হারানো পৃথিবী: ১১. আমার বুকটা সেদিন সত্যিই গর্বে ফুলে উঠেছিল

হারানো পৃথিবী: ১১. আমার বুকটা সেদিন সত্যিই গর্বে ফুলে উঠেছিল

১১. আমার বুকটা সেদিন সত্যিই গর্বে ফুলে উঠেছিল

আমার বুকটা সেদিন সত্যিই গর্বে ফুলে উঠেছিল যেদিন আমার তিনজন গুণী সঙ্গী আমাকে এই সাফল্যের জন্যে অভিনন্দন জানালেন। দলের প্রচুর সময় আর পরিশ্রম বেঁচে গেল। আমি দলের সবচেয়ে ছোট সদস্য। ছোট কেবল বয়সে নয়-অভিজ্ঞতায়, জ্ঞানে, আরও অন্যান্য দিক থেকে। সত্যিকারের মানুষ হতে যে সব যোগ্যতার দরকার হয়, সবদিক থেকেই আমি ওঁদের কনিষ্ঠ। শুরু থেকেই ওঁদের ছায়ায় ঢাকা পড়ে ছিলাম আমি, কিন্তু নিজের উদ্যোগে সেই ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি আজ।

সেই রাতে অহেতুক উত্তেজনায় কিছুতেই ঘুমাতে পারলাম না আমি। সামারলী পাহারায় ছিলেন। কুঁজো হয়ে আগুনের ধারে বসে আছেন, রাইফেলটা তার হাঁটুর উপর আড়াআড়ি ভাবে রাখা। তার ছাগলা দাড়ি নড়ছে ঝিমানির তালে তালে। দক্ষিণ আমেরিকার একটা পঞ্চো জড়িয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছেন জন। চ্যালেঞ্জার শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে একটু একটু গড়াচ্ছেন আর তার নাক ডাকছে বিকট শব্দ তুলে।

পূর্ণিমার বিরাট চাঁদটা চারদিক আলো করে রেখেছে-বাতাস নির্মল সতেজ, একটু ঠান্ডা-ঠান্ডা। হেঁটে বেড়িয়ে আসার জন্যে চমৎকার একটা রাত। হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল চিন্তাটা, অসুবিধা কি? চুপিচুপি বেরিয়ে লেকের পাড় থেকে ঘুরে আসতে কোনো বাধা নেই। সকালের নাস্তার সময়ে এই জায়াগটা সম্পর্কে যদি আরও কিছু তথ্য নিয়ে ফিরতে পারি, সবাই আমাকে তাদের যোগ্য সহকর্মী মনে করবেন। যখন ফিরে যাবার উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে, আর আমরা লন্ডনে ফিরব তখন আমিই থাকব মালভূমির কেন্দ্র এলাকার রহস্যের একমাত্র চাক্ষুষ দর্শক।

গ্লাডিসের কথা মনে পড়ল আমার। আমাদের চারপাশেই রয়েছে নানান ধরনের নায়কোচিত কাজ। পরিষ্কার তার গলা যেন শুনতে পেলাম আমি। আমাদের এডিটর মাকারডলের কথাও একবার মনে হলো, কেমন জমজমাট একটা তিন কলাম প্রবন্ধ যাবে কাগজে। পেশায় উন্নতি করার জন্যে অতি চমৎকার সুযোগ।

একটা রাইফেল তুলে নিয়ে পকেটে গুলি বোঝাই করে কাটা গাছের বেড়া সরিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেরুবার আগে একবার পিছন ফিরে দেখলাম সামারলী ঘুমে অচেতন। নিরর্থক প্রহরী–তখনও একই ভাবে একটা যন্ত্র-নিয়ন্ত্রিত পুতুলের মত নিয়মিত তালে ঝিমাচ্ছেন আগুনের ধারে।

একশো গজও যাইনি আমি তখনও, নিজের গোয়ার্তুমির জন্যে গভীর অনুশোচনা হলো। আগেই বলেছি আমি খুব একটা সাহসী লোক নই। কিন্তু ভয় পেয়েছি তা স্বীকার করার ভীতিই যেন আমাকে সামনে টেনে নিয়ে চলল। কিন্তু কিছু একটা না করে গোপনে ক্যাম্পে ফিরে যেতে পারলাম না। ফিরে গেলে কেউ হয়তো আমার অনুপস্থিতি টেরই পাবে না–আমার দুর্বলতার কথাও জানবে না, কিন্তু নিজের বিবেকের কাছে কি জবাব দেব আমি? আমার বর্তমান অবস্থাটা চিন্তা করে শিউরে উঠলাম। ওই অবস্থা থেকে মানেমানে রেহাই পাবার জন্যে আমি পার্থিব যে কোন কিছু হারাতে রাজি।

বনের মধ্যে ভয়াবহ অবস্থা। জঙ্গল, ঝোপ, তা সবই আরও ধন হয়েছে। চাঁদের আলো পৌঁছাচ্ছে না নিচে। মাঝে মধ্যে পাতার ফাঁক দিয়ে একটু আলোর ঝিলিক দেখা যায় তারা ভরা আকাশের বুকে। আলোর স্বল্পতা চোখে এক রকম সয়ে এল, দেখলাম গাছের মাঝে মাঝে আঁধারের কালো সব জায়গায় এক রকম নয়। কিছু গাছ আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে আবার কিছু জায়গা একেবারে কয়লার মত কালো। ওগুলো দেখে গা ছমছম করে উঠছে আমার। ইগুয়েনোডটার বিকট অর্তচিৎকারের কথা মনে পড়ল। জনের হাতের কাঠের আগুনে দেখা ফুসকুড়ি তোলা মুখটাও সেই সঙ্গে মনে পড়ল আমার। এই মুহূর্তে আমি দাঁড়িয়ে আছি তার শিকারের জায়গায়। যে কোন সময়ে সে অন্ধকারের আড়াল থেকে ঝাপিয়ে পড়তে পারে আমার ওপর।

একটু থামলাম আমি। পকেট থেকে গুলি বের করে ভরার জন্যে রাইফেলটা খুললাম। লিভারের ওপর হাত পড়তেই বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। রাইফেল নয়, ভুলে ছররা গুলির বন্দুক নিয়ে এসেছি আমি!

ক্যাম্পে ফিরে যাবার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠল আমার। ফিরে যাবার জন্যে এই একটি যুক্তিই যথেষ্ট; কেউ আমাকে কাপুরুষ ভাববে না। কিন্তু আবার সেই মিথ্যা গর্ব আমাকে ঘিরে ধরল, ব্যর্থ হলে চলবে না, সফল আমাকে হতেই হবে। যে সব ভয়ানক বিপদের মধ্যে আমাকে পড়তে হতে পারে সে সব ক্ষেত্রে রাইফেলও হয়তো বন্দুকের সমানই কাজে আসবে। ক্যাম্পে ফিরে অস্ত্র বদলে রাইফেল নিয়ে আসতে গেলে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। সে ক্ষেত্রে আমাকে অনেক কৈফিয়তও দিতে হবে এবং আমার একক প্রচেষ্টা তখন আর একক থাকবে না। কিছুক্ষণ ইতস্তত করলাম, তারপর সাহসে বুক বেধে আবার সামনে এগুলাম।

জঙ্গলের অন্ধকার ভয়ঙ্কর। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল ইগুয়েনোডনের মাঠে চাঁদের আলো। ঝোপের পিছনে লুকিয়ে ভয়ে ভয়ে আমি মাঠের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকালাম। বড় কোনো প্রাণী নজরে পড়ল না। হয়তো সেই রাতে বিপর্যয় ঘটার পর থেকেই ওরা খাবারের জন্যে চরে বেড়াবার জায়গা বদল করেছে। সামান্য কুয়াশাচ্ছন্ন রূপালী চাঁদের আলোয় কোন প্রাণী আমার নজরে পড়ল না। সাহস সঞ্চয় করে মাঠটা খুব দ্রুত পার হলাম আমি। তারপর আবার স্রোতের ধারা ধরে এগিয়ে চললাম। ছোট্ট পানির ধারাটা আমার মনের জোর অনেকখানি বাড়িয়ে দিল। কুলকুল শব্দে বিশ্বস্ত বন্ধুর মতই বয়ে চলেছে সে। ছেলেবেলায় ইংল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলে অনেক রাতই এমন ছোট্ট নদীতে ট্রাউট মাছ ধরেছি আমি। এই ধারাটা অনুসরণ করে গেলেই লেকে পৌঁছতে পারব—আর উল্টোদিকে গেলে পৌঁছব ক্যাম্পে।

চলার পথে মাঝেমাঝে আমাকে ধারাটি থেকে একটু দূরে সরে যেতে হচ্ছে, ঘন জঙ্গল এড়ানোর জন্যে, কিন্তু মিষ্টি কুকা আওয়াজ সব সময়েই কানে আসছে আমার।

ঢাল দিয়ে নিচে নামতে নামতে জঙ্গলটা পাতলা হয়ে এল। ফাঁকে ফাঁকে বড় গাছ আর এখন নেই। বেশ দ্রুত চলেছি আমি। নিজেকে দেখা না দিয়ে বেশ তাড়াতাড়ি এগুতে পারছি। টেরাডাকটিলের আস্তানার খুব কাছ দিয়েই পার হলাম। পাশ দিয়ে যেতে ওদের একটা আকাশে উড়ল, চাঁদের আলোয় বিরাট ছায়া মাটিতে পড়েছে। আমি মাটির সাথে মিশে উপুড় হয়ে লুকিয়ে রইলাম। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমার ভালই জানা আছে যে ওদের কারও একটার ডাকে শয়ে শয়ে টেরাড্যাকটিল আকাশে উড়বে! এটা আবার নিচে না নামা পর্যন্ত আর সাহস করে আগে বাড়লাম না আমি।

নিস্তব্ধ রাত। কিন্তু আগে বাড়ার সাথে সাথে আমি একটা গর গর শব্দ শুনে সচেতন হলাম। একটানা একটা শব্দ আসছে আমারই একটু সামনে থেকে। একটু আগে বাড়তেই শব্দটা আরও জোরদার হলো। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে শব্দটা আমার খুব কাছে থেকে আসছে। আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম। বুঝলাম একটা আবদ্ধস্থান থেকে শব্দটা আসছে। অনেকটা টগবগ করে পানি ফোটার শব্দের মত। অল্পক্ষণের মধ্যেই শব্দের উৎপত্তি স্থলে পৌঁছলাম আমি। ছোট একটা ফাঁকা জায়গায় একটা ছোট্ট ডোবা। ট্রাফালগার স্কোয়ারের ঝর্নার চেয়ে বড় হবে না। কালো আলকাতরার মত জিনিস ফোস্কার মত ফুলে উঠে শব্দ তুলে ফেটে যাচ্ছে। আশেপাশের বাতাস গরম, মাটিও এমন গরম যে হাত রাখা যায় না। স্পষ্টতই বোঝা গেল যে আগ্নেয় শক্তিতে এই মালভূমির সৃষ্টি, দাপট কমলেও শক্তি এখন পর্যন্ত একেবারে ফুরিয়ে যায়নি।

আমার চারপাশে কেবল কালো হয়ে যাওয়া পাথর আর লাভার স্রোতের চিহ্ন। ঘন সবুজ গাছ গাছড়া ঘিরে রেখেছে সেগুলোকে। কিন্তু আর বেশি সময় নেই আমার হাতে, ভোরের আগে ফিরতে হলে এখনই লেকের পথে রওনা হতে হবে।

সুন্দর চাঁদের আলো ভরা রাতে আমি ফাঁকা জায়গায় গাছের ছায়ায় ছায়ায় লুকিয়ে এগুতে লাগলাম। পা টিপে টিপে চলেছি, একটু পরপরই ডালপালা ভেঙে কোনো জন্তুর চলার শব্দে থমকে দাঁড়াতে হচ্ছে। মাঝে মাঝেই এক একটা বিরাট ছায়া অস্পষ্ট ভাবে ভেসে উঠছে সামনে, আবার পরক্ষণেই মিলিয়ে যাচ্ছে। ওরা যেন তুলোর পায়ের উপর ভর দিয়ে চলাফেরা করছে।

শেষ পর্যন্ত সামনে খোলা জায়গায় পানির উপর চাঁদের আলোর অস্পষ্ট ঝিলিক চোখে পড়ল। ঘড়িতে দেখলাম রাত একটা বাজে। দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমি লেকের ধারে নলখাগড়ার ভিতর।

গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে আমার, ঝুঁকে পড়ে লেকের পানি খেলাম, তাজা ঠান্ডা পানি। মাটিতে চওড়া পথের উপর নানা রকম পায়ের ছাপ। নিশ্চয়ই জীবজন্তুর পানি খাবার জায়গা এটা।

পানির ধারে লাভার একটা বিরাট চাক পড়ে রয়েছে। সেটার উপরে উঠলাম আমি। সেখানে শুয়ে চারদিক চমৎকার পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করল গুহার মুখগুলো। প্রত্যেকটাই লালচে আলোর চাক্কির মত দেখাচ্ছে—অনেকটা জাহাজের পোর্টহোলের মত। কিন্তু আলো কোত্থেকে আসছে? কোন আগ্নেয় প্রক্রিয়া? কিন্তু না, অত উপরে তো সেটা সম্ভব নয়। চিন্তার ঝড় বয়ে চলল মাথায়, তবে কি…? অবশ্যই, আগুন জ্বলছে গুহার ভিতরে। আগুন। মানুষ ছাড়া তো আর কারও পক্ষে আগুন জ্বালানো সম্ভব নয়। আমার অভিযান যথার্থই সার্থক হলো। লন্ডনে নিয়ে যাবার মত একটা গরম খবর মিলল।

অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে আমি কাপা আলোগুলো লক্ষ্য করলাম। আমার থেকে প্রায় দশ মাইল দূরে হবে, এতদূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে যে কেউ সামনে দিয়ে গেলেই আলোটা মিটমিট করে ওঠে।

ওখানে পৌঁছে চুপিচুপি উঁকি দিয়ে যদি একটু দেখতে পারতাম এই অদ্ভুত দেশে যে মানুষ বাস করে তারা দেখতে কেমন, বা কি স্বভাবের; কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা সম্ভব নয়। ওদের সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু না জেনে আমাদের ফিরে যাওয়া কিছুতেই ঠিক হবে না।

আমার সামনে রূপালী পারার মত ঝিকমিক করছে গ্ল্যাডিস লেক -আমার অতি আপন হ্রদ। প্রতিফলিত চাঁদটা ঠিক লেকের মাঝখানে ঝিকমিক করছে। লেকটা খুব গভীর নয়। কয়েক জায়গাতেই আমি চর দেখতে পেলাম। স্থির পানিতে প্রাণের প্রাচুর্য চোখে পড়ল, ছোট ছোট গোলাকার ঢেউ, লাফিয়ে ওঠা মাছের চকচকে সাদা পেট, কখনও আবার কোন বিরাট জানোয়ারের কালো কুঁজো পিঠ। রাজহাঁস আকারের বিরাট একটা প্রাণী দেখলাম এক হলুদ চরের ধারে পানি নামল, কিছুদূর এগিয়েই ডুব দিল, তারপর আর দেখা গেল না।

দূর থেকে কাছে দৃষ্টি ফিরে এল আমার। দুটো আর্মাডিল্লোর মত প্রাণী, ছুঁচোর মত দেখতে, আকারে ছুঁচোর চেয়ে অনেক বড়, সারা গায়ে মাছের আঁশের মত শক্ত আবরণ। জলার ধারে পানি খেতে এসেছে। পাড়ে বসে লাল ফিতার মত লম্বা জিভ দ্রুত নেড়ে চপচপ করে পানি খাচ্ছে।

একটা বিরাট শিঙওয়ালা রাজকীয় চালের হরিণ দুটো বাচ্চা আর হরিণীর সাথে আর্মাডিল্লো দুটোর পাশে দাঁড়িয়ে পানি খেলো। এতবড় হরিণ আজ পৃথিবীর কোথাও নেই। সবচেয়ে বড় এলকও এর কাঁধের সমান উঁচু হবে কিনা সন্দেহ। হঠাৎ সচকিত হয়ে সবাইকে নিয়ে নলখাগড়ার ভিতরে ঢুকে গেল ওরা। আর্মাডিল্লো দুটাও ছুটল নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে। আর অল্প পরেই আগন্তুককে দেখা গেল। পথ ধরে এগিয়ে আসছে–ভীষণ আকৃতির এক জানোয়ার।

মুহূর্তের জন্যে মনে হলো কোথায় যেন দেখেছি আমি ওই আকৃতি। কুঁজো পিঠ, তার উপরে কালো ত্রিভুজের মত ঝালর। পাখির মাথার আকৃতির বিরাট মাথাটা মাটির সামান্য উপরে রয়েছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার। স্টিগেসরাস! এরই ছবি এঁকেছিলেন মেপল হোয়াইট; হয়তো একেই স্কেচ করেছিলেন শিল্পী। পাঁচ মিনিট পর্যন্ত জন্তুটা আমার পাথরের চাকের এত কাছে ছিল যে আমি হাত বাড়ালেই ওর পিঠের ঢেউ খেলানো খাঁজ ছুঁতে পারতাম। তার প্রচন্ড ভারে মাটি কাঁপছিল, পানি খাওয়া শেষ করে সে হেলেদুলে পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ঘড়ি দেখলাম, রাত আড়াইটা বাজছে। এখনই রওনা না হলে সময় মত ক্যাম্পে পৌঁছতে পারব না। দিক চিনতে কোন কষ্ট হলো না আমার, পানির ধারাটাকে বাঁয়ে রেখে এগিয়ে চললাম। খুশি মনে চলেছি আমি, আজকের রাত সফল হয়েছে আমার। এখন শুধু সঙ্গীদের খবরগুলো দিয়ে চমকে দেবার অপেক্ষা। চলতে চলতে ভাবলাম পৃথিবীর কোন মানুষই বোধ হয় এর আগে আর এত ঘটনাবহুল একটা রাত কাটায়নি।

নানান কথা ভাবতে ভাবতে ঢাল বেয়ে উপরে উঠছি আমি। প্রায় অর্ধেক পথ চলে এসেছি, হঠাৎ আমার পিছন দিকে একটা অদ্ভুত শব্দ আমাকে স্বপ্নের রাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল। কুকুরের রাগে গোঁ গোঁ শব্দ আর নাক ডাকার শব্দের মাঝামাঝি একটা আওয়াজ, নিচু, গভীর স্বর। হিংস্র এবং আতঙ্কজনক।

অজানা কোন জন্তু রয়েছে আমার আশেপাশেই, কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পা চালিয়ে এগুলাম, আধমাইল মত পথ চলার পরেও একই শব্দ আবার আমার কানে এল। এবারও পিছন থেকেই আসছে আওয়াজ, কিন্তু আরও জোরে, আরও ভয়ঙ্কর। হৃৎস্পন্দন,যেন থেমে গেল আমার, যে জন্তুই হোক না কেন সে যে আমার পিছু নিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল, ভয়ে সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে গেছে।

বাঁচার তাগিদে জন্তুগুলো নিজেরা মারামারি করে একে অন্যকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষের পিছু লাগবে, পিছনে পিছনে অনুসরণ করে এসে জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ শিকার করবে এটা ভীতিজনক। সেদিনকার রাতের বীভৎস জীবটার মুখ ভেসে উঠল আমার স্মৃতিপটে।

আবারও সেই শব্দ! এবার আরও জোরে, আরও কাছে। সন্দেহ নেই আমারই পিছু নিয়েছে সে। আমাদের মধ্যেকার দূরত্ব কমে আসছে প্রতি মিনিটে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোকের মত দাঁড়িয়ে রইলাম আমি, যে পথে এসেছি সেদিকে তাকাতে হঠাৎ দেখা গেল জন্তুটাকে। আমি যে ফাঁকা জায়গাটা পার হয়ে এসেছি তারই উল্টো দিকের ঝোপ-ঝাড় নড়ে উঠল, তারপর অন্ধকারের ভিতর থেকে একটা বিশাল কালো ছায়া ক্যাঙ্গারুর মত লাফাতে লাফাতে পরিষ্কার চাঁদের আলোয় বেরিয়ে এল। খাড়া হয়ে তার শক্তিশালী পিছনের পায়ের সাহায্যে লাফাচ্ছে, সামনের দুটো পা বাঁকা তাবস্থায় শূন্যে ঝুলছে। হাতির মত বিরাট বড় আর শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও জন্তুটার চলা অত্যন্ত ক্ষিপ্র।

আশায় বুক বাঁধলাম যে ওটা হয়তো একটা ইগুয়েনোডন হবে; আমি জানি ওরা মানুষের কোন ক্ষতি করে না, নিরামিষাশী। কিন্তু পরক্ষণেই আমার ভুল ভাঙল; এই রকমই একটা জন্তু হানা দিয়েছিল আমাদের ক্যাম্পে। ওরাই পৃথিবীর বুকে বিচরণকারী জন্তুদের মধ্যে সবচেয়ে হিংস্র ডাইনোসর। প্রত্যেক বিশগজ চলার পরেই ঝুঁকে পড়ে মাটি শুকতে লাগল ওটা।

শুকে শুকে অনুসরণ করছে আমাকে। দুই একবার কিছুটা ভুল পথে চলে গেলেও ফের শুধরে নিতে ওর সময় লাগল না, আবার লাফাতে লাফাতে ঠিক আমার পিছু পিছু এগিয়ে এল জীবন্ত বিভীষিকা।

ভয়ে আমার হাত পা পেটের ভিতর ঢুকে যাবার যোগাড় হলো। এই বিশাল দানবের বিরুদ্ধে একটা ছররা বন্দুক দিয়ে কি করব আমি? গুলিতে আঁচড়ও লাগবে না ওর গায়ে। পাথর বা কোন বড় গাছের খোঁজে চারপাশে চাইলাম আমি; কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, ছোট ঝোপ আর লতা ছাড়া আশেপাশে আর কিছুই নজরে পড়ল না। গাছে উঠেও কোন ফল হবে না, জানোয়ারটা বড় বড় গাছ দিয়াশলাইয়ের কাঠির মত মট করে ভেঙে ফেলতে পারবে। প্রাণপণে ঝেড়ে দৌড় দেয়া ছাড়া আর অন্য উপায় নেই এখন।

উঁচু নিচু ভাঙাচোরা জমির উপর দিয়ে তাড়াতাড়ি চলতে পারছি না আমি। হতাশার মাঝে হঠাৎ পরিষ্কার চোখে পড়ল একটা পায়ে চলার পথ! আমরা আগেও মালভূমিতে ঘোরাফেরা করার সময়ে এই ধরনের পথ কয়েকটা দেখেছি। এই পথ ধরে ঝেড়ে দৌড় দিলে সম্ভবত ওটা আর আমাকে ধরতে পারবে না; খুব ভাল দৌড়াতে পারি আমি, শরীরও মজবুত আছে।

অনাবশ্যক বন্দুকটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুটলাম আমি। জীবনে আর কোনদিন এত দ্রুত দৌড়াইনি, পরেও বোধহয় আর কোনদিন পারব না। ছুটতে ছুটতে এক সময় দুই পা ধরে এল, হাপরের মত হাঁপাচ্ছি। গলাটা বাতাসের অভাবে ফেটে যাবে মনে হচ্ছে। কিন্তু তবু থামলাম না আমি, ছুটতে লাগলাম, প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম, পিছনে আমার সাক্ষাৎ যম।

এক সময়ে পিছনে ফেলে আসা পথটা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল, আর কোন শব্দ নেই। ভাবলাম, এযাত্রায় বেঁচে গেছি। কিন্তু পরক্ষণেই ভুল ভাঙল, নিষ্ঠুর নিয়তির মত ধুপ ধুপ শব্দ তুলে এগিয়ে আসছে জন্তুটা-ধরে ফেলল বলে আমাকে। হেরে গেছি আমি, বাঁচার আর কোন উপায় নেই।

আবার ছুটবার আগে বোকার মত অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছি আমি। এতক্ষণ জন্তুটা আমাকে অনুসরণ করছিল গন্ধ শুকে, কিন্তু এখন সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে আমাকে। বিরাট বড় বড় লাফ দিয়ে দ্রুত বেগে এগিয়ে আসছে। বাকটা ঘুরতেই চাঁদের আলো পড়ল তার উপর। ঠিকরে বেরিয়ে আসা বিরাট দুটো হিংস্র চোখ, হাঁ করা চোয়ালে দেখা যাচ্ছে দুই সারি তীক্ষ্ণ দাঁত, সামনের থাবার নখগুলো পর্যন্ত ঝকঝক করছে!

ভয়ে একটা চিৎকার দিয়ে ঘুরেই আবার ছুটলাম আমি। পিছনে পায়ের শব্দও এগিয়ে আসছে। যে কোন মুহূর্তে ওটার থাবা আমার কাঁধের ওপর পড়তে পারে। হঠাৎ নিচে পড়ে জ্ঞান হারালাম আমি।

ধীরে ধীরে আবার জ্ঞান ফিরে এল আমার। মাত্র কয়েক মিনিট অজ্ঞান ছিলাম। একটা তীব্র বোটকা দুর্গন্ধ নাকে এল। অন্ধকারে একটু হাতড়াতেই একহাতে একটা বড় মাংসপিন্ডের মত কি যেন ঠেকল, অন্য হাতে একটা বড় হাড়। মাথার ওপরে দেখলাম গোল খানিকটা আকাশ, তারায় ভরা। একটা গভীর গর্তে পড়ে গেছি আমি। টলতে টলতে আবার উঠে দাঁড়ালাম। মাথা থেকে পা পর্যন্ত নিজেকে পরীক্ষা করে দেখলাম। সারা শরীরে ব্যথা, কিন্তু হাড় ভাঙেনি। একটু আগের ঘটনা মনে পড়তেই আবার উপরের দিকে চাইলাম, ভেবেছিলাম জন্তুর বিরাট আকৃতিটা দেখব, কিন্তু না, আশেপাশে কিছুই নজরে পড়ল না।

গর্তের চারপাশেই ঢালু দেয়াল। তলাটা সমান, প্রায় বিশ ফুট চওড়া হবে। জায়গাটা পচন ধরা মাংসের টুকরায় ভর্তি। বিষাক্ত পরিবেশ। পচা মাংসের দলায় হোঁচট খেয়ে শক্ত কিছু একটার সাথে বাড়ি খেলাম। মাটিতে মজবুত একটা খুঁটি পোঁতা রয়েছে। হাত উঁচিয়ে চর্বি মাখা খুঁটিটার মাথার নাগাল পেলাম না।

হঠাৎ মনে পড়ল, আমার পকেটে দিয়াশলাই, আর মোমমাখানো ফিতা আছে। একটা ফিতা জ্বেলে কিছুটা আন্দাজ পেলাম যে আমি কোথায় আছি। এটা একটা ফাঁদ, মানুষের হাতে তৈরি! খুঁটিটা প্রায় নয় ফুট লম্বা, উপরের দিকটা চোখা, রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। নিচে পড়ে থাকা মাংস ফাঁদে পড়া জন্তুরই দেহাবশেষ। খুঁটি থেকে কেটে নিচে ফেলা হয়েছে যাতে পরবর্তী শিকার ফঁাদের অবস্থান টের না পায়।

প্রফেসর চ্যালেঞ্জার বলেছিলেন যে এইসব শক্তিশালী জানোয়ারের সঙ্গে সংগ্রাম করে মানুষের পক্ষে এখানে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এখন পরিষ্কার বোঝা গেল মানুষ কিভাবে টিকে আছে এইসব জীবজন্তুর মাঝে। সরু মুখের গুহা-যেখানে বড় কোন প্রাণী ঢুকতে পারবে না, এমন জায়গায় বাস করে তারা। আর এসব ফাঁদ পেতে শত্রু ধ্বংস করে। মানুষ সত্যিই সৃষ্টির সেরা!

ওই ঢালু দেয়াল বেয়ে উপরে ওঠা একজন কর্মক্ষম মানুষের পক্ষে কঠিন কাজ নয়। তবু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমি জানোয়ারটার ভয়ে। আশেপাশের কোন ঝোপে সে যে আমার জন্যে ওঁত পেতে বসে নেই তা জানার উপায় নেই। সাহস করে শেষ পর্যন্ত ওপরে উঠলাম। প্রফেসার চ্যালেঞ্জার আর সামারলীর কথাবার্তাগুলো মনে করে সাহস পেলাম। তাদের মত সরিয়ান জন্তুদের মাথার মগজ এতই কম যে তারা কোন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলছে পারে না। আমাকে হঠাৎ অদৃশ্য হতে দেখে নিশ্চয়ই এতক্ষণে সে অন্য কোন শিকারের সন্ধানে চলে গেছে।

গর্তের ধার পর্যন্ত উঠে বাইরে উঁকি দিলাম। সকালের ঠান্ডা হাওয়া লাগল আমার চোখে মুখে। তারাগুলো বিলীন হয়ে এসেছে, পরিষ্কার হয়ে আসছে আকাশ। ধীরে সন্তর্পণে উপরে উঠে গর্তের কিনারে কিছুক্ষণ বসে রইলাম, বিপদ দেখলেই আবার ভিতরে নিরাপদ আশ্রয়ে লাফিয়ে পড়ব। দেখলাম একেবারে শান্ত স্থির পরিবেশ চারদিকে। প্রাণটা হাতের মুঠোয় নিয়ে সাহস করে আবার রওনা হলাম আমি ক্যাম্পের উদ্দেশে। কিছুদূর এগুতেই আমার বন্দুকটা পেলাম। ভয়ে চমকে বারবার পিছনে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে চললাম আমি ফোর্ট চ্যালেঞ্জারের দিকে।

সকালের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা রাইফেলের আওয়াজ আমাকে সঙ্গীদের কথা মনে করিয়ে দিল। থমকে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু না, আর কোন শব্দ হলো না। ওদের কোন বিপদ হয়েছে ভেবে বিব্রত আর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম। কিন্তু পরক্ষণেই একটা অতি সরল আর স্বাভাবিক ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম আমি। সকাল হয়ে গেছে, অথচ আমাকে ক্যাম্পে না দেখে জঙ্গলে পথ হারিয়েছি ধারণা করেই পথ নির্দেশ করতে গুলি ছুঁড়েছে ওরা যদিও গুলি ছোঁড়ার বিষয়ে কঠিন হুঁশিয়ারি রয়েছে, তবু আমি বিপদে পড়েছি মনে করলে তারা গুলি করতে মোটেও দ্বিধা করবেন না। পা চালিয়ে ফিরে চললাম।

ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আমি, শত চেষ্টা করেও আমার অগ্রগতি তেমন দ্রুত করতে পারছি না। এখন চেনা জায়গায় পৌঁছে গেছি, বামে টেরাড্যাকটিলের আস্তানা-সামনে ইগুয়েনোডন মাঠ। একসারি গাছ তার পরেই আমাদের ঘাঁটি। ওদের ভয় কাটানোর উদ্দেশ্যে গলা চড়িয়ে উল্লাসের সঙ্গে চিৎকার করলাম আমি। কোন জবাব পেলাম না, অশুভ নীরবতায় বুকটা ধড়াস করে উঠল আমার। তাড়াহুড়া করে দৌড়াতে আরম্ভ করলাম, বেড়াটা যেমন দেখে গিয়েছিলাম ঠিক তেমনি আছে কিন্তু গেট খোলা! ভিতরে ঢুকে দেখলাম লন্ডভন্ড অবস্থায় পড়ে আছে আমাদের সব জিনিস, আমার কমরেডরা কেউই নেই। নিভু নিভু আগুনের পাশে লাল রক্তে ভেসে রয়েছে কিছুটা ঘাস।

ঘটনার আকস্মিকতায় আমার বুদ্ধি একেবারে লোপ পেল। পাগলের মত ক্যাম্পের আশেপাশে জঙ্গলে ছুটোছুটি করে খুঁজতে লাগলাম আমি। চিৎকার করে ডাকলাম কিন্তু কোন সাড়া এল না। হয়তো কোনদিনই আর তাদের দেখা পার না। এই ভয়াবহ বিপজ্জনক জায়গায় সম্পূর্ণ একা আটকা পড়ে গেছি আমি; নিচে নামার কোন পথ নেই। নানান চিন্তা আমাকে উন্মত্ত করে তুলল। নৈরাশ্যে মাথার চুল ছিড়ে মাথা ঠুকতে ইচ্ছা করছে। আত্মপ্রত্যয়ে ভরপুর চ্যালেঞ্জার, নিপুণ আর হাসিখুশি লর্ড রক্সটন—এঁদের উপর আমি যে কতখানি নির্ভরশীল ছিলাম তা নতুন করে উপলব্ধি করলাম এই মুহূর্তে। তাদের ছাড়া আমি অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া একটি শিশু-উপায়হীন, শক্তিহীন। কোন দিশা নেই কোথায় যাব, কি করব।

কিছুক্ষণ বিভ্রান্ত হয়ে বসে থেকে আমার সঙ্গীদের হঠাৎ কি বিপদ হয়ে থাকতে পারে তা ভাবতে লাগলাম। লন্ডভন্ড অবস্থা দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় যে কোন ভয়াবহ আক্রমণ এসেছিল তাদের ওপর। আর তা এসেছিল সম্ভবত রাইফেলের শব্দ যে সময়ে শোনা গিয়েছে তখনই। মাত্র একটা গুলির শব্দ থেকে প্রমাণিত হয় যে মুহূর্তেই হয়তো শেষ হয়ে গেছে সব ঘটনা। রাইফেলগুলো মাটিতে পড়ে আছে-জনের রাইফেলেই কেবল একটা খালি কার্তুজ পাওয়া গেল। সামারলী আর চ্যালেঞ্জারের কম্বল আগুনের পাশে, আক্রমণের সময়ে তারা নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছিলেন। খাবারের প্যাকেট আর গুলির বাক্সগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে আছে ক্যামেরা আর ক্যামেরার প্লেটের বাক্সের কাছে। এগুলো খোয়া না গেলেও খাবার যা বাইরে ছিল–বেশ কিছু পরিমাণ খাবার, সেগুলো সবই অদৃশ্য হয়েছে। তাহলে জন্তুর আক্রমণই হয়েছিল, স্থানীয় মানুষ হলে কিছুই রেখে যেত না।

কিন্তু জন্তুই যদি হবে তবে নিশ্চয়ই সবাইকে মেরে রেখে যেত, তাহলে আমার সঙ্গীদের কোন চিহ্ন নেই কেন? আগুনের ধারে জমাট বাঁধা রক্ত রক্তপাতের সাক্ষ্য দিচ্ছে। রাতে আমাকে যেটা তাড়া করেছিল তেমন বিশাল জন্তুর পক্ষে মানুষকে মুখে করে টেনে নিয়ে যাওয়া বিড়ালের ইঁদুর নেয়ার মতই সোজা। তেমন কিছু ঘটে থাকলে অন্যান্য সঙ্গীরা পিছু নিত, কিন্তু রাইফেল নেয়নি কেন সাথে? যতই চিন্তা করছি ততই বেশি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই জট ছাড়াতে পারছি না।

ওদের সবাইকে খুঁজতে বেরিয়ে পথ হারিয়ে ফেললাম আমি। এক ঘণ্টা বিভিন্ন দিকে ঘুরে ভাগ্যের জোরে আবার পথ খুঁজে পেলাম। হঠাৎ জাম্বাের কথা মনে পড়তেই কিছুটা সান্তনা পেলাম মনে, একেবারে একা নই আমি। পাহাড়ের গোড়াতেই বিশ্বস্ত জাম্বাে অপেক্ষা করছে। পাহাড়ের ধারে গিয়ে নিচে ঝুঁকে দেখলাম, আগুন জ্বেলে কম্বল বিছিয়ে ঠিকই বসে আগুন পোহাচ্ছে জাম্বাে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম ওর পাশে আরও একজন লোক বসে আছে। আমার সঙ্গীরা নিচে নামার পথ খুঁজে পেয়েছেন মনে করে খুশি হয়ে উঠলাম—কিন্তু ভাল করে লক্ষ্য করতে ভুল ভাঙল আমার; লোকটা ইন্ডিয়ান। চিৎকার করে ডেকে রুমাল নাড়লাম আমি। সাথে সাথেই উপরের দিকে চাইল জাম্বাে। অল্পক্ষণ পরেই ওদিকের পাহাড়ের মাথায় দেখা গেল ওকে। একেবারে কিনারে দাঁড়িয়ে গভীর বেদনার সাথে পুরো ঘটনা শুনল সে।

মাসসা (মিস্টার) মালোন, জিন-ভূতের পাল্লায় পড়েছেন আপনারা সবাই, জাম্বাে গভীর মুখে বলল। অভিশপ্ত দেশে গিয়ে পড়েছেন আপনি, সাহ (স্যার), এখনও আমার কথা শুনুন, জলদি নেমে আসুন, নইলে আপনিও শেষ হবেন।

কিন্তু কি করে নামব, জাম্বাে?

লতা জোগাড় করে এপারে ছুঁড়ে দেন, আমি গুড়ির সাথে বেঁধে দেব, মাস মালোন! আপনার পুল হয়ে যাবে।

সে কথা আমরাও ভেবেছি, কিন্তু এদিকে তেমন কোন শক্ত লতা নেই যে আমাদের ভার বইতে পারবে।

তাহলে দড়ির জন্যে লোক পাঠান, মাসসা মালোন।

কাকে পাঠাব, আর কোথায়ই বা পাঠাব?

ইন্ডিয়ান গ্রামে পাঠান, সাহ। অনেক চামড়ার দড়ি আছে ওখানে। নিচের ইন্ডিয়ানকে পাঠান।

কে ও?

আমাদের দলেরই একজন। অন্যেরা ওকে মেরে পিটিয়ে ওর টাকা পয়সা সব কেড়ে নিয়েছে, তাই আবার আমাদের কাছে ফিরে এসেছে ও। চিঠি নিতে, দড়ি আনতে বা যে কোন কিছু করতেই সে প্রস্তুত।

চিঠি—অবশ্যই! হয়তো সে সাহায্য নিয়ে আসতে পারবে। যাই হোক, অন্তত চিঠিটা পৌঁছলেও বিজ্ঞানের খাতিরে মৃত্যু বরণ সার্থক হবে আমাদের। চিঠিটা যেভাবেই হোক পৌঁছানো দরকার লন্ডনে। বেশ কিছু আমার লেখাই আছে, আজ সারাদিনে আমার বাকি অভিজ্ঞতা লিখে শেষ করতে পারব। সন্ধ্যায় জাম্বােকে আবার উপরে আসার আদেশ দিলাম।

সারাদিন একা একা চিঠি লেখার কাজেই কাটল আমার। যে কোন সাধারণ ব্যবসায়ী বা একজন ক্যাপ্টেনকে পৌঁছে দেয়ার জন্যে আরও একটা চিঠি লিখলাম আমি। তাঁতে রইল দড়ি আর সাহায্য পাঠানোর অনুরোধ। সন্ধ্যায় সব কাগজ পত্র ছুঁড়ে পৌঁছে দিলাম জাম্বাের কাছে, সেই সাথে আমার টাকার থলিটাও। তিনটা মোহর ছিল ওতে, ওগুলো ইন্ডিয়ান লোকটার পারিশ্রমিক। বলা হলো দড়ি নিয়ে ফিরতে পারলে এর দুই গুণ টাকা ওকে দেয়া হবে।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত