মবি ডিক: ৮১-৯০. যে-তিমিটার জন্যে এত কাণ্ড

মবি ডিক: ৮১-৯০. যে-তিমিটার জন্যে এত কাণ্ড

৮১-৯০. যে-তিমিটার জন্যে এত কাণ্ড

৮১.

যে-তিমিটার জন্যে এত কাণ্ড, সেটা অবশ্য মারা পড়েছিল। যথাসময়ে সেটাকে ঝোলানো হয়েছিল পেকোডের পাশে এবং কাটাকাটিও করা হয়েছিল।

তিমি মারার পর কত কাজ থাকে। অনেকে শুধু বালতি টানাটানি করে। এক বালতি পার্মাসেটিতে ভরে গেলে সেটা সরিয়ে রেখে আনতে হয় আরেকটা বালতি। পরে এই ভরা বালতিগুলো আবার ঠিক করতে হয় ট্রাই-ওয়র্কসে যাবার আগে।

স্পার্মাসেটি কখনও কখনও জমে দলা দলা হয়ে যায়। তখন আমাদের কাজ সেই দলাগুলোকে টিপে টিপে আবার তরল আকারে নিয়ে আসা। বসে বসে সারা সকাল টিপতে টিপতে অনেক সময় সঙ্গীর আঙুলই টিপতে শুরু করি স্পার্মাসেটির দলা ভেবে।

এসব কাজের পাশাপাশি তিমি টুকরো করে প্রস্তুত করতে হয় ট্রাই-ওয়র্কসের জন্যে। মাঝরাতে নতুন কেউ তিমি কাটা দেখলে আঁতকে উঠতে পারে। পুরো জায়গাটা পরিণত হয় বিশাল এক কসাইখানায়। কাটার সময় স্পেডম্যান তিমির ওপর ওঠে খালি পায়ে, ফলে মাঝেমাঝেই তার পা হড়কে যায়। হয়তো ভাবছেন, এতে কখনও তার নিজের বা সঙ্গীর পায়ের আঙুল কেটে যায় কিনা। অভিজ্ঞ স্পেডম্যানদের খুব কম জনেরই পায়ের পাঁচটা আঙুল আস্ত থাকে।

৮২.

তোলা নৌকো ছাড়াও আমেরিকান হোয়েল-শিপের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো এর ট্রাই-ওয়র্কস। এটাকে দেখলে মনে হয়, ইটখোলা থেকে যেন তুলে আনা হয়েছে আস্ত এক ইটের পাজা।

ডেকে ফোরমাস্ট আর মেইনমাস্টের মাঝখানের জায়গাটা সবচেয়ে প্রশস্ত বলে সেখানেই স্থাপন করা হয় ট্রাই-ওয়স। এর নিচের তক্তাগুলো এতই শক্ত যে পাঁচ ফুট উচ্চতার, দশ বাই আট ফুটের একটা ইট বা চুনসুরকির বোঝা বহন করতে পারে। ট্রাই-ওয়র্কসের ওপরটা ঢালু এক হ্যাচওয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ ঢাকা। হ্যাচটা সরালেই চোখে পড়বে বিরাট দুই পাত্র, একেকটার ধারণ ক্ষমতা বেশ কয়েক ব্যারেল। যখন কাজ থাকে না, তখনও পাত্র দুটোকে রাখা হয় ঝকঝকে পরিষ্কার। রাতের পাহারার সময় বুড়ো অনেক নাবিক পাত্রে ঢুকে ঘুম দিয়ে নেয়। ট্রাই-ওয়র্কসে তিমিকে জ্বাল দেয়া হয় তিমিরই তেলে।

৮৩.

পেকোডের ট্রাই-ওয়র্কস থেকে নেমে যদি ফোকাসলে যান, হঠাৎ করে মনে হবে, যেন হাজির হয়েছেন কোন রাজা-বাদশার আলোকিত সমাধিতে।

ব্যবসায়ীদের জাহাজে তেল দুধের চেয়েও দুপ্রাপ্য। তারা কাপড় পরে আঁধারে, খায় আঁধারে, আঁধারে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খায়। কিন্তু তিমি শিকারীদের বসবাসই আলোর মাঝে। নিচ্ছিদ্র আঁধার রাতেও হোয়েল-শিপে আলো চোখে পড়বে আপনার।

হোয়েলম্যানরা আলো ব্যবহার করে স্বাধীনভাবে। তাদের হাতে হাতে প্রদীপ, হোক না তা পুরানো বোতল, শিশি, কিংবা এলের মগে তৈরি। তারা পোড়ায় সবচেয়ে খাটি তেল। এই তেলের গন্ধ অবিকল এপ্রিলের গ্রাস বাটার। খাটি তেল পাবার জন্যে নিজেই তেল সংগ্রহ করে তিমি শিকারী, ঠিক যেমন প্রেইরির কোন ভ্রমণকারী জুটিয়ে নেয় তার রাতের খাবার।

৮৪.

তিমি মারার পর সেটাকে নিয়ে কি কি করা হয়, তার প্রায় সব বর্ণনাই দিয়েছি। এবার বলব শেষ কাজের কথাটা।

তেল জ্বাল দেয়া হলে সরিয়ে নেয়া হয় ট্রাই-ওয়র্কস, প্রকাণ্ড দুই পাত্র ঢুকে পড়ে হ্যাচে। তারপর গরম গরমই তেলগুলোকে ভরা হয় ছয় ব্যারেলের সব পিপেয়। মাঝরাতের মৃদু বাতাসে জাহাজ যখন অল্প অল্প দুলছে, হয়তো তখনই খুলে দেয়া হয় তার পেট। নাবিকেরা পিপে বয়ে এনে সেখানে সাজিয়ে রাখে। তেল ঠাণ্ডা হলে আবার বন্ধ হয়ে যায় জাহাজের পেট। নাবিকেরা বিশ্রাম নিতে যায়।

কাজ শেষের পরিষ্কার ডেক দেখলে ধারণা করা অসম্ভব যে এখানেই এত সব কর্মকাণ্ড হয়েছে। কিন্তু কাজ কি সত্যিই শেষ হলো নাবিকদের? মোটেই না। সকালের বাতাস উপভোগ করতে করতে হয়তো তারা কেবল জামার বোতাম লাগাচ্ছে, তখনই চিৎকার মাস্ট-হেড থেকে ওই যে, ওই যে ডাকছে! সুতরাং নামাও নৌকো, ছোট তিমির পেছনে। সমাপ্ত হয়ে যাওয়া কাজ আবার শুরু করো গোড়া থেকে।

৮৫.

এই জাহাজ, সাদা তিমিটাকে দেখেছেন?

মুখের সামনে হাত গোল করে চেচাল আহাব। পতাকা বলছে, জাহাজটা ব্রিটিশ। ক্যাপটেনের বয়স মোটামুটি ষাট, স্বাস্থ্যবান, সুন্দর চেহারা, দাঁড়িয়ে রয়েছে বোতে। পরনে জ্যাকেট, একটা হাতা পিঠের পেছনে উড়ছে।

সাদা তিমিটাকে দেখেছেন?

এটা দেখেছেন? জ্যাকেটের ভেতর থেকে বের করে, স্পার্ম তিমির হাড়ে তৈরি সাদা ধপধপে একটা হাত দেখাল ভদ্রলোক।

আমার নৌকো নামাও! ছটফট করে উঠল আহাব।

নিজের জাহাজে আহাবকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল ভদ্রলোক। কিন্তু আহাবের আর তর সইছিল না। বলল, কোথায় দেখেছেন সাদা তিমিটাকে?–কত দিন আগে?

সাদা তিমিটাকে, পুবদিকে হাত তুলল ভদ্রলোক, দেখেছি ওখানে। গত ঋতুতে।

হাত কেটে নিয়েছে, তাই না?

হ্যাঁ, হাত গেছে তিমিটার জন্যেই। আপনার পা-টাও বুঝি?

ঘটনাটা বলুন, কিভাবে কি হলো।

প্রথমে সাদা তিমিটার কথা আমরা জানতামই না। একদিন চার পাঁচটা তিমি দেখে পিছু নিয়ে একটাকে হারপুন লাগালাম। কিন্তু তিমিটা ছুটতে লাগল মাইলের পর মাইল। হাল প্রায় ছেড়ে দিয়েছে নাবিকেরা, হঠাৎ ভেসে উঠল প্রকাণ্ড এক তিমি, মাথা আর কুঁজ দুধের মত সাদা, সারা শরীর কোঁচকানো।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওটাই, ওটাই, অস্থির হয়ে উঠল আহাব।

পাখনার কাছে একটা হারপুন লেগে রয়েছে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার হারপুন! বলে যান!

সুযোগ দিলে তো বলবই, রসিকতা করল ইংরেজ ক্যাপটেন। তিমিটা সোজা ছুটে এল হোয়েল-লাইন কাটার জন্যে। কিন্তু লাইন কামড়াতে গিয়ে কিছু একটা আটকে গেল তার মুখে। অন্য তিমিগুলো সরে গেছে ইতিমধ্যে। ভাবলাম, এই তিমিটাকেই ধরব। একেবারে পাশে এসে পড়েছিল ফার্স্ট মেট মি. মাউনটপ, লাফিয়ে গেলাম তার নৌকোয়। হারপুনটা কেবল ছুঁড়েছি, সাদা একটা মিনারের মত ওপরে উঠে গেল তিমিটার লেজ, পরমুহূর্তেই ভয়ঙ্কর বেগে নেমে এল আমাদের নৌকোর মাঝখানে। চোখের পলকে গুড়ো হয়ে গেল নৌকো, মেটসহ ছিটকে পড়লাম পানিতে। প্রাণ বাঁচানোর জন্যে যখন অস্থির, দ্বিতীয় হারপুনটার কাটা বিধে গেল আমার বাহুতে। তিমিটা ছুটতে লাগল সামনে। প্রচণ্ড টানে হারপুনের কাটা আমার বাহু ভেদ করে বেরিয়ে গেল কবজির কাছ দিয়ে। আঘাতটা কেমন ছিল, সে-সম্বন্ধে এবার বলবে জাহাজের সার্জন ডা. বাঙ্গার।

জখমটা ছিল বিশ্রী, শুরু করল সার্জন, তাই ক্যাপটেন বুমার উপদেশ মেনে আমাদের বুড়ো স্যামিকে–

আমার জাহাজটার নাম স্যামুয়েল এনডারবাই, ক্যাপটেন জানাল আহাবকে। হ্যাঁ, বলো, সার্জন।

বুড়ো স্যামিকে ক্যাপটেন নিয়ে গেলেন উত্তরে। ভীষণ গরম, তার মধ্যে রাতের পর রাত জাগতে হলো আমাকে। তবে ডায়েটের ব্যাপারে।

হ্যাঁ, ডায়েটের ব্যাপারে সার্জন ছিল নিষ্ঠুর। আমার তো মানে যাকে বলেযাক গে, বলো, সার্জন।

বুঝতেই পারছেন, সার্জন ঘুরল আহাবের দিকে, আমাদের ক্যাপটেন মাঝে মাঝে ইয়ারকি মারতে ভালবাসেন। কিন্তু আমি কড়া ধাতের মানুষ। এমনকি কোনরকম–

আমাদের সার্জন পানিও খায় না, বলল ক্যাপটেন বুমার, তাজা পানি দেখলেই তার জলাতঙ্ক হয়। হ্যাঁ, এবার ঘটনাটা বলো, সার্জন।

জখমটা ছিল সত্যিই বিশ্রীদুফুটেরও বেশি লম্বা, কয়েক ইঞ্চি চওড়া। শেষমেশ কাটা ছাড়া উপায় রইল না। তবে মাছের হাড়ের হাত লাগানোর পরিকল্পনা ক্যাপটেনের সম্পূর্ণ নিজস্ব, ওটা উনি তৈরি করে নিয়েছেন ছুতোরকে দিয়ে। হয়তো কারও মাথা ফাটাতে চান। মাঝেমাঝে রাগে অন্ধ হয়ে যান উনি। এই দেখুন না–হ্যাট খুলে মাথা দেখাল সার্জন, খুলির মাঝখানে একটা জায়গা উঁচু হয়ে আছে, তবে সেখানে আঘাতের কোন চিহ্ন নেই–তা এই অবস্থা কিভাবে হলো, সেই কথা ক্যাপটেনই বলবেন।

না ওটা আসলে জানে তার মা, জন্মেছেই তো অমন মাথা নিয়ে। আচ্ছা, বাঙ্গার, তোমার মত আরেকটা হাড় হারামজাদা পৃথিবীর আর কোথাও আছে? সত্যি, মরার পর তোমার দেহটা সংরক্ষণ করে রাখা উচিত ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেখাবার জন্যে।

সাদা তিমিটার কি হলো? ক্যাপটেন আর সার্জনের রসিকতা দেখতে দেখতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটল আহাবের।

ও, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সাদা তিমি, বলল ক্যাপটেন বুমার, আগে ওটার নাম জানতাম না। পরে জেনেছি–মবি ডিক।

পরে আর কখনও দেখেছেন ওটাকে?

দুবার।

হারপুন লাগাতে পারেননি?

সাধ মিটে গিয়েছিল। একটা বাহুই কি যথেষ্ট নয়?

বেশ, মুখ গম্ভীর করে বলল ডা. বাঙ্গার, ডান হাত তো দিয়েছেন, এবার বাম হাতটা টোপ দিয়ে দেখুন না, ফল পেতে পারেন। সত্যি, তিমিটাকে কিন্তু অন্তত আর একটা সুযোগ দেয়া উচিত আপনার।

ধন্যবাদ, বাঙ্গার, বলল ক্যাপটেন, একবার ওটার পিছু নিয়েই সাধ মিটে গেছে। সাদা তিমি শিকার করার কোনরকম ইচ্ছে আমার নেই। জানি, ওটাকে মারতে পারলে খুব সুনাম হবে। এও জানি যে ওটার মাথায় রয়েছে প্রায় এক জাহাজ স্পার্মাসেটি। তবু আমার মনে হয়, তিমিটাকে বিরক্ত না করাই ভাল। আপনারও তা-ই মনে হয় না, ক্যাপটেন?–আহাবের হাড়ের পা-টার ওপর দৃষ্টি বোলাল বুমার।

তবু ওটাকে ধাওয়া করব। শেষ কবে তিমিটাকে দেখেছেন আপনি? কোন্ দিকে গেছে?

আহাবের কাছে গিয়ে কুকুরের মত তার গা কল বাঙ্গার। আরে, এই লোকের রক্ত তো টগবগ করে ফুটছে–থার্মোমিটারটা নিয়ে এসো তো! পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে এগিয়ে এল সার্জন।

থামুন! গর্জে উঠল আহাব, তারপরই ছুটে গেল বুলওয়ার্কের কাছে নৌকোয় ওঠো সবাই! তিমিটা কোন দিকে গেছে?

হায় ঈশ্বর! প্রশ্নটা তাকে করা হয়েছে বুঝতে পেরে আঁতকে উঠল ইংরেজ ক্যাপটেন। পুব দিকে, এবার ফিসফিস করে ফেদাল্লাকে বলল, কি ব্যাপার? তোমাদের ক্যাপটেন পাগল নাকি?

জবাবে ঠোঁটে একটা আঙুল রাখল ফেদাল্লা, তারপর বুলওয়ার্ক টপকে নেমে গেল নৌকোয়।

আহাবেরও নামতে দেরি হলো না। বিদায় জানাতে চাইল বুমার, কিন্তু আহাব দাঁড়িয়ে আছে পেছন ফিরে। পেকোডের পাশে গিয়ে না পৌছা পর্যন্ত পাথরের মত মুখ করে রইল সে।

৮৬.

ইংল্যাণ্ডের জাহাজটা ধীরে ধীরে উধাও হয়ে গেল দৃষ্টিপথ থেকে। জাহাজটার নামকরণ করা হয়েছে ব্যবসায়ী এবং বিখ্যাত হোয়েলিং হাউস এনডারবাই অ্যাণ্ড সন্সের মালিক স্যামুয়েল এনডারবাইয়ের নামানুসারে। ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম তিমি শিকারের তোড়জোড় শুরু করে এনডারবাই। ন্যানটাকেটের কফিন আর মেসি অবশ্য তার অনেক আগেই (১৭২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে) তিমি শিকার শুরু করেছে, কিন্তু তারা যেত শুধু উত্তর আর দক্ষিণ আটলান্টিকে।

১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে এমেলিয়া নামে একটা জাহাজ বেরিয়ে পড়ে এনডারবাইয়ের তত্ত্বাবধানে। কেপ হর্ন ঘুরে তারা ফিরে আসে সফল শিকার সেরে। শিগগিরই আরও সব ইংরেজ আর আমেরিকান জাহাজ এমেলিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে। এভাবেই প্রশান্ত মহাসাগরে তিমি শিকারীদের আনাগোনা শুরু হয়। এরপর এনডারবাইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সম্ভবত আংশিক খরচে ব্রিটিশ সরকার আবিষ্কার অভিযানে পাঠায় র্যাটলার নামের এক যুদ্ধজাহাজকে। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে পরীক্ষামূলক এক আবিষ্কার অভিযানে জাপান যায় এনডারবাইয়ের নিজস্ব জাহাজ সাইরেন। এভাবেই জাপানের বিরাট তিমি শিকার এলাকা মানুষের গোচরে আসে। সাইরেনের সেই বিখ্যাত অভিযানে ক্যাপটেন ছিল কফিন নামের এক ন্যানটাকেটার।

এনডারবাই হাউস যে আজ পর্যন্ত টিকে রয়েছে, এটা তাদের দারুণ কৃতিত্বেরই পরিচায়ক। তবে আসল এনডারবাই নিশ্চয় এখন তিমি শিকার করছে আরেক পৃথিবীর দক্ষিণ সাগরে।

মাঝরাতে একবার এনডারবাইয়ে গিয়েছিলাম আমি। চমৎকার গ্যাম ছিল নেটা। সত্যি, কোন দিন ভুলব না জাহাজটার অ্যাংলো-স্যাক্সন আতিথেয়তার কথা। নাবিকরা ছিল ফুর্তিতে টইটম্বুর। গ্যালনের পর গ্যালন ফ্লিপ পান করলাম আমরা। খেলাম গরুর মাংস, ঈষৎ শক্ত হলেও মন্দ ছিল না। মাংসের পর ডাম্পলিং।

শুধু এনডারবাই নয়, আর সব ইংরেজ জাহাজেও ছিল আতিথেয়তার চুড়ান্ত ইংরেজ জাহাজে গেলে প্রায় নিশ্চিতভাবেই পাওয়া যেত রুটি, গরুর মাংস, মদের ক্যান আর রসিকতা। অবশ্য ইংরেজ হোয়েল-শিপে ব্যবহার একটু আলাদা হওয়ারই কথা, তিমি শিকারে তারা হল্যাণ্ড, নিউজিল্যাণ্ড আর ডেনমার্কের পূর্বসূরী।

তিমির চর্চা করতে করতে একবার পেয়ে গেলাম খুব পুরানো একটা ডাচ বই–ড্যান কুপম্যান। ভাবলাম, তিমি শিকারীদের সম্বন্ধে নিশ্চয় অনেক কথা পাওয়া যাবে এতে, বিশেষ করে অমূল্য তথ্য মিলবে কুপারদের বিষয়ে। প্রত্যেক হোয়েল-শিপেই কুপার থাকে। বইটা অনুবাদ করতে দিলাম আমার এক বিজ্ঞ অধ্যাপক বন্ধু ড, স্নডহেডকে। কিন্তু অনুবাদের পর দেখা গেল যে ড্যান কুপম্যান মানে ব্যবসায়ী। তবে বইটাতে মজার একটা তথ্য আছে। হল্যাণ্ডের ১৮০টা তিমি শিকার অভিযানে নেয়া খাদ্যের বিবরণ:

গরুর মাংস–৪,০০,০০০ পাউণ্ড

শুয়োরের মাংস–৬০,০০০

পাউণ্ড মাছ–১,৫০,০০০ পাউণ্ড

বিস্কুট–৫,৫০,০০০ পাউণ্ড

নরম রুটি–৭২,০০০ পাউণ্ড

মাখন–২,৮০০ ছোট পিপে

উন্নতমানের পনির–২০,০০০ পাউণ্ড

নিম্নমানের পনির–১,৪৪,০০০ পাউণ্ড

জেনেভা–৫৫০ অ্যাংকার (১ অ্যাংকার =৮.৫ গ্যালন)

বিয়ার–১০,৮০০ ব্যারেল।

বইটা লেখা হয়েছে দুতিনশো বছর আগে। তখনকার দিনে অভিযানের সময়সীমা তিন মাস পেরোত না, আর একেকটা জাহাজে লোক থাকত ৩০ জন। তাহলে ১৮০টা অভিযানে সবসুদ্ধ লোক হয় ৫,৪০০ জন। সেই হিসেবে তাদের মাথা পিছু মাছ, পনির, জেনেভা জিন আর বিয়ার খাওয়া দেখলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়।

থাক, খাওয়া নিয়ে কটাক্ষ করব না। ওই যে ইংরেজ তিমি শিকারীরা বলে–যখন মন্দ ছাড়া কিছুই তোমার ভাগ্যে জুটবে না, তখন ভাল একটা ডিনার খাও।

৮৭.

হঠকারীর মত ক্যাপটেন আহাব স্যামুয়েল এনডারবাই থেকে নেমে আসায় তার নিজেরও কিছু ক্ষতি হয়েছিল। প্রথমত তাড়াহুড়ো করে নৌকোয় উঠতে গিয়ে

ঝাঁকি লেগেছিল তার হাড়ের পায়ে, তারপর ঘুরে এক নাবিককে আদেশ দিতে গিয়ে এমন মোচড় লেগেছিল যে পা-টা প্রায় খুলে যাবার জোগাড়।

আর সব বিষয়ে আহাবের যত পাগলামিই থাকুক না কেন, পায়ের যত্ন সে সত্যিই নেয়। কারণ, পেকোড বন্দর ত্যাগ করার মাত্র কদিন আগে ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানা থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সে। কিভাবে যেন খুলে গিয়েছিল পা-টা। রক্তারক্তি কাণ্ড। তো লেগে কুঁচকিতে সৃষ্ট ক্ষত সারতে অনেক সময় নিয়েছিল।

একটা ব্যাপার রহস্যাবৃত। কেন পেকোড ছাড়ার বেশ কিছু দিন আগে থেকে ছাড়ার পরেও অনেক দিন আহাবকে ডেকে বের হতে দেখা যায়নি। ক্যাপটেন পেলেগ যদিও এই ব্যাপারে কারণ দর্শিয়েছে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। তার বের না হবার পেছনে দুর্ঘটনাটা অবশ্যই ছিল। তবে যুতটা না শারীরিক, তার চেয়ে বেশি আঘাতটা ছিল মানসিক। কিন্তু আঘাত যেমনই হোক, তার মধ্যেও বাস্তব ভোলেনি আহাব। ছুতোরকে ডেকে পাঠিয়েছিল। আদেশ দিয়েছিল নতুন আরেকটা পা বানাবার। আহাবের আদেশে আলস্য ছেড়ে উঠতে হয়েছিল কামারকে। নিখুঁত পা তৈরি করতে লোহার যেসব জিনিসের প্রয়োজন, সরবরাহ করতে হবে তাকে।

৮৮.

অন্যান্য সব হোয়েল-শিপের ছুতোরের সঙ্গে পেকোডের ছুতোরের বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। ছুতোর বলতেই আমাদের সামনে যে কাঠ নিয়ে কর্মরত মানুষের ছবি ভেসে ওঠে, হোয়েল-শিপের ছুতোর কিন্তু শুধু সেই জিনিস নয়। সে সকল কাজের ওস্তাদ। ভাঙাচোরা নৌকো মেরামত, অস্বস্তিকর দাড়ে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা, খুলে পড়া মাস্তুল দাড় করিয়ে দেয়া, ডেকে বুলস্ আই বসানো সহ আরও অনেক রকম কাজে পারদর্শী হতে হয় তাকে।

তার নানারকম কাজের জায়গা কিন্তু একটাই–ভাইস-বেঞ্চ। লম্বা, অমসৃণ একটা বেঞ্চ সেটা, ওপরে বসানো লোহা এবং কাঠের বিভিন্ন আকারের ভাইস। একমাত্র জাহাজের পাশে তিমি ঝুলিয়ে রাখার সময় ছাড়া বেঞ্চটা শক্ত করে বাধা থাকে ট্রাই-ওয়র্কসের পেছনে।

কোন নাবিকের হাত মচকে গেছে? লোশন লাগিয়ে দেবে ছুতোর; নিজের নৌকোর প্রত্যেকটা দাঁড়ের ওপর সিঁদুর-রঙা তারা ভালবাসে স্টাব? বানিয়ে দেবে ছুতোর; কোন নাবিক কানে হাঙরের হাড়ের দুল পরতে পছন্দ করে? কান ফুটো করে দেবে ছুতোর; দাঁত ভীষণ ব্যথা করছে? তার জন্যেও রয়েছে। ছুতোর।

দাঁত টেনে তুলতে তার কিছু মনেই হয় না। মানুষের দাঁত আর তিমির আইভরি তার চোখে সমান।

৫৯.

এনডারবাই থেকে ফেরার সময় পায়ে মোচড় খাওয়ায় সতর্ক হয়ে গিয়েছিল আহাব। তাই ছুতোরকে আদেশ করেছিল পা-টাকে আরও নিখুঁতভাবে তৈরি করতে। এখন ভাইস-বেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে সেই পা নিয়ে ব্যস্ত ছুতোর বিড়বিড় করছে আপন মনে।

এই যে ফাইল আর ওই যে হাড়। যেটা নরম হওয়া উচিত সেটা শক্ত, আর যেটা শক্ত হওয়া উচিত সেটা নরম। আরেক বার চেষ্টা করে দেখি। এই তো, এখন বেশ ভাল কাজ হচ্ছে (হ্যাঁচ্চো)–হাড়ের গুঁড়ো হলো (হ্যাঁচ্চো)–এটা হচ্ছে গিয়ে (হ্যাঁচ্চো)–হ্যাঁ, এটা (হ্যাঁচ্চো)–ঈশ্বর! এই হারামজাদা হাড়ের গুঁড়ো আমাকে কথাই বলতে দেবে না দেখছি। জ্যান্ত কোন গাছ কাটলেও এত গুড়ো ওড়ে না (হ্যাঁচ্চো)–পায়ের মাপ নেয়ার জন্যে মোঘলকে সংবাদ দিতে হবে। আরে, কী সৌভাগ্য! বুড়ো তো দেখি এদিকেই আসছে।

ধীরে ধীরে ভাইস-বেঞ্চের কাছে এসে দাঁড়াল ক্যাপটেন আহাব। কাজ কেমন এগোচ্ছে? গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইল সে।

ভালই, স্যার। যদি কিছু মনে না করেন, আমি আপনার পায়ের মাপটা আরেক বার নিতে চাই।

তা নাও, কিন্তু এত হ্যাঁচ্চো হাজ্জো কিসের?

স্যার, হাড়ে খুব গুড়ো।

এ-থেকে একটা শিক্ষা নাও। মরার পর কেউ যেন তোমাকে লোকালয়ে কবর না দেয়। হাড়ের গুড়ো নাকে ঢুকে মানুষজন হাচি তুলতে তুলতে মরবে। যাকগে, পায়ের কাজ শেষ হতে আর কতক্ষণ লাগবে?

বোধ হয় আর ঘণ্টাখানেক, স্যার।

আহাব চলে যাবার পর দ্রুত হাতে কাজ সারতে সারতে আবার শুরু হলো ছুতোরের বিড়বিড়ানি:

মোঘলকে সবচেয়ে ভাল চেনে স্টাব, এজন্যে একটা শব্দই ব্যবহার করে তার সম্বন্ধে–অদ্ভুত। হ্যাঁ, কোন সন্দেহ নেই, বুড়ো হলো অদ্ভুত, অদ্ভুত, খুবই অদ্ভুত। না, বেশি কথা বলব না, কাজে ভুল হয়ে যাবে।

৯০.

প্রতিদিনের মত পাম্প করে বাড়তি পানি বের করে দিচ্ছিল পেকোড কিন্তু পানির সঙ্গে মিশে আছে প্রচুর তেল। ঘটনা গুরুতর, নিচের পিপেগুলোতে নিশ্চয় বিশ্রী কোন ফুটো হয়েছে। স্টারবাক গেল রিপোর্ট করতে।

পেকোড তখন দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে এগোচ্ছিল ফরমোজা আর বেসি দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশে। স্টারবাক দেখল, দ্বীপপুঞ্জগুলোর একটা ম্যাপ সামনে মেলে বসে আছে আহাব।

কে? পায়ের শব্দ কানে যেতে পেছন না ফিরেই বলল আহাব ডেকে যাও! ভাগো এখান থেকে!

ক্যাপটেন আহাব, ভুল করছেন। আমি স্টারবাক, স্যার। তেলের পিপে ফুটো হয়ে গেছে, মেরামতের জন্যে বার্টন ওপরে তোলা প্রয়োজন।

আমরা এখন প্রায় জাপানের কাছাকাছি। এই সময় বার্টন ওপরে তুলে এক সপ্তাহ দেরি করতে চাও?

কাজটা না করলে এক বছরে সংগ্রহ করা তেল এক দিনে নষ্ট হয়ে যাবে, স্যার।

আমি ওসবের কথা বলছি না। ভাবছিও না। দূর হও! ফুটো হতে দাও ওটাকে। আমার নিজেরই সারা শরীরে ফুটো। বিরাট এই জাহাজের কোথায় ফুটো হয়েছে, তা কি এখন খুঁজে বের করা সম্ভব? আর বের করা যদি যায়ও, কে মেরামত করবে এই ঝড়ের মধ্যে? বার্টন ওপরে তুলতে আমি দেব না, স্টারবাক।

মালিকেরা কি বলবে, স্যার?

ন্যানটাকেটে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচাক মালিকেরা। আহাব ওদের ঘোড়াই কেয়ার করে। কৃপণ এই মালিকগুলোর কথা তুলে তুমি প্রায়ই আমাকে খোচাও, স্টারবাক। কিন্তু শুনে রাখো, জাহাজের সবকিছুর আসল মালিক হলো তার কমাণ্ডার। যাও–ডেকে যাও!

ক্যাপটেন আহাব, চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল চীফ মেটের, আমার জায়গায় অন্য কোন লোক হলে তার বিরক্তি গোপন করে রাখত না। বিরক্তি প্রকাশ করতে পেরে সে খুশি হত।

শয়তান! এখনও ডেকে যাও বলছি!

না, স্যার, এখনই নয়। আচ্ছা, ক্যাপটেন আহাব, আমাদের সম্পর্ক কি আরেকটু ভাল হতে পারে না?

র্যাক থেকে একটা মাস্কেট নামিয়ে সেটা স্টারবাকের দিকে তাক করল আহাব। ঈশ্বর একজনই আছে, সে পৃথিবী শাসন করে, আর ক্যাপটেন একজনই আছে যে পেকোড শাসন করে। ডেকে যাও!

এক মুহূর্তের জন্যে চীফ মেটের মুখ দেখে মনে হলো যেন সত্যিই গুলি খেয়েছে। ধীরে ধীরে উঠে কেবিনের দরজার কাছে গিয়ে সে বলল, আপনি রেগে গেছেন, স্যার, আমাকে অপমান করেননি। তবে একটা কথা শুনে রাখুন। স্টারবকের জন্যে আপনার সাবধান হবার কিছু নেই, তবে আহাব যেন সাবধান হয় আহাবের কাছ থেকে। সে সাহস দেখায়, তবে কথা মান্য করে, একে বলে সতর্কতাপূর্ণ সাহসিকতা! স্টারবাক চলে যাবার পর বিড়বিড় করতে লাগল আহাব। কিন্তু ওটা কি বলল–আহাব যেন সাবধান হয় আহাবের কাছ থেকে নিশ্চয় কথাটার গৃঢ় কোন অর্থ আছে! অসচেতনভাবে মাস্কেটটাকে কিছুক্ষণ লাঠি হিসেবে ধরে পায়চারি করল সে, তারপর বন্দুকটা নামিয়ে রেখে বেরিয়ে এল ডেকে।

স্টারবাকের কাছে গিয়ে শান্ত স্বরে বলল সে, তুমি খুবই ভাল মানুষ, স্টারবাক! তারপর নাবিকদের দিকে চেয়ে গলা চড়াল, বার্টন ওপরে তোল, মূল গুদাম ভাঙতে হবে?

আহার এই কাজ স্টারবাককে সম্মান দেখিয়ে করল কিনা, অনুমান করা কঠিন। হয়তো মুহূর্তের জন্যে তার মধ্যে ঝলকে উঠেছিল সততা। তবে এটা তার চালও হতে পারে। হয়তো ভেবেছে, জাহাজের প্রধান অফিসারকে না চটানোই ভাল। যা-ই হোক, তার আদেশ পালিত হলো।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত