবাদ করতে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন? সারে লেনের কোন বেকার ভবঘুরের চেহারাও তো এত হতাশ আর গরীব দেখায় না। একথা সত্যি যে আমরা মাত্র এক সপ্তাহ হয় মালভূমির মাথায় উঠেছি, কিন্তু আমাদের বাড়তি জামাকাপড় সবই নিচের ক্যাম্পে রয়ে গেছে। আর এই একটা সপ্তাহ আমাদের সবারই জীবনের সবচেয়ে কঠিন সপ্তাহ গেছে। আমার উপর দিয়েই সবচেয়ে কম চোট গেছে, কারণ আমাকে বনমানুষের পাল্লায় পড়ে হয়রান হতে হয়নি। আমার কমরেড তিনজনের কারও মাথায়ই টুপি নেই, এখন রুমাল বেঁধেছেন তারা মাথায়। জামাগুলো ফিতের মত ঝুলছে তাদের গায়ে। দাড়ি না কাটার ফলে সবার মুখেই বড় বড় দাড়ি গজিয়েছে, এখন চেহারা চেনাই দায়। চ্যালেঞ্জার আর সামারলী দুজনেই বেশ খুঁড়িয়ে হাঁটছেন, আর আমি চলেছি মাটির উপর দিয়ে পা টেনে টেনে। সকালের দুর্ঘটনায় জখম না হলেও বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছি, বাঁকা মুঠোর চাপে আমার ঘাড়টা আড়ষ্ট হয়ে আছে। আমাদের চারজনকে দেখাচ্ছে যেন চারজন হতভাগা। তাই আমাদের ইন্ডিয়ান সঙ্গীরা যখন বারবার অবাক ভীত চোখে পিছনে ফিরে ফিরে দেখতে লাগল আমাদের, তখন মোটেও অবাক হলাম না আমি।
বিকালের দিকে লেকের ধারে পৌঁছে গেলাম। ঝোপ থেকে বেরিয়ে শান্ত পানির ধারে দাঁড়াতেই আমাদের ইন্ডিয়ান সাথীদের মাঝে বেশ উত্তেজনা আর খুশির ভাব দেখা গেল। আঙ্গুল দিয়ে ওরা বারবার লেকের দিকে দেখতে লাগল। পানির ওপর দিয়ে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে অনেকগুলো সরু সরু লম্বা নৌকা। তখনও নৌকাগুলো কয়েক মাইল দূরে। কিন্তু খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে ওরা, আমাদের চেহারা চিনতে পারার মত কাছে এসে পড়ল। হঠাৎ উল্লসিত চিৎকারে ফেটে পড়ল ওরা। উত্তেজনায় সবাই নৌকার উপর দাঁড়িয়ে গেল। আনন্দে বৈঠা আর বর্শা আকাশের দিকে ঝাঁকাচ্ছে। তারপরই বৈঠা হাতে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল এবং বাকিটুকু যেন প্রায় উড়ে চলে এল। পাড়ে নৌকা রেখে সবাই ছুটে এল আমাদের দিকে। তরুণ চীফের সামনে এসে সবাই উচ্চস্বরে সম্বর্ধনা জানাল।
শেষে তাদের মধ্যে থেকে একজন বৃদ্ধ লোক এগিয়ে এল। গলায় বড় বড় সুন্দর উজ্জ্বল পুঁথির মালা, হাতে পুঁতির বাহুবন্ধনী, কাঁধে হলুদ রঙের অপূর্ব সুন্দর কোন প্রাণীর চামড়া। সে এগিয়ে এসে খুব আদবের সাথে তরুণ চীফকে জড়িয়ে ধরল। তারপর আমাদের দিকে ফিরে তাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল। জবাব শুনে ধীরে ধীরে সে এগিয়ে এল আমাদের দিকে। একে একে সবাইকে আন্তরিকতার সাথে জড়িয়ে ধরে কৃতজ্ঞতা জানাল বৃদ্ধ। তার হুকুমে আমাদের সম্মানে সবাই যার যার অস্ত্র মাটিতে রেখে মাটিতে শুয়ে সালাম জানাল।
ব্যক্তিগতভাবে আমার এসব আনুষ্ঠানিকতায় কেমন যেন একটু লজ্জাই লাগছিল। জন আর সামারলীরও দেখলাম আমার মতই অবস্থা, কিন্তু আমাদের প্রফেসর চ্যালেঞ্জার যেন সূর্যমুখী ফুলের মতই দীপ্ত হয়ে ফুটে উঠেছেন, এমন ভাব। তিনি সবটাই রীতিমত উপভোগ করছেন।
ওরা অনুন্নত হতে পারে, দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন চ্যালেঞ্জার, কিন্তু ওদের এই যে ঊর্ধ্বতনের প্রতি শ্রদ্ধা এ থেকে আমাদের উন্নত ইউরোপেরও শিক্ষা নেয়ার জিনিস আছে।
স্পষ্টই বোঝা যায় ওরা সবাই যুদ্ধের জন্যে তৈরি হয়ে এসেছে। প্রত্যেকের হাতেই বর্শা না হয় সড়কি, লম্বা বাঁশের মাথায় পাথর বাধা, তীর ধনুক, গদা বা কোমরে পাথরের কুঠার ঝুলছে। আমরা যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে ওরা বারবার চাওয়া চাওয়ি করতে করতে ডোডা ডোডা উচ্চারণ করতে লাগল। তা থেকে বোঝা গেল যে তারা এসেছে তাদের বুড়ো চীফের ছেলেকে উদ্ধার করতে, অন্যথায় প্রতিশোধ নিতে।
ওরা সবাই গোল হয়ে বসে একটা আলোচনা সভা করল। আমরা সামান্য একটু দূরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। দুজন যোদ্ধা তাদের বক্তব্য প্রকাশ করল। সব শেষে আমাদের তরুণ চীফ উঠে দাঁড়াল। হাত পা নেড়ে এমন অনবদ্য আর রক্ত গরম করা বক্তৃতা দিল সে যে তার ভাষা না বুঝলেও বিষয়বস্তু বুঝতে কোনই অসুবিধা হলো না আমাদের।
তরুণ চীফ বলল, ফিরে গিয়ে কি লাভ? আজ হোক কাল হোক আমাদের একদিন এদের মোকাবিলা করতেই হবে। তোমাদের সাথী বন্ধু বান্ধবকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি বেঁচে ফিরে এসেছি, কিন্তু তাতে কি? অন্যেরা তো সবাই মারা পড়েছে। আমাদের কোন নিরাপত্তা নেই, কারও জন্যেই না। আজ আমরা তৈরি হয়েই একত্রিত হয়েছি। এরপর আমাদের দেখিয়ে সে বলল, এই আশ্চর্য মানুষগুলো আমাদের বন্ধু। এঁরা প্রত্যেকেই অসম সাহসী যোদ্ধা। আর কোনদিন আমাদের এমন সুযোগ আসবে না, চলো আজ সবাই মিলে অগ্রসর হই। হয় বাকি জীবনটা সুখে শান্তিতে কাটাব আর না হয় সবাই মরব আজ। এছাড়া কোন্ মুখে মেয়ে মহলে মুখ দেখাব আমরা?
সবাই ধীরে ধীরে উত্তেজনার চরমে পৌঁছল। বক্তার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই সবাই উল্লাস ধ্বনি করে নিজ নিজ অস্ত্র আকাশে উচিয়ে ধরল। বুড়ো চীফ এগিয়ে এল আমাদের দিকে, জঙ্গলের দিকে নির্দেশ করে কিছু বলল। জন হাতের ইশারায় তাকে আমাদের জবাবের জন্যে একটু অপেক্ষা করতে বলে আমাদের দিকে ফিরলেন।
এখন সব কিছু আপনাদের উপর নির্ভর করছে, আরম্ভ করলেন জন। আমি কেবল নিজের কথাই বলতে পারি। ওই বানরদের সাথে আমার বোঝাপড়া শেষ হয়নি। আমি যাব আমাদের এই ছোট বন্ধুদের সাহায্য করতে। আমাদের তরুণ সঙ্গীর মত কি?
আমি আছি আপনার সাথে, জবাব দিলাম আমি।
প্রফেসর চ্যালেঞ্জার?
অবশ্যই আমিও যাব তোমাদের সাথে, অত্যন্ত প্রত্যয়ের সাথে জবাব দিলেন চ্যালেঞ্জার।
আর প্রফেসর সামারলী?
আমরা আমাদের এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছি, লর্ড জন। লন্ডন থেকে রওনা হবার সময়ে আমি ভাবিনি যে আমরা বনমানুষের বিরুদ্ধে অসভ্য মানুষের একটা দলকে নেতৃত্ব দেব।
সেটা আমরাও ভাবিনি, হেসে জবাব দিলেন জন। কিন্তু আমাদের সামনে এই সমস্যা উপস্থিত, এখন আপনার রায় কি?
মনস্থির করা খুবই কঠিন, শেষ পর্যন্তও তর্ক করলেন তর্কবাগিশ সামারলী। কিন্তু সবাই যখন যাওয়াই মনস্থ করেছেন তখন আমার পিছনে পড়ে থাকার কোন অর্থ হয় না।
তাহলে এই সিদ্ধান্তই রইল, বলে ওদের দিকে ফিরলেন জন। মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের রাইফেলে চাপড় মেরে রাইফেলটা উঁচিয়ে ধরলেন তিনি।
সবাই একযোগে চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করল। বুড়ো চীফ আমাদের সবার সাথে হাত মেলালেন।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, আজ আর আক্রমণ করার সময় নেই। রাত কাটাবার জন্যে ওরা চারদিকে আগুন জেলে ব্যুহ তৈরি করল। কয়েকজন জঙ্গলে গিয়েছিল, তারা ফিরে এল একটা বাচ্চা ইগুয়েনোডন সাথে নিয়ে। অন্যান্যগুলোর মত এটার কাঁধেও দেখলাম আলকাতরার দাগ।
একটু পরে ইন্ডিয়ানদের মধ্য থেকে একজন এগিয়ে এসে ওটাকে জবাই করার অনুমতি দিল। এবার বোঝা গেল ওগুলো কিসের দাগ। গরু দাগানোর মতই মালিকানা চিহ্নিত করার জন্যে দেয়া হয় আলকাতরার দাগ। পোষা জন্তুর মত এগুলো। দেখতে বিশাল হলেও তৃণভোজী, নিরীহ। যেটুকু মগজ ওদের তাতে যে কোন বাচ্চা ছেলের পক্ষেও ওদের জড় করে তাড়িয়ে নিয়ে আসা সম্ভব।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লেক থেকে বর্শা দিয়ে শিকার করা বিরাট আঁশওয়ালা গ্যানয়েড মাছের সাথে ইগুয়েনডনের টুকরাগুলো আগুনের উপর ঝলসানো হলো।
সামারলী বালুর উপর শুয়ে পড়লেন, কিন্তু আমরা বাকি তিনজন জলার পাড়ে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম নতুন কিছু জানার আশায়। দুবার আমরা নীল কাদামাটির গর্ত দেখলাম। ঠিক যেমন দেখেছিলাম টেরাড্যাকটিলের আস্তানায়। এগুলো সবই পুরানো জ্বালামুখ। কেন জানি না, জন এগুলোর বিষয়ে খুব আগ্রহ দেখালেন। কিন্তু প্রফেসর চ্যালেঞ্জার উৎসাহী হলেন একটা ফুটন্ত কাদার ডোবাতে। এক অজানা গ্যাস দৈত্যাকার সব বুদবুদের আকারে ভেসে উঠে ফুলে ফেটে যাচ্ছে। একটা ফাঁপা নলখাগড়া ভেঙে ওর ভিতরে ঢুকিয়ে অন্য মাথায় দিয়াশলাইয়ের আগুন দিলেন প্রফেসর। নীল শিখা জ্বলে উঠে বিস্ফোরণ ঘটল। আর স্কুলের বাচ্চার মত খুশি হয়ে উঠলেন তিনি। আরও খুশি হলেন তিনি যখন উল্টো করে খুব পাতলা চামড়ার ব্যাগটায় নলখাগড়ার সাহায্যে গ্যাস ভরতেই সেটা শূন্যে উড়ল।
দাহ্য গ্যাস, বাতাসের চেয়ে অনেক হালকা! নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে মুক্ত হাইড্রোজেন আছে। জি, ই. সির জ্ঞান ভান্ডারে এখনও বহু কিছু লুকিয়ে আছে, তরুণ বন্ধু! বেশির ভাগ সময়েই জ্ঞান দান করতে হলে চ্যালেঞ্জার কেন জানি আমাকেই বেছে নেন; হয়তো সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবেই। তোমরা দেখবে কিভাবে জ্ঞানী মানুষ প্রকৃতিকে নিজের কাজে ব্যবহার করে। গোপন উদ্দেশ্যের আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন চ্যালেঞ্জার, কিন্তু আমাদের আর খুলে বললেন না কিছু।
লেকের টলটলে পানির চেয়ে সুন্দর আর কিছুই আমার চোখে পড়ল না। আমাদের সাড়া পেয়ে আর সংখ্যায়ও আমরা ভারি হওয়ায় কোন জীবজন্তুই আর এদিকে ঘেঁষতে সাহস পায়নি। মাত্র কয়েকটা টেরাড্যাকটিল আমাদের মাথার উপর দিয়ে কিছুক্ষণ উড়ে আবার নিজেদের আস্তানায় ফিরে গেল। লেকটা বাদে চারদিক নিশ্চুপ হয়ে এসেছে এখন কেবল। ওটা যেন এখন আরও জীবন্ত। বিভিন্ন প্রাণীর প্রাচুর্যে লেকটা যেন চঞ্চল আর মুখর হয়ে উঠেছে। দূরের হলুদ চরগুলো এখন কালো কালো দাগে বোঝাই, কোনটা কচ্ছপের মত হামাগুড়ি দিচ্ছে, কোনটা সাপের মত একেবেঁকে চলছে; কোনটা আবার স্থির। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে দুএকটা কালো আকৃতি থেমে থেমে চলে পানিতে নেমে যাচ্ছে। পানির উপরে এখানে সেখানে সাপের মত মাথা দেখা যাচ্ছে। দ্রুত পানি কেটে একেবেঁকে চলছে ওরা। সামনে কোন ঢেউ বা ফেনা নেই, কিন্তু রাজহাঁসের মত পেছনে দুদিকে ঢেউ তুলে এগুচ্ছে; হঠাৎ একটা জীব যখন আমাদের পাড়ে উঠে এল তখন দেখলাম প্রাণীটার দেহ পিপার মত, আর সেই অনুপাতে দাড়া অনেক বড়।
সামারলীও আমাদের সাথে যোগ দিলেন এসে। অদ্ভুত জীবটাকে দেখে দুজনেই একসাথে বিস্ময় প্রকাশ করলেন, প্লেসিওসরাস! সামারলী চেঁচিয়ে উঠলেন, একটা মিঠে পানির প্লেসিওসরাস! এমন দৃশ্য দেখাও আমার ভাগ্যে ছিল। আমরা সত্যি ভাগ্যবান চ্যালেঞ্জার–জীববিজ্ঞানে আমরাই সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি।
রাত অনেক গভীর না হওয়া পর্যন্ত সামারলী বা চ্যালেঞ্জার কাউকেই লেকের ধার থেকে ফিরিয়ে আনা গেল না। সারারাত ধরে জীবজন্তুর বিচিত্র সব আওয়াজ আর তাদের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ আমাদের কানে এল।
প্রত্যুষে ক্যাম্প ভাঙলাম আমরা। ভোরেই সবাই রওনা হলাম আমাদের বিচিত্র অভিযানে। আমার একটা বিশেষ শখ ছিল আমি কখনও সামরিক রিপোর্টার হব। এখন একবার ভাবলাম, কি কপাল আমার, আজ আমি শুধু সামরিক রিপোর্টারই নই, একজন সৈনিকও!
রাতেই গুহা থেকে আরও বেশ কিছু লোক এসে যোগ দিয়েছে। তাতে আমাদের সংখ্যা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সমগ্র শক্তি প্রয়োগ করছে এরা, অর্থাৎ যথার্থই বনমানুষের বিরুদ্ধে এটা তাদের শেষ যুদ্ধ। আমরা চার-পাঁচশো লোক এগিয়ে চললাম অভিযানে। একটা ছোট দল চলেছে আগে আগে পথ প্রদর্শক আর বিপদ সঙ্কেত দাঁতা হিসেবে। তাদের পিছনে আমরা সবাই একযোগে দল বেঁধে এগুচ্ছি। ঘন জঙ্গলের কাছে এসে জন আর সামারলী ডান ধারে খুঁটি গাড়লেন। আমি আর চ্যালেঞ্জার নিলাম বাম ধার। পাথর যুগের কিছু লোক যুদ্ধে চলেছে সেন্ট জেমস স্টীট আর স্ট্র্যান্ডের নির্মিত অস্ত্রে সজ্জিত লোকের সাথে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না আমাদের। উচ্চ চিৎকারের সাথে একটা দল বেরিয়ে এল জঙ্গলের ভিতর থেকে। ওরা মুগুর আর পাথর নিয়ে বেরিয়েই ইন্ডিয়ানদের দলের দিকে ছুটে এল। বীরোচিত হলেও নেহাৎই বোকার মত কাজ। সমতল জমিতে বাঁকা পায়ের বনমানুষদের চেয়ে এরা অনেক বেশি ওস্তাদ। বিশালদেহী বনমানুষগুলো কোন পাত্তাই পেল না, ওদের আঘাত সহজেই ক্ষিপ্রতার সাথে এড়িয়ে গিয়ে এরা পাল্টা আঘাত হানল। তীরের উপর তীর ওদের একের পর এক বিদ্ধ করল। একটা বিশাল বনমানুষ একেবারে আমার পাশ দিয়ে ছুটে গেল, দেখলাম ডজনখানেক তীর বিধেছে ওর বুকে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সে! দয়া পরবশ হয়ে ওর মাথায় একটা গুলি করে ওর সব যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে দিলাম।
এই আক্রমণে আমার কেবল মাত্র ওই একটি গুলিই ছোড়া হলো-কারণ এবারের আক্রমণ ছিল কেন্দ্রভাগে। আর ইন্ডিয়ানদের কোন সাহায্যেরই প্রয়োজন ছিল না। যে কয়জন বনমানুষ আক্রমণ করতে বেরিয়ে এসেছিল তাদের একজনও ফিরে যাবার সুযোগ পায়নি।
জঙ্গলে ঢুকতেই ঘটনা ধীরে ধীরে খারাপের দিকে গেল। এক এক সময়ে আমাদের প্রচন্ড যুদ্ধ করতে হয়েছে, মাঝে মাঝে এমন অবস্থাও গেছে যে মনে হয়েছে আর বুঝি শেষ রক্ষা হলো না। লতাপাতার ভিতর থেকে এক একটা বনমানুষ লাফিয়ে পড়েছে ইন্ডিয়ানদের মাঝে। গদার বাড়িতে তিন চারজনকে ঘায়েল করার আগে ওদের বর্শাবিদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। একজন তো সামারলীর রাইফেলই চ্যাপ্টা করে দিল, তার মাথাটারও একই অবস্থা করত যদি না একজন ইন্ডিয়ান চট করে ওর বুক না ফুড়ে দিত। উপর থেকে অন্যান্য বনমানুষগুলো আমাদের ওপর পাথর আর লাঠি ছুঁড়ে মারছে। কখনও কখনও নিজেরাই ঝাপিয়ে পড়ছে আমাদের উপর, না মরা পর্যন্ত যতটুকু ক্ষতি করা সম্ভব তা করতে কোন ত্রুটি করছে না ওরা। একবার তো আমাদের মিত্র বাহিনীর রণে ভঙ্গ দেয়ার জোগাড় হয়েছিল। আমাদের রাইফেলের শক্তি ওদের মনোবল ফিরিয়ে দেয়াতেই ওরা আবার ফিরে আসে। ফিরে বুড়ো চীফের দক্ষ পরিচালনায় তারা এমন পাল্টা আক্রমণ করেছে যে বনমানুষরা কোনমতে পালিয়ে বাঁচল।
সামারলী নিরস্ত্র, আমি সমানে গুলি ছুঁড়ে যাচ্ছি, অন্য ধার থেকেও অনবরত গুলির শব্দ আসছে। তারপর হঠাৎ এক সময়ে দেখলাম আতঙ্কিত সমর্পণের আভাস। চিৎকার করে যে যেদিকে পারল পালাতে লেগেছে ওরা। বিজয় উল্লাসে হর্ষধ্বনি করতে করতে ইন্ডিয়ানরা পিছু নিল ওদের। এতদিনের বিবাদ, ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা, সব কিছুরই শোধ সুদে আসলে নেবে আজ ওরা।
আমরা চারজন একত্রিত হয়ে ওদের পিছু পিছু আরও কিছুদূর গেলাম। কেবল শোনা যাচ্ছে ধনুকের টঙ্কার, বনমানুষের আর্ত-চিৎকার আর ইন্ডিয়ানদের উল্লাসধ্বনি।
মনে হচ্ছে সব শেষ, বললেন জন। আমার মনে হয় শেষ কাজটুকু সারার দায়িত্ব ওদেরই দেয়া উচিত। হত্যাকান্ড যত কম দেখি রাতে ততই ভাল ঘুম হবে আমাদের।
খুনের নেশায় চোখ দুটো চকচক করছে চ্যালেঞ্জারের। তার চলাফেরা এখন লড়াইয়ের মোরগের মতই গর্বিত। আমাদের সৌভাগ্য, বললেন তিনি, আজ আমরা পৃথিবীর ইতিহাসে একটা চুড়ান্ত যুদ্ধে অংশ নিলাম, এই ধরনের যুদ্ধই পৃথিবীর মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে এসেছে চিরকাল। দেশে দেশে যুদ্ধ, সেটা কি? নিরর্থক-আসল বিজয় হচ্ছে সেটা, যখন বাঘ দেখেছে সে আদিম গুহাবাসীদের সাথে এঁটে উঠতে পারছে না; অথবা হাতি যখন বুঝেছে যে তার একজন প্রভু আছে। এগুলোই হচ্ছে মানুষের অর্থবহ বিজয়। এই মালভূমির মানুষের ভবিষ্যৎ এখন উজ্জ্বল।
কোন একটা গোঁড়া বিশ্বাস নিয়ে যুদ্ধে না নামলে এমন হত্যাযজ্ঞ সম্ভব নয়। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সামনে এগুতে এগুতে দেখলাম শত শত বনমানুষ মরে পড়ে আছে চারপাশে। তীর আর বর্শায় গাঁথা দেই। চিৎকার আর হুঙ্কারের তাড়া খেয়ে ওরা কোন দিকে যে পালাচ্ছে তা সহজেই বোঝা যায়; নিজেদের আস্তানায় পালাচ্ছে। শেষ বারের মত রুখে দাঁড়াল ওরা। কিন্তু প্রচন্ড আক্রমণের মুখে আবার ছত্রভঙ্গ হতে বাধ্য হলো। আমরা যখন পৌঁছলাম তখন বীভৎস হত্যাকান্ড চলছে। প্রায় আশি নব্বই জন পুরুষ বনমানুষ যারা শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল, তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তাদেরই পদ্ধতিতে নিচে ফেলে দেয়া হলো। উপায় ছিল না ওদের; ইন্ডিয়ানরা অর্ধ চক্রাকারে ঘিরে বর্শা উচিয়ে তাড়া করেছিল। এক মিনিটেই শেষ হয়ে গেল সব।
ধ্বংস করা হলো গোটা শহরটা। মেয়ে বনমানুষ আর বাচ্চাগুলোকে বন্দী করা হলো দাস হিসাবে। দীর্ঘকালের অকথিত শত্রুতার এইভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটল।
এই বিজয়ে আমাদের বেশ সুবিধা হলো। আমরা নির্ভয়ে আমাদের ক্যাম্পে ফিরে সব দরকারী জিনিস নিয়ে এলাম। সেই সাথে আবারও জাম্বাের সাথে আমরা যোগাযোগ করার সুযোগ পেলাম। বেচারা জাম্বাে দূর থেকে এতগুলো বনমানুষকে ঝাপিয়ে পড়তে দেখে খুবই ভয় পেয়েছে।
পালিয়ে আসুন, মাসসাস, (মিস্টারস) চলে আসুন, চিৎকার করে বলল জাম্বাে, ওই প্রেতের দেশে থাকলে আপনাদের ঠিকই শেষ করবে।
উচিত কথাই বলেছে জাম্বাে, একটু রোষের সাথেই বললেন সামারলী। যথেষ্ট অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে ইতিমধ্যেই। এখন সভ্য জগতে ফিরে যাবার চেষ্টায় আমাদের সব শক্তি আর বুদ্ধি নিয়োগ করা উচিত হবে।