হারানো পৃথিবী: ০১. মেয়েটির বাবা মিস্টার হাঙ্গারটন

হারানো পৃথিবী: ০১. মেয়েটির বাবা মিস্টার হাঙ্গারটন

০১. মেয়েটির বাবা মিস্টার হাঙ্গারটন
খ্যাপা বিজ্ঞানী প্রফেসর চ্যালেঞ্জার দাবি করেছেন, আদিম পৃথিবীর বিশালাকার জীবজন্তু— দানবাকৃতি ডাইনোসর, স্টেগোসরাস, ইগুয়ানেডেন, দৈত্যপাখি টেরোডাকটিস নাকি আছে আজও, জ্যান্ত! পাঠক, যাবেন নাকি রোমাঞ্চকর অভিযানে?

০১.

মেয়েটির বাবা মিস্টার হাঙ্গারটন। নিতান্ত ভালমানুষ, তবে তাঁর স্বাভাবিক বুদ্ধির কিছুটা অভাব আছে। নিজের জগৎ আর পছন্দের বিষয়টি ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না। গ্ল্যাডিসের কাছ থেকে আমাকে যদি কোনদিন সরে যেতে হয়, তার কারণ হবে মিস্টার হাঙ্গারটনের জামাতা হবার ভয়। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা, সপ্তাহে তিনদিন আমি যে চেস্টনাটস যাই সেটা তাঁর সাহচর্যের লোভে; বিশেষ করে সোনা রূপা দ্বৈত ধাতুর মুদ্রা ব্যবস্থা বিষয়ে তার মতামত জানার আগ্রহে।

আজ সন্ধ্যায় একঘণ্টার উপরে একঘেয়ে বক্তৃতা শুনতে হয়েছে আমাকেঃ কেমন করে ময়লা টাকা ভাল টাকাকে বাজার থেকে তাড়িয়ে দেয়; রূপার প্রকৃত প্রতীক মান কি, ভারতবর্ষে টাকার মূল্যমান হ্রাস আর মুদ্রা বিনিময়ের সত্যিকার হার, ইত্যাদি। এসব বিষয়ে উনি একজন বিশেষজ্ঞ।

ধরো পৃথিবীর সব ধার দেনা একসাথে ফেরত চাওয়া হলো, আর কার্যকরও করা হলো—কি ঘটবে তাহলে? প্রশ্ন করলেন মিস্টার হাঙ্গারটন।

তাহলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমার স্বভাবজাত হালকা ভাবেই বললাম আমি। জবাবটা শুনে লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার হাঙ্গারটন। আমা হেন হালকা স্বভাবের লোকের সাথে কোন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা যায় না। কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি, মেসনিক সভায় যাবার জন্যে তৈরি হতে হবে।

এতক্ষণে আমি গ্ল্যাডিসকে একা পেলাম। চরম মুহূর্ত! সারাটা সন্ধ্যা আমার মনের অবস্থা ছিল একজন সৈনিকের মত। বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ করার জন্যে তৈরি। সংশয়ে দুলছে মন জয়, নাকি পরাজয় লেখা আছে ভাগ্যে?

বসে আছে ও-পিছনের লাল পর্দায় তার গর্বিত কোমল মুখের কাঠামোটা ফুটে উঠেছে। সত্যিই সুন্দর ও, কিন্তু যেন অনেক দূরের। বন্ধুত্ব আছে আমাদের বেশ গাঢ় বন্ধুত্ব। কিন্তু কোনদিনই ওর খুব কাছে আসতে পারিনি আমি। গেজেট পত্রিকার সহকর্মীদের সাথে যেমন সহজ সরল কামনাবিহীন সম্পর্ক-গ্ল্যাডিসের সাথেও তাই। মেয়েরা আমার সাথে বেশি দিলখোলা হোক বা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করুক এটা আমার কাম্য নয়। এতে পৌরুষের হানি হয়। যৌন চেতনার শুরুতেই ভীরু-নম্তরা আর অবিশ্বাস মানুষের সঙ্গী। উত্তরাধিকার সূত্রে পুরানো আমলের নৈতিকতাহীন যুগ থেকেই প্রেম আর বলাৎকার পাশাপাশি চলেছে। নত মাথা, চোরা চাউনি, কাঁপা কাঁপা গলা, অস্থিরতা এসবই হলো কামনার লক্ষণ—অসঙ্কোচ চাউনি বা স্পষ্টবাদিতা নয়। বয়স কম হলেও এটুকু জেনেছি আমি এরই মধ্যে। হয়তো এটাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।

নারীসুলভ সব গুণেরই অধিকারী গ্ল্যাডিস। নিন্দুকেরা ওকে একটু কঠিন আর আবেদনবিহীন বলে, কিন্তু সেটা নেহায়েত অন্যায়। প্রাচ্যের উজ্জ্বল তামা রঙের কোমল দেহ, ঘন কালো চুল, বড় বড় মায়াময় চোখ, টসটসে দুটো ঠোঁট। যে-কোন পুরুষের কামনা জাগানোর সব উপাদানই রয়েছে ওর। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ওর মধ্যে কামনা জাগানোর কৌশলটা আজও আমি আয়ত্ত করতে পারিনি। যাহোক, আজ একটা হেস্তনেস্ত করবই-পরিণাম যাই হোক না কেন। না হয় প্রত্যাখ্যান করবে, তার বেশি আর কি? ভাইবোনের সম্পর্ক রাখার থেকে ব্যর্থ প্রেমিক হওয়া ঢের ভাল।

নিজের চিন্তার মাঝেই ডুবে ছিলাম এতক্ষণ! অস্বস্তিকর নীরবতা ভাঙতে যাচ্ছি, এমন সময় বড় বড় চোখ দুটো তুলে সে চাইল আমার দিকে। অহঙ্কারী মাথাটা দুলিয়ে হাসিমুখে আমার দিকে চেয়ে বলল, তুমি মনে হচ্ছে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে যাচ্ছ, নেড? সেটা না করাই ভাল। এইতো বেশ আছি।

চেয়ারটা একটু কাছে টেনে নিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি করে জানলে আমি বিয়ের প্রস্তাব দিতে যাচ্ছি?

মেয়েরা সব সময়ই টের পায়। পৃথিবীর কোন মেয়েই অপ্রত্যাশিত বিয়ের প্রস্তাব পায়নি। কিন্তু দেখো তো, নেড, আমাদের বন্ধুত্ব কত সুন্দর আর কত মধুর। এটাকে নষ্ট করে দিও না। ভেবে দেখো, দুজন যুবক-যুবতীর এরকম সামনাসামনি বসে গল্প করাটা কত আনন্দের।

জানি না, গ্ল্যাডিস। সে রকম গল্প তো আমি—আমি স্টেশন মাস্টারের সাথে মুখোমুখি বসেও করতে পারি। কেন যে স্টেশন মাস্টারের কথা আমার হঠাৎ মনে এল তা আমি নিজেও জানি না। দুজনে একসাথে হেসে উঠলাম। ওতে আমি মোটেও সন্তুষ্ট নই। আমি চাই তোমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে—তোমার মাথা থাকবে আমার বুকে। ওহ, গ্ল্যাডিস, আমি চাই—

হঠাৎ উঠে দাঁড়াল গ্ল্যাডিস। বুঝেছে সে, হয়তো যা চাই তা আদায়ের চেষ্টা করব।

সব মাটি করে দিলে তুমি, নেড। সব কিছু এত সুন্দর, এত সহজ, স্বাভাবিক ছিল—এর মাঝে ওসব টেনে এনে পরিবেশটাই নষ্ট করে দিলে। নিজেকে সংযত রাখতে পারো না কেন?

এটা আমি আবিষ্কার করিনি, ওকালতির চেষ্টা করলাম। এটা খুব স্বাভাবিক, এটাই প্রেম।

দুপক্ষেরই প্রেম থাকলে হয়তো অন্য রকম হত, কিন্তু আমি তো অমন করে কিছু অনুভব করিনি।

কিন্তু, গ্ল্যাডিস, তোমার এই রূপ, এই কোমল হৃদয়—ভালবাসার জন্যেই তোমার সৃষ্টি! ভাল যে তোমাকে বাসতেই হবে।

অন্তর থেকে ভালবাসা না আসা পর্যন্ত অন্যজনকে অপেক্ষা করতে হয়।

কিন্তু আমাকে কেন ভালবাসতে পারো না তুমি? আমি কি দেখতে এতই খারাপ?

একটু নরম হলো গ্ল্যাডিস। একটা হাত সামনে বাড়াল সে-সামনে ঝুঁকে অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে আমার মাথাটা একটু পিছনে ঠেলে ধরল। আমার মুখটা ভাল করে দেখে সবজান্তার মত একটু হাসল।

না, তা নয়। তুমি আত্মাভিমানী ছেলে নও জানি। তবে বলতে দোষ নেই—কারণটা আরও গভীর।

আমার চরিত্র?

প্রবল ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল সে।

কি করে শোধরাতে পারি আমি?

বসো, একটু বিশদ ভাবে আলাপ করি ব্যাপারটা। তুমি না বসা পর্যন্ত কোন কথাই বলব না আমি।

আমার দিকে সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে দেখে সসঙ্কোচে বসল সে।

এখন বলো আমার কি দোষ?

আমি আর একজনকে ভালবাসি, জবাব দিল গ্ল্যাডিস।

এবার আমার চমকে উঠবার পালা।

না, নির্দিষ্ট কাউকে নয়, আমার মুখের ভাব দেখে হাসতে হাসতে বলল ও। একটা আদর্শের কথা বলছি আমি। যে মানুষের কথা বলছি, আজও তার দেখা পাইনি।

বলো তো সে কেমন-তোমার সেই মনের মানুষ?

দেখতে সে তোমার মতও হতে পারে।

খুবই খুশি হলাম তোমার কথায়। তাহলে সে ব্যক্তি এমন কি করতে পারে যা আমি পারি না? কি করতে হবে আমাকে বলে দাও, গ্ল্যাডিস। শুধু চা খেয়ে থাকতে হবে, নিরামিষভোজী হতে হবে, বৈমানিক, নাকি সুপারম্যান? জানলে একবার চেষ্টা করে দেখতাম তোমার মনের মানুষ হতে পারি কি না।

পেশার বৈচিত্র্য শুনে হেসে ফেলল গ্ল্যাডিস। প্রথমত, আমার মনে হয় না যে আমার মনের মানুষটি এমন কথা বলবে। সে হবে অনেক শক্ত আর সমর্থ। নিজেকে সে এভাবে একটা মেয়ের ইচ্ছার কাছে সঁপে দেবে না। তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হবে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বিন্দুমাত্র ভয় পাবে না। বড় বড় অনেক কাজ করতে হবে তাকে—সেই সাথে থাকবে তার নানান অভিজ্ঞতা। কোন ব্যক্তিসত্তাকে আমি ভালবাসব না, ভালবাসব তার গৌরবময় বিজয়কে। রিচার্ড বার্টনের কথাই ধরো, স্ত্রীর লেখা তার জীবনী পড়ে বোঝা যায় কত গভীর ছিল তার ভালবাসা। আর লেডী স্ট্যালী-স্বামীর জীবনী যে লিখেছেন, তার শেষ অধ্যায়টা পড়েছ তুমি? এই ধরনের মানুষকে নারীরা নিজেকে ছোট না করেও ভক্তি করতে পারে। কারণ নারীর প্রেরণাতেই গৌরব অর্জন করে পৃথিবীতে সম্মান পেয়েছে তার প্রেমিক।

উৎসাহের আতিশয্যে ওকে তখন আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল। নিজেকে শক্ত করে যুক্তির অবতারণা করলাম আমি, সবাই কি আমরা স্ট্যানলী আর বার্টন হতে পারি? আর তাছাড়া সবাই সমান সুযোগও পায় না—অন্তত আমি তো কোনদিন তা পাইনি। পেলে নিশ্চয়ই তা লুফে নিতাম।

কিন্তু সুযোগ রয়েছে তোমার চারপাশে। এমন মানুষের কথা আমি বলছি, যে নিজের সুযোগ নিজেই করে নিতে জানে; যাকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। এমন লোকের সাথে আজও পরিচয় হয়নি আমার অথচ তাকে কত ভালভাবেই না চিনি আমি। আমাদের চারপাশেই রয়েছে অনেক দুঃসাহসিক কাজের সুযোগ। পুরুষ করবে সে কাজ আর পুরস্কার স্বরূপ নারী নিজেকে সঁপে দেবে সেই বীরের পায়ে। ফরাসী লোকটার কথাই ধরো—এই যে গত সপ্তাহে যে বেলুনে চড়ে আসমানে উঠেছিল। ঝড় বইতে শুরু করল, কিন্তু যেহেতু আগে থেকেই প্রচার করা হয়েছিল, তাই ঝড়ের মধ্যেই জেদ ধরে রওনা হলো। ঝড় চব্বিশ ঘণ্টায় তাকে নিয়ে গেল দেড় হাজার মাইল। রাশিয়ার মাঝখানে গিয়ে নামল সে। তার প্রেমিকার কথা চিন্তা করো—অন্যান্য মেয়েরা নিশ্চয়ই ওর সৌভাগ্যকে হিংসা করে। সেটাই চাই আমি, আর সবার হিংসার পাত্রী হতে চাই।

তোমাকে খুশি করার জন্যে আমিও তা করতে পারতাম, বললাম আমি।

কিন্তু আমার প্রেমিক কেবল আমাকে খুশি করার জন্যেই কাজ করবে না। তার মন অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বলেই করবে। নিজের অন্তরের তাগিদেই সে বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপদকে বরণ করবে। তুমি তো গতমাসে উইগানের কয়লা খনিতে বিস্ফোরণের বিবরণ দিয়েছিলে। নিচে কার্বনিক অ্যাসিড গ্যাস আছে জেনেও কি তুমি ওদের সাহায্যে নামতে পারতে না?

অবশ্যই, নিচে নেমে সাহায্য করেছি আমি।

কিন্তু তুমি তো আমাকে বলেনি সে কথা।

ওটা বড়াই করে বলার মত কোন ঘটনা বলে মনে করিনি।

আমি জানতাম না, আমার দিকে শ্রদ্ধার চোখে চাইল গ্ল্যাডিস। সাহস আছে তোমার।

আমাকে বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছিল। ভাল রিপোর্ট ঘটনাস্থলে না গিয়ে লেখা যায় না।

আশ্চর্য ছন্দপতন! তোমার নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যের পুরো আমেজটাই নষ্ট করে দিলে। যাক তবু তুমি এগিয়ে গিয়েছিলে শুনে খুশি হলাম, বলে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল সে। ওর ভঙ্গিতে এমন একটা আভিজাত্য ছিল যে আমি সামনে ঝুঁকে কেবল ছোট্ট একটা চুমু খেলাম হাতে।

গ্ল্যাডিস বলল, হয়তো একটা বোকা মেয়ের মতই যৌবনের রঙীন স্বপ্ন দেখছি আমি। কিন্তু তবু আমার কাছে এটা এত বাস্তব, আমার জীবনেরই অংশ যেন। যদি কোনদিন বিয়ে করি আমি বিখ্যাত লোককেই বিয়ে করব।

নিশ্চয়ই। তোমার মত নারীই তো পুরুষকে প্রেরণা যোগায়। সুযোগ দাও, দেখি আমি কিছু করতে পারি কিনা। তাছাড়া, তুমি ঠিকই বলেছ, মানুষকে নিজের সুযোগ নিজেকেই করে নিতে হয়। ক্লাইভের কথাই ভেবে দেখো, সামান্য কেরানী ছিল, ভারতবর্ষ জয় করল। তুমি দেখে নিও-আমি কিছু একটা করবই।

আমার আইরিশ রক্ত ফুটে উঠেছে দেখে হেসে ফেলল গ্ল্যাডিস।

কেন পারবে না? মানুষের যা যা উপকরণ সবই আছে তোমার। যৌবন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, উদ্যম-কোন কিছুরই অভাব নেই। এসব কথা উঠল বলে প্রথমে খারাপ লাগছিল, কিন্তু এখন ভাল লাগছে। সত্যিকার পুরুষ হওয়ার ইচ্ছা তোমার মধ্যে জেগে থাকলেই আমি সুখী হব।

আর যদি সত্যিই…।

কুসুম উষ্ণ ভেলভেটের মত নরম একটা হাত আমার ঠোঁট চেপে ধরল।

আর কথা নয় এখন। সন্ধ্যায় তোমার অফিসে যাবার সময় আধঘণ্টা আগেই পেরিয়ে গেছে। আগে মনে করিয়ে দিতে বাধছিল। যেদিন সত্যিই পৃথিবীতে তুমি সম্মানের স্থান অধিকার করতে পারবে সেদিন আবার আমরা এই সম্পর্কে কথা বলব।

কুয়াশাচ্ছন্ন নভেম্বরের সন্ধ্যায় ক্যামবারওয়েল ট্রামে চেপে উষ্ণ হৃদয়ে ভাবতে ভাবতে চললাম। আর একদিনও নষ্ট হতে দেয়া চলবে না। আমার প্রেমিকার উপযুক্ত বীরত্বের একটা কাজ আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত