হারানো পৃথিবী: ০৯. অত্যাশ্চর্য সব ঘটনা অনবরত ঘটে চলেছে

হারানো পৃথিবী: ০৯. অত্যাশ্চর্য সব ঘটনা অনবরত ঘটে চলেছে

০৯. অত্যাশ্চর্য সব ঘটনা অনবরত ঘটে চলেছে

অত্যাশ্চর্য সব ঘটনা অনবরত ঘটে চলেছে আমাদের সামনে। মোট কাগজ যা আছে আমার কাছে তা হচ্ছে পাঁচটা খাতা আর কিছু ফাসকা কাগজ। আর আছে মাত্র একটা সীস কলম। যতক্ষণ হাত চলে আমি লিখে যাব, সেই লেখা কোনদিন সভ্য সমাজে পৌঁছবে কিনা জানি না, তবে লিখতে আমাকে হবেই। এমন সব অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে যা কোন মানুষ কোনদিন প্রত্যক্ষ করেনি!

মালভূমিতে আটকা পড়ার পরদিন থেকেই নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতা হতে লেগেছে আমাদের। আমার প্রথম অভিজ্ঞতা থেকেই এই জায়গা সম্বন্ধে খুব একটা অনুকূল মনোভাব আমি পোষণ করতে পারিনি।

সকালে ঘুম থেকে উঠতেই আমার পায়ের উপর কি যেন একটা জিনিস নজরে পড়ল। আমার ট্রাউজার্স ঘুমের ঘোরে একটু উপরে উঠে এসেছিল, পায়ের উপর দেখলাম একটা বেগুনী রঙের আঙ্গুর। পা থেকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করতেই ফেটে গেল সেটা। চারপাশে রক্ত ছিটিয়ে পড়ল পিচকারির মত। ঘৃণায় আমার মুখ থেকে একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল; সাথে সাথেই প্রফেসর দুজন এসে দাঁড়ালেন আমার পাশে।

সামারলী বললেন, চমৎকার! আমার পায়ের উপর ঝুঁকে পড়ে পরীক্ষা করলেন তিনি। রক্তপায়ী জীব সন্দেহ নেই, কিন্তু আজ পর্যন্ত এর কোন শ্রেণী বিভাগ হয়নি।

আমাদের এত কষ্টের প্রথম ফল, গমগমে গলায় বললেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। আমরা এটার নামকরণ করতে পারি ইক্সোডেস ম্যালোনী। জীবতত্ত্বের ইতিহাসে তোমার নাম চিরদিন বেঁচে থাকবে। অমরত্বের আনন্দের কাছে একটা কামড় নিতান্তই তুচ্ছ, কিন্তু দুঃখের বিষয় তুমি এই সুন্দর নমুনাটাকে চ্যাপ্টা করে ফেলেছ।

জঘন্য কীট! বীতশ্রদ্ধ হয়ে বললাম আমি।

ভুরু উঁচিয়ে আমার কথার প্রতিবাদ জানালেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে তার একটা বিরাট থাবা তিনি আমার কাঁধের উপর রাখলেন। তোমাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ভঙ্গি আর আলাদা বৈজ্ঞানিক মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে, হে তরুণ। আমার মত দার্শনিক মেজাজের মানুষের কাছে ওটা একটা প্রকৃতির বিস্ময়। ওর বর্শার ফলার মত শুড়, আর রবারের বেলুনের মত পেট, ময়ূরপুচ্ছ বা অরোরা বোরিয়ালিসের রঙিন স্টার মতই সুন্দর। ঠিক মত অনুসন্ধান চালাতে পারলে আমরা ওটার একটা আস্ত নমুনা সংগ্রহ করতে পারব আশা করি।

তাতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই, বিষণ্ণ মুখে বললেন সামারলী। এইমাত্র আপনার শার্টের কলারের পিছনে একটাকে অদৃশ্য হতে দেখলাম।

ষাঁড়ের মত ডাক ছেড়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠলেন চ্যালেঞ্জার। পাগলের মত শার্ট কোট খুলতে গিয়ে একেবারে ছিড়ে ফেলার উপক্রম করলেন। সামারলী আর আমি তাকে সাহায্যই করব না হাসব ভেবে পেলাম না। হাসি থামলে শেষ পর্যন্ত আমরা তার জামা খুলে সেই বিশাল আকৃতিটি উন্মুক্ত করলাম। দরজির ফিতায় অন্তত চুয়ান্ন ইঞ্চি বুক। সারা দেহ ঘন কালো লোমে ঢাকা। সেই জঙ্গলের অভ্যন্তর থেকে প্রফেসরকে কামড়ানোর আগেই আমরা জীবটাকে খুঁজে বের করলাম। আশপাশের ঝোপঝাড়ে নানান ধরনের অসংখ্য পোকামাকড়ে বোঝাই, অতএব স্থির করলাম, এখান থেকে আমাদের ক্যাম্প সরিয়ে নিতেই হবে।

কিন্তু তার আগে আমাদের বিশ্বস্ত নিগ্রো জাম্বাের সাথে ব্যবস্থা করে নিতে হয়। সকাল বেলাই কতগুলো কোকো আর বিস্কিটের টিন নিয়ে হাজির হলো সে। এক এক করে টিনগুলো ছুঁড়ে এপারে ফেলল। নিচে যা খাবার ছিল তা থেকে তার নিজের জন্যে দুমাসের খাবার রেখে বাকিটা ইন্ডিয়ানদেরকে সহযোগিতার পুরস্কার হিসাবে আর আমাজনে চিঠি পৌঁছে দেয়ার পারিশ্রমিক স্বরূপ দিয়ে দিতে বলা হলো। কয়েক ঘণ্টা পরে দেখলাম দূরে সারি বেঁধে চলেছে ওরা ফিরতি পথে। প্রত্যেকের মাথায় একটা করে পুটুলী। নিচের ছোট তাঁবুটা ব্যবহার করছে জাম্বাে। সে-ই এখন আমাদের সঙ্গে নিচের পৃথিবীর একমাত্র যোগসূত্র।

ঝোপের পোকা মাকড়ের দৌরাত্ম থেকে ক্যাম্প দূরে সরিয়ে নিলাম আমরা। জায়গাটা বেশ পরিষ্কার চারিদিকে বিশাল বিশাল গাছ দিয়ে ঘেরা। কতগুলো চ্যাপটা পাথরের টুকরা রয়েছে ঠিক মাঝখানে। কাছেই একটা কুয়াও পাওয়া গেল। সেখানে পরিচ্ছন্ন জায়গায় আরাম করে বসে আমরা এই অজানা দেশে অনুসন্ধান চালানোর প্রাথমিক খসড়া তৈরি করে ফেললাম।

গাছের উপর থেকে পাখির ডাক ভেসে আসছে। বিশেষ করে যে পাখিটা উচ্চস্বরে ডাকছে সেটা আমাদের কাছে নতুন। কিন্তু এ ছাড়া অন্য আর কোননা প্রাণীর সাড়া পেলাম না আমরা।

প্রথমেই আমাদের জিনিসপত্রের একটা তালিকা তৈরি করে ফেললাম। কিসের ওপর নির্ভর করে চলতে হবে, তার একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া গেল। আমরা সাথে যা বয়ে এনেছি আর জাম্বাে দড়ির মাথায় বেঁধে যা পাঠিয়েছে তাতে আমাদের বেশ কয়েক সপ্তাহ চলবে। সবচেয়ে বড় কথা যে কোন বিপদই আসুক না কেন তা মোকাবেলা করার জন্যে আমাদের আছে চারটে রাইফেল আর এক হাজার তিনশো গুলি। বন্দুকও একটা আছে তবে কার্তুজ মাত্র একশো পঞ্চাশটা তাও খুব শক্তিশালী নয়, মাঝারি ছররা। অন্যান্য সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট তামাক, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, একটা বড় টেলিস্কোপ, আর একটা ভাল বিনোকিউলার, ক্যামেরা ইত্যাদি।

আমাদের সব মালামাল মাঝখানে রেখে প্রাথমিক নিরাপত্তা হিসাবে হাত কুড়াল আর বড় ছুরি দিয়ে বেশ কিছু কাঁটাগাছ কেটে আমাদের চারপাশে গোল করে ঘিরে দিলাম। আপাতত এটাই হলো আমাদের প্রধান ক্যাম্প। চ্যালেঞ্জারের সম্মানে এটার নাম দিলাম আমরা ফোর্ট চ্যালোয়।

সব রকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা সমেত দুর্গ তৈরি করতে আমাদের দুপুর গড়িয়ে গেল। বীচ, ওক, বার্চ, এসব গাছ আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। একটা বিশাল জিংকো গাছ অন্যান্য সব গাছ ছাড়িয়ে অনেক উপরে উঠে গেছে। ওটারই ডালপাতা আমাদের ক্যাম্পে ছায়া দিচ্ছে। আমাদের এই বেঁচে থাকার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিলেন লর্ড জন। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার শেষে তিনি কিছু বলার জন্যে তৈরি হলেন।

এতক্ষণ পর্যন্ত কোন মানুষ বা জন্তু আমাদের অস্তিত্ব টের পায়নি, আমরা এখনও নিরাপদ, ব্যাখ্যা দিলেন জন, কিন্তু যেইমাত্র ওরা টের পাবে, ঠিক তখন থেকেই আরম্ভ হবে বিপদ। এই অজানা জায়গায় আমরা চুপি চুপি খোঁজখবর নেব, সামনাসামনি সাক্ষাৎ হবার আগেই এখানকার প্রতিবেশীদের স্বভাব সম্পর্কে ভাল ভাবেই জেনে নিতে হবে।

আমি বললাম, কিন্তু শেষপর্যন্ত আমাদের তো ভিতরে ঢুকতেই হবে?

অবশ্যই, জবাব দিলেন জন, আমরা আগে বাড়ব, কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখে। আমরা হিসাব করে প্রত্যেক বারে এতটুকুই প্রবেশ করব যেন দিনের শেষে নিরাপদে আবার ঘাঁটিতে ফিরে আসতে পারি। আর একটা কথা, জীবন-মরণ সমস্যা না হলে গুলি ছোড়া চলবে না।

গতকাল তুমি গুলি করেছিলে, স্মরণ করিয়ে দিলেন সামারলী।

না করে উপায় ছিল না। তবে উল্টো দিকে জোর হাওয়া বইছিল—শব্দ মালভূমির মধ্যে সম্ভবত খুব বেশিদূর যায়নি। হ্যাঁ, ভাল কথা-এই মালভূমিটার একটা নাম তো দিতে হয়। কি নাম দেব আমরা এটার?

কয়েকটি নামের প্রস্তাব করা হলো, কিন্তু চ্যালেঞ্জার কোনটিই মানতে রাজি নন।

এই জায়গার একটাই নাম হতে পারে, বললেন প্রফেসর, প্রথম আবিষ্কারকের নাম অনুসারে সেটা হচ্ছে মেপল হোয়াইট ল্যান্ড।

ওই নামই গ্রহণ করা হলো। আমার উপর বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এখানকার ম্যাপ আঁকার, তাই আমার মানচিত্রেও সেই নামই আছে। একদিন হয়তো বিশ্বের মানচিত্রেও ওই নামেই পরিচিত হবে এই জায়গা।

মেপল হোয়াইট ল্যান্ডের ভিতরে নির্বিঘ্নে ঢোকাই এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। নিজের চোখেই আমরা দেখেছি এখানে অচেনা অজানা প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে। তাছাড়া মেপলের স্কেচ বই দেখে আঁচ করা যায় যে ভয়ানক শক্তিশালী হিংস্র দানবের অস্তিত্ব থাকাও অসম্ভব নয়। মানুষের বাসও থাকা সম্ভব। মানুষ থাকলে, তারা যে বন্ধুসুলভ ব্যবহার করবে না তা বোঝা গেছে বেতের ঝড়ে জেমস কোলভারের কঙ্কাল দেখে। তাঁকে নিশ্চয়ই উপর থেকে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল, নাহলে ওখানে তিনি যাবেন কিভাবে?

একটা বিপদসঙ্কুল জায়গায় আটকা পড়েছি আমরা, বেরোবার কোনো পথ নেই। চারদিকে বিপদ-লর্ড জনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আমাদের যতগুলো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে বললেন সবগুলোই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু এতদূর এসে-বিরাট একটা আবিষ্কারের এত কাছে এসে সংযত থাকা সত্যিই কষ্টসাধ্য। অধৈর্য মন রহস্য উদঘাটনের জন্যে ছটফট করছে।

আমাদের ঘাঁটিতে ঢোকার পথ ভাল করে কাঁটাগাছ দিয়ে বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম। খুব সাবধানে, খুব ধীরে এগিয়ে চললাম অজানার উদ্দেশে। আমাদের ঝর্নাটা থেকে যে ছোট স্রোতটা বইছে সেটা ধরেই এগিয়ে চললাম। ফেরার সময়ে ওটাই পথ নির্দেশ করবে।

কয়েকশো গজ ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেলাম। অনেক গাছই আমার অচেনা, কিন্তু সামারলী গাছ গাছড়ার বিশেষজ্ঞ, তিনি ঠিকই চিনলেন। ওগুলো হচ্ছে কনিফেরা আর সাইকাডেশিয়াস গাছ, আমাদের নিচের পৃথিবী থেকে ওগুলো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে।

আমরা এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছলাম যেখানে ছোট্ট স্রোতটা চওড়া হয়ে একটা জলাতে পরিণত হয়েছে। এক ধরনের লম্বা নলখাগড়া ঘন হয়ে জন্মেছে এখানে, জানলাম ওগুলো ইকুইসেটাসিয়া বা ঘোটকীর লেজ। ফার্ণ গাছও রয়েছে মাঝে মাঝে। দমকা হাওয়ায় দুলছে গাছগুলো।

হঠাৎ লর্ড জন হাত তুলে সবাইকে থামতে বলে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মাটিতে একটা ছাপ দেখিয়ে উত্তেজিত ভাবে বললেন, দেখেছেন! বাবারও বাবা আছে; কিন্তু এই ছাপ দেখে মনে হয় এ হচ্ছে আদি বাবা!

বিরাট বিরাট তিন আঙ্গুলের একটা ছাপ পড়েছে নরম কাদায়। যে প্রাণীই হোক না কেন জলা পার হয়ে গিয়ে বনে ঢুকেছে। ভাল ভাবে পায়ের ছাপটা পরীক্ষা করে দেখার জন্যে আমরা সবাই দাঁড়ালাম। যদি ওটা পাখির ছাপ হয়—পাখি ছাড়া এরকম ছাপ আর কার হবে?-ছাপটা এতই বড় যে সেই পাখির আকৃতি অত্যন্ত বিশাল হবে। জন এদিক ওদিক চেয়ে চট করে দুটো হাতিমারা কার্তুজ ভরে নিলেন তাঁর রাইফেলে।

তিনি বললেন, শিকারী হিসাবে আমার সুনাম বাজি রেখে আমি বলতে পারি যে ছাপটা নতুন। এখনও পানি চুইয়ে পড়ছে ওই গভীর ছাপটার মধ্যে। অর্থাৎ দশ মিনিটও হয়নি ওটা এখান দিয়ে পার হয়েছে। আরে! এখানে দেখছি একটা বাচ্চার পায়ের ছাপও রয়েছে!

ছোট দাগগুলো বড় ছাপের সমান্তরাল ভাবে গেছে।

কিন্তু এটাকে আপনারা কি বলবেন? প্রফেসর সামারলী মানুষের হাতের মত বিশাল একটা ছাপের দিকে নির্দেশ করে বিজয়ীর মত হাসলেন।

উইলডেন! উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন চ্যালেঞ্জার। উইলডেন ক্লে ফসিলে আমি দেখেছি ওই ছাপ। ওরা তিন আঙ্গুলের পিছনের পায়ে চলে—মাঝে মধ্যে পাঁচ আঙ্গুলের একটা সামনের পা মাটিতে ছোয়ায়। পাখি নয়, রক্সটন, ওটা মোটেও কোন পাখি নয়।

তবে কি, জন্তু? প্রশ্ন করলেন জন।

না, গর্বের সাথে বললেন চ্যালেঞ্জার, ওটা একটা সরীসৃপ, ডাইনোসর। আর কিছুই এমন ছাপ ফেলতে পারে না। সাসেক্সের এক ডাক্তারকে ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল এই ছাপ, প্রায় নব্বই বৎসর আগে। ফিন্তু কে আশা করেছিল যে এমন দৃশ্য আমরা দেখতে পাব?

শেষের দিকে চ্যালেঞ্জারের কথা ফিসফিসানি হয়ে মিলিয়ে গেল, আর আমরা সবাই বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেলাম। পায়ের ছাপ ধরে এগুচ্ছিলাম। জলা পার হয়ে কয়েকটা ঝোপঝাড় আর গাছের ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে আমরা দেখলাম সামনে একটা ফাঁকা জায়গায় পাঁচটা অসাধারণ জীব চরছে। ঝোপের পিছনে উপুড় হয়ে বসে আড়াল থেকে আমরা অবাক চোখে দেখতে লাগলাম।

পাঁচটার মধ্যে দুটো পূর্ণ বয়স্ক আর তিনটে বাচ্চা। কিন্তু বাচ্চা হলে কি হবে এক একটা হাতির মত বড়। আর বড় দুটো আমি জীবনে যত জীবজন্তু দেখেছি তাদের চেয়ে অনেক গুণে বড়।

চামড়া স্লেটের মত কালো। গায়ে গিরগিটির মত আঁশ। সূর্যের আলোয় রামধনুর মত চমকাচ্ছে সেই আঁশ। পাঁচটাই লেজ আর পিছনের দুপায়ের উপর ভর দিয়ে খাড়া হয়ে বসেছে। পাঁচ আঙ্গুলের সামনের পা দিয়ে গাছের বড় বড় ডাল ভেঙে পাতা খাচ্ছে। দেখতে অনেকটা কালো কুমিরের চামড়াওয়ালা বিশাল বিশ ফুট উঁচু ক্যাঙ্গারুর মত।

আমরা কতক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে এই আশ্চর্য দৃশ্য দেখেছি বলতে পারব না। বেশ জোর হাওয়া বইছিল আমাদের দিকে, সামনের ঘন ঝোপগুলো ভাল ভাবেই আমাদের আড়াল রেখেছে; তাই আমাদের অবস্থান ফাঁস হবার সম্ভবনা নেই। বাপ মায়ের আশেপাশে খেলে বেড়াচ্ছে বাচ্চা তিনটা, দেহের বিশালতায় ওদের নড়াচড়ার ভঙ্গি যেন কিছুটা আড়ষ্ট, মাঝে মাঝে লাফিয়ে শূন্যে উঠে আবার ধপ করে মাটি কাঁপিয়ে নিচে পড়ছে।

বড় দুটোর শক্তির সীমা নেই। মোটা একটা গাছের ডালের নাগাল না পেয়ে ওদের একটা সামনের দুই পা দিয়ে গাছটা জাপটে ধরে চারাগাছের মত মট করে ভেঙে ফেলল। প্রমাণ পেলাম যে শক্তিতে ওরা যতটা বড় বুদ্ধিতে ঠিক ততটা খাট; গাছটা হুড়মুড় করে ওরই মাথার ওপর ভেঙে পড়ল।

তারস্বরে কিছুক্ষণ চিৎকার করে জন্তুটা জানিয়ে দিল যে আকৃতিতে যত বড়ই হোক না কেন ওদেরও একটা সহ্যের সীমা আছে। ঘটনায় পারিপার্শ্বিক অবস্থা সুবিধাজনক নয় মনে করে একে একে ওরা জঙ্গলের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল; প্রথমে আহত ডাইনোসর, তারপর তার সঙ্গীটি এবং সবশেষে বাচ্চা তিনটে।

সঙ্গীদের দিকে তাকালাম। লর্ড জন একদৃষ্টিতে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর আঙ্গুল রাইফেলের ট্রিগারের উপর প্রস্তুত। শিকারী সত্তা পুরোপুরি ফুটে উঠেছে। তাঁর চোখে মুখে।

অমন একটা মাথা বৈঠকখানার বৈঠা দুটোর উপরে ঝুলানোর জন্যে কী না দিতে পারতেন জন। কিন্তু ভেবেচিন্তে শেষ পর্যন্ত নিজেকে সংযত রেখেছেন তিনি।

প্রফেসর দুজন নীরব যেন আত্মসমাহিত। উত্তেজনায় দুজন দুজনের হাত আঁকড়ে ধরে আছেন। যেন দুটি ছোট্ট শিশু কোন যাদুমন্ত্রের খেলা দেখতে বিভোর। চ্যালেঞ্জারের গাল দুটো ফুলে উঠেছে স্বর্গীয় হাসিতে আর সামারলীর কঠিন সমালোচক মুখটা যেন সেই মুহূর্তে কোমল হয়ে এসেছে শ্রদ্ধা আর বিস্ময়ে।

নাঙ্ক ডিমিট্রিস। কাঁপা উত্তেজিত গলায় বললেন সামারলী। লন্ডনের ওরা কি বলবে?

প্রিয় সামারলী, চ্যালেঞ্জার বললেন, আমি জানি কি মন্তব্য করত লন্ডনবাসীরা। তারা বলত যে আপনি ডাহা মিথুক আর একজন হাতুড়ে বৈজ্ঞানিক। ঠিক যা আপনি আর অন্যান্য সবাই আমাকে বলেছিলেন।

ছবিগুলো দেখার পরেও?

জাল, সামারলী, জাল, সবই জাল করা!

নমুনা দেখেও ওকথা বলবে?

হ্যাঁ, ওই একটা জায়গায় হয়তো আপনি ওদের কাবু করতে পারবেন। ম্যালোন আর তার ফ্লিটস্ট্রীটের নীচ সহকর্মীরা হয়তো শেষ পর্যন্ত আমাদের জয়গান গাইবে। আগস্টের আটাশ তারিখে আমরা পাঁচটা জীবন্ত ইয়েনোডন দেখেছি, লিখে রাখো তোমার ডায়েরীতে। সুযোগ পেলে তোমার অফিসে পাঠিও খবরটা।

হ্যাঁ, ফোড়ন কাটলেন জন, সেই সাথে সম্পাদকীয় বুটের লাথি খাওয়ার জন্যেও তৈরি থেকো। লন্ডন থেকে সব কিছুই একটু ভিন্ন রকম দেখায়। অনেকে তো তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলতেই সাহস পায় না। লোকে বিশ্বাস করবে না। অবশ্য সেজন্যে তাদের দোষ দেয়া যায় না। মাস দুয়েক পরে এই এটা আমাদের কাছেই স্বপ্নের মত মনে হবে। ওগুলোর নাম না কি বললেন?

ইগুয়েনোডন, জবাব দিলেন সামারলী। কেন্ট আর সাসেক্স-এর হেস্টিংস্যান্ডস্-এ বহু পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে ওদের। দক্ষিণ ইংল্যান্ডে এক সময় গিজগিজ করত ওরা, প্রচুর সবুজ খাবারও ছিল তখন সেখানে। পরে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বদলে যায়, ওরাও মারা পড়ে। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি, জানোয়ারগুলো বেঁচে আছে।

লর্ড জন বললেন, এখান থেকে যদি প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারি তাহলে এর একটা মাথা নিয়েই ফিরব। উহ! সোমালী ল্যান্ড, ইউগান্ডার লোকেরা এদের চেহারা দেখলে সবুজ হয়ে যাবে ভয়ে। আমি চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি তা। কে কি ভাবছেন জানি না, আমার মনে হয় এখানে আমরা ভীষণ বিপদের মধ্যে রয়েছি।

আমাদের চারপাশে রহস্যময় পরিবেশ আর বিপদ সম্বন্ধে জনের সাথে আমি একমত। গাছের ছায়ায় কেমন যেন একটা ছমছমে ভাব। ওদিকে তাকালে মনে আপনাআপনি কেমন একটা অজানা ভয় জন্মায়। যে দানব জন্তুগুলোকে আমরা চরতে দেখলাম তারা আমাদের কোন ক্ষতি করবে না বলেই ধরে নেয়া যায়, ওরা তৃণভোজী। কিন্তু এই বিচিত্র জায়গায় হাজার রকমের ভয়ঙ্কর আর হিংস্র প্রাণী থাকতে পারে। কোন ঝোপ বা পাথরের আড়াল থেকে যে কোন মুহূর্তে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে আমাদের উপর। প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তু সম্বন্ধে আমার খুব বেশি জানা নেই, তবে এটুকু মনে আছে, একটা বইয়ে পড়েছিলাম যে ওদের মধ্যে কোন কোন জন্তু বিড়ালের ইদুর ধরে খাওয়ার মত বাঘ সিংহ ধরে খায়। তেমন প্রাণীর অস্তিত্ব এখানেও থাকা অসম্ভব নয়!

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চললাম আমরা। আমাদের ধীর গতির কারণ কিছুটা জন, আর বাকিটা দুই প্রফেসর। জন নিজে এগিয়ে ভাল করে চারদিক না দেখে আমাদের সামনে বাড়তে দিচ্ছেন না। আর প্রফেসর দুজনের একজন না একজন প্রতি পদেই একটা করে বিস্ময়কর ফুল বা পোকা দেখে একেবারে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। জলস্রোতের ডান ধার ধরে আমরা প্রায় দুতিন মাইল এলাম। তারপর হঠাৎ পৌঁছলাম একটা বেশ বড় ফাঁকা জায়গায়। ঝোপের একটা সারি একটানা গিয়ে কতগুলো পাথরের ধারে শেষ হয়েছে। পুরো এলাকাটাই বড় বড় পাথরে ভর্তি। আমরা ঝোপের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেলাম পাথরগুলোর দিকে। ঝোপ প্রায় আমাদের কোমর সমান উঁচু।

একটা অদ্ভুত শিস আর গড়গড় শব্দ পেলাম আমরা। হাত তুলে আমাদের থামতে বলে লর্ড জন ঝুঁকে নিচু হয়ে দ্রুত ছুটে গেলেন পাথরের সারির কাছে। পাথরের উপর দিয়ে উঁকি দিলেন তিনি। কিছু একটা দেখে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেছে তার। মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে রয়েছেন সেই দিকে, আমাদের কথা যেন ভুলেই গেছেন। শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় আমাদের এগুতে বলে হাতটা উঁচিয়েই রাখলেন, অর্থাৎ খুবই সাবধানে আগে বাড়তে বলছেন আমাদের। জনের ইঙ্গিত থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, পাথরের ওপাশে আশ্চর্য অথচ বিপদজনক কিছু একটা রয়েছে। গুড়ি মেরে তাঁর পাশে পৌঁছে পাথরের উপর দিয়ে উঁকি দিলাম আমরা। সামনেই একটা গভীর গর্ত, সম্ভবত আগে এটা আগ্নেয়গিরির ছোট মুখ ছিল। বাটির মত গর্তটার কয়েকশো ফুট নিচে একেবারে তলায় সবুজ পানি জমে রয়েছে। পানির চারপাশে নলখাগড়ার ঝালর, যেন এক ভৌতিক জায়গা।

টেরাড্যাকটিলের একটা ঘিঞ্জি বস্তি! শয়ে শয়ে একত্র হয়েছে ওরা এখানে। পানির ধারে বাচ্চাগুলো কিলবিল করছে ঝাকে ঝাকে। ওদের মায়েরা হলুদ চামড়ার মত ডিমে বসে তা দিচ্ছে। আমরা যে শব্দ শুনেছিলাম সেটা এগুলোরই শব্দ। কাছে আসায় এখন শব্দের সাথে যোগ হয়েছে বোটকা বিচ্ছিরি একটা ছাতা পড়া গন্ধ। আরও উপরের দিকে পুরুষগুলো নিজের নিজের পাথরের উপর বসে আরাম করছে। দেখতে মনে হচ্ছে যেন জীবন্ত নয়, মরা, শুকানো নমুনার মত। একেবারে স্থির হয়ে বসে রয়েছে ওগুলো। লাল চোখগুলো কেবল এদিক ওদিক ঘুরছে আর কচিৎ কখনও পাশ দিয়ে ফড়িং উড়ে যেতে দেখলেই ইঁদুর ধরা ফাঁদের মত ঠোঁট দিয়ে খটাস করে আওয়াজ তুলছে।

পাতলা চামড়ার মত বিশাল পাখা ভাঁজ করে বসেছে ওরা। এক একটাকে মাকড়সার জাল রঙের শাল জড়ানো বিশাল আকারের বুড়ীর মত দেখাচ্ছে। ছোট বড় মিলিয়ে সংখ্যায় কমপক্ষে হাজার খানেকের উপরে হবে।

দুই প্রফেসর তো আনন্দের সাথেই ওখানে সারাটা দিন কাটিয়ে দিতে রাজি। এত কাছে থেকে প্রাগৈতিহাসিক জীবন পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়ে তারা সব ভুলে গেছেন। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে মরা মাছ আর পাখিগুলো দেখিয়ে প্রফেসর দুজন জানালেন, এসবই ওদের খাদ্য। তারা দুজনে দুজনকে অভিনন্দন জানালেন, কারণ এখন নিঃসন্দেহে প্রমাণ হয়ে গেল যে কোন কোন জায়গায় এইসব উড়ন্ত ড্রাগনের এত হাড় কেন দেখা গেছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে পেঙ্গুইনের মত এরাও দলবদ্ধ হয়ে বাস করে।

চ্যালেঞ্জারের একটা মন্তব্যে সামারলী প্রতিবাদ করায় নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার জন্যে তিনি মাথা অনেকখানি সামনে বাড়িয়ে দিয়ে দেখতে চেষ্টা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে কাছে বসা পুরুষ টেরাড্যাকটিলটা উচ্চ কর্কশ শিস দিয়ে বিশ ফুট পাখা ঝাপটে আকাশে উঠে গেল। মাদীগুলো বাচ্চাঁদের সাথে পানির ধারে জড় হলো। আর প্রত্যেকটা প্রহরী আকাশে উঠল একের পর এক।

সে এক অপরূপ দৃশ্য। প্রায় একশো বিদঘুটে জীবন্ত প্রাণী দোয়েলের মত দ্রুত ডানা নেড়ে শোঁ শোঁ করে নেমে আসছে আমাদের মাথার উপর। অল্পক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম এই দৃশ্য দেখে নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই। নৃশংস প্রাণীগুলো আমাদের মাথার চারপাশে বিরাট চক্কর দিয়ে ঘুরছে; যেন প্রতিপক্ষকে জরিপ করে নিচ্ছে। তারপর ক্রমে নিচে নেমে এল ওরা, চক্করের বৃত্তটাও অনেক ছোট হয়ে এল। শোঁ শোঁ করে ঘুরতে থাকল আমাদের চারপাশে। এতগুলো শুকনো সশব্দ কালো পাখার ঝাপটা হেনডন বিমান ঘাঁটির বিমান প্রতিযোগিতার কথা মনে করিয়ে দেয়।

জন চিৎকার করে বললেন, সবাই একসাথে জঙ্গলের দিকে ছুটুন। মহাবিপদ ঘটতে যাচ্ছে। রাইফেলটাকে গদার মত ধরে ছুটলেন জন, সাথে আমরাও।

আমাদের পালাতে দেখেই আক্রমণ করল ওরা। কাছের জীবগুলোর পাখার ঝাপটা প্রায় মুখে লাগছে আমাদের। রাইফেলের কুঁদোর বাড়ি দিয়ে ঠেকাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ওদের শরীর চামড়ার মত, শক্ত বা বাড়ি মারার মত কোন জায়গা খুঁজে পেলাম না। হঠাৎ সাঁ সাঁ শব্দে লম্বা কালো গলা নিচু হয়ে এসে ঠোকর দেয়ার চেষ্টা করল, তারপর একের পর এক নেমে আসতে লাগল ওরা।

সামারলী চিৎকার করে হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন, তাঁর আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত ঝরছে। গলার পিছনে একটা গুতো খেলাম আমি, প্রচন্ড ধাক্কার চোটে মাথা ঘুরে উঠল আমার। চ্যালেঞ্জার পড়ে গেলেন, তাঁকে তুলতে গিয়ে আর এক ঠোকর খেয়ে আমি তার উপরই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।

লর্ড জনের রাইফেল গর্জে উঠল। একটা ডানা ভাঙা টেরাড্যাকটিল মাটির উপর দাপাচ্ছে আর আমাদের দিকে থুথু ছিটিয়ে গলা দিয়ে গড়গড় শব্দ করছে। বিরাট হাঁ করা ঠোঁট, রক্তবর্ণ গোল চোখ, পঞ্চদশ শতাব্দীতে আঁকা পিশাচের ছবির মতই দেখাচ্ছে। ওর সঙ্গীরা গুলির শব্দ শুনে অনেক উপরে উঠে গেল, চক্কর দিতে লাগল আমাদের মাথার উপর।

জন চিৎকার করে বললেন, জলদি দৌড়ান!

ঝোপের ভিতর দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে আবার ছুটলাম আমরা। বড় গাছগুলোর কাছাকাছি পৌঁছতেই আবার আর এক দফা আক্রমণ এল। সামারলী পড়ে গেলেন, আমরা তাঁকে কোনমতে তুলে নিয়ে ছুটে গাছের গুড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লাম। এখানে আমরা নিরাপদ, অতবড় পাখা নিয়ে কোনমতেই ওরা ডালপালার ভিতরে ঢুকতে পারবে না।

খুঁড়িয়ে ঘাঁটির দিকে ফিরে চললাম। সবাই টানা হেঁচড়ায় আহত আর পরাজিত। অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমরা দেখলাম বহু উপরে আকাশে ওরা উড়ছে। ওদের রক্ত চক্ষু নিশ্চয়ই তখন আমাদের উপরই নজর রাখছে। আমরা আরও ঘল জঙ্গলে ঢুকলে পরে ওরা রণে ভঙ্গ দিল।

ঝর্নার ধারে থেমে চ্যালেঞ্জার তার খোলা হাঁটুতে পানি দিতে দিতে বললেন, খুবই বিস্ময়কর আর চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা। ক্রুদ্ধ টেরোড্যাকটিল কি রকম ব্যবহার করে সে সম্বন্ধে আমরা অসাধারণ জ্ঞান অর্জন করলাম।

সামারলী তার কপালের কাটা জায়গাটা পানিতে ধুয়ে নিলেন। আমি আমার গলার পিছনের ক্ষতটার পরিচর্যায় ব্যস্ত। জনের কোট কাঁধের কাছে ছিড়ে গেছে কিন্তু তার গায়ে দাঁতের সামান্য আঁচড় মাত্র লেগেছে।

লক্ষ্য করার মত বিষয়, আগের কথার সূত্র ধরেই বলে চললেন প্রফেসর, আমাদের এই ম্যালোন ছেলেটা খোঁচা খেয়েছে, আর জনের কোট দাঁতের কামড়েই ছিড়েছে। আর আমি ডানার বাড়ি খেয়েছি মাথায়; অর্থাৎ আমরা তাদের বিভিন্ন আক্রমণ পদ্ধতির একটা সুন্দর প্রদর্শনী দেখলাম।

এটা ছিল আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা, গম্ভীর ভাবে বললেন জন। এমন একটা জীবের হাতে মৃত্যু বরণ করার চেয়ে জঘন্য কোন মৃত্যু আমি ভাবতেও পারি না। রাইফেল ছুঁড়তে বাধ্য হয়েছি বলে আমি দুঃখিত, কিন্তু না করে কোন উপায় ছিল না।

আমি কৃতজ্ঞভাবে বললাম, আপনি গুলিটা না ছুঁড়লে আর আমাদের আজ রেহাই ছিল না।

হয়তো খুব একটা ক্ষতি হবে না এতে। এই জঙ্গলে এমন অনেক শব্দই হয়। গাছের ডাল বা গাছ ভাঙার শব্দও প্রায় গুলির শব্দের মতই জোরাল–আর আমরা দেখেছি তা এই বনে বেশ ঘন ঘনই ঘটে। চারদিক আর একবার ভাল করে দেখে নিয়ে জন আবার বললেন, একদিনের জন্যে আমাদের যথেষ্ট উত্তেজনা গেছে-আমার মতে এবার ক্যাম্পে ফিরে আমাদের ওষুধের সাহায্য নেয়াই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত হবে। কে বলতে পারে ওদের দাঁতে কোন বিষ আছে কিনা?

পৃথিবীর কোন মানুষই এমন একটা উত্তেজনাময় দিন কাটিয়েছে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। ক্যাম্পে ফিরে আমাদের প্রবেশ পথ যেমন রেখে গেছিলাম ঠিক তেমনি পেলাম। কিন্তু ভিতরে ঢুকে বোঝা গেল গেট বা দেয়াল ভেঙে কেউ ভিতরে ঢোকেনি বটে, কিন্তু আমাদের অবর্তমানে শক্তিশালী কোন জীব ঢুকেছিল ক্যাম্পে। পায়ের ছাপ বা অন্য কোন চিহ্ন থেকে বোঝা গেল না সেটা কি ধরনের প্রাণী হতে পারে। শুধু একটা জিংকো গাছের ভাঙা ডাল থেকে বোঝা যাচ্ছে যে সে কোন পথে প্রবেশ করেছিল। আর তার অসীম শক্তির সাক্ষ্য দিচ্ছে আমাদের খাবারের সাপ্লাই। ওগুলো সব ছড়ানো ছিটানো রয়েছে মাটির উপর-একটা টিনের ভিতরের মালমশলা বের করার জন্যে ভেঙে গুড়িয়ে ফেলা হয়েছে সেটা। এক বাক্স কার্তুজ টুকরো টুকরো অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। এমন কি একটা পিতলের গুলিও ছিন্ন ভিন্ন অবস্থায় পড়ে আছে পাশেই। আবার সেই অজানা ভয় আর শঙ্কা আমাদের ঘিরে ধরল। আলো ছায়ার মাঝে আমরা চেয়ে রইলাম ভাঙাচোরা জিনিসগুলোর দিকে।

জাম্বাের গলার স্বর আমাদের মনে নতুন সাহস আর উদ্দীপনার জোগান দিল। মালভূমির ধারে গিয়ে দেখলাম সে বসে আছে উল্টো দিকের চুড়ায়, আমাদের দেখে সব কয়টা দাঁত বের করে শিশুর হাসি হাসল সে।

সব ভাল তো? চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল জাম্বাে ভাঙা ইংরেজীতে। কোন ভয় নেই আপনাদের সাহ, আমি আপনাদের ছেড়ে যাব না। যখন দরকার আমাকে এখানেই পাবেন।

ওর নিস্পাপ কালো মুখ আর সামনের বিস্তৃত দৃশ্য দেখে আমরা কল্পনায় আমাজনের শাখানদী ধরে অর্ধেক পথ পিছনে ফিরে গেলাম। নতুন করে আবার উপলব্ধি করলাম যে আমরা সত্যিই বিংশ শতাব্দীর মানুষ—কোন যাদুমন্ত্রে প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে যাইনি। বেগুনি রঙের ঝাপসা জায়গাটায় যেখানে বন গিয়ে দিগন্তের সাথে মিশেছে তার কাছেই বয়ে চলেছে বিশাল আমাজন। ওখানে স্টীমার চলে, সভ্য মানুষ বাস করে, তারা নিজেদের মধ্যে সুখ-দুঃখের কথা বলে। কিম্ভুতকিমাকার সব জন্তু জানোয়ারের সাথে মেপল হোয়াইট ল্যান্ডে আটকা পড়ে সভ্যতার কথা ভাবাও আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন ওদিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাহুতাশ করা ছাড়া আর আমাদের কিছু করার নেই।

আহত হয়ে দুই প্রফেসরের মেজাজ এখন আরও চড়া। দুজনে তর্কে লেগে গেছেন আমাদের আক্রমণকারীরা টেরাড্যাকটিলাস না ডাইমোরকোডন পরিবারের, তাই নিয়ে। দুর্বোধ্য সব কঠিন শব্দ আর নামের ভিড়ে টিকতে না পেরে একটু দূরে একটা পাথরে বসে সিগারেট ধরালাম আমি। একটু পরে জনও এসে যোগ দিলেন আমার সঙ্গে।

আচ্ছা, ম্যালোন, টেরাড্যাকটিল আস্তানাটার কথা তোমার মনে আছে?

খুব পরিষ্কার মনে আছে কেন?

ওটা একটা আগ্নেয়গিরির ছোট মুখ, তাই না?

ঠিক তাই।

মাটিটা লক্ষ্য করেছিলে?

মাটি কোথায়-পাথর বলুন।

না, ওখানে নয়, পানির ধারে-নলখাগড়াগুলোর পাশে।

হ্যাঁ, নীলচে মাটি—অনেকটা কাদার মত।

নীলচে মাটিওয়ালা আগ্নেয়গিরির ছোট মুখ, নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললেন জন।

তাতে কি? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

নাহ্, কিছু না, বলে ধীর পায়ে আবার ফিরে গেলেন তিনি প্রফেসরদের দিকে। সামারলী উচ্চৈস্বরে আর চ্যালেঞ্জার খাদে গমগমে গলায় তখনও তর্ক চালিয়ে যাচ্ছেন।

সেই রাতে আবার শুনলাম নিজের মনেই স্বগতোক্তি করছেন জন। নীল কাদা—আগ্নেয়-শিলার মাঝে নীল মাটি।

ক্লান্তিতে ঘুমের কোলে ঢুলে পড়ার আগে ওই কথা কটাই শেষ কানে গেল আমার।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত