৪১-৫০. ডেকের উল্টো পাশে
৪১.
ডেকের উল্টো পাশে দাঁড়ানো ভৌতিক মূর্তিগুলো খুলতে লাগল ওখানে বাধা নৌকোটা। স্টারবোর্ড কোয়ার্টারে থাকে বলে এটাকে, ক্যাপটেনের নৌকো বলো। বের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিটা কালো। লম্বা, সাদা একটা ঝকঝকে দাঁত বেরিয়ে আছে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে মাথায় একটা পাগতি। অন্য চারজন এতটা কালো নয়, চামড়ার রঙ অনেকটা বাঘের মত হলুদ ফিলিপাইনের আদিবাসীদের মধ্যে এই ধরনের লোক দেখতে পাওয়া যায়।
জাহাজের সবাই যখন তাকিয়ে রয়েছে হতবাক হয়ে, সাদা পাগড়িঅলা লোকটার উদ্দেশে অহাব বলল, সব তৈরি, ফেদাল্লা?
তৈরি, জবাব এল খসখসে গলায়।
তাহলে নামাও শুনতে পাচ্ছ সবাই? নৌকো নামাও।
নামিয়ে দেয়া হলো তিনটে নৌকে সেগুলো পানির সংস্পর্শে আসতে না আসতেই পাঁচ মূর্তিসহ পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল ক্যাপটেনের নৌকো স্টার্নে দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে স্টারবাক, স্টার আর ফ্লাস্ককে তাদের নৌকো নিয়ে বিরাট একটা জায়গা বেড় দিয়ে এগিয়ে যেতে বলল আহাব। কিন্তু তখনও তারা মূর্তিগুলোর দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যে, ক্যাপটেনের কথা ঠিকমত শুনতেই পেল না।
ক্যাপটেন আহাব? বলল স্টারবাক।
ছড়িয়ে পড়ো, ছড়িয়ে পড়ো সবাই, বলল আহাব; ফ্লাস্ক, তুমি আরও সরে যাও জাহাজের পেছনদিকে।
জ্বী, স্যার, জবাব দিল ফ্লাস্ক। পেছনে সরে যাও! আদেশ দিল নাবিকদের। ওখানে! ওখানে! হ্যাঁ। ছেলেরা, একেবারে সামনেই ডাকছে তিমি। পেছনে সরে যাও! আরও পেছনে!
হাঁ করে হলুদ লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকো না, আর্চি। নিজের কাজ করো।
তাকানোর প্রয়োজন নেই, স্যার। ওদের কথা তো আমি আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু কাবাকো আমার কথা বিশ্বাস করেনি।
টানো, টানো, বাছারা আমার, ঘুমপাড়ানি সুরে নাবিকদের বলে চলল স্টাব। প্রাণপণ টেনে মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলছ না কেন? কিসের দিকে তাকিয়ে আছ? ওই নৌকোর লোকগুলোর দিকে? ওই নতুন পাঁচজন এসেছে আমাদের সাহায্য করতে–কোত্থেকে এসেছে তা নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই–মাথা যত কম ঘামাবে তত বেশি আনন্দে থাকবে। দাড় টানেনা, আরও জোরে। হ্যাঁ, এই ভাবে। এতক্ষণে বুঝতে পেরেছ। এই দাঁড় টানার কোন জবাব নেই। বাহ্! বাহ্! থ্রী চিয়ারস্! তাড়াহুড়ো কোরো না। স্বাভাবিকভাবে টানো। জোরের সঙ্গে কিন্তু লম্বা করে। হ্যাঁ, এই তো! খবরদার! কেউ নাক ডাকবে না, ঘুমাবে না কেউ! এই দেখো! কোমর থেকে একটা ছুরি টেনে নিল সে; সবাই ছুরি বের করে দাতে কামড়ে ধরে দাড় টানো! হ্যাঁ, ঠিক এভাবে! এতক্ষণে একটা কাজের কাজ হয়েছে!
নাবিকদের সঙ্গে এভাবেই কথা বলে স্টাব। হাবভাবে মনে হয়, সে বুঝি দাড় টানার সঙ্গে মিশে গেছে, আসলে মোটেই তা নয়। তবে তার নিজের অতি স্বাভাবিক দাঁড় টানা আর কথা বলার মধ্যে এমন একটা টং আছে যে সঙ্গীরা দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়
ইতিমধ্যে আহাবের নির্দেশ মেনে স্টারবাক এসে পড়েছে প্রায় স্টাবের নৌকোর পাশে নৌকো দুটো আরও কাছে আসতে স্টাব বলল:
মি. স্টারবাক, আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে।
বলো! পাশ না ফিরেই বলল স্টারবাক।
ওই হলুদ ছেলেগুলোর ব্যাপারে কি মনে হয়, স্যার?
চোরাভাবে আনা হয়েছে জাহাজ ছাড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে। বিশ্রী ব্যাপার, স্টাব! কিন্তু ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। যা হবার হবে, তোমার নাবিকদের দাড় টানতে বলো জোরে। সামনে রয়েছে এক ঝাক তিমি, সেজন্যেই আমরা নৌকো নামিয়েছি। এখন তিমির পিছু নেয়াই আমাদের কর্তব্য। কর্তব্য আর লাভ হাত ধরাধরি করে থাকে!
হুঁ, আমিও তা-ই ভেবেছি, নৌকো দুটো আলাদা হয়ে যেতে আপনমনে বলল স্টাব। স্টুয়ার্ড অনেক আগেই সন্দেহ করেছিল। কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছিল ব্যাটাদের। এসব কিছুর মূলে রয়েছে সেই সাদা তিমি। কিন্তু এতে আমার কিছু করার নেই। ছেলেরা, দাঁড় টানো! জোরে! আরও জোরে!
লোকগুলোর ব্যাপারে আর্চি ঠিক সন্দেহই করেছে। এদের নিয়ে আরও নানারকম জল্পনা-কল্পনা হতে পারে। আমার শুধু মনে পড়ছে জাহাজে ওঠার আগে কুয়াশার মধ্যে দেখা সেই পাঁচ মূর্তি আর তাদের সম্বন্ধে বলা এলিজার গোলকধাধার মত কথাগুলো।
অন্যান্যদের ছেড়ে আহাবের নৌকো এগিয়ে গেছে অনেকটা। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে তার পাঁচ নাবিকের শক্তি। যেন ইস্পাতের মানুষ, যন্ত্রের মত দাড় উঠছে আর পড়ছে। ফেদাল্লা ইতিমধ্যে ঊর্ধ্বাংশের পেপাশাক খুলে ফেলেছে, সারা শরীরে তার অসংখ্য মাংসপেশি। কিন্তু তিমিগুলোর কোন চিহ্ন নেই, যেন চলে গেছে সাগরের গভীরে।
সবাই নিজ নিজ দাঁড়ের দিকে লক্ষ রাখো! চিৎকার করল স্টারবাক। কুইকেগ, উঠে দাঁড়াও!
এক লাফে উঠে দাঁড়াল কুইকেগ, কড়া চোখে তাকিয়ে রইল নীল পানির দিকে। স্টারবাকও ঘন ঘন তাকাতে লাগল এদিক-সেদিক।
খানিকটা সরে স্থির হয়ে আছে ফ্লাস্কের নৌকো। লগারহেডের মাথায় দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে আশেপাশে তাকাচ্ছে ফ্লাস্ক।
না, ভালভাবে দেখা যাচ্ছে না, একটু পর বলল সে।
দুহাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে ডাগৃগু বলল, আমি মাস্ট-হেড হতে রাজি আছি। উঠবেন, স্যার?
নিশ্চয়। ধন্যবাদ। তবে তুমি পঞ্চাশ ফুট লম্বা হলে খুব ভাল হত, ডাগ্গুর দুহাতের ওপর দুপা রেখে তার কাধে উঠে পড়ল ফ্লাস্ক।
তিমিদের নিয়ে খুব একটা ব্যস্ত নেই স্টাব। তার ধারণা, নিয়মিত কিছু শব্দ করার পর ডুব দিয়েছে তিমিগুলো, আজ আর তাদের দেখা পাবার সম্ভাবনা নেই। বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠেসে ধীরেসুস্থে পাইপে তামাক ভরল সে। কিন্তু ম্যাচ জ্বালতে না জ্বালতেই চেঁচিয়ে উঠল তার হারপুনার ট্যাসটেগো, তৈরি হও, তৈরি হও সবাই! পথ ছাড়ো!–ওই যে তিমি!
সাধারণ কোন মানুষ হলে কিছুই টের পেত না। সবজেটে-সাদা পানির ওপর কেবল উঠেছে সামান্য একটু বাপ, কিন্তু ট্যাসটেগোর জন্যে সেটাই যথেষ্ট।
চারটে নৌকোই তীর বেগে ছুটল সেই ঈষৎ আলোড়িত পানি লক্ষ করে। কিন্তু বুট্টগদগুলো দ্রুত সরে যেতে লাগল আরও দূরে।
জোরে, ছেলেরা, জোরে! ফিসফিস করে বলল স্টারবাক। তার দুই চোখ কম্পাসের কাঁটার মত সামনের দিকে নিবদ্ধ। মাল্লারা একদম চুপ করে আছে। বেড়ে গেল নৌকোর গতি।
হঠাৎ ভেসে এল স্টারবাকের কণ্ঠ, উঠে দাঁড়াও! হারপুন হাতে তড়াক করে উঠে পড়ল কুইকেগ।
ওই যে কুঁজ! হ্যাঁ, ওটাই! তাড়াতাড়ি। ফিসফিস করে উঠল স্টারবাক।
শাঁ করে ছুটে গেল কুইকেগের হারপুন। কিসে যেন ধাক্কা লাগল নৌকো, আর তারপরেই যেন একটা ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল পানির নিচে। প্রচণ্ড শব্দ তুলে ছিঁড়ে গেল পাল, নৌকোর সবাই ছিটকে পড়ল পানিতে। হারপুনের স্রেফ আঁচড় লাগায় এই যাত্রা বেঁচে গেল তিমিটা।
সৌভাগ্যের বিষয়, নৌকোটার কোন ক্ষতি হয়নি। পানিতে পড়া দাঁড়গুলো তুলে হাঁচড়ে-চড়ে উঠে পড়লাম আমরা।
বাতাসের বেগ ক্রমেই বাড়ছিল, এবার গর্জন করতে করতে এসে পড়ল ঝড়। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমাদের নাস্তানাবুদ করে যখন ফিরে গেল, চারপাশ ঢেকে গেছে আঁধারে। একটা বাতি জ্বালিয়ে কুইকেগের হাতে দিল স্টারবাক। সেই বাতি নিয়ে চুপচাপ বসে রইল কুইকেগ।
শীতে কাঁপতে কাঁপতে একসময় চোখে পড়ল ঊষার আলো। ঘুমের ঘোরে কখন যেন কুইকেগের হাত থেকে পড়ে ছাতু হয়ে গেছে বাতিটা। আলো আরও খানিকটা স্পষ্ট হতে কট কট করে একটা শব্দ এল কানে। কুয়াশা ফুড়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল জাহাজ। নাবিকেরা ধরাধরি করে আমাদের তুলে ফেলল ডেকে। গতকাল ঝড়ের আভাস পেয়ে অন্য নৌকোগুলো যথাসময়ে ফিরে গিয়েছিল জাহাজে।
৪২.
বিভিন্ন জিনিসের মিশ্রণে তালগোল পাকানো যে-বস্তুটিকে জীবন বলে, সেখানে কখনও কখনও আসে এমন কিছু মুহূর্ত আর ঘটনা, যখন পুরো পৃথিবীটাকেই মনে হয় মস্ত এক বাস্তব রসিকতা।
কুইকেগ, সব শেষে জাহাজে ওঠার পর বললাম আমি, বন্ধু, এই ধরনের ঘটনা কি অহরহই ঘটে? গা মুছতে মুছতে কুইকেগ যেরকম ভঙ্গি করল, তার অর্থ–হ্যাঁ, অহরহই ঘটে।
ইতিমধ্যে অয়েল-জ্যাকেট পরে পাইপে টান দিতে শুরু করেছে মি. স্টাব। তার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, মি. স্টাব, আপনি তো প্রায়ই বলেন চীফ মেট মি. স্টারবাকের চেয়ে বিচক্ষণ হোয়েলম্যান আপনি জীবনে দেখেননি; তাহলে কি ধরে নেব ঝড়ের আভাস পেয়েও তিমির পিছু নেয়া একজন হোয়েলম্যানের চূড়ান্ত বিচক্ষণতার প্রকাশ?
নিশ্চয়। ঝড়ের আভাস পেয়েও আমি ফুটো হয়ে যাওয়া এক জাহাজ থেকে নেমে তিমির পিছু নিয়েছিলাম কেপ হর্নে।
এবার ঘুরলাম পাশে দাঁড়ানো থার্ড মেটের দিকে। মি. ফ্লাস্ক, আমি অনভিজ্ঞ, কিন্তু তিমি শিকারে আপনার প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে। এটাই কি নিয়ম যে, দাঁড় টানতে টানতে নিজের মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলবার উপক্রম করতে হবে?
হাসল থার্ড মেট। আমি তো সোজা তিমির মুখের কাছে নৌকো নিয়ে যাবার সাহস রাখে, এমন নাবিকদেরই পছন্দ করি।
তিনজন পক্ষপাতহীন মানুষকে প্রশ্ন করে যে-জবাব আমি পেলাম, তার সারবস্তু হলো–তিমি শিকারে ভয়ঙ্করই স্বাভাবিক, এখানে নেতার নির্দেশে নির্দ্বিধায় গিয়ে ঢুকতে হবে মৃত্যুর চোয়ালে। প্রথম তিমির পিছু নেয়াতেই মারা যেতে পারতাম, যাইনি স্রেফ আমার মৃত্যু ছিল না বলেই।
৪৩.
স্বাভাবিক মানুষের পক্ষেই যেখানে তিমির পিছু নেয়া ভীষণ বিপজ্জনক, সেখানে একটা পা না থাকা সত্ত্বেও আহাব কিভাবে সে-ঝুঁকি নেয়, এটা একটা প্রশ্ন। পেকোডের মালিকদের মনে এই প্রশ্ন উঁকি দেয়নি বলেই মনে হয়।
আহাব খুব ভালভাবেই জানে, তার বন্ধুরা বড় জোর মনে করবে, সে নিজে নৌকোয় যায় কাছ থেকে দলগুলোকে ভালভাবে পরিচালিত করতে। কিন্তু আসলে সে যায় তিমির মৃত্যু স্বচক্ষে দেখতে। তিমি তার শত্রু। ইতিমধ্যেই সে জানিয়েছে, তার সবচেয়ে বড় শত্রু মবি ডিককে সে মারতে চায় নিজ হাতে। একটা জিনিস আহাব অনেক আগেই চিন্তা করেছে। তিমির পিছু নিলে তাকে কেউ বাধা দেবে না বটে, কিন্তু সবসময় পাচজন নাবিক তাকে বরাদ্দ করতে বন্ধু বা মালিকদের কেউই রাজি হবে না। তাই নিজের ব্যবস্থা সে নিজেই করেছে, পেকোডে পছন্দের নাবিক তুলেছে সবার অজান্তে। আর কী চেহারা সেই নাবিকদের। বিশেষ করে ফেদাল্লাকে দেখলেই তো শরীরের ভেতরটা কেমন শিরশির করে। ভাবলে অবাক হতে হয়, এই ধরনের লোককে আহাব দলে টেনেছে কিভাবে। হয়তো এদের ওপরেও আহাব বিস্তার করতে পেরেছে তার বিখ্যাত প্রভাব!
৪৪.
কেটে গেল দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, তিমি শিকারের চারটে এলাকা পেরিয়ে গেল পেকোড–অ্যাজোরেস, কেপ দ্য ভার্দিস, রিও দে লা প্লাটা এবং সেন্ট হেলেনার দক্ষিণে ক্যারল গ্রাউণ্ড!
শেষ জায়গাটা পেরোবার সময় ঘটল এক ঘটনা! চাদনি রাত, ঢেউ ভেঙে পড়ছে রূপোর স্তুপের মত। হঠাৎ জাহাজের সামনেই উঠল রূপালী এক ফোয়ারা। পরিষ্কার চাদের আলোয় ফোয়ারাটাকে মনে হলো স্বর্গীয়। চাদনি রাতে মেইনমাস্টে উঠে বসে থাকত বলে ফোয়ারাটা সবচেয়ে আগে চোখে পড়ল ফেদাল্লার। রাতে অবশ্য অনেক সময়েই তিমির দল দেখা যায়, কিন্তু খুব কম হোয়েলম্যানই তাদের পিছু নেয় তখন। ফেদাল্লার চিৎকারে সবাই ডেকে এসে ফোয়ারাটা দেখল। দেখে তাদের মধ্যে কোন আতঙ্ক জাগল না, বরং কেমন যেন একটা আনন্দই হলো। খানিক পর অদৃশ্য হয়ে গেল ফোয়ারাটা, সেই রাতে আর দেখা গেল না।
ধীরে ধীরে সবাই প্রায় ভুলেই গেল মাঝরাতের সেই ফোয়ারার কথা। তারপর হঠাৎ করেই ফোয়ারাটাকে আবার দেখা গেল। কিন্তু জাহাজ কাছে যেতেই অদৃশ্য হলো ফোয়ারা। রাতের পর রাত দেখা গেল এটাকে, চাদ কিংবা তারার আলোয় পড়ছে ঝির ঝির করে। কখনও কখনও দুতিন রাত ধরে অদৃশ্য হয়ে রইল ফোয়ারা, তারপর ফিরে এল আবার রূপালী ওই ফোয়ারা যেন প্রলুব্ধ করতে চায় আমাদের।
নাবিকরা সাধারণত কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়। কয়েকজন তো শপথ করে বলল, রূপালী এই ফোয়ারা তুলছে মবি ডিক। দুচার দিন একটা ভয় ভয় ভাব গেল। রূপালী ফোয়ারাটা যেন সবাইকে নিয়ে যেতে চায় সর্বনাশের পথে।
৪৫.
কেপ থেকে দক্ষিণ-পুবে, ক্রোজেটস্ থেকে বেশ খানিকটা দূরে চোখে পড়ল অ্যালবাট্রস নামের এক জাহাজ। প্রায় চার বছর সাগরে সাগরে ঘুরে জীর্ণ হয়ে গেছে জাহাজটা। মাস্ট-হেড থেকে আমার মনে হলো, ওটা যেন তীরে আটকা পড়া কোন সিন্ধুঘোটকের কঙ্কাল, দড়িদড়াগুলো যেন বরফে মোড়া গাছের ডাল।
এই জাহাজ! সাদা তিমিটাকে দেখেছ?
চেঁচাতে গিয়ে ক্যাপটেন আহাবের হাত থেকে কেমন করে যেন শিঙাটা পড়ে গেল সাগরে। ঠিক সেই সময়েই উঠল একটা ঝড়, নাহলে একটা নৌকো নামিয়ে হয়তো ওই জাহাজে গিয়ে উঠত আহাব। তা যখন হলো না, আবার চেচিয়ে উঠল সে। চেহারা দেখেই আহাব বুঝতে পেরেছিল যে জাহাজটা ন্যানটাকেটের, তাই বলল, শোনো! এটা পেকোড, সারা পৃথিবী ঘুরতে বেরিয়েছে। এখন থেকে সব চিঠিপত্র পাঠাতে বোলো প্রশান্ত মহাসাগরের ঠিকানায়! আগামী তিন বছরের মধ্যে যদি বাড়ি না ফিরি, তাহলে ঠিকানা হলো–
গত কয়েক দিন ধরে পেকোডের পিছু পিছু আসা এক আঁকনিরীহ মাছ পিছু নিল অ্যালবাট্রসের।
আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিস, তাই না? চুড়ান্ত এক অসহায়তা ঝরে পড়ল আহাবের কণ্ঠ থেকে। কিন্তু এক মুহূর্ত পরেই শোনা গেল চিরাচরিত সেই সিংহ গর্জন–কাণ্ডারী! পেকোডকে নিয়ে চলো সারা পৃথিবী বেড় দিয়ে!
সারা পৃথিবী বেড় দিয়ে! কিন্তু মাঝে মাঝে শুধু নিদারুণ কষ্ট ভোগ ছাড়া এই অভিযান আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? যদি এমন হত, আমরা চলেছি সলোমন দ্বীপপুঞ্জের চেয়েও অদ্ভুত কোন দ্বীপ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে, তাহলে পৃথিবী বেড় দেয়ার একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যেত। কিন্তু তা তো নয়, আমরা চলেছি এক প্রেতাত্মার পেছনে।
৪৬.
আহাব কেন অন্য হোয়েল-শিপটাতে গেল না, তার একটা কারণ আমি দেখিয়েছি। কিন্তু ঝড় না আসলেও সে সম্ভবত জাহাজটাতে যেত না। কারণ, তার আসল প্রশ্নটার না বাচক জবাব পেয়েছিল সে। সাদা তিমিটার সংবাদ দিতে না পারলে সেই জাহাজে পাঁচ মিনিটের জন্যে যাওয়াও পছন্দ করে না আহাব।
যদি দুজন আগন্তুক পেরোতে শুরু করে নিউইয়র্কের জনশূন্য পাইন ব্যারেনস কিংবা ইংল্যাণ্ডের স্যালিসবারি প্লেইন, মুখখামুখি দেখা হলে ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক অন্তত হাঁপ ছাড়ার খাতিরেও থামবে তারা কিছুক্ষণের জন্যে, কুশল জিজ্ঞেস করবে। তাহলে এই দুই জায়গার তুলনায় মহাসাগর কত বিশাল এলাকা, সেখানে দুই হোয়েল-শিপের দেখা হলে স্বাভাবিকভাবেই দুই ক্যাপটেনের নানারকম আলাপ করার ইচ্ছে জাগে।
যে-জাহাজটা বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছে, তার কাছ থেকে কেবল আসা জাহাজটা পেতে পারে তিমি শিকারের কোন এমন এলাকার সংবাদ যা তার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পেতে পারে এই মুহূর্তে অনেক দূরে চলে যাওয়া তৃতীয় কোন জাহাজের চিঠি, যেগুলোর মধ্যে হয়তো রয়েছে তাদেরও বেশ কয়েকটা চিঠি। এছাড়াও অনেকদিন পর একই পেশার মানুষের দেখা পেলে খানিকটা খোশগল্প করার ইচ্ছে কার মধ্যে না জাগে?
এসব ক্ষেত্রে দেশ ভিন্ন হলেও ক্ষতি নেই, শুধু ভাষাটা অভিন্ন হলেই হলো। ইংরেজ আর আমেরিকানদের মধ্যে চালচলনের বেশ কিছুটা পার্থক্য আছে। ইংরেজদের মধ্যে কিছুটা লাজুকভাব আছে, আমেরিকানদের যা মোটেই নেই। আবার আমেরিকানরা যেমন খানিকটা অমার্জিত, ইংরেজরা মোটেই তা নয়, তারা আদব-কায়দার দিক থেকে বেশ দুরস্ত। তিমি শিকারী হিসেবে আমেরিকানদের তুলনায় ইংরেজরা দক্ষ নয়। আমেরিকান অনেক হোয়েল-শিপ এক দিনে যত তিমি মারে, বেশিরভাগ ইংরেজ হোয়েল-শিপের দশ বছর লাগে ওই পরিমাণ তিমি শিকার করতে। কিন্তু এত পার্থক্য সত্ত্বেও দুই জাহাজের দেখা হলে তাদের আলাপে কোনরকম বাধার সৃষ্টি হয় না।
দুটো হোয়েল-শিপের মুখোমুখি দেখা হলে আলাপ তারা করবেই। কিন্তু দুটো ব্যবসায়ী জাহাজ কথা না বলে চলে যাবে পাশ কাটিয়ে। কারণ, কথা বলার অর্থই হলো ব্যবসায়িক গোপনীয়তা কিছু না কিছু ফাঁস করে দেয়া। দুটো যুদ্ধ জাহাজের দেখা হলে আলাপ হয় ঠিকই, কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত নিয়ম-কানুনের জন্যে সেআলাপে আর কোন রস থাকে না। দুটো জলদস্যু জাহাজের দেখা হলে একে অপরকে প্রথম প্রশ্ন করে–কত খুলি?–ঠিক যেমন হোয়েলাররা বলে কত ব্যারেল?। আর জবাব পাবার সঙ্গে সঙ্গে চলে যায় পরস্পরকে ছেড়ে। অপকর্ম করছে তা খুব ভালভাবে জানা থাকলেও কেউ কারও অপকর্মের সাক্ষী হতে চায় না।
দুটো হোয়েলশিপের দেখা হলে ক্যাপটেন দুজন এক জাহাজে একত্রিত হয় এবং চীফ মেট দুজন একত্রিত হয় অন্য জাহাজে। দুই হোয়েল-শিপের এই দেখা হওয়াটাকে গ্যাম বলে। অন্য ধরনের দুই জাহাজের দেখা হওয়ার ব্যাপারে কিন্তু এই শব্দটা প্রযোজ্য নয়। গ্যাম শব্দটা রীতিমত অপরিচিতও বটে। ড, জনসন বা নোয়া ওয়েবস্টার কারও অভিধানেই আপনি পাবেন না এই শব্দ। তবে এই শব্দ অবশ্যই অভিধানভুক্ত হওয়া উচিত। অর্থটা আমি বলে দিচ্ছি:
গ্যাম (বিশেষ্য), সাধারণত তিমি শিকারের কোন এলাকায় দুই বা ততধিক হোয়েল-শিপের সামাজিক দেখা-সাক্ষাৎ; এই সাক্ষাতে এক জাহাজের নাবিক অন্য জাহাজে যায়।
৪৭.
অ্যালবাট্রসের সঙ্গে দেখা হবার কিছু দিন পরেই আমাদের দেখা হলো আরেক জাহাজ–টাউন হোর সঙ্গে। নাবিকদের প্রায় সবাই পলিনেশিয়ান। স্বল্পকালীন গ্যামে পাওয়া গেল মবি ডিকের গরম সংবাদ। একদিন সূর্যোদয়ের ঠিক আগে ডেকঝাড় দিচ্ছিল টেনেরিফের এক বোকা লোক। হঠাৎ তার চিৎকারে সবাই ডেকে বের হয়ে দেখে, সামনেই পানি তোলপাড় করছে প্রকাণ্ড এক সাদা তিমি। সঙ্গে সঙ্গে নৌকো নামিয়ে পিছু নেয়া হলো। কিন্তু দানবটাকে কাবু করা তো দূরের কথা, উল্টো সে-ই গিলে ফেলল র্যাডলি নামের এক হারপুনারকে।
৪৮.
শিল্পীরা তিমির অনেক ছবি এঁকেছে। আমি পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে চাই, এ-যাবৎ শিল্পীরা তিমির যত ছবি এঁকেছে, সেগুলোর সবই ভুল।
তিমির সবচেয়ে প্রাচীন ছবি পাওয়া যায় হিন্দু, মিশরীয় আর গ্রীক ভাস্কর্যে। ভারতের এলিফান্টা গুহায় তিমির ছবি রয়েছে। হিন্দুদের মৎস্য অবতার-এ আঁকা হয়েছে তিমির ছবি। অবশ্য ছবিটা অর্ধেক মানুষ অর্ধেক মাছের কোমরের ওপর থেকে মানুষ, নিচের দিকটা মাছ। কিন্তু শুধু এই লেজের ছবিটাও তিমির মত হয়নি, হয়েছে অ্যানাকোণ্ডার মত।
১৬৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এক ডাচ বইয়ে তিমির লেজ আঁকা হয়েছে মাছের লেজের মত খাড়াভাবে। ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত গোল্ডস্মিথ এনিমেটেড নেচার-এ অদ্ভুত ছবি আঁকা হয়েছে তিমি আর নারহোয়েলের। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে বার্নার্ড জারমেইনের হোয়েল বুকে ভুল ছবি আঁকা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির তিমির। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেডারিক কিউভিয়ারের ন্যাচারাল হিস্ট্রি অভ হোয়েলস-এ আঁকা স্পার্ম তিমির ছবিটা স্পার্ম তিমি হয়নি, হয়েছে একটা লাউ।
এখন কথা হলো, অন্যান্য প্রাণীর মত তিমিকে মডেল হিসেবে পাওয়া সম্ভব নয় যে দেখে দেখে তার নিখুঁত ছবি আঁকা যাবে। ভাটায় আটকা পড়া তিমি অবশ্য দেখেছে শিল্পীরা, কিন্তু অতিকায় শরীরের কারণে ওই অবস্থায় তিমির চেহারা ভালভাবে বোঝা অসম্ভব। অনেকে বলে, তিমির কঙ্কাল দেখে বোঝা যায়। মোটেই না। কঙ্কাল দেখে তিমির চেহারার আন্দাজ পাওয়া যায় না বললেই চলে।
তিমিকে ঠিকমত বুঝতে হলে, তার নিখুঁত চেহারা দেখতে চাইলে একটামাত্র পথই আছে–যেতে হবে আপনাকে তিমি শিকার অভিযানে। কিন্তু সেখানে রয়েছে পদে পদে মৃত্যুর সম্ভাবনা। সুতরাং তিমির খাটি চেহারা দেখার কৌতুহল খুব একটা না থাকাই ভাল।
৪৯.
গত অধ্যায়ে তিমির অঙ্কিত ছবির ব্যাপারে নানা ভুল-ভ্রান্তির কথা বলেছি। কিন্তু সম্পূর্ণ নির্ভুল না হলেও তিমির অনেক ভাল ছবিও এঁকেছে লোকে।
স্পার্ম তিমির বেশ ভাল ছবি এঁকেছে বিয়েল। রাইট তিমির চমৎকার ছবি এঁকেছে স্কোরসবাই, যদিও আকারে তা একেবারেই ছোট। আমার দেখা তিমির ছবির মধ্যে জনৈক গার্নারির আঁকা ছবিই শ্রেষ্ঠ। স্পার্ম তিমি আর রাইট তিমির আক্রমণের ছবি এঁকেছে সে। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটা নৌকোর ধ্বংসস্তুপের মধ্যে মাথা তুলেছে এক স্পার্ম তিমি, প্রাণভয়ে উল্টোপাশে ঝাঁপিয়ে পড়ছে একজন নাবিক। সব মিলিয়ে অ্যাকশনটা অপূর্ব। যদিও তিমির অ্যানাটমিক্যাল দিক দিয়ে বিচার করলে কিছুটা খুঁত রয়ে গেছে, আমি মাথা কুটলেও গার্নারির মত ছবি আঁকতে পারব না।
কে এই গার্নারি, খোঁজ নিয়েও বের করতে পারিনি আমি। তবে এটা ঠিক যে হয় সে তিমি শিকারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল, নয়তো তিমির ব্যাপারে তাকে হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়েছে কোন জাত হোয়েলম্যান।
৫০.
যদি কখনও লণ্ডনের টাওয়ার-হিলে যান, তাহলে আপনার দেখা হতে পারে এক ভিক্ষুকের সঙ্গে। হাতে তার আঁকা একখানা বোর্ড, যেটায় দেখা যাচ্ছে কি করুণভাবে একটা পা হারিয়েছিল সে। বোর্ডে তিনটে তিমি আর তিনটে নৌকোর ছবি। একটা নৌকো চিবিয়ে ছাতু করছে সামনের তিমিটা।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা ছাড়াও ন্যানটাকেট, নিউ বেডফোর্ড কিংবা স্যাগ বন্দরে পাওয়া য? স্পার্ম তিমির দাতের ওপর খোদাই করা তিমি এবং তিমি শিকারের নানা চিত্র। খোদাইয়ের জন্যে ছোট ছোট অনেক রকম যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়, তবে নাবিকরা সাধারণত তাদের জ্যাক-নাইফই ব্যবহার করে।
আমেরিকান হোয়েল-শিপের ফোকাসলে প্রায়ই চোখে পড়ে কাঠের তিমি, কোন কোনটা হয় প্রায় নিখুঁত। গ্রাম্য পুরানো বাড়িতে পেতলের তিমি ব্যবহৃত হয় কড়া হিসেবে। প্রাচীন কোন কোন গির্জায় এমনকি রয়েছে তিমির অনুকরণে নির্মিত ওয়েদারকক। এছাড়া চোখ খোলা রাখলে পাহাড়ী অঞ্চলে হঠাৎ চোখে পড়বে প্রস্তরীভূত তিমি।