৫১-৬০. ক্রোজেটস থেকে উত্তর-পুবে যেতে
৫১.
ক্রোজেটস থেকে উত্তর-পুবে যেতে যেতে আমরা এসে পড়লাম ব্রিটের বিস্তীর্ণ সব খেতে। হলুদ এই খুদে উদ্ভিদগুলো রাইট তিমির প্রধান খাদ্য। লীগের পর লীগ ব্রিট দেখে মনে হচ্ছে, পেকোড যেন ঢুকে পড়েছে পাকা সোনালি গমের খেতে।
দ্বিতীয় দিন চোখে পড়ল অনেক রাইট তিমি, হাঁ করে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন সকালবেলা ঘাস কাটতে বেরিয়েছে বাগানের মালী। ওগুলোর এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে ঠিক ঘাস কাটার মতই শব্দ হচ্ছে, পেছনে পড়ে থাকছে রাশি রাশি কাটা ব্রিট।
ব্রিট খেতে খেতে রাইট তিমিগুলো যখন থামছে, মাস্ট-হেড থেকে তাদের মনে হচ্ছে নিপ্রাণ প্রস্তরখণ্ড। ভারতে অনেক আগন্তুক নাকি কালো মাটির ঢিবি মনে করে হাতিকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়, তেমনি সাগরে আসা নতুন কেউ নিশ্চল তিমিকে বিশাল প্রস্তরখণ্ড ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারবে না।
৫২.
রাশি রাশি ব্রিটের মাঝখান দিয়ে এগোলাম আমরা উত্তর পুবের জাভা দ্বীপ অভিমুখে। ঝিরঝিরে চমৎকার বাতাস বইছে। চাদনি রাতে এখনও মাঝেসাঝে দেখা যাচ্ছে রূপালী সেই ফোয়ারা।
স্বচ্ছ এক সকাল। সোনালি সূর্য আঙুল উচিয়ে চুপ থাকতে বলছে সাগরকে, কানাকানি করতে করতে ছুটে যাচ্ছে ঢেউ। মেইনমাস্ট-হেড থেকে হঠাৎ একটা জিনিসু চোখে পড়ল ডাগর।
দূরে পানি থেকে উঠল বিরাট একটা সাদা স্তূপ, বেশ খানিকটা ওপরে ওঠার পর ভেঙে পড়ল পাহাড় থেকে নামা বরফ-ধ্বসের মত। পানির ওপর কিছুক্ষণ ঝকমক করল, তারপর ডুবে গেল ধীরে ধীরে। একটু পরেই আবার উঠল। জিনিসটাকে ঠিক তিমি মনে হলো না, নাকি ওটাই মবি ডিক? সাদা স্তূপটা আবার ডুবল, আবার উঠল, আর এবার উঠে এমন এক তীক্ষ্ণ চিৎকার ছাড়ল যে চমকে গেল সবাই। ডাগৃগু চেঁচাল–ওই যে! ওখানে! সাদা তিমি! সাদা তিমি!
মৌমাছির ঝাকের মত নাবিকেরা ছুটে এল ডেকে। খালি মাথাতেই উপস্থিত হলো আহাব। ডাগর নির্দেশিত দিকে নিবদ্ধ তার প্রত্যাশী দুই চোখ, একটা হাত ওপরে ওঠানো যে-কোন মুহূর্তে নাবিকদের নৌকো নামাবার আদেশ দেয়ার জন্যে।
সাদা স্তুপটা চোখে পড়তেই আদেশ দিল ক্যাপটেন আহাব। চোখের পলকে নামানো হলো চারটে নৌকো। সবচেয়ে সামনে আহাবের নৌকো, তার পেছনে পেছনে অন্য তিনটে ছটে চলল শিকারের উদ্দেশে। ডুবে গেল স্তূপটা। দাঁড় থামিয়ে আমরা অপেক্ষা করছি রুদ্ধশ্বাসে, একটু পর যেখানে ডুবেছিল ঠিক সেখানেই ধীরে ধীরে আবার ভেসে উঠল জিনিসটা। মুহূর্তে মবি ডিকের কথা উধাও হয়ে গেল সবার মাথা থেকে, অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম আমরা রহস্যময় সাগরের সবচেয়ে বড় রহস্যটির দিকে। ঝলসানো ক্রীম রঙের বিশাল এক মণ্ড, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে এক ফার্লং, মাঝখান থেকে অসংখ্য বাহু মোচড় খাচ্ছে এক দল অ্যানাকোণ্ডার মত, যেন দুর্ভাগা কোন প্রাণী ওটার আওতার মধ্যে গেলেই হয়। জিনিসটার কোন মুখ বা শরীরের সম্মুখভাগ নেই, কোন বোধ আছে বলেও মনে হয় না, পানির ওপর ফুসছে যেন আকারহীন জীবনের এক প্রেতচ্ছায়া।
মৃদু শব্দ করে পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল জিনিসটা। আলোড়িত পানির ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই স্টারবাক বলল, মবি ডিকের সঙ্গে লড়াই করার চেয়ে তোকে দেখেই বেশি ভাল লাগল রে, সাদা ভূত!
ওটা কি, স্যার? জিজ্ঞেস করল ফ্লাস্ক।
দানব স্কুইড। খুব কম হোয়েল-শিপেরই একে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, আর যারা দেখেছে তাদের খুব কমই বন্দরে ফিরে সে-গল্প করতে পেরেছে।
আহাব কিছুই বলল না। নিঃশব্দে ফিরে চলল পেকোডের দিকে, পেছনে পেছনে অন্য তিন নৌকো।
এক নজরে এত বড় একটা জিনিসকে ভালভাবে লক্ষ করা কঠিন। স্কুইড যারা দেখেছে, তাদের সবাই এক বাক্যে বলেছে যে মহাসাগরের প্রাণিকুলের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড়, কিন্তু তাদের কেউই এটার সঠিক আকার আর স্বভাবের ব্যাপারে কোন ইঙ্গিত দিতে পারেনি।
বিশপ পন্টোপ্লোডান যে অতিকায় ক্র্যাকেনের কথা বলেছেন, খুব সম্ভব সেটা আসলে স্কুইড। তবে তার আকারের বর্ণনাটা অবিশ্বাস্য। যাই হোক, স্কুইড যে ক্যাটল মাছ গোত্রের প্রাণী, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
৫৩.
তিমি শিকারের বিষয়টা ভালভাবে বুঝতে হলে হোয়েল-লাইন অর্থাৎ তিমি শিকারে ব্যবহৃত রশিটার কথা জানতেই হবে।
এই রশি তৈরি হয় উৎকৃষ্ট জাতের শণ থেকে। রশির ওপর দেয়া হয় আলকাতরার প্রলেপ। পরের দিকে আমেরিকায় তিমি শিকারে শণের রশির বদলে ব্যবহৃত হয় ম্যানিলা রোপ। শণের রশির মত অতটা টেকসই না হলেও ম্যানিলা রোপ অনেক বেশি শক্ত।
হোয়েল-লাইন মাত্র এক ইঞ্চির দুই তৃতীয়াংশ মোটা। প্রথম দেখায় কেউ ধারণাই করতে পারবে না যে রশিটা এত শক্ত। এটা তিন টন পর্যন্ত চাপ সহ্য করতে পারে। সাধারণত স্পার্ম তিমির জন্যে রশি লাগে দুশো ফ্যাদমের চেয়েও খানিকটা লম্বা। যেটার সঙ্গে রশি প্যাচানো থাকে, সেই জিনিসটাকে বলে টাব। ইংরেজ নৌকোয় টাব থাকে দুটো। আমেরিকান নৌকোয় একটা করে টাব থাকলেও তার ব্যাস প্রায় তিন ফুট।
৫৪.
স্কুইড স্টারবাকের দৃষ্টিতে বিস্ময়কর হলেও কুইকেগের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। ওই স্কুইডকে যখন দেখা গেছে, বলল সে হারপুন ঝাঁকিয়ে, খুব শিগগিরই স্পার্ম তিমির দেখা পাওয়া যাবে।
পর দিন কোন কাজ না থাকায় ঢুলতে লাগল নাবিকরা। এখন ভারত মহাসাগরের যে-এলাকা দিয়ে পেকোড যাচ্ছে, সেটা তিমি শিকারীদের হিসেবে প্রাণবন্ত অঞ্চল নয়। অর্থাৎ, এদিকটায় রিও দে লা প্লাটা বা পেরুর উপকূলের মত পরপয়েজ, ডলফিন আর ফ্লাইং ফিশ দেখা যায় না।
এখন ফোরমাস্ট-হেডে প্রহরা দেয়ার পালা চলছে আমার। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলছি অলস বাতাসে, এছাড়া আর করার কী-ইবা আছে। একসময় মন চলে গেল শরীর ছেড়ে। কেমন একটা আচ্ছন্নতা পেয়ে বসল আমাকে। মেইন আর মিজেন মাস্ট-হেডে প্রহরারত নাবিক দুজনও ঢুলছে। ঢুলছে নিচের নাবিকেরা, ঢুলছে ঢেউ, পুব ঢুলে পড়ছে পশ্চিমের দিকে, আর সবার মাথার ওপর ঢুলছে সূর্য।
হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠলাম আমি। সামনে তাকাতেই দেখি, চল্লিশ ফ্যাদমেরও কম দূরত্বে ভেসে উঠেছে প্রকাণ্ড এক স্পার্ম তিমি। সূর্যের আলোয় আয়নার মত চকচক করছে শরীর, অলস ভঙ্গীতে ফোয়ারা ছাড়ছে তিমিটা। ইতিমধ্যে যেন অদৃশ্য কোন জাদুদণ্ডের স্পর্শে জেগে গেছে সমস্ত নাবিক, পুরো জাহাজে শুরু হয়ে গেছে ছুটাছুটি, চেঁচামেচি।
নৌকো থামাও! আদেশ দিল আহাব, তারপর নিজেই নিজের আদেশ পালন করতে দৌড়ে গেল সামনে।
নাবিকদের হঠাৎ চেঁচামেচিতে ভয় না পেলেও যেন একটু সজাগ হয়ে খুব ধীরে ধীরে সাঁতরাতে লাগল তিমিটা। আহাব আদেশ দিল, কেউ দাঁড় ব্যবহার করতে পারবে না, জোরে কথা বলতে পারবে না। সুতরাং নৌকোর গানেলে বসে নিঃশব্দে কিন্তু দ্রুতগতিতে প্যাডেল মেরে এগোতে লাগলাম আমরা। একবার দানবটার লেজ পানি থেকে উঠে গেল প্রায় চল্লিশ ফুট ওপরে, তারপর ডুবল, ঠিক যেন অদৃশ্য হয়ে গেল একটা মিনার।
ওই যে লেজ! বলে পাইপ ধরাল স্টাব। আবার ভাসল তিমিটা, চলে এল তার নৌকোর কাছে। অবশেষে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে তিমি, সুতরাং রাখঢাকের আর কোন প্রয়োজন নেই। প্যাডেল রেখে ঝপাঝপ দাড় টানতে লাগল সবাই, পাইপে টান দিতে দিতে তাদের উৎসাহিত করতে লাগল স্টাব।
তিমিটা সত্যিই বুঝতে পেরেছে, গতি সামান্য বাড়িয়ে সামনে এগোল সে।
ওকে চমকে তোল, চমকে তোল! তাড়াহুড়োর কিছু নেই, যা করার যথেষ্ট সময় নিয়ে করো–কিন্তু চমকে দাও ওকে, ঠিক যেমন বজ্রপাতে চমকে ওঠে মানুষ। আরও জোরে, ট্যাসটেগো। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রাখো! মৃত্যু আর মুখ ভ্যাংচানো শয়তান দেখার মত করে চমকে তোল ওকে! ব্যস, ব্যস!
উঁ-হু! ওয়া-হী? জবাবে আকাশে রণহুংকার ছুঁড়ে মারল গে-হেডার। আরও জোরে দাঁড় বাইতে লাগল নাবিকরা।
ট্যাসটেগোর বুনো চিৎকারের জবাব ভেসে এল ডাগগুর তরফ থেকে। কীহী! কী-হী! সামনে-পেছনে দুলছে সে খাঁচায় বন্দী বাঘের মত।
কা-লা! কু-লু! চিৎকার ছাড়ল কুইকেগও। ধূমপানের সঙ্গে সঙ্গে নাবিকদের উৎসাহিত করে চলল স্টাব। তর তর করে এগোল নৌকো, বেশ কিছুক্ষণ পর শোনা গেল বিশেষ সেই চিৎকার–ট্যাসটেগো, উঠে দাঁড়াও! শাঁ করে ছুটে গেল হারপুন। নৌকো পিছিয়ে নেয়া হলো। প্রায় তখনই পাক খুলে বো বো করে ছুটতে লাগল হোয়েল-লাইন। রশিটাকে ধরে থাকতে থাকতে স্টাবের মনে হলো, হাতের ভেতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে দুধারী তলোয়ার।
লাইন ভেজাও! লাইন ভেজাও! টাবের পাশে বসে থাকা নাবিককে বলল স্টাব। রশিটা ভিজিয়ে দিল সে। নৌকো এখন ছুটছে আক্রমণােদ্যত হাঙরের মত। দ্রুত নিজেদের মধ্যে জায়গা বদল করে নিল স্টাব আর ট্যাসটেগো, নৌকোর ছুটন্ত অবস্থায় কঠিন এক কাজ ওটা।
বীণার তারের মত টান টান হয়ে গেছে রশি, নাবিকদের স্নায়ুও এখন রশির মত টান টান, নৌকোর বোতে ধাক্কা খেয়ে জলপ্রপাতের মত ছুটে যাচ্ছে পানি।
টেনে ধরো–টেনে ধরো! চেঁচাল স্টাব নাবিকদের উদ্দেশে। তারপর নৌকোয় হাটু গেড়ে বর্শা ছুঁড়তে লাগল তিমিটাকে লক্ষ্য করে। প্রত্যেকবার তিমির ভয়াবহ আলোড়নের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যে স্টাবের নির্দেশে নৌকো পিছিয়ে নেয়া হলো, আর নৌকো পেছাতেই আবার প্রস্তুত হলো সে বর্শা ছোড়ার জন্যে।
রক্তের স্রোত বইতে লাগল তিমিটার চারপাশে, তাতে সূর্যের বাঁকা আলো প্রতিফলিত হয়ে নাবিকদের সবাইকে পরিণত করল লাল মানুষে। স্পার্ম তিমিটা শরীর মোচড়াতে লাগল তীব্র যন্ত্রণায়।
নৌকো এগোও! কাছে নিয়ে যাও! আরও কাছে! নির্দেশ দিয়ে বিরাট লম্বা একটা বর্শা হাতে শেষ আঘাত হানার জন্যে প্রস্তুত হলো স্টাব। নৌকো তিমির পাঁজরের কাছে আসতে বর্শাটা গেঁথে ঘোরাতে লাগল স্টাব, যেন খুঁজে ফিরছে হারিয়ে যাওয়া কোন সোনার ঘড়ি।
ভলকে ভলকে রক্ত বের করে দিয়ে খাবি খেতে লাগল তিমিটা, তারপর আস্তে আস্তে কাৎ হয়ে পড়ল একপাশে। ফেটে চৌচির হয়ে গেছে ওটার হৃৎপিণ্ড।
তিমিটা মারা গেছে, মি. স্টাব, বলল ডাগগু।
হ্যাঁ, মুখ থেকে পাইপ টেনে নিয়ে সাগরে ছাই ঝাড়ল স্টাব, তারপর চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকাল নিজের হাতে মারা পড়া তিমিটার দিকে।
৫৫.
গত অধ্যায়ের ঘটনা সম্বন্ধে একটা কথা বলতে চাই আমি।
তিমি শিকারে সাধারণত জাহাজ থেকে নৌকো এগোবার সময় হেডসম্যান অর্থাৎ তিমির প্রকৃত শিকারী অস্থায়ীভাবে হাল ধরে থাকে, আর সবচেয়ে সামনের দাঁড় বায় হারপুনার। হারপুন যে ছুঁড়বে, তার হাতে প্রচুর শক্তি আর মাথাটা ঠাণ্ডা থাকা দরকার। কারণ, হারপুন যদিও বেশ লম্বা, ভারী অস্ত্রটাকে ছুঁড়তে হয় বিশ তিরিশ ফুট দূর থেকে। হারপুনারকে নৌকো ছোটার সময় শুধু দাঁড়ই ধরে থাকলে হয় না, সর্বক্ষণ চেঁচাতে হয়। দেশি টান টান হয়ে থাকা অবস্থায় একনাগাড়ে চিৎকার করা যে কি কষ্ট, তা যার এই অভিজ্ঞতা আছে, সে-ই শুধু জানে। আর এরকম প্রচণ্ড ক্লান্তিকর একটা কাজ করতে করতেই হারপুনারের কানে চিৎকার ভেসে আসে–উঠে দাঁড়াও! হারপুন ছোড়ো! তখন দাড় নামিয়ে রেখে তাকে ঘুরে যেতে হয় অর্ধবৃত্তাকারে, তারপর ক্রচ থেকে হারপুন তুলে নিয়ে ছুঁড়তে হয় তিমি লক্ষ্য করে। এজন্যেই পঞ্চাশটা হারপুনের মধ্যে লক্ষ্যভেদ করে গোটা পাচেক। এজন্যেই অনেক জাহাজ মালিকের কাছে তিমি শিকারটা লাভজনক হয় না। তিমি শিকারের মূলে রয়েছে হারপুনার। আগেই যদি তার দম বের করে নেয়া হয়, প্রয়োজনের সময়ে সে দম পাবে কোথায়?
আবার হারপুন যদি লক্ষ্যভেদ করে, তিমি ছোটার সঙ্গে সঙ্গে হেডসম্যান আর হারপুনার নিজেদের জায়গা বদল করে। আমার মনে হয়, এটা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত হেডসম্যানেরই থাকা উচিত নৌকোর সামনে, তারই ছোড়া উচিত হারপুন এবং বর্শা। এতে সময় কিছুটা বেশি লাগে বটে, কিন্তু এই কারণে তিমি শিকার ব্যর্থ হয় না। তিমি শিকারের ব্যর্থতার মূলে রয়েছে হারপুনারের ক্লান্তি।
৫৬.
কাণ্ড থেকেই গাছের শাখা জন্মে, আর শাখা থেকেই প্রশাখা। তেমনি বইয়ের বেলায় এক অধ্যায় জন্ম দেয় অরেক অধ্যায়ের।
গত অধ্যায়ে ক্রচ সম্বন্ধে বলেছি। এখন ক্রচ জিনিসটা কি, তার একটা ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন মনে করছি। ক্রচ হলো দুফুট লম্বা, খাজ কাটা অদ্ভুত দর্শন একটা লাঠি, যেটা বোর কাছে স্টারবোর্ড গানেলে ঢোকানো থাকে। ক্রচ ব্যবহৃত হয় হারপুনের কাঠের অংশটা ঠেস দিয়ে রাখার কাজে, যেন হারপুনার চাওয়ামাত্র অস্ত্রটা তুলে নিতে পারে। ক্ৰচে সাধারণত দুটো হারপুন রাখা হয়, তিমি শিকারীরা যাকে বলে প্রথম ও দ্বিতীয় লোহা।
দুটো হারপুনের সঙ্গেই জড়ানো থাকে হোয়েল-লাইন, যেন দুটোই ছোঁড়া যায় পর পর। কিন্তু প্রথম হারপুন বিদ্ধ হলে তিমি এত জোরে ছুটতে শুরু করে যে সাধারণত দ্বিতীয় হারপুন ছোঁড়ার সুযোগ হারপুনার পায় না। তবে দ্বিতীয় হারপুনের সঙ্গেও যেহেতু লাইন জড়ানো থাকে, ওটা না ছুঁড়লেও লাইনের টানে একসময় ছিটকে পড়ে পানিতে, এবং সেই সময়টা ভালভাবে লক্ষ না রাখলে লাইনে প্যাচ লেগে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা।
আর দ্বিতীয় হারপুন যদি তিমির গায়ে বিদ্ধ হয়, লাইন জড়িয়ে গিয়ে অনেক সময়েই সবগুলো নৌকায় একটা হৈচৈ ফেলে দেয়, এবং এই ক্ষেত্রে তিমি মারা না যাওয়া পর্যন্ত জড়ানো লাইন খুলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে আনা সম্ভব হয় না।
এবার মনে করুন, চারটে নৌকো পিছু নিয়েছে একটা মাত্র শক্তিশালী তিমির; প্রত্যেক নৌকোতেই যেহেতু একাধিক হারপুন থাকে, প্রত্যেকেই ছুঁড়তে পারে তাদের দ্বিতীয় হারপুন। তাহলে হয়তো দেখা গেল, তিমি ছুটছে তীর বেগে, আর অনেকগুলো হারপুন ঝুলছে তার গায়ে আলগাভাবে বিদ্ধ হয়ে। কল্পনা করুন, তখন এক নৌকোর রশির সঙ্গে আরেক নৌকোর রশি জড়িয়ে গেলে কি ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। বিশদভাবে জিনিসগুলোর ব্যাখ্যা দিলাম যেন পরবর্তী অধ্যায়গুলো পড়তে কোনকিছু আপনাদের কাছে জটিল মনে না হয়।
৫৭.
স্টাবের তিমিটা মারা গিয়েছিল জাহাজ থেকে বেশ খানিকটা দূরে। আমরা আঠারোটা মানুষ লেগে পড়লাম ওটাকে বাঁধার কাজে। তবে, তিমির মত অত বড় একটা জিনিস বাঁধা অল্প সময়ে সম্ভব নয়।
আঁধার নেমে এল, পেকোডে তিনটে বাতি জ্বেলে পথ দেখানো হলো আমাদের। কাছে যেতে বুলওয়ার্কের ওপর দিয়ে একটা বাতি ঝুলিয়ে দিল আহাব। তিমিটার ব্যাপারে কোন উৎসাহ দেখাল না সে। ফাঁকা চোখে একবার তাকিয়ে, তিমিটাকে রাতের মত বাঁধতে বলে চলে গেল কেবিনে।
তিমিটাকে প্রথম দেখার পর আহাবের উৎসাহ ভালই ছিল, কিন্তু এখন মৃত অবস্থায় দেখে হয়তো পেয়ে বসেছে একটা হতাশা। মনে হচ্ছে, মবি ডিক এখনও মরেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝনঝনানি উঠল পেকোডের ডেকে, শেকল দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হলো তিমিটাকে। এসবের পুরো দায়িত্ব সেকেণ্ড মেটের হাতে দিয়ে স্টারবাকও চলে গেছে ইতিমধ্যে।
একটা স্টেক, বলল স্টাব, ঘুমানোর আগে স্টেক খাব আমি। ডাগগু, যাও তো, ওটার গা থেকে একটা টুকরো কেটে নিয়ে এসো!
মাঝরাতের দিকে রান্না শেষ হলো। আরাম করে খেতে বসল স্টাব। ইতিমধ্যে জুটেছে আরও ভোজন রসিক। এক পাল হাঙর এসে ছিড়তে শুরু করেছে তিমিটা। তাদের লেজের বাড়ি লাগছে জাহাজের গায়ে। উঁকি দিলে দেখা যাচ্ছে, ঝাপিয়ে পড়ছে তারা তিমিটার ওপর, একেক বারে কেটে নিচ্ছে মানুষের মাথার সমান একটা করে টুকরো।
প্রথমে হাঙরগুলোকে কোন গুরুত্বই দিল না স্টাব। কিন্তু পরে একসময় দুপা ছড়িয়ে দিয়ে ডাকল, রাঁধুনি! রাঁধুনি! বুড়ো ফ্লিসটা গেল কোথায়? এই, রাঁধুনি, জলদি এদিকে এসো!
অনিচ্ছাসত্ত্বেও হ্যামকের আরাম ছেড়ে বুড়ো কৃষ্ণাঙ্গ পাচক এসে উপস্থিত হলো সেকেণ্ড মেটের পাশে।
রাঁধুনি, লাল একটা টুকরো মুখে পুরে বলল স্টাব, রান্নাটা একটু বেশি হয়ে যায়নি? বড় নরম হয়ে গেছে স্টেকটা। তোমাকে অনেক বার বলিনি, তিমির স্টেক সুস্বাদু করতে হলে খানিকটা শক্ত রাখতে হবে? ওই যে হাঙরগুলো, ওরাও শক্ত মাছ পছন্দ করে। শুনতে পাচ্ছ, কেমন: হুটোপাটি শুরু করে দিয়েছে? যাও, ওদের গিয়ে বলো, খেতে মানা নেই, কিন্তু খেতে হবে চুপচাপ। ভদ্রভাবে। যাও, গিয়ে বুঝিয়ে বললো আমার কথা। এই নাও বাতি, সাইডবোর্ড থেকে একটা বাতি নিয়ে পাচকের হাতে দিল সে।
গম্ভীর মুখে বাতিটা নিয়ে এগোল বুড়ো ফ্লিস। কথা শোনার জন্যে পা টিপে টিপে স্টাব গিয়ে দাঁড়াল তার পেছনে।
প্রিয় প্রাণীগণ, তমাদের জানানোর জন্যে আমাকে আদেশ করা হয়েছে যে বিশ্রী এই গোলমাল বন্ধ করতে হবে। শুনতে পাচ্ছ? ঠোঁট চাটা বন্ধ করো! মাস্টার স্টাব বলেছেন, পেট পুরে খেতে কোন বাধা নেই তোমাদের। কিন্তু ঈশ্বরের দোহাই, এই গণ্ডগোল থামাতেই হবে!
রাধুনি, বুড়োর কাঁধে একটা থাবড়া মারল স্টাব–উঁহুঁ, কারও দোহাই দিও না। পাপীদের সুপথে আনার সময় শপথ করতে নেই!
তাহলে আপনিই বলুন, যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল সে।
না, না, চালিয়ে যাও, চালিয়ে যাও।
প্রিয় প্রাণীগণ, তোমরা খুবই পেটুক। এত পেটুক হওয়া ভাল নয়। জাহাজে লেজ দিয়ে বাড়ি মেরো না। অবশ্য পেটুক হবার জন্যে তোমাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, জন্ম থেকেই পেটুক তোমরা। কিন্তু এটা একটু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করো। তোমরা হাঙর, কিন্তু ভেতরের হাঙরটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই তোমরা পরিণত হবে ফেরেশতায়। শুনে রাখো, ফেরেশতারা নিয়ন্ত্রিত হাঙর ছাড়া আর কিছুই নয়। এই তিমির ওপর তোমাদের কোন অধিকার নেই, অধিকার রয়েছে অন্যের। তবু খেতে পারো তোমরা, কিন্তু ঈশ্বরের দোহাই, ভদ্রভাবে খাও। জানি, তোমাদের মুখ অন্যের চেয়ে বড়, কিন্তু মুখ বড় হলেও অনেকের পেট ছোট থাকে।
চমৎকার, ফ্লিস, বলল স্টাব, চালিয়ে যাও, চালিয়ে যাও!
লাভ নেই, মাস্টার স্টাব, ব্যাটারা পেট না ভরা পর্যন্ত কিছুই শুনবে না। আর ভরলেই বা শুনবে কখন, তখন তো ওরা চলে যাবে ঘুমাতে।
বিশ্বাস করো, আমিও ঠিক এই কথাটাই বলতে চাইছিলাম। ওদের আশীর্বাদ করো, ফ্লিস। আমি খেতে যাই।
গণ্ডগোল করো তোমরা যত খুশি, আর খেতে থাকো যতক্ষণ ইচ্ছে। পেট ফেটে মরলে তখন বুঝবে!
এবার, বঁধুনি, খেতে খেতে বলল স্টাব, আগের জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে আমার কথা শোনো।
শুনছি।
বেশ। এখন আমি আবার বলতে চাই সেই রান্নার কথা। তা, তোমার বয়স কত হয়েছে, রাধুনি?
আপনার কত মনে হয়? পাল্টা প্রশ্ন করল ফ্লিস।
চুপ! বলো, বয়স কত হয়েছে?
সবাই বলে, প্রায় নব্বই, বিড়বিড় করে উঠল বুড়ো।
তাহলে কি প্রায় একশো বছর বাঁচা সত্ত্বেও রান্না তুমি শিখবে না? এবার বলো, তোমার জন্ম কোথায়?
হ্যাচওয়ের পেছনে, ফেরিতে, রোয়ানক যাবার সময়।
ফেরিতে? অদ্ভুত ব্যাপার! কিন্তু আমি জানতে চেয়েছিলাম, বঁধুনি, তোমার জন্ম হয়েছে কোন্ দেশে।
বললামই তো–রোয়ানক, তীক্ষ্ণ স্বরে বলল বুড়ো।
তুমি এক কাজ করো, রাঁধুনি, তোমার দেশে ফিরে গিয়ে আবার জন্মগ্রহণ করো। এত বয়স হয়েছে, অথচ তুমি এখনও তিমির স্টেক রান্না করতে শেখখানি।
আর যদি কখনও রান্না করেছি, গজরাতে গজরাতে ঘুরে চলে যাবার জন্যে পা বাড়াল বুড়ো।
শোনো, শোনো, ডাকল স্টাব পেছন থেকে। এই নাও। তুমি নিজেই খেয়ে বলো, স্টেকটা কেমন হয়েছে।
শুকনো ঠোঁট স্টেকটায় সামান্য বুলিয়ে নিগ্রো বুড়ো বলল, এর চেয়ে ভাল স্টেক আমি জীবনে খাইনি; রসাল, খুব রসাল।
রাধুনি, জীবনে তুমি কখনও গির্জায় গেছ?
একবার গেছি। কেপ টাউনে।
বলছ, গির্জায় গেছ, অথচ এইমাত্র এত বড় একটা মিথ্যে কথা তুমি আমাকে বলতে পারলে? কোথায় যাবার আশা করো, রাধুনি?
বিছানায়, বলতে বলতেই ঘুরে দাঁড়াল বুড়ো।
থামো! আমি বলতে চাইছি, মরার পর তুমি কোথায় যাবার আশা করো। প্রশ্নটা ভয়ঙ্কর, রাধুনি, ভেবে-চিন্তে জবাব দাও।
এই কালো মানুষটা যখন মরবে, সম্পূর্ণ বদলে গেল তার স্বর এবং মুখের ভাব, সে নিজে কোথাও যাবে না, ফেরেশতারা তাকে নিতে আসবে।
নিতে আসবে? কিভাবে? গাড়ি নিয়ে? কোথায় নিয়ে যাবে?
ওখানে, ওপরদিকে আঙুল নির্দেশ করল ফ্লিস!
অর্থাৎ, মরার পর তুমি মেইনমাস্ট-হেডে যাবার আশা করো? কিন্তু জানে তো, যত ওপরে যাবে তত ঠাণ্ডা লাগবে? মেইনমাস্ট, অ্যা?
আমি মোটেই এ-কথা বলিনি, গম্ভীর হয়ে গেল ফ্লিস।
বলেছ–ওখানে তুমি নিজেই দেখো, তোমার আঙুলটা কোনদিকে ধরা আছে। তবে তুমি বোধ হয় স্বর্গে যাবার আশা করো, তাই না? স্বর্গে যাওয়া অত সহজ নয়। আমরা কেউ এখনও স্বর্গে যাইনি। যাক গে, বাদ দাও ওসব। মনোযোগ দিয়ে শোনো আমার কথা।
মনোযোগ দিয়েছি।
বেশ। তোমার রান্না করা তিমির স্টেক এতই বাজে যে সেটা আমি যত শিগগির সম্ভব অদৃশ্য করে দিয়েছি। ভবিষ্যতে আমার জন্যে স্টেক রান্না করার সময় বলে দেব, রান্নাটা ঠিক কিভাবে করতে হবে। নিজে ওস্তাদি করে আগেই যেন সব নষ্ট করে দিও না। এক হাতে স্টেকটা ধরবে, আরেক হাতে এক টুকরো জুলন্ত কয়লা তুলে নিয়ে স্টেকটাতে চুইয়েই পরিবেশন করবে। বুঝতে পেরেছ? আর আগামীকাল তিমিটা কাটার সময় নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওটার পাখনার ডগাগুলো নিয়ে আচার করতে দেবে। লেজের উগারও আচার করবে। হ্যাঁ, এবার যাও।
কিন্তু ধাপ তিনেক না যেতেই আবার তাকে ডাকল স্টাব।
আগামীকাল রাতের খাবারে তিমির কাটলেট দেবে আমাকে। বুঝতে পেরেছ? হ্যাঁ, এবার যাও। শোনো, শোনো! সকালের নাস্তায় দেবে তিমির চপ। খবরদার–ভুলো না যেন!
ঈশ্বরের দোহাই, হ্যামকে শুতে শুতে বলল বুড়ো, সে তিমিকে খাবে না, তিমিই তাকে খাবে। যে-হাঙরের পাল এসেছে, মাস্টার স্টার তাদের চেয়ে অনেক বড় হাঙর!
৫৮.
একটা স্পার্ম তিমিকে মেরে জাহাজের কাছে আনার সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে কাটাকাটি শুরু করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে রাত নেমে এলে তো একেবারেই অসম্ভব। কারণ, তিমি কাটা সময়সাপেক্ষ কাজ। তখন প্রতি ঘণ্টায় দুজন করে তিমিটাকে পাহারা দিতে হয় সারা রাত।
তবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বেশির ভাগ সময়েই এই পাহারা কোন কাজে আসে না। মৃত তিমির রক্তের গন্ধে এসে হাজির হয় পালে পালে হাঙর। এবং ছয় ঘণ্টা পর যখন দিনের আলো ফোটে, কঙ্কাল ছাড়া তিমির আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। সাগরের যেসব এলাকায় হাঙরের সংখ্যা কম, সেখানে তীক্ষ হোয়েল-স্পেড় দিয়ে অনবরত তোতে থাকলে তাদের ভোজনের মাত্রা কিছুটা কমে আসে। কিন্তু এতে অনেক সময়ে হিতে বিপরীত হয়, খোচা খেয়ে হাঙর আরও লোভী হয়ে ওঠে।
যাই হোক, রাতের খাবার সেরে পাহারার ব্যবস্থা করল স্টাব। কুইকেগ আর ফোকাসলের একজন নাবিক যখন ডেকে এল, হাঙরদের মাঝে শুরু হয়ে গেছে ভীষণ হুটোপাটি। তিনটে লণ্ঠন নামিয়ে হোয়েল-স্পেড দিয়ে পাগলের মত খোচাতে লাগল ওরা। সম্ভবত মাথাই হাঙরের একমাত্র মারাত্মক অঙ্গ। বেশ কয়েকটা হাঙর মারা গেল মাথায় খোচা খেয়ে। কিন্তু প্রত্যেক বার লক্ষ্যভেদ করা সম্ভব হলো না দুই প্রহরীর পক্ষে। আর এতে করে হিংস্রতা আরও অনেক বেড়ে গেল হাঙরগুলোর। সঙ্গীদের বেরিয়ে পড়া নাড়ীভুড়িগুলো চিবিয়েই ক্ষান্ত হলো না, চিবাতে লাগল নিজের নাড়ীভুড়িও। হাঙরদের বুঝি দ্বিতীয় প্রাণ থাকে, নাহলে সমস্ত নাড়ীভুড়ি খেয়ে ফেলার পরেও তারা বেঁচে থাকে কিভাবে! চামড়ার লোভে একটা হাঙরকে ডেকে তুলেছিল কুইকেগ, সেটার চোয়াল বন্ধ করতে গিয়ে ওর একটা হাত খুব অল্পের জন্যে বেঁচে গেল।
যন্ত্রণায় হাত ওপর-নিচ করতে করতে সে বলল, কুইকেগ কোন হাঙরকে থোড়াই পরোয়া করে।
৫৯.
গত রাত ছিল শনিবারের রাত। পর দিন যেন শুরু হয়ে গেল বিরাট এক সাবাথ! তবে কিনা এই সাবাথে শয়তান উপাসকদের বদলে যোগ দিল নাবিকরা। পেকোড পরিণত হলো একটা কসাইখানায়, নাবিকেরা কসাইয়ে। এখানে হঠাৎ কেউ এসে উপস্থিত হলে ভাববে, আমরা বুঝি দশ হাজার লাল ষাঁড় উৎসর্গ করছি সাগর দেবতার উদ্দেশে।
প্রথমে কাটার যন্ত্রের সঙ্গে বড় বড় ভারী ব্লক ওপরে তুলে শক্ত করে বাঁধা হলো লোয়ার মাস্ট-হেডে নিচের ঝুলন্ত ব্লকের সঙ্গে সংযুক্ত করা হলো একশো পাউণ্ড ওজনের ব্লাবার হুক তারপর হুক ঢোকানোর জন্যে লম্বা স্পেড় দিয়ে তিমির পার্শ্বদেশের দুই পাখনার সামান্য ওপরে ফুটো করল স্টারবাক আর স্টাব। তারপর ফুটো দিয়ে হুক ঢুকিয়ে বন্য চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণপণ শক্তিতে টানতে লাগল নাবিকেরা প্রত্যেকটা টানে দুলে উঠল পুরো জাহাজ। অনেকক্ষণ পর কিছু একটা ছেড়ার শব্দ পাওয়া গেল, হুকের সঙ্গে উঠে এল ব্লাবারের একটা টুকরো। সূচনা হলো তিমি কাটার।
৬০.
এবার দুএকটা কথা বলতে চাই তিমির চামড়া প্রসঙ্গে। এই চামড়া নিয়ে অনেক মতভেদ আছে, কিন্তু আমি আমার মতেই অটল থাকতে চাই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তিমির চামড়াটা কোথায় থাকে? আমার মতে, ব্লাবারের ওপর যে দশ-বারো ইঞ্চি পুরু একটা আবরণ আছে, ওটাই তিমির চামড়া। এটা সত্যি যে, তিমির পুরো শরীরের ওপর স্বচ্ছ একটা স্তর আছে, কিন্তু এরকম অতিকায় একটা প্রাণীর চামড়া নিশ্চয় নবজাতক শিশুর চামড়ার চেয়েও পাতলা হতে পারে না। সুতরাং ব্লাবারকেই বলা উচিত তিমির চামড়া।
ব্লাবারের গরম কম্বল গায়ে জড়ানো থাকে বলেই তিমি যে কোন আবহাওয়ায় বসবাস করতে পারে। ভেবে দেখুন, ব্লাবার না থাকলে গ্রীনল্যাণ্ডে তিমির কি অবস্থা হত! এই পানিতে অন্য প্রজাতির মাছ দেখা যায় সত্যি, কিন্তু সেগুলো সবই ফুসফুসহীন, ঠাণ্ডা রক্তের মাছ, তাদের নিজেদের পেটই একটা করে রেফ্রিজারেটর। কিন্তু তিমির রক্ত গরম, তার ফুসফুস আছে। এই রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেলে তিমি মারা যাবে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, গ্রীষ্মে বোর্নিওর নিগ্রোদের রক্ত যতখানি গরম থাকে, মেরু অঞ্চলের তিমির রক্ত তার চেয়েও গরম।