হারানো পৃথিবী: ০৭. পরদিন খুব সকালেই রওনা হলাম

হারানো পৃথিবী: ০৭. পরদিন খুব সকালেই রওনা হলাম

০৭. পরদিন খুব সকালেই রওনা হলাম

পরদিন খুব সকালেই রওনা হলাম। এক এক নৌকায় ছয়জন করে। দুই প্রফেসরের ঝগড়া এড়াবার জন্যে সামারলীর নৌকায় পাঁচজন হতেই রক্সটন সেটাতে চট করে উঠে পড়লেন। প্রফেসর চ্যালেঞ্জার ওদিকেই এগুচ্ছিলেন, কিন্তু আর জায়গা নেই দেখে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে রক্সটনের দিকে তাকিয়ে ফিরে এসে উঠলেন আমাদের নৌকায়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মেজাজ ভাল হয়ে গেল প্রফেসরের। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে একেবারে ডুবে গেলেন। স্মিত হাস্যে কচি ছেলের মত অবাক বিস্ময়ে প্রতিটি দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলেন। তবে কখন যে বিনা মেঘে বজ্রপাত হবে সেটা কারও বলার উপায় নেই। তার মেজাজ মর্জির কিছুটা অভিজ্ঞতা আমার ইতিমধ্যেই হয়েছে। চ্যালেঞ্জারের সঙ্গে থাকলে যেমন কারও পক্ষে স্বস্তিতে থাকা অসম্ভব ঠিক তেমনি আবার তার সান্নিধ্যে কারও পক্ষে বিষণ্ণ থাকাও অসম্ভব।

দুদিন ধরে আমরা প্রায় দুশো গজ চওড়া নদী বেয়ে এগিয়ে চললাম। নদীর পানি একটু কালচে হলেও স্বচ্ছ। তলা পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। আমাজনের উপনদীগুলো অর্ধেকই এই রঙের, বাকি অর্ধেক সাদাটে, অস্বচ্ছ। যে যে এলাকা পেরিয়ে এসেছে তার ওপর নির্ভর করে পানির রঙ। গাছ-গাছড়া পচলে হয় কালো আর কাদামাটি থাকলে হয় অন্য রঙ।

দুবার বাধা পেলাম আমরা, একবার জলপ্রপাতে, আরেকবার একটা খাড়াইয়ে। দুবারই আধ মাইল করে ঘুরে সবকিছু বয়ে নিয়ে যেতে হলো। জঙ্গল বেশি ঘন না হওয়ায় বিশেষ অসুবিধে হলো না আমাদের।

কোনদিন ভুলব না আমি এই জঙ্গলের দৃশ্য। গাছগুলোর যেমন মোটা গুড়ি, লম্বায় তেমনি উঁচু। আমার শহুরে জীবনে আমি চিন্তাও করতে পারিনি যে এও সম্ভব। গাছ সোজা উঠে গেছে উপরের দিকে, অনেক উঁচুতে। আমাদের মাথার বহু উপরে ডালপালা মেলেছে চারদিকে। যেখান থেকে ডাল মেলেছে সে জায়গাটা আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে। ডাল বাঁকা হয়ে উপরের দিকে উঠে গিয়ে যেন একটা পাতার মাদুর তৈরি করেছে। পাতার ফাঁক গলে মাঝে মধ্যে দুএক ফালি সোনালী রোদ সরু লম্বা রেখায় নিচে পড়ছে।

বনের ভিতর দিয়ে শুকনো পাতার কার্পেট মাড়িয়ে চললাম আমরা। কেমন একটা ছমছমে নীরবতা সবার মাঝে। এমন কি যে প্রফেসর চ্যালেঞ্জার আস্তে কথা বলতে জানেন না তার গলা থেকেও এখন ফিসফিস করে শব্দ বেরুচ্ছে।

যদি একা থাকতাম তাহলে সবই অজানা থেকে যেত আমার। কিন্তু আমাদের বৈজ্ঞানিক প্রফেসর দুজন নিচু গলায় চিনিয়ে দিতে লাগলেন বিভিন্ন শ্রেণীর গাছ, শিমুল, লালকাঠ, দেবদারু আরও অন্যান্য সব গাছ। এই সব অসংখ্য গাছের প্রাচুর্যের জন্যেই এই মহাদেশ পৃথিবীর সবথেকে বড় কাঠ সরবরাহকারী। কিন্তু জন্তু-জানোয়ারের দিক থেকে এখানে রয়েছে ঘাটতি।

উজ্জল অর্কিড, বিচিত্র সুন্দর রঙীন লিচেন, বড় বড় গাছের কালো গা বেয়ে ধোঁয়ার মত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠেছে। কোথাও বা এক এক ফালি রোদ এসে পড়েছে সোনালী অ্যালামান্ডা, ট্যাকসোনিয়ার উজ্জ্বল লাল তারা-গুচ্ছে কিংবা কোন গভীর নীল রঙের ইপোমিয়ার উপর। একটা স্বপ্নের দেশের মত দেখাচ্ছে। সূর্যের আলো পাওয়ার জন্যে সব গাছের মধ্যেই যেন একটা নীরব প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। লতা গাছগুলো তো বড় গাছের গা বেয়ে উপরে উঠেছেই, অন্য গাছও, যেমন জেসমিন আর জেসিটারা পাম, ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে লতানোর কৌশল শিখে ফেলেছে।

নিচে কোন প্রাণী চোখে না পড়লেও উপরের নড়াচড়ায় বুঝলাম সাপ, বানর আর বড় বাদুড় জাতীয় স্লথের একটা রাজ্য আছে আমাদের মাথার উপর। অনেক উপর থেকে অবাক বিস্ময়ে ওরা লক্ষ্য করছে আমাদের।

দেখা না গেলেও আশেপাশেই কোথাও কোনো ফাঁকে যে মানুষ আছে তার নিদর্শন দেখা যাচ্ছিল। তৃতীয় দিনে বাতাসে ভেসে এল গুরু গভীর দ্রুম দ্রুম শব্দ। আমাদের ক্যানো নৌকা দুটো একটা আরেকটাকে খুব কাছাকাছি অনুসরণ করছে। সঙ্গের ইন্ডিয়ান অনুচরেরা সবাই যেন একেবারে পাথর হয়ে গেল, তাদের চোখে মুখে ভয়ের চিহ্ন।

কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

ড্রাম, অবহেলাভরে জবাব দিলেন জন, আগেও শুনেছি আমি, এগুলো ওদের যুদ্ধ দামামা।

ঠিক বলেছেন, স্যার, বর্ণশংকর গোমেস বলল, মানসো নয়তো ব্রাভো জংলী ইন্ডিয়ান। ওরা আমাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখছে। সুযোগ পেলে সবাইকে মেরে ফেলবে।

কিভাবে নজর রাখছে আমাদের উপর? নিশ্চুপ স্থির বনের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি। কোন রকম নড়াচড়া চোখে পড়েনি আমার।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে গোমেস বলল, তা ওরাই জানে—ইন্ডিয়ানদের নিজস্ব পদ্ধতি আছে। ড্রাম পিটিয়ে পরস্পর কথা বলছে আর আমাদের উপর নজর রাখছে। একটু সুযোগ পেলেই মেরে ফেলবে আমাদের।

আঠারোই আগস্ট–মঙ্গলবার। আজ কম করে হলেও ছয়টা ড্রাম বাজতে লাগল বিভিন্ন জায়গা থেকে। বিকেল হয়ে আসলে কখনও দ্রুত আবার কখনও ধীরে ধীরে বাজছে। স্পষ্টই বোঝা গেল যে সওয়াল জবাব চলছে ওদের মধ্যে। পুব দিকের একটা ড্রাম অত্যন্ত দ্রুততালে বেজে উঠল ডুগডুগির মত। একটু পরেই উত্তরের ড্রাম বাজল গভীর খাদে। অতি ভয়াবহ আর হিংস্র একটা ভাব রয়েছে ওই একটানা ড্রামের শব্দে। মনে হলো যেন এক কথাই বারবার আউড়ে চলেছে, সুযোগ পেলেই মারব তোদের, এইবারেতে মারব তোদের।

নীরব বনের মধ্যে কেউ নড়ছে না। ছায়া ঘেরা বনে সুন্দর স্নিগ্ধ শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। কিন্তু তারই পিছন থেকে একটানা হুমকি আসছে ভেসে, সুযোগ পেলেই মারব তোদের, সুযোগ পেলেই মারব।

সারাদিন ধরে ড্রামগুলো গুড়গুড় ফিসফিস করল। সেই ভীতিকর শব্দ প্রত্যেকটা স্থানীয় লোকের মুখে সুস্পষ্ট ভয়ের ছাপ একে দিয়েছে। এমন কি ক্ষিপ্র চিতার মত গোমেস, সেও চুপসে গেছে।

বিজ্ঞানী প্রফেসর দুজনকে দেখে অবাক হতে হয়। মানুষখেকোদের ড্রাম আদৌ বিচলিত করতে পারেনি তাদের। সারাদিন তারা লতাপাতা আর পাখি দেখে, আর ঝগড়া করে কাটাচ্ছেন। ড্রামের শব্দ যেন তাদের মনে বিন্দুমাত্র দাগ কাটছে না। এমন একটা ভাব যেন সেন্ট জেমস স্ট্রীটের রয়াল সোসাইটি ক্লাবের বিশ্রাম কক্ষে তারা বসে আছেন!

মাত্র একবারই চ্যালেঞ্জার ওদের বিষয়ে কথা তুললেন। বুড়ো আঙুল দিয়ে পিছনের বনে শব্দের দিকে নির্দেশ করে বললেন, মানুষখেকো মিরানহা বা আমাজুয়াকা।

কোন সন্দেহ নেই, উত্তর দিলেন সামারলী। অন্যান্য উপজাতীয়দের মত মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর নানা ভাষার সংমিশ্রণ এখানেও আছে বলে আমার বিশ্বাস।

বহু সংমিশ্রণ অবশ্যই আছে, বললেন চ্যালেঞ্জার, প্রায় একশো গোত্র সম্বন্ধে আমার বিশেষ নোট নেয়া আছে। কিন্তু মঙ্গোলীয় কিনা সে সম্বন্ধে আমার গভীর সন্দেহ আছে।

আবার লেগে গেলেন দুই প্রফেসর।

তুলনামুলক শরীর বিদ্যাতে যার সামান্য জ্ঞান আছে সে-ও আমার কথার মর্ম বুঝতে পারত, তিক্ত ভাবে বললেন সামারলী।

গর্ব ভরে আকাশের দিকে মুখ তুলতে তুলতে চ্যালেঞ্জারের এমন অবস্থা হলো যে দাড়ি আর টুপির কিনারা ছাড়া মুখের আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কোনই সন্দেহ নেই, জনাব, কেবল মাত্র অল্প বিদ্যান ব্যক্তিই ওকথা বলবে। কিন্তু জ্ঞান যার গভীর তিনি ভিন্ন রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন।

রক্তচোখে দুজন দুজনের দিকে চেয়ে রইলেন। ওদিকে ড্রাম ফিসফিসিয়ে একটানা বলে চলেছে, অল্প পরেই মারব তোদের, সুযোগ পেলেই মারব।

সেই রাতে আমরা মাঝ নদীতে ভারী পাথরের সাথে নৌকা বাঁধলাম। সেই সাথে যে কোন আক্রমণ প্রতিহত করার সব রকম ব্যবস্থাই নেয়া হলো। কিন্তু কোন আক্রমণ এল না। সকালে আবার রওনা হলাম আমরা, ধীরে ধীরে ড্রামের শব্দ পিছিয়ে পড়তে লাগল। বিকেল তিনটার দিকে প্রায় এক মাইল লম্বা একটা খাড়াই আর প্রবল স্রোতের সম্মুখীন হলাম।

মনটা খুশিতে ভরে উঠল আমার। চ্যালেঞ্জারের গল্পের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে, এখানেই নৌকা উল্টে টেরাড্যাকটিলটা হারিয়েছিলেন তিনি।

ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আমাদের নিযুক্ত স্থানীয় ইন্ডিয়ানরা প্রথমে আমাদের নৌকা ও পরে রসদ পার করল।

সন্ধ্যার মধ্যে আরও মাইল দশেক এগিয়ে নৌকা বাঁধলাম। আমি আন্দাজ করলাম উপনদী ধরে অন্তত একশো মাইল ভিতরে ঢুকেছি আমরা।

পরদিন সকালে রওনা হতে হতে দশটা বেজে গেল। রওনা হওয়ার পর থেকেই প্রফেসর চ্যালেঞ্জার অত্যন্ত উল্কণ্ঠার সঙ্গে বার বার দুই পাড়ে কি যেন খুঁজতে লাগলেন। হঠাৎ ঘোঁৎ! করে একটা শব্দে সন্তোষ প্রকাশ করলেন তিনি।

একটা বিরাট পাম গাছ বাঁকা হয়ে নদীর দিকে হেলে রয়েছে। ওদিকে সামারলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিজ্ঞেস করলেন, কি ওটা?

ওটা অতি অবশ্যই একটা আসাই পাম।

ঠিক! এই আসাই পাম গাছটাই আমি পথ নির্দেশের চিহ্ন হিসাবে ব্যবহার করব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। গোপন পথটা ঠিক আধ মাইল সামনে নদীর উল্টো পাড়ে। গাছ গাছড়ার মধ্যে কোন ফাঁক নেই, সেটাই আশ্চর্য রহস্য। সামনে যেখানে হালকা সবুজ নলখাগড়া দেখা যাচ্ছে-ওই যে শিমূল আর গাঢ় সবুজ ঝোপঝাড়ের ঠিক মাঝখানে-ওটাই আমার অজানা দেশে পৌছবার গোপন প্রবেশ পথ। কাছে গেলেই বুঝতে পারবেন।

জায়গাটা সত্যিই সুন্দর! নলখাগড়ার ভিতর দিয়ে লগি ঠেলে কয়েকশো গজ এগিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম একটা ছোট অগভীর স্রোতস্বিনীতে। খুবই খেয়াল করে ঝোপের বদলে যে নলখাগড়া জন্মেছে তা লক্ষ্য না করলে কেউ কোনদিনও এখানে পৌঁছতে পারবে না। এমন স্বচ্ছ একটা স্রোতস্বিনী আর পরীর দেশের মত জায়গা কল্পনাও করা যায় না।

পরীর দেশই এটা। মানুষ এমন সুন্দর জায়গা কেবল স্বপ্নেই দেখতে পায়। স্রোতস্বিনীর দুধারের গাছগুলো মাথার উপর প্রাকৃতিক ছাতা তৈরি করেছে। ফাঁক দিয়ে সোনালী আলো আর দুএক ফালি রোদ এসে পড়েছে স্বচ্ছ পানির উপর। হিমবাহের ধারের মত সবজে, স্ফটিকের মত স্বচ্ছ আর কাচের সরু পাতের মত পরিষ্কার দেখাচ্ছে। পাতার তোরণের নিচে বৈঠার প্রত্যেক টানে শত শত ছোট্ট ঢেউ কাঁপছে পানির উজ্জ্বল উপরিভাগে। অজানা অচেনা অদ্ভুত দেশে পৌঁছার উপযুক্ত পথ বটে।

জংলী ইন্ডিয়ানদের চিহ্নও নেই এখানে। তবে এখন অনেক জীবজন্তু দেখা যাচ্ছে। ওদের নির্ভয় চলা ফেরা দেখেই বোঝা যায় যে শিকারী সম্পর্কে ওরা মোটেও সতর্ক নয়।

ছোট ছোট ব্ল্যাক-ভেলভেট বানরগুলো তাদের তুষার সাদা দাঁতে দাঁতে বাড়ি দিয়ে শব্দ তুলে কৌতূহলী চোখে আমাদের যাওয়া লক্ষ্য করছে। একটা টাপির ঝোপের ভিতর থেকে একবার উঁকি দিয়েই অদৃশ্য হলো। বিরাট একটা চিতা ঝোপের পিছন থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকে আক্রোশ ভরা চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নিজের পথ ধরল।

পাখির প্রাচুর্য বিশেষ করে নজরে পড়ছে। বেশির ভাগই জলচর পাখি। বক, সারস আর ইবিস-নীল, গাঢ় লাল আর সাদা রঙের। নদীর উপরে ঝুঁকে পড়া প্রত্যেকটি ডালেই দেখা গেল অসংখ্য পাখি। আর পানিতে বিভিন্ন আকার ও বিচিত্র রঙের মাছের সমারোহ।

তিনদিন আমরা প্রায় ঝাপসা সবুজ সূর্যের আলোয় স্রোতস্বিনীর সুড়ঙ্গ ধরে এগিয়ে গেলাম। লম্বা পানির ধারাটি যে কোথা থেকে শুরু হয়েছে বোঝা মুশকিল; সামনে বহুদূর পর্যন্ত দেখা গেল শুধু পানি আর পানি। এদিকে মানুষের কোনো অস্তিত্ব মোটেও চোখে পড়ল না।

এদিকে কোন ইন্ডিয়ান নেই। কুরুপুরির ভয়ে এই এলাকায় কেউ আসে না, বলল গোমেস।

কুরুপুরি হচ্ছে জঙ্গলের ভূত বা দৈত্য, ব্যাখ্যা দিলেন জন। যে কোন ভূত, প্রেত, দৈত্য, দানব, জিন, পরী সবার বেলাতেই এই নাম প্রযোজ্য। ওদের ধারণা এদিকে ভীতিজনক কিছু আছে, তাই ভুলেও কেউ এদিকে আসে না।

তৃতীয় দিনে পরিষ্কার বোঝা গেল আমাদের নৌকা যাত্রার পথ এবার ফুরিয়ে এসেছে। স্রোতের ধারাটা দ্রুত অগভীর হয়ে এল, দুঘণ্টায় আমাদের নৌকা দুবার তলায় ঠেকে গেল। শেষ পর্যন্ত দুটো নৌকাই ঝোপের মধ্যে টেনে তুলে রাতের মত ক্যাম্প করলাম।

সন্ধ্যায় তাঁবুর ভিতর আমরা চারজন আলাপ করছি ভবিষ্যৎ কর্মসূচী নিয়ে। দুই প্রফেসর যথারীতি পরস্পরের পিছনে লেগেছেন এবং কথা কাটাকাটি করছেন। বাইরে একটা ধস্তাধস্তির শব্দে আমরা বেরিয়ে আসার আগেই হারকিউলিস জাম্বাে গোমেসকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে তাঁবুতে ঢুকল। জাম্বাের ভাঙা ভাঙা ইংরেজী থেকে বোঝা গেল যে আমাদের তাঁবুর পিছনে সন্দেহজনকভাবে উবু হয়ে বসে ছিল গোমেস।

খাঁটি ইন্ডিয়ান অধিবাসীরা মিশ্র রক্তের মানুষকে একেবারেই দেখতে পারে না, রীতিমত ঘৃণা করে। সুযোগ পেয়ে প্রভুভক্ত কুকুরের মত গোমেসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে জাম্বাে।

হঠাৎ ছুরি বের করেই কোপ মারল গোমেস। অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সাথে হাতটা কজির কাছে ধরে ফেলল জাম্বাে, তার হাতের পেশীগুলো ফুলে উঠল। এক হাতেই মোচড় দিল সে, ছুরিটা মাটিতে পড়ে গেল। কিন্তু তার পরেও ছাড়ল না জাম্বাে। জন বাধা না দিলে হাতটা হয়তো মুচড়ে ভেঙেই ফেলত সে।

গোমেস খুবই কাজের লোক। কোন কাজেই না নেই তার। কৌতূহল চাপতে না পেরে হয়তো শুনতে চেষ্টা করছিল আমরা কোথায় যাচ্ছি বা আমাদের উদ্দেশ্য কি।

গোমেসকে ভৎসনা করে দুজনের হাত মিলিয়ে দেয়া হলো। আশা করা যায় যে ওদের নিয়ে ভবিষ্যতে আর কোন জটিলতা দেখা দেবে না।

সকালে আমি আর রক্সটন প্রায় দুই মাইল অগ্রসর হলাম, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে, স্রোতের ধারার কিনার ঘেঁষে। দেখলাম উপরের দিকে পানি আরও সরু আর অগভীর হয়ে এসেছে। ক্যাম্পে ফিরে জানালাম সবাইকে।

চ্যালেঞ্জার বললেন, হ্যাঁ, আমি তো গতকালই বলেছি এর পরে আর নৌকা নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। এখন থেকে আমাদের পায়ে হেঁটে যেতে হবে বাকি পথ।

নৌকা দুটো ভাল করে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রেখে কুড়াল দিয়ে গাছে দাগ কেটে চিহ্ন রাখা হলো যেন ফেরার পথে চিহ্ন খুঁজে পেতে কোন অসুবিধা না হয়। সব মালপত্র আর বোঝা ভাগ করে নিয়ে আমরা যাত্রার সবথেকে কঠিন অংশ পার হতে রওনা হলাম।

কিন্তু শুরুতেই আবার দুই প্রফেসরে বেধে গেল। প্রথম থেকেই প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের নির্দেশে সবাই চলে আসলে কিন্তু সামারলী সেটা ঠিক মেনে নিতে পারেননি। এতদিনের জমা সেই অসন্তোষ অবশেষে প্রকাশ হয়ে পড়ল।

তেমন ভারী কিছু নয়, একটা ব্যারোমিটার বহন করতে দেয়া হয়েছিল তাঁকে। হিসহিসিয়ে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলেন সামারলী। জানতে পারি কি, জনাব, কোন অধিকারে আপনি সবাইকে আদেশ নির্দেশ দিয়ে চলেছেন?

কটমট করে তাকালেন চ্যালেঞ্জার সামারলীর দিকে। সোজা হয়ে গেল তাঁর দেহ। প্রফেসর সামারলী, আমি নির্দেশ দিচ্ছি এই অভিযানের নেতা হিসাবে।

কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আপনাকে আমি নেতা হিসাবে মানি না।

তাই নাকি? ব্যঙ্গ ভরে সামারলীকে কুর্নিশ করলেন চ্যালেঞ্জার। তাহলে আপনিই বলে দিন আমার পদ-মর্যাদা কি।

বলছি। আপনার সত্যবাদিতার বিচার চলছে। বিচারকমন্ডলীর সাথে চলেছেন আপনি!

আচ্ছা! বলেই একটা গাছের নিচে বসে পড়লেন চ্যালেঞ্জার। ঠিক আছে, আপনারা তাহলে এগিয়ে যান, আমি আমার সময় মত আপনাদের পিছু পিছু আসব। আপনি নিজে, বা যাকে আপনি নেতা মানেন তিনিই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন-আমি দায়িত্ব থেকে রেহাই পেলাম।

এত জ্ঞানী মানুষ, এমন মেধা তাদের, যে লোকে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। নিজ নিজ বিষয়ে তারা পৃথিবীর সেরা বৈজ্ঞানিক। অথচ ব্যবহারে দুজন একেবারেই শিশু। কি বিচিত্র এই পৃথিবী।

ভাগ্য ভাল যে দলে দুজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষও ছিল। নইলে অভিযান অসমাপ্ত রেখে এখান থেকেই ফিরে যেতে হত আমাদের। বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে, অনেক সাধ্যসাধনা করে রাজি করানো গেল তাদের। তবু চ্যালেঞ্জারকে আগে নেয়া গেল না। সামারুলীই আগে থাকলেন, আর পিছন থেকেই নির্দেশ দিয়ে আমাদের এগিয়ে নিয়ে চললেন চ্যালেঞ্জার।

আমরা পরে টের পেয়েছিলাম যে এডিনবারার ডক্টর ইলিংওয়ার্থ সম্পর্কে উভয় প্রফেসরেরই ধারণা খুব খারাপ। কোনো ভাবে ওই বিষয়টিকে ওঠাতে পারলেই উভয়ে একমত হন এবং একটা আপাত মৈত্রী হয়ে যায় তাদের মধ্যে। কখনও বেগতিক দেখলেই আমরা ডক্টর ইলিংওয়ার্থের নাম উচ্চারণ করে তার প্রসঙ্গ তুলতাম।

সার বেঁধে নদীর ধার দিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। স্রোতের ধারা ছোট হতে হতে শেষ পর্যন্ত এক জায়গায় মিলিয়ে গেল শ্যাওলার তলায়। সেখানেই স্রোত পার হলাম আমরা। আমাদের পা শ্যাওলায় হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেল। মেঘের মত মশা উড়ছে চারপাশে। মশার সঙ্গে হাজারো রকমের ছোট ছোট পোকা। পাড়ে উঠে আশ্বস্ত হলাম। তখনও কানে আসছে পোকা আর মশার গুনগুন শব্দ।

নৌকা ছেড়ে আসার দ্বিতীয় দিনে দেখলাম আশেপাশের পরিবেশে পরিবর্তন আসছে। আমরা কেবল উপরের দিকেই উঠছি। যতই উপরে যাচ্ছি গাছপালাও ততই পাতলা হয়ে আসছে। নদীর ধারের বিশাল বিশাল গাছের জায়গায় এদিকে দেখা যাচ্ছে ফিনিক্স আর কোকো পাম, সব বিচ্ছিন্নভাবে গজিয়ে উঠেছে। মাঝে মধ্যে ঝোপঝাড়। কম্পাসের সাহায্যে দিক নির্ণয় করে চললাম আমরা। দুই একবার চ্যালেঞ্জারের সঙ্গে পথ প্রদর্শক ইন্ডিয়ান দুজনের মতবিরোধ দেখা দিল। দলের সবাই ইন্ডিয়ানদের নির্দেশই মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিলাম। রাগে, দুঃখে চ্যালেঞ্জার মন্তব্য করলেন, বিজ্ঞানসম্মত কম্পাসের চেয়ে দুজন অসভ্য ইন্ডিয়ানের ধারণাকেই বেশি বিশ্বাস করলেন আপনারা? ছোঃ!

আমরা যে ভুল করিনি তা প্রমাণিত হলো তৃতীয় দিনে যখন চ্যালেঞ্জার নিজেই স্বীকার করলেন যে কিছু কিছু জায়গা তিনি চিনতে পারছেন। আরও নিশ্চিত হওয়া গেল যখন আগুনে জ্বলে কালো হওয়া চারটে পাথর দেখতে পেলাম।

আমাদের পথ এখনও উঁচুতেই উঠছে। পাথরে ভরা জায়গাটা পার হতে আমাদের দুদিন সময় লাগল। গাছপালার চেহারা আবারও বদল হয়েছে। আইভরি পাম ছাড়া আর কোন বড় গাছ নেই এই এলাকায়। আর আছে নানা জাতীয় অর্কিড। এখানেই আমি দুর্লভ নাট্টোনিয়া ভেক্সিল্লারিয়া, গোলাপী ও গাঢ় লাল রঙের ক্যাটলিয়া আর অডটোগ্লসাস চিনতে শিখলাম। একটি দুটি ছোট ঝর্না, ছোট্ট ছোট্ট পাথরের নুড়ির উপর দিয়ে পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে নেমে গেছে। দুধারে শ্যাওলা।

প্রতি সন্ধ্যায়ই আমরা কোন একটি ঝর্নার ধারে ক্যাম্প করি। ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ঘুরছে ঝর্নাগুলোতে—পিঠের রঙ নীল। প্রায় ইংলিশ ট্রাউটের সমানই বড়। আকৃতিও একই রকমের। (আমাদের দেশের শোল মাছের মত-অনুবাদক) রাতের বেলা এই মাছ দিয়ে চমৎকার সুস্বাদু খাবার রান্না হয়।

নৌকা ছেড়ে আসার নয় দিনের দিন থেকে গাছপালা ক্রমে ছোট হতে হতে শেষে গুল্মলতায় পরিণত হলো। এখন গাছ আর নেই, শুধু বেত ঝাড়। এতই ঘন যে কুড়াল আর বড় ছুরি দিয়ে না কেটে ভিতরে ঢোকাই যায় না। সকাল সাতটা থেকে আরম্ভ করে সারাদিন গিয়ে রাত আটটা বেজে গেল আমাদের বেতবন পার হতে। মাঝে দুবার এক ঘন্টা করে মাত্র বিশ্রাম নিয়েছি। এমন একঘেয়ে ক্লান্তিকর পথ যে চিন্তাই করা যায় না। সবচেয়ে খোলা জায়গাতেও দশ বারো গজের বেশি নজর যায় না। বেশির ভাগ সময়েই আমি কেবল লর্ড জনের জ্যাকেট পর্যন্ত দেখতে পেয়েছি, তার দুপাশে ঝোপঝাড় হলদে দেয়ালের মত দাঁড়ানো। এমন জঙ্গলে কিসের বাস জানি না তবে কয়েকবারই আমাদের খুব কাছ থেকে কোন ভারি জন্তু ছুটে পালিয়ে গেল। জন ধারণা করলেন যে ওগুলো বুনো ষাঁড়।

রাত হতে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে আমরা তাঁবু ফেললাম। সবাই ক্লান্ত।

পরদিন সকালেই আবার রওনা হলাম। আমাদের সামনের দৃশ্য আবার পাল্টাচ্ছে এখন। খোলা প্রান্তর ক্রমে উপরের দিকে উঠে গেছে, অসংখ্য ফার্ণ গাছে ভরা। প্রান্তরটা তিমি মাছের পিঠের মত বাঁকা হয়ে ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

দুপুর নাগাদ আমরা বাঁকের মাথায় পৌঁছলাম। ওপাশে ছোট অগভীর উপত্যকা; তার পরে আবার উপরে উঠেছে মাঠ।

দুজন ইন্ডিয়ানের সাথে প্রফেসর চ্যালেঞ্জার সবার আগে আগে চলছিলেন। হঠাৎ থেমে উত্তেজিত ভাবে ডান দিকে দেখালেন তিনি। তাকিয়ে দেখলাম প্রায় মাইল খানেক দূরে বিরাট বড় একটা সাদা রঙের পাখি ডানা ঝাপটে ধীরে ধীরে মাটি থেকে উপরে উঠল। খুব নিচু দিয়ে সোজা উড়ে আড়ালে চলে গেল পাখিটা।

দেখেছেন! উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন চ্যালেঞ্জার, সামারলী, দেখেছেন তো?

পাখিটা যেখানে অদৃশ্য হয়েছে সেদিকে নীরবে তাকিয়ে আছেন সামারলী। ওটা কি বলে দাবি করছেন আপনি? তিনি ব্যঙ্গ ভরে জিজ্ঞেস করলেন।

আমার যতদূর বিশ্বাস ওটা একটা টেরাড্যাকটিল, গম্ভীরভাবে বললেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার।

হো হো করে হেসে উঠলেন সামারলী। একটা বড় সারস ছাড়া আর কিছুই নয় ওটা।

রাগের চোটে কথা ফুটল না চ্যালেঞ্জারের মুখে, ঝট করে ঘুরেই হাঁটা আরম্ভ করলেন তিনি।

জন এগিয়ে এলেন আমার পাশে। ওঁর মুখ অস্বাভাবিক রকম গম্ভীর। হাতে জাইস বাইনোকুলার। পাখিটা অদৃশ্য হবার আগে ফোকাস করেছিলাম আমি। কি যে ওটা বলতে পারব না আমি, তবে জোর দিয়ে বলতে পারি যে জীবনে বহু পাখি দেখেছি, শিকারও করেছি, কিন্তু এরকম পাখি কোনদিন চোখে পড়েনি।

সামনে এগিয়ে চললাম আমরা। দ্বিতীয় টিলাটা পার হতেই সামনে খোলা জায়গা পড়ল। এখানে পাম গাছ বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে আছে। শেষ মাথায় লাল পাথরের খাঁড়া উঁচু একটা পাহাড়-স্কেচে দেখা এই পাহাড়টা চিনতে দেরি হলো না আমার। কোন সন্দেহই রইল না যে আমরা আমাদের গন্তব্যস্থলে এসে পৌঁছেছি। আমাদের ক্যাম্প থেকে এই পাহাড়টা এখন প্রায় সাত মাইল দূরে। গর্বিত ভাবে আকাশের দিকে চেয়ে হাঁটাচলা করছেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। সামারলী চুপ করে থাকলেও সন্দিগ্ধ। আর মাত্র একদিন পরেই সব সন্দেহের অবসান হবে।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত