১২. ঠিক সূর্যাস্তের সময়ে
ঠিক সূর্যাস্তের সময়ে সেই বিষাদময় সন্ধ্যায় ইন্ডিয়ান লোকটার আকৃতি দেখা গেল ওই বিশাল সমভূমিটার উপর। চেয়ে চেয়ে দেখলাম ওকে যতক্ষণ দেখা যায়। আমার উদ্ধার পাবার শেষ ভরসা হচ্ছে লোকটা।
বিধ্বস্ত ক্যাম্পে ফিরতে বেশ অন্ধকার হয়ে গেল। ফেরার আগে জাম্বাের জ্বালানো লাল আগুনটা শেষবারের মত আর একবার দেখে নিলাম। নিচের জগতে ওই একটাই মাত্র আলো জাম্বাের বিশ্বস্ত উপস্থিতি, ঠিক ওই আলোর মতই আমার মনের বিষণ্ণ ছায়া বিতাড়িত করেছে।
এতবড় একটা শোকার্ত দুর্ঘটনার আঘাতের পরেও এইটুকুই আমার সান্তনা যে পৃথিবী জানবে আমরা কি করেছি। আমাদের দেহের সাথে নামটাও মুছে যাবে না, উজ্জ্বল অক্ষরে ইতিহাসে লেখা থাকবে আমাদের সংগ্রামের কথা।
একা একা ক্যাম্পে ঘুমানো সত্যিই দুঃসাহসিক কাজ-ভাবাই যায় না। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে রাত কাটানো তার চেয়েও ভয়ানক। আমার সহজাত বুদ্ধি বলছে। সজাগ পাহারায় থাকা উচিত কিন্তু ক্লান্ত শরীরে কুলাচ্ছে না। বিশাল জিঙ্কো গাছে চড়ে বসলাম আমি। কিন্তু মসৃণ গোল ডালপালার মাঝে নিরাপদ কোন জায়গা খুঁজে পেলাম না। একটু ঝিমানি এলেই নির্ঘাত পড়ে গিয়ে ঘাড় ভাঙবে। নেমে ভাবতে লাগলাম এখন আমার কি করা উচিত। শেষ পর্যন্ত ক্যাম্পের গেট বন্ধ করে ত্রিভুজের আকারে তিনটা আলাদা আগুন জেলে, পেট পুরে খেয়ে নিয়ে, গভীর ঘুমের কোলে ঢলে পড়লাম।
সকালে ঘুম ভাঙল কারও হাতের ছোঁয়ায়। চোখ মেলে আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম আমি, হাঁটু গেড়ে লর্ড জন বসে আছেন আমার পাশে!
জনই—তবে জন বলে চেনা যায় না। সেই ফিটফাট বাবু আর নেই তিনি। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, চোখ উদভ্রান্ত। মুখে আঁচড়ের দাগ, বেশ হাঁপাচ্ছেন, কাপড় শতচ্ছিন্ন, টুপি নেই মাথায়। অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম আমি। আমাকে প্রশ্ন করার কোন সুযোগ দিলেন না জন, কথা বলতে বলতেই দরকারী জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলেন তিনি।
জলদি করে, বললেন জন, সময় নেই, প্রত্যেকটা মুহূর্ত এখন অত্যন্ত মূল্যবান। দুটো রাইফেল নাও তুমি, বাকি দুটো আমি নিচ্ছি। কয়েক টিন খাবার আর পকেট বোঝাই করে গুলি নাও। কথা বলে বা মিছে ভেবে সময় নষ্ট কোরো, একটু দেরি হলেই আমরা শেষ।
কোন কিছু না বুঝেই তাড়াহুড়া করে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে জনের পিছনে পিছনে ছুটলাম আমি দুই বগলে দুটো রাইফেল আর দুহাতে বিভিন্ন ধরনের খাবার। ঘন লতাপাতার ভিতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে একটা ঝাকড়া ঝোপের উপর ঝাপিয়ে পড়ে আমাকে টেনে পাশে শুইয়ে দিলেন জন।
এইবার মনে হয় আমরা নিরাপদ, হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন জন। ওরা অবধারিত ভাবে সোজা ক্যাম্পেই খুঁজতে যাবে আমাদের।
একটু দম ফিরে পেতেই জিজ্ঞেস করলাম, ঘটনা কি? প্রফেসররাই বা। কোথায় আর কারাই বা ধাওয়া করছে আমাদের?
বনমানুষ, বললেন জন, খোদা জানেন কি নিষ্ঠুর জানোয়ার ওরা। সাবধান, ভুলেও চড়া গলায় কথা বোলো না, ওরা অনেক দূর থেকে দেখতে আর শুনতে পায়। তবে ওদের নাক তেমন তীক্ষ্ণ নয়, ঘ্রাণ শুকে খুঁজে বের করতে পারবে বলে মনে হয় না। তা তুমি ছিলে কোথায়?
সংক্ষেপে আমার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলাম।
খুব খারাপ, ডাইনোসরের আর গর্তের বর্ণনা শুনে মন্তব্য করলেন জন। এই জায়গাটা ঠিক অবসর বিনোদনের উপযোগী নয়—কি বলো? এদের নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। একবার মানুষখেকো পাপুয়ানদের হাতে পড়েছিলাম আমি কিন্তু এদের কাছে ওরা নস্যি।
কি হয়েছিল? জানতে চাইলাম আমি।
প্রায় ভোর বেলা, প্রফেসর দুজন মাত্র ওঠার প্রস্তুতিতে এপাশ ওপাশ করছেন, হঠাৎ বৃষ্টির মত পাতার ভিতর থেকে আবির্ভাব হলো ববনমানুষের। ঝাকে ঝাকে গাছ থেকে নামতে লাগল ওরা। একটাকে পেটে গুলি করলাম আমি, কিন্তু আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের চিৎ করে ফেলে দিয়ে লতা দিয়ে বেঁধে ফেলল ওরা। বনমানুষ বলছি বটে কিন্তু ওদের হাতে ছিল মুগুর আর পাথর। ওদের মধ্যে কিচির মিচির করে কথা বলতে বলতে শক্ত করে বাঁধল আমাদের। আহত সঙ্গীকে তুলে নিয়ে গেল ওরা। শুয়োরের মত গলগল করে রক্ত পড়ছিল ওর পেট থেকে। ওরা এরপর আমাদের সবাইকে ঘিরে বসল, ওদের সবার মুখে হত্যার ছাপ। মানুষেরই সমান উঁচু হবে আকারে, কিন্তু দেহে অসুরের শক্তি।
একটু থেমে আবার আরম্ভ করলেন জন, ওরা আমাদের চারপাশে ঘিরে বসে আগ্রহ ভরে কেবল চেয়ে রইল আমাদের দিকে। প্রফেসর চ্যালেঞ্জার পর্যন্ত চুপসে গেলেন। কোনমতে ধস্তাধস্তি করে উঠে দাঁড়িয়ে বকাবকি গালাগালি আরম্ভ করলেন তিনি। চিৎকার করে জলদি কাজ সারতে বললেন। ঘটনার আকস্মিকতায় হয়তো মাথা বিগড়ে গেছিল তার, অকথ্য ভাষায় পাগলের মত বকাবাজি করলেন।
তা ওরা কি করল? অবাক বিস্ময়ে জনের কথা শুনতে শুনতে জিজ্ঞেস করলাম আমি। ফিসফিস করে আমাকে কানে কানে গল্প শোনাতে শোনাতেও চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিলেন জন। শক্ত হাতে তার রাইফেলটা ধরা রয়েছে।
আমি ভেবেছিলাম বুঝি আমাদের অন্তিম মুহূর্ত উপস্থিত। কিন্তু ওদের মতলব দেখা গেল অন্য রকম। শুনলে না হেসে থাকতে পারবে না তুমি, কিন্তু বিশ্বাস করো ওরা নিকটাত্মীয়ও হতে পারত। নিজের চোখে না দেখলে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারতাম না। ওদের যে বুড়ো নেতা সে দেখতে হুবহু চ্যালেঞ্জারের লাল সংস্করণ। খাটো শরীর, চওড়া কাঁধ, গোল বুক–গলা নেই। লালচে একগুচ্ছ দাড়ি। ঘন ভুরু, আর ব্যাটা-কি-চাস? এমন একটা ভাব, তার চোখে চ্যালেঞ্জারের পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে থাবা রাখল চীফ। সামারলী হিস্ট্রিরিয়াগ্রস্ত হয়ে হাসতে হাসতে কেঁদে ফেললেন। চীফও খ্যাক খ্যাক করে হাসল। এরপরেই কাজে লেগে গেল ওরা। আমাদের টেনে হিচড়ে নিয়ে চলল জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। আমাদের রাইফেল ওরা ছুঁয়েও দেখল না, কেবল যা খাবার বাইরে বের করা ছিল তা সবটাই নিয়ে গেল। পথে সামারলীকে আর আমাকে খুব রুক্ষভাবেই পরিচালিত করল ওরা। আমার ছেড়া জামা কাপড় তারই সাক্ষী। চ্যালেঞ্জার বেশ ভালই ছিলেন—চারজনে তাঁকে কাঁধে তুলে রোমান রাজার মত সসম্মানে বয়ে নিয়ে গেল। কিন্তু ওটা কি?
করতালের মত অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল বেশ দূর থেকে।
ওই যে যাচ্ছে ওরা, ডাবল ব্যারেলে এক্সপ্রেসে কার্তুজ ভরতে ভরতে বললেন জন। সব কটা রাইফেল ভরে ফেল, জীবিত অবস্থায় আমরা ধরা দেব না কিছুতেই। খুব উত্তেজিত হলে ওরা ওই শব্দ করে। এখনও শুনতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ, অনেক দূরে।
ওই কয়জনে খুব একটা সুবিধে করতে পারবে না। এমন অনেক কয়টা দলই আমাদের খুঁজতে বেরিয়েছে জঙ্গলের চারদিকে। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, ওরা আমাদের নিয়ে গেল ওদের মহল্লায়। প্রায় হাজার খানেক ঘর, চুড়ার ধারে বড় বড় গাছের সারির মধ্যে ডাল পাতা দিয়ে তৈরি। জংলী জানোয়ারগুলো আমার সারা শরীর আঙুল দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেছে। মনে হচ্ছে আমার চামড়া আর কোনদিনও পরিচ্ছন্ন হবে না। আমাকে যে বেঁধেছিল সে ব্যাটা বাঁধতে জানে। গাছের তলায় চিৎ হয়ে পড়ে রইলাম আমরা, একজন মুগুর হাতে পাহারায় রইল। আমারা মানে সামারলী আর আমি, কেননা চ্যালেঞ্জার একটা গাছের উপর বসে খাওয়া দাওয়া আর আনন্দে ব্যস্ত। তবে কিছু ফল আমাদের কাছেও পৌঁছাতে পেরেছিলেন তিনি। নিজের হাতে আমাদের বাঁধনও একটু ঢিলা করেছিলেন এক ফাঁকে। তুমি যদি তখন দেখতে তাঁকে, গাছের উপর জমজ ভাইয়ের সাথে যে সে কি হাসাহাসি আর গলা ছেড়ে গান। যে কোনরকম গানই বনমানুষদের খোশ মেজাজে রাখে বোঝা গেল। কিন্তু চ্যালেঞ্জারকে খেয়াল খুশিমত অনেক কিছু করতে দিলেও আমাদের ব্যাপারে কোন খাতির করল না ওরা।
তারপর কি হলো?
বলছি, এবার তোমাকে যা বলব তা শুনে সত্যিই অবাক হবে। তুমি না বলছিলে এখানে মানুষের অস্তিত্বের কিছু কিছু প্রমাণ পেয়েছ?
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম।
বেচারারা গড়নে বেশ খাট। যতদূর বোঝা গেল মালভূমিটার একদিক মানুষের আর অন্যদিক বনমানুষের দখলে আছে। ওদের মধ্যে সবসময়ে যুদ্ধ লেগে রয়েছে। গতকাল বনমানুষেরা ডজন খানেক মানুষ বন্দী করে এনেছিল। কামড়ে খামচে এমন অবস্থা করেছে ঠিক মত দাঁড়াতেও পারছিল না ওরা। দুজনকে বনমানুষেরা ওখানেই হত্যা করল, একটা চিৎকার করারও সুযোগ পায়নি তারা। ঘটনা দেখে আমরা অসুস্থ বোধ করলাম, সামারলী জ্ঞান হারালেন। চ্যালেঞ্জারও সহ্যের একেবারে শেষ সীমায় পৌঁছলেন। মনে হয় ওরা চলে গেছে, কি বলো?
বেশ মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম আমরা। পাখির ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ জঙ্গলের শান্তি ভঙ্গ করছে না। জন আবার তার গল্প বলে চললেন;
বড় বাচা বেঁচে গেছ তুমি। ওই মানুষগুলো ধরা পড়ায় তোমার কথা ওরা একদম ভুলে গেছে। নইলে অবশ্যই তোমার জন্যে আবার ক্যাম্পে আসত ওরা। গাছ থেকে ঠিকই আমাদের উপর নজর রেখেছিল ওরা প্রথম থেকেই। আর ভাল করেই জানত যে সংখ্যায় আমরা একজন কম। পাহাড়ের নিচে ওই বেতগুলোর কথা মনে আছে তোমার, যেখানে আমেরিকান লোকটির কঙ্কাল পেয়েছিলাম আমরা? বনমানুষদের শহরের ঠিক নিচেই ওটা। সবকিছুই যেন একটা দুঃস্বপ্নের মত লাগছে, খুঁজলে আরও অনেক কঙ্কাল পাওয়া যাবে ওখানে। চুড়ার ধারে ফাঁকা জায়গাটা থেকে বন্দীদের এক এক করে নিচে লাফিয়ে পড়তে হয়। সবই করা হয় আনুষ্ঠানিকভাবে। কে সরাসরি নিচে পড়ে ছাতু হলো আর কে বেতে বিঁধে মরল এটা দেখাই তাদের আসল মজা। আমাদেরও দেখাতে নিয়ে গেছিল ওরা। পুরো বনমানুষের দল সারি বেঁধে ধারের কাছে দাঁড়াল, মহা উত্তেজনা। চারজন মানুষকে লাফিয়ে পড়তে হলো নিচে। উল বোনার কাঁটা যেমন সহজে মাখনের মধ্যে ঢুকে যায় ঠিক তেমনি বেতের কাঁটায় বিধে গেল ওরা। অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য, অবাক বিস্ময়ে শুধু চেয়ে দেখলাম ওদের ঝাঁপিয়ে পড়া। অবশ্য এটাও জানা কথা যে আমাদের কপালে ওই একই দুর্ভোগ আছে।
ওরা ছয়জন ইন্ডিয়ানকে আজকের জন্যে বাঁচিয়ে রেখেছে বলেই আমার ধারণা। আমাদের রেখেছে ওরা ওদের অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি শিল্পী হিসাবে—সবার শেষে বলি দেবে আমাদের চ্যালেঞ্জার হয়তো মাফ পেতেও পারেন, কিন্তু সামারলী আর আমার রেহাই নেই। ওদের ভাষা অঙ্গভঙ্গী প্রধান, তাই ওদের ইঙ্গিত বুঝে নিতে খুব অসুবিধা হয়নি আমার। যে কোন উপায়ে ছুটে পালাবার চেষ্টা করতে হবে এবার। চিন্তা করে দেখলাম সবটা নির্ভর করছে আমারই উপর, সামারলী ধরতে গেলে অকেজো আর চ্যালেঞ্জারও খুব একটা সাহায্যে আসবেন না। দুই প্রফেসর একবারই একত্র হয়েছিলেন, তখন তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল, যে বনমানুষগুলো আমাদের ধরে এনেছে তারা কোন শ্রেণীর? একজন বলেন যে ওরা জাভার ড্রাইওপিথেকাস আর অন্যজনের মতে ওরা পিথেক্যানথ্রোপাস। বলো তো পাগলামি ছাড়া আর কি? বদ্ধ পাগল-দুজনেই।
এদের বিষয়ে দুএকটা ব্যাপার বেশ খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেছি আমি। একটা হচ্ছে এরা খোলা জায়গায় মানুষের মত জোরে ছুটতে পারে না। ছোট ছোট বাকা পা ওদের, সেই সাথে ভারী শরীর। এমন কি চ্যালেঞ্জারও প্রতি একশো গজে ওদের কয়েক গজ পিছিয়ে ফেলতে পারবেন।
আর একটা ব্যাপার, ওরা আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। ওরা বুঝতেই পারেনি আমি যাকে গুলি করেছি সে কিভাবে আহত হলো। ভাবলাম, আমি যদি কোনমতে রাইফেলগুলো হাতে পাই হয়তো কিছু করতে পারব।
আজ ভোরে আমার প্রহরীর পেটে লাথি মেরে চিৎ করে ফেলেই পালাই আমি। ছুটে চলে এসেছি ক্যাম্পে। ওখানে তোমার দেখা পেলাম—এইবার আমাদের হাতে আছে রাইফেল।
কিন্তু প্রফেসরদের কি হবে? আমি উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞেস করলাম।
তাদের উদ্ধার করে আনতে হবে আমাদের। আমার পক্ষে প্রফেসরদের সাথে নিয়ে আসা অসম্ভব ছিল। চ্যালেঞ্জার ছিলেন গাছের উপরে আর সামারালীর পক্ষে এতদূর ছুটে পালানো সম্ভব নয়। আমাদের একমাত্র উপায় রাইফেল নিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা করা। অবশ্য প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে ওরা প্রফেসর দুজনকে সাথে সাথেই মেরে থাকতে পারে। চ্যালেঞ্জারকে কিছু না করলেও সামারলীর বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার। তাঁকে এমনিতেও মারতই ওরা, কাজেই আমি পালিয়ে এমন বিশেষ কোনো বিপদ ডেকে আনিনি। কিন্তু তাদের উদ্ধারের চেষ্টায় ফিরে যাওয়া আমাদের একান্ত কর্তব্য। যদি না পারি তাঁদের সাথেই একত্রে মৃত্যুবরণ করব। সুতরাং মনস্থির করে নাও, সন্ধ্যার আগেই ভাগ্য নির্ধারিত হবে আমাদের।
উপরের বর্ণনা দিতে গিয়ে লর্ড রক্সটনের ছোট ছোট জোরাল বাক্যে কথা বলার ভঙ্গি নকল করার চেষ্টা করেছি। তার আধা রসাত্মক বেপরোয়া ধরনের স্বরের পুরোপুরি প্রভাব রয়েছে তার সংলাপে। একটা আজন্ম নেতা তিনি। বিপদ যতই ঘনীভূত হতে থাকে তাঁর কথাও তত দ্রুত হয়। স্থির, অচঞ্চল চোখ দুটোতে অস্বাভাবিক জ্যোতি দেখা দেয়, আর তাঁর ডন কুয়োতের মত গোঁফ উত্তেজনার আনন্দে খাড়া হয়ে ওঠে। বিপজ্জনক কাজে তার আসক্তি, তাঁর অভিযানের নাটকীয়তা, তার উদ্যম এ ধরনের কঠিন মুহূর্তে তাকে একজন কাম্য সঙ্গী করে তোলে। আমরা গোপন আশ্রয় থেকে মাত্র বের হতে যাব এমন সময় জন হাত দিয়ে আমার কনুই চেপে ধরলেন।
সর্বনাশ, ফিসফিস করে বললেন জন, ওরা ফিরে আসছে!
আমরা যেখানে লুকিয়ে ছিলাম সেখান থেকে একটা পিঙ্গল উঠানের মত জমি দেখা যাচ্ছে। সবুজ পাতায় ছাওয়া গাছের গুড়ির সারি একটার পর একটা। ওই পথ ধরে বনমানুষের একটা দল পার হচ্ছে। এক সারিতে এগুচ্ছে ওরা। বাঁকা পা আর কুঁজো কাঁধ, মাঝে মাঝে হাত মাটিতে ঠেকছে। কুঁজো হয়ে চলার কারণে যদিও ছোট দেখাচ্ছে ওদের, তবু লম্বায় ওরা পাঁচ ফুটের কম হবে না আন্দাজ করলাম আমি। অধিকাংশের হাতেই লাঠি বা মুগুর। দূর থেকে রোমশ বিকৃত মানুষের মত লাগছে দেখতে। মুহূর্তের জন্যে পরিষ্কার দেখলাম, কিন্তু তার পরক্ষণেই অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা।
এখনও সময় হয়নি, বললেন জন, ওদের খোঁজাখুজি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ঘাপটি মেরে বসে থাকতে হবে। ঘণ্টা খানেক পরে আমরা রওনা হব ওদের শহরের দিকে।
একটা খাবারের টিন খুলে সকালের নাস্তা সারতে কিছুটা সময় কাটল আমাদের। জন গতকাল সকাল থেকে এ পর্যন্ত কয়েকটা ফল ছাড়া আর কিছুই খাননি। বুভুক্ষের মত খেলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত পকেট ভর্তি গুলি আর দুহাতে দুটো করে রাইফেল নিয়ে রওনা হলাম আমরা। যাবার আগে আমাদের আস্তানা চিহ্নিত করে গেলাম, দরকার বোধে ভবিষ্যতে ব্যবহার করব। চলতে চলতে আমাদের পুরানো ক্যাম্পের খুব কাছে হাজির হলাম। এখানে একটু থামলাম আমরা, জন তার মতলব কিছুটা খুলে বললেন আমার কাছে।
যতক্ষণ আমরা বড় বড় মোটা গাছের জঙ্গলে আছি ততক্ষণ ওরা আমাদের কর্তা, আমরা ওদের দেখতে না পেলেও ওরা আমাদের ঠিকই দেখবে। কিন্তু খোলা জায়গায় তা নয়; সেখানে ওদের আমরা দেখতেও পাব আর ওদের চেয়ে জোরে ছুটতেও পারব। তাই যতদূর সম্ভব খোলা জায়গা দিয়ে এগুতে হবে আমাদের। চূড়ার ধার ধরেই যাব আমরা, যেদিকে বড় গাছের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। চোখ কান খোলা, আর রাইফেল তৈরি রেখে ধীরে ধীরে এগুতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা-রাইফেলে একটা গুলি থাকতেও আমাদের ধরা দেয়া চলবে না।
ধারের কাছে পৌঁছে নিচে উঁকি দিয়ে দেখলাম একটা পাথরের উপর বসে তামাক খাচ্ছে জাম্বাে। খুব ইচ্ছা করল ওকে ডেকে আমাদের বর্তমান অবস্থার কথা খুলে বলি। কিন্তু অতি বিপজ্জনক কাজ হবে সেটা। জঙ্গলে গিজগিজ করছে বনমানুষ। বারবার আমরা ওদের ক্ল্যাপস্টিকের শব্দ শুনছি আর লাফিয়ে পড়ছি ঘন ঝোপের ভিতরে। শব্দ না মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত চুপচাপ পড়ে থাকছি। খুবই ধীরে ধীরে এগুতে লাগলাম আমরা। প্রায় দুঘণ্টা চলার পরে লর্ড জনের খুব বেশি সতর্ক চলাফেরায় বুঝলাম যে ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি আমরা। হাতের ইশারায় আমাকে চুপ করে শুয়ে থাকতে বলে কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে গেলেন জন। কিন্তু মাত্র এক মিনিট পরেই ফিরে এলেন আবার, তার চোখে মুখে উত্তেজনা।
শিগগির এসো, জন ফিসফিস করে বললেন, আমাদের বেশি দেরি না হয়ে থাকলেই রক্ষা।
উত্তেজনায় সারা দেহ থরথর করে কাঁপছে আমার। কনুইয়ে ভর করে এগিয়ে জনের পাশে চলে এলাম আমি। ঝোপের ফাঁক দিয়ে সামনের খোলা জায়গাটা চোখে পড়ল।
এমন অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য দৃশ্য আমি কোনদিন ভুলতে পারব না। আর কেউ হোক, অন্তত আমার পাশে শোয়া লোকটি জানেন যে আমি মিথ্যা বলছি না। যদি বেঁচে থাকি তাহলে কোনদিন স্যাভেজ ক্লাবের ভিন্ন পরিবেশে বসে একদিন হয়তো এই দুঃস্বপ্নের মত ঘটনা বিশ্বাস করা আমার নিজের পক্ষেই কঠিন হবে।
চওড়া একটা খোলা জায়গা আমাদের সামনে, পাশে কয়েকশো ফুট হবে। সবুজ ঘাস আর ছোট ছোট গুল্মলতা দেখা যাচ্ছে চুড়ার ধারে। ফাঁকা জায়গাটার শেষে অর্ধবৃত্তাকার বড় বড় গাছের সারি। সেগুলোর মোটা ডালের থাকে থাকে লতাপাতার ঘর–ঘর না বলে খোপ বললেই হয়তো বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। প্রতিটি ঝুপড়ি এক একটা ছোট্ট বাসা। গাছে বোঝাই বনমানুষ, সবারই মনোেযোগ একই দিকে, সেদিকে চেয়ে বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম।
খোলা জায়গায় চূড়ার কিনার ঘেঁষে কয়েকশো লাল চুলওয়ালা বনমানুষ জড় হয়েছে। ওদের মধ্যে কয়েকটা সত্যিই বিশাল, আর প্রত্যেকেই বীভৎস দেখতে। এক ধরনের শৃঙ্খলা রয়েছে ওদের মধ্যে, সারি ভাঙছে না কেউ। ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইন্ডিয়ানদের একটা ছোট দল; ছোটখাট, পরিচ্ছন্ন, লাল মানুষগুলো। উজ্জ্বল সূর্যের আলো ওদের গায়ে পড়ে পালিশ করা ব্রোঞ্জের মত ঝকঝক করছে। একজন লম্বা চিকন সাদা চামড়ার মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ওদের পাশে, মাথা নিচু, হাত ভাঁজ করা। তার ভঙ্গিতে হতাশা, ভীতি, আর বিষণ্ণতা ফুটে উঠেছে। নিঃসন্দেহে, চোখা চেহারার লোকটিই হচ্ছেন প্রফেসর সামারলী।
বিধ্বস্ত বন্দী দলটার আশেপাশে কয়েকজন বনমানুষ পাহারায় রয়েছে। কারও পালিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সবার থেকে একটু দূরে ডান দিকে একেবারে কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দুটো অদ্ভুত আকৃতি, এতই অস্বাভাবিক যে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারল না। একজন আমাদের সঙ্গী প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। তাঁর কোটের কিছুটা অংশ তখনও কাঁধে ঝুলছে, কিন্তু ভিতরের শার্ট পুরোটাই ছিড়ে নামানো হয়েছে। তার কালো দাড়ি আর বুকের কালো লোম মিশে একাকার হয়ে গেছে। মাথায় হ্যাটটা নেই, গত কয় মাসে তার চুলও বেশ বড় হয়েছে, হাওয়ায় উড়ছে তা। একদিনের বিশৃঙ্খলাই তাঁকে শ্রেষ্ঠ সভ্য মানুষ গ্নেকে দক্ষিণ আমেরিকার বেপরোয়া জংলী মানুষে পরিণত করেছে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বনমানুষদের রাজা এবং চীফ।
লর্ড জন ভুল বলেননি, দুজন হুবহু একই রকমের দেখতে, কেবল চামড়ার রঙের একটু যা তফাৎ। একই রকম খাটো ভারী চেহারা, চওড়া কাঁধ, হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হাত। এমন কি দাড়িও একই ভাবে বুকের লোমের সাথে মিশেছে। ভুরু আর বনমানুষটার চ্যাপটা মাথাই কেবল আর একটু বিভেদ সৃষ্টি করেছে।
বলতে এত সময় লাগলেও কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা এটা। আমাদের মাথায় এখন একটাই চিন্তা-যুদ্ধে নামতে হবে। দুটো বনমানুষ একজন ইন্ডিয়ানকে ধরে টেনে নিয়ে গেল ক্লিফের ধারে। ওদের রাজা হাত উঠিয়ে সম্মতি জানাল। লোকটার হাত আর পা ধরে চ্যাংদোলা করে তিনবার সামনে পিছনে দুলিয়ে ছুঁড়ে দিল ওরা সামনের দিকে। এত জোরে ছুঁড়ল যে নিচে নামতে আরম্ভ করার আগে প্রথমে তার দেহটা উপরে উঠে গেল। মানুষটা অদৃশ্য হবার সাথে সাথেই প্রহরী ছাড়া আর সবাই চুড়ার ধারে ছুটে গেল। কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপরই বনমানুষদের উল্লসিত সমবেত চিৎকার। রোমশ হাত শূন্যে তুলে খুশিতে উন্মত্ত হয়ে নাচল কিছুক্ষণ, তারপর আবার পিছিয়ে এল চুড়ার ধার থেকে। এখন দ্বিতীয় বলির অপেক্ষা।
এইবার সামারলী! দুজন প্রহরী তাঁকে কজি ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল সামনে। তার ক্ষীণ দেহ প্রতিবাদে কেবল অসহায় মুরগীর মত ঝাপটাল কিছুক্ষণ। চ্যালেঞ্জার হাত নেড়ে রাজার কাছে অনেক অনুরোধ, অনেক অনুনয় বিনয় করলেন সঙ্গীর প্রাণ রক্ষার জন্যে, কিন্তু সবই বৃথা হলো। ধাক্কা মেরে চ্যালেঞ্জারকে সরিয়ে দিয়ে মাথা নাড়ল সে; অন্তিম মুহূর্ত উপস্থিত।
লর্ড জনের রাইফেল গর্জে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জারের পাশে বনমানুষের চীফ লাল রক্তে ভেসে লুটিয়ে পড়ল। গুলি চালাও, ওই ঝাঁকের মধ্যে গুলি চালাও! চিৎকার করে বললেন জন।
অনেকের মনেই একটা দুর্বল জায়গা থাকে, আহত খরগোশের আর্ত চিৎকারে অনেকবার আমার চোখে পানি এসেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে রক্ত পিপাসা যেন আমাকে পেয়ে বসেছে। যন্ত্রচালিতের মত একের পর এক ম্যাগাজিন খালি করতে লাগলাম আমি। খুনের নেশায় রক্ত টগবগ করে ফুটছে আমার। দুজনের চারটা রাইফেল দিয়ে ওদের উপর বিপর্যয় ঘনিয়ে আনলাম। সামারলীকে যে দুজন ধরেছিল তারা ভূপাতিত হলো; সামারলী মাতালের মত টলতে টলতে ঘুরতে লাগলেন বিস্ময়ে। এখনও ভাবতেই পারছেন না যে তিনি সত্যিই মুক্ত। বনমানুষেরা বিশৃঙ্খল ভাবে ছুটোছুটি করছে। তারা বুঝতেই পারছে না এত শব্দ কোথা থেকে আসছে, আর তারা মরেই বা যাচ্ছে কেন। বিভ্রান্ত হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি আরম্ভ করল ওরা। হঠাৎ সহজাত প্রবৃত্তির বশেই বাকি সবাই গাছের আড়ালে আশ্রয়ের জন্যে ছুটল। বন্দী সবাই ফাঁকা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে, এখন আর কোন প্রহরী নেই।
প্রথমে চ্যালেঞ্জারই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারলেন। তিনি সামারলীকে কনুই ধরে টেনে নিয়ে ছুটে এলেন আমাদের দিকে। দুজন প্রহরী তাদের পিছনে ধাওয়া করল, কিন্তু জনের দুই বুলেট দুটোকেই ধরাশায়ী করল। আমরা একটু এগিয়ে আমাদের সঙ্গীদের সম্বর্ধনা জানালাম; সেই সাথে একটা করে গুলি ভরা রাইফেল তাদের হাতে ধরিয়ে দিলাম। সামারলীকে অত্যন্ত ক্লান্ত আর পরিশ্রান্ত মনে হলো, ভাল করে হাঁটতেও পারছেন না তিনি।
ওদিকে বনমানুষগুলো কিছুটা ভয় কাটিয়ে উঠে ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসছে। আমাদের ফিরতে বাধা দেবার চেষ্টা করল ওরা। চ্যালেঞ্জার আর আমি সামারলীকে ধরে নিয়ে ছুটলাম। জন রাইফেল দিয়ে একের পর এক অব্যর্থ গুলি চালিয়ে যেতে লাগলেন। প্রায় একমাইল পর্যন্ত ওরা আমাদের পিছু পিছু এসেছিল, পরে ক্রমে ওদের চাপ হালকা হয়ে এল; আমাদের রাইফেলের নির্ভুল নিশানা ওরা উপলব্ধি করতে পেরেছে বলেই মনে হলো। ক্যাম্পে পৌঁছানোর পরে নিশ্চিন্ত হলাম আর কেউ তাড়া করছে না আমাদের।
সবাই তাই মনে করেছিলাম, কিন্তু একটু পরেই বুঝলাম যে আমরা ভুল করেছি। ক্যাম্পের গেট বন্ধ করে আমরা নিজেদের মধ্যে হাত মিলিয়েও সারতে পারিনি, হঠাৎ শুনলাম বাইরে পায়ের শব্দ, সেই সাথে মৃদু কান্নার ধ্বনি।
রাইফেল হাতে লর্ড জন এগিয়ে গেলেন সামনে, একটানে গেটটা খুলে ফেললেন। চারজন ইন্ডিয়ান বন্দীকে দেখা গেল বাইরে মাটিতে লুটাচ্ছে। আমাদের শক্তি দেখে ভীত, কিন্তু সাহায্যপ্রার্থী। হাতের ইশারায় একজন বুঝিয়ে দিল যে চতুর্দিকে বিপদ। তারপর সামনে এগিয়ে এসে সে লর্ড জনের পা চেপে ধরল, তার মাথা জনের পায়ের উপর।
হায় খোদা, বলে উঠলেন জন, এদের নিয়ে এখন কি করি? উঠে দাঁড়াও পা ছাড়ো।
সামারলী তাঁর পাইপে তামাক ভরায় ব্যস্ত ছিলেন। তিনি বললেন, ওদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা আমাদের কর্তব্য। আমাদের সবাইকেই তোমরা মৃত্যু মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছ। ঘটনাটা এখনও ঠিক পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছে না, তবে তোমরা খেলা একটা দেখিয়েছ বটে!
প্রশংসনীয়, বললেন চ্যালেঞ্জার, সত্যিই প্রশংসনীয়। শুধু আমরাই নই, বিজ্ঞান জগৎ তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। আমার আর প্রফেসর সামারলীর অন্তর্ধানে নিঃসন্দেহে ইউরোপীয় প্রাণী বিজ্ঞান ক্ষতিগ্রস্ত হত। জন আর আমাদের তরুণ সঙ্গী চমৎকার কাজ করেছে, অস্বীকার করব না।
পিতৃসুলভ প্রশান্ত হাসিতে আমাদের অদ্ভাসিত করলেন তিনি। কিন্তু তাঁর ছেড়া কাপড় বিপর্যস্ত অবস্থা আর সেই সাথে অবিন্যস্ত চুল দেখে এই মুহূর্তে সমাজ তাকে গ্রহণ করত কিনা সে সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। চ্যালেঞ্জার একটা অস্ট্রেলিয়ান মাংসের টিন তার দুই হাঁটুর ফাঁকে ধরলেন, ইন্ডিয়ানটা তার দিকে একবার তাকিয়েই আবার গিয়ে জনের পায়ে পড়ল।
আপনার আকৃতি ঠিক স্বীকার করে নিতে পারছে না বেচারা, অহেতুক ভয় পাচ্ছে। এজন্যে অবশ্য দোষ দেয়া যায় না ওকে, বেচারা তো আমাদের মতই একজন মানুষ-ছোট্ট মানুষ!
বটে! রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠলেন চ্যালেঞ্জার। বটে!
আপনার চেহারাটা ওই চীফের মত না হলে ভিন্ন কথা ছিল। আপনাকে ভয় পেলে ওদের ঠিক দোষ দেয়া যায় না।
একটু বেশি বলে ফেলছেন না কি, লর্ড রক্সটন? প্রশ্ন করলেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার।
আমি যথার্থই বলেছি।
আপনার বর্ণনা নিতান্ত অযৌক্তিক আর অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু এদের নিয়ে কি করব সেটাই আমাদের কাছে বড় প্রশ্ন এখন। ওদের বাড়ি পৌঁছে দেয়া দরকার, কিন্তু ওদের বাড়ি কোথায় তা কে জানে?
আমি চিনি, বললাম আমি, ওরা লেকের ওপারেই থাকে।
আমাদের তরুণ বন্ধু জানে ওরা কোথায় থাকে, কিন্তু সে জায়গাটা বেশ কিছুটা দূরে বলেই আমার ধারণা।
প্রায় বিশ মাইল হবে এখান থেকে।
সামারলী গলার ভিতর থেকে একটা আওয়াজ করে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন।
ওই বনমানুষের প্রাচীর ভেদ করে আমরা এতদূর পৌঁছানোর কোন আশাই করতে পারি না।
আমার কথা শেষ হবার আগেই দূর থেকে বনমানুষের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। ভয়ে ইন্ডিয়ানরা বিলাপের সুরে ককিয়ে উঠল।
লর্ড জন বললেন, শিগগির আমাদের সরে যেতে হবে এখান থেকে, ধরা পড়ার আগেই সরে যেতে হবে। প্রফেসর সামারলীকে তুমি সামলাবে, মালমসলা ইন্ডিয়ানরা নিতে পারবে। ওরা আমাদের দেখে ফেলার আগেই চলুন বেরিয়ে পড়ি।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা আমাদের গুপ্ত আস্তানায় আশ্রয় নিলাম। সারাদিন ধরেই চারপাশে উত্তেজিত বনমানুষের সাড়া পেলাম। বেশির ভাগই আমাদের পুরানো ক্যাম্পের দিক থেকে। আমাদের এদিকে বিশেষ কোন সাড়া পেলাম না। সবাই কমবেশি ঘুমিয়ে নিলাম, আমিও ঘুমালাম। সন্ধ্যার সময়ে হাতায় কিসের টান পড়তে আমার ঘুম ভেঙে গেল, দেখি চ্যালেঞ্জার আমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন।
তুমি এইসব ঘটনা ছাপাবার জন্যে একটা ডায়েরী রাখো তাই না, মিস্টার ম্যালোন? বিষণ্ণ মুখে গভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন চ্যালেঞ্জার।
এখানে আমি এসেছি কাগজের রিপোর্টার হিসাবে, জবাব দিলাম আমি।
ঠিক তাই, তুমি হয়তো শুনে থাকবে লর্ড রক্সটন আমার সম্বন্ধে কিছু উদ্দেশ্যবিহীন মন্তব্য করেছেন। উনি বলতে চান যে আমার আর ওই বনমানুষের চীফের সাথে..মানে…একটা…
হ্যাঁ, শুনেছি আমি।
কিন্তু এমন একটা কথা ছাপা হলে সেটা আমার পক্ষে খুব অসম্মানজনক আর হৃদয়বিদারক হবে।
সত্যি ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু ছাপব না আমি, তাঁর মনে আঘাত না দিয়ে সান্তনা দিলাম আমি।
জনের মন্তব্য আর যুক্তি বেশির ভাগই অবান্তর আর নীচু শ্রেণীর, ওগুলো কেবলমাত্র মানুষের সম্মান আর চরিত্রের প্রতি অহেতুক কটাক্ষ। আমি কি বলছি বুঝতে পারছ তো?
অবশ্যই।
পুরোটাই তোমার বিচারের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি আমি। এরপর অনেকক্ষণ চুপ থেকে আবার বললেন, অবশ্য এটা ঠিক যে বনমানুষের চীফ সত্যিই অত্যন্ত অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যেমন দর্শন তেমনি বুদ্ধিমান, তোমারও কি তাই মনে হয় না?
বিশিষ্ট প্রাণী সন্দেহ নেই, জবাব দিলাম আমি।
প্রফেসর ফিরে গেলেন তার জায়গায়, তাকে এখন অনেকটা আশ্বস্ত মনে হলো।