০৩. উনিশ নম্বর সেন্সরটার কাছে
উনিশ নম্বর সেন্সরটার কাছে বসে আছে ইভান বেকি। কাছেই ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসে মার্লিন। কোলের ওপর রাখা পোর্টেবল টেস্ট ইকুইপমেন্ট। সেন্সর থেকে আসা সংকেত ধরছে একটা যন্ত্র, সঙ্গে সঙ্গেই রিডিং দিচ্ছে ডায়ালে। ভুরু কুঁচকে ডায়ালের দিকে তাকিয়ে আছে সে। অবাক হয়ে গেছে।
আরও আধ মিনিট তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ডায়ালের দিকে তাকিয়ে থাকল মার্লিন, তারপর পুরো সেটটার বিশেষ বিশেষ অংশ পরীক্ষা করে দেখল। নাহ্ যন্ত্রটা তো ঠিকই আছে। তাহলে?
স্বামীর দিকে মুখ তুলে তাকাল মার্লিন, ওয়্যারিংগুলো ঠিকমত করেছিলে?
সেন্সরের অ্যান্টেনা আরও ওপরের দিকে তুলে দিতে ব্যস্ত ইভান। স্ত্রীর দিকে তাকিয়েই পাল্টা প্রশ্ন করল সে, কেন?
ওয়্যারিংগুলো ঠিকঠাক মত করেছিলে কিনা জানতে চাইছি।
নিশ্চয়ই! কিন্তু কেন?
সন্দেহ হচ্ছে আমার!
যন্ত্রটার ওপর আবার ঝুঁকে পড়ল মার্লিন। দক্ষহাতে ডায়ালটা খুলে নিল। টেনেটুনে ওয়্যারিং দেখে নিয়ে শ্রাগ করল। অদ্ভুত রিডিং দিচ্ছে ডায়াল, বলল মার্লিন, আশেপাশেই কোথাও আগ্নেয় গহবর জাতীয় কিছু আছে মনে হচ্ছে?
কি বললে? ফিরে তাকাল ইভান।
হ্যাঁ, তাইই! ব্যাটল মাউনটেনের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল মার্লিন, ওদিকেই কোথাও।
পর্বতটার দিকে তাকাল ইভান। মুখের ওপর খাড়া এসে পড়ছে রোদ। দুহাত কপালের ওপর তুলে আড়াল করে রাখতে হচ্ছে।
আশ্চর্য তো!
অথচ ওদিকে আগ্নেয়গিরি আছে, শুনিনি তো কখনো!
কিন্তু সেন্সরের রিডিং তো ভুল হতে পারে না।
যন্ত্রটায় কোন দোষ নেই তো?
জোরে এদিক ওদিক মাথা দোলাল মার্লিন, ভালমত দেখেছি আমি। কোন গোলমাল নেই।
এক কাজ কর। সেন্সরটার পজিশন জানিয়ে ট্রিনিটি বেস এর টেস্ট ইকুইপমেন্টে রিডিং দেখতে বল তো অস্টিনকে। শোনা যাক কি রিডিং পাচ্ছে ও।
মাইক্রোফোনটা তুলে নিল মার্লিন। রেডিওর সুইচ অন করল। ট্রিনিটি মোবাইল টু ট্রি নিটি বেস।
কড় কড় করে উঠল রেডিও। দুএকবার ঝড় বওয়ার শব্দ উঠল। কথা শোনা গেল এরপর, ট্রিনিটি বেস। বলে যাও। অস্টিনের গলা।
স্টিভ, জিজ্ঞেস করল মার্লিন, উনিশ নম্বর সেন্সরের রিডিং পাচ্ছ?
রিডিং টেপ হচ্ছে, কিন্তু আমি দেখছি না এখন। গোল্ডম্যান আর, রেনট্রির অপেক্ষায় আছি। ওরা এলেই এখান থেকে সরে যাব। বেস চেঞ্জ করব।
অ্যান্টেনার গোলমাল সেরেছে?
এখন তো ঠিকই আছে।
বেশ, বলল মার্লিন, এক কাজ কর। রিডিং ডায়ালটা অন কর। উনিশ নম্বর থেকে পাঠাব। দেখ তো কোন গন্ডগোল আছে কিনা?
সেন্সরের ট্রান্সমিটার সেকশনটা অন করল ইভান।
সংকেত যাচ্ছে? মাইক্রোফোনে বলল মার্লিন।
হ্যাঁ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ডায়ালের দিকে তাকিয়ে আছে অস্টিন। রেনট্রি আর গোল্ডম্যান এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে, টের পেয়ে একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল, তারপর আবার মন দিল ডায়ালের দিকে। মার্লিনের গন্ডগোল শব্দটা আগন্তুক দুজনেরও কানে গেছে।
এন. সি. ই. আর-এর একজন বিজ্ঞানী টম রেনট্রি। জাতে রেড ইন্ডিয়ান। হু ভ্যালির ইন্ডিয়ান রিজার্ভেশনে জন্ম। ট্রিনিটি ফল্টের আশপাশটা তাই নিউ ইয়র্কের অধিবাসীদের চাইতে অনেক বেশি চেনে সে। ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানে অগাধ জ্ঞান। অথচ বয়েস একেবারে কম, মাত্র বিশ। সবদিক বিবেচনা করেই ট্রিনিটি ফল্টের বৈজ্ঞানিক অভিযানে সঙ্গে নেয়া হয়েছে তাকে।
অসকার গোল্ডম্যানের আগমন কিন্তু রহস্যজনক। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলছেন বটে, স্টিভ অস্টিনকে সঙ্গ দেবার জন্যেই তার আগমন। কিন্তু স্পেশাল ইনটেলিজেন্সের অপারেশন বিভাগের একজন চিফ শুধুই একজন জ্যান্ত রোবটকে সঙ্গ দিতে এসেছেন, ঠিক মেনে নেয়া যায় না। তবে কে জানে, সিক্স মিলিয়ন ডলার তো সোজা কথা নয়। অমন দামী সাইবর্গকে আগলে রাখার কিংবা তার সত্যিকারের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করার দায়িত্বটা হয়ত গোল্ডম্যানের ওপরই অর্পণ করেছেন সরকার।
মিনিটখানেক গভীর মনোযোগে ডায়ালের রিডিং দেখল অস্টিন। তারপর উঠে গিয়ে তাঁবু থেকে একটা ছোট টি. ভি. জাতীয় সেট নিয়ে এল। জেনারেটরের সঙ্গে কানেকশন দিয়ে চালু করে টিউনিং করতেই কতগুলো আঁকাবাঁকা রেখা ফুটে উঠল স্ক্রীনে।
ভুরু কুঁচকে উঠল অস্টিনের। মাইক্রোফোনটা ঠোঁটের কাছে এনে বলল, ট্রিনিটি মোবাইল মনে হচ্ছে কোন আগ্নেয়গুহার কাছাকাছি আছ তোমরা!
অবিশ্বাস্য! এ কি করে সম্ভব? ফিসফিস করে বলল রেনট্রি।
ট্রিনিটি মোবাইল শুনতে পাচ্ছ তো তোমরা? জিজ্ঞেস করল অস্টিন।
পাচ্ছি। এই গোলমালটাই অবাক করেছে আমাদের, বলল বার্লিন। ছেড়ো না। ধরে থাক।
একটু সরিয়ে বসিয়ে দেখা দরকার, কি রিডিং দেয় সেনসর, বলল ইভান। এগিয়ে গিয়ে বসে পড়ল সে। কাজ শুরু করল। সেনসরটা তুলে আনল। অ্যান্টেনা আর প্রোব খুলে নিয়ে সার্কিট পরীক্ষা করায় মন দিল।
ডান হাতের তালুর ওপর থুতনি রেখে বসে বসে স্বামীর কাজ দেখছে মার্লিন।
নাহ্ কোথাও কোন গোলমাল নেই, এদিক ওদিক মাথা দুলিয়ে আপন মনেই বলল ইভান।
দেখ তো সার্কিটের কোথাও ক্রস কানেকশন হয়ে গেছে কিনা? সন্দেহ যাচ্ছে না মার্লিনের, টিনের টুকরো-টাকরা লেগে থাকতে পারে সার্কিট বোর্ডের পেছনে। বাড়তি তার বেরিয়ে থাকাও বিচিত্র নয়।
বিচিত্র নয়, স্বীকার করল ইভান। কিন্তু তাতে সার্কিট অচল হয়ে যেতে পারে, জ্বলে যেতে পারে, গোটা এক আগ্নেয়গিরি আবিষ্কার করে ফেলতে পারে না।
শ্রাগ করল মার্লিন। একটু নড়েচড়ে বসল। বাঁ হাতের তালুও এনে ঠেকাল থুতনিতে।
ওদের কয়েকগজ দূরে রেডউডের এক টুকরো ঘন বনের মধ্যে চুপচাপ দুজনের দিকেই লক্ষ্য রাখছে বিশাল এক ভয়ংকর জীব। ইভান কিংবা মার্লিন টেরই পাচ্ছে না।
জীবটার স্থানীয় নাম সাসকোয়াচ। লম্বায় আট ফুটের কাছাকাছি। অনেকটা গরিলার মত দেখতে। পায়ের পাতা, হাতের তালু আর মুখমন্ডল ছাড়া বাকি শরীর লম্বা বাদামী রোমে ঢাকা। দুদিকে ছড়ালে এক হাতের মধ্যমা থেকে অন্য হাতের মধ্যমার দূরত্ব ফুট দশেক হবে। ইচ্ছে করলে দুহাতে দুজন শক্তসমর্থ জোয়ান লোককে অনায়াসে তুলে নিতে পারে। চেহারায় গরিলা আর মানুষের সংমিশ্রণ, অনেকটা আমাদের আদি পূর্বপুরুষদের মত। দুপায়ের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে ইচ্ছে করলে, কিন্তু সাধারণত একটু কুঁজো হয়ে চলাই এর স্বভাব। চলার সময় কাঁধ থেকে ঝুলে থাকে দুই হাত, হঠাৎ দেখলে মনে হবে প্রাণ নেই ও দুটোয়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী সাসকোয়াচের কথা চালু আছে ওসব এলাকার রেড ইন্ডিয়ানদের মাঝে, হিমালয়ের ইয়েতীর মতই। তবে আগে কোনদিন চোখে দেখেনি দানবটাকে কেউ। ইদানীং কারও কারও চোখে পড়েছে সাসকোয়াচ। তারা গিয়ে গাঁয়ে বলেছে। প্রথম প্রথম হেসেই উড়িয়ে দেয় গাঁয়ের লোকে। তারপর এই অঞ্চলে শিকার কিংবা আউটিং-এ এসে যখন শহরে কিছু শিক্ষিত লোক সাসকোয়াচের কবলে পড়ল, হাসাহাসির পর্যায়ে থাকল না আর ব্যাপারটা। একান ওকান হতে হতে জীববিজ্ঞানীদের কানে গিয়ে খবর পৌঁছল। ব্যস, তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তাঁরা। জানোয়ারটার দেখা পেলেন না, তবে অস্বাভাবিক বড় পায়ের ছাপ আবিষ্কার করলেন ট্রিনিটি ফল্ট আর আশেপাশের পাহাড়, পর্বতের ঢাল আর জঙ্গলে। সাসকোয়াচের নাম দিলেন বিগ ফুট।
সেন্সরের সিলিকনের তৈরি সার্কিট পরীক্ষা করতে ব্যস্ত ইভান। বসে বসে তাই দেখছে মার্লিন। পেছনের রেডউডের জঙ্গলের দিকে নজর নেই কারোই। এই সুযোগে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল সাসকোয়াচ। ভারি পায়ের তলায় শুকনো কুটোপাতা ভাঙার ক্ষীণ আওয়াজ উঠল। জঙ্গলে ছোটখাট অনেক জন্তু জানোয়ার আছে। ও ধরনের খুটখাট শব্দ প্রায় সর্বক্ষণই করে ওরা। বাদামের শক্ত খোসা কাটছে হয়ত কাঠবেড়ালী, কিংবা শুকনো ঘাস পাতা মাড়িয়ে ছুটোছুটি করছে ঘেসো ইঁদুর। তাই শব্দটা শুনে থাকলেও খুব একটা কেয়ার করল না স্বামী-স্ত্রী।
বড়জোর দুই কদম বাড়িয়েছে সাসকোয়াচ, এমন সময় রেডিও কথা বলে উঠল। পরিষ্কার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে অস্টিনের। ধরে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে পড়েছে সে।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সাসকোয়াচ। রেডিওতে ভেসে আসা কথা শুনছে কান পেতে।
ট্রিনিটি বেস টু ট্রিনিটি মোবাইল, বলল অস্টিন, কাজ এগিয়েছ?
পায়ের কাছে ফেলে রাখা মাইক্রোফোনটা তুলে নিল মার্লিন। চোখ ইভানের হাতের সেন্সরের দিকে।
স্টিভ, সার্কিটটা আরেকবার পরীক্ষা করছে ইভান।
সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেছে?
এখন পর্যন্ত না। ধরে থাক, পেলে সঙ্গে সঙ্গে জানাব।
ঠিক আছে, বলল অস্টিন।
সবে টেবিলে মাইক্রোফোনটা নামিয়ে রেখেছে অস্টিন, তিনজনকে চমকে দিয়ে গর্জন করে উঠল রেডিও। আজব কোন জানোয়ারের গলা থেকে বেরিয়ে আসা কুৎসিত ভয়ংকর চাপা গর্জন। পরক্ষণেই নারী কণ্ঠের ভয়ার্ত চিৎকার। চেয়ারে সোজা হয়ে বসেছে অস্টিন। নিমেষে সতর্ক হয়ে উঠেছে তার বায়োনিক ব্রেন। লাফ দিয়ে টেবিলের একেবারে ধার ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে গোল্ডম্যান আর রেনট্রি।
গর্জন শুনেই চোখ তুলে তাকিয়েছে ইভান, ফিরে চেয়েছে মার্লিন। তাদের একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে সাসকোয়াচ। নিজের অজান্তেই গলা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে মার্লিনের বিকট চিৎকার। স্থির বসে বোবা বিস্ময়ে শুধু চেয়ে আছে ইভান। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কথা বলার শক্তিও হারিয়েছে যেন।
মার্লিন আর ইভান, দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখল একবার করে সাসকোয়াচ। তারপর ঝুঁকে হাত বাড়াল। একই সঙ্গে ঘাড় চেপে ধরল দুজনের।
মাইক্রোফোন ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছে অস্টিন। মার্লিন…মার্লিন, চেঁচিয়ে বলল সে, কথা বলছ না কেন?…কি হয়েছে?
ইভান আর মার্লিনের ঘাড় ধড়ে রেখেই রেডিওটার দিকে তাকাল সাসকোয়াচ। নিঃশব্দে, ধীরে ডান পা-টা তুলল রেডিওর ওপর। তারপর চোখের পলকে নামিয়ে আনল। পা-টা সরিয়ে নিতেই দেখা গেল, দুমড়ে মুচড়ে চেপ্টে মাটিতে বেশ কিছুটা গেড়ে গেছে যন্ত্রটা।
মার্লিন… দাঁড়িয়ে পড়েছে অস্টিন, কি হল?…রেডিও চুপচাপ কেন?… হ্যালো …মার্লিন… ইভান…
নিজের রেডিও আর সুইচগুলো খটাখট করে টিপল অস্টিন। আবার চেষ্টা করল, ট্রিনিটি বেস টু ট্রিনিটি মোবাইল মার্লিন, ইভান, জবাব দাও…শুনতে পাচ্ছ?…হ্যালো…হ্যালো…
ওপাশ থেকে সাড়া দিল না কেউ।