মবি ডিক: ৬১-৭০. শেকল টেনে নাও

মবি ডিক: ৬১-৭০. শেকল টেনে নাও

৬১-৭০. শেকল টেনে নাও

৬১.

শেকল টেনে নাও! মড়াটা ভেসে চলে যাক! তিমি কাটার কাজ শেষ হয়ে গেছে। চামড়া ছাড়ানো মুণ্ডহীন তিমিটাকে এখন মনে হচ্ছে মার্বেল পাথরের সমাধি। ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে ক্রমেই দূরে সরে যেতে লাগল তিমিটা, ওটাকে ঘিরে তখনও হুল্লোড় করছে অতৃপ্ত হাঙরের পাল। নিশ্চল জাহাজ থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখা গেল তিমিটাকে। নীল আকাশের নিচে, শান্ত সাগরে ভাসতে ভাসতে এসময় ফুটকি হয়ে দিগন্তে মিলিয়ে গেল ওটা।

৬২.

তিমির মাথা কাটা খুব কঠিন। কারণ যে জায়গায় মাথা যুক্ত হয়েছে শরীরের সঙ্গে, সেটাই শরীরের সবচেয়ে মোটা অংশ মাথা যে কাটে তাকে কাটতে হয় ওপর থেকে এবং তার লক্ষ্যস্থল থাকে আট দশ ফুট নিচে। সুতরাং এরকম একটা মাথা দশ মিনিটে কাটতে সক্ষম বলে স্টাব গর্ব করতে পারে বৈকি।

প্রথমে মাথা কাটার পর শরীরের চামড়া ছাড়ানোর জন্যে তার দিয়ে সেটাকে ঝুলিয়ে রাখা হয় স্টার্নে। বাচ্চা স্পার্ম তিমি হলে পরে মাথা ভোলা হয় ডেকে, কিন্তু বড় তিমির বেলায় তা সম্ভব হয় না।

কাটাকুটি শেষ হতে দুপুর হয়ে গেল। খাবার জন্যে নাবিকেরা নিচে যাওয়ায় ডেক সম্পূর্ণ ফাঁকা। খানিক পর সেই নীরবতার মাঝে বেরিয়ে এল ক্যাপটেন আহাব, কোয়ার্টার-ডেকে কিছুক্ষণ পায়চারি করে এসে দাঁড়াল মাথাটার পাশে।

জাহাজ দেখা যায়। এসময় উল্লসিত স্বর ভেসে এল মেইনমাস্ট-হেড থেকে।

উল্লাস প্রকাশ পেল আহাবের স্বরেও, কোথায়?

স্টারবোর্ড বো থেকে মাত্র তিন পয়েন্ট দূরে, স্যার, ওটার বাতাস এসে লাগছে আমাদের গায়ে!

৬৩.

ভাল করে দেখে বোঝা গেল, ওটা একটা হোয়েল-শিপ। কিন্তু জাহাজটা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে দেখে সঙ্কেত দিল পেকোড।

এখানে বলা দরকার, যুদ্ধজাহাজের মত আমেরিকান হোয়েল-শিপগুলোরও রয়েছে নিজ নিজ সঙ্কেত, এই সঙ্কেত জাহাজের নামসহ একটা বইয়ে ছেপে তার কপি দেয়া হয় প্রত্যেকটা জাহাজের ক্যাপটেনকে। ফলে সঙ্কেত দেখলে অনেক দূর থেকেও জাহাজ চিনতে কারও কোন অসুবিধে হয় না।

বেশ কিছুক্ষণ সঙ্কেত দেখানোর পর নতুন জাহাজটাও সঙ্কেত দেখাল। বই পরীক্ষ, করে বোঝা গেল, জাহাজটা ন্যানটাকেটের, নাম–জেরোবোয়াম। জাহাজ দুটো কাছাকাছি হতে মই নামিয়ে দিল পেকোড। কিন্তু জেরোবোয়ামের ক্যাপটেন, মেহিউ, ইশারায় জানাল এসবের কোন প্রয়োজন নেই। তার জাহাজে মহামারী চলছে, তাই এই জাহাজে এসে রোগ ছড়াতে চায় না সে। অবশ্য ক্যাপটেন আসতে না চাইলেও আলাপে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলো না। নাবিকরা জাহাজ দুটোকে দাড় করিয়ে দিল একদম পাশাপাশি।

আপনাদের মহামারীকে আমি ভয় পাই না, বুলওয়ার্ক থেকে আহাব বলল ক্যাপটেন মেহিউয়ের উদ্দেশে, চলে আসুন এখানে।

উঠে দাঁড়াল গ্যাবরিয়েল নামের এক নাবিক।

ভাল করে ভেবে দেখুন। ভয়ঙ্কর প্লেগ!

গ্যাবরিয়েল, গ্যাবরিয়েল! বলল ক্যাপটেন মেহিউ, তুমি বরং ঠিক এই সময়েই জাহাজের গায়ে এসে আছড়ে পড়ল একটা ঢেউ, গর্জনে চাপা পড়ে গেল ক্যাপটেনের বাকি কথা।

আপনি সাদা তিমিটাকে দেখেছেন? ঢেউ থিতিয়ে আসার পর জানতে চাইল আহাব।

আপনার হোয়েল-বোট চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ডুবে যাবে! ভয়াবহ ওই লেজ থেকে সাবধান!

আহ, গ্যাবরিয়েল, তুমি বরং–কিন্তু ঢেউ আছড়ে পড়ায় এবারেও কথা শেষ হলো না ক্যাপটেন মেহিউয়ের। ঢেউয়ের মাতামাতির জন্যে বেশ কিছুক্ষণ দুই জাহাজের কেউই কথা বলতে পারল না। তারপর মবি ডিকের একটা গল্প শোনাল ক্যাপটেন মেহিউ।

বন্দর ত্যাগ করার অল্প দিন পরেই জেরোবোয়াম মবি ডিকের কথা জানতে পারে আরেক হোয়েল-শিপের কাছ থেকে। গ্যাবরিয়েল ক্যাপটেনকে সাবধান করে দেয়, দেখতে পেলেও সে যেন মবি ডিকের পিছু না নেয়। বছর দুই পর সত্যিই মবি ডিককে দেখতে পায় মাস্ট-হেডার। তিমিটার মুখোমুখি হবার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠে চীফ মেট মেসি। গ্যাবরিয়েল বার বার নিষেধ করা সত্ত্বেও বাধা দেয়নি ক্যাপটেন। সঙ্গে যাবার জন্যে পাঁচজন নাবিককে রাজি করিয়ে নৌকো নামিয়ে ঝটপট রওনা দিল মেসি। অনেকক্ষণ ধাওয়া করার পর একটা হারপুন লাগাতে পারল সে। ওদিকে মাস্ট-হেডে উঠে গ্যাবরিয়েল চেঁচাচ্ছে, শিগগিরই তাদের সর্বনাশ হবে। নৌকোর বোতে দাঁড়িয়ে মারণাঘাত হানার জন্যে উত্তেজনায় টান টান হয়ে আছে মেসি, হঠাৎ সাদা একটা বিশাল মূর্তি ভেসে উঠল তার সামনে। আত্মা খাচাছাড়া হবার জোগাড় হলো পাঁচ নাবিকের, প্রচণ্ড ধাক্কায় শূন্যে উঠে প্রায় পঞ্চাশ গজ ওপর থেকে সাগরে আছড়ে পড়ল হতভাগ্য মেট। নৌকো বা নাবিকদের চুল পরিমাণ ক্ষতি হলো না, কিন্তু পানির নিচ থেকে আর ভাসল না চীফ মেটের দেহ।

তিমি শিকারে এই ঘটনায় অবাক হবার মত কিছু নেই। অনেক সময়েই নিহত ব্যক্তি ছাড়া কারও কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু মেসির লাশ উদ্ধার করার পর দেখা গেল, শরীরের কোথাও কোন ক্ষতচিহ্ন নেই, অথচ মরে কাঠ হয়ে গেছে সে।

মেসির মৃতদেহ জাহাজে আনতেই শোনা গেল গ্যাবরিয়েলের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ প্রতিশোধ! প্রতিশোধ! তার সাবধানবাণী নাবিকরা শুনেছে। ফলে আরও বেড়ে গেল গ্যাবরিয়েলের প্রভাব। বর্তমানে তার ভবিষ্যদ্বাণীতে নাবিকেরা আতঙ্কিত হয়।

গল্প শেষ করে ক্যাপটেন মেহিউ জানতে চাইল, সাদা তিমিটাকে দেখতে পেলে সে পিছু নেবে কিনা। আহাব জবাব দিল, নিশ্চয়। পিছু নেব কালবিলম্ব না করে।

জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে গ্যাবরিয়েল বলল, মনে রাখবেন নাস্তিকের কথা মরে কাঠ হয়ে গেছে! ওই তিমিকে ধাওয়া করার আগে মনে করবেন নাস্তিকের পরিণতির কথা!

বিচলিত হবার বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখা গেল না আহাবের মধ্যে। মেহিউকে উদ্দেশ করে সে বলল, ক্যাপটেন, এইমাত্র মনে পড়ল চিঠির ব্যাগের কথা। ওখানে আপনার কোন অফিসারের নামে যেন একটা চিঠি আছে। স্টারবাক, যাও তো, ব্যাগটা নিয়ে এসো।

প্রায় প্রত্যেক হোয়েল-শিপেই এরকম চিঠি থাকে, আর সে-চিঠি বিলি করা হয় নির্দিষ্ট জাহাজটার সঙ্গে চার মহাসাগরের কোথাও হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে। ফলে প্রাপকের হাতে চিঠি পৌঁছুতে পৌঁছুতে প্রায়ই লেগে যায় দুতিন বছর, এমনকি তার চেয়েও বেশি সময়।

শিগগিরই একটা চিঠি হাতে ফিরে এল স্টারবাক। বহু দিন ধরে পড়ে থাকায় সেটার চেহারা এখন অত্যন্ত মলিন।

পড়তে পারছ না? বলল আহাব। দেখি, আমাকে দাও। হুম, লেখাটা খুবই অস্পষ্ট। পড়ার চেষ্টা করতে লাগল সে, ওদিকে স্পেডের মাথায় করে চিঠিটা এগিয়ে দেয়ার জন্যে ছুরি দিয়ে খামের এক কোণে ফুটো করতে লাগল স্টারবাক।

ইতিমধ্যে লেখাটা ধরতে পেরেছে আহাব। মি. হ্যার–হ্যাঁ, মি. হ্যারিমেয়েলি হাতের লেখা মনে হচ্ছে–হ্যাঁ, মি. হ্যারি মেসি, জেরোবোয়াম জাহাজ। কিন্তু মেসি তো মারা গেছে।

আহা, বেচারি! স্ত্রীর কাছ থেকে চিঠি! দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেহিউ, দিন, চিঠিটা আমাকে দিন।

না, চিঠিটা আপনিই রাখুন, গ্যাবরিয়েল বলল আহাবকে, শিগগিরই আপনাকেও যেতে হবে মেসির পথে।

অভিশাপ দিতে দিতে তোর গলা বুজে আসবে! চেঁচিয়ে উঠল আহাব। ক্যাপটেন মেহিউ, চিঠিটা নিন। স্পেডে গেঁথে খামটা বাড়িয়ে ধরল সে। হঠাৎ যেন জাদুমন্ত্রবলে স্পেডের মাথা থেকে খুলে খামটা চলে গেল গ্যাবরিয়েলের হাতে। এক মুহূর্ত দেরি না করে খামটা ছুঁড়ে দিল সে, উড়তে উড়তে ওটা এসে পড়ল আহাবের পায়ের কাছে। তারপর গ্যাবরিয়েলের নির্দেশে দাড় তুলে নিল। নাবিকেরা, দ্রুত দূরে সরে যেতে লাগল জেরোবোয়াম।

৬৪.

তিমি কাটার সময় ব্যস্ততার চূড়ান্ত হয়। ছুটাছুটি, হইচই কেউ সামনে দৌড়াচ্ছে তো কেউ পেছনে, এখনই এখানে সাহায্য দরকার তো এখনই সেখানে। এক জায়গায় স্থির থাকার কোন উপায়ই নেই। একইসঙ্গে যেন সবাইকে সব জায়গায় প্রয়োজন। এমনকি বর্ণনা দিচ্ছি বলে ছুটি নেই আমারও। আগেই বলেছি, হুক ঢোকানো হয় ব্লাবারের পাশ দিয়ে। কিন্তু মুখে বলা যত সহজ, অত বিশাল এক বপুতে হুক ঢোকানো তত সহজ নয়। এই কাজটা করে আমার বন্ধু কুইকেগ। হুক ঢোকানোর জন্যে সে নেমে যায় তিমির পিঠে। কিন্তু পরিস্থিতি অনেক সময় এমন দেখা দেয় যে চামড়া না ছাড়ানো পর্যন্ত ওখান থেকে উঠতে পারে না সে। তিমির শরীরের বেশির ভাগ অংশই ডুবে থাকে। কুইকেগকেও থাকতে হয় অনেকটা সেভাবেই, অর্ধেক পানির ওপরে অর্ধেক নিচে।

তিমির পিচ্ছিল পিঠে বসে থাকার ব্যাপারে কুইকেগকে সাহায্য করি আমি। ইটালির অরগান বাদকরা নৃত্যরত বদরকে বেঁধে রাখে লম্বা একটা রশি দিয়ে আমিও অমন একটা রশির সাহায্যেই পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করি কুইকেগকে, তিমি শিকারীরা এই রশিটাকে বলে মাঙ্কি রোপ।

৬৫.

স্পার্ম তিমিটার বিশাল মাথা বাঁধা রয়েছে পেকোডের পাশে। কিন্তু শুধু ওই মাথার দিকে তাকিয়ে থাকলে তো চলবে না, মানুষের জীবনে কাজেরশেষ নেই। তো, যতক্ষণ পর্যন্ত আর নজর দেয়া যাচ্ছে না মাথাটার দিকে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রার্থনা করা যাক, যেসব রশি দিয়ে মাথাটা বাধা হয়েছে, সেগুলো যেন ওটার ভার বইতে পারে।

গত রাত এবং আজ দুপুরের আগ পর্যন্ত ধীরে ধীরে এগোচ্ছে পেকোড। এখানে-সেখানে কিছু ব্রিটের ক্ষেত্র, রাইট তিমি থাকলেও থাকতে পারে। অবশ্য স্পার্ম তিমির চেয়ে অনেক নিচু জাতের এই তিমি মারার ইচ্ছে কারও নেই, পেকোডও রাইট তিমি শিকারে বেরয়নি, অথচ সবাইকে অবাক করে ঘোষণা দেয়া হলো যে পারলে আজ একটা রাইট তিমি মারা হবে।

রাইট তিমি চোখে পড়তেও দেরি হলো না। দুই নৌকো নামিয়ে ধাওয়া করল স্টাব আর ফ্লাস্ক। যেতে যেতে তাদের নৌকো এত দূরে চলে গেল যে মাস্ট-হেড থেকেও চোখে পড়ে কি পড়ে না। হঠাৎ পানিতে উঠল তীব্র আলোড়ন। কিছুক্ষণ পর দুটো নৌকোই দেখা গেল পরিষ্কার, হারপুন বিদ্ধ হয়ে নৌকোসহ সোজা পেকোডের দিকে ছুটে আসছে তিমি। ভয়াবহ সঙ্ঘর্ষের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম আমরা। তবে টাবে তখনও প্রচুর লাইন থাকায় শেষ মুহূর্তে দুর্ঘটনা এড়াতে পারল স্টাব আর ফ্লাস্ক। জাহাজ পেরিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরে সামনে গিয়ে বর্শা ছুঁড়ে তিমিটাকে কাবু করে ফেলল ওরা।

অবশেষে ঘন হয়ে এল রাইট তিমিটার ফোয়ারা, রক্ত বমি করতে করতে একপাশে কাৎ হয়ে নিশ্চল হয়ে গেল।

দুই নৌকোর হেডসম্যান যখন তিমিটাকে বেশ করে বাঁধছে, ছোটখাট একটা আলাপ হয়ে গেল দুই মেটের মধ্যে।

বুঝতে পারছি না বুড়ো এই বিশ্রী জিনিসটা নিয়ে কি করবে, বলল স্টাব তিমিটার দিকে ঘূণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

কি করবে? বোতে অতিরিক্ত লাইন পঁাচাতে প্যাচাতে বলল ফ্লাস্ক, কখনও শোনেননি, যে-জাহাজের স্টারবোর্ডে স্পার্ম তিমি আর লারবোর্ডে রাইট তিমির মাথা ঝোলানো হয়, সে-জাহাজ কখনও ডোবে না?

কেন?

অত ব্যাখ্যা করতে পারব না। ওই ফেদাল্লা ভূতটা বলছিল, আমি শুনে ফেলেছি। ব্যাটার হাবভাবে মনে হয় যেন জাদুবিদ্যার সবই জানে। কিন্তু ওর জাদুবিদ্যা পেকোডের কোন উপকারে আসবে বলে মনে হয় না। শয়তানটাকে আমার একেবারেই পছন্দ নয়। সামনের দাঁতটা দেখেছেন? মানুষের নয়, যেন সাপের দাঁত।

হারামজাদা ডুবে মরুক! আমি ওর দিকে তাকাই না। কিন্তু বিশ্বাস করো, গাঢ় অন্ধকার রাতে যদি ব্যাটাকে বুলওয়ার্কের পাশে একা পাই। ব্যাটা ছদ্মবেশী শয়তান! লেজ দেখা যায় না কেন জানো? লুকিয়ে রাখে বলে। হ্যাঁ, লেজটা গুটিয়ে খুঁজে রাখে পকেটে!

আর ব্যাটা ঘুমায় জুতোর মধ্যে, তাই না? কোন হ্যামক নেই ওর। তবে একরাতে ঘুমাতে দেখেছি দড়িদড়ার মাঝখানে।

ঠিকই দেখেছ। দড়িদড়ার মাঝখানে তো ঘুমাবেই, ওখানে যে লেজ লুকিয়ে রাখার সুবিধে।

কিন্তু বুড়োর ওকে এত কি প্রয়োজন?

কোন লেনদেন বা চুক্তি করতে চায় মনে হয়।

চুক্তি? কিসের?

কেন দেখোনি, সাদা তিমিটার জন্যে বুড়ো কেমন উতলা হয়ে আছে? হয়তো আত্মার বদলে ফেদাল্লা তাকে এনে দেবে মবি ডিক।

কি বাজে বকছেন, এ তো অসম্ভব!

পারবে, পারবে, শয়তানরা সব পারে, অসম্ভবের কিছু নেই।

আচ্ছা, মি. স্টাব, ফেদাল্লা যদি সত্যিই শয়তান হয়, এখন ওর বয়স কত হয়েছে বলে মনে হয় আপনার?

এই জাহাজে যত পেরেক আছে, তার চেয়েও বেশি। জানো না, শয়তানদের মৃত্যু নেই?

একটু আগেই বললেন, সুযোগ পেলে ধাক্কা দিয়ে ওকে ফেলে দেবেন সাগরে। মৃত্যুই যদি না থাকে, ফেলে দিয়ে কি লাভ?

বাঁধার কাজ শেষে নৌকো দুটো এগোতে লাগল পেকোডের দিকে।

আমি ব্যাটাকে ভালমত ভেজাতে চাই, জবাব দিল স্টাব।

ভিজলেও হামাগুড়ি দিয়ে আবার উঠে আসবে ও।

যতবার উঠবে ততবার ফেলে ফেলে ভেজাব।

কিন্তু ভিজতে ভিজতে ওরও যদি আপনাকে ভেজাবার কিংবা একেবারে ডুবিয়ে দেয়ার ইচ্ছে হয়?

তোমার কি ধারণা, ফ্লাস্ক, আমি ওকে ভয় পাই? ডোবাবার চেষ্টা করে দেখুকই না একবার। কি করব জানো? পকেটে হাত ঢুকিয়ে লেজটা বের করে, নোঙরের সঙ্গে জড়িয়ে এমন এক টান মারব যে পুরোটা একেবারে গোড়া থেকে ছিঁড়ে আসবে।

তারপর সেই লেজ দিয়ে আপনি কি করবেন, মি. স্টাব?

বিক্রি করে একটা চাবুক কিনব, আবার কি?

আপনি এতক্ষণ যা বললেন, সব ভেবেচিন্তে বলেছেন, মি. স্টাব?

ভেবে বলি বা না বলি, আমরা এসে পড়েছি জাহাজের কাছে।

ইতিমধ্যে তিমিটাকে লারবোর্ডে বাঁধার জন্যে শেকল আর রশি নিয়ে প্রস্তুত হয়েছে নাবিকরা।

আপনাকে বলিনি, ফিসফিস করে উঠল ফ্লাস্ক, রাইট তিমিটাকে ওরা স্পার্ম তিমির উল্টো পাশে বাঁধবে?

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্লাস্কের কথা সত্যি হলো। তবে নতুন মাথাটা উল্টো পাশে বাধায় পেকোড় ভারসাম্য ফিরে পেল।

স্পার্ম তিমির মত রাইট তিমি কাটার সময়েও একই প্রক্রিয়া এবং একই ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, কেবল রাইট তিমির মাথা পুরোটাই কেটে নেয়া হয়, যেখানে স্পার্ম তিমির ঠোঁট আর জিভ আলাদাভাবে কেটে টেনে তোেলা হয় ডেকে। কাটাকাটি শেষে স্পার্ম তিমির মত রাইট তিমির মুণ্ডহীন শরীরটাকেও সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হলো।

৬৬.

এবার তিমির চেহারা সম্বন্ধে কিছু বলা যাক।

তিমির মুখের অবস্থান খুবই অদ্ভুত, মুখটা রয়েছে মাথার সম্পূর্ণ নিচে। মনে মনে যদি কল্পনা করতে পারেন যে আপনার মুখটা রয়েছে চিবুকের নিচে, তাহলে তিমির মুখের কিছুটা ধারণা পাবেন। তিমির কোন নাক নেই। নাকের কাজ করে স্পাউটের ফুটো, আর সেটা রয়েছে মাথার ওপরে। আগেই বলেছি, তিমির চোখ আর কান রয়েছে মাথার অনেকটা পাশে। সামনে থেকে ধরলে মোট দৈর্ঘ্যের প্রায় এক তৃতীয়াংশ পেছনে।

এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, সামনে থেকে তিমির মাথাটাকে মনে হয় আস্ত একটা দেয়াল। ওখানে হাড়ের চিহ্নমাত্র নেই। হাড় পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে কপাল থেকে অন্তত বিশ ফুট পেছনে। তিমির মাথার হাড়বিহীন এই অংশে চমৎকার তেল হয়। তিমির ব্লাবার যেমন চামড়া দিয়ে ঢাকা থাকে, মাথার চামড়া অতটা মোটা না হলেও সামনে থেকে এতই শক্ত যে শক্তিশালী মানুষের ছোড়া হারপুনও সেখানে লেগে ছিটকে আসে।

৬৭.

স্পার্ম তিমির মাথাটাকে যদি একটা আয়তাকার নিরেট বস্তু ধরে নিয়ে পাশাপাশি দুভাগে ভাগ করা যায়, তাহলে যাবতীয় হাড় থেকে যাবে নিচের অংশে আর ওপরের অংশ হাড়বিহীন। এখন ওপরের এই হাড়বিহীন অংশটাকে যদি আবার পাশাপাশি দুটো ভাগ করেন, নিচের অংশের খাঁজে খাঁজে পাবেন তেল। দ্বিখণ্ডিত এই নিচের অংশটাকে বলে জাঙ্ক, আর ওপরের অংশটাকে কেস। এই ওপরের অংশটাকে মনে করা যেতে পারে গ্রেট হাইডেলবার্গ টান, এখানেই রয়েছে স্পার্ম তিমির জগদ্বিখ্যাত স্পার্মাসেটির বিশাল সঞ্চয়।

তিমির জীবিতাবস্থায় স্পার্মাসেটি থাকে তরলাকারে, কিন্তু মরার পর বাইরের আলো-বাতাসে ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে দানা বাঁধে। বড়সড় একটা তিমির কেসে সাধারণত পাচশো গ্যালন পার্মাসেটি থাকে, তবে অনিবার্য কারণবশত অনেক সময় এর কিছু অংশ নষ্ট হয়ে যায়।

তিমির মাথাটা প্রকাণ্ড–এ-কথা বার বার বললেও তার কোন মাপ এখন পর্যন্ত আপনাদের দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। পূর্ণদেহী একটা তিমির দৈর্ঘ্য অল্পবিস্তর আশি ফুট, আর তার মাথা দেহের এক তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ মোটামুটি ছাব্বিশ ফুট।

৬৮.

বিড়ালের মত ক্ষিপ্রগতিতে স্পার্ম তিমিটার মাথার ওপর উঠে পড়ল ট্যাসটেগো। হাতে তার একটামাত্র যন্ত্র, যাকে তিমি শিকারীরা বলে হুইপ। তবে জুত হয়ে বসার পর ডেক থেকে তার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো খাটো হাতলঅলা একটা ধারাল কুড়াল। প্রাচীন বাড়ির দেয়ালে টোকা দিয়ে দিয়ে যেমন গুপ্তধনের সন্ধান করে মানুষ, ঠিক তেমনি সতর্কতার সঙ্গে ট্যাসটেগো সন্ধান করতে লাগল, কোন দিক দিয়ে গর্ত খুঁড়বে হাইডেলবার্গ টানে। সন্ধান শেষ হতে লোহার একটা বালতি সংযুক্ত করল হুইপের এক প্রান্তে, হুইপের আরেক প্রান্ত রইল ডেকের সাহায্যকারীদের হাতে। টানের ভেতরে বালতি নামিয়ে দিল ট্যাসটেগো, একটু পর আবার টেনে তুলল নাবিকদের ইশারা করে। কাঁচা দুধের মত পদার্থে ভর্তি বালতি নাবিকরা ঢালল আরেকটা বড় বালতিতে। এভাবে তুলতে তুলতে একসময় বড় বালতিটা ভরে গেল। শেষের দিকে টাসটেগোকে স্পার্মাসেটি তুলতে হলো প্রায় বিশ ফুট নিচে থেকে।

আরও স্পার্মাসেটি তোলার পর ঘটল এক দুর্ঘটনা। ট্যাসটেগোর হাত ফসকে গিয়েছিল, নাকি বেশি পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল পায়ের নিচটা ঠিক বুঝতে পারলাম না, বালতির মতই সে গিয়ে পড়ল হাইডেলবার্গ টানে।

লাফ দিয়ে তিমির মাথার ওপরে উঠল ডাগগু। সে কেবল ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখছে ট্যাসটেগোর অবস্থা, সেই সময় আরেক দুর্ঘটনা। বিরাট বিরাট যে দুটো হুকে মাথাটা ঝোলানো ছিল, তার একটা গেল ভেঙে। আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেল সমস্ত নাবিক। মাথার সম্পূর্ণ ভার এখন একটামাত্র হুকের ওপর। পেকোড দুলছে, যেন ধাক্কা খেয়েছে আইসবার্গে।

নেমে এসো, নেমে এসো! চেঁচাল সবাই ডাগগুর উদ্দেশে। কিন্তু সে ততক্ষণে বালতিটা নামিয়ে দিয়েছে ভেতরে, তবু যদি সেটা জড়িয়ে ধরে উঠে আসতে পারে ট্যাসটেগো।

ঈশ্বরের দোহাই, নেমে এসো এখনই! চিৎকার করে উঠল স্টাব, কী লাভ হবে ওই লোহার বালতি লোকটার মাথার ওপর নামিয়ে?

সাবধান! সরে যাও! গর্জন ছাড়ল কে যেন।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দ্বিতীয় হুক ভেঙে স্পার্ম তিমির প্রকাণ্ড মাথাটা সশব্দে আছড়ে পড়ল সাগরে। একটা ট্যাকল আঁকড়ে ধরে কোনমতে নিজেকে রক্ষা করল ডাগগু। সবাই যখন ভাবছে, সলিল-সমাধি হয়ে গেল ট্যাসটেগোর, ঠিক তখনই খোলা তলোয়ার হাতে সম্পূর্ণ ন্যাংটো এক মূর্তি ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে। কুইকেগ! চোখের পলকে সবাই জমায়েত হলো জাহাজের প্রান্তে কিন্তু দুজনের কারোই কোন চিহ্ন নেই। কয়েকজন নাবিক নেমে পড়ল নৌকো নিয়ে।

ঝুলতে ঝুলতে হঠাৎ চিৎকার ছাড়ল ডাগগু। বেশ খানিকটা দূরে নীল সাগরের নিচ থেকে ভেসে উঠেছে একটা বাহু। সবার মনে হলো, বাহুটা যেন ছিটকে উঠেছে কবরের ঘাস সরিয়ে।

উঠেছে! উঠেছে! দুজনেই উঠেছে! আবার গলা ফাটাল ডাগগু। এক হাতে পানি কাটছে কুইকেগ, আরেক হাতে ধরে আছে ট্যাসটেগোর চুল। ঝটপট অপেক্ষমাণ নৌকোয় তুলে ওদের আনা হলো ডেকে। কিন্তু ট্যাসটেগোর জ্ঞান ফিরতে অনেক সময় লাগল, কুইকেগকেও খুব সুস্থ মনে হলো না।

তীক্ষ্ণধার তলোয়ারের কোপে হাইডেলবার্গ টানের তলাটা কেটে ফেলেছে কুইকেগ, তারপর লম্বা হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ট্যাসটেগোকে বের করে এনেছে চুলের মুঠি ধরে।

প্রায় অবিশ্বাস্য এক জীবন ফিরে পেল ট্যাসটেগো। কিন্তু মরলেও সে-মৃত্যু হত মূল্যবান। ওহাইয়োর কোন মধু-সংগ্রাহক নাকি গাছের খাজে মধুর ভাণ্ডার দেখে বেশি ঝুঁকে পড়ে হঠাৎ পা পিছলে ডুবে গিয়েছিল মধুতে। কুইকেগ উদ্ধার করলে গে-হেডারটাও ডুবে থাকত দুধ-সাদা, সুগন্ধী স্পার্মাসেটিতে। এমন মৃত্যু কজনের ভাগ্যে জোটে?

৬৯.

চেহারার দিক থেকে বিচার করলে স্পার্ম তিমি একটা ব্যতিক্রমী প্রাণী। নাক বলতে আমরা যা বুঝি, তা তার নেই অথচ নাক মুখমণ্ডলের একটা কেন্দ্রীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। চেহারার ভাল-মন্দের অনেকখানিই নির্ভর করে নাকের ওপর। মার্বেল পাথরে নির্মিত অপূর্ব কোন জুপিটারের নাকটা কেবল ভেঙে দিন, দেখুন, তার চেহারার কী গতি হয়। কিন্তু নাক না থাকলে জুপিটারের মূর্তির যা ক্ষতি, স্পার্ম তিমির বেলায় মোটেই তা নয়। বরং মনে হয়, নাক না থাকার ফলেই সে যেন বিশিষ্ট হয়েছে।

স্পার্ম তিমির কপালে রয়েছে অসংখ্য কুঞ্চন, যেন প্রাচীন কোন সাহিত্যিক লিখে রেখেছে মহাগ্রন্থ। কিন্তু কে করবে এর পাঠোদ্ধার! চ্যাম্পােলিয়ন হাইরোগ্লিফিকের পাঠোদ্ধার করেছিলেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের মুখেও যে-রহস্য লুকিয়ে আছে, তার দুর্বোধ্যতা ঘোচাবে কে? তিরিশটা ভাষা জানা সত্ত্বেও স্যার উইলিয়ম জোনস্ যদি চাষার মুখের ভাষা পড়তে ব্যর্থ হন, সেখানে তুচ্ছ ইসমাইল কিভাবে আশা করতে পারে তিমির কপালের ভাষা পড়ার? যাক, মহাগ্রন্থের সংবাদটা জানালাম সবাইকে সুযোগ পেলে চেষ্টা করে দেখবেন, পাঠোদ্ধার করতে পারেন কিনা।

৭০.

স্পার্মাসেটি সম্পূর্ণ বের করে নেয়ার পর স্পার্ম তিমির খুলিটাকে ভালভাবে পরীক্ষা করলে, অবাক হয়ে যাবেন মানুষের খুলির সঙ্গে সাদৃশ্য দেখে। পূর্ণবয়স্ক একটা স্পার্ম তিমির খুলির দৈর্ঘ্য অন্ততপক্ষে বিশ ফুট। নিচের চোয়ালটা খুলে ফেলুন, পাশ থেকে ওটাকে মনে হবে এয়ারবেসে পড়ে থাকা এরোপ্লেনের মত। খুলির উপরিভাগের প্রান্তে রয়েছে বাটির মত একটা গর্ত। সেই গর্তের মেঝের নিচে রয়েছে দশ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য আর দশ ইঞ্চি গভীরতার একটা খোপ। ছোট্ট এই খোপেই থাকে দানব প্রাণীটার মগজ।

এবার দুটো কথা বলব স্পার্ম তিমির কুঁজ সম্বন্ধে। অসংখ্য ভার্টেব্রা রয়েছে। তিমির শরীরে যত দূর মনে হয়, অপেক্ষাকৃত বড় একটা ভার্টেব্রার ওপরই গড়ে উঠেছে কুঁজ। আমার মতে, স্পার্ম তিমির মধ্যে যে একটা অদম্য, অটল ভাব আছে, তা এসেছে উঁচু এই কুঁজ থেকে।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত