১০১-শেষ. পরদিন সকালে ঝড়ের বেগ
১০১.
পরদিন সকালে ঝড়ের বেগ কমে এলেও সাগরে এখনও উঠছে বড় বড় ঢেউ। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে ছুরির ফলার মত আলো ছড়াচ্ছে সূর্য। এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে আছে আহাব, মাঝে মাঝে সূর্যের তির্যক আলোর দিকে তাকিয়ে কি যেন অনুমানের চেষ্টা করছে।
হঠাৎ হালের কাছে এগিয়ে এসে জানতে চাইল আহাব, পেকোড এখন কোনদিকে চলেছে।
পূর্ব-দক্ষিণ-পূর্ব, স্যার, ভয়ে ভয়ে জবাব দিল কাণ্ডারী।
মিথ্যুক! কাণ্ডারীকে একটা ঘুসি লাগাল আহাব। সকালে জাহাজ পুবে গেলে সূর্য পেছনে থাকে কিভাবে? আহাবের কথা চমকে দিল জাহাজের সবাইকে। আরে, তাই তো, এব্যাপারটা তো কেউই লক্ষ করেনি।
বিনাকলের কম্পাস দেখার জন্যে ঝুঁকে পড়ল আহাব, পেছনে স্টারবাক। কম্পাসের দুটো কাটাই আটকে আছে পুবমুখখা হয়ে। অর্থাৎ, পেকোড এখন নিঃসন্দেহেই চলেছে পশ্চিমে।
একটা কাষ্ঠ হাসি হেসে বুড়ো বলল, বুঝেছি! এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। মি. স্টারবাক, গত রাতের বিদ্যুৎ ঝড়ে কম্পাস নষ্ট হয়ে গেছে। এই ধরনের ঘটনার কথা নিশ্চয় শুনেছ তুমি।
তা শুনেছি, স্যার, কিন্তু ঘটতে দেখিনি কখনও, বিষণ্ণ মুখে জবাব দিল স্টারবাক।
জাহাজ দারুণ বিদ্যুৎ ঝড়ে পড়লে কম্পাস অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। কখনও নষ্ট হয় নির্দিষ্ট কোন কম্পাস, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বিনাকলের কম্পাসটা বিকল হলে জাহাজের একটা কম্পাসও আর সচল থাকে না।
তবে আহাব উন্মাদ হোক আর যা-ই হোক, জাহাজের কাজে তার মত পারদর্শী লোক খুব কমই আছে। বর্শার ইস্পাতের মাথাটা খুলে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মেরামত করে ফেলল বিনাকলের কম্পাস।
বিস্ময়ে চুপ মেরে গেল সবাই, আর ক্যাপটেন আহাবের মুখে ফুটে উঠল দারুণ গর্ব।
১০২.
নিয়তির যাত্রায় ভাসমান পেকোড চলেছে তো চলেইছে। অনেক দিন হলো কোন লগ লাইন ব্যবহার করা হয়নি। পরীক্ষা করার জন্যে একদিন বেশকিছু লাইন পেঁচিয়ে হাতে নিল আহাব।
লক্ষ করতে করতে এক ম্যাংক্স নাবিক সাহস করে শেষমেশ বলল, ওই লাইনে আর কোন কাজ হবে বলে মনে হয় না, স্যার। রোদে পুড়ে আর পানিতে ভিজে ওগুলো একেবারে শেষ হয়ে গেছে।
বুড়ো মিয়া, তুমিও তো দীর্ঘ দিন রোদে পুড়ছ আর পানিতে ভিজছ, কিন্তু তাই বলে তুমি কি শেষ হয়ে গেছ? যাকগে, তর্ক বাদ দিয়ে এখন এই লাইনগুলো একটু ধরো।
ধরছি, স্যার। আপনি ঠিকই বলেছেন, বুড়ো মানুষদের তর্ক করা শোভা পায় না। ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে তর্ক করা উচিতও নয়।
তোমার বাড়ি কোথায়?
আইল অভ ম্যান।
চমৎকার! তাহলে ওই দ্বীপ থেকেই সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছ তুমি।
আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছি কিনা তা জানি না, স্যার। তবে ওই দ্বীপেই আমার জন্ম।
লগ টেনে তোলা হলো, টান টান হয়ে গেল লাইন। টলতে লাগল বুড়ো ম্যাংক্স নাবিক।
শক্ত করে ধরে রাখো! হঠাৎ পটাং করে ছিঁড়ে গেল লাইন।
কোয়াড্রান্ট আমি আছড়ে ভেঙেছি, কম্পাস বিকল হয়েছিল, এখন পাগলা সাগর ছিঁড়ে ফেলল লগ-লাইন। কিন্তু আহাব সব মেরামত করতে পারে। তোমরা দড়িটা জোড়া দাও, আর ছুতোরকে ডেকে বললো আরেকটা লগ তৈরি করে দিতে।
ওই যে চলে যাচ্ছে ক্যাপটেন। তার হিসেবে কোথাও অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। কিন্তু আমার তো মাথা ঘুরছে। আরে, পিপ যে, আমাদের সাহায্য করতে এসেছ, আঁ?
পিপ? পিপ বলে কে ডাকল? পিপ তো ঝাপিয়ে পড়েছে হোয়েল-বোট থেকে। তারপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রশিটা উঠতে চাইছে না কেন, পানির নিচ থেকে নিশ্চয় টেনে ধরেছে পিপ। তাড়াতাড়ি তুলে নাও রশিটা, তুলতে অসুবিধে হলে কেটে দাও হ্যাচেট দিয়ে। জাহাজে আর কোন কাপুরুষকে দেখতে চাই না আমরা। ক্যাপটেন আহাব! স্যার! পিপ আবার জাহাজে উঠতে চাইছে!
দূর, যত্তসব পাগলামি! ধমকে উঠল ম্যাংক্স নাবিক পিপের একটা হাত ধরে, ভাগ এখান থেকে!
বড় গাধা সবসময়ই ছোটদের ধমকায়, বিড়বিড় করতে করতে এগোল আহাব। ছাড়ো ওর হাত! পিপ কোথায়, বাছা?
স্টার্নে, স্যার। ওই দেখেন?
তাহলে তুমি কে?
বেল-বয়, স্যার। এই কে কোথায় আছ, পিপ কাপুরুষকে দেখেছ কেউ? খুঁজে দাও, খুঁজে দাও, পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে।
ওহ, ছেলেটা আমার মনের গভীরে খোঁচা দিয়েছে। শোনো সবাই, যত দিন আহাব বেঁচে আছে, পিপ থাকবে তার কেবিনে।
এটা কি? মখমলের মত নরম, আহাবের একটা হাত তুলে নিয়ে দেখতে লাগল সে মনোযোগ দিয়ে। আহ, এরকম একটা জিনিস নাড়ার সুযোগ পেলে পিপ বোধহয় হারিয়ে যেত না। স্যার, আমার মনে হচ্ছে, এটা একটা রশি যা দিয়ে দুর্বল মন বেঁধে রাখা যায়। পার্থকে ডাকুন, আপনার হাতের সঙ্গে আমার হাতটা জোড়া লাগিয়ে দিক। আমি এটাকে আর ছেড়ে দিতে চাই না।
ওরে, যদি ভয়ঙ্কর কোন বিপদ না আসে, আমিও ছাড়তে চাই না তোর হাত। চল, আমার কেবিনে চল। কোন সম্রাটের চেয়ে কেবিনে তোকে নিয়ে যেতেই বেশি ভাল লাগবে আমার!
চলল দুই পাগল একসঙ্গে, বিড়বিড় করতে লাগল ম্যাংক্স নাবিক। একজন সবল পাগল, একজন দুর্বল। কিন্তু এই লাইনকে এখন জোড়া দেবে কে, এটা কি জোড়া দেয়ার অবস্থায় আছে? এর চেয়ে বদলে নতুন লাইন লাগানো অনেক ভাল। যাই, এই বিষয়ে মি. স্টাবের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
১০৩.
পেকোড ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে নিরক্ষরেখার দিকে। চারপাশের প্রকৃতি সম্পূর্ণ শান্ত। হাবভাবে মনে হচ্ছে, এটা যেন কোন বিপদের পূর্বাভাস।
একসময় এদিক-সেদিক চোখে পড়ল পাথুরে কয়েকটা খুদে দ্বীপ। ফ্লাস্কের নেতৃত্বে পাহারাদাররা একরাতে হঠাৎ শুনতে পেল অপার্থিব এক আর্তনাদ, যেন গোঙাচ্ছে প্রেতাত্মার দল। কান খাড়া হয়ে গেল সমস্ত নাবিকের, কিন্তু গোঙানি বন্ধ হলো না। খ্রিস্টান এবং অপেক্ষাকৃত সভ্য নাবিকেরা বলল, চিৎকার করছে মৎস্যকুমারীরা। কথাটা বলতে গিয়ে কেঁপে উঠল তাদের সারা শরীর। সবচেয়ে বয়স্ক ম্যাংক্স নাবিক বলল, গোঙাচ্ছে আসলে সদ্য ডুবে যাওয়া মানুষদের প্রেতাত্মা।
নিচ থেকে আহাব অবশ্য এই ডাক শুনতে পেল না। পরদিন সকালে ডেকে আসতে তাকে সব খুলে বলল ফ্লাস্ক। শোনার পর হো হো করে হেসে উঠে রহস্যটা ভেঙে দিল ক্যাপটেন।
নিরক্ষরেখার আশেপাশের পাথরে দ্বীপগুলোয় হাজার হাজার সীলমাছের আবাস। তাদেরই কোন বাচ্চমাকে হারিয়ে কিংবা কোন মা বাচ্চাকে হারিয়ে কাতর হয়ে পড়েছিল। সীলমাহেব ডাক অবিকল মানুষের মত! সে-ডাক শুনে কুসংস্কারাচ্ছন্ন অনেক নাবিকই স্যথা আতঙ্কিত হয়
পরদিন ঘটল আরেক ঘটনা। মাস্ট-হেডে প্রহরারত নাবিক দেখল, কী যেন একটা খুলে পড়ল পেকোড থেকে নিচে, নীল সাগরের খানিকটা অংশ ভরে গেল শাদা বুদবুদে।
খুলে পড়েছে লাইফ-বয়া। প্রহরারত নাবিক ভাবল, এটা নিশ্চয় কোন অমঙ্গলের আভাস! তা অমঙ্গল হোক আর যা-ই হোক, আরেকটা লাইফ-বয়া ঝোলাতে হবে স্টার্নে! নতুন লাইফ-বয়া তৈরি করানোর ভার পড়ল স্টারবাকের ওপর। কিন্তু খুঁজে-পেতে হালকা কিছু না পেয়ে সে যখন লাইফ-বয়ার আশা ত্যাগ করছে, ঠিক তখনই কুইকেগ দেখিয়ে দিল তার কফিনটা।
কফি দিয়ে লাইফ-বয়া! বলল বিস্মিত স্টারবাক।
ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে না? মাথা ঝাঁকাল স্টাব।
তবে লাইফ..বয়া হিসেবে জিনিসটা মন্দ নয়, বলল ফ্লাস্ক, আমার তো মনে হয়, ছুতোর ওটা দিয়ে বেশ সহজেই লাইফ-বয়া তৈরি করতে পারবে।
তৈরি করার মত উপযুক্ত আর কিছু নেই যখন, নিয়ে এসো ওটাই, খানিক চুপ করে থাকার পর আদেশ দিল স্টারবাক। ছুতোর, ওভাবে তাকিয়ে থেকো না, ঝটপট একখানা লাইফ-বয়া তৈরি করে ফেলো।
ডালাটা পেরেক দিয়ে আটকে দেব, স্যার? একটা হাতুড়ি হাতে এগিয়ে এল ছুতোর।
হ্যাঁ।
ফুটোগুলো বন্ধ করে দেব দড়ি খুঁজে?
হ্যাঁ।
তারপর সেই দড়ির ওপর পিচ দেব, স্যার?
দূর হও আমার সামনে থেকে, দূর হও! তোমার যা খুশি করো, আমার কেবল একখানা লাইফ-বয়া চাই–ব্যস।
আদেশ দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে তো চলে গেল অফিসার। এখন আমার কাজের পালা। ক্যাপটেন আহাবের জন্যে একটা পা বানালাম, ক্যাপটেন সেটা ভদ্রলোকের মত পরে আছে। কিন্তু এত কষ্ট করে বানানো কফিনটা তো কুইকেগের কোন কাজে লাগল না। অযথা খাটতে ভাল লাগে না বাপু। এখন আবার কফিন দিয়ে লাইফ-বয়া বানাতে হবে। কফিন দিয়ে লাইফ-বয়া বানানোর কথা কেউ শুনেছে কখনও? যাকগে, আমি হলাম ছুতোর। আমার অত মাথা ঘামিয়ে কাজ কি! ফুলশয্যার খাট আর কফিন যদি একই হাতে বানাতে পারি, তাহলে লাইফ-বয়া বানাতেই বা আপত্তিটা কিসের? কফিন দিয়ে বানাতে হবে, তাতে কি হয়েছে? ছুতোরের হাতে কফিন এক টুকরো কাঠ বই কিছু নয়। চিন্তা বাদ দিয়ে এবার লেগে পড়া যাক কাজে, বিড়বিড় করতে করতে কাজে হাত লাগাল ছুতোর।
১০৪.
কেবিন গ্যাংওয়ে ধরে পা বাড়াতেই আহাবের পিছু নিল পিপ। আহাব বলল, যা, ফিরে যা, আমি এখনই আসছি।
একটু পরেই ছুতোরের সামনে এসে দাঁড়াল সে, এখানে কি হচ্ছে?
লাইফ-বয়া, স্যার। মি. স্টারবাকের আদেশ।
আচ্ছা, তুমিই তো আমার পা তৈরি করেছিলে?
জ্বী। কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো, স্যার?
না। কিন্তু কফিনটাও তো তোমারই তৈরি?
জ্বী, কুইকেগের জন্যে বানিয়েছিলাম। এখন ওই কফিন দিয়েই আবার অন্য জিনিস বানাতে হচ্ছে।
তাহলে তোমার নিয়ম-নীতি বলে কিছু নেই, তাই না? কখনও তুমি তৈরি করো পা, কখনও কফিন, আবার কখনও সেই কফিন দিয়েই লাইফ-বয়া।
আমি কিছু ভেবে করি না, স্যার। হাতের কাছে যখন যে-কাজ পাই, করি।
আচ্ছা, কফিন তৈরি করতে করতে কখনও কি তুমি গান গাওনি? কবর যারা খোঁড়ে, তারাও কিন্তু খুঁড়তে খুঁড়তে গান গায়।
ওরা গান গায় ওদের যন্ত্রপাতি গান জানে না বলে। আমার, স্যার, যন্ত্রপাতিই গান গায়, তাই নিজে গাইবার প্রয়োজন পড়ে না।
ফিরতে ফিরতে বিড়বিড় করতে লাগল আহাব, এই ব্যাটার কফিনের লাইফবয়া বানানোর শব্দে কান তো ঝালাপালা হয়ে যাবে। উঁহুঁ, বলে দিতে হবে, এবার ডেকে এসে এই জিনিস যেন আর না দেখি। পিপের সঙ্গে আলাপ করতে হবে এবিষয়ে। ইতিমধ্যেই ওর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি।
১০৫.
পরদিন দেখা হলো র্যাচেল নামের এক জাহাজের সঙ্গে। পেকোড তখন এগোচ্ছিল পূর্ণ গতিতে, র্যাচেল একেবারে সামনে এসে পড়ায় থামতে বাধ্য হলো।
দুঃসংবাদ, নিশ্চয় দুঃসংবাদ আছে, বিড়বিড় করল বুড়ো ম্যাংক্স। শিঙ্গা মুখে নৌকোয় দাঁড়িয়ে আছে র্যাচেলের ক্যাপটেন। খানিক পরেই আহাব বেরিয়ে এল বাইরে।
সাদা তিমিটাকে দেখেছেন?
হ্যাঁ, গতকাল। কোন নৌকো ভেসে যেতে দেখেছেন?
না-সূচক জবাব দিল আহাব। লাফিয়ে পেকোডের ডেকে উঠল র্যাচেলের ক্যাপটেন। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে চিনতে পারল আহাব, ন্যানটাকেটেই ভদ্রলোকের বাড়ি।
তিমিটা কোথায়?–মারা যায়নি নিশ্চয়? এগিয়ে এল উত্তেজিত আহাব।
গতকাল বিকেলে একদল তিমি দেখে পিছু নিয়েছিল র্যাচেলের তিনটে নৌকো। জাহাজ থেকে চার পাঁচ মাইল এগোবার পর হঠাৎ তাদের সামনে ভেসে উঠল মবি ডিকের প্রকাণ্ড সাদা মাথা আর কুঁজ। তিমিটাকে দেখে নামানো হলো চতুর্থ আরেকটা নৌকো। বাতাসের অনুকূলে বেশ খানিকটা এগোবার পর হারপুন গাঁথতে সমর্থ হলো ওটা। কিন্তু তীর বেগে সেটাকে টানতে টানতে উধাও হয়ে গেল মবি ডিক। চিন্তিত হয়ে পড়ল নাবিকেরা, তবে আতঙ্কিত হবার মত তেমন কিছু খুঁজে পেল না। আঁধার নেমে এল সাগরের ওপর। ফলে সেদিনের মত খোজার আশা ত্যাগ করতে হলো সবাইকে। পরদিন খোঁজ শুরু হলো চারদিকে নৌকো পাঠিয়ে, কিন্তু চতুর্থ সেই নৌকোটাকে আর পাওয়া গেল না।
কথা শেষে পেকোডকেও তাদের সঙ্গে যোগ দিতে অনুরোধ করল র্যাচেলের ক্যাপটেন। দুই জাহাজ মিলে অনুসন্ধান করলে কাজ অনেক সহজ হয়ে আসবে।
আমার মনে হয়, ফিসফিস করে উঠল স্টাব ফ্লাস্কের কানে কানে, হারানো নৌকোয় রয়েছে ক্যাপটেনের সবচেয়ে ভাল কোটটা। তাই ওটা পাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে বেচারি। তিমি মারার এই সুসময়ে একটা হোয়েল-বোট খোজার জন্যে দুটো জাহাজ ব্যস্ত হবার কথা কেউ শুনেছে কখনও? কিন্তু ক্যাপটেনের মুখটা অমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে কেন? উহুঁ, আমার মনে হচ্ছে কোট নয়–ঘটনা গুরুতর–
নৌকোটায় অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছে আমার ছেলে আমার নিজের ছেলে, আহাবের সামনে প্রায় হাতজোড় করে দাঁড়াল র্যাচেলের ক্যাপটেন, তাই আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, আটচল্লিশ ঘণ্টার জন্যে আপনার জাহাজটা দয়া করে দিন আমাকে। আমি এজন্যে ভাড়া দেব, উপযুক্ত ভাড়া দেব–আমার এই অনুরোধ আপনাকে রাখতেই হবে।
ছেলে! বলল স্টাব, আহা, বেচারির ছেলে হারিয়ে গেছে! কোট নিয়ে বাজে কথা বলার জন্যে আমি সত্যিই লজ্জিত।
আর সবার সঙ্গে ডুবে গেছে সে, বলল বুড়ো ম্যাংক্স, সেরাতে তাদের প্রেতাত্মার গোঙানিই শুনেছি আমরা।
ছেলেটাকে আমাদের উদ্ধার করতেই হবে, বলল স্টাব।
শুধু ক্যাপটেনের ছেলেই নয়, হারিয়ে গেছে ন্যানটাকেটের আরেকটা বারো বছরের ছেলে। তাই শেষমেশ র্যাচেলের ক্যাপটেন আহাবকে বলল, আপনি রাজি
হওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে যাব না। সন্তান আপনারও আছে, আমার অবস্থাটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।
থামুন, বলল আহাব, ক্যাপটেন গার্ডিনার, আপনার আবদার রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ইতিমধ্যেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি। মি. স্টারবাক, অন্য জাহাজের সবাইকে পেকোড থেকে নেমে যেতে বলো, আর তিন মিনিটের মধ্যে রওনা দাও পূর্ণ গতিতে, ঘুরে কেবিনের দিকে পা বাড়াল সে।
১০৬.
আহাব ভেকের দিকে এগোতেই তার একটা হাত ধরে ফেলল পিপ।
এখন আমার পিছু নিস না। এখানে আমার চেয়ারে বসে থাকি, ক্যাপটেনের মত সম্মান পাবি।
না, না, না, আমি একা থাকতে চাই না, আমি সবসময় আপনার একটা অংশ হয়ে থাকতে চাই।
ছেলেটার মাথা বোধ হয় ভাল হয়ে যাচ্ছে।
স্যার, শুনেছি, স্টাব ছেড়ে গিয়েছিল বলেই নাকি ডুবে গেছে পিপ আমি কখনও আপনাকে ছেড়ে যাব না।
এখন তার যাওয়া চলবে না আমার সঙ্গে।
ফোঁপাতে লাগল পিপ।
খবরদার, কাদবি তো একেবারে খুন করে ফেলব। শোন, সঙ্গে যাবার দরকার নেই, তুই এখান থেকেই আমার পায়ের শব্দ পাবি। তুই খুব ভাল ছেলে রে, একদম খাটি! এরকম থাকার চেষ্টা করিস, তাহলে ঈশ্বর তোকে সব রকম বিপদ থেকে রক্ষা করবে।
আহাব চলে গেল, এক ধাপ এগিয়ে থেমে গেল পিপ।
মঁসিয়ে, তোমরা কেউ পিপকে দেখেছ? কালো একটা ছেলে, পাঁচ ফুট লম্বা, ভীতু–একবার লাফিয়ে পড়েছিল হোয়েল-বোট থেকে। দেখোনি? বেশ। আরে, ঠিকই তো স্যারের পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। না, স্যারের কাছে যাব না। পরিস্থিতি যত খারাপই হোক, আমি এখানেই থাকব।
১০৭.
এত দিনে সাদা তিমিটাকে আওতার মধ্যে পেয়েছে আহাব। বিশাল জলরাশি জুড়ে বিচরণকারী তিমিটা এখন এসে গেছে মাত্র এক মহাসাগরের সীমানায়। সেইসঙ্গে হারিয়ে গেছে নাবিকদের যাবতীয় হাসি-আনন্দ। স্টাব আর রসিকতা করে না, স্টারবাকেরও সময় নেই রসিকতা শোনার। যন্ত্রের মত ডেকে ঘুরে বেড়ায় তারা, সবসময় সচকিত হয়ে থাকে অত্যাচারী একজোড়া চোখের কথা ভেবে।
এখন, শুধু আহাব না থাকলে, দিন-রাতের যে-কোন সময়ে নাবিকেরা আসে ডেকে। আহাব প্রায়ই এখন দাঁড়িয়ে থাকে ওখানে, কখনও পায়চারি করে মেইন আর মিজেন-মাস্টের মাঝখানে। আবার কখনও দাঁড়িয়ে থাকে কেবিনের সামনে, হ্যাট নামানো থাকে চোখের ওপরে, ফলে নিশ্চল ক্যাপটেনকে দেখে অনেক সময়েই বোঝা যায় না সে ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে। ইদানীং হ্যামকে আর ওঠেই না আহাব। নাবিকরা সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে, ভারী হ্যাটের নিচ থেকে আহাব বুঝি তাদের ওপরেই রেখেছে কড়া নজর। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত গড়িয়ে যাচ্ছে এভাবেই। রাতের কুয়াশায় আহাবের পোশাক ভিজে যায়, পরদিন আবার শুকিয়ে যায় সূর্যের তাপে।
ঊষার প্রথম আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে আসে আহাবের চিৎকারমাস্ট-হেডে ওঠো!–তারপর গোধূলি পেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় সে বলতে থাকে কিছু দেখতে পেলে? ভাল করে দেখো! নজর আরও তীক্ষ করো!
কিন্তু র্যাচেলের সঙ্গে দেখা হবার তিন চার দিন পরেও যখন কারও চোখে পড়ল না তিমির কোন ফোয়ারা, তিন হারপুনার ছাড়া আর সবার ওপর সন্দেহ এসে গেল আহাবের। তার মনে হলো, ফোয়ারা উঠেছে ঠিকই, কিন্তু নজর এড়িয়ে গেছে অমনোযোগী নাবিকদের। সুখের বিষয়, এই সন্দেহের কথা আহাব প্রকাশ করল না।
তবে এক সকালে সে ঘোষণা দিল, তিমিটা প্রথমে আমিই দেখতে চাই। হ্যাঁ, ওই ডাবলুন আহাবকেই পেতে হবে!
একটা পা কৃত্রিম বলে মাস্ট-হেডে ওঠা আহাবের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং ওপরে উঠবে সে ঝুড়ির সাহায্যে। ঝুড়িতে বসে পড়বে সে, তারপর তাকে ওপরে তোলা হবে দড়ি টেনে টেনে। এই প্রক্রিয়ার একটা বিপদ আছে। ওপরে ওঠানোর পর নিচ থেকে সবসময় একজনকে ধরে থাকতে হয় দড়ি। কারণ, দড়ি ছেড়ে দিলেই পড়ে যাবে ঝুড়ি। কে নেবে এই ভার? ডাগগু, কুইকেগ, ট্যাসটেগোর ওপর দিয়ে ঘুরে আহাবের দৃষ্টি শেষমেশ এসে স্থির হলো চীফ মেট স্টারবাকের ওপর।
প্রথম বার ওপরে উঠে মিনিট দশেক থাকল আহাব। লাল টকটকে ঠোঁটের একটা সামুদ্রিক বাজপাখি কিছুক্ষণ ঘুরল তার মাথার চারপাশে, খাড়া উঠে গেল অনেক ওপরে, তারপর নেমে এসে আবার ঘুরতে লাগল।
কিন্তু আহাবের দৃষ্টি দূরে নিবদ্ধ, বুনো পাখিটাকে সে লক্ষই করেনি।
আপনার হ্যাট, স্যার! আপনার হ্যাট! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল মিজেন মাস্টহেডে পাহারারত একজন সিসিলিয়ান নাবিক।
কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। হ্যাট খুলে নিয়ে অনেকটা সরে গেছে পাখিটা।
প্রাচীন কালে এক ঈগল তারকিনের মাথার চারপাশে বার তিনেক ঘুরে হ্যাট খুলে নিয়ে, ফিরিয়ে দিয়েছিল আবার। আর তারপরেই তার স্ত্রী, তানাকিল ঘোষণা করেছিল যে তারকিনই হবে রোমের রাজা।
সেক্ষেত্রে হ্যাট খুলে নিয়েও ফিরিয়ে দেয়াটা বিবেচিত হয়েছিল শুভ লক্ষণ হিসেবে। কিন্তু সামুদ্রিক বাজপাখিটা ফিরিয়ে দিল না আহাবের হ্যাট। উড়তে উড়তে একসময় দিগন্তে মিলিয়ে গেল পাখিটা। তবে ঠিক যেখানে মিলিয়ে গেল, সেখানে থেকে কালো একটা বিন্দু খসে পড়ল অনেক নিচের সাগরে।
১০৮.
এগিয়ে চলল পেকোড। কেটে গেল দিনের পর দিন। অবশেষে একদিন দেখা হলো বিষণ্ণ এক জাহাজের সঙ্গে। এরকম একটা জাহাজের নাম ডিলাইট, এর চেয়ে বড় ব্যঙ্গ বুঝি আর কিছু হতে পারে না।
জাহাজটায় ঝুলছে ছিন্নভিন্ন একটা নৌকো, হোয়েল-বোট হিসেবে ওটাকে চিনতেও কষ্ট হয়।
সাদা তিমিটাকে দেখেছেন?
দেখেছি! জবাব দিল ডিলাইটের শীর্ণ ক্যাপটেন।
ওটাকে মেরেছেন?
ওই তিমিকে মারার মত হারপুন আজও তৈরি হয়নি।
হয়নি! ক্ৰচ থেকে নিজের হারপুনটা তুলে নিল আহাব–এই দেখুন, এটার আঘাতেই শেষ হবে অভিশপ্ত তিমিটার জীবন!
ঈশ্বর আপনাকে রক্ষা করুন। ওই হ্যামকে পড়ে থাকা মৃতদেহটা দেখতে পাচ্ছেন? গতকালও জীবিত ছিল পাচজন তরতাজা যুবক, আজ তাদের একজনকে কবর দিতে পারছি, মরার আগেই কবর হয়ে গেছে বাদবাকি চারজনের। একজন নাবিকের দিকে ঘুরল সে, সব তৈরি? তক্তাটাকে ওপরে রেখে দেহটা তোলো। হে ঈশ্বর–হাত ওপরে তুলে এগিয়ে গেল সে হ্যামকটার দিকে হয়তো সেই পুনরুজ্জীবন।
জাহাজ চালু করা! এই মুহূর্তে! বজ্রের মত ঘঘাষিত হলো ক্যাপটেন আহাবের আদেশ।
কিন্তু পেকোড যাত্রা শুরু করার আগেই ডিলাইট থেকে পানিতে আছড়ে পড়ল হতভাগ্য নাবিকের দেহ।
১০৯.
সে রাতে পাহারার মাঝখানে ডেকে এসে হঠাৎ কুকুরের মত সাগরের দিকে নাক বাড়িয়ে কি যেন শুকল আহাব। তারপর ঘোষণা দিল, কাছেপিঠে কোথাও অবশ্যই একটা তিমি রয়েছে। শিগগিরই সবাই পেল অদ্ভুত সেই গন্ধ।
সকাল হতেই শোনা গেল তার বজ্র গর্জন, মাস্ট-হেডে উঠে পড়ো! ডেকে আসো সবাই!
ফোকাসলে তিনটে হ্যাণ্ডস্পাইক দিয়ে জোরে জোরে বাড়ি দিয়ে নাবিকদের ঘুম ভাঙাল ট্যাসটেগো।
কি দেখতে পাচ্ছ? আকাশের দিকে মুখ তুলল আহাব।
কিছুই না, স্যার, জবাব দিল মাস্ট-হেডে দাঁড়ানো নাবিক।
বিরক্ত হয়ে আহাব নিজেই উঠতে চাইল ওপরে। তাকে ওপরে তুলতে দিগন্তের দিকে চেয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল, ওই যে ডাকছে! সে ডাকছে! বরফপাহাড়ের মত সাদা কুঁজ! ওই যে মবি ডিক!।
আহাবের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চেঁচিয়ে উঠল তিন মাস্ট-হেডের নাবিক। বিখ্যাত তিমিটাকে এক নজর দেখার জন্যে অন্যেরা ছুটল জাহাজের প্রান্তে। আহাবের সমান উচ্চতায় উঠে পড়েছে ট্যাসটেগো। তাদের মাইলখানেক সামনে দেখা যাচ্ছে মবি ডিকের ঝকঝকে সাদা কুঁজ, নিয়মিত বিরতিতে ফোয়ারা ছাড়ছে তিমিটা। নাবিকদের মনে হলো, চাঁদনি রাতে ঠিক এরকম ফোয়ারাই তারা দেখেছে আটলান্টিক আর ভারত মহাসাগরে।
তোমাদের কেউই তিমিটাকে আমার আগে দেখতে পাওনি? ওপরে ওঠা নাবিকদের দিকে চেয়ে জানতে চাইল আহাব।
আমি স্যারের সঙ্গেই দেখতে পেয়েছি, বলল ট্যাসটেগো।
সঙ্গে নয়–উঁহুঁ, একসঙ্গে নয়–না, ওই ডাবলুন আমার, নিয়তিই আমার জন্যে তুলে রেখেছে ওটা। সাদা তিমিটাকে আমিই আগে দেখতে পেয়েছি। ওই যে সে ডাকছে! সে ডাকছে! আবার! আবার! স্বপ্নে পাওয়া মানুষের মত বকছে আহাব। শব্দ না করে ওর উপায় নেই! মি, স্টারবাক, লক্ষ রেখো, জাহাজ যেন কোন দিকে ঘুরে না যায়। প্রস্তুত হয়ে থাকো সবাই, একদম প্রস্তুত! ওই যে লেজ! না, লেজ নয়, কালো পানি! নৌকো সবগুলো তৈরি? মি. স্টারবাক, আমাকে নামিয়ে দাও! নামাও! শিগগির! ডেকে নামল আহাব।
ওটা চলেছে বাতাসের দিকে, স্যার, বলল স্টাব, সোজা আমাদের সামনে সামনে। জাহাজ এখনও দেখতে পায়নি।
চুপ করো সবাই! চুপ করো! নৌকো নামাও! নৌকো!
দেখতে দেখতে নামানো হলো স্টারবাক ছাড়া আর সবার হোয়েল-বোট। ঝপাঝপ দাড় পড়তে লাগল পানিতে। সবচেয়ে সামনে আহাবের নৌকো।
প্রায় নিঃশব্দে তারা গিয়ে পৌঁছুল শক্রর পাশে। হাবভাবে মনে হলো, তিমিটা তাদেরকে লক্ষ করেনি। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওটার সাদা কুঁজ, আশেপাশের সাগর সম্পূর্ণ শান্ত, যেন কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে কেউ পানির ওপরে। সামান্য ভেসে আছে তিমিটার মাথা, চোয়ালের ওপরের কুঞ্চনগুলো দেখতে কোন অসুবিধে হচ্ছে না। পিঠের ওপরে বেরিয়ে আছে সাম্প্রতিক ছোড়া একটা লম্বা বর্শার ভাঙা অংশ। আশেপাশে উড়ছে অসংখ্য সামুদ্রিক পাখি, তাদের আঁক কখনও চাদোয়া সৃষ্টি করছে সাদা তিমিটার ওপর, আবার কোন কোনটা এসে বসছে বর্শায়।
রাজকীয় ভঙ্গিতে সঁতরাতে সঁতরাতে হঠাৎ লেজ ওপরে তুলল তিমিটা, তারপর ডুবে গেল ভুস করে। পানিতে যে-আলোড়ন উঠল, তা ঘিরে উড়তে লাগল সামুদ্রিক পাখির দল।
উত্তেজনায় টান টান হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল তিনটে নৌকো, আবার কখন উঠে আসে মবি ডিক।
এক ঘণ্টা, বলল আহাব হোয়েল-বোটের স্টার্নে দাঁড়িয়ে, দৃষ্টি পানির ওপর স্থির।
পাখি! পাখি! বলল ট্যাসটেগো।
সাদা পাখিগুলো আহাবের নৌকোর দিকে উড়ে আসছে এখন সারসের মত লম্বা সারি বেঁধে। পাখিরা ওপরে থাকে বলে পানিতে কোন জিনিসের গতিবিধি মানুষের অনেক আগেই টের পায়। তাই আহাব কিছু দেখতে না পেলেও উল্লসিত ডাক ছাড়তে ছাড়তে পানির ওপর চক্কর দিতে লাগল ওগুলো। হঠাৎ পানির অনেক নিচে বেজির মত সাদা একটা জিনিস ধরা পড়ল ক্যাপটেনের চোখে। সাদা ঝকঝকে দুসারি দাঁত, হাঁ করা মুখটা যেন দরজা খোেলা কোন সমাধি। দাঁড় টেনে নৌকোটাকে পিছিয়ে নিল আহাব, তারপর ফেদাল্লার সঙ্গে জায়গা বদল করে তুলে নিল পার্থের হারপুন।
কিন্তু মবি ডিকের যে-শয়তানি বুদ্ধির কথা সবাই বলাবলি করে, এবার দেখা গেল তার প্রকাশ। লম্বালম্বিভাবে মাথাটা সে নামিয়ে আনল হোয়েলবোটের ঠিক নিচে।
একটু পর সামান্য ভাসল মবি ডিক, তার চোয়ালের একটা পাশ এখন আহাবের মাথার ইঞ্চি ছয়েক ওপরে। এই অবস্থায় হারপুন বিদ্ধ করা অসম্ভব, তার ওপর পিঠ দিয়ে নৌকোটাকে ঝাকাতে লাগল তিমিটা। স্টার্নে কোনরকমে টিকে রইল ফেদাল্লা।
ক্রমাগত নৌকো ঝাকানো দেখে মনে হলো, মবি ডিক এতে বেশ একটা আনন্দ উপভোগ করছে। কিছুই করতে না পেরে আহাবের উন্মাদনা একেবারে মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। খোলা দুই হাতে সে চেপে ধরল তিমির চোয়াল। খানিক পর চোয়াল নামাল তিমিটা, তারপর এক কামড়ে দুটুকরো করে ফেলল নৌকোটা। ছিটকে পানিতে পড়ল আহাব।
শিকারের কাছ থেকে খানিকটা সরে গেল মবি ডিক। মাঝে মাঝে তার মাথা উঠে গেল পানি ছেড়ে বিশ ফুট কি তারও বেশি ওপরে, ফলে নামানোর সময় উথালপাতাল হতে লাগল আশেপাশের পানি। একটু পর আবার ভাসমান নাবিকদের ঘিরে চক্কর কাটা শুরু করল মবি ডিক। একটা পা কৃত্রিম হওয়ায় সাঁতরানো আহাবের পক্ষে সহজ নয়, তবু কোনমতে ভেসে রইল সে।
ওদিকে পুরো দৃশ্যটাই দেখা গেল জাহাজের মাস্ট-হেড থেকে উদ্ধারের জন্যে এগিয়ে এল পেকোড। সোজা গিয়ে, কথাটা শেষ না হতেই ঢেউয়ের ধাক্কায় খানিকটা ছিটকে গেল আহাব। কিন্তু ওপরে উঠতেই আবার বলল, সোজা গিয়ে তাড়িয়ে দাও তিমিটাকে!
পেকোড এসে পড়ল তিমি আর ভাসমান নাবিকদের মাঝখানে। ধীরে ধীরে সরে গেল মবি ডিক, সঙ্গে সঙ্গে ছুটল উদ্ধারের নৌকো।
ধরাধরি করে স্টাবের হোয়েল-বোটে তোলা হলো আহাবকে। চোখদুটো রক্তের মত লাল, শক্তি নিঃশেষ প্রায়। নিশ্চল পড়ে রইল সে বেশ কিছুক্ষণ। বুকের মৃদু ওঠানামা জানান দিল যে সে এখনও মরেনি।
হারপুনটা, অবশেষে কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে অতি কষ্টে সামান্য উঠে জিজ্ঞেস করল আহাব, আমার হারপুনটা ভাল আছে?
জ্বী, স্যার, আপনি ছোড়েননি বলেই রক্ষা পেয়েছে ওটা, হারপুনটা দেখিয়ে বলল স্টাব, এই যে।
আমার সামনে রাখো। মারা গেছে কেউ?
এক, দুই, তিন, চার, পাচ–ওই যে পাঁচটা দাঁড়, স্যার, আর এখানে রয়েছে পাঁচজন মানুষ।
বেশ, বেশ। এবার একটু তুলে ধরো, আমি দাঁড়াতে চাই। না দাঁড়ালে যে মবি ডিককে দেখতে পাব না! ওই যে! ওই যে! এখনও যাচ্ছে সে বাতাসের দিকে! কী বিরাট ফোয়ারা! হাত সরাও, আমাকে ধরে থাকতে হবে না। হাড়ের ভেতর থেকে আবার চুইয়ে নামছে অনন্ত প্রাণশক্তি! সব পাল তুলে দাও! এখনই পিছু নাও ওটার!
তিমি শিকারে এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে যে উদ্ধারকৃত নৌকোর নাবিকেরা উদ্ধারকারী নৌকোর নাবিকদের সঙ্গে যোগ দেয়। পেকোডেও সেরকমই ঘটল। স্টাবের নাবিকদের সঙ্গে দাঁড় ধরল আহাবের নাবিকেরা। দ্বিগুণ শক্তি পেয়ে তীরবেগে এগোতে লাগল হোয়েল-বোট। কিন্তু তিমির শক্তির কাছে মানুষের মিলিত শক্তিও কিছুই নয়। মবি ডিক তার সাঁতারের বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে। এখন তার কাছে যাওয়া একেবারে অসম্ভব না হলেও দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার, অত সময় ধরে দাঁড় টানার শক্তি বজায় রাখা কোন নাবিকের পক্ষেই সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে জাহাজ এগিয়ে আসে সাহায্য করার জন্যে। ভাঙা নৌকোটাকে আগেই তোলা হয়েছিল, এবার নাবিকসহ স্টাবের নৌকোটাকে তুলে নিয়ে দুপাশের পাল তুলে পেকোড এগোতে লাগল অ্যালবাট্রসের মত। মাঝেমধ্যে যখনই ফোয়ারা চোখে পড়ল, চিৎকার করে জাহাজের সবাইকে জানিয়ে দিল মাস্ট-হেডের নাবিকেরা। ডেকে পায়চারি করতে করতে আহাব বলল, ডাবলুনটা এখন কার? তিমিটাকে দেখতে পাচ্ছ কেউ?
কিন্তু ফোয়ারা ছাড়া তিমিটার আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ফলে নাবিকেরা জবাব দিল, না, স্যার। তখন আহাব নিজেই উঠতে চাইল ওপরে, কিন্তু খানিক পরে আবার ডেকে নেমে পায়চারি করতে লাগল সে। এভাবেই কেটে চলল দিনটা।
পায়চারি করতে করতে আহাব কখনও কখনও থামল তার ভাঙা নৌকোটার সামনে। বিষণ্ণ মুখ আরও বিষণ্ণ হয়ে উঠতে লাগল।
ব্যাপারটা লক্ষ করল স্টাব, তারপর ক্যাপটেনের মনে রেখাপাত করার মত কিছু কথা বলার জন্যে এসে দাঁড়াল পাশে। কাঁটাগাছটা বোধ হয় গাধাটার মুখে খুব লেগেছে, স্যার, তাই খেতে চাইল না। হা হা হা।
একটা ভাঙা নৌকোর সামনে দাঁড়িয়ে হাসাটা কিরকম নির্দয় ব্যাপার জানো? আমি তো এতদিন তোমাকে একজন বীরপুরুষই ভেবে এসেছি। কিন্তু এখন শপথ করে বলতে পারি, আসলে তুমি একটা কাপুরুষ। ভাঙা নৌকোর সামনে হাসির শব্দ একেবারে বেমানান।
জী, স্যার, এগিয়ে এল স্টারবাক, এরকম হাসা অশুভ লক্ষণ।
লক্ষণ? উঁহুঁ, ঈশ্বরের যদি কিছু বলার থাকে মানুষকে, তাহলে সরাসরিই বলবে, কোন লক্ষণ-টক্ষণ দেখাবে না। ভাগো এখান থেকে! তোমরা দুজন একই জিনিসের বিপরীত দুই মেরু–স্টারবাককে ওল্টালে স্টাব আর স্টাবকে ওল্টালে স্টারবাক। কোটি কোটি মানুষের মধ্যে আহাব মাত্র একজন, ঈশ্বর বা মানুষ কেউই তার প্রতিবেশী নয়! উহ্, কী ঠাণ্ডা! কাপ ধরে যাচ্ছে! এই, আর কিছু দেখতে পেলে তোমরা? ফোয়ারা দেখলেই জানাবে, মুহূর্তে যদি দশ বার ফোয়ারা ছাড়ে–তবু!
দিন প্রায় শেষ। দেখতে দেখতে চারপাশ ঢেকে গেল অন্ধকারে, মাস্ট-হেড থেকে ফোয়ারা দেখা আর সম্ভব নয়।
আর দেখতে পাচ্ছি না, স্যার, খুব অন্ধকার, ভেসে এল একটা কণ্ঠ।
শেষ কোন দিকে যাচ্ছিল?
আগের মতই–বাতাসের দিকে, স্যার।
এখন সে গতি কমিয়ে দেবে, রাত নেমে এসেছে তো। জাহাজের গতি কমিয়ে দাও, ওটার গায়ের ওপর উঠে পড়া চলবে না। মি. স্টাব, সারা রাতের জন্যে কাউকে তুলে দাও ফোরমাস্ট-হেডে।–আহাব এবার এগিয়ে গেল মেইনমাস্ট-হেডের কাছে এই ডাবলুন আমার, কিন্তু সাদা তিমিটা না মরা পর্যন্ত আমি এটা খুলে নেব না। মারা যাওয়ার দিন মবি ডিককে যে দেখতে পাবে, স্বর্ণমুদ্রাটা হবে তার। তবে সেদিনও আমিই যদি তিমিটাকে প্রথম দেখতে পাই, তাহলে দশটা স্বর্ণমুদ্রার সমান টাকা ভাগ করে দেব তোমাদের মাঝে!
হ্যাটটাকে আরও নামিয়ে ডেকের একপাশে গিয়ে দাঁড়াল আহাব। তারপর একইভাবে ওখানে দাঁড়িয়ে রইল ভোর পর্যন্ত। মাঝে মাঝে তন্দ্রা ভেঙে শুধু চমকে উঠে দেখল, কিভাবে কেটে যাচ্ছে দীর্ঘ রাত।
১১০.
সকালে তিন মাস্ট-হেডেই তুলে দেয়া হলো নতুন নাবিক।
দেখতে পাচ্ছ তিমিটাকে? জানতে চাইল আহাব।
না, স্যার।
সব পাল তুলে দাও! যতখানি ভেবেছিলাম, তিমিটা তার চেয়ে অনেক জোরে যাচ্ছে–রাতে পালগুলো তুলে রাখাই উচিত ছিল। তবে এক দিক দিয়ে এটা ভাল হয়েছে–কাজের আগে বিশ্রাম।
এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। দিনের পর দিন মাত্র একটা তিমির পিছু নেয়া কিন্তু সহজ কাজ নয়। দিনের আলোয় দেখা গেলেও রাতে তিমিকে দেখা যায় না। তখন নিখুঁতভাবে অনুমান করতে হয়, রাতের মধ্যে মাছটা কোন দিকে কতখানি এগোতে পারে।
দ্রুত এগিয়ে চলেছে পেকোড।
ডেকে পায়চারি করতে করতে পায়ে একেবারে খিল ধরে গেল! বলল স্টাব। তবে জাহাজটার মতই সাহসী আমি! হা হা! ছুঁড়ে দাও আমাকে সাগরে, চলতে থাকব জাহাজের মতই!
ওই যে ফোয়ারা তুলছে! ফোয়ারা তুলছে! ঠিক সামনে! ভেসে এল মাস্টহেড নাবিকের চিৎকার।
হ্যাঁ হ্যাঁ, বলল স্টাব, আমি জানতাম, পালাতে তুমি পারবে না, বাবা তিমি, ফোয়ারা তুলতে তুলতে ফাটিয়ে ফেলো তোমার স্পাউট, স্বয়ং শয়তান পিছু নিয়েছে, তোমার আর নিস্তার নেই!
পেকোডের নাবিকরা উত্তেজনায় টান টান হয়ে আছে। গত কাল দিন এবং রাতের পর আবার উত্তেজনা জেগে উঠেছে তাদের মধ্যে। নির্দিষ্ট একটা তিমি এই উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু। সব পাল তুলে দেয়ায় পেকোড প্রায় উড়ে চলল।
তিরিশজন নাবিক এই মুহূর্তে আর তিরিশজন নেই, এক হয়ে গেছে। তাদের সাহস-ভয়-আশা আকাঙ্ক্ষা সব গাঁথা পড়েছে এক নিয়তির সুতোয়। আহাবের ইচ্ছের কাছে সবাই সঁপে দিয়েছে নিজেদের সত্তা।
আরে, তোমরা তিমিটা সম্বন্ধে আর কিছু বলছ না কেন? মাস্ট-হেড নাবিকদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ল আহাব। আমাকে তুলে নাও ওপরে, দেখায় তোমাদের ভুল হতে পারে। একবার মাত্র ফোয়ারা তুলে অদৃশ্য হয়ে যাবে, মবি ডিক সেরকম বস্তু নয়।
আহাব ভুল বলেনি। উত্তেজনার মাথায় মাস্ট-হেড নাবিক অন্য কোন জিনিসকে মনে করেছে তিমির ফোয়ারা। আহাব ওপরে উঠতে না উঠতেই পেকোডের মাত্র মাইলখানেক সামনে ভেসে উঠল মবি ডিক।
ওই যে! ওই যে! সম্মিলিত চিৎকার ছাড়ল নাবিকরা। অতিকায় শরীর নিয়েও মবি ডিক স্যামন মাছের মত লাফিয়ে উঠল শূন্যে। আকাশ আর সাগরের নীল মিলেমিশে একাকার হওয়ায় ফোয়ারাটাকে মনে হলো হিমবাহের মত ঝকঝকে।
হ্যাঁ, শেষ বারের মত লাফিয়ে নে, বলল আহাব, সময় তোর শেষ হয়ে এসেছে। নৌকো নামাও! শিগগির!
মবি ডিককে দেখার জন্যে যেসব নাবিক দড়াদড়ি বেয়ে ওপরে উঠেছিল, ঝটপট নেমে এল তারা। নামল আহাবও।
গতকাল বিকেলে অতিরিক্ত একটা নৌকো ঝোলানো হয়েছিল ক্যাপটেনের জন্যে। সেটাতে উঠেই আহাব বলল, নামিয়ে দাও! মি. স্টারবাক, তুমি জাহাজ নিয়ে সরে যাও। তবে দেখো, নৌকোগুলো থেকে একেবারে দূরে যেয়ো না আবার। নামাও আমার নৌকো, এই মুহূর্তে!
যেন একটা আতঙ্ক ছড়ানোর উদ্দেশ্যে মবি ডিক এগিয়ে আসতে লাগল নৌকো তিনটের দিকে। মাঝখানে রয়েছে আহাবের নৌকো। তিমির মাথা বরাবর নাবিকদের এগোতে বলল সে। এটা একটা কৌশল, একেবারে সামনের দিকে দেখতে পায় না তিমি। হঠাৎ গতি বাড়িয়ে, হাঁ করে লেজ আছড়াতে আছড়াতে ছুটে এল মবি ডিক। হারপুন ছুঁড়ল তিনটে নৌকো, কিন্তু তিমিটা সেসবের তোয়াক্কাই করল না, নৌকোগুলোকে খণ্ড বিখণ্ড করলে তবে যেন তার শান্তি। কৌশলের সঙ্গে আঘাত এড়িয়ে যেতে লাগল নৌকো তিনটে, আর এই হুটোপাটির মাঝেও আদেশ দিয়ে চলল আহাব।
এদিকে মবি ডিক একবার এই নৌকো একবার ওই নৌকোর দিকে ছোটার ফলে প্যাচ লেগে গেছে হারপুনের লাইনগুলোতে। আহাব লক্ষ করল, নৌকো থেকে ছোড়া অসংখ্য বর্শা আর হারপুনের প্রান্ত হাঙরের দাতের মত এগিয়ে আসছে তার নৌকোর দিকে। ঝটপট ছুরি তুলে নিয়ে নৌকোর লাইনগুলো কেটে দিল আহাব। মুক্ত হলো তার নৌকো, কিন্তু আটকা পড়ে রইল স্টাব আর ফ্লাস্কের নৌকো দুটো।
এতক্ষণ সম্ভবত একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল তিমিটা, এবার সোজা ছুটে এসে আঘাত হানল দুই নৌকোয়। তক্তাগুলো খুলে গেল, কে কোথায় ছিটকে পড়ল তার কোন ঠিক নেই। পানিতে বিশাল এক বাদামী আলোড়ন তুলে ডুবে গেল মবি ডিক।
ভাঙা দুই হোয়েল-বোটের নাবিকেরা পাগলের মত এদিক-সেদিক সঁতরাচ্ছে ভেসে যাওয়া টাব, দাঁড় এবং অন্যান্য জিনিসপত্র ধরার জন্যে। শূন্য শিশির মত ওঠানামা করছে ফ্লাস্কের মাথা। উদ্ধার পাবার জন্যে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে স্টাব। আহাব এগিয়ে গেল তাদের দিকে। হঠাৎ পানি ছেড়ে শূন্যে উঠে গেল তার নৌকো। বিশাল কপাল দিয়ে খানিক ঠেলা দেয়ার পর জোর ধাক্কা লাগাল সাদা তিমিটা। শূন্যে উঠে গেল আহাবের নৌকো, তারপর কয়েক বার পাক খেয়ে আছড়ে পড়ল পানিতে। সাগর প্রান্তের গুহায় বাস করা সীলমাছের মত নাবিকদের নিয়ে নৌকোর নিচ থেকে বেরিয়ে এল আহাব।
সামান্য সরে গিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়াল তিমিটা, ভাসমান দাঁড় বা অন্য যেকোন জিনিস লেজের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে গুঁড়িয়ে ফেলল প্রচণ্ড আঘাতে। এভাবে কিছুক্ষণ ধ্বংসলীলা চালাবার পর গতকালের মত আবার রওনা দিল মবি ডিক।
এবারেও উদ্ধার করতে এগিয়ে এল পেকোড। প্রথমে একটা নৌকো নামিয়ে দিয়ে নাবিকদের তুলে নিল, তারপর একে একে তোলা হলো ভাসমান জিনিসপত্র। সৌভাগ্যের বিষয়, কেটে ছড়ে যাওয়া ছাড়া মারাত্মক আঘাত কেউই পায়নি। ডেকে তোলার পর সবার চোখ গিয়ে পড়ল আহাবের ওপর। দাঁড়িয়ে আছে সে স্টারবাকের কাধে ভর দিয়ে, কখন যেন খুলে পড়ে গেছে হাড়ের পা-টা।
স্টারবাক, কখনও কখনও কারও ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ানো সত্যিই খুব আরামের, বিড়বিড় করে উঠল ক্যাপটেন।
জিনিসটা টিকল না, স্যার, এগিয়ে এল ছুতোর, আপনার পা-টা কিন্তু খুব খেটে তৈরি করেছিলাম।
আশা করি কোনও হাড় ভাঙেনি, স্যার, গম্ভীর মুখে বলল স্টাব।
হ্যাঁ, সবকিছু ভেঙে গেলেও হাড় আমার ভাঙেনি। তবে ভাঙা হাড় নিয়েও আহাব পৃথিবীর যে-কোন জিনিসের মোকাবিলা করতে পারে। যাকগে, তিমিটা গেছে কোন্ দিকে?
সোজা বাতাসের দিকে, স্যার।
তাহলে যাও, আবার শক্ত হাতে হাল ধরো। মি. স্টারবাক, নাবিকদের একত্রিত করো!
আগে আপনাকে বুলওয়ার্কে রেখে আসি, স্যার।
হায়রে দুর্ভাগ্য! নির্ভীক যে-ক্যাপটেন জীবনে কাউকে ভয় করেনি, তার কিনা এমন মেট!
কী বললেন, স্যার?
আমার শরীরের অবস্থা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। বেত বা ভাঙা একটা বর্শা দাও, তাহলেই আমি দাঁড়াতে পারব। তুমি নাবিকদের একত্রিত করো। একজনকে আমি দেখতে পাচ্ছি না। হারিয়ে গেছে? শিগগির সবাইকে ডাকো!
বুড়োর সন্দেহই সত্য বলে প্রমাণিত হলো। নাবিকদের জড়ো করার পর দেখা গেল, কামার সেখানে নেই।
কামার নেই, বলল স্টাব, ও নিশ্চয় জড়িয়ে গিয়েছিল তাহলে–
তোমার মুখে পোকা পড়ক! দৌড় দাও সবাই, কেবিন আর ফোকাসলে খুঁজে দেখো, আছেই কোথাও না কোথাও।
কিন্তু খোজাখুঁজি করে ফিরে এল সবাই, কামারকে পাওয়া গেল না।
জ্বী, স্যার, বলল স্টাব, ও জড়িয়ে গিয়েছিল আপনার লাইনের সঙ্গেআমার তো মনে হয় ওকে তলিয়ে যেতেও দেখেছি।
হায় ঈশ্বর! অন্তত একবার মাথা ঠাণ্ডা করে বোঝার চেষ্টা করুন, বলল স্টারবাক। ওই তিমিকে আপনি কখনও মারতে পারবেন না। ঈশ্বরের দোহাই, এই উন্মাদনা ছাড়ন। দুদিন পিছু নিলেন, একের পর এক ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেল নৌকোগুলো, পা-টাও হারালেন। ঈশ্বর আপনাকে বার বার সাবধান করে দিচ্ছেন, এখনও সময় আছে। আসলে কী চান আপনি? আমরা সবাই মারা পড়ি খুনে ওই মাছটার পিছু নিয়ে? আমাদের সবাইকে সে সাগরের অতলে টেনে নিয়ে যাক, এটাই কি আপনি চান?
স্টারবাক, পরে তোমার প্রতি একটা টান জেগেছে আমার। কবে থেকে, সেটা তুমি খুব ভাল করেই জানো। কিন্তু এই তিমিটার ব্যাপারে তোমার ভয় পাওয়া চলবে না। মনে নেই, এই সাদা তিমিটাকে মারার জন্যে কোটি কোটি বছর আগে থেকে মহড়া দিয়ে আসছি আমরা দুজন? এত আগে থেকে যে এই সাগরের জন্মও তখন হয়নি, মনে পড়ে? কিসের এত ভয় তোমার, স্টারবাক? নিয়তির? নিয়তিকে তো আমি নিয়ন্ত্রণ করি। তাছাড়া একটা পা হারিয়েও আমি যদি নির্ভীক থাকতে পারি, তুমি সুস্থ-সবল মানুষ হয়ে কেন কাঁপবে নিয়তির ভয়ে? আচ্ছা, তুমি এসব লক্ষণ-টক্ষণ বিশ্বাস করো? যদি তা-ই করো, তাহলে ভেবে নাও, তিমিটার শেষ লক্ষণ আমরা দেখেছি। দুবার ডোবার পর দুবার উঠেছে তিমিটা। আগামীকাল সে উঠবে শেষ বারের মত ডোবার জন্যে। তৃতীয় বার ওঠাই হবে তার শেষ ওঠা। কি, সাহস একটু জাগছে এখন?
আমার ভয়-ডর সব উবে গেছে, স্যার, বলল স্টাব। আমি এখন আগুনের মত নির্ভীক।
এবং আগুনের মত যান্ত্রিক, বিড়বিড় করতে করতে এগিয়ে এল আহাব। ওহ্, এসবকে নাকি লক্ষণ বলে! কামার, কামার, সত্যিই কি নেই সে? মরার আগে আরেকবার তার দেখা নিশ্চয় পাব–কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? এ-ধাধা তো মাথায় ঢুকছে না–তবু এর সমাধান আমি করবই।
গোধূলি নেমে এল, তিমিটা তখনও বাতাসের দিকেই চলেছে।
গত রাতের মতই আবার খাটো করা হলো পাল, কমে এল পেকোডের গতিবেগ। কানে আসতে লাগল শুধু হাতুড়ির শব্দ, লণ্ঠনের আলোয় জাহাজের গায়ে আবার হোয়েল-বোট ঝোলানোর তোড়জোড় চলছে, অস্ত্রপাতিতে শান দিচ্ছে কেউ কেউ। হ্যাট মাথায় ডেকের একপাশে সারা রাত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল আহাব, প্রথম সূর্যের আলো দেখার আশায় দৃষ্টি স্থির পুবাকাশে।
১১১.
তাজা বাতাস বয়ে নিয়ে এল তৃতীয় দিনের ভোর। প্রত্যেকটা মাস্ট-হেডে তুলে দেয়া হলো নতুন নাবিক।
তিমিটাকে দেখতে পাচ্ছ তোমরা? জানতে চাইল আহাব। না-সূচক জবাব দিল সবাই।
লক্ষ রাখো সবাই, তীক্ষ্ণ চোখে নজর রাখো চারদিকে। আহ, আবার কী চমৎকার একটা দিন! এর চেয়ে সুন্দর ভোর আর হতে পারে না। এই পরিবেশে চিন্তার খোরাক আছে, কিন্তু আহাব কখনও চিন্তা করে না। সে শুধু অনুভব করে। অনুভব–নশ্বর মানুষের পক্ষে ওটুকুই যথেষ্ট! চিন্তা করা ধৃষ্টতা চিন্তা করার অধিকার রয়েছে কেবল ঈশ্বরের। কারাগার আর হাসপাতাল থেকে বয়ে আসা বিশ্রী বাতাস এখানে এসে সুন্দরের পোশাক পরেছে। আমি বাতাস হলে দুর্দশাগ্রস্ত এই পৃথিবীতে কখনোই বইতাম না। তবে এটা ঠিক যে বাতাসের মধ্যে একটা বীরত্বব্যঞ্জক ব্যাপার রয়েছে। আজ পর্যন্ত কে তাকে জয় করতে পেরেছে? যেকোন লড়াইয়ে সে-ই জয়ী হয় শেষমেশ। যাকগে, চোখ তীক্ষ করো সবাই। কী দেখতে পাচ্ছ?
কিচ্ছু না, স্যার।
কিচ্ছু না! এদিকে যে প্রায় দুপুর হয়ে এল! কারও কাছে যাবার জন্যে ডাবলুনটা অস্থির হয়ে উঠেছে। আমরা নিশ্চয় পেরিয়ে এসেছি তিমিটাকে। এখন আমরা তাকে অনুসরণ করছি না, সে-ই আমাদের অনুসরণ করছে। হ্যাঁ, গত রাতেই তিমিটাকে পেছনে ফেলে দিয়েছি আমরা। জাহাজ ঘোরাও! মাস্ট-হেডের কজন ছাড়া নেমে এসো আর সবাই।
ঘুরে বাতাসের উল্টো দিকে চলতে লাগল পেকোড।
আপনমনে বিড়বিড় করে স্টারবাক বলল, ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন। কিন্তু হাড়-মাংস ভেতর থেকে কেমন জমে যেতে চাইছে। তাকে মান্য করার ফলে আমি বুঝি ঈশ্বরকে অমান্য করছি!
আমাকে ওপরে টেনে তোলো, এগোতে এগোতে বলল আহাব। শিগগিরই ওটাকে দেখতে পাব আমরা।
জ্বী, স্যার, আবার আহাবের আদেশ পালন করল স্টারবাক, ঝুড়িতে বসে দুলতে দুলতে ওপরে উঠে গেল ক্যাপটেন।
দেখতে দেখতে কেটে গেল একটা ঘণ্টা। সময়ও যেন উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠেছে। অবশেষে ওয়েদার বো থেকে তিন পয়েন্ট সামনে ফোয়ারা দেখতে পেল আহাব। একইসঙ্গে তিন মাস্ট-হেড নাবিকেরও চোখে পড়ল ফোয়ারাটা। পরমুহূর্তে বাতাস বিদীর্ণ হলো তাদের চেঁচামেচিতে।
এই নিয়ে তিন বার তোর মুখোমুখি হব, মবি ডিক। মি. স্টারবাক, এখন নৌকো নামানো যাবে না, তিমিটা দূরে আছে। বেশ জোরেই যাচ্ছে সে, আমাকে নামতে হবে এখান থেকে। তবে নামার আগে আরেক বার সাগরটাকে দেখে নিই। পুরনো একটা দৃশ্য, তবু যেন চির নতুন। সেই কবে, ছোটবেলায়, প্রথম সাগর দেখেছিলাম ন্যানটাকেটের বালিয়াড়ির ওপর থেকে, অথচ আজও তার এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। নূহু নবী যেমন দেখেছিল, সাগর আজও ঠিক তেমনি আছে। মাস্ট-হেড, তিমিটার ওপর চোখ রাখো।
ঝুলতে ঝুলতে ডেকে নেমে এল আহাব।
যথাসময়ে নামানো হলো নৌকো। ওঠার আগে চীফ মেটকে ডাকল আহাব।
স্টারবাক!
বলুন, স্যার।
তৃতীয় বার আমার নৌকো তিমিটার পিছু নিতে যাচ্ছে।
জ্বী, স্যার।
স্টারবাক, কোন কোন জাহাজ বন্দর থেকে বেরোয় কিন্তু আর কখনোই বন্দরে ফিরে আসে না।
ঘটনাটা দুঃখজনক হলেও সত্য।
জোয়ার-ভাটার সময় মানুষ মরে, মরে অগভীর পানিতেও। আমি বুড়ো মানুষ, স্টারবাক। এসো, হাত মেলাও আমার সঙ্গে।
মিলে গেল দুজোড়া হাত, সামনাসামনি তাকিয়ে চোখ ভিজে উঠল স্টারবাকের।
ক্যাপটেন, ক্যাপটেন, দয়া করে যাবেন না!
নৌকো নামাও! ঝটকা মেরে স্টারবাকের হাত সরিয়ে দিল আহাব। নাবিকেরা প্রস্তুত হও!
নৌকো নিয়ে আসা হলো স্টার্নের ঠিক নিচে। হাঙর! হাঙর! চেঁচিয়ে উঠল কে যেন, ক্যাপটেন, যাবেন না! কিন্তু আহাব সেই চিৎকার শুনেও শুনল না।
নৌকো জাহাজ থেকে সামান্য সরে যেতেই পানির নিচ থেকে উঠে এল দলে দলে হাঙর। প্রত্যেক বার ডুব মারার আগে কামড় বসাতে লাগল দাড়ে। এই দৃশ্যটা অবশ্য দুর্লভ নয়। অনেক সময়েই হোয়েল-বোটকে অনুসরণ করে হাঙরের দল। তবে সাদা তিমিটাকে দেখার পর এই প্রথম হাঙর চোখে পড়ল। এগোতে লাগল ওগুলো আহাবের নৌকোর পিছে পিছে, অন্য নৌকোগুলোর কোনরকম অসুবিধে সৃষ্টি করল না।
হঠাৎ নিচের দিকে হাত দেখিয়ে একটা ইশারা করল মাস্ট-হেডের নাবিক। আহাব বুঝতে পারল, তিমিটা শব্দ করেছে। কিন্তু মাছটার আরও কাছে যাবার জন্যে নৌকো থামাবার নির্দেশ দিল না।
কখনও কোন কফিন আমার কাজে লাগবে না, আমার মৃত্যু হতে পারে একমাত্র শণের দড়িতে! হা! হা! হা! উন্মাদের মত হাসছে আহাব।
চারপাশের পানি ফুলে উঠতে লাগল, নিচ থেকে ভেসে এল একটা গুম গুম শব্দ। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগল নাবিকেরা। ভৌতিক একটা প্রকাণ্ড সাদা মূর্তি ভেসে উঠল ধীরে ধীরে, শরীরের পাশ থেকে ঝুলছে অসংখ্য লাইন, হারপুন আর বর্শা। পানি থেকে ত্রিশ ফুট ওপরে মাথা তুলল মবি ডিক, চারপাশের পানি রূপান্তরিত হলো কাঁচা দুধে।
এগোও! দাঁড়িদের উদ্দেশে চিৎকার করল আহাব। আক্রমণের জন্যে ছুটে এল মবি ডিক। অন্য নৌকো দুটোর গলুই ভেঙে গেল, কিন্তু অক্ষত রয়ে গেল আহাবেরটা।
ভাঙা গলুই তোলার জন্যে ঝুঁকে পড়ল ডাগ আর কুইকেগ। সাদা তিমিটা সরে যেতে লাগল। বিস্ফারিত চোখে সবাই দেখল, তিমিটার পাঁজরের কাছে জট পাকানো লাইনে আটকে রয়েছে কামারের প্রায় দুটুকরো হয়ে যাওয়া মৃতদেহ। পোশাক ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, খোলা দুই চোখ সোজা তাকিয়ে রয়েছে আহাবের দিকে।
হারপুন পড়ে গেল ক্যাপটেনের হাত থেকে।
তাহলে আবার দেখা হলো তোমার সঙ্গে, কয়েক মুহূর্ত দম বন্ধ করে রাখার পর বলল সে। মেটরা, জাহাজে চলে যাও, নৌকো মেরামত করে পারলে ফিরে আসো। মরার জন্যে আহাব একাই যথেষ্ট–কি ব্যাপার, দাঁড়িয়ে রইলে কেন? যাও, যাও, তোমরাই তো আমার হাত-পা, সুতরাং অবাধ্য হয়ো না। তিমিটা কোথায়? আবার ডুব মেরেছে?
নিচু হয়ে বেশ কিছুক্ষণ খোজাখুঁজি করল আহাব। না, কাছে কোথাও নেই তিমিটা। তারপর মাথা তুলতে সে দেখল, মবি ডিক পেকোড পেরিয়ে যাচ্ছে।
ওই যে, ক্যাপটেন, বলল স্টারবাক, এখনও সময় আছে, ফিরে আসুন। দেখছেন না, তিমিটা চলে যাচ্ছে? মবি ডিক আপনাকে খুঁজছে না, আপনিই তাকে খুজছেন!
কিন্তু পাল তুলে দ্রুত বেগে আবার ধাওয়া শুরু করল আহাব। পেকোডের পাশে আসতে দেখল, ট্যাসটেগো, কুইকেগ আর ডাগগু ইতিমধ্যেই উঠে পড়েছে মাস্ট-হেডে। রেলিংয়ে ঝুঁকে থাকা স্টারবাককে ধীরে ধীরে অনুসরণ করতে বলল সে। পোর্টহোল দিয়ে স্টাব আর ফ্লাস্ককেও সে দেখতে পেল এক ঝলক, দুজনেই নতুন হারপুন আর বর্শা খোজায় ব্যস্ত। হাতুড়ির শব্দও কানে এল তার, মেরামত হচ্ছে ভাঙা নৌকো।
গতি ইতিমধ্যে কমিয়ে দিয়েছে মবি ডিক। হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তিন দিনের দৌড়াদৌড়িতে, কিংবা হারপুন আর বর্শার আঘাতে। প্রায় কাছাকাছি এসে পড়ল আহাবের হোয়েল-বোট। হাঙরের পাল তখনও পিছু ছাড়েনি। মাঝে মাঝেই কামড় বসাচ্ছে তারা, ফলে এবড়োখেবড়ো হয়ে যাচ্ছে দাঁড়।
ব্যাটাদের পাত্তা দিয়ো না, ওরা কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
কিন্তু, স্যার, শয়তানগুলোর কামড়ে দাড় যে ছোট হয়ে আসছে।
এই দাঁড়ই আরও অনেকক্ষণ টিকবে! বেয়ে যাও!–কিন্তু কে জানে, বিড়বিড় করতে লাগল আহাব, কাকে খাবার জন্যে পিছু নিয়েছে হাঙরের দল, তিমিটাকে না আমাকে!–যা-ই হোক, দাড় বেয়ে যাও তোমরা! হাল ধরো! আমাকে সামনে যেতে দাও। দুজন নাবিকের সাহায্যে নৌকোর সামনে এসে দাঁড়াল সে।
অবশেষে মবি ডিকের পাশে এসে পড়ল হোয়েল-বোট। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে সাদা কুঁজ, কুয়াশার ফোয়ারা যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। অভিশাপ দিতে দিতে হারপুন ছুঁড়ল আহাব। প্রায় সকেট পর্যন্ত ঢুকে গেল হারপুন। যন্ত্রণায় মোচড় খেলো মবি ডিক, টু লাগল নৌকোতে। গানেল আঁকড়ে ধরে না থাকলে আবার সাগরে পড়ে যেত আহাব। তবে সে ছাড়া বাকি তিন নাবিক ছিটকে পড়ল পানিতে। দুজন সঙ্গে সঙ্গে উঠে এল হাঁচড়ে-পাচড়ে, কিন্তু একজন সাঁতরাতে লাগল অসহায়ভাবে। নৌকো ততক্ষণে ছুটতে শুরু করেছে মবি ডিকের টানে।
নৌকোর মুখ ঘুরিয়ে নিতে বলল আহাব। ব্যস্ত হয়ে উঠল নাবিকেরা, কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে টান লেগে ছিঁড়ে গেল লাইন।
কি ছিঁড়ে গেল আমার ভেতরে? মাংসপেশী? না, জোড়া লেগে গেছে আবার। দাঁড় বাও সবাই! জোরে জোরে!
ঘুরতেই তিমিটার চোখে পড়ল এগিয়ে আসা জাহাজের কালো হাল। সম্ভবত সে ভাবল, এটা আরও বড় কোন শত্রু। ছড়ানো ফেনার মাঝে হাঁ করে জাহাজের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল তিমিটা।
টলে উঠল আহাব, হাত বাড়ি খেলো কপালের সঙ্গে। সবকিছু আঁধার হয়ে এল কেন? রাত নামল নাকি?
সাদা তিমি! জাহাজ! চিৎকার করে উঠল এক নাবিক।
এগোও সবাই! হে সাগর, একটা শেষ সুযোগ দাও, আহাব যেন লক্ষ্যভেদ করতে পারে। জাহাজ! জাহাজ! আরও জোরে দাড় বাও! তোমরা কি আমার জাহাজটাকে রক্ষা করবে না? আহাবের কণ্ঠে আক্ষেপ ফুটে উঠল।
কিন্তু হোয়েল-বোট জাহাজের কাছে যাবার আগেই তিমিটা যেখানে আঘাত হেনেছিল, সেখান থেকে খুলে পড়ল দুটো তক্তা। হুড় হুড় করে পানি ঢুকতে লাগল, তোড় ঠেকাবার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল নাবিকেরা।
মাস্ট-হেড থেকে ট্যাসটেগো দেখল, হাঁ করে এগিয়ে আসছে তিমিটা। নিচ থেকে স্টাব আর ফ্লাস্কও দেখতে পেল এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য।
তিমি! তিমি! এরকম অসহায়ভাবে স্টারবাককে মরতে দিয়ো না! এখানেই কি তাহলে আহাবের সব প্রার্থনার ইতি হতে যাচ্ছে? ওই যে, ভয়ঙ্কর চোয়াল খুলে এগিয়ে আসছে দানবটা। ঈশ্বর, আমার পাশে এসে দাঁড়াও! পাগলের মত প্রলাপ বকছে আহাব।
জাহাজের বো থেকে অসহায়ের মত ঝুলছে নাবিকরা। হাতে তাদের হাতুড়ি, তক্তার টুকরো, বর্শা, হারপুন। মবি ডিকের দিকে চেয়ে তাদের দুচোখ বিস্ফারিত। ফেনা কেটে তীব্র গতিতে ছুটে এল সাদা মাথাটা, প্রচণ্ড ধাক্কা মারল স্টারবোর্ড বোতে। ছিটকে পড়ল সবাই, জাহাজে পানি ঢুকতে লাগল পাহাড়ী ঢলের মত।
জাহাজের নিচে ঢুকে উল্টো পাশ দিয়ে বেরিয়ে এল মবি ডিক, তারপর চুপচাপ ভেসে রইল আহাবের হোয়েল-বোটের কয়েক গজ দূরে।
ট্যাসটেগো, তোমার হাতুড়ির শব্দ শুনতে পাচ্ছি না কেন? আমার হার-নামানা তিন বীরও কি তাহলে হার মানল? নাবিকদের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করার গৌরবও কি তাহলে আমার ভাগ্যে জুটবে না? নিঃসঙ্গ জীবনের নিঃসঙ্গ পরিসমাপ্তি! মবি ডিক, সব ধ্বংস করেও তুই অপরাজেয়। কিন্তু শেষ নিশ্বাসেও আমি তোর প্রতি ছুঁড়ে দেব রাশি রাশি ঘৃণা! :
হারপুন ছুঁড়ল আহাব। ছুটতে লাগল হারপুন বিদ্ধ মবি ডিক। টাবের গা থেকে খুলে গেল লাইন, তারপর প্যাচ লাগল হঠাৎ। দ্রুত ঝুঁকে পড়ে প্যাচ খুলে দিতে গেল আহাব, কিন্তু হাত লাগাবার আগেই উড়ন্ত লাইনে জড়িয়ে গেল সে, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গিয়ে পড়ল পানিতে। শূন্য টাব থেকে একসময় ছিঁড়ে চলে গেল লাইন, টাবের আঘাতে ছিটকে পড়ে তলিয়ে গেল এক নাবিক।
বিস্ময়ে এক মুহূর্ত পাথর হয়ে রইল হোয়েল-বোটের নাবিকেরা, তারপর ফিরল জাহাজের দিকে। কিন্তু কোথায় জাহাজ? ঘূর্ণির মাঝে জেগে আছে কেবল তার তিনটে মাস্ট-হেড; কুইকেগ, ডাগ আর ট্যাসটেগো তখনও লটকে আছে সেখানে। হঠাৎ হোয়েল-বোটটা ছুটে গেল সেই ঘূর্ণিজলের দিকে, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পেকোডের চিহ্নমাত্র রইল না। তবে পেকোড সম্পূর্ণ ডুবে যাবার আগে একটা কাণ্ড ঘটল। শয়তান যেমন স্বর্গীয় কোন জিনিস সঙ্গে না নিয়ে নরকে যাবে না, ঠিক তেমনি পেকোডের মেইন মাস্ট-হেডে ওড়া পতাকায় জড়িয়ে তলিয়ে গেল একটা সামুদ্রিক পাখি।
ঘূর্ণিজলের কাছ দিয়ে উড়তে লাগল ছোট ছোট পাখিরা, ফেনা আছড়ে পড়ল এদিক-সেদিক। তারপর একসময় সব শান্ত হয়ে এল, শুধু গড়িয়ে যেতে লাগল প্রকাণ্ড সব ঢেউ, মহাসাগরে যে-ঢেউ গড়াত পাঁচ হাজার বছর আগেও।
শেষ কথা
নাটকের যবনিকা পড়ে গেছে। তাহলে কেন আবার এই দৃশ্যের অবতারণা? কারণ, পেকোডের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে একজন রেহাই পেয়েছিল।
কামার মারা যাবার পর আমি যোগ দিয়েছিলাম আহাবের হোয়েল-বোটের নাবিকদের সঙ্গে। তৃতীয় দিনে হোয়েল-বোটে মবি ডিকের টু লেগে দুজন নাবিকের সঙ্গে ছিটকে পড়লাম পানিতে। ওরা দুজন ঝটপট উঠে পড়ল আবার, আমি উঠতে পারলাম না। ভাসতে ভাসতে একসময় এগিয়ে চললাম ঘূর্ণিজলের দিকে। উথালপাতাল হচ্ছে ক্রীম-রঙা সাগর, সামনে মুখ ব্যাদান করে আছে নিশ্চিত মৃত্যু। হঠাৎ চোখে পড়ল কালোমত কি যেন একটা। দেখি, কুইকেগের কফিনে তৈরি সেই লাইফ-বয়া, কখন যেন ছিঁড়ে পড়ে গেছে পেকোডের গা থেকে। উঠে পড়লাম ওটায়। মাথার ওপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তে লাগল ঠোঁটবাঁকা সামুদ্রিক পাখির দল, লাইফ-বয়া ঘিরে ভদ্রলোকের মত সাঁতরে চলল হাঙরের পাল–একবারও কামড়াল না তারা। পুরো এক দিন এক রাত ভাসার পর দেখা হলো র্যাচেলের সঙ্গে। জাহাজটা তখনও খুঁজছিল ক্যাপটেনের সেই হারানো ছেলেকে, কিন্তু একজন এতিমকে পেল তার পরিবর্তে।