হারানো পৃথিবী: ১০. জন ঠিকই বলেছিলেন

হারানো পৃথিবী: ১০. জন ঠিকই বলেছিলেন

১০. জন ঠিকই বলেছিলেন

জন ঠিকই বলেছিলেন যে ওদের দাঁতে কোনরকম বিষ থাকতে পারে। পর দিন সকালে সামারলী আর আমি দুজনেই অসহ্য ব্যথা আর জ্বরে পড়ে রইলাম। চ্যালেঞ্জারের হাঁটুর অবস্থাও ভাল নয়—কোনমতে খুঁড়িয়ে সামান্য চলতে পারেন মাত্র। সারাদিন ক্যাম্পেই থাকলাম আমরা। জন দিনভর কাটা ঝোপের বেড়া আরও চওড়া আর উঁচু করার কাজে কাটালেন। সেদিন সারাটা দিন আমার কেবলই মনে হলো যে আমাদের প্রত্যেকের উপর কেউ আড়াল থেকে কড়া নজর রাখছে। কিন্তু কে বা কেমন করে নজর রাখছে তা কিছুতেই অনুমান করতে পারলাম না।

এই অনুভূতিটা আমার মনে এতই গভীর দাগ কাটল যে প্রফেসর চ্যালেঞ্জারকে না জানিয়ে পারলাম না। তিনি এটাকে আমার জ্বরের ঘোরে মানসিক উত্তেজনা বলে উড়িয়ে দিলেন। বার বার আমি ঝট করে এদিক ওদিক চোখ ফিরিয়ে তাকালাম। প্রতিবারই মনে হলো যেন কিছু একটা দেখতে পাব। কিন্তু না, আমাদের ঘন কালো কাটা ঝোপের বুনানি আর বড় গাছগুলোর ঘন পাতার ভিতরে অস্বাভাবিক কিছুই নজরে পড়ল না। কিন্তু তবু আমার মন থেকে চিন্তাটা গেল না, বরং আরও জোরাল হলো যেন হিংস্র একটা কিছু অলক্ষ্যে আমাদের ঘাড়ে ঝাপিয়ে পড়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে। ইন্ডিয়ান কুসংস্কারের কথাটা মনে পড়ল আমার–কুরুপুরি-বনের পিশাচ! যারা তার এলাকায় অনধিকারপ্রবেশ করে, তারা হয়তো এই ভাবেই মানসিক অশান্তি ভোগ করে।

মেপল হোয়াইট ল্যান্ডে আমাদের তৃতীয় রাত। নিভে আসা আগুনের চারপাশে সবাই আমরা ঘুমিয়ে আছি। হঠাৎ বিকট হুঙ্কার আর চিৎকারে আমরা একেবারে লাফিয়ে উঠলাম। এমন ভয়ঙ্কর শব্দ এর আগে আর কোনদিন শুনিনি। আমাদের ক্যাম্পের কয়েকশো গজের ভিতর থেকেই আসছে শব্দটা। ট্রেনের হুইসেলের মতই কান ফাটা জোরাল আওয়াজ। তবে অনেক গভীর আর কাঁপানো, অসহ্য ব্যথা আর ভয়ের আর্তনাদ। দুহাতে কান বন্ধ করলাম, রীতিমত ঘামতে লেগেছি আমরা। ভয়ে কলজে শুকিয়ে আসছে সবার। সারা জীবনের সব ব্যথা, দুঃখ, প্রতিবাদ যেন ওই চিৎকারের মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। ওই চিৎকারের মাঝেই আবার শোনা গেল একটা ভারী গমকের হাসি, গলার ভিতর থেকে আসা একটা আনন্দের গরর্ শব্দ। তিন চার মিনিট চলল এই দ্বৈত ভীতিপ্রদ হুঙ্কার। গাছের পাতায় ভয়ার্ত পাখি উড়ে ঝটপট শব্দ তুলছে। তারপরে যেমন হঠাৎ করে আরম্ভ হয়েছিল, ঠিক তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেল সব। অনেকক্ষণ সবাই নীরব উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে রইলাম। কিছু ডালপালা আগুনে ফেলে আগুনটাকে একটু উস্কে দিলেন জন। লকলকিয়ে জ্বলে উঠল আগুন, সেই লাল শিখায় সবার সন্ত্রস্ত মুখ ফুটে উঠল।

আসলে ছিল কি ওটা? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

সকালেই জানা যাবে, জবাব দিলেন জন, ঘটনাটা কাছেই কোথাও ঘটেছে।

গম্ভীর থমথমে গলায় প্রফেসর চ্যালেঞ্জার বললেন, জুরাসিক যুগে যে সব বিয়োগান্ত নাটক হত, লেগুনের ধারে নলখাগড়ার ভিতর, তারই একটা নিজের কানে শোনার সৌভাগ্য আজ আমাদের হলো। তার এত আবেগ ভরা গলা এর আগে কোনদিন শুনিনি। তিনি বলে উঠলেন, সেখানে বেশি শক্তিশালী ড্রাগন কমজোরীগুলোকে কাদায় ঠেসে ধরে মারত। মানুষ যে অনেক পরে এসেছে এটা তার জন্যে মঙ্গলজনকই হয়েছে। এই প্রচন্ড শক্তির সামনে মানুষ তার লাঠি আর তীর ধনুক নিয়ে কি করতে পারত? এমন কি আজকের দিনের আধুনিক রাইফেল নিয়েও যে মানুষ ওদের সাথে পারবে তেমন আশা কম।

আমি আমার ছোট্ট বন্ধুর ওপরই আস্থা রাখি, এক্সপ্রেস রাইফেলটাকে আদর করে হাত বুলিয়ে বললেন জন। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে পশুর জয়ী হবার সম্ভাবনাও নেহাত কম নয়।

সামারলী হাত উঁচিয়ে বললেন, চুপ! কিসের যেন আওয়াজ পেলাম।

অখন্ড নীরবতার মাঝে ধুপ! ধুপ! একটা ভারী একটানা শব্দ শোনা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে কোন বড় জন্তুর পায়ের শব্দ। থপ থপ করে পা ফেলে পুরো ক্যাম্প ঘুরল জন্তুটা। তারপর ঠিক আমাদের গেটের কাছে এসে থামল। ওটার শ্বাস প্রশ্বাসের নিচু শব্দ কানে আসছে। মাত্র একটা দুর্বল বেড়ার ব্যবধান এখন। রাতের বিভীষিকা আর আমাদের মাঝে। আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ রাইফেল জাপটে ধরলাম। জন বেড়া থেকে একটা ছোট্ট ঝোপ সরিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করলেন।

ফিসফিস করে বললেন জন, ওই যে! দেখতে পাচ্ছি আমি।

জনের পাশে গিয়ে ঝুঁকে দাঁড়ালাম। আমিও দেখতে পেলাম, গাছের ছায়ার পটভূমিতে খুব গাঢ় কালো একটা আকৃতি দেখা যাচ্ছে। উপুড় হয়ে বসে আছে। জন্তুটা—বলিষ্ঠ, হিংস্র। আকারে একটা ঘোড়ার চেয়ে বড় হবে না, কিন্তু আবছা আকৃতিটা দেখেই বোঝা যায় যে অসীম শক্তি ওর। জন্তুটা একটু নড়ে উঠল আর মুহূর্তের জন্যে আমার মনে হলো যেন ওর সবুজ দুটো চোখ অন্ধকারে জ্বলে উঠল। পরক্ষণে খসখস শব্দ এল কানে। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে ওটা!

আমার রাইফেলটা কক্ করে নিয়ে বললাম, জন্তুটা এবার লাফ দেবে।

গুলি কোরো না, গুলি কোরো না, নিচু গলায় বললেন জন। নিস্তব্ধ রাতে গুলির আওয়াজ বহুদূর যাবে। কেবল একান্ত নিরুপায় হলে তবেই শেষ তুরুপ হিসাবে ওটা ব্যবহার করবে।

ওটা বেড়া পার হলেই আমরা শেষ। বলে একটা অপ্রস্তুত ভাবে কাষ্ঠ হাসি হাসলেন সামারলী।

না, ওকে ভিতরে আসতে দেয়া যাবে না, জন বললেন, কিন্তু আপনারা গুলি করার আগে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। হয়তো আমি এর মধ্যে একটা ব্যবস্থা করতে পারব। দেখি, বলেই আগুনের কুন্ড থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ তুলে নিয়ে প্রবেশ পথের দিকে এগুলেন তিনি। জন্তুটা একটা ক্রুদ্ধ গর্জন করে আরও সামনে বাড়ল। মুহূর্তমাত্র দ্বিধা না করে গেট খুলে ছুটে এগিয়ে গেলেন জন। হাতের জ্বলন্ত কাঠটা দিয়ে সজোরে ওর মুখে একটা খোঁচা মারলেন তিনি।

জ্বলন্ত কাঠের আগুনে জন্তুটার মুখ দেখলাম মুহূর্তের জন্যে। ব্যাঙের মাথার মত দেখতে একটা বিরাট মাথা, আবে ভর্তি কুষ্ঠ রোগীর মত চামড়ার রঙ। মুখে তাজা রক্ত খাওয়ার চিহ্ন। পরক্ষণেই দুড়দাড় করে ঝোপঝাড় ভেঙে ভয়াল রাতের বিভীষিকা অন্ধকারে অদৃশ্য হলো।

জন ফিরে এসে কাঠটা আবার আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে দিলেন। প্রফেসর দুজন সমস্বরে বলে উঠলেন, তোমার এমন ঝুঁকি নেয়া কোনমতেই উচিত হয়নি।

হেসে সহজ ভাবেই বললেন জন, আমার ধারণা ছিল আগুনকে ভয় পাবে জন্তুটা। অবশ্য আমাদের করারও আর কিছু ছিল না, লাফিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লে ওটাকে মারতে গিয়ে আমরা নিজেদের গায়েই গুলি করতাম। কথা শেষ করে একটা চুরুট বের করলেন জন। আশ্চর্য! এমন উত্তেজনাময় একটা কাজ করে আসার পরও আগুন ধরাতে বিন্দুমাত্র কাঁপল না তার হাত।

জনের প্রতি শ্রদ্ধায় ভরে গেল আমার মন। মানুষের সাহসেরও একটা সীমা থাকে, চোখের সামনে এমন দুঃসাহসিক কাজ এর আগে কোনদিন কোন মানুষকে আমি করতে দেখিনি। আচ্ছন্ন, অভিভূত অবস্থায় আমার মুখ থেকে এতক্ষণ আর শব্দ বের হয়নি, এবার নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জিজ্ঞেল করলাম, ওটা কি?

প্রফেসর দুজন দুজনের দিকে চেয়ে ইতস্তত করতে লাগলেন। শেষে সামারলী বললেন, ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিশ্চিত হয়ে ওটাকে কোনো গোষ্ঠীতে ফেলতে পারছি না। বলে আমাদের সাথে যাতে চোখাচোখি না হয় সেজন্যে পাইপে তামাক ভরতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি।

চ্যালেঞ্জার মন্তব্য করলেন, কিছু বলতে অস্বীকার করে আপনি বিজ্ঞানকে যথার্থ সম্মান দেখিয়েছেন। আমিও ভাসাভাসা ভাবে বলব যে ওটা এক ধরনের মাংসাশী ডাইনোসর। এর বেশি কিছু বলতে আমি রাজি নই।

আমাদের মনে রাখতে হবে, বললেন সামারলী, যে এমন অনেক প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী রয়েছে যাদের সঙ্গে আমরা মোটেও পরিচিত নই। এখানে আমরা যত কিছু দেখব তাদের প্রত্যেকটারই নাম আমাদের জানা থাকবে এমন ধরে নেয়া হঠকারিতা হবে।

ঠিক বলেছেন, প্রসন্ন ভাবে বললেন চ্যালেঞ্জার, একটা আনুমানিক শ্রেণী বিভাগ করার চেয়ে বেশি কিছু করার চেষ্টা বেঠিক হবে। আগামীকাল আরও কিছু তথ্য হয়তো পাব যা আমাদের সনাক্ত করার কাজে আসবে। ততক্ষণ চলুন আমরা বিঘ্নিত ঘুম পুরো করে নিই!

জন বলে উঠলেন, কিন্তু পাহারা ছাড়া আর নয়। এরকম জায়গায় আমরা অার ঝুঁকি নিতে পারি না, এরপর থেকে পালা করে এক-একজনকে দুঘণ্টা পাহারায় থাকতে হবে।

ঠিক আছে, বললেন সামারলী, পাইপটা শেষ করেই আমি প্রথম পাহারা আরম্ভ করব।

ডিউটি ভাগাভাগি হয়ে গেল। এর পর থেকে মেপল হোয়াইট ল্যান্ডে আমরা আর পাহারা ছাড়া কোনো রাত কাটাইনি।

সকাল হলে অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা খুঁজে পেলাম গত রাতের হত্যাযজ্ঞের জায়গাটা-ইয়েলোডন মাঠেই ঘটেছে ঘটনা। বিভিন্ন জায়গায় জমাট বাঁধা রক্ত আর সেই সাথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা বিরাট মাংসের টুকরোগুলো দেখে প্রথমে আমরা ধারণা করেছিলাম যে কয়েকটা প্রাণী মারা পড়েছে। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতেই দেখা গেল অনেক নয়, একটা জন্তুই বধ হয়েছে। বোঝা গেল যে ঘাতক আকৃতিতে ছোট হলেও নিহত জন্তুর তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী।

আমাদের দুই প্রফেসর বসে গেলেন টুকরো টুকরো বিশ্লেষণে। প্রত্যেকটা টুকরোতেই ধারাল নির্দয় দাঁত আর দুর্দান্ত শক্তিশালী থাবার স্বাক্ষর রয়েছে।

সাদাটে রঙের এক চাক বিরাট মাংসের টুকরো নিজের দুই হাঁটুর উপর বিছিয়ে চ্যালেঞ্জার বললেন, চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে এখনও যেতে পারি না আমরা। বাঁকা তলোয়ারের মতন দাঁতওয়ালা বাঘের পক্ষেও এই ধরনের জখমের চিহ্ন রাখা সম্ভব, ওদের এখনও গভীর গুহায় মাঝে মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু রাতে যে জন্তুটা দেখেছি সেটা আকৃতিতে অনেক বড়, তাছাড়া সেটা ছিল সরীসৃপ শ্রেণীর। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি যে ওটা খুব সম্ভব ছিল অ্যালোসস।

কিংবা মেগালোসরাস, জোগান দিলেন সামারলী।

ঠিক তাই-বড় মাংসাশী কোন ডায়নোসরেরই কাজ এটা। এই শ্রেণীতেই রয়েছে অনেক ভয়াবহ হিংস্র প্রাণী, এরা একসময়ে পৃথিবীর অভিশাপ ছিল এখন যাদুঘরের শোভা। নিজের রসিকতায় নিজেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন চ্যালেঞ্জার। তার রসবোধ বড় কম, তাই নিজের স্থুল রসিকতায় নিজেই হেসে লুটিয়ে পড়েন।

শব্দ কম করাই ভাল, সংক্ষিপ্ত ভাবে বললেন জন। আমরা জানি না কি রয়েছে আমাদের আশে পাশে। ওই ব্যাটা যদি সকালের নাস্তার জন্যে এখন ফিরে এসে আমাদের দেখতে পায়, তাহলে ব্যাপারটা মোটেই হাসির হবে না। জন চারদিকে একবার তার শিকারী চোখ বুলিয়ে নিলেন। ভাল কথা—ইগুয়েনোডনটার চামড়ায় এই দাগটা কিসের?

স্লেট রঙের আঁশযুক্ত চামড়ার উপর পীচের গোল একটা ছাপ। আমরা কেউ কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম না। সামারলী জানালেন যে দুদিন আগে তিনি এই রকম দাগ দেখেছেন একটা বাচ্চা ইয়েনোডনের গায়ে। চ্যালেঞ্জার কোন মন্তব্য করলেন না, কিন্তু তাঁর মধ্যে একটা প্রত্যয়ের ভাব প্রকাশ পেল যেন ইচ্ছা করলেই ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি আমাদের ধন্য করতে পারেন। জন সরাসরি তার মতামত জানতে চাইলেন।

উপরওয়ালা যদি আমাকে মুখ খোলার অনুমতি দেন আমি সানন্দে মতামত ব্যক্ত করব, খোঁচা দিয়ে বললেন চ্যালেঞ্জার। আপনাদের উপরওয়ালার প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী আমি অন্যের নির্দেশ মেনে চলতে অভ্যস্ত নই। জানতাম না যে নির্মল একটা রসিকতায় হাসতে হলেও আবার অনুমতির প্রয়োজন হয়।

জনকে শেষ পর্যন্ত মাফ চাইতে হলো তার ক্ষুব্ধ অভিমানী ছেলেমানুষীর কাছে। তাঁর ক্ষতে প্রলেপ পড়ার পর একটা ভাঙা ডালের উপর বসে আরম্ভ করলেন চ্যালেঞ্জার-যেন হাজার ছাত্রের একটা ক্লাশে শিক্ষকতা করছেন তিনি, এমনি একটা ভাব;

ওই দাগ সম্বন্ধে আমি আমার সহকর্মী বন্ধুর সঙ্গে একমত। ওটা পীচেরই ছাপ। এই মালভূমি আগ্নেয়শিলায় তৈরি, আর অ্যাসফল্ট বা পীচ এমন একটা জিনিস যা আগ্নেয় শক্তির সাথে সংযুক্ত থাকে। এখানে কোনখানে সম্ভবত পীচ তরল অবস্থাতেই রয়েছে, আর এই জন্তুগুলো তার সংস্পর্শে এসেই ওই দাগ সংগ্রহ করেছে। কিন্তু এরচেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে এখানে মাংসাশী প্রাগৈতিহাসিক দানবের অস্তিত্ব। আমরা জানি মালভূমিটা একটা মাঝারি ইংলিশ কাউন্টির চেয়ে বড় হবে না। এখানে একটা সীমাবদ্ধ এলাকায় নিচের পৃথিবীতে লোপ পাওয়া নানা জীবজন্তু পরস্পর এক সাথে বাস করছে অগুণতি বছর ধরে। এটা খুবই পরিষ্কার যে এমন পরিস্থিতিতে মাংসাশী প্রাণীগুলো অবাধে বংশবৃদ্ধি করে এতদিনে তাদের খাবার ফুরিয়ে ফেলার কথা। হয় তাদের মাংস খাওয়ার অভ্যাস ছাড়তে হবে আর নয়তো ক্ষুধায় মরতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে তা হয়নি এখানে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রয়েছে। যে কারণেই হোক এই ভয়ানক জন্তুর বংশবৃদ্ধি সীমিত আছে। সেই পদ্ধতিটা কি এবং কিভাবে তা কাজ করছে এটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আশা করি ভবিষ্যতে আরও খুঁটিয়ে এদের নিরীক্ষণ করার সৌভাগ্য আর সুযোগ আমাদের হবে।

তেমন সুযোগ না এলেই খুশি হই, আমি মন্তব্য করলাম।

স্কুলের মাস্টারসাহেব যেভাবে দুষ্টু ছেলের অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য এড়িয়ে যান, প্রফেসর ঠিক সেই ভাবে একটু ভুরু উচালেন আমার মন্তব্যে।

প্রফেসর সামারলীর হয়তো এ বিষয়ে কিছু বক্তব্য আছে, বললেন চ্যালেঞ্জার। অতঃপর দুই পন্ডিত দুর্বোধ্য বৈজ্ঞানিক আলোচনায় লিপ্ত হলেন।

সেদিন সকালে আমরা মেপল হোয়াইট ল্যান্ডের একটা ছোট অংশের ম্যাপ তৈরি করলাম। টেরোড্যাকটিলদের আস্তানাটা এড়িয়ে পানির ধারার পশ্চিম পাড়ে থেকে পুবে থাকলাম আমরা। এদিকটায় জঙ্গল খুব ঘন, আমাদের অগ্রগতিও তাই খুব ধীর হলো।

মালভূমির বিপজ্জনক দিকটা নিয়েই বেশি ভেবেছি আমরা। সেদিন এর আর একটা রূপ আমাদের চোখে পড়ল। সারা সকাল অসংখ্য সুন্দর ফুলের ভিতর দিয়ে হাঁটলাম। বেশির ভাগ ফুলের রঙই সাদা বা হলুদ। প্রফেসর দুজন ব্যাখ্যা করে বললেন, এ দুটোই ফুলের আদি রঙ। কোন কোন জায়গা একেবারে ফুলে বোঝাই, ফুলের গন্ধে অদ্ভুত মাদকতা। মৌমাছি গুনগুন করে বেড়াচ্ছে বনে। অনেক গাছের ডাল ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে। কিছু চেনা কিছু অচেনা ফল। পাখি যেগুলো টুকরেছে আমরা কেবল সেগুলোই সংগ্রহ করলাম, অন্যগুলো বিষাক্ত হতে পারে মনে করে এড়িয়ে গেলাম। সুস্বাদু ফলে আমাদের সঞ্চিত খাবারের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেল।

জঙ্গলে কয়েকটা পায়ে চলার পথ দেখলাম—ওগুলো জন্তু জানোয়ারের পায়ের চাপে তৈরি হয়েছে। জলা জায়গায় নানা ধরনের পায়ের ছাপ-ইগুয়েনোডনের ছাপও রয়েছে সেগুলোর মধ্যে। একটা ফাঁকা জায়গায় কতগুলোকে চরতে দেখা গেল। বিনোকিউলার দিয়ে ভাল করে দেখে জন জানালেন যে ওদের সব কটারই গায়ে আলকাতরার কালো দাগ রয়েছে। কিন্তু সকালে আমরা যেটাকে দেখেছি সেটার দাগ ভিন্ন জায়গায় ছিল। এর অর্থ কিছুই বুঝলাম না আমরা।

অনেক ছোট ছোট জন্তুও দেখলাম। যেমন শজারু, আঁশওয়ালা বনরুই, বাঁকাদেঁতো বিচিত্র রঙের বুনো শুয়োর, ইত্যাদি। দূরে একটা পাহাড়ের সবুজ ঢালে মেটে-খয়েরী রঙের একটা জন্তুকে অত্যন্ত দ্রুত ছুটতে দেখলাম। এত জলদি অদৃশ্য হয়ে গেল ওটা যে আমরা কেউ সঠিক বলতে পারব না কি। জনের মতানুযায়ী ওটা যদি সত্যিই হরিণ হয়, তবে বলতেই হবে যে আইরিশ বিশাল এলকের সমান বড় ওটা।

আমাদের ক্যাম্প লন্ডভন্ড অবস্থায় পাওয়ার পর থেকে যতবার আমরা ক্যাম্পে ঢুকি প্রতিবারই বুক দুরুদুরু করতে থাকে। যাই হোক আজ সব কিছু ঠিকঠাক মতই পেলাম। সন্ধ্যায় আমরা আমাদের বর্তমান অবস্থা আর ভবিষ্যৎ কর্মসূচী নিয়ে বিতর্কে বসলাম। সামারলীই প্রথম শুরু করলেন। সারাদিনই মেজাজ একটু চড়া ছিল তার, আগামীকালের করণীয় সম্পর্কে জনের মন্তব্য তার মুখের বাঁধন খুলে দিল।

আমাদের বর্তমানে যা করা উচিত তা হচ্ছে এই ফাঁদ থেকে বের হবার একটা উপায় বের করা, তিক্তভাবে বললেন তিনি। আর আপনারা সবাই মাথা ঘামাচ্ছেন কি করে আরও ভিতরে ঢোকা যায়। আমি বলি আর ঢোকা নয়, এবার বের হবার পরিকল্পনা নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে।

অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি, জনাব, চ্যালেঞ্জার তাঁর রাজকীয় দাড়িতে আঙ্গুল চালাতে চালাতে ভারী গলায় বললেন। একজন বিজ্ঞানের সাধক যে এমন একটা সস্তা মানসিকতার কাছে নতি স্বীকার করবেন এটা সত্যিই দুঃখজনক। আপনি এমন এক রাজ্যে আছেন, যেখানে পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কোন মানুষ যা দেখার বা জানার সুযোগ পায়নি, অথচ আপনি কিনা এখান থেকে সামান্য একটু ভাসাভাসা জ্ঞান নিয়েই ফিরে যেতে ইচ্ছুক। আপনার কাছ থেকে আমি এটা আশা করিনি, প্রফেসর সামারলী।

জবাবে সামারলী বললেন, আপনার মনে রাখা উচিত যে আমার জন্যে লন্ডনে একটা বিরাট ক্লাস পথ চেয়ে আছে। বর্তমানে তারা একেবারে অযোগ্য একজন লোকের হাতে রয়েছে। আপনার কথা ভিন্ন, কারণ যতদূর জানি আজ পর্যন্ত এই ধরনের দায়িত্বপূর্ণ কোন শিক্ষকতার কাজ আপনাকে দেয়া হয়নি।

ঠিকই বলেছেন, একটু বাঁকা ভাবে বললেন চ্যালেঞ্জার। যে মাথা সর্বোচ্চ গবেষণার কাজ চালাবার ক্ষমতা রাখে তার জন্যে শিক্ষকতা করে সময় নষ্ট করা মূর্খতা, এইজন্যেই আমি ওই ধরনের কাজ কখনও গ্রহণ করিনি।

কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন আপনি? ঠোঁট বাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সামারলী।

জন তাড়াতাড়ি কথার মোড় অন্যদিকে ফেরাবার জন্যে বললেন, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এমন একটা জায়গাকে ভালভাবে না দেখে না জেনে লন্ডনে ফেরা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হবে।

আমি বললাম, আমি তো কখনই অফিসে ঢুকে বুড়ো ম্যাকারডলের সামনে দাঁড়াতে পারব না। বিশদ, সম্পূর্ণ রিপোর্ট না দিতে পারলে তিনি কোনদিন আমাকে ক্ষমা করবেন না তাছাড়া আমরা ইচ্ছা করলেও যখন এখান থেকে নামতে পারছি না। তখন তা নিয়ে আলাপ করে কি লাভ?

ছেলেটা নিজের বুদ্ধির ঘাটতি অনেকটা পুষিয়ে নিয়েছে স্বাভাবিক সাধারণ জ্ঞান দিয়ে, মন্তব্য করলেন চ্যালেঞ্জার। ওর শোচনীয় পেশাগত আগ্রহ আমাদের কাছে অবান্তর, তবে একটা কথা ও ঠিকই বলেছে যে উপায় যখন নেই তখন আলাপ আলোচনা করে কোন ফল নেই।

দাঁতের ফাঁকে পাইপটা কামড়ে ধরে সামারলী বললেন, আর কোন কিছু করতে যাওয়াই অনর্থক। লন্ডনের জুওলজিক্যাল ইনস্টিটিউট একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যেই আমাদের এখানে পাঠিয়েছে। প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের কথার সততা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে এবং সেই সাথে আমাদের কাজও শেষ হয়েছে। পুরো মালভূমির খুঁটিনা খতিয়ে দেখতে গেলে বিশেষ ধরনের যন্ত্রপাতি আর অনেক লোকজনের দরকার। আমরা নিজেরা যদি তা করতে যাই তা হলে ফল হবে হয়তো আমরা কেউই ফিরতে পারব না-বিজ্ঞান জগতের একটা অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।

আমরা সবাই যখন উপরে ওঠা অসম্ভব মনে করেছিলাম তখন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার অভিনব উপায়ে আমাদের উপরে আনেন। তিনিই তার চাতুর্য আর কৌশল প্রয়োগ করে আবার আমাদের নিচে নামার পথ দেখাবেন।

স্বীকার করতেই হবে যে সামারলীর বক্তব্য আমার কাছে খুবই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হলো। এমন কি চ্যালেঞ্জারও একটু বিচলিত হলেন। যারা বিশ্বাস করেনি, খবরটা তাদের কাছে না পৌঁছলে তাদের দর্পচূর্ণ হবে না।

নিচে নামার সমস্যাটা প্রথম দৃষ্টিতে ভীষণ মনে হলেও আমার বিশ্বাস যে বুদ্ধি খাটালে একটা উপায় নিশ্চয়ই বের করা যাবে, দাম্ভিক ভাবে বললেন চ্যালেঞ্জার।

আমার বন্ধু প্রফেসর সামারলীর কথা আমি সমর্থন করছি। মেপল হোয়াইট ল্যান্ডে আমাদের দীর্ঘ সময় কাটানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তবে মোটামুটি ঘুরে না দেখে, আর জায়গাটার একটা ম্যাপ না নিয়ে এখান থেকে নড়তে আমি নারাজ।

নাক থেকে ঘোঁত করে একটা শব্দ বের করে অস্থিরতা প্রকাশ করলেন সামারলী। আমরা দুদিন কাটিয়েছি অনুসন্ধান করে কিন্তু এখানকার ভূগোল সম্বন্ধে মোটেও ধারণা হয়নি আমাদের। এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করে অনুসন্ধান করতে চাইলে মাসের পর মাস সময় লাগবে। যদি কোন চুড়া বা উঁচু জায়গা থেকে আমরা মালভূমিটা দেখার সুযোগ পেতাম তবে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেত।

ঠিক এই সময়ে বুদ্ধিটা আমার মাথায় এল। জিঙ্কো গাছের গুঁড়িটাই যদি এত মোটা হয় তবে মাথায়ও নিশ্চয়ই ওটা আর সব গাছকে ছাড়িয়ে গেছে। আর মালভূমিটা ধারের দিকেই সবচেয়ে উঁচু। সুতরাং গাছের মাথায় উঠলে ওখান থেকে পুরো এলাকাটা দেখা যাবে। ছোটকাল থেকেই গাছে চড়ায় আমার জুড়ি ছিল না। কোনমতে একবার প্রথম ডালটাতে উঠতে পারলে বাকিটা সড়সড় করে উঠে যেতে পারব আমি। সঙ্গীরা সবাই আমার প্রস্তাব আনন্দের সাথে গ্রহণ করলেন।

লাল আপেলের মত গাল দুটো ফুলিয়ে চ্যালেঞ্জার বললেন, আমাদের এই তরুণ ছেলেটা শক্ত আছে। আরও সুগঠিত লোকের পক্ষে যে সব কাজ সম্ভব এ তা করতে পারে। আমি এ প্রস্তাবকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

জন পিঠ চাপড়ে দিলেন আমার, বললেন, একেবারে জায়গা মত হাত দিয়েছ হে, এই সোজা জিনিসটা আমাদের মাথায়ই আসেনি। আরও ঘণ্টাখানেক আলো থাকবে, তোমার নোট বইটা নিয়ে গাছে উঠলে হয়তো একটা খসড়া ম্যাপ আজই আঁকতে পারবে।

তিনটে গুলির বাক্স গাছের নিচে একের উপর এক সাজিয়ে জন ধীরে ধীরে আমাকে উপরে তুলছিলেন, কোথা থেকে চ্যালেঞ্জার ছুটে এসে তার বিশাল হাত দিয়ে এক ধাক্কা দিলেন আমাকে, আমার শরীর প্রায় উড়ে উপরের দিকে উঠে এল। মোটা ডালটা জড়িয়ে ধরে পায়ের সাহায্যে চড়ে বসলাম। বেশ ঘনঘনই ডাল বেরিয়েছে গাছটার। ঝটপট উপরে উঠতে লাগলাম আমি। অল্পক্ষণ পরেই লক্ষ্য করলাম, মাটি আর দেখা যাচ্ছে না। মাঝে একবার কেবল একটু বাধা এল, প্রায় দশ ফুট গুঁড়ি বেয়ে সোজা উঠতে হলো। গাছটা সত্যিই বিশাল। উপর দিকে চেয়ে গাছের পাতা পাতলা হবার কোন লক্ষণ দেখলাম না। যে ডালটা বেয়ে উঠছি তাতে ঘন পরগাছা জন্মেছে।

ওপাশে উঁকি দিতেই শরীরের রক্ত হিম হয়ে এলো আমার, ঠিক দুই ফুট দূরেই আমার দিকে চেয়ে আছে একটা মুখ! সেই মুখের অধিকারী জন্তুটা পরগাছার পেছনে উপুড় হয়ে বসে ছিল এবং সে-ও একই সাথে উঁকি দিয়েছে। মুখটা যেন মানুষের অর্থাৎ বানরের চেয়ে মানুষের মুখের সাথেই তার মিল বেশি। লম্বা সাদাটে মুখে ফুসকুড়ি ভরা, নাক থ্যাবড়া। থুতনিতে ঝাটার মত একটু দাড়ি, ভারি ভুরুর নিচে চোখ দুটো ভয়ঙ্কর। দাঁত বের করে আমার দিকে ভেঙচি কাটল সে, চোখে মুখে ঘৃণা আর বিদ্বেষ। হঠাৎ নিমেষের মধ্যে মুখের ভাব পালটে গেল ওর, ভীষণ ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল মুখে। কয়েক লাফে ডাল পালা ভেঙে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল সে। ওর লালচে শুয়োরের মত রোমশ দেহটা কেবল ক্ষণিকের জন্যে দেখলাম আমি।

জনের গলা শোনা গেল, কি হয়েছে—বিপদ হয়নি তো?

দুহাতে ডালটা জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, দেখেছেন ওটাকে? আমার হাত পা তখনও উত্তেজনায় কাঁপছে।

শব্দ শুনে আমরা ভেবেছিলাম পা ফস্কে গেছে বুঝি তোমার, কি হয়েছিল?

হঠাৎ অদ্ভুত জন্তুটার দেখা পেয়ে মনটা দুর্বল হয়ে গেছে আমার। একবার ভাবলাম নেমে যাই, কিন্তু এতদূর ওঠার পরে ভয়ে নেমে যাওয়ার অবমাননা মেনে নিতে পারলাম না।

বেশ কিছুক্ষণ বসে দম আর সাহস একত্র করে নিয়ে আবার উঠতে শুরু করলাম। ভুলে একটা পচা ডালে ভর দিয়ে কিছুক্ষণ হাতের উপর ঝুলতে হলো। কিন্তু মোটামুটি ভাবে বেশ সহজেই উপরে উঠে গেলাম আমি। মাথার উপর গাছের পাতা এখন একটু পাতলা হয়ে এসেছে। মুখে বাতাসের ঝাপটা লাগছে, উপলব্ধি করলাম যে বনের অন্যান্য গাছ ছাড়িয়ে অনেক উপরে চলে এসেছি আমি। মনে মনে সঙ্কল্প করলাম সবচেয়ে উঁচু ডালটিতে না উঠে আর আশেপাশে চাইব না। উঁচু ডালে চড়ে খুঁটি গেড়ে বসলাম, আমার সামনেই আশ্চর্য দেশের অপরূপ দৃশ্য।

সূর্য এখনও পশ্চিম দিগন্তের একটু উপরে রয়েছে। উজ্জল পরিষ্কার বিকেল। আমার নিচে পুরো মালভূমিটাই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমি। আকৃতি অনেকটা ডিমের মত, প্রায় তিরিশ মাইল লম্বা আর বিশ মাইল চওড়া হবে। চারদিক থেকে ঢালু হতে হতে মাঝের দিকে নেমে গেছে, ঠিক মধ্যখানে একটা বিরাট হ্রদ। প্রায় পনেরো মাইল হবে ওটার পরিধি। বিকেলের আলোয় হ্রদের ধারে সবুজ ঘন নলখাগড়ার ঝালর অপূর্ব দেখাচ্ছে। কয়েকটা হলুদ রঙের বালুচর জেগেছে পানিতে। লম্বা কালো কালো কতগুলো জিনিস দেখা যাচ্ছে চরে– কুমীরের চেয়ে অনেক বড়, সরু নৌকার চেয়েও লম্বা। বিনোকিউলার দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম, ওগুলো জীবন্ত।

আমরা মালভূমির যে ধারে সেদিক থেকে হ্রদ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ ছয় মাইল এগিয়ে গেছে জঙ্গল। মাঝে মধ্যে দুএকটা ফাঁকা জায়গা। আমার গাছের বেশ কাছে ইয়েনোডনের মাঠটা, আর একটু সামনে গাছের ফাঁকে গোল গর্তটাই হচ্ছে টেরাড্যাকটিলদের আস্তানা।

আমার উল্টো দিকের চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাইরের দিকে বেসল্টের খাড়া ধার এদিকেও প্রসারিত হয়েছে। প্রায় দুশো ফুট উঁচু হবে। নিচে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে জঙ্গল। বিনোকিউলারে লাল পাথরের গায়ে এক সারি কালো কালো গর্ত চোখে পড়ল। ওগুলো গুহার মুখ বলে ধরে নিলাম আমি। একটি গুহার মুখে কি যেন চকচক করতে দেখলাম, কিন্তু ওটা যে কি এতদূর থেকে ঠিক বুঝতে পারলাম।

সূর্য ডুবে যাওয়ার পরেও আমি অনেকক্ষণ ব্যস্ত রইলাম ম্যাপ আঁকার কাজে। যখন দেখলাম অন্ধকারে আর খুঁটিনাটি চিনতে পারছি না তখন নেমে এলাম। একবারের জন্যে হলেও এই অভিযানের একক নায়ক ছিলাম আমি! বুদ্ধিটাও ছিল আমার আর কাজটাও আমিই সম্পূর্ণ করলাম। এই ম্যাপটা আমাদের মাসের পর মাস বিপদ মাথায় নিয়ে কানার মত জঙ্গলে হাতড়ে বেড়ানোর হাত থেকে বাঁচাল।

গাছ থেকে নেমে আসতেই সবাই আমার সাথে হাত মেলালেন। ম্যাপ সম্বন্ধে আলাপ আলোচনা করার আগে বনমানুষের সাথে আমার সাক্ষাতের ঘটনাটা বর্ণনা করলাম।

প্রথম থেকেই সে ছিল গাছে, বললাম আমি।

জন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কিভাবে তা জানলে?

কেউ আমাদের উপর অলক্ষ্যে নজর রাখছে এমন একটা অনুভূতি সব সময়েই আমার ছিল—প্রফেসর চ্যালেঞ্জারকেও বলেছি আমি সে কথা।

হ্যাঁ, আমাদের তরুণ সঙ্গী ওই ধরনের কিছু একটা বলেছিল, বললেন চ্যালেঞ্জার। আমাদের সবার চেয়ে তান্ত্রিক যোগাযোগটা সম্ভবত ওরই একটু বেশি প্রবল।

টেলিপ্যাথির সম্পূর্ণ ভিত্তি… সামারলী তার পাইপে তামাক ভরতে ভরতে আরম্ভ করলেন।

এত ব্যাপক একটা বিষয় আলাপ করার সময় এখন নেই, বেশ জোর দিয়েই বললেন চ্যালেঞ্জার। আচ্ছা বলত, জন্তুটা কি তার বুড়ো আঙ্গুল ভাঁজ করতে পারে? লক্ষ করেছিলে?

দেখেছি, পারে না।

লেজ ছিল ওর?

না।

পা দিয়ে ডাল আঁকড়ে ধরতে পারে?

আমার মনে হয় তা পারে, নইলে এত দ্রুত অদৃশ্য হতে পারত না সে।

চ্যালেঞ্জার বললেন আমার যতদূর মনে পড়ে দক্ষিণ আমেরিকায় ছত্রিশ রকম বিভিন্ন জাতের বানর আছে, কিন্তু বনমানুষের কথা মোটেও শোনা যায় না। যাহোক এখন বোঝা গেল যে এখানে তাদের অস্তিত্বও আছে। এটা রোমশ গরিলা জাতের নয়-রোমশগুলো কেবল আফ্রিকা বা প্রাচ্য দেশেই সীমাবদ্ধ।

চ্যালেঞ্জারের মুখের দিকে চেয়ে আমি প্রায় বলেই ফেলেছিলাম যে লন্ডনে বনমানুষের মাসতুত ভাইয়ের দেখা পেয়েছিলাম আমি কেনসিংটনে।

চ্যালেঞ্জার বলে চললেন, আমাদের সামনে এখন একটাই প্রশ্ন, তা হচ্ছে জন্তুটা কতটা মানুষের আর কতটা বনমানুষের সদৃশ তা বের করা। এমনও হতে পারে যে একেই মূর্খটা মিসিং লিঙ্ক বা হারানো সূত্র বলেছে। এই সমস্যার সমাধান আমাদের জরুরী দায়িত্ব।

মোটেও নয়, আপত্তি করে উঠলেন সামারলী। মিস্টার ম্যালোনের বুদ্ধি আর চেষ্টায় ম্যাপ যখন আমরা পেয়ে গেছি, তখন আমাদের প্রথম কাজ হবে এই বিদঘুটে জায়গা ত্যাগ করা।

সভ্যতার বিলাস! বলে গজরাতে লাগলেন চ্যালেঞ্জার।

বিলাস নয়, স্যার, যুক্তি দিলেন সামারলী, আমরা এখানে যা দেখেছি সেটা কাগজে কলমে পৃথিবীর সবার কাছে তুলে ধরা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ম্যাপটা হাতে আসার আগে সে বিষয়ে আমরা সবাই একমত হয়েছিলাম।

হুম! বাজখাই গলায় হুঙ্কার দিলেন চ্যালেঞ্জার। একথা সত্য যে আমি আমাদের অভিযানের ফলাফল বন্ধুদের হাতে না পৌঁছা পর্যন্ত স্বস্তি পাব না, কিন্তু। কিভাবে যে এখান থেকে আমরা নামব সে বিষয়ে এখনও ভাবনা চিন্তা করিনি। সমাধান করতে পারিনি এমন কোন সমস্যা আজ পর্যন্ত পাইনি আমি। কথা দিলাম, আগামীকাল থেকেই আমার উদ্ভাবনী মস্তিষ্ককে কাজে লাগাব। আমি নিচে নামার একটা উপায় খুঁজে বের করবই।

আলোচনা এখানেই শেষ হলো। সেই রাতে আমি মোমবাতির আলোয় ম্যাপ নিয়ে বসলাম। গাছের উপর থেকে যা দেখেছি সব নিখুঁতভাবে জায়গা মত ম্যাপে বসিয়ে দিলাম। প্রফেসর চ্যালেঞ্জার তার পেনসিল দিয়ে ম্যাপের মাঝখানের অংশ—যেখানে হ্রদটা আঁকা হয়েছে সেটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটার নাম কি দেব আমরা?

আপনার নামই জুড়ে দিন, বিষ ছড়ালেন সামারলী, আমরা কেউ আপত্তি করব না।

কঠিন স্বরে জবাব দিলেন চ্যালেঞ্জার, আমার নাম কেবলমাত্র বিশেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্যবহারের জন্যে। যে কোন অজ্ঞ মূর্খ তার নাম পাহাড় বা নদীর সাথে জড়াতে পারে। আমার দরকার নেই অমন স্মৃতি সৌধ।

সামারলী বাঁকা হাসি হেসে পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতেই জন চট করে বলে উঠলেন, তুমিই নাম রাখো হ্রদটার, তুমিই সবার আগে দেখেছ। তুমি যদি ওটার নাম ম্যালোন হ্রদ রাখতে চাও তাতে কারও কোন আপত্তি থাকতে পারে না।

অবশ্যই, বললেন চ্যালেঞ্জার। আমাদের তরুণ বন্ধুই নামকরণ করুক ওটার।

তবে, একটু লজ্জিত ভাবে বললাম আমি, ওটার নাম দেয়া হোক গ্লাডিস লেক।

সামারলী বললেন, ওটাকে সেন্ট্রাল লেক নাম দিলেই কি বেশি অর্থবহ হত না?

গ্ল্যাডিস লেকই আমার পছন্দ।

সমবেদনার সাথে আমার দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে কপট আপত্তি জানিয়ে, চ্যালেঞ্জার বললেন, ছেলেমানুষ সবসময়ে ছেলেমানুষই। গ্ল্যাডিস লেকই নাম হোক ওটার।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত