২১-৩০. আমরা যখন জেটিতে পৌঁছুলাম
আমরা যখন জেটিতে পৌঁছুলাম, তখন প্রায় ছটা বাজে। কুয়াশাচ্ছন্ন ঊষা ধূসর চাদর বিছিয়ে রেখেছে চারপাশে।
ওই দেখো, কয়েকজন নাবিক দৌড়াচ্ছে, বললাম আমি কুইকেগকে, জাহাজ মনে হয় সূর্য উঠলেই ছাড়বে। চলো, চলো!
থামো! একটা স্বর ভেসে এল পেছন থেকে, আমাদের দুজনের কাঁধে হাত রেখে অদ্ভুত চোখে চেয়ে রয়েছে এলিজা।
জাহাজে উঠতে যাচ্ছ?
হাত সরাও, বললাম আমি।
ভাগো এখান থেকে! শরীর ঝাঁকাল কুইকেগ।
তোমরা তাহলে জাহাজে যাচ্ছ না?
হ্যাঁ, আমরা জাহাজেই যাচ্ছি, বললাম আমি, কিন্তু যাই বা না যাই তাতে তোমার কি? দেখো, মি. এলিজা, তুমি কিন্তু অন্যের ব্যাপারে বড় বেশি নাক গলানো শুরু করেছ।
তাই বুঝি? আমি খেয়াল করিনি।
চলো, কুইকেগ, এর মাথাটা পুরোপুরিই গেছে।
শোনো! কয়েক ধাপ এগোতেই পেছন থেকে ডাকল এলিজা।
এগোও, কুইকেগ, ওর কথায় কান দিয়ো না।
দ্রুত এসে আবার আমার কাঁধে হাত রাখল এলিজা, খানিক আগে কয়েকজন নাবিকের মত লোককে জাহাজের দিকে যেতে দেখেছ?
সাধারণ এই প্রশ্ন কেমন যেন চমকে দিল আমাকে বললাম, হ্যাঁ, চার কি পাচজন লোক ছিল। তবে এত কুয়াশা ছিল সেসময়, কোন ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া অসম্ভব।
কুয়াশা, ঘোর কুয়াশা, বলল এলিজা।
আবার এগোলাম আমরা, আবার এসে আমার কাঁধে হাত রাখল সে। দেখো, আর কোথাও তাদের খুঁজে পাও কিনা। খুঁজবে?
কাদের খুঁজব?
সুপ্রভাত সুপ্রভাত! পেছনে সরে যেতে যেতে বলল এলিজা। আমি সাবধান করে দিতে চাচ্ছিলাম তোমাদের মনে কিছু কোরো নাখুব কুয়াশা পড়েছে আজ, তাই না? বিদায়। শিগগির বোধ হয় আর দেখা হবে না তোমাদের সঙ্গে। তবে মহা সেই বিচারক ডেকে পাঠালে ভিন্ন কথা। আবোলতাবোল বকে অবশেষে আমাদের রেহাই দিল সে।
পেকোডে বিরাজ করছে নিরেট স্তব্ধতা। কোথাও কেউ নেই। কেবিনের প্রবেশপথ ভেতর থেকে বন্ধ। ফোরকাসলে গিয়ে একটা আলো দেখতে পেয়ে নিচে নেমে গেলাম আমরা। দুটো সিন্দুকের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে গভীর ঘুমে অচেতন জ্যাকেট পরা বুড়ো এক মাল্লা।
ওই নাবিকগুলো গেল কোথায়, কুইকেগ? বললাম আমি মাল্লাটার দিকে চেয়ে। কিন্তু হাবভাবে নাবিকগুলোকে ও দেখেছে বলে মনে হলো না। পুরো ব্যাপারটাকে আমি চোখের ভুল হিসেবেই ধরে নিতাম, যদি না এলিজা ওই প্রশ্নটা করত। যাই হোক, জোর করে মনটা ওদিক থেকে সরিয়ে রসিকতা করে কুইকেগকে বললাম, অযথা দাঁড়িয়ে না থেকে মাল্লাটার ওপরে বসাই ভাল। ঘুমন্ত লোকটার নিতম্বে হাত দিল ও, যেন পরীক্ষা করে দেখছে জায়গাটা নরম কিনা, তারপর সোজা বসে পড়ল নিরীহ মুখ করে।
হায় ঈশ্বর! ওখানে বসো না, কুইকেগ।
খুব সুন্দর আসন, ঠিক আমাদের দেশের মত।
ওঠো, কুইকেগ। ওই দেখো, কত কষ্ট করে শ্বাস নিচ্ছে লোকটা। তুমি ভারী মানুষ, বেচারির মুখটা তো ভর্তা হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি ওঠো, নাহলে ছিটকে ফেলে দেবে তোমাকে। অবাক ব্যাপার, এখনও জাগছে না কেন!
উঠে গিয়ে মাল্লাটার মাথার কাছে বসে পাইপ ধরাল কুইকেগ। আমি বসলাম তার পায়ের কাছে।
শুরু হলো আমাদের যৌথ ধূমপান। কুইকেগ বলল, ওদের দেশে কোন সোফা বা গদিমোড়া চেয়ার নেই। নিচু বংশের কিছু লোককে খাইয়ে-দাইয়ে মোটা করা হয় আসন হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে। বসে বসে খেয়ে তারা আলসেও হয় চূড়ান্ত। কারও আসনের প্রয়োজন হলে তাদের কয়েকটাকে কিনে নিয়ে যায় বাড়িতে। সত্যিকারের আসনের তুলনায় এগুলোকে স্থানান্তরের ঝামেলা নেই বললেই চলে। তাছাড়া একটা সোফা যেখানে-সেখানে নিয়ে যাওয়াও যায় না। কিন্তু ওদের দেশে এমনকি জলাভূমির পাশের স্যাতসেঁতে জায়গাতেও আরামে বসার কোন অসুবিধে নেই। নিজে বা কাউকে দিয়ে একটা আসনকে ডেকে নিলেই হলো।
লোকটার গায়ের ওপর দিয়েই পাইপ হস্তান্তরের মাধ্যমে ধূমপান চলছিল আমাদের। ছোট্ট জায়গাটা ধোয়ায় ভরে যাওয়াতে ফোৎ ফোৎ করতে লাগল বুড়ো মাল্লা, খানিক পর উঠে বসল চোখ রগড়াতে রগড়াতে।
বলল, এই, কে তোমরা?
এই মহাজেরই নাবিক, জবাব দিলাম আমি। তা, জাহাজটা ছাড়বে কখন বলতে পারো?
ও, তোমরা তাহলে এই জাহাজেই যাচ্ছ? আজই ছাড়বে। গত রাতে তো ক্যাপটেন এসেছিল ডেকে।
কোন ক্যাপটেন? আহাব?
তাছাড়া আবার কে?
আরও প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম আহাব সম্বন্ধে, এমন সময় একটা শব্দ ভেসে এল ডেকের দিক থেকে।
ওই যে স্টারবাক, বলল মাল্লাটা। খুব ভাল চীফ মেট, ধার্মিক, প্রাণবন্ত। এবার যেতে হেবে। দ্রুত ডেকের দিকে এগোল সে, পেছনে পেছনে আমরা।
ইতিমধ্যে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে সূর্যের সোনালী আলো। দুজন তিনজন করে এসে উপস্থিত হতে লাগল নাবিকরা, রিগাররা ব্যস্ত হয়ে পড়ল দড়িদড়া নিয়ে, ওদিকে টুকিটাকি জিনিস আনা অব্যাহত রয়েছে। বাইরে এত হৈচৈ, অথচ তখনও কেবিন থেকে বেরোয়নি ক্যাপটেন আহাব।
২২.
অবশেষে ধীরে ধীরে জেটি ত্যাগ করল পেকোড। তখন দুপুর। শেষ মুহূর্তে একটা হোয়েলবোটে করে আন্ট চ্যারিটি নিয়ে এল সেকে মেটের জন্যে একটা নাইটক্যাপ আর স্টুয়ার্ডের জন্যে একটা বাড়তি বাইবেল।
এখনও ক্যাপটেন আহাবের কোন পাত্তা নেই। সবাই বলছে, ক্যাপটেন কেবিনে আছে। অবশ্য এই মুহূর্তেই ক্যাপটেনের প্রয়োজনীয়তা নেই। ব্যবসায়ী জাহাজগুলোতে নোঙর তোলার অনেক পরেও ক্যাপটেনের দেখা পাওয়া যায় না। তখন কেবিন টেবিলে বসে সে গল্পগুজব করে তীরের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে।
ক্যাপটেন পেলেগ আর ক্যাপটেন বিলদাদের যৌথ নেতৃত্বে এগিয়ে চলল পেকোড। স্টার্নে দাঁড়িয়ে আছি আমি, হঠাৎ তীব্র একটা ধাক্কা অনুভব করলাম পাছায়। তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখি, ক্যাপটেন পেলেগ তার পা টেনে নিচ্ছে। ওটাই আমার জীবনের প্রথম লাথি খাওয়া।
এভাবেই বুঝি ব্যবসায়ী জাহাজে হাত গুটিয়ে বসে থাকা হয়? গর্জে উঠল সে ঝাঁপিয়ে পড়ো, কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ো সবাই। নির্বিচারে ডানে-বামে লাথি চালাতে লাগল ক্যাপটেন পেলেগ। নিশ্চয় যথেষ্ট মদ গিলেছে ক্যাপটেন, ভাবলাম আমি।
বন্দর ছেড়ে বেরোনোর পর জাহাজ থেকে বিদায় নিল আন্ট চ্যারিটি, ক্যাপটেন পেলেগ আর ক্যাপটেন বিলদাদ।
২৩.
কুইকেগ অনেক আগেই হয়েছে, সম্প্রতি আমি যুক্ত হলাম হোয়েলিংয়ে। সাধারণ মানুষের চোখে এই পেশা মোটেই সম্মানজনক নয়। এ-যাবৎ তারা আমাদের, অর্থাৎ তিমি শিকারীদের প্রতি দারুণ অবিচার করে এসেছে।
এটাকে কোন পেশাই মনে করা হয় না। অন্য লোকেরা যেরকম সহজে তাদের পেশার কথা উল্লেখ করে, একজন হারপুনারের পক্ষে তা সম্ভব নয়। আর দশটা লোকের মত একজন তিমি শিকারী যদি ভিজিটিং কার্ড তৈরি করে, মানুষের কাছে তা হবে হাসির খোরাক।
পৃথিবীর প্রায় সবাই আমাদের পেশাটাকে নিষ্ঠুর মনে করে, তিমি শিকারী মাত্রেই তাদের চোখে কসাই। হ্যাঁ, আমরা কসাই, এ-কথা সত্যি। কিন্তু মার্শালদের চেয়ে বড় কসাই আর কেউ আছে? অথচ তারা পৃথিবীর চোখে বীর, এইসব বীরদের ভাগ্যে জোটে পদকের পর পদক। অভিযোগ রয়েছে, তিমি শিকারীরা নোংরা, তিমির মৃতদেহ তাদের জাহাজের ডেক নোংরা করে দেয়। কিন্তু সৈন্যদের গলিত মৃতদেহ যুদ্ধক্ষেত্রের যে-অবস্থা করে, সেই নোংরামির কি কোন জুড়ি আছে?
বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, আমাদের কোন অবদানই নেই। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যত মোমবাতি জ্বলছে, তার মূলে রয়েছি আমরা।
আমার ভাগ্যে যদি কোন মরণােত্তর খেতাব জোটে, তাহলে তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব হোয়েলিংয়ের। একজন ছাত্রের কাছে ইয়েল কলেজ আর হার্ভার্ড যা, আমার কাছে একটা হোয়েল শিপ তা-ই।
২৪.
পেকোডের চীফ মেট স্টারবাক ন্যানটাকেটেরই স্থানীয় অধিবাসী। ঠাণ্ডা দেশে জন্ম নিলেও গরমে সে অভ্যস্ত। দীর্ঘদেহী, আন্তরিক স্টারবাকের বয়েস মাত্র তিরিশ। তার চোখে রয়েছে হাজারটা বিপজ্জনক ঘটনার ছায়া। মন তার ইস্পাতদৃঢ়, তবু কিছু কুসংস্কার আছে। মূখের চেয়ে শিক্ষিতের কুসংস্কারকে সে অনেক বেশি ভয় পায়। স্টারবাক বলে, তিমিকে ভয় পায় না, এমন কোন লোককে আমি আমার নৌকোয় নেব না। এই কথা বলে সে হয়তো বোঝাতে চায়, বিপদ উপলব্ধি করার মধ্যেই রয়েছে সাহসের পরিচয়, কিংবা কাপুরুষের চেয়ে অকুতোভয় সঙ্গী অনেক বেশি বিপজ্জনক।
সেকেণ্ড মেট স্টাব বলে, যত তিমি শিকারী আছে, তাদের মধ্যে স্টারবাকের চেয়ে সাবধানী মানুষ আর কেউ নেই।
স্টারবাকের দৃষ্টিতে সাহস কোন আবেগ নয়। তিমি শিকারী হতে গেলে সাহসের প্রয়োজন, আর প্রয়োজনীয় জিনিস বলেই এটাকে অযথা খরচ করা স্টারবাক অনুমোদন করে না। সূর্যাস্তের পর তিমির পিছু নিতে সে নারাজ। মবি ডিক তিমিকে সে মারতে চায়, কিন্তু মরতে চায় না তিমির হাতে। প্রয়োজনে তিমি যে কতখানি হিংস্র, সেটা তার চেয়ে ভাল আর কজন জানে! বাবার মৃত্যু সে নিজের চোখে দেখেছে। অতল ওই মহাসাগরের কোথায় সে খুঁজে পাবে তার ভাইয়ের ছিন্নবিচ্ছিন্ন অঙ্গ?
২৫.
স্টাব পেকোডের সেকেণ্ড মেট। কেপ কডের অধিবাসী। হাসিখুশি, ফুর্তিবাজ মানুষ। দুঃসাহসী নয়, আবার কাপুরুষও বলা যাবে না। আক্রমণােদ্যত তিমির সামনে দাঁড়িয়ে বর্শা ছুঁড়তে হাত কাঁপে না স্টাবের। আসলে মানুষের কাছে যেটা মৃত্যুর চোয়াল, দীর্ঘ দিনের অভ্যাসে সেটাই তার কাছে পরিণত হয়েছে ইজি চেয়ারে। মৃত্যুর কথা সে আদৌ কোন দিন ভেবেছে কিনা জানি না, ভাবলেও নিশ্চয় গভীর ভাবে নয়। জীবনের সব কিছুই তার কাছে রসিকতা।
থার্ড মেট ফ্লাস্ক। টিসবারির অধিবাসী। খাটো, শক্তসমর্থ এই তরুণ তিমির ব্যাপারে সবসময়েই যুদ্ধংদেহী। তিমির বিশাল আকার তার কাছে কোন মহিমাই বহন করে না, ওগুলো যেন দানবীয় জল-হঁদুর মাত্র, দেখার সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলাটাই প্রধান কর্তব্য।
এই তিন মেট–স্টারবাক, স্টাব আর ফ্লাস্ক পেকোডের বোটগুলোতে হেডম্যান হিসেবে কাজ করে।
আগেকার যুগে নাইটের পাশে পাশে যেমন স্কয়ার থাকত, তিমি শিকারে তেমনি মেট যেন নাইট আর হারপুনার তার স্কয়ার।
তো, পেকোডের চীফ মেট স্কয়ার হিসেবে বেছে নিল কুইকেগকে। কুইকেগের পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন নেই। ইতিমধ্যেই ওর সম্বন্ধে আপনারা অনেক কিছু জেনেছেন।
আরেক হারপুনার ট্যাসটেগো। গে হেডের এক ইণ্ডিয়ান। এই জায়গাটা যুগে যুগে বিখ্যাত সব হারপুনারের জন্ম দিয়েছে, তারা সবাই গে হেডার বলে পরিচিত। ট্যাসটেগো বেশ লম্বা, হালকা-পাতলা শরীরে কিলবিল করছে মাংসপেশি, কালো গোল গোল চোখ, চুল নেমে এসেছে কাঁধ পর্যন্ত। রেড ইণ্ডিয়ানদের রক্ত বইছে তার শিরায়। ফলে অন্যান্য ইণ্ডিয়ানরা তীর-ধনুক হাতে যেমন নির্ভীক, সেও তেমনি হারপুন হাতে। ট্যাসটেগো সেকেণ্ড মেট স্টাবের স্কয়ার।
তৃতীয় হারপুনার ডাগৃগু, বিশালদেহী এক কালো কুচকুচে নিগ্রো। তার কান থেকে ঝুলছে বড় দুটো সোনালি আংটা। প্রথম জীবনে সে আফ্রিকা ছাড়া আর কোন দেশ দেখেনি। তারপর একদিন কৌতূহলী হয়ে যোগ দেয় এক জাহাজে। ডাগগু হলো ফ্লাস্কের স্কয়ার, পাশাপাশি দুজনকে দেখায় দাবার রাজা আর বোড়ের মত। শ্বেতাঙ্গ কোন লোক তার সামনে দাঁড়ালে মনে হয়, সাদা পতাকা নিয়ে কেউ দুর্গে এসেছে সন্ধি ভিক্ষা করতে।
২৬.
ন্যানটাকেট ছাড়ার পর বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল, তবু ক্যাপটেন আহারের দেখা নেই। যে-কারও মনে হতে পারে যে তিনজন মেটই বুঝি পেকোডের সর্বেসর্বা। কিন্তু মাঝে মাঝে চূড়ান্ত আদেশ আসে কেবিন থেকে। বোঝা যায়, অলক্ষে হলেও পেকোডের এক নায়ক অনুপস্থিত নয়।
নিচের কাজ সেরে কখনও কখনও ডেকে আসি আমি, চোখ খুঁজে ফেরে অপরিচিত এক মুখকে। তীব্র শীতকে পেছনে ফেলে জাহাজ এখন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে স্বাভাবিক আবহাওয়ার দিকে। সেদিনও যথারীতি ওপরে গেছি। ট্যাফরেইলের দিকে চোখ পড়তেই শিহরণ বয়ে গেল আমার শরীরে। কোয়ার্টারডেকে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্যাপটেন আহাব।
অসুস্থ তাকে মনে হচ্ছে না। লম্বা চওড়া শরীর যেন তৈরি হয়েছে ব্রোঞ্জ দিয়ে। পাকা চুলের ভেতর থেকে সাদা একটা রেখা তামাটে কপাল, গলা বেয়ে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেছে পোশাকের ভেতর। কোন কোন বড় গাছে বজ্রপাত হয়, ছাল-বাকল ছিঁড়ে বিদ্যুৎ নেমে আসে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত। গাছ মরে না, কিন্তু চিরদিনের মত চিহ্নিত হয়ে যায়। জানি না, ক্যাপটেন আহাবের ওই দাগ জন্মগত নাকি, কোন ভয়াবহ সংঘর্ষের স্মৃতি বহন করছে। একবার ট্যাসটেগোর সিনিয়র, বুড়ো এক গে-হেডার হারপুনার শুনিয়েছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক গল্প—সাগরের অশরীরী কোন শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ের ফলেই নাকি ওই দাগ হয়েছে ক্যাপটেন আহাবের। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে এই গল্পের প্রতিবাদ করেছিল আরেক বুড়ো নাবিক।
ক্যাপটেন আহাবের এই অদ্ভুত চেহারা আমাকে এমনই আচ্ছন্ন করে ফেলল যে, লক্ষই করলাম না, তাকে অদ্ভুত দেখানোর অন্যতম প্রধান কারণ বিচ্ছিন্ন। অঙ্গের স্থানে লাগানো সাদা একটা কৃত্রিম পা। তার এই তৈরি হয়েছে স্পার্ম তিমির চোয়ালের হাড় থেকে!
জাহাজের ওপর দিয়ে ভোলা সাগরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ক্যাপটেন আহাব। স্থির এই দৃষ্টিতে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। প্রথম থেকেই সে একেবারে চুপ। আশেপাশে দাঁড়ানে অফিসারদের মুখেও কোন কথা নেই। বোঝা যায় অস্বস্তিতে ভুগছে তারা ক্যাপটেন আহারের দুর্ভেদ্য ব্যক্তিত্বের সামনে চিরকালই অস্বস্তিতে ভুগেছে মানুষ।
খোলা বাতাসে খুব বেশিক্ষণ না থেকে কেবিনে ফিরে গেল ক্যাপটেন আহাব কিন্তু সেদিনের পর থেকে প্রায়ই তাকে দেখতে পেল নাবিকেরা। কখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে, কখনও টুলে বসে রয়েছে, আবার কখনও ভারী পা ফেলে পায়চারি করছে ডেকে। আকাশ পরিষ্কার হবার সাথে সাথে যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে লাগল ক্যাপটেন আহাব। আমার মনে হলো, বিষণ্ণ পরিবেশই ক্যাপটেনকে কেবিনে বন্দী করে রেখেছিল, এখন ভাল আবহাওয়ায় ধীরে ধীরে তার ওপর ভর করছে নতুন এক কর্মচাঞ্চল্য।
দেখতে দেখতে এসে গেল প্রকৃতির নাচুনী দুই মেয়ে–এপ্রিল আর মে। তাদের নৃত্যের তালে তালে উধাও হলো বরফ। মনমরা ভাব দূরে ছুঁড়ে ফেলে চাঙ্গা হয়ে উঠল সবাই। পরিবেশের একটা প্রভাব আছে। প্রভাবান্বিত হলো ক্যাপটেন আহাবও। তবে নিজের মত করে। অন্য আর দশটা লোক যেখানে ভেঙে পড়ত প্রাণখোলা হাসিতে, সেখানে কেবল রঙিন ছোপ লাগল তার দৃষ্টিতে।
২৭.
আরও দিন গেল। পরিষ্কার প্রকৃতি এখন ঝলমল করে সূর্যালোকে, রাতের আকাশকে পরায় রত্নখচিত মখমলের মালা। মানুষের ভেতরটাও কেমন ওলোট-পালট হয়ে যায়। নিস্তব্ধ গোধূলির স্বচ্ছ বরফের মত উপচে পড়ে স্মৃতির ফটিক।
বয়স যত বাড়ে, ঘুম তত কমতে থাকে। ক্যাপটেন আহাবও ব্যতিক্রম নয়। রাতে কেবিনের চেয়ে ভোলা বাতাসেই বেশিক্ষণ থাকে সে। কেবিনে যাওয়া যেন, বিড়বিড় করে বলে সে, নিজের খোড়া কবরে গিয়ে ঢোকা। তো, এমনি এক রাতে ডেকে পায়চারি করছে সে, এমন সময় স্টাব খোলা বাতাসে না থেকে তাকে কেবিনে যেতে বলল।
ঠাণ্ডা চোখে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল ক্যাপটেন আহাব। তারপর বলল, নিজের কাজে যাও। আমার পিছনে লেগো না। চাদর মুড়ি দিয়ে শোয়া ছাড়া তোমাদের জীবনে আর আছেটা কি? অবশ্য গর্তে গিয়ে না ঢোকা পর্যন্ত কুকুরের ভাল লাগবেই বা কেন–যাও, ভাগগা এখান থেকে!
বাক্যটার শেষ অংশের ধাক্কায় কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে রইল স্টাব। তারপর উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, আমার সঙ্গে কারও এভাবে কথা বলাটা আমি পছন্দ করি না, স্যার। মোটেই পছন্দ করি না।
থামো! দাঁত কিড়মিড় করতে করতে পেছনে সরে গেল ক্যাপটেন আহাব, যেন ভয়ঙ্কর কোন ইচ্ছে দমন করতে চায়।
না, স্যার, আরও সাহস দেখিয়ে বলল স্টাব, কারও কুকুর বলাটা আমি এত সহজে মেনে নেব না।
কুকুর বলা পছন্দ হয়নি, তাই না? বেশ, কুকুর বলে আর ডাকব না। তুমি হলে দশটা গাধার সমান। একটা খচ্চর। ভাগো, নইলে একেবারে খতম করে ফেলব! যাও!
এমন ভয়ঙ্কর মূর্তিতে তেড়ে এল ক্যাপটেন আহাব যে পালিয়ে এল স্টাব।
এর আগে আমার সঙ্গে কেউ এমন ব্যবহার করলে ঘুসি না খেয়ে পার পায়নি, কেবিনের পথে যেতে যেতে বিড়বিড় করতে লাগল স্টাব। অদ্ভুত ব্যাপার, খুবই অদ্ভুত। এখন কি করা উচিত বুঝতে পারছি না। ফিরে গিয়ে ব্যাটাকে ঘুসি লাগাব? নাকি এখানেই হাঁটু মুড়ে তার জন্যে প্রার্থনা করব? হ্যাঁ, প্রার্থনা করাটাই বুঝি ভাল হবে। কিন্তু প্রার্থনা যে জীবনে করিনি কখনও। অদ্ভুত ব্যাপার, খুবই অদ্ভুত। এই লোকটাও কম অদ্ভুত নয়। সত্যি কথা বলতে কি, এর চেয়ে অদ্ভুত লোকের সঙ্গে আমি আর কোন জাহাজে উঠিনি। কীভাবে ছুটে এল আমার দিকে!–চোখদুটো জ্বলছিল বাঘের মত। ব্যাটা কি পাগল নাকি বিছানা সে এখন থাকে না বললেই চলে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র তিন বঁটা, সেসময়টুকুও ঘুমায় না। স্টুয়ার্ড বলল, সে দেখেছে, চাদরসহ লুডোর কাপড়চোপড় নাকি তালগোল পাকিয়ে পড়ে আছে বিছানার পায়ের দিকে। সুভোর নিশ্চয় মায়া গরম হয়েছে। হ্যাঁ, ওই জিনিস থাকলে মাথা গরম হবেই। ওই য়েলোকে আরে বলে–বিবেক। অদ্ভুত ব্যাপার, লোকে ঘুমাবে না? কিন্তু ওটা কি হলো? বুড়ো যে কুকুর বলল আমাকে! শুধু তা-ই নয়। বলল, দশটা গাধার সমান। খচ্চর। আর যেভাবে তেড়ে এল, লাথি মারত নাকি? নাকি লাথি মেরেছে, আমি লক্ষ করিনি এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ঈশ্বর, আমি কি স্বপ্ন দেখছিলাম যাক গে, আপাতত বাদ যাক এসব চিন্তা। হ্যামক আমায় ডাকছে। গিয়ে সুম দিই। দেখা যাক, আগামীকাল সকালে ব্যাপারটাকে বাস্তব মনে হ, নাকি অবাস্তব!
২৮.
স্টাব চলে যাবার পর বুলওয়ার্কে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ক্যাপটেন আহাব। তারপর প্রহরারত এক নাবিককে নিচে পাঠাল তার স্বাদের চুল আর পাইপটা আনতে। পাইপ এলে সেটাকে কিনাকলের বাতিতে ধ্বরিয়ে, টুলে বসে ধূমপান করতে লাগল সে।
শোনা যায়, প্রাচীন কালে ডেনিশ রাজারা নাকি তাদের সিংহাক্ষম তৈরি করত নারহোয়ালের দাঁত দিয়ে। এখন, এই প্রান্ধকারে, হারে টুলে বসে থাকা ক্যাপটেন আহাবকে দেখলে কেউ মনে করতে পারে সে বুঝি এই প্রাচীন রাজাদের উত্তরসুরি।
ক্যাপটেনের পাইপ থেকে বেরোনো রাশি রাশি ধোঁয়া বাজামে ফিরে এসে ঝাপটা মারতে লাগল তারই মুখে। অবশেষে পাইপে টান দিয়ে সে স্বশালাক্তি করে উঠল, কই, ধূমপান তো আর শান্তি দিচ্ছে না। যা শান্তি দেয় না, তাকে কি কাছে রাখার কোন যুক্তি আছে? তাহলে আর কী কাজ এই পাইলে? আমি আর ধূমপান করব না আজ থেকে
জ্বলন্ত পাইপটা পানিতে ছুঁড়ে দিল সে। তারপর পাউচ হ্যাট মায়ায় জাম্পিয়ে পায়চারি করতে লাগল।
২৯.
পর দিন সকালে ফ্লাস্কের সাথে আলাপ জুড়ল স্টাব।
এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন আমি কখনও দেখিনি। জানোই তো, বুড়ো ক্যাপটেনের একটা পা মাছের হাড়ের। সেই পা দিয়ে সে একটা লাথি মারল আমাকে পাল্টা লাথি মারতে গিয়ে দেখি এক অবাক কাণ্ড। বিশ্বাস করো, দেখি কি, আহাব যেন একটা পিরামিড হয়ে গেছে। আমি বোকার মত সেখানেই লাথি মেরে চললাম।। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কি জানো, ফ্লাস্ক–স্বপ্ন যে কত অদ্ভুত হতে পারে—লাথি মারতে মারতে একসময় মনে হলো, আরে, কেন অযথা রাগ করছি! সে তো আসল পা দিয়ে লাথি মারেনি, মেরেছে কৃত্রিম পা দিয়ে। আসল পা আর কৃত্রিম পায়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সেজন্যেই বেতের চেয়ে একটা ঘুসি পঞ্চাশ গুণ বেশি ব্যথা দেয়। যে-জিনিসে প্রাণ আছে, সেটাই জলজ্যান্ত অপমানের সৃষ্টি করে। সুতরাং তার লাথিটাকে ঠিক লাথি বলা চলে না, ওটা অনেকটা বেত মারার মতই। কৃত্রিম পা-টা দেখেছ, নিচের দিকটা কেমন সরু? ওই পায়ের লাথিতে অপমানিত হবার মত কিছু নেই। কিন্তু কোন চাষা যদি লাথি মারত তার গোদা পা দিয়ে, দারুন অপমানের ব্যাপার ছিল। যাই হোক এবার ঘটল এক মজার ঘটনা। ব্যাজারের মত চুলঅলা বুড়ো এক মৎস্যমানব কোত্থেকে হাজির হয়ে আমার কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এখানে কি করছ? আমি তো ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম, আপনাকে তো লাথি মারিনি বোধ হয়। জ্ঞানী স্টাব, বলল সে। তারপর বিড়বিড় করে একই কথা বলেই চলল। বুড়ো এই একনাগাড়ে জ্ঞানী স্টাব বলা থামবে না বুঝতে পেরে আবার পিরামিডটাকে লাথি মারতে উদ্যত হলাম। কিন্তু যেই না পা তুলেছি, গর্জে উঠল বুড়ো, থামো, থামো বলছি! বললাম, ব্যাপার কি বুড়ো মিয়া? সে বলল, এসো, তোমার বিষয়ে একটা আলোচনা করা যাক। ক্যাপটেন আহাব তোমাকে লাথি মেরেছে, তাই না? হ্যাঁ, জবাব দিলাম। সে লাথি মেরেছে তার কৃত্রিম পা দিয়ে, তাই না? আবারো বুড়োর প্রশ্ন। হ্যাঁ, একই জবাব আমার। তাহলে তো তোমার রাগ করার কোন কারণই দেখাছি না, মাথা ঝাঁকাল বুড়ো। একে তোমাকে লাথি মেরেছে বিখ্যাত এক মানুষ, তার ওপর মাছের হাড়ে তৈরি চমৎকার পা দিয়ে। এটা একটা সম্মান। হ্যাঁ এটাকে সম্মানের ব্যাপারই মনে করি। শোনো, জ্ঞানী স্টাব। প্রাচীন ইংল্যাণ্ডে বড় বড় জমিদাররা রানীর হাতে চড় খাওয়াটাকে মহা সম্মানের ব্যাপার মনে করত। এই চড়ের বিনিময়ে অনেকে এমনকি নাইট উপাধিও বাগিয়ে নিয়েছে। তো রানীর চড় খেয়ে তারা যেমন নাইট হত, আহাবের লাথি খেয়ে তুমি তেমনি জ্ঞানী হলে। এবার যা বলছি, মন দিয়ে শোনো। মাঝে মাঝে তার লাথি খাবে, কিন্তু ভুলেও পালটা লাথি মারার চেষ্টা করবে না। কারণ, তাতে কোন লাভ হবে না। পিরামিড তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছ? কথা শেষ করে অদ্ভুত এক ভঙ্গীতে সে চলে গেল বাতাসে সাঁতরাতে সাঁতরাতে। নাক ডেকে চিত হতেই ঘুম ভেঙে গেল আমার। দেখি, শুয়ে আছি হ্যামকে। এখন বলো, ফ্রাস্ক, স্বপ্নটা কেমন মনে হলো?
বেশি বলতে পারব না, তবে কেমন যেন অর্থহীন।
হতে পারে, হতে পারে। কিন্তু এই স্বপ্ন সত্যিই আমাকে জ্ঞান দিয়েছে। ওই দেখো, পাশ ফিরে সাগরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আহাব। সবচেয়ে ভাল কাজ কি জানো, ফ্লাস্ক? বুড়োকে একা থাকতে দেয়া–সে যা-ই বলুক, কখনও তার জবাব দেবে না। আরে! কী বলে চেঁচাচ্ছে বুড়ো? শোনো!
।মাস্তুল থেকে দেখো! তীক্ষ্ণ চোখে দেখো সবাই! তিমির সন্ধান পাওয়া গেছে! সাদা কোন তিমি দেখতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে!
ঘটনাটা কেমন মনে হচ্ছে, ফ্লাস্ক? অদ্ভুত না? শুনতে পেয়েছে–সাদা তিমি। সত্যিই বিশেষ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এবার। এই সাদা তিমির কথাই সম্ভবত আহাবের মনে দগদগে ঘা হয়ে আছে। কিন্তু ওরে বাবা, ক্যাপটেন যে এদিকেই আসছে!
৩০.
হোয়েল-শিপের অফিসারদের মধ্যে এমন একটা পদ রয়েছে, যা আর কোনরকম নৌযানেই নেই।
দুশো বছর কি তারও আগে ডাচ ফিসারিতে হোয়েল-সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব ক্যাপটেনের হাতে ছিল না। অর্ধেক কর্তৃত্ব ছিল আরেকজল অফিসারের, যাকে বলা হত–স্পেকসিণ্ডার। এই পদ প্রধান হারপুনারের সমকক্ষ। তখন ক্যাপটেন দেখত জাহাজের নেভিগেশন আর সাধারণ ব্যবস্থাপনার দিকটা, তিমি শিকার এবং তাল সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কিছুর কর্তৃত্ব ছিল স্পেকসিণ্ডার বা প্রধান হারপুনারের। ব্রিটিশ গ্রীনল্যাণ্ড ফিসারিতে স্পেকসিণ্ডার নামে ডাচ সেই পদটা এখনও বহাল রয়েছে বটে, কিন্তু তার আগের মর্যাদা আর নেই। এখন সে ক্যাপটেনের নিম্নপদস্থ কর্মচারী মাত্র। তবে এ-কথা অনস্বীকার্য, তিমি শিকারের সফলতা অনেকটাই হারপুনারদের ওপর নির্ভর করে।।