হারানো পৃথিবী: ০৪. চ্যালেঞ্জারের সাথে দেখা করতে এসে

হারানো পৃথিবী: ০৪. চ্যালেঞ্জারের সাথে দেখা করতে এসে

০৪. চ্যালেঞ্জারের সাথে দেখা করতে এসে

চ্যালেঞ্জারের সাথে দেখা করতে এসে প্রথমে শারিরীক ও পরে মানসিক নির্যাতন আমার সাংবাদিকসুলভ মনের জোর ভেঙে দিয়েছে। মাথা ব্যথা করছে—সেই সাথে একটা চিন্তা ক্রমাগত মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে: প্রফেসরের কাহিনীটা সত্যিই বাস্তব!

একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা অফিসে গেলাম। দেখি ম্যাকারডল রোজকার মতই তার জায়গায় বসে আছেন।

কি খবর, জিজ্ঞেস করলেন তিনি, চেহারা দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধ করে ফিরলেন; ব্যাটা প্রফেসর মারধোর করেনি তো?

একটু মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল প্রথমে।

লোক বটে একটা! তা আপনি কি করলেন?

পরে ভাল ব্যবহার করেছেন, গল্প করেছি আমরা। কিন্তু ছাপাবার মত কিছুই বের করতে পারিনি আমি।

একেবারে কিছুই পাননি তা বলব না আমি, মেরে তো দেখি চোখে কালশিরা ফেলে দিয়েছে; এটা অবশ্যই ছাপার মত খবর। মিস্টার ম্যালোন, এই ভাবে স্বেচ্ছাচারিতা চলতে দেয়া যায় না। ঘটনার বর্ণনা দিন, আমি এমন হেডিং দেব যে পড়ে প্রফেসরের গায়ে ফোস্কা পড়ে যাবে। প্রফেসর মাক্ষুসেন!-কেমন হয় এই শিরোনাম? স্যার জন ম্যানডোভল-ক্যাগলিওস্ত্রো—সব ঠগ আর রংবাজের ইতিহাস। কলমের বিষে জ্বলবে সে।

দয়া করে লিখবেন না, স্যার।

কেন?

কারণ আমার বিশ্বাস উনি জোচ্চোর নন।

কি! চিৎকার করে উঠলেন ম্যাকারডল, তারমানে আপনি তার সেই বিকট জীবজন্তুর গল্প সব বিশ্বাস করেন?

খুব বেশি কিছু পেয়েছেন বলে দাবি করেননি উনি, তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস নতুন একটা কিছু আবিষ্কার করেছেন প্রফেসর।

তাহলে আর দেরি করছেন কেন, লিখে ফেলুন।

লিখতে পারলে খুশি হতাম কিন্তু আমার কাছে যা বলেছেন প্রফেসর তা আমাকে বিশ্বাস করেই বলেছেন। শর্ত আছে, তার অনুমতি ছাড়া এক লাইনও লেখা চলবে না। আর আজ রাতে একটা অনুষ্ঠানে দাওয়াত করেছেন, ওখানে তিনি বিষয়টি উত্থাপন করবেন।

গভীর অবিশ্বাস ফুটে উঠল ম্যাকারডলের চেহারায়।

ঠিক আছে, মিস্টার ম্যালোন, আজ রাতের অনুষ্ঠান তো গোপনীয় নয়। অন্য কাগজ হয়ত কোন রিপোর্টার পাঠাবে না, কারণ ইতিমধ্যেই ওয়াল্ড্রনের ওপর বেশ কয়েকটা রিপোর্ট হয়েছে। কেউ জানবে না যে চ্যালেঞ্জারও বক্তৃতা দেবেন। কপাল ভাল থাকলে ভাল একটা একচেটিয়া খবর পাওয়া যেতে পারে। রাত বারোটা পর্যন্ত প্রথম পৃষ্ঠায় জায়গা রাখব আমি আপনার জন্যে।

বেশ ব্যস্তভাবেই দিনটা কাটল আমার। একটু সকাল সকালই টারপ হেনরির সাথে রাতের খাবার সেরে নিলাম। সকাল বেলার ঘটনার কিছুটা বর্ণনা দিলাম আমি ওকে। অবিশ্বাসের হাসি হাসতে হাসতে পুরোটা শুনল সে। তারপর হাসির দমকে ফেটে পড়ল, আমি প্রফেসরের কাহিনী বিশ্বাস করেছি বলে এই হাসি।

বন্ধু মেলোন, বাস্তবে এমন ঘটে না। বিরাট কিছু আবিষ্কার করার পর কেউ ওভাবে প্রমাণ হারিয়ে ফেলেন না। ওটা কেবল ঔপন্যাসিকদের পক্ষেই সম্ভব। লোকটা চিড়িয়াখানার বানরের মতই ছল চাতুরীতে ভরা; কাহিনীর পুরোটাই বানোয়াট।

আমেরিকান শিল্পী—সেটাও কি গল্প?

সেটাও গল্প, মেপল হোয়াইট বলে কেউ নেই, কোনদিন ছিল না।

আমি তার স্কেচ বই দেখেছি।

বলো, চ্যালেঞ্জারের স্কেচ বই।

তুমি বলতে চাও চ্যালেঞ্জারই এঁকেছেন ওই ছবি?

অবশ্যই—আর কে আঁকবেন?

আর ফটোগুলো?

তুমি তো নিজেই বলেছ, একটা পাখি ছাড়া ছবিতে আর কিছুই ছিল না।

পাখি নয়, টেরাড্যাকটিল।

ওটা প্রফেসরের কথা—তোমার মাথায় টেরাড্যাকটিল ঢুকিয়ে দিয়েছেন তিনি।

হাড়গুলো সম্বন্ধে কি বলবে তুমি?

প্রথম হাড়টা আইরিশ ঝোল-মাংস থেকে নেয়া; আর দ্বিতীয়টা-যে কোন চালাক লোকের পক্ষেই ছবি আর হাড় দুটো নকল করা সহজ।

মীটিং-এ যাবে তুমি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

চিন্তিত দেখাল টারপকে।

মোটেই জনপ্রিয় লোক নন এই চ্যালেঞ্জার। অনেকেরই রাগ আছে তাঁর উপর। ডাক্তারির ছাত্ররা ওখানে উপস্থিত থাকলে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে। এর মধ্যে যেতে চাই না আমি।

অন্তত তাঁর বক্তব্যটুকু বলার সুযোগ প্রফেসরকে দেয়া উচিত।

এমন করে বলছ যখন—ঠিক আছে, সন্ধ্যায় আমিও যাব তোমার সঙ্গে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলো টারপ।

পৌঁছে দেখলাম যা আশা করেছিলাম তার চেয়ে অনেক বড় একটি হল। ইলেকট্রিক গাড়ি থেকে সাদা দাড়িওয়ালা প্রফেসররা একে একে নামলেন। উপস্থিত ব্যক্তিদের দেখেই বোঝা যায়, তারা সবাই বিজ্ঞানের লোক এবং সবাই ভাল শ্রোতা। বসেই বুঝতে পারলাম গ্যালারি আর হলের পিছন দিকে একদল মেডিক্যাল ছাত্র বসেছে। সম্ভবত বড় বড় সব হাসপাতাল থেকে রীতি অনুযায়ী প্রতিনিধি এসেছে। বেশ হালকা একটা পরিবেশ ছাত্রদের মাঝে। কয়েকজন আবার জনপ্রিয় গান ধরেছে কোরাসে।

বৃদ্ধ ডক্টর মেলড্রাম তার সুপরিচিত ঢেউ খেলানো অপেরা হাট পরে স্টেজে এলেন। অমনি ছেলেদের মধ্যে রব উঠল, চটকদার টুপিখানা পেলেন কোথায়? তক্ষুণি চট করে টুপিটা খুলে চেয়ারের তলায় লুকিয়ে রাখলেন তিনি।

বেতো রোগী প্রফেসর ওয়াডলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে নিজের আসন গ্রহণ করতে যাবেন—তক্ষুণি সবাই দরদী স্বরে তার পায়ের অবস্থায় উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতে শুরু করল। অপ্রস্তুত হয়ে বসে পড়লেন ওয়াডলে।

সাড়ম্বরে প্রবেশ করলেন আমার সদ্য পরিচিত প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। তাঁর কালো দাড়ি দেখার সাথে সাথেই হলের পিছন দিক থেকে ছেলেরা এমন চিৎকার করে সংবর্ধনা জানাল যে টারপ্ যে তাকে লন্ডনের সবচেয়ে অপ্রিয় ব্যক্তি মনে করে ভুল করেনি, সেটা প্রমাণিত হয়ে গেল।

সামনের দিকে নিখুঁত পোশাক পরা কয়েকজন ভদ্রলোকের কাছ থেকে সমবেদনার হাসি শোনা গেল। ছাত্রদের সংবর্ধনা তাদের অপছন্দ হয়নি। হিংস্র পশুর খাঁচায় বালতি করে খাবার দিতে গেলে যেমন হুঙ্কার ওঠে, ছাত্রদের ওই চিকারকে একমাত্র তার সাথেই তুলনা করা যেতে পারে, অর্থাৎ রীতিমত বিকট। চ্যালেঞ্জার বিরক্তির হাসি হেসে দর্শকদের দেখতে দেখতে দাড়িতে হাত বুলাতে লাগলেন। ভাবটা এমন যেন কতগুলো জন্তু জানোয়ার দেখছেন তিনি। হৈ চৈ কমে আসতেই চেয়ারম্যান প্রফেসর রোনাল্ড মারে আর মিস্টার ওয়ার্ল্ডন এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে; অনুষ্ঠান শুরু হলো।

চেয়ারম্যানের পরে আরম্ভ করলেন ওয়াল্টন, প্রফেসর মারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলছি, বেশিরভাগ ইংরেজের যা দোষ তা তার মধ্যেও রয়েছে, অর্থাৎ এত আস্তে কথা বলেন যে শোনাই যায় না। যে সব মানুষের কোন বক্তব্য আছে তারা যে কেন একটু কষ্ট না করে নিজেদের কথা শ্রুতিগোচর হওয়ার প্রতি উদাসীন তা বর্তমান দুনিয়ার এক আশ্চর্য রহস্য।

শক্ত বেতো মানুষ ওয়ান্ড্রন! কণ্ঠ আর স্বভাব দুটোই একটু উগ্র ধরনের। কিন্তু একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তাঁর। অন্যের কথা থেকে বাছা বাছা অংশগুলো নিয়ে নিজের ভাষায় সুন্দর করে সাজিয়ে বলতে পারেন তিনি। নীরস বিষয়ও উপভোগ্য হয়ে ওঠে কেবল তার বলার ভঙ্গিতে।

তিনি সংক্ষেপে, এমন ভাষায় তাঁর বক্তব্য আমাদের সামনে তুলে ধরলেন যে, চোখের সামনে যেন জীবন্ত ছবি ভেসে উঠল। পৃথিবী কেমন ছিল, ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে কুঁচকে গিয়ে কেমন করে পাহাড় পর্বতের সৃষ্টি হলো, কেমন করে বাস্প পানি হলো। কিন্তু প্রাণীর জন্ম ঠিক কিভাবে হলো তা এড়িয়ে গেলেন কৌশলে। বললেন, যেহেতু সৃষ্টির শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ের প্রচন্ড গরমে কোন প্রাণীরই জীবন্ত থাকা সম্ভব ছিল না, অতএব ধরে নেয়া যায় যে তারা পরে এসেছে। তবে কি প্রাণের জন্ম হয়েছে পৃথিবী ঠান্ডা হবার সময়েই-অজৈব পদার্থ থেকে? খুবই সম্ভব। বাইরে থেকে উল্কায় চড়ে প্রাণী পৃথিবীতে এসেছে—এটা অচিন্তনীয়। এটাও আবার ঠিক যে ল্যাবরেটরিতে আজ পর্যন্ত আমরা অজৈব পদার্থ থেকে প্রাণ সঞ্চার করতে পারিনি। তবে তখনকার রসায়ন আর পরিবেশ ভিন্ন ছিল—সেই পরিবেশ আর নেই বলেই হয়তো আমরা এখনও জীবন তৈরি করতে পারিনি।

বলে চললেন বক্তা। কিভাবে জীবনের ক্রম বিকাশ হয়েছে, প্রথমে অতি ক্ষুদ্র প্রাণী ছিল, তারপর আরও এগিয়ে সরীসৃপ, মাছ থেকে ক্যাঙ্গারু, ইঁদুর। এই প্রাণীই প্রথম জীবন্ত সন্তান প্রসব করে, অর্থাৎ সব জীবন্ত প্রসবকারী প্রাণীর আদি। এখান যারা উপস্থিত আছেন তাদেরও আদি পিতামাতা সে-ই।

হলের পিছন থেকে একজন ছাত্র চিৎকার করে উঠল, মানি না! মানি না!

সেদিকে ভাল করে খেয়াল করে বললেন, লাল টাই পরা যে ভদ্রলোক ডিম ফুটে বেরিয়েছেন বলে দাবি করেছেন, তাঁকে বলছি-দয়া করে বক্তৃতা শেষ হবার পর আমার জন্যে একটু অপেক্ষা করলে আমি খুবই বাধিত হব। এমন একটি আশ্চর্য প্রাণী দেখার সুযোগ জীবনে হয়তো আর হবে না আমার। (হেসে উঠল সবাই)। ভাবতে অবাক লাগে যে প্রকৃতির আশ্চর্য ব্যতিক্রমে জন্ম হয়েছে ওই লাল টাই পরা ভদ্রলোকের।

এই ভাবে সবার মুখ টিপে হাসাহাসির মধ্যে দিয়ে সুকৌশলে লাল টাই পরা ছেলেটিকে জব্দ করে নিজের বক্তব্যে ফিরে গেলেন বক্তা। সমুদ্র শুকিয়ে যাওয়া, চর জেগে উঠা, কাদার মধ্যে বাস করা প্রাণী—লেগুনে প্রাণীর প্রাচুর্য, সামুদ্রিক প্রাণীর প্রচুর খাদ্যের লোভে কাদায় উঠে আসা। ফলে সামুদ্রিক প্রাণীগুলোর বৃহদাকার হয়ে ওঠা। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য যে, সেই সব বিরাটকায় প্রাণী—যাদের ফসিল উইলডন বা সোলেনহফেন প্লেটের মধ্যে দেখে এখনও আমাদের কলজে শুকিয়ে যায়—তারা মানুষ জন্ম নেয়ার আগেই পৃথিবীর বুক থেকে বিলীন হয়ে গেছে।

মানি না! মঞ্চ থেকে একটা স্বর হুঙ্কার ছাড়ল।

লাল টাই পরা ছেলেটার বেলাতেই দেখা গেছে যে বাধা পেলে কেমন রূঢ় ভাষায় পর্যুদস্ত করতে পারেন মিস্টার ওয়ার্ল্ডন। কিন্তু এবার এমন অস্বাভাবিক জায়গায় বাধা পেয়েছেন যে হঠাৎ করে বলার কিছুই খুঁজে পেলেন না তিনি। তারপর গলা চড়িয়ে ধীরে ধীরে নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন, মানুষ পৃথিবীতে আসার আগেই তারা নিশ্চিহ্ন হয়েছে পৃথিবীর বুক থেকে।

জবাব চাই! আবার সেই কণ্ঠ শোনা গেল মঞ্চ থেকে।

ওয়াল্টন মঞ্চে বসা প্রফেসরগণের উপর চোখ বুলালেন। চ্যালেঞ্জারের উপর দৃষ্টি পড়তেই চোখ আটকে গেল তার। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আধবোজা চোখে মিটিমিটি হাসছেন প্রফেসর। আচ্ছা, বললেন ওয়ার্ল্ডন, তাহলে আমার বন্ধু প্রফেসর চ্যালেঞ্জার! বলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবার নিজের বক্তব্যে ফিরে গেলেন তিনি। যেন চ্যালেঞ্জারের বাধা দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এর বেশি কিছু বলার বা গুরুত্ব দেয়ার দরকার নেই।

কিন্তু যতবারই নতুন করে আরম্ভ করেন তিনি প্রতিবারেই হুঙ্কার আসে, জবাব চাই! সেই একই গলা। কয়েকবার চেষ্টা করেও এগুতে পারলেন না বক্তা। এবার ছাত্ররাও যোগ দিল চ্যালেঞ্জারের সাথে। প্রফেসরের দাড়ি একটু নড়ে উঠলেই তার মুখ থেকে কোন শব্দ বের হবার আগেই ছেলেরা গর্জন করে ওঠে, জবাব চাই! এমন কঠিন পরিস্থিতিতে এর আগে আর কোনদিন পড়েননি তিনি।

অর্ডার! শেম! ইত্যাদি চিৎকারের মধ্যে ওয়ার্ল্ডন প্রফেসরের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। এটা সত্যিই অসহ্য। তাঁর চোখের দৃষ্টিতে আগুন ঝরছে। আপনি এমন অজ্ঞ আর অভদ্রের মত বারবার বাধা না দিলে ভাল করবেন।

হলের সব শ্রোতা উত্তেজনা নিয়ে নীরবে বসে আছে। ছাত্রেরা কৌতুকের সাথে স্টেজের ওপর প্রফেসরদের ঝগড়া উপভোগ করছে। প্রফেসর হাতলের উপর ভর দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

মিস্টার ওয়ার্ল্ডন, আপনার কথার উত্তরে আমি আপনাকে বলব যে আপনিও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে প্রমাণিত নয় এমন সব কথা না বললেই ভাল করবেন।

ভীষণ হৈ চৈ উঠল চ্যালেঞ্জারের এই মন্তব্যে। শেম! শেম! ওঁকেও বলতে দিন, বের করে দিন ওকে, মঞ্চ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিন, আমরা শুনব ওঁর বক্তব্য, ইত্যাদি নানারকম চিৎকার উঠল শ্রোতাদের মধ্য থেকে।

সভাপতি উত্তেজিতভাবে দুহাত নাড়তে নাড়তে উঠে দাঁড়ালেন। চিৎকার করে বললেন, প্রফেসর চ্যালেঞ্জার, এটা তার নিজস্ব মতামত, পরে আলোচনা হবে।

কুর্নিশ করে চ্যালেঞ্জার নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন; বক্তা বক্তৃতার মাঝে মাঝে বারবার রক্ত দৃষ্টিতে চাইতে লাগলেন চ্যালেঞ্জারের দিকে। কিন্তু প্রফেসরের চেহারার কোন পরিবর্তন নেই—একই রকম হাসি মাখা মুখ নিয়ে বসে আছেন নিজের আসনে।

বক্তৃতা শেষ হলো; একটু যেন তাড়াহুড়ো করেই বক্তা হঠাৎ তার বক্তৃতা শেষ করলেন বলে মনে হলো।

সভাপতির অনুরোধে আবার উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর, ভদ্রমহিলা এবং ভদ্র মহোদয়গণ, আরম্ভ করলেন তিনি। পিছন থেকে একটা গুঞ্জন উঠল। মাফ করবেন, ভদ্র মহিলা, ভদ্রমহোদয় এবং তরুণমন্ডলী, আবার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি— অনিচ্ছাকৃতভাবে দর্শক মন্ডলীর একটা বিরাট অংশের কথা আমি উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। শোরগোল আরম্ভ হলো, বিরাট মাথাটা উপরে নিচে ঝাকাতে ঝাকাতে এক হাত তুলে সমঝদারের মত দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি, যেন সবাইকে তার ধৈর্যশীল আর্শীবাদ জানাচ্ছেন।

হট্টগোল থামতেই প্রফেসর আবার আরম্ভ করলেন, সবার তরফ থেকে মিস্টার ওয়াল্ড্রনকে তার সুন্দর বর্ণনামূলক ও কল্পনাপ্রবণ বক্তৃতার জন্যে ধন্যবাদ জানানোর জন্যে আমাকে মনোনীত করা হয়েছে। কোন কোন বিষয়ে আমি তার সাথে একমত নই—সেগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরা আমি পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করি। জনপ্রিয় বক্তৃতা শুনতে ভাল লাগে বটে, কিন্তু মিস্টার ওয়াল্ড্রন, প্রাক্তন বক্তার দিকে মিট মিট করে চেয়ে বললেন, আমি জানি আমার সত্য এবং স্পষ্ট উক্তির জন্যে নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করবেন আপনি। এসব বক্তৃতা স্বভাবতই ভাসাভাসা হয়ে থাকে, এবং শ্রোতাদেরকে বিপথে চালিত করে। বিশেষত বক্তৃতাটা যখন একেবারে অজ্ঞ লোকেদের সামনে দেয়া হচ্ছে।

শ্লেষপূর্ণ হর্ষধ্বনি উঠল শ্রোতাদের মাঝ থেকে।

জনপ্রিয় বক্তৃতা প্রকৃতিগত ভাবেই পরনির্ভরশীল হয়। ওয়াল্ড্রনের চোখে মুখে যেন রাগ ফেটে পড়তে লাগল।

জনপ্রিয়তার জন্যে তাঁরা অপরিচিত সহকর্মীদের কৃত কর্মের সুফল ভোগ করে থাকেন। কিন্তু যাক সে কথা, এবার আসল কথায় আসি।

লম্বা ভূমিকা শেষ হয়েছে দেখে অনেকক্ষণ হাততালি পড়ল।

একজন মৌলিক অনুসন্ধিৎসু বৈজ্ঞানিক হিসাবেই আমি প্রতিবাদ করেছি। মিস্টার ওয়াল্ড্রন নিজে কোনদিন প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তু দেখেননি বলেই যে সেসবের অস্তিত্ব থাকবে না এটা ধরে নেয়া তাঁর খুবই ভুল হবে। সন্ধানের মত সন্ধান করলে আজও তাদের দেখা পাওয়া যাবে।

নানারকম চিৎকার উঠল দর্শকদের মাঝে। গাঁজা, প্রমাণ চাই!, আপনি কি করে জানলেন! ইত্যাদি।

আমি কেমন করে জানি? আমি জানি কারণ আমি তাদের গোপন বিচরণ ভূমিতে গিয়ে নিজের চোখে দেখে এসেছি।

হাত তালি আর কোলাহলের মাঝে একটা চড়া গলা শোনা গেল, মিথ্যাবাদী।

মিথ্যাবাদী? কেউ কি আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন? একবার উঠে দাঁড়াবেন কি তিনি?

ছাত্রদের মাঝে একজন চশমা পরা নিরীহ গোছের ছোটখাট মানুষকে ধস্তাধস্তি করতে দেখা গেল। ছাত্রেরা জোর করেই তাকে দাঁড় করিয়ে দিল, এই লোকই আপনাকে মিথ্যাবাদী বলেছে, স্যার।

ঠিক আছে, মীটিং এর পরে নিষ্পত্তি হবে।

আবার শোনা গেল চিৎকার, মিথ্যাবাদী!

কে? কে বলছে ও কথা? জানতে চাইলেন চ্যালেঞ্জার।

আবারও ছাত্রেরা সেই নিরীহ লোকটাকে তুলে ধরল। ফাজলামি হচ্ছে? আমি যদি নেমে আসি…

আসুন না, ভাই, আসুন। চিৎকার উঠল ওদের মাঝে, বেশ কিছুক্ষণ হট্টগোল চলল। সভাপতি উঠে দাঁড়িয়ে সঙ্গীত পরিচালকের মত দুহাত নেড়ে কোন মতে শান্ত করলেন সবাইকে।

সব বড় আবিষ্কারই প্রথমে প্রচন্ড বাধার সম্মুখীন হয়েছে। খ্যাপার মত বললেন প্রফেসর। অসাধারণ সত্য আপনাদের সামনে তুলে ধরা হলেও সত্য মিথ্যা বিচার করার মত সত্তা আপনাদের নেই। যে মানুষ নিজের জীবন বিপন্ন করে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন আবিষ্কার করলেন, আপনারা কেবল তার দিকে কাদা ছুঁড়তেই জানেন। গ্যালিলিও, ডারউইন, আমি…

এবারে প্রচন্ড হর্ষধ্বনি হেতু থামতে বাধ্য হলেন প্রফেসর। এমনই বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হলো যে কয়েকজন মহিলা বাধ্য হয়ে উঠে চলে গেলেন। বড়রাও যোগ দিল ছাত্রদের সাথে। সাদা দাড়িওয়ালা একজন উঠে দাঁড়িয়ে মুঠি ঝাকালেন প্রফেসরের দিকে, শ্রোতাগণ উত্তেজনায় একেবারে ফুটন্ত পানির মত টগবগ করতে লাগল।

এক পা সামনে এগিয়ে দুহাত তুলে দাঁড়ালেন প্রফেসর। তার ভঙ্গিতে এমন একটা ব্যক্তিত্ব রয়েছে যে গোলমাল কমে এল। প্রফেসরের কোন একটা বিশেষ বক্তব্য আছে বলেই মনে হলো। সেটা কি শোনার জন্যে চুপ করল সবাই।

আপনাদের বেশিক্ষণ আটকে রাখব না আমি। একদল বোকা ছেলে আর বুড়ো যত চিৎকারই করুক না কেন তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি বিজ্ঞানের একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছি। অথচ আপনারা মানতে রাজি নন—বেশ ঠিক আছে, আপনাদের মধ্য থেকেই একজন বা দুজন লোক দিন, তারা আপনাদের পক্ষ থেকে আমার বিবৃতির সততা নির্ধারণ করে আসবেন?

তুলনামূলক শরীর তত্ত্বের প্রবীণ অধ্যাপক মিস্টার সামারলী দর্শকমন্ডলীর মাঝ থেকে উঠে দাঁড়ালেন। লম্বা, ছিপছিপে, আর কঠিন প্রকৃতির মানুষ।

আপনি কি দুবছর আগে আমাজনের ধারে আপনার আবিষ্কারের পরিপ্রেক্ষিতেই বলছেন একথা? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইলেন সামারলী।

হ্যা। জবাব দিলেন চ্যালেঞ্জার।

তা কেমন করে হয়? তাহলে আপনি বলতে চান যে ওয়ালেস আর বেটস্ এর মত সুবিখ্যাত আর অভিজ্ঞ আবিষ্কারকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে এত বিশাল একটা জিনিস?

আপনি ভুল করে আমাজনকে টেমস নদী মনে করছেন। আসলে কিন্তু ওই বিশাল এলাকায় যে কোন অভিজ্ঞ আবিষ্কারকেরই বহু কিছু অজানা থেকে যেতে পারে।

ধারালো তিক্ত হাসি হেসে সামারলী বললেন, টেমস্ আর আমাজনের তফাত আমার ভাল করেই জানা আছে। কিন্তু ঠিক কোথায় গেলে এসব প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর দেখা পাওয়া যাবে, সেই অবস্থানটা আমাদের বলবেন কি?

অবস্থান গোপন রাখার যথেষ্ট কারণ আছে আমার। তবে এ বিষয়ে একটা কমিটি গঠন করা হলে সময় মত সেটা জানাতে আমার আপত্তি নেই। আপনি কি সেই কমিটির পক্ষ থেকে আমার বক্তব্যের সততা পরীক্ষা করে দেখতে রাজি আছেন?

সামারলী বললেন, হ্যাঁ, আমি রাজি আছি। সবাই চিৎকার করে উল্লাস প্রকাশ করল।

আমি কথা দিচ্ছি কেমন করে ওখানে পৌছতে হবে তা আপনাকে নিশ্চয়ই জানাব। তবে মিস্টার সামারলী যখন আমার কথার সততা পরীক্ষা করতে যাচ্ছেন তখন আমি তার সাথে আরও একজন সাক্ষী থাকা উচিত বলে মনে করি। দর্শকমন্ডলীর মাঝে এমন কোন স্বেচ্ছাসেবক আছেন কি?

এভাবেই মানুষের জীবনের মহাসঙ্কট ঘনিয়ে আসে। গ্লাডিস না এই রকম একটা কিছুর কথাই বলছিল? সে নিশ্চয়ই চাইতো যে আমি যাই। লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলাম। কথা তৈরি নেই তবু বলতে শুরু করলাম। টারপ হেনরি আমার কোটের ঝুল ধরে টানতে লাগল। ফিসফিস করে বলল, বসে পড়ো, ম্যালোন—বোকামি কোরো না।

আমার কয়েক সারি সামনের আরও একজন উঠে দাঁড়ালেন। ছিপছিপে লম্বা গড়ন-লালচে চুল। ওঁকে পাত্তা দিলাম না বলে আমার দিকে রক্ত চোখে চেয়ে রইলেন। আমি চিৎকার করে বললাম, আমি যাব, মাননীয় সভাপতি সাহেব।

দর্শকের মধ্য থেকে রব উঠল, নাম কি?

এডওয়ার্ড ডুন ম্যালোন। আমি দৈনিক গেজেটের লোক, সুতরাং নিঃসন্দেহে আমি নিরপেক্ষ সাক্ষী হব।

আপনার নাম, জনাব? সভাপতি আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে জিজ্ঞেস করলেন।

আমি লর্ড জন রক্সটন। আমাজনে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। আর এই বনের অভিযানে আমার দক্ষতাও আছে।

শিকারী, খ্যাতনামা পর্যটক আর খেলোয়াড় বলে আপনার নাম জগৎ বিখ্যাত, বললেন সভাপতি। অন্যদিকে আবার প্রেসের কেউ এই অভিযানে থাকলেও ভালই হয়।

আমি প্রস্তাব দিচ্ছি এঁদের দুজনকেই এই সভার পক্ষ থেকে প্রফেসর সামারলীর সাথে যেতে দেয়া হোক। তারা আমার বক্তব্যের সততা সম্বন্ধে রিপোর্ট পেশ করবেন। সভা শেষ হলো; চ্যালেঞ্জারের প্রস্তাব মেনে নেয়া হলো।

এভাবেই আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। জনতার স্রোতে দরজার দিকে ভেসে চললাম আমি। রিজেন্ট স্ট্রীট ধরে এগিয়ে চললাম—পায়ে হেঁটে। হঠাৎ কনুই-এ কার হাত লাগতে ফিরে তাকালাম। কৌতুকপূর্ণ, সুচতুর দুটো চোখের সাথে চোখাচোখি হলো আমার; একহারা দীর্ঘ ব্যক্তিটি লর্ড জন রক্সটন।

আমরা পরস্পরের সঙ্গী হতে যাচ্ছি, তাই না, মিস্টার ম্যালোন? কাছেই আমার বাসা, আপনার সাথে একটু আলাপ করতে চাই-দয়া করে যদি আধঘণ্টার জন্যে আসেন, বড় খুশি হব।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত