হারানো পৃথিবী: ০২. বুড়ো ম্যাকারডলকে আমার বেশ ভাল লাগে

হারানো পৃথিবী: ০২. বুড়ো ম্যাকারডলকে আমার বেশ ভাল লাগে

০২. বুড়ো ম্যাকারডলকে আমার বেশ ভাল লাগে

বুড়ো ম্যাকারডলকে আমার বেশ ভাল লাগে। আমাদের গেজেট পত্রিকার বার্তা সম্পাদক। মাথায় লাল চুল, সামনের দিকে চুল নেই বললেই চলে; ফলে কপালটা বিরাট দেখায়।

ঘরে ঢুকতেই চশমাটা ঠেলে টাকের উপরে তুলে দিলেন তিনি।

এই যে, মিস্টার ম্যালোন, শুনছি ভাল রিপোর্ট করছেন আপনি? কথায় স্কচ টানের সাথে দরাজ গলায় বললেন তিনি।

আমি তাকে ধন্যবাদ জানালাম।

খনি বিস্ফোরণের খবরটা খুব ভাল হয়েছে। সাদার্কের আগুনের রিপোর্টও চমৎকার। লেখার হাত আছে আপনার। তা আমার কাছে কি মনে করে?

একটা অনুগ্রহ চাইতে এসেছি।

একটু সচকিত হয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন মিস্টার ম্যাকারডল।

কি করতে পারি বলুন, পারলে নিশ্চয়ই চেষ্টা করব।

আমাকে কাগজের তরফ থেকে কোন একটা মিশনে পাঠাবেন? প্রাণ দিয়ে কাজ করব আমি, ভাল রিপোর্ট দেব।

কি ধরনের মিশনের কথা বলছেন, মিস্টার ম্যালোন?

যে কোন ধরনের, স্যার-তবে কাজে অ্যাডভেঞ্চার আর বিপদ আপদ থাকতেই হবে। যত বেশি বিপদের ঝুঁকি হবে ততই ভাল।

নিজের জানটা খোয়াবার জন্যে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছেন মনে হচ্ছে?

ব্যক্তিগত ব্যাপার, স্যার, আমাকে যোগ্যতা প্রমাণ করতেই হবে।

হুম! কিছুক্ষণ চুপ করে চিন্তা করলেন ম্যাকারডল। তারপর বললেন, একটা কাজ দেয়া যেতে পারে। আধুনিক মাঞ্চুসেন আছেন একজন, তাকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করতে হবে।

যে কোন কাজ, যে কোন জায়গায় যেতে বলুন, আমার আপত্তি নেই।

আরও কিছুক্ষণ ভেবে তিনি বললেন, কিন্তু বন্ধুত্ব তো দূরের কথা তার সাথে কথা বলাই কঠিন। তবে বলা যায় না, মানুষকে সহজেই আপন করে নেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে আপনার।

কে সেই লোক?

এনমোর পার্কের প্রফেসর চ্যালেঞ্জার।

নাম শুনে একটু চমকে উঠলাম আমি।

চ্যালেঞ্জার! বিখ্যাত প্রাণীতত্ত্ববিদ। এই প্রফেসর চ্যালেঞ্জারই তো ডেইলী টেলিগ্রাফের রানডেলের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন?

বার্তা সম্পাদক একটু বাঁকা হাসি হাসলেন।

কি আপত্তি আছে? আপনিই না বললেন যে, যে কাজে বিপদ আপদ থাকে তেমন কাজই আপনার প্রয়োজন?

হ্যাঁ, কাজ কাজই, স্যার, জবাব দিলাম আমি।

ঠিক বলেছেন। সবার সাথেই যে একই ব্যবহার করবেন প্রফেসর তা বলা যায় না। প্রফেসর সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না, কেবল নামটা মনে আছে। ব্লানডেলকে মারার পর কাগজে ফলাও করে লিখেছিল, তাই।

আগে থেকেই চ্যালেঞ্জারের প্রতি নজর আমার। ড্রয়ার হাতড়ে একটা কাগজ বের করলেন ম্যাকারুডল। এতে বেশ কিছু তথ্য আছে, বলে কাগজটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি আমার দিকে।

কাগজটাতে লেখাঃ

জর্জ এডওয়ার্ড চ্যালেঞ্জার। জন্মঃ লারগস-১৮৬৩- শিক্ষা লাভঃ লারস একাডেমী। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সহকারী: ১৮৯২-সহকারী রক্ষী, অ্যানথ্রাপলজি বিভাগ: ১৮৯৩-ওই বছরই তিক্ত পত্রালাপের পর কাজ ছেড়ে দেন। প্রাণীতত্ত্বের উপর গবেষণার জন্যে ক্রেস্টন মেডাল লাভ। আন্তর্জাতিক সদস্য… (বিশ্বের কোন নামই বাদ নেই।)

প্রকাশনা: মঙ্গোলীয় মাথার খুলির উপর মন্তব্য প্রদান; মেরুদন্ডী প্রাণীর ক্রমবিকাশের খসড়া; ইত্যাদি আরও অনেক কিছুর সাথে, ওয়াইম্যানিজমের ভ্রমাত্মক ধারণার উপর তার লেখা প্রবন্ধ ভিয়েনায় জীবতত্ত্ব কংগ্রেসে তুমুল বাকবিতন্ডার সৃষ্টি করেছিল। শখ: হাঁটা, পাহাড়ে চড়া। ঠিকানা: এনমোর পার্ক, কেনাসংটন, পশ্চিম।

কাগজটা নিয়ে যান, আজ আপনার জন্যে বিশেষ কোন কাজ নেই।

পকেটে রেখে দিলাম কাগজটা। কিন্তু, সার, কি জন্যে তার সাক্ষাৎকার নেব তা তো বললেন না? কি করেছেন প্রফেসর?

দুই বছর আগে একক অভিযানে তিনি গিয়েছিলেন দক্ষিণ আমেরিকায়। গত বছর ফিরে ওখানকার কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। কেউ একজন তার কথাকে মিথ্যা বানোয়াট বলে অভিহিত করে। এখন একেবারে চুপ মেরে গেছেন। কিছু নষ্ট, ঝাপসা ছবিও ছিল তার কাছে। দক্ষিণ আমেরিকাতে গিয়েছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিছু একটা আশ্চর্য ঘটনা, হয় সত্যি সত্যি দেখে এসেছেন, নয়তো তিনি একজন সেরা মিথ্যুক–পরেরটা ঠিক হবার সম্ভাবনাই বেশি। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলেই খেপে যান। কথা শেষ করলেন ম্যাকারডল।

স্যাভেজ ক্লাবের দিকে এগুলাম আমি। ক্লাবে না ঢুকে অ্যাডেলফি টিরেসের রেলিঙে ভর দিয়ে নদীর বাদামী তেলতেলে পানির দিকে চেয়ে রইলাম। মুক্ত বাতাসে আমার মাথাটা খোলে ভাল। পকেট থেকে কাগজটা বের করে লাইট পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে পুরোটা আবার পড়লাম। স্পষ্টই বোঝা যায় বিজ্ঞানের বিষয়ে অত্যন্ত উৎসাহী ভদ্রলোক। প্রেসের লোক এই পরিচয়ে যে কোনমতেই প্রফেসরের সাথে দেখা করা সম্ভব নয় তা পরিষ্কার।

ক্লাবে ঢুকলাম। এগারোটা মাত্র বাজে। বড় ঘরটা এরই মধ্যে বেশ ভরে উঠেছে। আগুনের ধারে হাতলওয়ালা চেয়ারে বসা লম্বা, শুকনো, তীক্ষ্ণ চেহারার লোকটার দিকে নজর পড়ল আমার। চেয়ার টেনে পাশে বসতেই ঘুরে তাকাল সে। এই মুহূর্তে ওকেই প্রয়োজন ছিল আমার—টারপ হেনরি, নেচার পত্রিকার লোক। বন্ধু-বান্ধবেরা, সবাই জানে টারপ ভাল মানুষ। আমি টারপের কাছে সরাসরি আমার কথা পাড়লাম।

প্রফেসর চ্যালেঞ্জার সম্বন্ধে কি জানো তুমি?

চ্যালেঞ্জার! অশ্রদ্ধায় ভুরু কুঁচকে গেল তার। এই চ্যালেঞ্জার লোকটাই দক্ষিণ আমেরিকা সম্পর্কে আজগুবী গল্প ফেঁদেছিলেন।

কি রকম?

উঁচু শ্রেণীর অর্থহীন গল্প—অদ্ভুত কি সব জন্তু জানোয়ার নাকি আবিষ্কার করেছেন তিনি ওখানে। একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন রয়টারকে। এমন বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল সেখানে, যে বোঝা গেল কিছুই কাজ হবে না। দুই একজন গুরুত্ব দিতে চাইলেও চ্যালেঞ্জার অচিরেই তাদেরও বিশ্বাসের ভিত্তি নেড়ে দেন।

কিভাবে?

অসহ্য রূঢ় ব্যবহার তার। জীববিজ্ঞানের বৃদ্ধ পন্ডিত ওয়াড়লে ছিলেন ওখানে। তিনি একটা নোট পাঠিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জারের কাছে—জীববিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট প্রফেসর চ্যালেঞ্জারকে অকৃত্রিম শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছেন। দয়া করে ইনস্টিটিউটের আগামী সভায় উপস্থিত থাকলে প্রেসিডেন্ট ব্যক্তিগতভাবে অনুগৃহীত বোধ করবেন।

এর যা উত্তর দিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জার তা উচ্চারণযোগ্য নয়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, কেটেছেটে ভদ্র রূপ দিলে জবাবটা এরকম দাঁড়ায়ঃ প্রফেসর চ্যালেঞ্জার তার পাল্টা শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট শয়তানের শরণাপন্ন হলেই চ্যালেঞ্জার সেটাকে ব্যক্তিগত অনুগ্রহ বলে মনে করবেন।-বোঝো ঠেলা।

ম্পৰ্দ্ধা!

হ্যাঁ, সম্ভবত ওয়াডলেও একই মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর সে কি বিলাপ আমার পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতায়— এইভাবে শুরু।

আর কিছু?

ঝগড়াটে স্বভাব লোকটার। ভিয়েনায় গিয়ে ওয়াইসম্যান এবং জীবনের বিকাশ বিষয় নিয়ে ভয়ানক ঝগড়া করেছেন চ্যালেঞ্জার।

বিষয়টা জানা আছে তোমার?

না, নেই, তবে ভিয়েনা আলোচনার একটা ইংরেজি অনুবাদ ফাইল করা আছে আমাদের অফিসে। দেখবে? এখনই দেখাতে পারি।

এমনই কিছু একটা খুঁজছিলাম আমি। তার

সাক্ষাৎকার নিতে হবে আমার। তোমার সময় থাকলে চলো এখনই যাই।

বিরাট মোটা বাঁধানো নথিপত্র নিয়ে বসলাম আমি পত্রিকা অফিসে। ওয়াইসম্যান বনাম ডারউইন শীর্ষক প্রবন্ধটায় চোখ বুলাচ্ছি। বহু চেষ্টা করলাম কিন্তু হাতামাথা কিছুই বুঝলাম না। তবু যেটুকু বুঝলাম তার ভিত্তিতেই একটা চিঠি লিখে ফেললাম, চিঠিটা জোরে জোরে পড়ে শোনালাম টারপকে।

জনাব প্রফেসর চ্যালেঞ্জার,

গাছ-গাছড়া এবং প্রাণী সম্বন্ধে পড়াশুনা করতে গিয়ে আমি সব সময়েই আপনার মতামত অতি আগ্রহের সঙ্গে পড়ে থাকি। ডারউইন আর ওয়াইসম্যানের মতবিরোধ সম্বন্ধে আপনার ভিয়েনার বক্তব্য আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে।

আপনার বক্তৃতাটা সম্প্রতি আবার পড়লাম। কিন্তু কয়েকটা জায়গা আমার কাছে ঠিক পরিষ্কার হয়নি।

আগামী পরশু আপনার সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি পেলে বক্তব্যগুলো আরও পরিষ্কার ভাবে বুঝে নিতে পারব এবং নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব।

বিনীত ইতি,

আপনার গুণগ্রাহী,

এডওয়ার্ড ডি ম্যালোন।

কেমন হয়েছে? গর্বের সাথে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

ভালই–কিন্তু তোমার মতলবটা কি?

কোনক্রমে দেখা করা। একবার তার ঘরে ঢুকতে পারলে একটা উপায় বেরিয়ে যাবেই। এমন কি নিজের ভন্ডামি সরাসরি স্বীকারও করে ফেলতে পারি।

আমার মতে চ্যালেঞ্জার যদি সাক্ষাৎ দিতে রাজি হয়ে চিঠির জবাব দেন, তাহলে তোমার উচিত হবে আমেরিকান ফুটবলের পোশাক পরে তৈরি হয়ে যাওয়া।

বুধবার সকালেই চিঠি এল। চিঠির বক্তব্যঃ

জনাব,

আপনার চিঠিতে জানলাম যে আপনি আমার মত সমর্থন করেন। আপনার জেনে রাখা ভাল যে আপনার বা অন্য কারও সমর্থনে কি অসমর্থনে আমার কিচ্ছু এসে যায় না।

যাই হোক, আপনি লিখেছেন আমার লেকচারের কিছু কিছু অংশ আপনার কাছে পরিষ্কার নয়। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? আমার ধারণা একজন সাধারণ মানুষও আমার অকাট্য যুক্তি স্পষ্ট বুঝতে পারবে।

চিঠিটা পড়ে আমার ধারণা হয়েছে যে বুদ্ধি একটু কম হলেও আপনি সত্যিই শিখতে আগ্রহী। তাই বুধবার সকাল এগারোটার সময় আপনাকে আমার সাথে দেখা করার অনুমতি দিলাম। আমার চিঠিটা সাথে এনে গেটে অস্টিনকে দেখাবেন। বাধ্য হয়েই এই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। সাংবাদিক বলে পরিচয়দানকারী কিছু সংখ্যক অসৎ লোকের হাত থেকে বাঁচার জন্যেই এই সতর্কতা।

জর্জ এডওয়ার্ড চ্যালেঞ্জার।

টারপ্ হেনরিকে চিঠিটা পড়ে শোনালাম। শুনে সে বলল, বাজারে একটা নতুন ওষুধ বেরিয়েছে, কিউটিকুরা না কি যেন নাম—শুনেছি আর্নিকার চেয়ে ভাল কাজ করে। কি বিচিত্র রসবোধ।

সাড়ে দশটায় ট্যাক্সি নিয়ে সময় মতই পৌঁছে গেলাম। বাড়িটার সামনে বারান্দায় বড় বড় থাম। বিরাট বাড়ি-জানালার ভারি পর্দা দেখে সহজেই অনুমান করা যায় বিত্তবান লোক এই প্রফেসর। বেল বাজাতেই দরজা খুলে অতিশয় শুকনো একটা লোক বেরিয়ে এল। বয়স বোঝা কঠিন। পরে জেনেছি সে প্রফেসরেরই ড্রাইভার। বাটলার ঘন ঘন পালিয়ে যায় বলে তাকে বাটলারের কাজও চালিয়ে নিতে হয়। হালকা নীল চোখে আমাকে জরিপ করে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, প্রফেসর কি আপনার সাথে দেখা করবেন বলেছেন?

হ্যা, এগারোটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট।

চিঠি আছে?

খামটা বের করে দিলাম। ওটা একটু দেখে নিয়ে ফিরিয়ে দিল সে।

ঠিক আছে। মনে হলো নোকটা কম কথা বলে। ওর পিছন পিছন এগুলাম। হঠাৎ একজন ছোটখাট আকারের মহিলার কাছ থেকে বাধা পেলাম। কালো চোখ, উজ্জ্বল প্রাণবন্ত মহিলা-ইংরেজ মেয়ের থেকে ফরাসী মেয়ের সাথেই যেন মিল বেশি।

এক মিনিট, একটু এদিকে আসুন, স্যার, বললেন মহিলা, অস্টিনকে অপেক্ষা করতে বলে, আবার আমার দিকে তাকালেন।

আমার স্বামীর সাথে আগে কখনও দেখা হয়েছে আপনার?

না, ম্যাডাম, সে সৌভাগ্য আমার হয়নি।

তাহলে স্বামীর পক্ষ থেকে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। খুবই বদরাগী মানুষ, সাবধান!

অনেক ধন্যবাদ, ম্যাডাম।

খেপে উঠতে দেখলেই চট করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবেন। খবরদার তর্ক করতে যাবেন না। কয়েকজনই তর্ক করতে গিয়ে আহত হয়েছেন। শেষে লোক জানাজানি হয়—অসম্মান। তা কি বিষয়ে আলাপ করবেন, দক্ষিণ আমেরিকা নয় তো?

ভদ্র মহিলার কাছে মিথ্যা বলতে পারলাম না। সর্বনাশ—সবচেয়ে বিপদজনক বিষয় ওটা। একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না–আমিও বিশ্বাস করি না। কিন্তু সেটা আবার তাকে বলতে যাবেন না যেন—তাহলেই খেপে যাবেন। তেমন কিছু যদি ঘটেই যায় বেলটা বাজিয়ে আমি না যাওয়া পর্যন্ত কোনমতে ঠেকিয়ে রাখবেন। খুব খেপে গেলেও সাধারণত আমি শান্ত করতে পারি। এই উৎসাহব্যঞ্জক কথাগুলো শুনিয়ে অস্টিনের হাতে আমাকে সঁপে দিলেন তিনি। করিডোরের শেষ মাথা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিল অস্টিন। ভিতর থেকে ষাঁড়ের ডাকের মত একটা আওয়াজ এল। প্রথম বারের মত প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের মুখোমুখি হলাম আমি।

চওড়া টেবিলের পেছনে একটা ঘূর্ণি চেয়ারে বসে আছেন তিনি। টেবিলের উপর বই, ম্যাপ আর নকশা ছড়ানো। আমি ঢুকতেই চেয়ার ঘুরিয়ে আমার দিকে ফিরলেন। তার হাবভাব আর আড়ম্বরে মুখ শুকিয়ে গেল আমার। আশ্চর্য কিছু দেখব বলেই আশা করেছিলাম—কিন্তু তিনি যে এমন পরাক্রান্ত ব্যক্তিত্ব তা মোটেও ধারণা করিনি। তাঁর বিশাল আকৃতিই যে কোন মানুষকে অবাক করার জন্যে যথেষ্ট। মানুষের কাঁধে এত বড় মাথা আর কোনদিন দেখিনি আমি। তার হ্যাটটা যদি আমি পরতে চেষ্টা করি তবে মাথা গলে কাঁধে এসে ঠেকবে। মুখটা বর্ণোজ্জ্বল-কুচকুচে কালো দাড়ি ঢেউ খেলে খেলে বুক পর্যন্ত নেমেছে। বিশাল চওড়া কাঁধ আর বুক দেখা যাচ্ছে টেবিলের উপরে। আর যা দেখা যাচ্ছে তা হলো কালো লোমে ভর্তি তার প্রশস্ত দুটো হাত।

তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন, বলুন, কি দরকার আপনার?

বুঝলাম, আরও কিছুক্ষণ আমাকে ছদ্ম পরিচয় বজায় রাখতে হবে-নইলে সাক্ষাৎকার এখানেই শেষ।

আপনি আমার সাথে দেখা করতে রাজি হওয়ায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি, স্যার। বলে পকেট থেকে খামটা বের করে দেখালাম আমি।

ওহ, তুমিই তাহলে সেই ছোকরা যে সহজ সরল ইংরেজি বুঝতে পারে না? সরাসরি তুমিতে নেমে এলেন প্রফেসর। তবে এটা ঠিক যে, বোঝোনি জিনিসটা স্বীকার করার মত সৎসাহস তোমার আছে। অন্তত ভিয়েনার ওই শুয়োরের দলের ঘোতঘোনির চেয়ে ইংলিশ মেষ শাবক কম অপ্রীতিকর। বলে এমন ভাবে তাকালেন তিনি যেন আমিই সেই ইংলিশ জন্তুটির প্রতিনিধি।

ওরা সত্যিই অত্যন্ত নিন্দনীয় ব্যবহার করেছে আপনার সাথে। বললাম আমি।

আমার যুদ্ধ আমি নিজেই লড়তে জানি, কারও সহানুভূতির প্রয়োজন নেই। এবার কাজের কথায় আসা যাক, কেননা বৃথা নষ্ট করার মত অঢেল সময় আমার নেই। কোন কোন জায়গা স্পষ্ট বোঝোনি তুমি?

এমন পরিষ্কার তাঁর আচার ব্যবহার, যে এড়িয়ে যাওয়া সত্যি মুশকিল। কিন্তু আসল কথা পাড়ার কোন একটা রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না আমি। আরও কিছুটা সময় দরকার।

বলো বলো—সময় নষ্ট কোরো না, অসহিষ্ণুভাবে বলে উঠলেন চ্যালেঞ্জার।

আমি একজন ছাত্র মাত্র–শিখতে চাই। ওয়াইসম্যান সম্বন্ধে আপনার বিচারটা কি একটু বেশি কঠিন হয়নি? আজ পর্যন্ত যা সাক্ষ্য আর প্রমাণ পাওয়া গেছে তা কি তার স্বপক্ষেই যায় না?

কিসের সাক্ষ্য প্রমাণ? একটু উষ্ম প্রকাশ পেল তার কণ্ঠে।

অবশ্য এটা ঠিক যে তেমন সঠিক প্রমাণ কিছু পাওয়া যায়নি-আমি আধুনিক চিন্তাধারার সূত্র ধরেই বলেছি কথাটা।

আগ্রহের সাথে সামনে ঝুঁকে এলেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার।

আশা করি তুমি জানো যে ক্রেনিয়াল ইনডেক্স বা মাথার খুলির দৈর্ঘ্যের তুলনায় প্রস্থের শতকরা মাপ একটা ধ্রুব গুণণীয়ক?

অবশ্যই, বললাম আমি।

এটাও নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে বস্তুর মূল কারণের সূত্র এখনও সাবজুডিস?

নিঃসন্দেহে।

আর জীবাণু প্লাসমা যে পার্থেনোজেনেটিক ডিম থেকে ভিন্ন সেটা স্বীকার করবে তো?

নিশ্চয়ই! সোৎসাহে বললাম আমি।

কিন্তু এসব থেকে কি প্রমাণিত হয়? দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন চ্যালেঞ্জার।

সত্যিই তো, বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলাম, কি প্রমাণিত হয় এসব থেকে? পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি।

আমি বলব?

বলুন, আমার জ্ঞান বাড়বে।

এতে প্রমাণিত হয়, হঠাৎ খ্যাপার মত গর্জন করে উঠলেন চ্যালেঞ্জার, যে লন্ডনের একজন সেরা জোচ্চোর তুমি, একজন ঘৃণ্য সাংবাদিক; বিজ্ঞানের কচুও বোঝো না।

বলেই লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন চ্যালেঞ্জার। রাগে তাঁর চোখ থেকে যেন আগুন ঝরছে। সেই সন্ত্রস্ত মুহূর্তেও অবাক হয়ে লক্ষ করলাম যে প্রফেসর চ্যালেঞ্জার আকারে বেশ ছোট। মাত্র আমার কাঁধ সমান হবেন।

অর্থহীন বৈজ্ঞানিক বুলি, চিৎকার করে উঠলেন তিনি। হ্যা, এতক্ষণ তাই আউড়েছি আমি। তুমি কি মনে করেছিলে ওইটুকু মাথা নিয়ে বুদ্ধিতে টেক্কা দেবে আমাকে? আগেই সাবধান করে দিয়েছিলাম আমি, তবু তুমি এসেছ। এবার তৈরি হও! বলেই হুঙ্কার ছাড়লেন।

আস্তে আস্তে পিছিয়ে দরজা খুলতে খুলতে বললাম, দেখুন, স্যার, আপনি আমাকে ভৎসনা করতে পারেন করেছেনও। কিন্তু সবকিছুরই একটা সীমা আছে—মারলে ভাল হবে না।

তাই নাকি? এগিয়ে আসতে আসতে ব্যঙ্গ ভরে বললেন প্রফেসর। তোমার মত ঘৃণ্য লোক কয়েকজনকেই আমি পিটিয়ে বের করেছি এই বাড়ি থেকে। মাথা পিছু গড়ে তিন পাউন্ড পনেরো শিলিং খরচ হয়েছে আমার।

জোর আমার গায়েও কিছু কম নেই। আমিই প্রথম অন্যায় করেছি তা ঠিক, কিন্তু এত কটু কথা আর গালাগালি শুনে আমার রক্তও গরম হতে শুরু করল। বললাম, ভাল হবে না কিন্তু, প্রফেসর গায়ে হাত তুললে আমি সহ্য করব না।

ওহ? তার কালো গোঁফটা উপরে উঠল, দাঁতের একটু সাদা অংশ দেখা গেল, সহ্য করবে না তুমি-না?

বোকামি করবেন না, প্রফেসর, চিৎকার করে বললাম আমি। একশো পাঁচ সের ওজন আমার। প্রত্যেক শনিবারে লন্ডন আইরিশ দলে রাগবি খেলি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন…

ঠিক এই সময়ে আমার উপর বিদ্যুৎ বেগে ঝাপিয়ে পড়লেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। কপাল ভাল, দরজাটা আগেই খুলে রেখেছিলাম—বন্ধ থাকলে দরজা ভেঙে নিয়ে পড়তাম আমরা। প্রফেসরের দাড়ি আমার মুখ চোখ প্রায় সবই ঢেকে ফেলেছে। দুজনেরই হাত-পা শক্ত হয়ে পেঁচিয়ে গেছে। ডিগবাজি খেতে খেতে চললাম দুজন। হলঘর দিয়ে বাইরে বেরুবার পথে হলঘরের একটা চেয়ারও চলল আমাদের সাথে। মনিবকে আগেও অনুরূপ অবস্থায় দেখেছে অস্টিন। আমরা সদর দরজার কাছাকাছি পৌঁছতেই নীরবে দরজাটা খুলে দিল। আর সিঁড়ি দিয়ে চেয়ার সহ উল্টে নিচে পড়লাম আমরা। চেয়ারটা ভেঙে খান খান হয়ে গেল; ছাড়াছাড়ি হয়ে দুজনেই গড়িয়ে গিয়ে পড়লাম ড্রেনে। এক লাফে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর হাঁপানি রোগীর মত হাঁপাতে হাঁপাতে মুঠো করা হাত নাড়তে লাগলেন। বললেন, শিক্ষা হয়েছে নাকি আরও দেব দুচার ঘা?

বেটা গুন্ডা কোথাকার! বলে আবার মোকাবেলার জন্যে তৈরি হলাম।

মারপিট করার জন্যে প্রফেসর তড়পাচ্ছেন। আর এক দফা লাগার আগেই অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে রেহাই পেলাম। একজন পুলিশ এসে দাঁড়ালো আমাদের পাশে–হাতে নোটবই আর পেনসিল।

কি হচ্ছে এখানে? লজ্জা থাকা উচিত আপনাদের, বললো পুলিশ অফিসার। তারপর আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো, বলুন, ঘটনা কি? নোট করার জন্যে খাতা পেনসিল তৈরি তার।

আমাকে আক্রমণ করেছিল এই লোকটি, বললাম আমি।

আপনি আক্রমণ করেছিলেন ওঁকে? পুলিশ অফিসার জানতে চাইলো।

জবাব না দিয়ে কেবল জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলেন প্রফেসর।

এ নিয়ে কবার হল, সজোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন অফিসার। গত মাসে একই কারণে কোর্টে যেতে হয়েছিল আপনাকে। দেখুন তো এই ভদ্রলোকের চোখ কালো করে দিয়েছেন আপনি। অভিযোগ আনছেন তো আপনি? আমাকে জিজ্ঞেস করলো সে।

না, কোন অভিযোগ নেই আমার, আমি নরম হলাম।

তার মানে? চোখ কপালে তুললো পুলিশ অফিসার।

দোষ আমারই—আমিই অনাহুত ভাবে অনধিকার প্রবেশ করেছি। আমাকে উনি আগেই সাবধান করেছিলেন, সত্যি কথাই বললাম আমি।

শব্দ করে নোট বইটা বন্ধ করলো পুলিশ অফিসার। এসব ঘটনা যত কম ঘটে ততই মঙ্গল। যাও, যাও ভিড় কোরো না, যারা জটলা করেছিল তাদের খেদিয়ে নিয়ে গেলো পুলিশ অফিসার। প্রফেসর চাইলেন আমার দিকে, তার চোখে দুষ্টুমির ভাব।

ভিতরে এসো, ধমকে বললেন তিনি। তোমার সাথে বোঝাপড়া এখনও শেষ হয়নি আমার।

প্রফেসরের পিছু পিছু আবার ভিতরে গেলাম। আমরা ঢুকতেই দরজাটা বন্ধ করে দিল অস্টিন।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত