৩১-৪০. এখন দুপুর
৩১.
এখন দুপুর। স্টুয়ার্ড মাথা বের করে জানাল, ডিনার রেডি। বসে বসে অক্ষাংশের চার্ট দেখছিল ক্যাপটেন আহাব। এমনই গভীর তার মানোযোগ, যেন শুনতেই পায়নি স্টুয়ার্ডের ডাক। কিন্তু না। ডেকে এসে ডিনার, মি. স্টারবাক বলেই আবার কেবিনে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।
সুলতানের পদশব্দ মিলিয়ে যেতে উঠল প্রধান আসামী–স্টারবাক, বিনাকলে চোখ লাগিয়ে ডিনার, মি. স্টাব বলেই নামতে লাগল নিচে।
দ্বিতীয় আমীর স্টাব তখন দড়িদড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিল। গুরুত্বপূর্ণ দড়িটাতে বেশ জোরে শেষ একটা টান দিয়ে ডিনার, মি. ফ্লাস্ক বলেই সে পিছু নিল স্টারবাকের।
কোয়ার্টার-ডেকে একা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল তৃতীয় আমীর ফ্লাস্ক। তারপর একটা হর্নপাইপে ফুঁ দিয়ে, ক্যাপ খুলে দ্রুত পা বাড়াল সামনে। শোয়ে গেলেও তাকেই আবার ফিরতে হবে সবচেয়ে আগে।
৩২.
চমৎকার আবহাওয়ায় অন্যান্য নাবিকদের মতই পর্যায়ক্রমে আমারও এল মাস্টহেড়ে দাঁড়ানোর পালা।
আমেরিকার প্রায় সব হোয়েল-শিপ বন্দর ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে লোক তুলে দেয় মাস্টহেডে। হাজার হাজার মাইল অভিযান শেষে চার-পাঁচ বছর পর জাহাজ আবার, একেবারে বন্দরে ঢুকে পড়তে বাড়তি আরেকটা তিমি পাবার আশা ত্যাগ করে মাস্ট-হেড থেকে নেমে আসে লোক।
খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সর্বপ্রথম মাস্ট-হেডে দাঁড়ানো শুরু করে মিশরীয়রা। তারপর যুগে যুগে অনেক বিখ্যাত মানুষও ওখানে দাঁড়িয়েছেন। নেপোলিয়ন, ওয়াশিংটন, নেলসন দাড়িম্বেছেন মাস্ট-হেডে। ক্যাপটেন পীট তো বই লিখেছেন মাস্ট-হেডে দাঁড়াবাব অভিজ্ঞতা নিয়ে। পীট ওখানে উঠতেন রাইফেল কাঁধে বুলিয়ে। গুলি করে নারহোলেল মারতেন।
এখন যারা মাস্ট-হেডে দাঁড়ায়, তারা যেন ধাতব মানুষ–লোহা কিংবা ব্রোঞ্জে তৈরি। ঘণ্টারপর ঘণ্টা তারা দাঁড়িয়ে থাকে একশো ফুট ওপরে, বৃষ্টি-বাদল-রোদ কিছুই তারা পরোয়া করে না, তিমি চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যান্ত্রিক স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে।
৩৩.
সাগরে পাইপ ফেলে দেয়ার কদিন পর সকালের নাস্তা সেরে ক্যাপটেন আহাব ডেকে এল। জাহাজের ক্যাপটেনরা সাধারণত পায়চারি করে এখানে, ঠিক যেমন গ্রাম্য কোন ভদ্রলোক নাস্তার পর পায়চারি করে বাগানে।
আহাব এখন গভীর চিন্তায় মগ্ন। মেইনমাস্ট কিংবা বিনাকলের কাছে গিয়ে বাঁক নেয়ার সঙ্গে সচ্ছে তা চিন্তাগুলোও যেন বাঁক নিচ্ছে, চলার বেগে যেন বেড়ে যাচ্ছে চিন্তার বেগ।
লক্ষ করেছ, ফ্লাস্ক? ফিসফিস করে বলল স্টাব: ওর ভেতরের মুরগির বাচ্চাটা ঠোকর দিচ্ছে খোসা। বাচ্চা ফুটল বলে।
সময় গড়িয়ে চলল। কখনও কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করল আহাব, আবার কখনও ডেকে এসো পায়ুচারি কব্রতে লাগল।
একসময় দিন প্রায় শেষ হয়ে এল। হঠাৎ বুলওয়ার্কের পাশে থেমে জাহাজের সবাইকে এখানে উপস্থিত করতে স্টারবাককে আদেশ দিল আহাব।
স্যার! বিস্ময়ধ্বনি বেরিয়ে এল চীফ মেটের গলা দিয়ে। অত্যন্ত জরুরী কোন প্রয়োজন ছাড়া জাহাজের সবাইকে ডাকা হয় না।
যা বলছি তা-ই করো, গমগম করে উঠল আহাবের স্বর। সবাইকে হাজির করো এখনে। মাস্ট-হেড, তোমরাও নেমে এসো!
সবাই এসে দেখল, ক্যাপটেনের মুখ থমথম করছে ঝড-পূর্ব দিগন্তের মত। একবার বুলওয়ার্কের ওপর দিয়ে সাগর, একবার নাবিকদের দিকে তাকাতে তাকাতে অনবরত পায়চারি করছে আহাব, নাবিকদের মধ্যে যে ফিসফিসানি শুরু হয়েছে সেদিকে কোন লক্ষ নেই। ফ্লাস্কের কানে কানে স্টাব বলল, ক্যাপটেন বুঝি সবাইকে এখানে ডেকেছে পায়চারির নানারকম কৌশল দেখাতে।
কিন্তু না, পায়চারির কায়দা দেখাবার জন্যে কাউকে এখানে ডেকে আনেনি ক্যাপটেন আহাব। ঝট করে থেমে সে বলল, যখন তোমরা কোন তিমি দেখতে পাও, তখন কি করো?
চিৎকার করে সংবাদটা জানিয়ে দিই সবাইকে! সমবেত কণ্ঠে জবাব দিল নাবিকরা।
বেশ! সায় দেয়ার ভঙ্গিতে কথাটা বলে নাবিকদের দেখতে লাগল আহাব, তার অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটা নাবিকদের মধ্যে কেমন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে বোঝার চেষ্টা করছে।
সংবাদ দেয়ার পর তোমরা কি করো?
নৌকো নামিয়ে ধাওয়া করি তিমিকে!
ধাওয়া শেষে ফিরে আসো কি নিয়ে?
হয় মরা তিমি নয়তো ভাঙাচোরা নৌকো নিয়ে!
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার বলল আহাব, মাস্ট-হেডাররা আমার মুখে সাদা একটা তিমির কথা নিশ্চয় শুনেছ। এক আউন্সের এই স্প্যানিশ স্বর্ণমুদ্রাটা দেখতে পাচ্ছ সবাই? চকচকে একটা মুদ্রা সে তুলে ধরল ওপরদিকে, এটা ষোলো ডলারের একটা মুদ্রা। দেখতে পাচ্ছ? মি. স্টারবাক, তোমার হাতুড়িটা দাও।
জ্যাকেটের কোনা দিয়ে মুদ্রাটা ঘষতে লাগল আহাব, যেন ঔজ্জ্বল্য আরও বাড়াতে চায়। কণ্ঠে তার চাপা এক দুর্বোধ্য গুঞ্জন, যেন ওটা কোন মানুষের স্বর নয়, ভেতরের যে-জটিল যন্ত্রে মানুষ পরিচালিত হয়, সেই যন্ত্রই যেন তুলছে শব্দটা।
স্টারবাকের কাছ থেকে হাতুড়িটা নিয়ে মেইনমাস্টের কাছে গিয়ে দাঁড়াল আহাব। এক হাতে হাতুড়ি আরেক হাতে মুদ্রাটা ওপরে তুলে ধরে বলল, তোমাদের মধ্যে যে ওই কোঁচকানো চোখ আর বাকা চোয়ালের তিমিটাকে এনে দিতে পারবে, যে এনে দিতে পারবে সেই সাদা তিমি যার লেজে রয়েছে তিনটে ফুটো, সে-ই পাবে এই এক আউন্সের স্বর্ণমুদ্রা!
হৈ হৈ করে উঠল নাবিকের দল।
মনে রেখো, তিমিটা সাদা, আবার বলে উঠল আহাব। সাদা তিমি। যদি দেখতে পাও সাদা পানি, এমনকি পানির নিচে যদি চোখে পড়ে সাদা কোন বুট্টগদ, চেঁচিয়ে উঠো গলা ফাটিয়ে।
অন্যান্যদের চেয়েও বেশি কৌতুহল এবং বিস্ময় নিয়ে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল ট্যাসটেগো, ডাগগু আর কুইকেগ, তিমির কোঁচকানো চোখ আর বাঁকা চোয়ালের উল্লেখে নড়েচড়ে উঠল ওরা।
ক্যাপটেন আহাব, বলল ট্যাসটেগো, এটাই তাহলে নিশ্চয় সেই সাদা তিমি, অনেকে যেটাকে মবি ডিক বলে ডাকে।
মবি ডিক? চেঁচিয়ে উঠল ক্যাপটেন আহাব। তাহলে–তাহলে কি সাদা তিমিটাকে তুমি দেখেছ, ট্যাস?
পানিতে ডুব দেয়ার আগে তিমিটা কি অদ্ভুতভাবে লেজ নাড়ায়? জানতে চাইল উৎসুক গে-হেডার।
তার স্পাউটটাও কি অদ্ভুত, ক্যাপটেন আহাব? জানতে চাইল ডাগগু।
আর তার লেজের পেছনদিকে কি ঢুকে আছে তিনটে লোহা, ক্যাপটেন? চোখ বড় বড় করল কুইকেগ।
হ্যাঁ, কুইকেগ, হারপুন ভেঙে ঢুকে আছে তার ভেতরে; হ্যাঁ, ডাগ্গু, তার স্পাউটটা অদ্ভুত, অন্যান্য তিমির চেয়ে অনেক বড়; হ্যাঁ, ট্যাসটেগো, ডুব দেয়ার আগে সে অদ্ভুতভাবে লেজ নাড়ায়। হ্যাঁ, হ্যাঁ, মবি ডিককেই দেখেছ তোমরা!
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে স্টাব আর ফ্লাস্কের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল স্টারবাক, কিন্তু তিমিটার নামের উল্লেখে যেন খুলে গেল রহস্যের সমস্ত দুয়ার। সে বলল, ক্যাপটেন আহাব, মবি ডিকের নাম আমি শুনেছি–এই মবি ডিকই কি আপনার পা কেটে নেয়নি?
কোথায় শুনলে তুমি একথা? চেঁচিয়ে উঠল আহাব; একটু থেমে বলল, হ্যাঁ, স্টারবাক, ঠিকই শুনেছ তুমি। প্রিয় নাবিকেরা, তোমরাও শোনো–এই মবি ডিকই কেটে নিয়েছে আমার পা। হ্যাঁ, এই সেই অভিশপ্ত তিমি, যে আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, কর্মক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অকালে বুড়ো বানিয়েছে আমাকে! দুহাত ওপরে ছুঁড়ে দিল আহাব, কণ্ঠে ভর করল অস্বাভাবিক হিংস্রতা। কিন্তু আমিও ওকে ছাড়ব না। ধাওয়া করে যাব গুড হোপে, যাব হর্নে, যাব নরওয়ের মেইলস্ট্রোমে, প্রয়োজনে যাব নরকের লেলিহান অগ্নিশিখার পাশে। আর, এজন্যেই তোমাদের এই জাহাজে তুলেছি আমি। আমার সঙ্গে সাদা তিমিটাকে ধাওয়া করে যাবে তোমরা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, যতক্ষণ না ওর নাক দিয়ে বেরিয়ে আসে পানির বদলে কালো রক্ত! কী, তোমরা যাবে না আমার সঙ্গে? দেখে তোমাদের তো সাহসীই মনে হচ্ছে।
যাব, যাব! চেঁচিয়ে উঠে উত্তেজিত বুড়োর আরও কাছে চলে এল নাবিক আর হারপুনাররা। খোজো সাদা তিমিকে, বর্শায় ধার দাও মবি ডিকের জন্যে!
ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন। স্টুয়ার্ড, নিয়ে এসো গ্রগের পাত্র! এই যে, মি. স্টারবাক, তোমার মুখটা অমন ঝুলে পড়েছে কেন? সাদা তিমির পিছু নিতে চাও না? শিকার করতে চাও না মবি ডিককে?
নিশ্চয় চাই, ক্যাপটেন আহাব। এসব ব্যাপারে মৃত্যুর চোয়ালের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতেও ভয় পাই না আমি। কিন্তু সাগরে জাহাজ ভাসিয়েছি আমরা তিমি শিকার করতে, কারও প্রতিহিংসা চরিতার্থে সাহায্য করার জন্যে নয়। প্রতিহিংসা
চরিতার্থ হলেই বা কত ব্যারেল তেল পাবেন, ক্যাপটেন আহাব? ন্যানটাকেটের বাজারে ওটা খুব বেশি দামে বিকোবে না।
লাভ-ক্ষতির কথা বলছ? পৃথিবীতে লাভ-ক্ষতিই সব নয়। তবু শুনে রাখো, যদি আমার ইচ্ছে পূরণ হয়, বড়সড় পুরস্কারই মিলবে।
ওই দেখো বুকে ঘুসি মারছে, ফিসফিস করে বলল স্টাব, কিন্তু কেন? বুকটা বড়ই তবে ভেতরটা তো ফাপা মনে হচ্ছে।
একটা বোবা জন্তুর ওপর প্রতিহিংসা! ধিক্কার দিল স্টারবাক। এই আবেগ সম্পূর্ণ অন্ধ! এ উন্মাদনা! বোবা কোন জিনিসের ওপর রাগ করা, ক্যাপটেন আহাব, নাস্তিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
নাস্তিকতার কথা আমাকে বোলো না। সূর্য যদি অপমান করে, সূর্যকেও আমি আঘাত হানব। ঈর্ষা, রাগ কোন মানুষটার নেই? ওই সাদা তিমির মধ্যে রয়েছে অবর্ণনীয় একটা কিছু, আর সেটাকেই আমি ঘৃণা করি। এই ঘৃণার শেষ আমাকে দেখতেই হবে। এ-ব্যাপারে সবাই আমার সঙ্গে একাত্মতা প্রদর্শন করেছে। স্টারবাক, এদের দলে তুমিও যোগ দাও। সামুদ্রিক ঝড়ের মুখে চারাগাছ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। স্টারবাক, কিছু একটা বলো। (একপাশে মুখ ঘুরিয়ে আপন মনে) হুঁ, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। খোলাখুলি বিদ্রোহ ঘোষণা ছাড়া আমার বিরুদ্ধে যাবার সাহস পাবে না।
ঈশ্বর আমাদের সবার দিকে লক্ষ রাখেন! চোখ বুজে অত্যন্ত বিনয়ীভাবে বলল স্টারবাক।
আহাব কথাটা খেয়ালই করল না। চেঁচিয়ে বলল, স্টুয়ার্ড, কই, মদ নিয়ে এসো! গ্ৰগ, গ্রগ!
স্টুয়ার্ডের হাত থেকে কানায় কানায় ভরা পিউটার নিয়ে হারপুনারদের দিকে ফিরল ক্যাপটেন আহাব, যার যার অস্ত্র নিয়ে এসো। সবাই অস্ত্র আনলে তাদের নিয়ে নোঙরের কাছে এল সে।
নাও, এবার হাত বদল করে খাও, সবচেয়ে কাছে দাঁড়ানো নাবিকের দিকে পিউটার এগিয়ে দিল ক্যাপটেন আহাব।
কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে তিন মেটের হাবভাব লক্ষ করছিল ক্যাপটেন আহাব। স্টাব আর ফ্লাস্ক মুখ ঘুরিয়ে আছে, স্টারবাক তাকিয়ে আছে নিচের দিকে।
বৃথা চেষ্টা! গর্জে উঠল আহাব। আমার প্রভাব এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছ? ভাল; হয়তো আমার আর আগের তেজ নেই, অজান্তে কখন ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গেছে বিদ্যুৎ। তবে সাবধান, অল্প বিদ্যুতেও কিন্তু মানুষ মরে। যাকগে, ফিরল সে হারপুনারদের দিকে, তোমাদের ভেতর থেকেই আমি বেছে নের সহযোগী। এবার অস্ত্রের হাতল খুলে ফেলো।
ক্যাপটেনের নির্দেশ মত কাঠের হাতল খুলে, হারপুনের লোহার অংশটা হাতে দাঁড়িয়ে রইল তিন হারপুনার।
হারপুনের সকেট কানা পর্যন্ত ভরে দিয়ে ক্যাপটেন আহাব বলল, খাও! খাও আর শপথ করো, মৃত্যু দেখবে মবি ডিকের! মনে রেখো, মবি ডিককে শিকার করতে না পারলে ঈশ্বর আমাদের সবাইকে শিকার করবেন!
তিমির বিরুদ্ধে আস্ফালন করতে করতে পাত্র খালি করে দিল তিন হারপুনার। ফ্যাকাসে মুখে অন্যদিকে চেয়ে শিউরে উঠল স্টারবাক। সবাইকে বিদায় করে দিয়ে কেবিনের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল ক্যাপটেন আহাব।
৩৪.
সেদিন নাবিকদের সঙ্গে আমিও ছিলাম, নাবিকদের সঙ্গে সঙ্গে গলা আমারও চড়ে যাচ্ছিল। নির্দিষ্ট ওই তিমিটার বিরুদ্ধে আহাবের অনন্ত প্রতিশোধ স্পৃহা আমার মধ্যেও জাগিয়ে তুলেছিল প্রতিহিংসা।
ইতিমধ্যে আহাব ছাড়া অন্যান্য জাহাজের আরও অনেকেই মবি ডিককে দেখেছে। পিছুও নিয়েছে। কিন্তু মবি ডিক প্রতিবারই সাফল্যের সঙ্গে এড়িয়ে গেছে তাদের, আর যাবার আগে কাউকে মেরে গেছে নয়তো জখম করেছে মারাত্মকভাবে। ধীরে ধীরে অতি হিংস্র এই তিমিটার ব্যাপারে একটা আতঙ্ক জন্ম নিয়েছে তিমি শিকারীদের মনে।
অবশ্য স্পার্ম তিমি জন্মগতভাবেই অন্য প্রজাতির তিমিদের তুলনায় হিংস্র। ওলাসেন আর পভেলসেন নামের দুই প্রকৃতিবিদ ঘোষণা দিয়েছেন–স্পার্ম তিমি কেবল অন্যান্য প্রাণীর কাছে আতঙ্কজনকই নয়, সে রীতিমত রক্তপিপাসু, বিশেষ করে মানুষের রক্ত। ব্যারন কিউভিয়ার তার ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে লিখেছেন–স্পার্ম তিমিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মাছ, এমনকি হাঙরও দিগ্বিদিহারা হয়ে ছুটতে থাকে, আর এভাবে ছুটতে গিয়ে অনেক সময় পাথরে ধাক্কা লেগে প্রাণত্যাগ করে। এসব বই পড়ে তিমি শিকারীদের আতঙ্ক আরও বেড়ে গেছে।
সাদা কোঁচকানো কপাল আর সাদা কুঁজের কারণে ধীরে ধীরে স্বাভাবিকভাবেই তিমিটার নাম হয়ে গেছে–সাদা তিমি। অন্যান্য তিমির সঙ্গে এই রঙের পার্থক্যের জন্যেই এটার পিছু নিয়েছে বিভিন্ন তিমি শিকারী, কিন্তু সবাই ফিরেছে দুঃস্বপ্ন নিয়ে। মবি ডিকের এই ভয়ঙ্করত্ব দিনে দিনে কুসংস্কারের জন্ম দিয়েছে। একই সঙ্গে নাকি তাকে দেখা যায় নানা জায়গায়, তাই নাম হয়ে গেলসর্বত্র বিরাজমান। হারপুন লেগেও জ্যান্ত পালিয়ে যাওয়ায় কিছু কিছু তিমি শিকারী আরও এক কাঠি এগিয়ে তার নাম রাখল–অমর। মানুষের তৈরি অস্ত্রে নাকি তার মৃত্যু অসম্ভব।
এরই মধ্যে মবি ডিকের মুখোমুখি হলো এক লোক। তার তিনটে নৌকো চিবিয়ে ছাতু করার পর হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সে ছুটে গেল মাত্র ছয় ইঞ্চি লম্বা একটা ছুরি নিয়ে। লোকটার নাম ক্যাপটেন আহাব। কাছে যেতেই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল তিমিটা, এক কামড়ে কেটে নিল একটা পা। পাগড়ি পরা কোন তুর্কী, মালয়ী কিংবা ভেনিশিয়ান এই কাজ করলে হয়তো এতটা বিদ্বেষ অনুভব করত না আহাব। যাই হোক, এই মারাত্মক দুর্ঘটনার পর থেকে বন্য এক প্রতিহিংসা পুষে রেখেছে আহাব। আর এই প্রতিহিংসা থেকেই সে আক্রান্ত হয়েছে মনোম্যানিয়ায়।
তবে এই মনোম্যানিয়া তার মধ্যে একদিনে বেড়ে ওঠেনি। ছুরি নিয়ে তিমির দিকে ছুটে গিয়েছিল সে জান্তব একটা আবেগ থেকে, ফলে পা কেটে নেয়ার সময় শারীরিক যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই অনুভব করেনি। কিন্তু বাড়ি ফেরার পথে মাসের পর মাস আহাবকে যখন হ্যামকে শুয়ে থাকতে হয়েছে, শরীরের পাশাপাশি রক্তক্ষরণ হয়েছে তার মনে। মাঝে মাঝে সাময়িক বিরতি ছাড়া আহাব পরিণত হয়েছে বদ্ধ উন্মাদে। তখন ঘোরে ঝিম মেরে থেকেছে সে, জেগে উঠলেই ঘটেছে উন্মাদনার বিস্ফোরণ। শেষমেশ নাবিকরা বাধ্য হয়েছে তাকে বেঁধে রাখতে। এক সময় জাহাজ এসে পৌঁছেছে কেপ হর্নে। হঠাৎ করেই ঘোর কমে গেছে তার, আবার নাবিকদের সে দিতে শুরু করেছে স্বাভাবিক আদেশ। ক্যাপটেনের সুস্থতায় হাঁপ ছেড়েছে জাহাজের সবাই। আসলে ক্যাপটেন কিন্তু মোটেই সুস্থ হয়নি। স্বাভাবিকতার পোশাক পরে আহাব তখন আরও বড় উন্মাদ, তার জগৎ তখন কেবলই এক সাদা তিমির জগৎ। উন্মাদনা জিনিসটাই এমন। যখন সবাই ভাবে যে রোগী ভাল হয়ে গেছে, তখন সে সুস্থতার ছদ্মবেশে আরও বড় উন্মাদ।
মনোম্যানিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোন একটা বিষয়ে উন্মাদ হয়ে ওঠে। আহাবও তা-ই হয়েছে, মবি ডিক ছাড়া আর কোন কথা সে ভাবতে পারে না। এবারে সে অভিযানে বেরিয়েছে একটামাত্র উদ্দেশ্যে–সাদা তিমিটাকে শিকার করতে। পুরানো বন্ধুরা ঘুণাক্ষরেও এ-কথা জানলে তাকে জাহাজ ভাসাতেই দিত না। তারা সবাই সুস্থ মানুষ, স্বাভাবিক হিসেব বোঝে। তারা আশা করে আছে, চার-পাঁচ বছর পর ফিরে আসবে পেকোড, ব্যাঙ্কে জমা পড়বে আরও একরাশ ডলার। কিন্তু কাউকে লাভ করিয়ে দেয়ার জন্যে ক্যাপটেন আহাব এবার জাহাজ নিয়ে বেরোয়নি, সে বেরিয়েছে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে।
সাদা সেই তিমির সন্ধানে বুড়ো এখন চষে ফেলতে চায় সারা পৃথিবী। শয়নে-স্বপনে-জাগরণে বিশাল শরীর নিয়ে এখন তার সামনে ভেসে রয়েছে মবি ডিক। নাবিক বাছাইটাও সেরেছে সে অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে। তার নাবিকদের মধ্যে রয়েছে দলত্যাগী, বিধর্মী, বিপথগামী, নরখাদক। এরকম মানুষরা সাধারণত মানসিকভাবে দুর্বল হয়, আর সেটাই আহাবের প্রয়োজন। কারণ, দুর্বলরা কখনও বিদ্রোহ করতে পারে না। যে-তিনজন মানুষ আহাবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারত, তারাও কোন কাজে আসেনি। ভাল-মন্দের বোধ রয়েছে স্টারবাকের, কিন্তু এই গুণ কার্যকর করার পক্ষে সে একেবারেই অযোগ্য, স্টাব রয়েছে তার রসিকতা নিয়ে, আর ফ্লাস্ক মানুষ হিসেবে খুবই সাধারণ।
কিন্তু কিভাবে একা ক্যাপটেন আহাব পারল এতগুলো মানুষকে প্রভাবান্বিত করতে? তার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের সবারই যেন মনে হচ্ছে, সাদা ওই তিমি তাদের জন্মান্তরের শত্রু। ক্যাপটেন আহাবের ঘৃণা সঞ্চারিত হয়েছে তাদের মধ্যে, জ্বলে উঠেছে সবাই ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসায়। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? বুঝি না। আমি বুঝি না। এসব বুঝতে হলে চাই ইসমাইলের চেয়ে অনেক গভীর অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। সুতরাং আপাতত নিজেকে ছেড়ে দিতে চাই আমি স্থান আর কালের হাতে। ছুটছে সবাই, ছুটছে প্রকাণ্ড এক তিমির খোঁজে–যার মধ্যে তারা দেখতে পাচ্ছে কেবল ওত পাতা এক মারাত্মক অশুভ সত্তা।
৩৫.
আহাবের দৃষ্টিতে সাদা তিমিটা কেমন, তার একটা আভাস দিয়েছি; কিন্তু আমার দৃষ্টিতে ওটা কেমন, তা এখনও বলা হয়নি।
সাধারণত যেসব কারণে মানুষ মবি ডিককে ভয় করে, তার বাইরেও আতঙ্কিত হবার মত একটা জিনিস প্রাণীটার মধ্যে আছে। ব্যাপারটা গুছিয়ে বলা আমার পক্ষে একটু কঠিন, কিন্তু না বলতে পারলে এই অধ্যায়টাই মাটি হয়ে যাবে। সবকিছুর ওপরে আমি আতঙ্কিত হয়েছি মবি ডিকের সাদা রঙে।
সাদাকে সাধারণত সৌন্দর্য বর্ধক মনে করা হয়। সম্মানের সঙ্গেও যেন রঙটা জড়িত। প্রাচীন পেণ্ড রাজাদের সবচেয়ে সম্মানজনক উপাধি ছিল লর্ড অভ দ্য হোয়াইট এলিফ্যান্টস; হ্যানোভারিয়ান পতাকায় রয়েছে সাদা একটা মূর্তি; কাউকে চূড়ান্ত সম্মান প্রদর্শন করতে চাইলে রেড ইমিয়ানরা তাকে দেয় সাদা ওয়ামপামের কোমরবন্ধনী; গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীতে স্বয়ং জুপিটার সাদা বলদের রূপ ধারণ করত।
কিন্তু সাদা রঙের এই সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে ভয়ঙ্কর। মেরু ভালুক কিংবা হাঙরের কথা ভাবুন। তাদের সাদা রঙটাই কি অন্তরাত্মা কাপিয়ে দেয় না? চিন্তা করে দেখুন, বাঘের চামড়ার রঙ অতটা আতঙ্ক জাগায় না।
আবার অ্যালবিনো মানুষের কথা ধরুন, অনেক সময় আত্মীয়-স্বজনও তাদের ঘৃণার চোখে দেখে। কিন্তু তার কি কোন শারীরিক অসুবিধে আছে? না। সে আমাদের মতই একজন মানুষ। তাহলে? তাকে ঘৃণা করার মূলে রয়েছে তার গায়ের সাদা রঙ।
নিউ হ্যাম্পশায়ারের হোয়াইট মাউন্টেনস-এর কথা শুনলে ভেতরটা কেমন যেন ছমছম করে ওঠে না? অথচ ভার্জিনিয়ার ব্লু রিজ দেয় স্বপ্নের হাতছানি।
সুতরাং বিভিন্ন জাহাজের ক্যাপটেন, নাবিক বিভিন্ন কারণে মবি ডিককে ভয় করলেও আমার আতঙ্ক তার সাদা রঙে। স্পার্ম তিমিকে মানুষ এমনিতেই ভয় করে, কিন্তু এই অ্যালবিনো তিমির ভয়ঙ্করত্বের কোন তুলনা হয় না।
৩৬.
চুপ! শব্দটা শুনেছ, কাবাকো?
পরিষ্কার চাদের আলো ঝরছে। নাবিকরা কোয়ার্টার-ডেকে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ট্যাঙ্ক ভরাচ্ছে হাতে হাতে বালতি পারাপার করে। কারও মুখে কথা নেই, শুধু মাঝে মাঝে শব্দ আসছে পাল থেকে।
এই সময়েই আফটার-হ্যাচের কাছে দাঁড়ানো এক নাবিক–আর্চি বলল তার পাশের নাবিককে, চুপ! শব্দটা শুনেছ, কাবাকো?
বালতি নাও, আর্চি। কিসের শব্দ?
ওই যে আবার–হ্যাচের নিচে–শুনতে পাচ্ছ না–কাশি–ঠিক কাশির মত শব্দ।
কাশির নিকুচি করি! বালতি পার করে দাও।
ওই যে আবার ওখানেই! দুতিনটে ঘুমন্ত মানুষ যেন ওলোট-পালট করছে!
ঘুমন্ত মানুষ নয়, তোমার পেটের মধ্যে রাতে খাওয়া বিস্কুটগুলো ওলোটপালট করছে। বালতির দিকে নজর দাও!
যা-ইচ্ছে বলো, বন্ধু, কিন্তু আমি ভুল শুনিনি।
হুঁ, এতক্ষণে মনে পড়েছে। তুমিই তো সেই লোক, যে পঞ্চাশ মাইল দূর থেকে বুড়ির উল বোনার শব্দ শুনতে পায়।
টিটকারি করছ? করো। শিগগিরই বোঝা যাবে, ওটা কিসের শব্দ। এই শব্দের কথা নিশ্চয় আমাদের মোঘলও জানে। এক সকালে স্টাবও ফিসফিস করে ফ্লাস্ককে বলছিল, বাতাসে সে কিসের যেন গন্ধ পাচ্ছে।
চুপ, বালতি!
৩৭.
ক্যাপটেন আহাব সবাইকে দিয়ে শপথ করিয়ে নেয়ার পর ঝড় উঠেছিল রাতে। তারপর যদি ক্যাপটেনকে কেউ অনুসরণ করত, তাহলে দেখতে পেত কোঁচকানো একটা হলুদ চার্ট টেবিলে বিছিয়ে নিবিষ্ট মনে পরীক্ষা করছে সে। মাঝে মাঝে ফাঁকা জায়গাগুলোতে পেন্সিলের দাগ টেনে চিহ্নিত করছে জাহাজের পথ। কখনও আবার পাশ থেকে টেনে নিচ্ছে লগ-বুক, লক্ষ করছে অতীতে কখন কোন জাহাজ ওই অঞ্চলে স্পার্ম তিমি মেরেছিল বা দেখেছিল।
এসব দেখছে ক্যাপটেন আহাব, ওদিকে জাহাজের দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে দুলছে মাথার ওপর ঝোলানো ভারী পিউটার বাতি। ক্যাপটেনের মুখের ওপর স্থানান্তরিত হচ্ছে আলো-ছায়া, যেন অদৃশ্য কোন পেন্সিল দাগ টেনে পথ চিহ্নিত করছে তার কোচকানো কপালের চার্টে।
শুধু ওই রাতেই নয়, প্রত্যেক রাতে চার্ট দেখতে লাগল আহাব। প্রায় রাতেই সে মুছে ফেলল পেন্সিলের অনেক দাগ, বসাল নতুন নতুন দাগ। হিসেব করছে আহাব, চুলচেরা হিসেব করছে, কিভাবে নিবিয়ে ফেলবে তার প্রতিহিংসার আগুন।
যারা তিমি সম্বন্ধে কিছুই জানেন না, তাদের মনে হবে, মহাসাগরের এই অগাধ জলরাশির বিশাল বিস্তারে নির্দিষ্ট একটা তিকে কি খুজে বের করা সম্ভব! কিন্তু আহাবের কাছে এটা মোটেই অসম্ভব ন দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় মহাসাগরের প্রতিটা জলসেত সে চেনে; জানে, কেয়া ভেল বা তিমির খাবার খাবারের পিছু পিছ যেতে তিমি বাধ্য। তাই সে বুঝতে পারে, কোন ঋতুতে কোন এলাকায় এসে উপস্থিত হবে স্পা তিমি।
সব দিক চিন্তা করেই ন্যানটাকেট থেকে সে জাহাজ ভাসিয়েছে অনেক আগে! হাতে রেখেছে অতিরিক্ত ৩৬৫ দিন। এতে ধীরেসুস্থে প্রত্যেকট। খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করতে পারবে সে।
৩৮.
তিমি শিকারের ভয়ঙ্করত্ব সম্বন্ধে মানুষের ধারণা খুবই ভাসা ভাসা অবশ্য পরিষ্কার ধারণা না থাকার কারণও রয়েছে। অন্যান্য সব দুর্ঘটনার মত তিমি শিকারের দুর্ঘটনা সংবাদপত্র খুললেই পাওয়া যায় না। স্পার্ম তিমি সম্বন্ধে নানাজনের নানা মত রয়েছে। প্রায় সবাই বলে যে স্পার্ম তিমি ভীষণ হিংস্র। আমার নিজের মত হা, সবসময়ে না হলেও কখনও কখনও স্পার্ম তিমি সত্যিই ভয়ঙ্কর।
১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ন্যানটাকেটের ক্যাপটেন পোলার্ড তার জাহাজ এসেক্স নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে গিয়েছিল। একদিন ফোয়ারা দেখে নৌকো নামিয়ে পিছু নিল এক ঝাক তিমির। কিছুক্ষণের মধ্যেই আহত হলো বেশ কয়েকটা তিমি। কিন্তু হঠাৎই একটা তিমি ঝাক ছেড়ে বেরিয়ে এসে আক্রমণ করল তার জাহাজ। মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে পানিতে ভাসমান তক্তা ছাড়া জাহাজটার আর কিছুই আস্ত রইল না। নাবিকদের নিয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট করে কোনমতে বাড়ি ফিরল ক্যাপটেন পোলার্ড। পরে আরেকটা জাহাজের ক্যাপটেন হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে আবার গেল সে। এবারে জাহাজ চুরমার হয়ে গেল ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা লেগে। সাগরে যাবার সাধ তার আর কখনোই হয়নি।
১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে ন্যানটাকেটেরই আরেক জাহাজ–ইউনিয়নকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল এক তিমি। কিন্তু সে-দুর্ঘটনার বিশদ বিবরণ আমি পাইনি।
এবার বলব আঠারো-বিশ বছর আগের একটা ঘটনা। স্যাণ্ডউইচ আইল্যাণ্ডের ওয়াহু বন্দরে নোঙর করা এক ন্যানটাকেট জাহাজের পার্টিতে হোয়েল-শিপের ক্যাপটেনদের সঙ্গে খোশগল্প করছিল আমেরিকান এক যুদ্ধজাহাজের কমোডর। কথায় কথায় সে বলল, জাহাজের ক্ষতি করার মত শক্তি তিমির আছে বলে সে বিশ্বাস করে না। বিশেষ করে তার জাহাজের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করার ক্ষমতা তিমির নেই। কয়েক সপ্তাহ পর তার ক্ষতির অসাধ্য জাহাজ নিয়ে ভ্যালপ্যারাইজোর উদ্দেশে রওনা দিল কমোডর। মাঝপথে এক তিমি ভেসে উঠে জাহাজকে এমন এক ধাক্কা লাগাল যে গন্তব্যে যাবার আশা ত্যাগ করে নিকটস্থ বন্দরে জাহাজ ভিড়াতে বাধ্য হলো সে মেরামত করার জন্যে।
ক্যাপটেন ল্যাংসডর্ফের অভিযানের উল্লেখটাও করতেই হয়। ক্যাপটেন ল্যাংসডর্ফ ছিল রাশিয়ার অ্যাডমিরাল ক্রাসেনস্টার্নের বিখ্যাত আবিষ্কার অভিযানের সঙ্গে জড়িত। নিজের বইয়ের সপ্তদশ অধ্যায়ে ল্যাংসডর্ফ লিখেছে:
১৯ মে আমাদের জাহাজ রওনা দেয়ার জন্যে প্রস্তুত হলো। পর দিন ওখোটস্ক যাবার উদ্দেশ্যে এসে পড়লাম খোলা সাগরে। আবহাওয়া মনোরম এবং আকাশ পরিষ্কার থাকলেও প্রচণ্ড ঠাণ্ডার ফলে আমরা লোমের পোশাক পরতে বাধ্য হলাম। কয়েক দিন বাতাস বইল খুব ধীরে। কিন্তু রওনা দেয়ার উনিশ দিন পর জোর একটা বাতাস উঠল উত্তর-পশ্চিম থেকে। অতিকায় এক তিমি জাহাজের গতিপথেই ভেসে ছিল পানির প্রায় সমতলে। তিমিটা যখন আমাদের চোখে পড়ল, তখন জাহাজ প্রায় তার ওপরে উঠে পড়েছে। অত কম দূরত্বে জাহাজ ঘোরাবার উপায় ছিল না, উঠেই পড়ল ওটা তিমির পিঠে। উঁচু হলো তিমি, পুরো জাহাজটা পানি ছেড়ে উঠে গেল অন্তত তিন ফুট উঁচুতে। জাহাজ ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেয়েছে ভেবে আমরা সবাই ছুটে বেরিয়ে এলাম ডেকে। তিমিটা তখন ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে অন্যদিকে। ক্যাপ্টেন ডীউলফ তখনই পরীক্ষা করল যন্ত্রপাতি। সৌভাগ্যের বিষয়, জাহাজের কোন ক্ষতি হয়নি।
অতিকায় আকারের কারণে তিমিকে নিয়ে অনেক ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছে। বলে আমার বিশ্বাস। ষােড়শ শতাব্দীতে কনস্টান্টিনোপলে প্রোকোপিয়াস নামে একজন ম্যাজিস্ট্রেট বাস করতেন। তার লেখা ইতিহাস জনসাধারণের কাছে খুবই সমাদৃত হয়েছিল। সেই ইতিহাসে তিনি লিখেছেন, একদিন সামুদ্রিক এক দানব এসে আস্তানা গেড়েছিল পোপনটিস অর্থাৎ সী অভ মারমারায়। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেই দানব অনেক সামুদ্রিক যানকে ধ্বংস করেছে। দানবটা কোন প্রজাতির, সে-সম্বন্ধে কিছু লেখেননি প্রোকোপিয়াস। আমার যত দূর মনে হয়, তার বর্ণিত সেই সামুদ্রিক দানব আসলে একটা স্পার্ম তিমি ছাড়া আর কিছুই নয়।
৩৯.
প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে আহাব বদ্ধপরিকর। তাই তার সাহায্যের প্রয়োজন। সাহায্য সে পেয়েছেও, মবি ডিককে মারার জন্যে শপথ করেছে সব নাবিক। কিন্তু উন্মাদনা থাকলেও বোকা নয় আহাব। সে জানে, পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে, তার মধ্যে মানুষই সবচেয়ে তাড়াতাড়ি বিগড়ে যেতে পারে। স্টারবাক আপাতত তার ইচ্ছে মেনে নিয়েছে বটে, যে-কোন সময় সে যে বেঁকে বসবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
আহাব জানে, মানুষকে তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে দিতে হয়। কেবল একটা জিনিসে মানুষকে আবদ্ধ রাখলে তার মনে বিক্ষোভ জমে, আর বিক্ষোভ থেকেই বিদ্রোহ। শৌর্যে-বীর্যে পরিপূর্ণ যে-ক্রুসেডারদের নাম মানুষ সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারণ করে, তারাও পদব্রজে দুহাজার মাইল পেরোবার সময় সিঁদ কেটেছে, পকেট মেরেছে, নজর নিয়েছে অনেকের কাছ থেকে।
সুতরাং সব দিক বিবেচনা করে পেকোডের কারও স্বাভাবিক ক্রিয়াকর্মে বাধা দেয়নি সে। তবে মাস্ট-হেডারদের সে বলেছে, একটা পরপয়েজ দেখতে পেলেও সে-সংবাদ জানাতে যেন তারা ভুল না করে। এবং কড়া এই প্রহরা কাজে লাগতে খুব বেশি দেরি হলো না।
৪০.
বিকেলটা ছিল মেঘাচ্ছন্ন, গুমোট। ডেকে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে নাবিকরা। কারও কারও দৃষ্টি নিবদ্ধ সীসে-রঙা পানির ওপর। এক পাশে বসে বসে একটা মাদুর বুনছি আমি আর কুইকেগ।
অবশ্য বুনছে কুইকেগ, আমি ওকে এটা-সেটা এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করছি। শুধু বোনার খসখস শব্দ ছাড়া পুরো জাহাজ স্তব্ধ। ভোঁতা এই শব্দ তুলে যেন তাঁত বুনে চলেছে সময়, আমাকে ব্যবহার করছে তার মাকু হিসেবে।
কুইকেগকে সাহায্য করতে করতে এসব অদ্ভুত কথা ভাবছি, হঠাৎই কানে এল শব্দটা। তারপরই ওপর থেকে চেঁচিয়ে উঠল ট্যাসটেগো। মাথা তুলে দেখি সামনে হাত বাড়িয়ে ঝুঁকে আছে গে-হেডার, যেন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে নিয়তির আগমনবার্তা।
ওই যে ডাকছে! ওখানে! ওখানে! ওখানে! ডাকছে! সে ডাকছে!
কোথায়? কোনদিকে?
জাহাজের পেছনে, মাইল দুয়েক দূরে! পুরো এক ঝাঁক!
ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেল সারা জাহাজে।
ঘড়ির টিক টিক করে চলার মত শব্দ তোলে স্পার্ম তিমি, ফলে তার উপস্থিতি নির্ভুলভাবে বুঝতে পারে হোয়েলম্যানরা।
ওই যে লেজ! আবার চেঁচাল ট্যাসটেগো, আর তারপরেই অদৃশ্য হয়ে গেল তিমির ঝাঁক।
তাড়াতাড়ি, স্টুয়ার্ড! বলল আহাব। সময়! সময়!
ছুটে গিয়ে ঘড়ি দেখে এসে নিখুঁত সময় জানাল স্টুয়ার্ড।
রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি আমরা। পেছনে ডুবেছে যখন খুব সম্ভব জাহাজের সামনে ভেসে উঠবে তিমিগুলো। আমাদের উপস্থিতির কথা জানতে পারেনি ওগুলো।
কিন্তু এই সময়ে কার যেন একটা বিস্ময়ধ্বনি শুনে চোখ ফেরাল সবাই। অবাক হয়ে দেখল, যেন বাতাস থেকে তৈরি হওয়া কুয়াশার মত পাঁচটা মূর্তি ঘিরে রয়েছে ক্যাপটেন আহাবকে।