হারানো পৃথিবী: ০৮. পাহাড়ের কাছে পৌঁছে দেখলাম

হারানো পৃথিবী: ০৮. পাহাড়ের কাছে পৌঁছে দেখলাম

০৮. পাহাড়ের কাছে পৌঁছে দেখলাম

পাহাড়ের কাছে পৌঁছে দেখলাম কোন কোন জায়গা হাজার ফুটেরও বেশি উঁচু। এডিনবারার সেলসবারি ক্রাগের মতই গড়ন। চুড়ার দিকে নানা রকম গাছ দেখা যাচ্ছে, তবে অন্য কোন প্রাণীর লক্ষণ এখনও আমাদের চোখে পড়েনি।

পাহাড়ের ধার কেবল যে খাড়া উঠে গেছে তাই নয়, উপরের দিকে আবার হেলে বেরিয়ে এসেছে কিছুটা। সুতরাং বেয়ে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না। পিরামিডের মত পাথরটার ঠিক উপরেই দেখা যাচ্ছে ছবির সেই বিশাল গাছটা। কিন্তু মাঝখানে বিরাট ফাঁক। প্রায় ছশো ফুট উঁচু হবে পাথরটা, পাহাড়ও এখানে বেশ নিচু; উচ্চতায় দুটো প্রায় সমানই হবে।

এই গাছের ওপরেই বসেছিল টেরাড্যাকটিলটা, গাছটা দেখিয়ে বললেন চ্যালেঞ্জার। আমি অর্ধেক বেয়ে উঠে গুলি করেছিলাম। আমার মত দক্ষ পাহাড়েচড়া লোকের পক্ষেও ওপর পর্যন্ত ওঠা সম্ভব হয়নি।

টেরোড্যাকটিলের কথা উঠতে আড় চোখে সামারলীর দিকে তাকালাম আমি। তার ঠোঁটের কোণ থেকে বিদ্রুপের হাসি উবে গেছে। কিছুটা যেন অনুতপ্তই মনে হচ্ছিল তাকে; দুই চোখে উত্তেজনা আর বিস্ময়। চ্যালেঞ্জারও সেটা লক্ষ্য করে তৃপ্তি বোধ করলেন।

সামারলীর পিছনে লাগলেন প্রফেসর, মিস্টার সামারলী অবশ্যই বুঝবেন যে, আমি টেরোড্যাকটিল বললে সেটা সারসকেই বোঝায়। এমন সারস, যেটার পালক নেই, আছে ছাল চামড়ার মত ঝিল্লীর পাখা আর চোয়ালে দাঁত, চোখ মিটমিট করতে করতে দাঁত বের করে হেসে কুর্নিশ করে দাঁড়িয়ে রইলেন চ্যালেঞ্জার। কোন কথা না বলে ঘুরে অন্যদিকে চলে গেলেন সামারলী।

সকালে সামান্য কিছু নাস্তা খেলাম। সঞ্চিত খাবারের দিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে আমাদের। কি করে উপরে ওঠা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ করতে মীটিঙে বসলাম আমরা।

চ্যালেঞ্জার এমন ভঙ্গিতে বসে সভাপতিত্ব করছেন, মনে হচ্ছে তিনি স্বয়ং লর্ড চীফ জাস্টিস। একটা পাথরের উপর বসে, ছেলেমানুষী হ্যাটটা মাথার পিছন দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তার গর্বিত চোখ আধ বোজা পাতার নিচ থেকে আমাদের উপর আধিপত্য করছে, আর তাঁর বিখ্যাত কালো দাড়ি কথা, তালে তালে নড়ছে উপরে আর নিচে। আমাদের বর্তমান অবস্থা আর পরবর্তী করণীয় কর্তব্য সম্বন্ধে ধীরে ধীরে জ্ঞান দান করলেন চ্যালেঞ্জার।

শ্রোতা আমরা সবাই। আমি, মুক্ত আলো বাতাসে এতদূর আসার পর রোদে পোড়া এক তরুণ যুবক। সামারলী চুপচাপ, কিন্তু এখনও নিঃসন্দেহ নন, পাইপটা লেগেই আছে তার মুখে; আর ক্ষুরের মত তীক্ষ্ণ ধার লর্ড জন তার নমনীয় সতর্ক দেহটা রাইফেলে ভর দিয়ে রয়েছেন কিন্তু ঈগল চক্ষু একাগ্রতার সাথে বক্তার উপর নিবদ্ধ। আমাদের পিছনে গোমেস, ম্যানুয়েল আর অন্যান্য সবাই।

বলাই বাহুল্য যে পাহাড়ে ওঠায় দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও গতবারে আমি সরঞ্জামের অভাবে পুরো উঠতে পারিনি। কিন্তু এবার তৈরি হয়ে এসেছি। আমি হলপ করে বলতে পারি যে ওই পিরামিডের মত পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে এখন আমার কোন অসুবিধা হবার কথা নয়। কিন্তু মূল মালভূমির সাথে যোগাযোগ না থাকলে এই পথে উপরে পৌঁছা অহেতুক। পুব দিকে ছয় মাইল পর্যন্ত আমি ঘুরে দেখেছি, উপরে ওঠার কোন পথ নেই। এখন করণীয় কি?

সেক্ষেত্রে আমাদের সামনে একটাই যুক্তিসঙ্গত পথ খোলা আছে, বললেন সামারলী। আগেরবার আপনি যখন পুব দিকে দেখেছেন এবার আমাদের পশ্চিম দিকে খোঁজ করে দেখা উচিত।

ঠিক, বলে উঠলেন জন। এই মালভূমিটা খুব বড় না হবারই সম্ভাবনা। আমরা এর চারপাশে একটা চক্কর দিয়ে দেখতে পারি। কোন সহজ পথ না পেলেও ক্ষতি নেই, যেখান থেকে রওনা হব আবার সেখানেই ফেরত আসব আমরা।

এই ছেলেকে আমি আগেই বুঝিয়ে বলেছি, বললেন চ্যালেঞ্জার। আমাকে বছর দশেকের স্কুলের ছাত্র হিসাবে গণ্য করা যেন তার একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। সহজ রাস্তা থাকা একেবারেই অসম্ভব, ওঠার সহজ রাস্তা থাকলে সেই পথে ওরাও সহজেই নেমে আসতে পারত।

তবে এটা ঠিক যে দক্ষ পর্বতারোহীর পক্ষে হয়তো কোন কোন জায়গায় উপরে চড়া সম্ভব হতে পারে। এমন জায়গা অন্তত একটা আছে নিশ্চয়ই। বিশাল ভারী কোন জন্তুর পক্ষে হয়তো সেই পথ দিয়ে নিচে নামা অসম্ভব।

কথাটা কি প্রমাণ ছাড়া আন্দাজে বলা হলো না? সামারলী কঠোর প্রতিবাদ করলেন। আপনার পাহাড়ের মত উঁচু জমি আমি স্বীকার করে নিতে রাজি আছি, কেননা আমি তা নিজে দেখেছি। কিন্তু তার উপরে প্রাণীর অস্তিত্ব আছে এটা আমি মানতে রাজি নই।

আপনি মানেন কি মানেন না সেটা নিতান্তই অবান্তর বিষয়। তবে লাল পাহাড়টা যে আপনার মগজে একটু স্থান করে নিতে পেরেছে তা জেনে খুশি হলাম। বলে উপরের দিকে চেয়ে পাহাড়টা দেখলেন চ্যালেঞ্জার। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে পাথর থেকে নেমে তিনি সামারলীর ঘাড়ে ধরে চিবুকটা ঠেলে উপরের দিকে চাইতে বাধ্য করলেন। এবার, স্যার! চিৎকার করে বললেন চ্যালেঞ্জার, এবার তো বিশ্বাস করবেন যে উপরে জীবজন্তু আছে?

উপরের সবুজ লতাপাতার ভিতর থেকে একটা কালো চকচকে বস্তু বেরিয়ে এল। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বাইরে ঝুলে রইল কিছুক্ষণ। দেখলাম একটা বিরাট সাপ, মাথাটা কোদালের মত চ্যাপ্টা। মিনিট খানেক একে বেঁকে মাথার উপর নড়াচড়া করল, সকালের রোদে ঝিলিক দিয়ে উঠল সাপটার মসৃণ তেলতেলে দেহ, একটু পরেই পিছু হটে অদৃশ্য হয়ে গেল ওটা।

সামারলী এতই বিস্মিত আর অভিভূত হয়ে দেখলেন দৃশ্যটা যে চ্যালেঞ্জারের অশোভন আচরণের প্রতিবাদ করতেও ভুলে গেলেন তিনি। সাপটা অদৃশ্য হতেই নিজেকে ছাড়িয়ে কাপড় জামা একটু ঠিকঠাক করে নিয়ে স্ব-সত্তায় ফিরে এলেন তিনি।

প্রফেসর চ্যালেঞ্জার, আপনার কিছু বক্তব্য থাকলে সেটা শুধু মুখে বললেই আমি খুশি হব। একটা পাথুরে পাইথনের আবির্ভাবেই এভাবে আমার থুতনি ঠেসে ধরার কোন অধিকার আপনার নেই।

কিন্তু এখন তো স্বীকার করবেন যে উপরে জীবজন্তু বাস করে? বিজয়ী কণ্ঠে বললেন চ্যালেঞ্জার। আমার মতে এই প্রদর্শনীর পর আর সময় নষ্ট না করে ওপরে ওঠার পথের খোঁজে এক্ষুণি আমাদের পশ্চিম দিকে রওনা হয়ে যাওয়া উচিত।

খাড়ির নিচে জমি পাথরে ভর্তি আর ভাঙাচোরা, তাই আমাদের অগ্রগতি খুবই ধীর আর কঠিন হলো। হঠাৎ আরেকটা জিনিস আবিষ্কারে আমাদের মন খুশিতে ভরে উঠল। এখানে আমাদের আগেও কেউ ক্যাম্প করেছিল। কয়েকটা খালি মাংসের টিন পড়ে রয়েছে, টিনগুলো শিকাগোতে তৈরি। একটা খালি বোতল-লেবেলে লেখা, ব্র্যান্ডি একটা ভাঙা টিন খোলার যন্ত্র ইত্যাদি আরও অনেক কিছুর সাথে আমরা পেলাম একটা দুমড়ানো খবরের কাগজ। নামটা পড়তে পারলাম শিকাগো ডেমোক্র্যাট, কিন্তু তারিখ পড়া গেল না।

এদিকে আমি আসিনি, বললেন চ্যালেঞ্জার, এগুলো নিশ্চয়ই মেপল হোয়াইটের পরিত্যক্ত জিনিস হবে।

লর্ড জন আগ্রহ ভরে একটা গাছের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, ম্যালোন, দেখ তো এটা বোধ হয় কোন চিহ্ন।

একটা কাঠের টুকরো পেরেক দিয়ে গাছের গায়ে লাগানো রয়েছে, পশ্চিম দিকে নির্দেশ করে।

অবশ্যই এটা পথ নির্দেশের চিহ্ন, বলে উঠলেন চ্যালেঞ্জার। সে চেয়েছিল যে আর কেউ যদি কোনদিন এই পথে আসে তবে যেন জানতে পারে কোন্ পথে গিয়েছিল মেপল। আমার মনে হয় সামনে আমরা আরও চিহ্ন দেখতে পাব।

সত্যিই তাই। কিন্তু বিষয়টা খুবই অপ্রত্যাশিত আর মর্মান্তিক। এখানেও বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে বেত গাছ জন্মেছে। আমরা যে বেত বন পার হয়ে এসেছি সেই রকমই কিন্তু আরও হালকা। গাছগুলোর ডগা বেশ চোখা আর প্রায় বিশ ফুট লম্বা-শক্তও। এক একটা বর্শার মত দাঁড়িয়ে আছে। পাশ দিয়ে যাবার সময়ে সাদা কি যেন একটা চোখে পড়ল আমার। কাছে গিয়ে বেতের ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে দেখলাম সামনে পড়ে রয়েছে চামড়া-মাংসহীন একটা মানুষের মাথার খুলি। অদূরেই বাকি কঙ্কালটাও পড়ে আছে, মাথাটা কেমন করে দেহ থেকে আলাদা হয়ে ঝোপের ধারে চলে এসেছে।

ইন্ডিয়ানদের বড় বড় ছুরি দিয়ে কয়েক কোপ দিতেই পরিষ্কার হয়ে গেল জায়গাটা। জীর্ণ কয়েক টুকরো কাপড় এখনও চেনা যায়, বুট জোড়া রয়েছে পায়ের হাড়ের উপর। স্পষ্ট বোঝা যায় মৃত লোকটি সাদা চামড়াধারী ছিল। নিউ ইয়র্কের হাডসন কোম্পানীর তৈরি একটা সোনার ঘড়ি আর চেনের সাথে আটকানো একটা কলম পড়ে রয়েছে পাশেই। একটা রূপার সিগারেট কেসও পাওয়া গেল, কেসের গায়ে এ. ই. এস. থেকে জে. সি, এই কথা কটা খোদাই করা। রূপার কেসের অবস্থা দেখে মনে হলো গত কয়েক বছরের মধ্যে ঘটে থাকবে এই দুর্ঘটনা।

লোকটা কে হতে পারে? জিজ্ঞেস করলেন জন। বেচারার শরীরের প্রায় প্রত্যেকটা হাড়ই ভাঙা।

ভাঙা পাঁজরের ভিতর দিয়ে বেত গাছ জন্মেছে, মন্তব্য করলেন সামারলী। যদিও বেত গাছ খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে, তবু যতদিন দেহটা এখানে আছে ততদিনে বিশ ফুট বেড়েছে, এটা অবিশ্বাস্য।

লোকটার পরিচয় সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ নেই। পারাতে যদিও কেউ মেপল হোয়াইট সম্বন্ধে কিছু বলতে পারেনি, রোজারিওতে আমি খবর পেয়েছিলাম যে মেপলের সাথে একজন আমেরিকানও ছিলেন। নাম জেমস কোলভার। মেপলের স্কেচ বইটাতেও একটা ছবি আছে ওঁর। জেমস কোলভারেরই দেহাবশিষ্ট খুঁজে পেয়েছি আমরা, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

কিভাবে মৃত্যু বরণ করেছেন তাও সুস্পষ্ট, বললেন জন, নিশ্চয়ই উপর থেকে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল বা তিনি পড়ে গিয়েছিলেন। এত উপর থেকে না পড়লে তার হাড়ও ভাঙত না আর বেতের ঝোপে শূলবিদ্ধও হতেন না।

ভাঙা হাড়গুলোর সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম। জনের কথাটা যে কত সত্যি তা উপলব্ধি করলাম সবাই। সন্দেহ নেই তিনি উপর থেকেই পড়েছিলেন, কিন্তু কথা হচ্ছে সেটা হঠাৎ দুর্ঘটনা বশত পা ফস্কে নাকি তাকে…? নানা অশুভ চিন্তা এসে মাথায় ভিড় করল অচেনা অজানা জায়গাটাকে ঘিরে।

কোন কথা না বলে চুপচাপ পাহাড়ের গা ঘেঁষে এগিয়ে গেলাম আমরা। সবখানেই একই রকম খাড়া ভাবে উঠে গেছে পাহাড়। দক্ষিণ মেরুর বিশাল হিমবাহের মতই যেন সোজা উপরে উঠেছে।

পাঁচ মাইল ঘোরার পরেও কোন ফাটল চোখে পড়ল না। হঠাৎ নতুন আশার সঞ্চার হলো আমাদের মনে। বৃষ্টিতে ভেজে না এমন এক জায়গায় পাহাড়ের গায়ে খড়িমাটি দিয়ে একটা তীর চিহ্ন আঁকা রয়েছে, তীরের মাথা পশ্চিম দিকে।

মেপল হোয়াইটের নির্দেশ, বলে উঠলেন চ্যালেঞ্জার। সাদা চক ব্যবহার করেছিল বলেই ওর বাক্সের রঙিন চকগুলো আস্ত ছিল। কিন্তু সাদাটা ছিল ক্ষয়ে যাওয়া, ছোট্ট।

ঘটনাক্রমে প্রমাণ হচ্ছে যে তিনি এই পথেই এগিয়েছিলেন, বললেন সামারলী। আমাদেরও এই পথই অনুসরণ করে পশ্চিমে যাওয়া উচিত হবে।

আমরা আরও প্রায় পাঁচ মাইল এগিয়ে গেলাম। আরও একটা তীর চিহ্ন দখতে পেলাম। নির্দেশ অনুযায়ী লক্ষ্য করতে করতে পাহাড়ের গায়ে এই প্রথম একটা ফাটল নজরে পড়ল। ফাটলের কাছে গিয়ে ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম আরও একটা চিহ্ন। এবারের সঙ্কেতটা বেঁকে কিছুটা উপরে উঠে গেছে, মনে হয় যেন মাটি কে একটু উপরে কোন একটা জায়গা নির্দেশ করছে।

নিচ থেকে সরু একফালি নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে, সামান্য আলো কোন রকমে ঢুকছে; আধো আলো আধো ছায়া, দুপাশে বিশাল পাথরের দেয়াল।

গত কয়েক ঘণ্টা ধরে আমাদের পেটে কিছুই পড়েনি। কিন্তু সবাই এমন উত্তেজনা বোধ করছি যে এই মুহূর্তে আর আমাদের পক্ষে ক্ষান্ত দেয়া সম্ভব নয়।

ইন্ডিয়ানদের ক্যাম্প খাটানোর কাজে লাগিয়ে দিয়ে আমরা চার জন ভিতরে ঢুকলাম, জোসেফ আর ম্যানুয়েলও এল আমাদের পিছু পিছু।

সরু পথ ধরে এগুচ্ছি। মুখের কাছে প্রায় চল্লিশ ফুট চওড়া হলেও দ্রুত সরু হয়ে এল পথটা। ছোট হতে হতে একটা সূক্ষ্ম কোণে মিলে শেষ হলো। পাথর এত মসৃণ আর এমন খাড়া ভাবে ওপরে উঠেছে যে কোন মানুষের পক্ষেই সেখান দিয়ে বেয়ে ওঠা সম্ভভ নয়। ফিরে চললাম আমরা। গিরিখাতটা মাত্র সিকি মাইল মত ভেতরে ঢুকেছে। আমরা যা খুঁজছিলাম তা হঠাৎ লর্ড জনের চোখে পড়ল। আমাদের মাথার বেশ উপরে আধো আলো আধো ছায়ায় দেখা গেল অপেক্ষাকৃত অন্ধকার গোল মত একটা জায়গা। হয়তো কোন গুহার মুখ।

ওইখানে পাহাড়ের গোঁড়ায় অনেক আলগা পাথর পড়ে রয়েছে। সেগুলো জড়ো করে হাত পা দুই-ই চালিয়ে উপরে ওঠা খুব কঠিন হলো না। সেখানে পৌঁছে আমাদের সব সন্দেহ দূর হয়ে গেল। সত্যিই একটা গুহা, আর যেটা বড় কথা, খড়িমাটির দাগ রয়েছে গুহার গায়ে। এখান দিয়েই তাহলে উপরে উঠেছিলেন তারা।

একটা প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষ না করে এখন আর ক্যাম্পে ফেরা যায় না। রক্সটনের পিঠে ক্যানভাস ব্যাগের মধ্যে একটা টর্চ ছিল, সেটাই আমাদের একমাত্র আলো। টর্চের ছোট গোল আলোয় পথ দেখে এগিয়ে চললেন জন, আর আমরা সবাই সার বেঁধে চলেছি তার পিছনে।

পানিতে ক্ষয়ে তৈরি হয়েছে গুহাটা। দুই পাশের পাথর খুবই মসৃণ, মেঝেটা গোল গোল পাথরে, ভর্তি। গুহা যথেষ্ট বড়, একটু ঝুঁকে দাঁড়ালেই একজন মানুষ স্বচ্ছন্দে এটে যায়। চল্লিশ ফুট সোজা ভিতরে যাবার পর দেখলাম গুহাটা পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী হয়ে উপরে উঠে গেছে। কিছুদূর গিয়ে আরও খাঁড়া উঠেছে, আমরা হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চললাম। মেঝের আলগা পাথর মাঝে মাঝে গড়িয়ে পড়ছে নিচে।

হঠাৎ রক্সটনের উত্তেজিত গলা শোনা গেল, পথ বন্ধ।

সবাই তার পিছনে জড়ো হয়ে টর্চের আলোয় দেখলাম ভাঙ্গা বেল্ট পাথরে গুহার মুখটা বন্ধ হয়ে গেছে।

ছাদ ধসে পড়েছে।

বৃথাই চেষ্টা করলাম আমরা, কয়েকটা পাথর সরাতেই আরও বড় বড় পাথর গড়িয়ে পড়তে লাগল। আরও বড় আকারের পাথর যদি গড়িয়ে পড়ে তাহলে আমাদের পিষে ফেলবে। বোঝা গেল, এই পথ পরিষ্কার করে ওপরে ওঠার কোন আশা নেই। মেপল হোয়াইট যে পথ ধরে উঠেছিল সে পথ আর আমরা ব্যবহার করতে পারব না।

হতাশ মনে ফিরে চললাম। ছোট দলে জড়ো হলাম আমরা। যখন ফাটলের মুখ থেকে প্রায় চল্লিশ ফুট ভিতরে, হঠাৎ একটা বড় পাথর ভীষণ বেগে ছুটে গেল আমাদের পাশ দিয়ে। অল্পের জন্যে বেঁচে গেলাম আমরা। পাথরটা কোন দিক থেকে এল ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। জোসেফ আর ম্যানুয়েল তখনও গুহার মুখে, ওরা এসে জানাল যে পাথরটা ওদের পাশ দিয়ে এসেছে। তাহলে নিশ্চয়ই পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়েছে ওটা।

উপরে তাকালাম, কোন নড়াচড়া নজরে পড়ল না আমাদের। সবুজ লতাপাতা গাছ সবই স্থির। এতে কোন সন্দেহ নেই যে পাথরটা আমাদের লক্ষ্য করেই ছোড়া হয়েছিল, ঘটনাটা মানুষের উপস্থিতিরই প্রমাণ দেয়। তবে কি হিংসাপরায়ণ জংলী মানুষের বাস আছে মালভূমির উপরে?

দ্রুত ফাটল থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। সবার মাথায় একই চিন্তা। এই নতুন পরিস্থিতি আমাদের অভিযানে কতখানি বাধার সৃষ্টি করবে? এখানে পাহাড়ের উচ্চতা কিছুটা কম। আর মালভূমির ধারটাও উত্তর দিকে বাঁক নিতে আরম্ভ করেছে। এটাকে যদি আমরা গোল বলে ধরে নেই তবে পরিসীমা খুব বেশি বড় হবে না। উপরে ওঠার সুবিধা না পেলেও কয়েক দিন পরেই আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম আবার সেখানে ফিরতে পারব।

একটা চিন্তা সবার মনেই খচ খচ করছে এমনিতেই প্রাকৃতিক বাধাহেতু উপরে ওঠা শক্ত কাজ, তার উপর আবার যদি আমাদের মানুষের বাধার সম্মুখীন হতে হয় তবে কাজটা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়বে। কিন্তু উপরের সুন্দর তাজা সবুজ ঝালরের দিকে চেয়ে, সবকিছু ভাল করে খতিয়ে না দেখে লন্ডনে ফেরার কথা আমরা কেউই ভাবতে পারলাম না।

প্রায় বাইশ মাইল হাঁটলাম সেদিন, কিন্তু ভাগ্য প্রসন্ন হলো না। নৌকা ছাড়ার পর থেকে হেঁটে ক্রমাগত উপরেই উঠেছি আমরা। ব্যারোমিটারে দেখা যাচ্ছে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার ফুট উঁচুতে উঠেছি। উচ্চতার কারণে তাপমাত্রা আর গাছ পালা, দুটোতেই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। পোকার দৌরাত্ম এখন অনেক কম। গ্রীষ্মমন্ডলের যে কোন দেশ ভ্রমণে পোকাই সাধারণত বড় বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

কিছু পাম আর অনেক ফার্ণ গাছ এখনও দেখা যাচ্ছে। আমাজন উপকূলের গাছ পিছনে ফেলে এসেছি আমরা। কনভলভিউলাস, কামনা ফুল আর বেগোনিয়া ফুলগুলো দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। বিদেশ বিভুইয়ে চেনা ফুল দেখলে দেশের জন্য মন কেমন করে। একটা লাল বেগোনিয়া আরও বেশি করে মনে করিয়ে দেয় স্ট্রাদামের একটা ভিলার কথা। জানালার উপর ঠিক এই রঙেরই ফুল রাখা আছে একটা ফুলদানীতে। ভাবপ্রবণ হয়ে পড়ছি আমি।

সেই সন্ধ্যায় লর্ড জন একটা অজুটি শিকার করলেন। জন্তুটা অনেকটা শুয়োরের মত দেখতে। অর্ধেক ইন্ডিয়ানদের দিয়ে বাকি অর্ধেক আমরা রোস্ট করলাম আমাদের খোলা আগুনের ওপর। বেশ একটু শীত শীত ভাব, তাই আমরা সবাই আগুন ঘিরে বসেছি। রাত হয়ে এল, আকাশে চাঁদ নেই, কিন্তু তারার আলোয় আর আমাদের আগুনের আলোতে কিছু কিছু এখনও দেখতে পাচ্ছি।

হঠাৎ রাতের আঁধারের ভিতর থেকে কি যেন বেরিয়ে এল। উড়োজাহাজের মত শোঁ শোঁ শব্দ তুলে নেমে এল ওটা। মুহূর্তের জন্যে দলের আমরা সবাই চামড়ার পাখার বিশাল চাদোয়ার নিচে ঢাকা পড়লাম। ক্ষণিকের জন্যে চোখে পড়ল একটা সাপের মত লম্বা গলা, ভীষণ ভয়ঙ্কর রক্তিম লোভাতুর চোখ। বিরাট ঠোঁট হাঁ করে কামড় দেয়ার সময়ে দেখলাম ভিতরে দুই সারি ধারাল দাঁত।

পরমুহূর্তেই দূরে চলে গেল ওটা, দেখলাম সেই সাথে আমাদের খাবারও অদৃশ্য হয়েছে। একটা বিরাট কালো ছায়া অন্তত বিশ ফুট চওড়া, ডানা ঝাপটে উপরে উঠে গেল; তারপর মালভূমির ওপর দিয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। আমরা হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইলাম।

সামারলীই প্রথম স্তব্ধতা ভাঙলেন, প্রফেসর চ্যালেঞ্জার, ভাবাবেগে কাঁপছে তার গলা, ক্ষমা চেয়ে আপনাকে ছোট করতে চাই না, আমার ভুল ভেঙেছে। অতীতে যা বলেছি দয়া করে নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।

সামারলী খুব সুন্দরভাবেই নিজেকে ব্যক্ত করলেন। সমগ্র অভিযানে এই প্রথমবারের মত দুই প্রফেসর হাত মেলালেন। টেরাড্যাকটিলকে চাক্ষুষ দেখে আমাদের একটা লাভ হলো। রাতের খাবার যে চুরি হয়ে গেল সেই শোক আমরা ভুলে গেলাম দুই প্রফেসরের এই মধুর মিলনে।

সত্যিই অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা হলো আমার। মনে সামান্য যা একটু সন্দেহ ছিল তা এবার সম্পূর্ণ মুছে গেল। দৈনিক গেজেট সম্ভবত এই প্রথম ফলপ্রসূ কোন কাজে প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। তবে আরও ভাল করে অনুসন্ধান করে সব দেখেশুনে প্রমাণ সহ যদি লন্ডনে ফিরতে পারি, আর প্রফেসর চ্যালেঞ্জার যদি অনুমতি দেন, তবেই এটা কাগজে ছাপা সম্ভব হবে। প্রমাণ ছাড়া এমন কিছু লিখলে লোকে আমাকে নির্ঘাৎ সাংবাদিক মাঞ্চুসেন বলে ডাকবে।

কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তু মালভূমির উপর থাকলেও তারা সংখ্যায় খুব বেশি হবে না, কারণ পরবর্তী তিন দিনে আমরা আর কোন টেরাড্যাকটিল বা অন্য কোন প্রাণীর দেখা পাইনি। এই তিন দিনে আমরা কেবল বিরক্তিজনক অনুর্বর জমি পার হলাম কখনও পাথুরে শুকনো জমি কখনও বা বন মুরগীতে পরিপূর্ণ নোংরা জায়গা। উত্তর আর পুবদিক পার হতে গিয়ে এমন এক বাধা পড়ল যে পাহাড়ের নিচের বাইরে বেরিয়ে থাকা শক্ত ধারটা না থাকলে আমাদের ফিরেই আসতে হত। কয়েকবারই কোমর পর্যন্ত চর্বির মত এঁটেল কাদা দিয়ে চলতে হলো। তার ওপর আরেক বিপদ, দেখা গেল জায়গাটা জারাকাকা সাপের বংশবৃদ্ধির অতি প্রিয় স্থান। দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বিষধর আর আক্রমণাত্মক সাপ হচ্ছে এই জারাকাকা। নলখাগড়ার ভিতর থেকে একেবেঁকে বেরিয়ে এসে সাপগুলো বারবার আক্রমণ করতে লাগল। সর্বক্ষণ বন্দুক নিয়ে তৈরি থেকে নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষা করলাম আমরা।

একটা ছোট ডোবা পড়ল পথে। এক ধরনের সবজ শৈবালে ভর্তি, সেটার পানির রঙও সবুজ হয়ে রয়েছে। এখানকার ঘটনা আমার চিরদিন দুঃস্বপ্নের মত মনে থাকবে। এই ডোবাটা ওই সাপের বিশেষ প্রিয় জায়গা হবে হয়তো; আমাদের দেখার সঙ্গে সঙ্গে ডোবার ঢালগুলো জীবন্ত হয়ে উঠল, হাজার হাজার সাপ কিলবিল করে ছুটে আসছে আমাদের দিকে। জারাকাকা সাপের স্বভাবই হচ্ছে যে দেখা মাত্র ওরা আক্রমণ করবে। আর এতগুলোকে গুলি করে মারাও অসম্ভব।

ঝেড়ে দৌড় দিলাম। অনেক দূর গিয়ে ক্ষণিকের জন্যে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম নলখাগড়ার ভিতর থেকে সাপগুলো একবার মাথা তুলছে আবার নামিয়ে নিচ্ছে। যতক্ষণ দমে কুলাল উর্ধ্বশ্বাসে ছুটলাম আমরা।

এদিককার পাহাড়ে এখন সেই লালচে রঙের বদলে তামাটে চকোলেটের মত রঙ ধরেছে। গাছও এদিকে কম আর বেশ দূরে দূরে। তবে এক একটা গাছ প্রায় তিন চারশো ফুট উঁচু। কিন্তু এত ঘুরেও কোথাও উপরে ওঠার পথ খুঁজে পেলাম না। বরং আমরা প্রথম যেখান থেকে রওনা হয়েছিলাম সেদিকের চেয়ে এদিকে উপরে ওঠা আরও বেশি কঠিন।

আলোচনার মাঝে আমি বলে উঠলাম, বৃষ্টির পানি নিশ্চয়ই কোন না কোন পথে নিচে নামে। পাথরের মধ্যে অবশ্যই কোথাও সুরঙ্গ আছে।

সস্নেহে আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে চ্যালেঞ্জার বললেন, মাঝে মধ্যে ছেলেটার মাথা খুলে যায়।

বৃষ্টির পানি সরতেই হবে কোথাও, নিজের যুক্তিতে অটল রইলাম আমি।

কঠিন বাস্তববাদী এই ম্যালোন, কিন্তু নিজেই তো ঘুরে দেখে প্রমাণ পেলে যে পানি বের হওয়ার কোন পথ নেই পাথরের ভিতরে, তাই না?

তাহলে পানি যায় কোথায়?

আমি মনে করি আমরা যুক্তিসঙ্গত ভাবেই ধরে নিতে পারি যে পানি যখন বাইরে আসছে না তখন ভিতরের দিকেই কোথাও যায়।

তাহলে মাঝখানে কোন হ্রদ আছে? প্রশ্ন করলাম আমি।

সম্ভবত, জবাব দিলেন প্রফেসর।

সামারলী বললেন, পুরানো কোন আগ্নেয়গিরির গর্তই হয়তো এখন হ্রদে পরিণত হয়েছে। তারপর নিভে যাওয়া পাইপটা আবার ধরিয়ে নিয়ে বললেন, পুরো মালভূমিটাই আগ্নেয়শিলায় তৈরি। যে কোন কারণেই হোক জায়গাটা ভিতরের দিকে ঢালু আর মাঝখানে বিরাট একটা হ্রদ আছে বলে আমার ধারণা। হয়তো সেখান থেকেই মাটির তলা দিয়ে কোন যোগাযোগ আছে জারাকাকা আর অন্যান্য জলাভূমিগুলোর সাথে।

অথবা পানি বাষ্পীভূত হয়ে সমতা রক্ষা করছে, বললেন চ্যালেঞ্জার।

দুই প্রফেসর এমন সব গভীর বৈজ্ঞানিক যুক্তি তর্কের মধ্যে চলে গেলেন যে সেগুলোতে আমাদের পক্ষে দাঁত বসানো সম্ভব নয়।

ছয় দিনের দিন মালভূমি প্রদক্ষিণ শেষ হলো। আমরা আমাদের প্রথম ক্যাম্পে ফিরে এলাম। সেই বিচ্ছিন্ন পিরামিডের চুড়ার মত পাহাড়টার নিচেই আবার ক্যাম্প করলাম আমরা। নৈরাশ্য সবাইকে গ্রাস করেছে। অনুসন্ধানে কোন খুঁত নেই আমাদের। কিন্তু কোথাও এমন একটা জায়গা খুঁজে পাইনি যেখান দিয়ে কোন মানুষ উপরে ওঠার কথা আদৌ ভাবতে পারে।

শিকার করার কারণে আমাদের অনেক খাবার বেঁচেছে, কিন্তু তাতে অনির্দিষ্ট কাল চলবে না। আরও খাবারের প্রয়োজন একদিন হবেই। দুমাস পরে বৃষ্টি আরম্ভ হবে, তখন পানির তোড়ে ক্যাম্প ভেসে যাবে। পাহাড়টা মার্বেল পাথরের মত শক্ত, পাথর কেটে যে পথ তৈরি করব তাও অসম্ভব। বিষণ্ণ মনে আমরা কম্বলের উপর গা এলিয়ে দিলাম, কথা বলার মত মনের অবস্থা কারোই নেই ঘুমানোর আগে চ্যালেঞ্জারকে শুভরাত্রি জানিয়ে কোন সাড়া পেলাম না, একটা পাথরের ওপর বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন তিনি।

কিন্তু সকালে চ্যালেঞ্জারের সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ দেখলাম। তৃপ্তি আর আত্মপ্রশংসার ভাব তার সারা মুখে। হাত দুটো সামনে জ্যাকেটের উপর রেখে তিনি। ভঙ্গি দেখে মনে হয় অবসর সময়ে তিনি ট্রাফালগার স্কোয়ারের মূর্তিটার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে থাকেন।

পেয়েছি! বললেন চ্যালেঞ্জার। তাঁর কুচকুচে কালো দাড়ির ভিতর দিয়ে ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো হেসে উঠল। আপনারা আমাকে অভিনন্দন জানাতে পারেন, আমরা সবাই সবাইকে অভিনন্দন জানাতে পারি; সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।

তাহলে আপনি উপরে ওঠার পথ খুঁজে পেয়েছেন? সোৎসাহে জিজ্ঞেস করলেন জন।

আমার তো তাই মনে হয়, তিনি জবাব দিলেন।

কোন পথে? আমি জানতে চাইলাম।

জবাবে পিরামিডের মত বিচ্ছিন্ন পাহাড়টার দিকে আঙ্গুল তুলে নির্দেশ করলেন চ্যালেঞ্জার।

অন্যদের কথা জানি না, ভাল করে ওটার দিকে তাকিয়ে আমি নিরাশ হলাম। প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের কথা মত আমরা ওটার উপরে উঠতে সক্ষম হলেও মালভূমির সাথে তার যে ব্যবধান সেটা পার হব কি ভাবে?

আমরা কিছুতেই পার হতে পারব না, মনের কথা বলেই ফেললাম আমি।

ঠিক আছে, অন্তত ওই পর্যন্ত তো পৌঁছাই, তারপরে প্রমাণ করা যাবে যে মানুষের মস্তিষ্ক অনেক কিছুই উদ্ভাবন করার ক্ষমতা রাখে।

নাস্তা খেয়ে আমরা প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের আনা পাহাড়ে চড়ার সরঞ্জামের বাক্স খুললাম। ওটা থেকে বের হলো দেড়শো ফুট নাইলনের দড়ি, গজাল, খিল আরও অনেক কিছু।

জন পাহাড়ে চড়ায় অভিজ্ঞ ব্যক্তি। সামারলীও কম বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তাঁর বিগত জীবনে। আর চ্যালেঞ্জারের তো কথাই নেই। একমাত্র আমিই অনভিজ্ঞ। আমাকে সম্পূর্ণ দৈহিক শক্তি আর প্রাণ-প্রাচুর্যের উপর নির্ভর করতে হবে।

যত কঠিন মনে করেছিলাম ঠিক ততটা কঠিন হলো না উপরে চড়া। যদিও কোন কোন মুহূর্তে ভয়ে আমার মাথার চুল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তবু প্রথম অর্ধেক বেশ সহজেই উঠলাম আমরা। কিন্তু পরের অর্ধেক পাহাড় আরও খাঁড়া হতে হতে একেবারে সোজা ওপরে উঠেছে। আমরা কোন মতে হাত পায়ের আঙ্গুল পাথরের খাঁজে ঢুকিয়ে লটকে রইলাম। আমার আর সামারলীর পক্ষে উপর পর্যন্ত পৌঁছানো একেবারেই অসম্ভব হত কিন্তু চ্যালেঞ্জার উপরে পৌঁছে একটা গাছের গুড়ির সাথে শক্ত করে দড়ি বেঁধে নিচে ফেললেন। আমাদের পক্ষে দড়ি বেয়ে ওঠা অনেকটা সহজ হয়ে গেল। উপরে উঠে দেখলাম পঁচিশ ফুট লম্বা, পঁচিশ ফুট চওড়া এক সমতল চুড়ার ওপর দাঁড়িয়ে আছি।

দম নিয়ে ফিরে তাকাতেই দেখলাম আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য। ব্রাজিলের বিশাল বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি বিছিয়ে রয়েছে আমার চোখের সামনে। প্রথমে লম্বা ফার্ণ গাছ আর পাথরে পূর্ণ মাঝামাঝি জায়গায় ঘোড়ার পিঠের মত পাহাড়ের ঢিবি, ওপাশে বেতের সবুজ হলুদ রঙ, তারপর থেকে গাছপালা ঘন হয়েছে। যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজ আর সবুজ। আকাশের সাথে গিয়ে মিশেছে অনেক অনেক দূরে।

প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের একটা বলিষ্ঠ হাত যখন আমার কাঁধে পড়ল আমি। তখনও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সুধা পান করছি। এই পথে, থোকা, বললেন তিনি, পিছু দেখতে নেই, সব সময়ে সামনের গৌরবময় ভবিষ্যৎ লক্ষ্যের দিকে চাইতে হবে আমাদের।

ঘুরেই লক্ষ্য করলাম মালভূমির উচ্চতা ঠিক, এই পাহাড়টারই সমান। সবুজ ঝোপঝাড় আর লম্বা উঁচু গাছগুলো এত কাছে যে মাত্র এই সামান্য দূরত্বটুকুই পার হওয়া যে কত অসম্ভব তা চট করে উপলব্ধি করা যায় না। ফাঁকটা আন্দাজ চল্লিশ ফুট হবে। তবে চল্লিশ ফুট না হয়ে চল্লিশ মাইল হলেও কথা একই হত; পার হবার কোন উপায় নেই। এক হাতে একটা গাছের গোড়া ধরে ঝুঁকে নিচের দিকে চাইলাম; দেখলাম অনেক নিচে ছোট ছোট আকৃতির ইন্ডিয়ানরা সব উপরের দিকে চেয়ে রয়েছে।

আশ্চর্য! সামারলীর স্বর শোনা গেল। ঘুরে দেখলাম খুব মনোযোগ দিয়ে সেই বড় গাছটা পরীক্ষা করছেন তিনি।

মসৃণ বাকল, পাঁজরের মত শিরাওয়ালা ছোট ছোট পাতা, আমার খুবই পরিচিত। আরে, এটা তো একটা বীচ গাছ, চেঁচিয়ে বললাম আমি।

ঠিক তাই, বললেন সামারলী, বিদেশ বিভঁুই-এ দেশী গাছ!

মহামান্য জনাব, শুধু দেশীই নয়, নাটকীয় ভঙ্গিতে আরম্ভ করলেন চ্যালেঞ্জার, অকৃত্রিম বন্ধুও বটে। এটাই আমাদের পথের নির্দেশ দেবে।

পুল! একটা পুল! উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলেন জন।

ঠিক বন্ধুগণ—একটা পুল। গতরাতে আমাদের এই সমস্যা নিয়ে পুরো একঘণ্টা চিন্তা করেছি আমি। আমার চেষ্টা বিফলে যায়নি। বলে দাড়িতে একটু হাত বুলিয়ে নিলেন চ্যালেঞ্জার। এই তরুণ সঙ্গীকে আমি আগেই বলেছি যে নিরুপায় অবস্থায় পড়লেই জি. ই. সি-র মাথা খোলে ভাল।

সত্যিই এক চমৎকার উপায় বের করেছেন চ্যালেঞ্জার। গাছটা প্রায় ষাট ফুট উঁচু। পড়ার সময় কেবল ঠিক দিকে পড়লেই হয়। চ্যালেঞ্জার পাহাড়ে ওঠার সময়ে কুঠারটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছিলেন, এবার সেটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি। বললেন, এই ছেলের পেশী আর শক্তি দুইই আছে। এই কাজের জন্যে ম্যালোনই সবচেয়ে উপযুক্ত। তবে একটা অনুরোধ, নিজের ভাবনা চিন্তা মতামত বাদ দিয়ে অক্ষরে অক্ষরে আমার নির্দেশ মত কাজ করতে হবে তোমাকে।

তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী গাছটা এমন ভাবে কাটলাম যেন ঠিক জায়গা মত পড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই ওদিকে একটু ঝুঁকে ছিল গাছটা, জন আর আমি পালা করে কেটে একঘন্টা কঠোর পরিশ্রম করে, মট মট শব্দে গাছটা ফেললাম। ওটা সশব্দে পড়ল গিয়ে মালভূমির ঝোপগুলোর উপর। ঝাঁকির চোটে কাটা গুড়ির দিকটা খাদের একেবারে কিনারায় চলে এল। মুহূর্তের জন্যে সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু কিনারার কয়েক ইঞ্চির মধ্যে এসে স্থির হয়ে থেমে গেল গাছটা। অজানাকে জানার জন্যে আমাদের সেতু তৈরি হলো।

কারও মুখে রা নেই, একে একে সবাই প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের সাথে নীরবে হাত মেলালাম আমরা। প্রফেসর তাঁর খড়ের হ্যাটটা একটু পিছন দিকে ঠেলে দিয়ে কুর্নিশের কায়দায় ঝুকে প্রত্যেককে সম্মান দেখালেন।

আমিই প্রথম পার হয়ে অজানা রাজ্যে পা রাখব, বললেন চ্যালেঞ্জার। এটা আমার ন্যায্য দাবি।

তিনি পুলের দিকে এগিয়ে যেতেই জন তার কোটের উপর হাত রেখে বাধা দিলেন, বললেন, আমি দুঃখিত, প্রফেসর, আমি এতে অনুমতি দিতে পারছি না।

অনুমতি? মাথাটা পিছন দিকে আর দাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে এল তার উদ্ধত ভঙ্গিতে।

বিজ্ঞানের ব্যাপারে আমি সবসময়ে আপনার নেতৃত্ব নির্দ্বিধায় মেনে এসেছি, কারণ আপনি বিজ্ঞান জগতের মানুষ। কিন্তু আমার জগতে আমার কথা আপনাদের মেনে চলতে হবে।

তোমার জগৎ?

আমাদের সবারই নিজস্ব পেশা আছে—আমি যোদ্ধা এবং শিকারী আমার মতে আমরা একটা নতুন অজানা জায়গায় অনুপ্রবেশ করতে যাচ্ছি। নানা শত্রু আর বিপদ আমাদের জন্যে ওঁত পেতে থাকতে পারে ওখানে। বলে থেমে মাথা নেড়ে আবার বললেন, না, না, একটু সাধারণ বুদ্ধি আর ধৈর্যের অভাবে এমন অন্ধের মত হুড়মুড় করে ঢুকে বিপদে পড়া আমাদের কোনমতেই ঠিক হবে না।

খুবই যুক্তিসঙ্গত কথা, একটু নরম হলেন চ্যালেঞ্জার; কাঁধ ঝাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে তুমি কি করতে বলো আমাদের?

জন বললেন, জানি না। হয়তো বা ওই ঝোপের আড়ালেই লুকিয়ে আছে একদল মানুষখেকো লোক, ভুরিভোজনের অপেক্ষায়। বোকার মত ঝুঁকি না নিয়ে ম্যালোন আর আমি গিয়ে নিচে থেকে গোমেস আর ম্যানুয়েল সহ প্রথমে চারটে রাইফেল নিয়ে আসি। পুলের ওপারে তাকিয়ে আবার বললেন, একজন প্রথমে পার হবে, এপার থেকে সবাই তাকে রাইফেলের কভার দেবে। সে গিয়ে সবার পার হওয়া নিরাপদ, এমন ইশারা করলে তখন বাকি সবাই পার হব।

চ্যালেঞ্জার গাছের কাটা গুঁড়িটার উপর বসে পড়ে অধৈর্য হয়ে ছটফট করতে লাগলেন। প্রফেসর সামারলী আর আমি দুজনেই একমত হলাম যে এসব ক্ষেত্রে জনকেই আমাদের নেতা মানতে হবে।

এবারে আর চড়তে কষ্ট হলো না। সবচেয়ে কঠিন জায়গাটার উপরই দড়ি ঝুলছিল। শঙ্কর ইণ্ডিয়ানদের দিয়ে কিছু খাবারও উপরে ওঠালেন জন। আমাদের হয়তো বা লম্বা সময় ধরে অনুসন্ধান চালাতে হবে। যথেষ্ট কার্তুজও আনলাম আমরা।

প্রফেসর, সব দিক থেকে তৈরি হয়ে জন বললেন, আপনি যদি সত্যিই প্রথমে পার হতে চান, তাহলে এবার এগোন।

তোমার সদয় অনুমতির জন্যে আমি কৃতার্থ। রোষের সাথে জবাব দিলেন চ্যালেঞ্জার। অপরের নেতৃত্ব সহ্য করা তার ধাতে সয় না। ঠিক আছে, সবার অগ্রদূত হিসাবে আমি এই গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।

দুপাশে পা ঝুলিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে পার হয়ে গেলেন চ্যালেঞ্জার। পিঠে একটা হাত-কুড়াল ঝুলছে তার। ওপারে গিয়ে দ্রুত চারদিক দেখে নিয়ে হাত নেড়ে সবাইকে পার হতে বললেন তিনি।

উদ্বিগ্নভাবে চেয়ে রয়েছি আমি প্রফেসরের দিকে। প্রতি মুহূর্তেই ভয় হচ্ছে আমার এই বুঝি পিছনের সবুজ ঝোপ থেকে ভয়ঙ্কর কিছু বেরিয়ে এসে আক্রমণ করল তাঁকে। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটল না। চারদিক চুপচাপ, ঘটনার মধ্যে কেবল তার পায়ের কাছ থেকে হঠাৎ একটা বিচিত্র রঙের পাখি উড়ে গাছের আড়ালে অদৃশ্য হলো।

এরপর পার হলেন সামারলী। তার ছোট্ট কাঠামোয় এত তেজ সত্যিই আশ্চর্যজনক। জিদ করেই পিঠে দুই দুইটা রাইফেল বহন করলেন তিনি, ওপারের দুই প্রফেসরই সশস্ত্র হচ্ছেন সামারলী পৌঁছার সাথে সাথে, এটাই তার যুক্তি।

এরপর এল আমার পালা। নিচের দিকে চাওয়া থেকে নিজেকে আমি অনেক কষ্টে বিরত রাখলাম। ওপারে আমাকে সাহায্য করার জন্যে সামারলী রাইফেলের নল বাড়িয়ে দিলেন, অল্পক্ষণ পরেই তাঁর হাতের নাগাল পেলাম আমি।

সর্বশেষ পালা লর্ড জনের। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সোজা হেঁটে পার হলেন তিনি। তার স্নায়ু সব কটাই স্টীলের তৈরি কিনা জানি না। সবার চোখই ছানাবড়া হয়ে গেল।

চারজনই এখন দাঁড়ালাম এক অদ্ভুত স্বপ্নের রাজ্যে মেপল হোয়াইটের হারানো পৃথিবীতে। সবার কাছেই মনে হচ্ছে যেন আমরা একটা মস্তবড় বিজয় সমাধা করেছি।

ঘন ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে পঞ্চাশ গজ অগ্রসর হতেই পিছন দিকে মড়মড় শব্দ শুনে সবাই একসাথে ছুটে এলাম মালভূমির ধারে; পুলটা অদৃশ্য হয়ে গেছে!

বহু নিচে পাহাড়ের গোড়ায় দেখা গেল ভেঙে পেচিয়ে যাওয়া ডালপালা আর ফেটে চৌচির হওয়া গুঁড়িটা। তবে কি পাহাড়ের ধার ভেঙে নিচে পড়ে গেছে। গাছটা? সবাই প্রথমে তাই ভেবেছিলাম। এমন সময় একটা কালো মুখ দেখা দিল ওপারের পাহাড়ে—গোমেস। কিন্তু তার মুখে তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাব ফুটে উঠেছে। চোখ দুটো চকচক করছে, উত্তেজনা আর ঘৃণায় জ্বলছে। মুখে একটা উম্মত্ত জিঘাংসার ছাপ।

লর্ড রক্সটন! চিৎকার করে ডাকল গোমেস, লর্ড জন রক্সটন!

কি? জবাব দিলেন জন, এখানে এই যে আমি।

চড়া স্বরে হাসির শব্দ এল ওপাশ থেকে।

হ্যাঁ, ওই যে ইংরেজ কুত্তা! ওখানেই থাকবি তুই। অনেক কাল অপেক্ষা করেছি আমি, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছি। শেষ পর্যন্ত আজ সুযোগ এসেছে। উঠতেই অনেক কষ্ট হয়েছে তোদের, নামা আরও কঠিন হবে। অভিশপ্ত বোকার দল, তোরা সব কয়জন ফাঁদে পড়েছিস।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম আমরা। বিরাট একটা বড় ভাঙা ডাল পড়ে আছে ওপাশে ঘাসের ওপর। ওই ডালটা বাধিয়েই আমাদের পুলটা ঠেলে নিচে ফেলে দিয়েছে সে। গোমেসের মুখ অদৃশ্য হলো, কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার দেখা গেল, এবার মুখটা আগের চেয়েও ভয়ঙ্কর ক্রোধে উন্মত্ত।

ওই গুহার কাছে পাথর ছুঁড়ে তোদের প্রায় শেষ করেছিলাম। চিৎকার করে জানাল সে, কিন্তু এটা আরও ভাল হয়েছে, ধীর স্থির আর অনেক বেশি ভয়াবহ। ওখানে পড়ে থাকতে থাকতে তোদের হাড্ডিগুলো সব সাদা হবে। মরণ শয্যায় শুয়ে ভাবিস লোপেজের কথা, যাকে পাঁচ বছর আগে পুটুমায়য়া নদীর ধারে গুলি করে মেরেছিলি। আমি তার ভাই। প্রতিশোধ নেয়া হয়েছে, এবার আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারব। মুঠো করা হাত আমাদের দিকে কয়েকবার সজোরে ঝাঁকিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।

নীরবে প্রতিশোধ নিয়ে কেটে পড়লেই হয়তো ওর জন্যে ভাল হত। নাটকীয়তা করার নির্বোধ দক্ষিণ আমেরিকান প্রবণতাই কাল হলো। লর্ড জন তিনটি দেশে বন্ধুর বন্ধু শত্রুর যম এই নামটি বৃথা কামাননি। দড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছিল গোমেস, জন দৌড়ে মালভূমির ধার দিয়ে ছুটে গেলেন। যেখান থেকে লোকটাকে দেখা যায় এমন একটা জায়গা পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। তার হাতের রাইফেলটা একবার গর্জে উঠল। প্রথমে প্রচন্ড চিৎকার আর তারপর ধপ করে একটা কিছু পড়ার শব্দ পেলাম আমরা।

মুখ মলিন করে ফিরে এলেন জন। আমার দোষেই আপনাদের সবার আজ এই দুরবস্থা হলো। আমার আগে থেকেই সাবধান হওয়া উচিত ছিল। এরা বংশ পরম্পরায় রক্তের প্রতিশোধ নেয়, কথাটা জেনেও আমি সাবধান হইনি। চরম বোকামি হয়েছে আমার।

অন্য লোকটার কি হলো? দুজন ছাড়া অতবড় গাছটাকে নিচে ফেলা অসম্ভব, বললাম আমি।

ওকেও গুলি করতে পারতাম, কিন্তু ছেড়ে দিলাম। হয়তো এতে ওর কোন হাত ছিল না, কে জানে?

গোমেসের উদ্দেশ্য জানার পর এখন দুয়ে দুয়ে চারের মত মিলে যাচ্ছে সব। আমাদের পরিকল্পনা জানার জন্যে ওর অদম্য কৌতূহল, ওর ঘৃণামিশ্রিত দৃষ্টি, সবই এখন আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, আমরা তখনও আকস্মিক ঘটে যাওয়া ঘটনাটা নিয়ে আলাপ করে নতুন পরিস্থিতির সাথে নিজেদের মনকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি, এমন সময়ে নিচের একটা দৃশ্য আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

সাদা কাপড় পরা একজন লোক—ম্যানুয়েল ছাড়া আর কেউ নয়—প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। মৃত্যুভয় না থাকলে এমন করে কেউ ছোটে না। তার মাত্র কয়েক গজ পিছনেই ছুটছে বিরাট কাঠামোর জাম্বাে। আমাদের বিশ্বস্ত নিগ্রো।

আমাদের চোখের সামনেই পলাতকের পিঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল জাম্বাে। মাটিতে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খেলো ওরা—একটু পরেই জাম্বাে উঠে দাঁড়াল, অসাড় দেহটার দিকে চাইল সে একবার, তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে খুশিতে হাত নেড়ে ছুটে এগিয়ে এল।

বিশ্বাসঘাতক দুজন শেষ হলো বটে কিন্তু তাদের কৃতকর্মের ফলটা রয়ে গেল। কোনমতেই আর আমাদের ওই চুড়ায় ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। আমরা ছিলাম পৃথিবীর মুক্ত মানুষ আর এখন হয়েছি মালভূমির বাসিন্দা-বন্দী। সভ্য জগৎ থেকে এখন আমরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।

লক্ষ্য করলাম আমার তিনজন সঙ্গীই নিজেদের খুব সংযত রেখেছেন। তাঁদের মুখ গম্ভীর, চিন্তিত কিন্তু শান্ত। চুপচাপ জাম্বাের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই আমাদের। একটু পরেই তার কালো মুখটা দেখা গেল ওপাশের পাথরের ওপর এবং পরক্ষণেই তার বিশাল দেহটা চুড়ার ওপর উঠে এল।

ধারের কাছে এসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল সে, আমি কি করব এখন? আপনারা যা বলবেন তাই করব আমি।

প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করা সোজা হলেও এর উত্তর সত্যিই কঠিন। খুব সত্যি কথা যে জাম্বােই এখন আমাদের সাথে বাইরের জগতের যোগাযোগ রাখার একমাত্র সূত্র। সে চলে গেলে কোন অবস্থাতেই আমাদের আর চলবে না।

না না! আপনাদের ছেড়ে আমি কোথাও যাব না, বলল জাম্বাে, তবে আমার পক্ষে আর বাকি সবাইকে ঠেকিয়ে রাখা বোধ হয় সম্ভব হবে না। এখনই নানান কথা বলা আরম্ভ করেছে, কুরুপুরি থাকে এখানে তাই ওরা সবাই বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কাল পর্যন্ত কোনমতে ওদের ঠেকিয়ে রাখো, জাম্বাে, আমি চিৎকার করে বললাম। ওদের হাতে একটা চিঠি পাঠাতে চাই আমি।

ঠিক আছে, সাহ, আমি কথা দিলাম আগামীকাল পর্যন্ত ওরা থাকবে।

অনেক কাজই করতে হলো জাম্বােকে। নিষ্ঠা আর আনুগত্যের সাথে সব কাজই চমৎকার ভাবে সম্পন্ন করল সে। আমাদের নির্দেশ মত প্রথমে গাছের গুড়ি থেকে দড়িটা খুলে নিয়ে এক মাথা আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিল। কাপড় শুকানোর দড়ির চেয়ে সামান্য মোটা হবে দড়িটা, কিন্তু খুব শক্ত। এটা দিয়ে কোন পুল তৈরি করা সম্ভব হবে না বটে, তবে আমাদের যদি মালভূমিতে কোন পাহাড়ে চড়ার দরকার হয় তখন ওটা খুবই কাজে আসবে। দড়ির একদিক ছুড়ে দিয়ে অন্যদিকে সে নিচে থেকে আনা খাবারের প্যাকেটটা বাধল। আমরা সেটা টেনে এপারে নিয়ে এলাম। সপ্তাহ খানেকের জন্যে আমাদের খাবারের চিন্তা দূর হলো। একই ভাবে নানান জিনিসের সাথে কিছু গোলাবারুদও এপারে পাঠাল জাম্বাে। সব কাজ সেরে সন্ধ্যার দিকে নিচে নেমে গেল সে। যাবার আগে বলে গেল ইন্ডিয়ানদের সে সকাল পর্যন্ত আটকে রাখবে। খাড়া চূড়ার ধারেই আমরা ক্যাম্প করলাম। একটা প্যাকেটের মধ্যে দুই বোতল অ্যাপোপ্লিনারিস পাওয়া গেল। তাই দিয়ে তৃষ্ণা মেটালাম আমরা। আমাদের জন্যে পানি খুঁজে পাওয়া একান্তই জরুরী। একদিনের মত যথেষ্ট অ্যাডভেঞ্চার হয়ে গেছে আজ লর্ড জনের। আজই ভিতরে ঢোকার ইচ্ছা আর কারও মনেই জাগল না। আগুন জ্বালানো, এমন কি নিষ্প্রয়োজনে শব্দ করা থেকেও বিরত রইলাম আমরা। রাতের বেশির ভাগ সময়ই আমার কাটল মোমবাতির আলোতে রিপোর্ট লিখে।

আগামীকাল—মানে আজই, কারণ ভোর প্রায় হয়ে এসেছে—আমরা বেরুব অজানার সন্ধানে।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত