মবি ডিক: ০১১-২০. ঘুম সহজে আসতে চাইল না

মবি ডিক: ০১১-২০. ঘুম সহজে আসতে চাইল না

১১-২০. ঘুম সহজে আসতে চাইল না

ঘুম সহজে আসতে চাইল না। মাঝরাতে উঠে হামাগুড়ি দেয়ার ভঙ্গীতে কিছুক্ষণ থাকার পর বসলাম আমরা। চোখ খুলব কি খুলব না করতে করতে খুলেই ফেললাম শেষ পর্যন্ত। ঘরের ভেতরে গাঢ় অন্ধকার, জানালার বাইরে ঝাপসা আলোর ক্ষীণ আভাস। জেগে যখন আছিই আলো জ্বালতে আপত্তি ছিল না আমার। কিন্তু তার আগে প্রায় একই সঙ্গে ধূমপানের ইচ্ছে জাগল দুজনেরই। গত রাতে বিছানায় বসে ওর ধূমপানের ব্যাপারে কতই না আপত্তি করেছিলাম, অথচ আজ সেটাকেই মনে হচ্ছে চমৎকার একটা ঘরোয়া আনন্দ। প্রীতির স্পর্শে কত সহজেই না উবে যায় মানুষের সংস্কার। মনের গভীরে এখন টোকা দিচ্ছে একটাই কথা–প্রকৃত কোন বন্ধুর সঙ্গে পাইপ এবং কম্বল ভাগাভাগির চেয়ে আরামের বুঝি আর কিছু নেই। পাইপের ধােয়ায় দেখতে দেখতে নীলচে একটা চাদোয়া তৈরি হলো আমাদের ওপরে।

তরঙ্গায়িত সেই চাঁদোয়ায় ভর করেই কুইকেগের মন সুদূরে ভেসে গেল কিনা জানি না, বলতে লাগল ওর দেশের কথা। আমিও কৌতূহলী হয়ে উঠলাম শোনার জন্যে। দ্রুত কথা বলায় প্রথমে অসুবিধে হলো ওর ভাঙা ভাঙা বাক্য বুঝতে, তবে খানিক পরেই অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।

১২.

কুইকেগ দক্ষিণ-পশ্চিমের সুদূর এক দ্বীপ কোকোভোকোর অধিবাসী। কোন ম্যাপে অবশ্য কোকোভোকোর উল্লেখ নেই, খাটি জায়গাগুলোর কখনোই থাকে না।

শৈশবে বর্বরেরা যখন ঘেসো জমিতে ছুটে বেড়ায় ছাগল সঙ্গে নিয়ে, কুইকেগ তখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল খ্রিস্টীয় জগৎ দেখবে। ওর বাবা ছিল গোত্রপ্রধান, রাজা; চাচা প্রধান পুরোহিত; খালারাও সব অজেয় বীরের স্ত্রী। ওর শিরায় ছিল রাজকীয় রক্ত, কিন্তু সম্ভবত শৈশবের ইচ্ছের তাড়না সে-রক্তকে কর্তৃত্বলোভী হয়ে উঠতে দেয়নি।

একদিন এক জাহাজ ভিড়ল ওর বাবার উপকূলে। খ্রিস্টানদের দেশে যাবার জন্যে জাহাজে উঠতে চাইল কুইকেগ, কিন্তু অনুমতি মিলল না জাহাজ কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। এল স্বয়ং রাজা, তবুও কোন লাভ হলো না। কুইকেগ ততক্ষণে বদ্ধপরিকর। দ্বীপের অদূরে রয়েছে এক প্রণালী, জাহাজকে তার ভেতর দিয়ে যেতেই হবে। প্রণালীর এক পাশে প্রবাল প্রাচীর, আরেক পাশের স্থলভূমি জঙ্গলে পরিণত হয়েছে গরান গাছে। পানির মাঝ পর্যন্ত নেমে যাওয়া সেই জঙ্গলে ক্যান্ লুকিয়ে রেখে অপেক্ষা করতে লাগল কুইকেগ। জাহাজ আসতেই এক লাথিতে ক্যান্‌ ডুবিয়ে দিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল ও জাহাজের পাশে; শেকল বেয়ে ডেকে উঠে চেপে ধরল রিং-বোল্ট। বলল, কেটে টুকরো টুকরো করলেও নড়তে রাজি নয় ও।

পানিতে ফেলে দেয়ার ভয় দেখাল ক্যাপটেন, খোলা কবজির ওপর খঞ্জর উঁচিয়ে রইল; কিন্তু কুইকেগ রাজার ছেলে, ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, চোখের পাতাও কাঁপাল না। সত্যিকারের এই জেদ দেখে শেষ পর্যন্ত নরম হলো ক্যাপটেন। বলল, নিজের বাড়ির মতই জাহাজটার যেখানে খুশি ঘুরতে পারে ও। কিন্তু ক্যাপটেনের কেবিন দেখার সৌভাগ্য ওর কখনোই হলো না, সবাই মিলে ওকে লাগিয়ে দিল নাবিকের কাজে। ধীরে ধীরে একজন হোয়েলম্যানে পরিণত হলো কুইকেগ, হারপুন ছোড়া শিখল। এসব নিয়ে ওর মনে কোন অপমানবোধ নেই। লালন করছে ও গোপন একটা ইচ্ছে, সেটা পূরণ হলেই হলো। ওর দেশবাসী এমনিতেই সুখী, তবু খ্রিস্টানদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তাদের আরও সুখী করতে চায় ও। কিন্তু হোয়েলম্যানদের সঙ্গে মিশতে মিশতে ধাক্কা খেল কুইকেগ। দেখল, খ্রিস্টানেরাও হতে পারে দুর্দশাগ্রস্ত আর শয়তানের শিরোমণি। বন্দরে জাহাজ ভিড়ার পর নিউ বেডফোর্ড এসে পুরো হতাশ হয়ে পড়ল ও। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, খ্রিস্টান হওয়ার আর প্রয়োজন নেই, মরবে ও একজন বিধর্মী হিসেবেই।

এভাবেই একজন মূর্তি পূজারী এখনও বাস করছে খ্রিস্টানদের মাঝে, পরছে তাদের পোশাক, বলার চেষ্টা করছে তাদেরই অর্থহীন ভাষা।

জানতে চাইলাম, আগামীতে কি করতে চায় ও। কুইকেগ বলল, সাগরে যাবে তিমি শিকার করতে। উফুল্ল হয়ে বললাম, এখান থেকে ন্যানটাকেটে যাব আমি, তিমি শিকারীদের রওনা দেয়ার জন্যে ওটাই সবচেয়ে ভাল বন্দর। আমার দুহাত জড়িয়ে ধরে কুইকেগ জানাল, আমার সঙ্গে ও-ও যাবে ন্যানটাকেটে, উঠবে একই জাহাজে, পাহারা দেবে একই প্রহরে, খাবে পাশাপাশি বসে–অর্থাৎ, ও পেতে চায় আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গ। খুশিমনেই রাজি হলাম আমি। কুইকেগ একজন অভিজ্ঞ হারপুনার, আমার মত নতুন লোককে ওর অভিজ্ঞতা অনেক সাহায্য করবে।

পাইপে শেষ টান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হলো ওর গল্প। কয়েক মুহূর্ত পর দুজনেই তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে।

১৩.

পর দিন সকালে, সোমবার, এম্বামিং করা মাথাটা এক নাপিতকে গছিয়ে বিল মিটিয়ে দিলাম আমাদের দুজনের। কুইকেগের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে দেখে মালিকসহ মজা পেল সরাইখানার সবাই।

ন্যানটাকেটগামী স্কুনার দ্য মস এসে গেছে। একটা ঠেলাগাড়ি ভাড়া করে তাতে জিনিসপত্র চাপিয়ে রওনা দিলাম আমরা। ঘাড় ঘুরিয়ে পথচারীরা বার বার দেখল আমাদের। তাদের দেখার বস্তু অবশ্য কুইকেগ নয়, নরখাদক নিউ বেডফোর্ডে অনেক দেখা যায়–কোন শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে যে নরখাদকের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, এটা তাদের ধারণার বাইরে।

অবশেষে টিকেট কেটে মালপত্রসহ নিরাপদে উঠে পড়লাম স্কুনারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাল উঠল, জাহাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল আকুসনেট নদী দিয়ে। বন্দরে সারি দিয়ে রয়েছে তিমি শিকারের জাহাজ, এখানে কষ্টকর একটা অভিযান শেষ মানে আরেকটার শুরু।

খোলা পানিতে এসে গতি বাড়াল স্কুনার। দুচোখ ভরে চারপাশের চমত্তার দৃশ্য দেখছি আমরা, হঠাৎ ঘটল এক কাণ্ড। গেঁয়ো এক লোক পেছন থেকে টিটকিরি দিতেই হারপুনটা রেখে খপ করে তাকে ধরে ফেলল কুইকেগ। এক ঝাঁকুনিতে তার পুরো শরীর উঠে গেল শূন্যে, পরমুহূর্তে চার হাত পায়ে ডেকে আছড়ে পড়ল বেচারা। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে পেছন ফিরে পাইপ ধরাল কুইকেগ। কয়েকটা টান দিয়ে বাড়িয়ে দিল আমার দিকে।

ক্যাপটিং! ক্যাপটিং! এক দৌড়ে অফিসারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল লোকটা; ক্যাপটিং, ওটা একটা শয়তান।

হ্যালো, স্যার, কুইকেগের দিকে এগিয়ে এসে চেঁচাল ক্যাপটেন, জানেন, লোকটাকে আপনি প্রায় মেরে ফেলতে যাচ্ছিলেন?

ও কি বলছে? আমার দিকে ফিরল কুইকেগ।

বলছে, ওই লোকটাকে তুমি খতমের জোগাড় করেছিলে।

খতম? বিরক্তিতে বেঁকে গেল ওর মুখ, কুইকেগ পুঁচকে মাছ মারে না, মারলে তিমি মারে–তিমি!

শুনুন, গর্জে উঠল ক্যাপটেন, আবার এই ধরনের আচরণ দেখলে আপনাকে আমি খুন করব!

ক্যাপটেনের কথা শেষ হতে না হতেই প্রধান পালের প্রচণ্ড টানে দুভাগ হয়ে গেল ওয়েদার-শীট, জাহাজ কাৎ হয়ে হুড়হুড় করে পানি উঠতে লাগল ডেকের পেছনদিকে। ছিটকে নদীতে গিয়ে পড়ল পেঁয়ো লোকটা, ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল যাত্রীদের মধ্যে। একটুও বিচলিত না হয়ে নিষ্কম্প হাতে শীটটা নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলল কুইকেগ, বন্ধ হলো জাহাজের লাফালাফি। এবারে কোমর থেকে উর্ধাংশের পোশাক খুলে ফেলে ঝাপিয়ে পড়ল খরস্রোতা নদীতে। কেটে গেল দারুণ উত্তেজনার কয়েকটা মিনিট। কুইকেগ ভেসে উঠলে দেখা গেল তার এক হাতে জাপটে ধরা একটা অচেতন শরীর। বোট নামিয়ে উদ্ধার করা হলো দুজনকেই। খানিক পরেই জ্ঞান ফিরল গেঁয়ো লোকটার। ক্যাপটেন নিজে এসে ক্ষমা চাইল কুইকেগের কাছে। ওই মুহূর্ত থেকে জড়িয়ে গেলাম ওর সঙ্গে।

জীবন বাজি রাখা এই বীরতু সমাজের মহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃষ্টিতে মেডেল পাবার দাবিদার কিনা, সে-সম্বন্ধে কুইকে সম্পূর্ণ অসচেতন। শরীর থেকে লবণ ধুয়ে ফেলার জন্যে ও কেবল চাইল পরিষ্কার পানি। ধােয়ামোছার পালা শেষ হতে শুকনো কাপড় পরল কুইকেগ, তারপর বুলওয়ার্কে হেলান দিয়ে পাইপ ধরাল ধীরেসুস্থে।

১৪.

যাত্রাপথে উল্লেখযোগ্য আর কিছুই ঘটল না, নিরাপদে ন্যানটাকেট বন্দরে এসে ভিড়ল স্কুনার।

ন্যানটাকেট! ম্যাপ খুলে দেখুন, পৃথিবীর একেবারে কোণে জায়গাটা অবস্থিত। চারপাশে শুধু বালি আর বালি।

অঞ্চলটা নাকি আবিষ্কার করেছে রেড ইণ্ডিয়ানরা। কিংবদন্তি আছে, প্রাচীন কালে উপকূলভাগে ছোঁ মেরে ইণ্ডিয়ান একটি শিশুকে ধরে উড়ে গিয়েছিল এক ঈগল। কাদতে কাদতে বাবা-মা দেখল, ঈগলের নখরে ঝুলতে ঝুলতে বিশাল জলরাশির ওপর দিয়ে তাদের প্রাণপ্রিয় বাচ্চা চলে গেল দৃষ্টিসীমার বাইরে। ক্যাতে করে তারা বেরিয়ে পড়ল সেদিক লক্ষ্য করে। বিপজ্জনক এক অভিযান শেষে এখানে এসে খুঁজে পেল শিশুটির কঙ্কাল।

সৈকতে জন্মগ্রহণ করলে সাগরের প্রতি আকর্ষণ জন্মাবে, এ আর আশ্চর্য কি! প্রথমে সৈকতে কাঁকড়া ধরল ন্যানটাকেটাররা, সাহস একটু বাড়তে জাল দিয়ে ধরতে লাগল ম্যাকেরেল, তারপর নৌকো নিয়ে এগোল কড মাছ ধরার জন্যে, সবশেষে জাহাজের বহর নিয়ে বেরিয়ে পড়ল পৃথিবীর জলভাগ আবিষ্কারের নেশায়।

বাইবেলের ভাষায়–ন্যানটাকেটাররা জাহাজে করে একাই গিয়েছিল সাগরে। হ্যাঁ, সাগরই হয়ে উঠেছিল তাদের ঘরবাড়ি, যা কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য তাও সাগরেই। সাগরই হয়ে উঠল তাদের জীবিকা। লুকায় তারা ঢেউয়ের আড়ালে, প্রয়োজনে ঢেউয়ের মাথায় ওঠে, ঠিক যেমন শ্যামোআ শিকারীরা ওঠে আল্পসে। বহু বছর তারা মাটির সংস্পর্শে আসেনি। ফলে শেষমেশ যখন এল, সবকিছুই মনে হলো অদ্ভুত। তাই দিনের বেলা মাটির ওপরে থাকলেও রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে নৌকো ভাসাল তারা। স্থলভাগ দৃষ্টিসীমা থেকে মুছে যেতে থামল তাদের নৌকো। পাল গুটিয়ে শুয়ে পড়ল ন্যানটাকেটাররা, তাদের বাড়ির নিচ দিয়ে ছুটে গেল সিন্ধুঘোটক আর তিমির দল।

১৫.

আমরা যখন বন্দরে নামলাম, সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। সুতরাং খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়া ছাড়া আজ আর কিছু করার নেই। আসার সময় স্পাউটার-ইন-এর মালিক বলে দিয়েছে তার কাজিন হোসিয়া হাসির সরাইখানায় যেতে। ট্রাই পস্এর চাউডার সুপ নাকি বিখ্যাত।

ঠিকানা মিলিয়ে খুঁজে বের করে ফেললাম ট্রাই পটস ইন। গাড়ি-বারান্দায় দাঁড়িয়ে একজন কর্মচারীকে গালি দিচ্ছে হলুদ গাউন পরা হলুদ চুলের এক মহিলা। আহত চোখের মত লাল একটা বাতি দুলছে তার মাথার ওপর।

এসো, কুইকেগ, বললাম আমি, ইনি নিশ্চয় মিসেস হাসি।

ধারণা আমার মিথ্যে নয়। রাতের খাবার আর থাকার জায়গা চাই শুনে আপাতত লোকটাকে রেহাই দিয়ে ছোট একটা ঘরে আমাদের নিয়ে গেল মহিলা। টেবিলে বসিয়ে দিয়ে জানতে চাইল–ক্ল্যাম না কড?

কডটা আবার কিরকম, ম্যাডাম? জানতে চাইলাম আমি।

ক্ল্যাম না কড? একই ভঙ্গীতে পুনরাবৃত্তি করল মহিলা।

রাতের খাবার হিসেবে ক্ল্যাম? এই তীব্র ঠাণ্ডায় আপনি আমাদের ক্ল্যাম দিতে চান, মিসেস হাসি? ঠাণ্ডা যে আরও বেড়ে যাবে।

ইতিমধ্যে মহিলা আবার গালি দিতে শুরু করেছে সেই কর্মচারীকে। হাবভাবে মনে হলো, আমার কথাগুলোর মধ্যে শুধু ক্ল্যাম শব্দটাই তার কানে গেছে। রান্নাঘরের দরজার সামনে গিয়ে দুজনের জন্যে ক্ল্যাম বলে ভেতরে চলে গেল মিসেস হাসি।

কুইকেগ, বললাম আমি, এক ক্ল্যামে দুজনের হবে তো?

রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা গন্ধে মনে হলো না যে খাবারটা খুব একটা সুবিধের হবে। কিন্তু ধোয়া ওঠা চাউডার সামনে এনে রাখতে ধারণাই বদলে গেল। হেজেল নাটের মত ছোট ছোট শামুক, শিপ বিস্কুটের গুঁড়ো আর লবণে জারিত শুয়োরের মাংসের সঙ্গে মেশানো হয়েছে পরিমাণমত মাখন, মরিচ আর লবণ। যাত্রার ফলে এমনিতেই খিদে লেগেছিল, তাই সুস্বাদু চাউডারের বাটি দেখতে দেখতে শূন্য হয়ে গেল। মাছজাতীয় খাবার পেয়ে বহু দিন পর তৃপ্তির সঙ্গে খেলো কুইকেগ। আমার মাথায় ততক্ষণে দোলা দিয়েছে মিসেস হাসির বলা দ্বিতীয় পদটা। হ্যাঁ, ওটাও পরীক্ষা করে দেখতে হবে। রান্নাঘরের দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে জোরে বললাম, কড, তারপর ফিরে এসে বসে রইলাম চুপচাপ। কয়েক মিনিট পর ভেসে এল ভিন্ন ধরনের একটা গন্ধ। বেশি অপেক্ষা করতে হলো না, আমাদের সামনে সাজিয়ে দেয়া হলো ধূমায়িত কড-চাউডার।

ট্রাই পটস-এর মত মাছজাতীয় খাবার সম্ভবত আর কোথাও পাওয়া যায় না। এখানকার পাত্রে সবসময় গরম হচ্ছে চাউডার। সকালের নাস্তায় চাউডার, দুপুরে চাউডার, রাতেও তাই। সরাইখানার সামনের অংশটা বোঝাই হয়ে আছে শামুকের খোলায়। মিসেস হাসির গলায় ঝুলছে কডের ভার্টেব্রার একটা মালা, হোসিয়া হাসির অ্যাকাউন্ট খাতাটা বাঁধানো হাঙরের চামড়ায়। এখানকার দুধেও মাছ মাছ গন্ধ কেন বুঝতে পারছিলাম না। এক সকালে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। দেখি, মাছ খাচ্ছে মি. হাসির গরু।

যাই হোক, খাবার শেষে একটা বাতি দিয়ে মিসেস হাসি বলে দিল, শোয়ার জন্যে আমাদের কোন দিকে যেতে হবে। কুইকেগ কেবল ওপরতলার দিকে পা বাড়িয়েছে, ওকে বাধা দিয়ে হারপুনটা চাইল মহিলা, কোনও বোর্ডারকে সে হারপুন নিয়ে ঘরে যেতে দেয় না।

কেন? বললাম আমি, সব জাত হোয়েলম্যানই সঙ্গে হারপুন রাখে। এতে অসুবিধেটা কোথায়?

অসুবিধে আছে, বলল মহিলা। জিনিসটা বিপজ্জনক। বছর চারেক আগে এক নাবিক মারা গিয়েছিল নিজেরই হারপুনে বিদ্ধ হয়ে। তারপর থেকে আর কাউকে সঙ্গে হারপুন রাখতে দিই না। মি. কুইকেগ, আপনার অস্ত্রটা দিন, আগামীকাল সকালেই পেয়ে যাবেন। তা ভাল কথা, সকালে কি খাবেন আপনারা, ক্ল্যাম না কড?।

দুটোই, জবাব দিলাম আমি, আর স্বাদ বদলের জন্যে গোটা দুই সেঁকা হেরিংও দেবেন।

১৬.

বিছানায় শুয়ে শুয়ে আগামীকালের পরিকল্পনা স্থির করতে লাগলাম আমরা। কুইকে বলল, সে ইয়োজো–মানে ওর নিগ্রো দেবতার সঙ্গে গত কয়েক দিন ধরে পরামর্শ করেছে। ইয়োজো বলেছে, কোন জাহাজে যাত্রা করব, সেটা বাছার ভার পুরোপুরি আমার ওপর ছেড়ে দিতে হবে, কুইকেগ সঙ্গে যেতে পারবে না।

হাজার কথা বোঝালেও দেবতাকে অমান্য করবে না কুইকেগ। তাই পর দিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম। আজ আবার ও রোজা অর্থাৎ উপোস করছে। সারা দিন বসে থাকবে ইয়োজোকে নিয়ে, প্রয়োজনে আরও পরামর্শ করবে। অনেক খুঁজেপেতে তিন বছরের জন্যে অভিযানে যাবে, এমন তিনটে জাহাজ বের করলাম আমি। ডেভিল-ড্যাম, টিট-বিট আর পেকোড। ভাল করে দেখে শুনে মনে হলো, পেকোডই হবে আমাদের উপযুক্ত জাহাজ। বুড়ো ক্যাপটেন পেলেগ অনেক দিন পর্যন্ত এটার চীফ মেট ছিল, এখন প্রধান মালিকদের একজন।

আমি যে এই জাহাজে যেতে চাই, তা বলার জন্যে মালিকদের কাউকে খুঁজতে লাগলাম কোয়ার্টার-ডেকে। প্রথমটায় কাউকে দেখতে পেলাম না, তারপর চোখে পড়ল মূল পালের পেছনদিকে রাইট হোয়েলের চোয়ালে নির্মিত অদ্ভুত চেহারার এক তাবু। ভেতরে উঁকি দিতে এক বুড়োকে দেখতে পেলাম। বুড়োর শরীর আর দশটা নাবিকের মতই পেশিবহুল, পরনে ভারী নীল পাইলট-ক্লথ, মুখের খুদে খুদে অসংখ্য কুঞ্চন কঠোর সব অভিযানের সাক্ষর বহন করছে।

আপনি কি পেকোডের ক্যাপটেন? তাবুর দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম আমি।

ধরো আমিই যদি পেকোডের ক্যাপটেন হই, তার কাছে তোমার কি প্রয়োজন? জানতে চাইল বুড়ো।

আমি এই জাহাজে যাবার কথা ভাবছিলাম।

ভাবছিলে, আঁ, ভাবছিলে তাই না? তুমি তো ন্যানটাকেটার নও–এই ধরনের জাহাজে গেছ কখনও?

না, স্যার, কখনও যাইনি।

যতদূর মনে হচ্ছে, হোয়েলিং সম্বন্ধে কিছুই জানো না তুমি–আঁ?

কিছুই না, স্যার; কিন্তু আশা করি খুব শিগগিরই শিখে নিতে পারব। ব্যবসায়ীদের জাহাজে অনেক বার গেছি, আমার মনে হয়-।

ব্যবসায়ী জাহাজের নিকুচি করি। ওই কথা আমার সামনে আর কখনও বলবে না। ব্যবসায়ী জাহাজ! ওসব জাহাজে গেছ বলে মনে মনে বুঝি খুব গর্ব অনুভব করো? যত্তোসব! তা এত দিন ব্যবসায়ী জাহাজেই গেছ যখন, এবার হোয়েলিং শিপে যেতে চাও কেন?—ব্যাপারটা সন্দেহজনক, তাই না?—একসময় তো জলদস্যু ছিলে, আঁ? লুটে নিয়েছ তোমার শেষ ক্যাপটেনের সর্বস্ব, ঠিক কিনা?–এবার বুঝি জাহাজ সাগরে গেলে সব অফিসারকে খুনের মতলব করেছ?

প্রতিবাদ করে বললাম যে এসব আমি কখনোই করিনি বা ভাবিনি। ক্যাপটেন পেলেগের বলার ভঙ্গীতে রসিকতার ছোঁয়া থাকলেও বুঝতে পারলাম, বিদেশী কাউকে বিশ্বাস করে না সে।

কিন্তু হোয়েলিংয়ে যেতে চাও কেন? তোমাকে জাহাজে নিতে চাইলে এ-কথা তো আমার জানতেই হবে।

তাহলে শুনুন, স্যার। আমি দেখতে চাই হোয়েলিং জিনিসটা কেমন। পৃথিবীটাও ভাল করে দেখতে চাই আমি।

হোয়েলিং দেখতে চাও, আঁ? ক্যাপটেন আহাবকে দেখেছ কখনও?

ক্যাপটেন আহাব কে, স্যার?

হুঁ, যা ভেবেছিলাম। ক্যাপটেন আহাবই এই জাহাজের ক্যাপটেন।

তাহলে তো ভুল করে ফেলেছি। এতক্ষণ ধরে ভাবছি, আমি বুঝি ক্যাপটেনের সঙ্গেই কথা বলছি।

এতক্ষণ ধরে তুমি কথা বলেছ ক্যাপটেন পেলেগের সঙ্গে। এই জাহাজটা আমার, আর নাবিক জোগাড় থেকে শুরু করে এটাকে অভিযানের উপযুক্ত করে রাখার দায়িত্ব ক্যাপটেন বিলদাদের। আমরা দুজনেই পেকোডের প্রধান অংশীদার এবং এজেন্ট। যাক যা বলছিলাম। ক্যাপটেন আহবকে অবশ্যই দেখবে, বেচারির একটা পা কেবল আছে।

কী বলতে চান, স্যার? আরেকটা পা কি তিমিতে নিয়ে গেছে?

তিমিতে নিয়ে গেছে! ইয়াং ম্যান, কাছে এসো। ওই পা শুধু নিয়ে যায়নি, চিবিয়ে গিলে ফেলেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্পার্ম তিমি। আহা রে!

ক্যাপটেন আহাবের জন্যে ক্যাপটেন পেলেগের সহানুভূতি আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। বললাম, কিভাবে জানব, স্যার, নির্দিষ্ট কোন তিমির এত হিংস্রতা থাকতে পারে। তবু ছোট্ট এই দুর্ঘটনা হয়তো তিমির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সাহায্য করবে আমাকে।

মনটা তোমার খুবই নরম, ইয়াং ম্যান। সত্যিই কি তুমি সাগরে গিয়েছিলে কখনও? সত্যি করে বলো।

স্যার, জবাব দিলাম আমি, আপনাকে তো বলেছি বোধ হয়, চার বার আমি সাগরে গেছি ব্যবসায়ী জাহাজের

থামো! নিষেধ করেছি না ব্যবসায়ী জাহাজের কথা আমার সামনে বলতে? একটা বোঝাপড়া হওয়া উচিত তোমার সঙ্গে। হোয়েলিং কেমন জিনিস, সেটার একটা আভাস তো দিলাম, তারপরেও যেতে চাও?

চাই, স্যার।

খুব ভাল কথা। কিন্তু তুমি তো শুধু হোয়েলিংই দেখতে চাও না, পৃথিবীটাকেও দেখতে চাও। যাও, ওই ওয়েদার বোর ওপর দিয়ে একটা উঁকি দিয়ে এসে আমাকে বলল, কি দেখলে।

কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলাম হতভম্ব হয়ে। ক্যাপটেন পেলেগ কি সত্যিই এটা বলেছে নাকি রসিকতা করছে? কিন্তু না। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম, ক্যাপটেনের মুখে রসিকতার কোন চিহ্ন নেই।

একটা উঁকি দিয়ে ফিরে এলাম আমি।

কি দেখলে? জিজ্ঞেস করল পেলেগ।

এমন কিছু নয়, জবাব দিলাম আমি–শুধু পানি আর পানি, দিগন্ত প্রায় দেখাই যায় না। তবে, একটা ঝড় আসছে মনে হয়।

তাহলে পৃথিবীর আর কি দেখার আশা করো তুমি? কেপ হর্নের ওপারে গিয়ে নতুন কিছু? পৃথিবী তো এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে।

বোকা বনে গেলাম। কিন্তু তিমি শিকার অভিযানে যেতেই হবে আমাকে, আর যেতে হলে পেকোডের চেয়ে ভাল জাহাজ সম্ভবত আর নেই। মনের কথা খুলে বললাম পেলেগকে। নাছোড়বান্দা ভাব দেখে শেষমেশ আমাকে জাহাজে নিতে রাজি হলো বুড়ো।

তাহলে তো এখনই তোমাকে দিয়ে কিছু কাগজপাতি সই করিয়ে নিতে হয়। চলো, আমাকে পথ দেখিয়ে একটা কেবিনে নিয়ে গেল সে।

দেখা হলো অদ্ভুত চেহারার ক্যাপটেন বিলদাদের সঙ্গে। বয়েস ষাটের কম নয়, বাড়তি এক বিন্দু চর্বি নেই শরীরের কোথাও। ক্যাপটেন পেলেগের মতই এখন নাবিকের জীবন থেকে অবসর নিয়েছে সে। বসে বসে হিসেবপাতি দেখে। একেবারে কেবিন বয় হিসেবে জীবন শুরু করে পর্যায়ক্রমে হারপুনার, বোটহেডার, চীফ-মেট, ক্যাপটেন এবং শেষে জাহাজের মালিক হয়েছে ক্যাপটেন বিলদাদ। ধার্মিক, কিন্তু কঠিন-প্রাণ, একটা পয়সা বাজে খরচ হতে দেয় না। সে হয়তো চলে এই দর্শনে যে মানুষের ধর্মজীবন এক জিনিস, আর বাস্তব জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। জাহাজে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার সময় সে ছিল একজন কঠোর টাস্ক-মাস্টার। নাবিকদের নাকি এতই খাটিয়ে নিত যে অভিযান শেষে তীরে নেমে প্রায় সবাইকেই যেতে হত হাসপাতালে।

নাকের ওপর চশমা লাগিয়ে প্রকাণ্ড একখানা বই পড়ছে ক্যাপটেন বিলদাদ। শরীর সম্পূর্ণ সোজা। উবু বা কুঁজো সে কখনোই হয় না। লোকে বলে, কোটের ঝুলে ধুলো লাগার ভয়ে।

বিলদাদ, চেচিয়ে উঠল ক্যাপটেন পেলেগ, আবার ওটা নিয়ে বসেছ, আঁ? বলি, গত ত্রিশ বছর ধরে তো ওই ধর্মশাস্ত্র পড়ছ, বুঝেছ কিছু?

দীর্ঘ দিন ধরে এসব খোঁচা মারা কথা শুনে অভ্যস্ত, তাই জবাব দেয়ার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করল না বিলদাদ, কিন্তু আমাকে দেখে জিজ্ঞাসু চোখ তুলে তাকাল সে পেলেগের দিকে।

এ আমাদের জাহাজে যেতে চায়।

চাও বুঝি? সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল বিলদাদ।

হ্যাঁ, জবাব দিলাম আমি।

ওকে কেমন বুঝছ, বিলদাদ? জানতে চাইল পেলেগ।

কাজ চলবে, বলে মাথা নামিয়ে বিড়বিড় করে আবার বই পড়তে লাগল ক্যাপটেন বিলদাদ।

একটা আলমারি খুলে কাগজপাতি নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসল পেলেগ। সঙ্গে সঙ্গে নানারকম চিন্তা ভিড় করে এল আমার মাথায়। ইতিমধ্যেই জেনেছি, হোয়েলিং জাহাজে কোন মজুরি দেয়া হয় না। তবে পরিশ্রম আর পদ অনুসারে ক্যাপটেন থেকে শুরু করে লাভের একটা অংশ পায় সবাই। এই পারিশ্রমিককে বলে–লে। যেহেতু আমি হোয়েলিংয়ে নতুন, খুব বেশি লে আমার হবে না। তবে সাগর যাত্রার অভিজ্ঞতা রয়েছে যখন, আমাকে তো দেয়া উচিত অন্তত ২৭৫ লেঅর্থাৎ, নেট লাভের ২৭৫ ভাগের এক ভাগ। সবাই জানে, ২৭৫ লে কোন অংশই প্রায় নয়, তবু নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। যতটুকুই পাই, আমার কাপড়চোপড়ের খরচা চলে যাবে মনে হয়। তাছাড়া তিন বছরের থাকা-খাওয়ার জন্যে একটা পয়সাও দিতে হবে না।

এই জাহাজের রয়েছে অনেক অংশীদার। প্রধান অংশীদার দুজন–ক্যাপটেন পেলেগ আর ক্যাপটেন বিলদাদ। এছাড়াও রয়েছে অনেক বিধবা, পিতৃহীন সন্তান, এমনকি চ্যান্সারি ওয়র্ড। কেউ হয়তো পাবে বড়সড় একটা তক্তার দাম, আবার কেউবা গোটা কয়েক পেরেকের। তবে এতে অবাক হবার কিছু নেই। আপনারা যেমন টাকা খাটান স্টক এক্সচেঞ্জে, ন্যানটাকেটাররা তেমনি জাহাজে। আবার মনে হলো ২৭৫ লের কথা, ভাগ্য ভাল থাকলে ২০০ লেও মিলে যেতে পারে।

বইয়ের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে করতেই ক্যাপটেন বিলদাদ বলল, বুঝেশুনে লে দিও, আমাদের রাজার ভাণ্ডার নেই। এই পৃথিবীতে—

বেশ, বাধা দিল পেলেগ, তা, ক্যাপটেন বিদাদ, এই ছেলেটাকে কত লে দিলে ঠিক হবে বলে মনে হয় তোমার?

সে তুমিই ভাল জানো, নিরুত্তাপ কণ্ঠে জবাব দিল বিলদাদ, ৭৭৭ লে খুব বেশি হবে না, কি বলো?

তুমি একটা যাচ্ছেতাই, বিলদাদ, চেঁচিয়ে উঠল পেলেগ, ছেলেটাকে ডোবাতে চাও? এর চেয়ে নিশ্চয় অনেক বেশি পাবে সে।

৭৭৭, চোখ না তুলেই বলল বিলদাদ।

আমি ওকে ৩০০ দিতে চাই। শুনতে পেয়েছ? ৩০০ লে।

ক্যাপটেন পেলেগ, মন তোমার খুবই দয়ালু। কিন্তু এভাবে বেশি দেয়ার অর্থ কি অনেক বিধবা, এতিমের রুটি-রুজিতে হস্তক্ষেপ করা নয়? সুতরাং ৭৭৭।

৭৭৭-এর নিকুচি করি, গর্জে উঠল ক্যাপটেন পেলেগ। এসব বিষয়ে তোমার কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু বিবেক বলেও একটা কথা আছে

এত বিবেকবান হলে জাহাজ তো লাটে উঠবে।

ক্যাপটেন বিলদাদ! তেড়ে গেল ক্যাপটেন পেলেগ। দ্রুত এক পাশে সরে তাকে এড়িয়ে গেল বিলদাদ।

শঙ্কিত হয়ে উঠলাম আমি। এও ভাবছিলাম, যে-জাহাজের অন্যতম প্রধান দুজনের মতের এত অমিল, সেটাতে যাওয়া আদৌ উচিত হবে কিনা ক্যাপটেন বিলদাদ পালিয়ে যেতে পারে মনে করে ইতিমধ্যে সরে দাঁড়িয়েছিলাম দরজার সামনে থেকে। কিন্তু আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বিলদাদ গিয়ে আবার বসল স্বস্থানে, পেলেগের এই রণমূর্তির সঙ্গে সে যেন খুব ভালভাবে পরিচিত ওদিকে পেলেগের হাবভাবে মনে হলো, দারুণ হম্বিতম্বি করার ফলে তার রগ মজুত নিঃশেষ হয়ে গেছে। বিলদাদের পাশে এসে বসল সে। সামান্য ইতস্তত করে বলল, ঝড়টা সরে গেছে মনে হয়। বিলদাদ, তুমি তো বর্শা-টর্শা খুব ভাল বার করো, আমার ছুরিটা একটু ধার করে দেবে? এই যে নাও, ধন্যবাদ আর, ইসমাইল, তোমার নাম তো ইসমাইল তাই না? তুমি যাচ্ছ আমাদের সঙ্গে হ্যাঁ, ৩০০ লে হিসেবে।

ক্যাপটেন পেলেগ, বললাম আমি, আমার এক বন্ধুও যেতে চায় হোয়েলিংয়ে আগামীকাল সকালে নিয়ে আসব ওকে?

নিশ্চয়। ওকে এক নজর দেখব আমরা।

সে আবার কত লে চায়? গুঙিয়ে উঠল বিলদাদ।

ওটা নিয়ে ভেব না, বিলদাদ, বলে আমার দিকে ঘুরল পেলেগ। তোমার বন্ধু কখনও হোয়েলিংয়ে গেছে?

শুধু যায়নি, অনেক তিমিও মেরেছে, ক্যাপটেন পেলেগ।

বেশ, নিয়ে এসো ওকে।

কাগজপাতি সই করে রওনা দিলাম আমি। এক সকালের হিসেবে যথেষ্ট কাজ করা হয়েছে। আমি আর কুইকেগ দুজনেই পেকোডে যেতে পারব, আর কি চাই!

কিন্তু বেশি দূর যেতে পারলাম না। যার নেতৃত্বে যাব, সেই ক্যাপটেনকেই যে এখনও দেখলাম না। অবশ্য এরকম প্রায়ই হয় যে ক্যাপটেন জাহাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করে একেবারে শেষ মুহূর্তে। কারণ, হোয়েলিং এত লম্বা সময় ধরে হয়, বন্দরে থাকাকালীন জাহাজের দিকে আর নজরই দেয় না ক্যাপটেন, ব্যস্ত থাকে পরিবার বা নিজস্ব কোন জরুরী কাজ নিয়ে। যাই হোক, যার হাতে নিজেকে ছেড়ে দেব, তাকে দেখার ইচ্ছে হওয়াটা স্বাভাবিক। ফিরে গিয়ে ক্যাপটেন পেলেগের কাছে জানতে চাইলাম, ক্যাপটেন আহাবকে কোথায় পাওয়া যাবে।

ক্যাপটেন আহাবের কাছে কি প্রয়োজন? তোমাকে তো নিয়েছি আমরা।

তা ঠিক, কিন্তু তাকে একবার দেখার ইচ্ছে হচ্ছে।

এখন তার দেখা পাবে বলে মনে হয় না। কি হয়েছে ঠিক জানি না আমি, কেবিন থেকে বেরোতেই চান না। এক ধরনের অসুখ বোধ হয়, কিন্তু অসুস্থও মনে হয় না। সত্যি বলতে কি, অসুস্থ তিনি নন, আবার সুস্থ বলাও সম্ভব নয়। এক অদ্ভুত মানুষ এই ক্যাপটেন আহাব–কেউ কেউ তাই ভাবে–তবে মানুষ তিনি ভাল। তোমার খুব পছন্দ হবে। না, না, ভয়ের কিছু নেই। তিনি এক অভিজাত, দেবতার মত মানুষ, অথচ ধার্মিক নন। বেশি কথা বলেন না, কিন্তু বললে তোমাকে শুনতে হবে। মনে রেখো, আহাব সাধারণের অনেক ওপরে। তিনি কলেজে পড়াশোনা করেছেন, গেছেন নরখাদকদের দেশে, মহাসাগরের ঢেউয়ের চেয়েও গভীর রহস্য দেখে তিনি অভ্যস্ত। তাঁর বর্শার নিশানা নির্ভুল। ক্যাপটেন বিলদাদ নন তিনি, ক্যাপটেন পেলেগও নন, তিনি হলেন আহাব। নিশ্চয় জানো, প্রাচীন কালে আহাব নামে এক রাজা ছিলেন!

খুব শয়তান ছিলেন সেই রাজা। মারা যাবার পর তো তার রক্ত কুকুরে চেটে চেটে খেয়েছিল, তাই না?

এসো, কাছে এসো, আরও কাছে, ক্যাপটেন পেলেগের সুরে এমন কিছু একটা ছিল যে রীতিমত চমকে গেলাম আমি। পেকোডে ওই কথা কখনও উচ্চারণ করবে না। অন্য কোন জায়গাতেও না। ক্যাপটেন আহাব তো আর নিজে রাখেননি তার নাম, রেখেছে তার অশিক্ষিত বিধবা মা। আহাবকে মাত্র বারো মাসের শিশু রেখে মহিলা মারা যায়। লোকে রটিয়েছে, আহাব ভবিষ্যতে কেমন হবেন বুঝতে পেরেই নাকি ওই রাজার নামে তার নাম রাখা হয়েছিল। আমি তোমাকে সাবধান করে দিতে চাই। কথাটা মিথ্যে। ক্যাপটেন আহাবকে আমি অত্যন্ত ভালভাবে চিনি। অনেক দিন আগে আমি তার সঙ্গে সাগরে গেছি মেট হিসেবে। আমি জানি, কখনোই তিনি খুব হাসিখুশি থাকেন না। বাড়ি ফেরার সময় কেমন যেন উদভ্রান্ত হয়ে যান, তবে সেটা তার হারানো পায়ের যন্ত্রণায়। আসলে গত অভিযানে পা-টা হারানোর পর তিনি কেমন যেন মেজাজী হয়ে গেছেন, হিংস্রও হয়ে ওঠেন কখনও কখনও। তবে মনে রেখো, রসিক বাজে ক্যাপটেনের চেয়ে মেজাজী ভাল ক্যাপটেনের নেতৃত্বে সাগরে যাওয়া ঢের ভাল। তাছাড়া তাঁর রয়েছে মিষ্টি চেহারার একটি বৌ। শুধু তা-ই নয়, সেই মেয়ের গর্ভে একটা সন্তানও হয়েছে বুড়োর। তাহলেই বুঝে দেখো, এরকম বৌ বাচ্চাঅলা একজন মানুষের পক্ষে কি চূড়ান্ত হিংস্রতা সম্ভব? না, না, ক্যাপটেন আহাবের নিশ্চয় মনুষ্যত্ব আছে!

ফিরতে লাগলাম চিন্তিত মন নিয়ে। অস্পষ্ট একটা দুঃখবোধ জাগল ক্যাপটেন আহাবের জন্যে। হয়তো তার হারানো পায়ের কথা ভেবে, ঠিক বুঝতে পারলাম না। এই দুঃখবোধ কিংবা সহানুভূতির পাশাপাশি কেমন যেন একটা সমও জাগল। সে এক অদ্ভুত সম্ভ্রম, অবর্ণনীয়, কেবল অনুভব করা যায়। তবে সে-সম্ভ্রম আমাকে ক্যাপটেন আহাবের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিল না, বরং আরও টানতে লাগল রহস্যের জাল বিছিয়ে। যাই হোক, অবশেষে আমার চিন্তাধারা গতিপথ পরিবর্তন করল, ধীরে ধীরে কোথায় যেন সরে গেল ক্যাপটেন আহাব।

১৭.

কুইকেগের রোজা বা উপোস যেহেতু সারা দিন চলবে, রাত নামার আগে ওকে বিরক্ত করব না বলে ঠিক করলাম। কারও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান যত হাস্যকরই হোক না কেন, সম্মানের চোখে দেখি আমি।

আমাদের, খ্রিস্টানদের, এসব ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো উচিত। অন্য ধর্মের লোকেরা তাদের আচার নিয়ে কিছুটা পাগলামি করে বলেই যে আমরা তাদের চেয়ে ভাল, এটা ভাবা ঠিক নয়। ওই যে কুইকেগ, ওর ইয়োজো আর রোজা নিয়ে পাগল হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাতে কি হয়েছে? কুইকেগ ওর ধর্ম নিয়ে তৃপ্ত, অন্য ধর্মের হাজার কিছু বলেও ওকে ওর বিশ্বাস থেকে নড়ানো যাবে না। সুতরাং ও থাকুক ওর ধর্ম নিয়ে। দয়াময় ঈশ্বর সব ধর্মের জন্যেই সদয় হন। কারণ, সবারই মাথার নাট-বল্ট ঢিলে হয়ে গেছে, সুচিকিৎসা প্রয়োজন।

সন্ধ্যার দিকে, ওর রোজা এতক্ষণে নিশ্চয় শেষ হয়ে গেছে ভেবে, ওপরতলায় গিয়ে ধাক্কা দিলাম দরজায়। কোন জবাব নেই। খোলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কুইকেগ, চাবির ফুটোয় মুখ লাগিয়ে নরম করে ডাকলাম। কুইকেগ, আমি ইসমাইল। কোন সাড়াশব্দ নেই। দীর্ঘ সময় ওকে একা রেখে গেছি, মৃগীতে আক্রান্ত হতে পারে। চাবির ফুটোয় চোখ লাগালাম। কিন্তু দরজাটার অবস্থান এত বিশ্রী, খাটের পায়ার দিক এবং খানিকটা দেয়াল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। তবে দেয়ালের গায়ে হারপুনের কাঠের হাতলটা হেলান দেয়া দেখে খুবই অবাক হলাম, হারপুন তো মহিলা নিয়ে নিয়েছিল গতকাল। যাই হোক, হারপুন যখন আছে, আশেপাশে কুইকেগও নিশ্চয় আছে।

কুইকেগ!–কুইকেগ!–এবারেও কোন সাড়াশব্দ নেই। নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে। দরজাটা ভাঙার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। নিচতলায় ছুটে গেলাম। একজন পরিচারিকার সঙ্গে দেখা হতে তাকেই খুলে বললাম ব্যাপারটা। চেঁচিয়ে উঠল সে, এরকমই কিছু একটা সন্দেহ করেছিলাম আমি। সকালে নাস্তার পর বিছানা গোছাতে গিয়ে দেখি, দরজা বন্ধ, ভেতরে কোন শব্দ নেই। এখন পর্যন্ত একই অবস্থা। ম্যাডাম! মিস্ট্রেস! খুন! মিসেস হাসি! মৃগী!–চিৎকার করতে করতে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল সে, পেছনে পেছনে আমি।

বেরিয়ে এল মিসেস হাসি। এক হাতে রাই-সরষের পাত্র, আরেক হাতে ভিনিগারের শিশি।

উড-হাউস থেকে দরজা ভাঙার মত কিছু একটা আনুন! কুড়াল! খালি হাতেই ওপরতলার দিকে ছুটলাম আমি।

কি ব্যাপার বলুন তো?

কুড়াল আনুন! আগে দরজা ভাঙি, ঈশ্বরের দোহাই, আপনারা ততক্ষণে ডাক্তার ডেকে আনুন!

আমার দরজা ভাঙবেন? ভিনিগারের শিশি নামিয়ে রেখে খপ করে আমার একটা হাত ধরে ফেলল মহিলা। কী ব্যাপার বলুন তো?

যথাসম্ভব ঠাণ্ডা মাথায়, সংক্ষেপে ঘটনাটা বললাম তাকে। আত্মহত্যা করেছে! চেঁচিয়ে উঠল মহিলা। আবার সেই ঘটনা ঘটল! হায় হায় রে, আমার সরাইখানার সর্বনাশ করেছে! এখনই একজন পেইন্টার ডেকে আনো কেউ, সাইনবোর্ড লিখে দিয়ে যাক–আত্মহত্যা-প্রবণদের প্রবেশ নিষেধ, গাড়িবারান্দায় ধূমপান নিষিদ্ধ।

দরজা ভাঙতে যেতেই ছুটে এসে আমাকে বাধা দিল মহিলা।

না। সরাইখানার সর্বনাশ আমি করতে দেব না। মাইলখানেক দূরে এক মিস্ত্রি আছে, তালা খুলতে হলে তাকে ডেকে আনুন। থামুন! আমার কাছে একটা চাবি আছে, এখানে লাগবে মনে হয়। চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিল মহিলা, কিন্তু দরজা খোলার কোন নাম নেই।

ভাঙতে হবে, পেছনে সরে গেলাম আমি। হাত চেপে ধরে আবার বাধা দিল মহিলা। কিন্তু কোন বাধা মানলাম না, সোজা ছুটে গিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা দিলাম সর্বশক্তি দিয়ে।

সশব্দে খুলে গেল দরজা, প্লাস্টারের কণা ছুটে গেল চারদিকে। ঘরের ঠিক মাঝখানে মাথায় ইয়োজোর মূর্তিটা রেখে, উবু হয়ে বসে আছে পাথরের মত নিশ্চল কুইকেগ।

কুইকেগ, কাছে গিয়ে বললাম আমি, এসব কি হচ্ছে?

উনি কি সারা দিন এইভাবে বসে আছেন? অবাক হলো মহিলা।

কিন্তু কুইকেগের মুখ থেকে কোন কথা বের করা গেল না। একবার মনে হলো, অবস্থান বদল করানোর জন্যে ওকে ধাক্কিয়ে ফেলে দিই। এভাবে একনাগাড়ে আট, দশ ঘণ্টা কি মানুষ বসে থাকতে পারে! পেটেও তো কিছু পড়েনি।

মিসেস হাসি, বললাম আমি, বুঝতেই পারছেন, ও বেঁচে আছে। দয়া করে যান, ব্যাপারটা আমি দেখছি।

মহিলা চলে যাবার পর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে কুইকেগকে একটা চেয়ারে বসাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। কোন কথাও বলল না ও, এমনকি আমার দিকে তাকাল না পর্যন্ত।

ভেবে অবাক হলাম, এটাই কি ওদের রমজানের রীতি? উপোসের সময়টা কি ওরা এভাবেই বসে থাকে? তাহলে থাকুক, সময় পেরিয়ে গেলেই অবস্থান বদলাবে। ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ, ওদের রমজান বছরে মাত্র একদিনের জন্যে আসে।

খেতে গেলাম নিচে। সদ্য তীরে আসা কিছু নাবিক জুড়ে দিয়েছে তাদের অভিযানের গল্প। প্রায় এগারোটা পর্যন্ত সে-গল্প শুনে উঠলাম আমি। ওপরে যেতে যেতে ভাবলাম, এতক্ষণে নিশ্চয় কুইকেগের উপবাস শেষ হয়েছে। কিন্তু না। যেভাবে দেখে গিয়েছিলাম, অবিকল সেভাবেই আছে, এক ইঞ্চিও নড়েনি ও। বেশ বিরক্তই লাগল এবার, একটা কাঠের টুকরো মাথায় নিয়ে সারা দিন এভাবে ঠায় বসে থাকার কোন মানে হয়!

ঈশ্বরের দোহাই, কুইকেগ, উঠে কিছু মুখে দাও, অনাহারে তো মারা পড়বে। কিন্তু কুইকেগ ঠোঁটও নাড়াল না।

ওর ব্যাপারে হতাশ হয়ে ঘুমাব বলে ঠিক করলাম। মোমবাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ দুচোখের পাতা এক করতে পারলাম না। মাত্র চার ফুট দূরে অনাহারী একজন লোক সারা দিন ধরে বসে আছে অতি কষ্টকর এক আসনে, এটা জানলে কি ঘুম আসা সম্ভব!

তবু ঘুম এল। সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি, তখনও একইভাবে বসে আছে কুইকেগ, কেউ যেন মেঝের সঙ্গে ওকে সেঁটে দিয়েছে ভ্রু দিয়ে। কিন্তু সূর্যের প্রথম রশ্মি জানালা দিয়ে ঢুকতেই উঠে পড়ল ও। ওর অনাহারক্লিষ্ট মুখে ঝলমল করছে অদ্ভুত এক আনন্দ। সারা দিন সারা রাত অনড় বসে থাকায় খিল ধরা পায়ে কিছুক্ষণ খোঁড়াল কুইকেগ, তারপর আমার কপালে কপাল ঠেকিয়ে জানাল যে ওর রমজান শেষ হয়েছে।

বিছানা ছেড়ে কাপড় পরলাম আমি। উপপাসের সময় মিসেস হাসির যে-ক্ষতি হয়েছে, সবরকম চাউডারের কয়েকটা বাটি খেয়ে তা পুষিয়ে দিল কুইকেগ। অবশেষে হ্যালিব্যাটের কাটায় দাঁত খুঁটতে খুঁটতে পেকোডে যাবার জন্যে বন্দরের উদ্দেশে রওনা দিলাম আমরা।

১৮.

জাহাজের কাছে যেতেই তাবু থেকে বের হয়ে ক্যাপটেন পেলেগ বলল, কগজপত্র

দেখালে কোন নরখাদককে জাহাজে উঠতে দেবে না সে।

কিসের কাগজ, ক্যাপটেন পেলেগ? জানতে চাইলাম আমি।

মানে আমি বলতে চাইছি, জবাব দিল সে, ওকে কাগজ দেখাতে হবে।

হ্যাঁ, ও যে ধর্মান্তরিত হয়েছে তার কাগজ, বলল ক্যাপটেন বিলদাদ।

কুইকে তো ফার্স্ট কংগ্রিগেশনাল চার্চের সদস্য।

মানে তুমি বলতে চাও, কোলম্যানের মীটিং হাউসের?

অতশত জানি না। ফাস্ট কংগ্রিগেশনাল চার্চের সদস্য–ব্যস।

ভাঁওতাবাজি ছাড়ো! চেঁচিয়ে উঠল ক্যাপটেন বিলদাদ, ওখানে ওকে একদিনও দেখিনি। ঠিক করে বলল, কোন চার্চ?

ফার্স্ট কংগ্রিগেশনাল চার্চ বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি আদি ক্যাথলিক চার্চকে, যেখানে সব ধর্মের লোকই ছিল সমান।

বেশ, বেশ, মাঝখান থেকে বলে উঠল ক্যাপটেন পেলেগ, তোমার কুয়োহগ না কি নাম যেন, ওকে জাহাজে আসতে বলো। হাতে তো বিরাট একখানা হারপুন দেখছি। তা, কুয়োহগ, হোয়েল-বোটের মাথায় উঠেছ কখনও? গেঁথেছ কোন মাছকে?।

এক লাফে বুলওয়ার্কে উঠল কুইকেগ, আরেক লাফে গিয়ে পড়ল পাশে বাঁধা একটা হোয়েল-বোটের ওপর। চেঁচিয়ে বলল, ওই যে আলকাতরার ফোঁটাটা দেখা যাচ্ছে, ওটা তিমির চোখ। ক্যাপটেন বিলদাদের কাঁধের ওপর দিয়ে ছুটে গেল হারপুন, ডেক পেরিয়ে অদৃশ্য করে দিল আলকাতরার ফোটা।

ওই যে, হেসে উঠল কুইকেগ, তিমি মারা গেছে।

বিলদাদ, তাড়াতাড়ি কাগজপত্র নিয়ে এসো, বলল ক্যাপটেন পেলেগ, এই কুয়োহগকে আমাদের জাহাজে নিতেই হবে। আমরা ওকে ৯০ লে দেব। আজ পর্যন্ত ন্যানটাকেটের বাইরের কোনও হারপুনার এত পায়নি।

দুই ক্যাপটেনের সঙ্গে কেবিনে গেলাম আমরা। কুইকেগের কাগজ তৈরি হতে বেশি দেরি লাগল না।

১৯.

তোমরা কি এই জাহাজে যাচ্ছ?

পেকোড থেকে নেমে পথ চলতে শুরু করেছি আমি আর কুইকেগ, হঠাৎ এক অপরিচিত লোক আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিল প্রশ্ন। পরনে রঙ-জ্বলা জ্যাকেট আর ট্রাউজারস, সারা মুখে বসন্তের দাগ।

তোমরা এই জাহাজে যাচ্ছ? আবার প্রশ্ন করল সে।

মানে, তুমি পেকোডের কথা বলছ? তাকে ভাল করে এক নজর দেখার জন্যে বললাম আমি।

হ্যাঁ, পেকোড।

হ্যাঁ, এইমাত্র কাগজপাতি সই করে এলাম।

ওখানকার কিছু মনে ধরেছে?

কি মনে ধরবে?

যাক গে, তোমাদের হয়তো ওই জিনিসটাই নেই। অনেকেরই থাকে না। না থাকাই ভাল। মন হলো কোন গাড়ির পঞ্চম চাকার মত।

কি আজেবাজে বকছ? বললাম আমি।

তার রয়েছে বিরাট মন।

কুইকেগ, চলো। এই লোক সম্ভবত পাগলাগারদ থেকে এসেছে। এমন কারও কথা সে বলছে, যাকে আমরা চিনি না।

ঠিক! বলল আগন্তুক, পুরানো বজ্রকে তোমরা এখনও দেখোনি।

পুরানো বজ্রটা কে?

ক্যাপটেন আহাব।

মানে, আমাদের পেকোডের ক্যাপটেন?

আমাদের বুড়ো নাবিকদের অনেকেই তাকে ওই নামে ডাকে। তোমরা এখনও তাকে দেখোনি, তাই না?

না, দেখিনি। সে নাকি অসুস্থ, তবে শিগগিরই ভাল হয়ে যাবে।

ভাল হয়ে যাবে! হেসে উঠল আগন্তুক। ক্যাপটেন আহাব যদি ভাল হয়, আমার বাম হাতটাও ভাল হয়ে যাবে।

তার সম্বন্ধে কতটুকু জানো তুমি?

তার আগে বলো, ওরা তোমাদের কতটা জানিয়েছে।

এমন কিছু নয়। কেবল শুনলাম সে একজন ভাল তিমি শিকারী আর ভাল ক্যাপটেন।

সত্যি, দুটো কথাই সত্যি। তবে এটা নিশ্চয় বলেনি যে কয়েক বছর আগে কেপ হর্নে ক্যাপটেন আহাব তিন দিন তিন রাত পড়েছিল মরার মত; বলেছে সান্তার বেদীর সামনে স্প্যানিয়ার্ডদের সঙ্গে ভয়াবহ সেই সঙ্ঘর্ষের কথা? জানেনা, রূপালী লাউয়ের খোলে তার থুতু ফেলার কথা? ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে গত অভিযানে তার পা হারানোর কথা? এসব কিছুই শোনোনি। কিছুই জানো না। জানবেই বা কিভাবে, ন্যানটাকেটের কেউই জানে না। তবে পা হারানোর কথাটা খুব সম্ভব শুনেছ। এটা অনেকেই জানে যে ক্যাপটেন আহাবের একটা মাত্র পা, অন্য পা-টা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে প্রকাণ্ড এক স্পার্ম তিমি।

শোনো, বললাম আমি, যেসব নিয়ে এতক্ষণ বকবক করলে, সেসবের কিছুই আমি জানি না, আর জানবার ইচ্ছেও নেই। যতদূর মনে হচ্ছে, তোমার মাথার বেশ কয়েকটা নাট-বল্ট ঢিলে হয়ে গেছে।

পেকোডের দিকে আঙুল তুলে কয়েক মুহূর্ত কি এক সুখস্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়ে রইল ভিখিরি চেহারার আগন্তুক। তারপর সামান্য চমকে উঠে, ঘুরে বলল, কাগজপাতি সই করা হয়ে গেছে, তাই না? বেশ, বেশ, যা সই হয়ে গেছে, হয়ে গেছে; যা হয়নি, তা হবে; হয়তো শেষমেশ হবেও না। নিশ্চয় অনেক নাবিক যাবে এবার, ঈশ্বর তাদের করুণা করুন! ঈশ্বরের আশীর্বাদ তোমাদের ওপর বর্ষিত হোক। তোমাদের দেরি করিয়ে দেয়ার জন্যে দুঃখিত।

দেখো, বললাম আমি, যদি বলার মত কিছু থাকে, তাহলে বলে ফেলো। ধােকা দেয়ার চেষ্টা করে কোন লাভ হবে না।

তোমার কথা বলার ধরন খুব ভাল লাগল। এরকম স্পষ্ট কথা বলতে পারে, এমন কারও পেকোডে যাওয়া উচিত। জাহাজে ওঠার পর সবাইকে জানিয়ে দিয়ো, আমি ওদের সঙ্গে এবার অভিযানে নাযাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

তা, তোমার নামটা কি? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

এলিজা।

এলিজা! হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম আমি। আমরা দুজনেই যে যার মত মন্তব্য করছিলাম লোকটা সম্বন্ধে। একসময় আমরা একমত হলাম, লোকটা একটা প্রতারক, আমাদের ভয় দেখাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুদূর এগোবার পর একটা বাঁক ঘুরতে গিয়ে দেখি, অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে পেছনে পেছনে আসছে এলিজা। কুইকেগকে এ-ব্যাপারে কিছুই জানালাম না। দেখা যাক, লোকটা একই বাঁক নেয় কিনা। নিল। ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম। লোকটা আমাদের অনুসরণ করছে, কিন্তু অনেক ভেবেও অনুসরণের কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। তার বলা রহস্যময় কথাগুলো মনে পড়ে গেল একে একে। কেপ হর্নে ক্যাপটেন আহাবের দীর্ঘ অচেতনতা, রূপালী লাউয়ের খোল, স্প্যানিয়ার্ডদের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষ–গতকাল বলা ক্যাপটেন পেলেগের কথাগুলোও মনে পড়ল।

পরীক্ষা করে দেখতে হবে, এলিজা সত্যিই অনুসরণ করছে কিনা। রাস্তা পেরিয়ে হাঁটতে লাগলাম উল্টোদিকে। পাশ কাটিয়ে চলে গেল এলিজা, আমাদের লক্ষ করেছে বলে মনে হলো না। বুকের ওপর থেকে যেন পাথর নেমে গেল। এলিজা সত্যিই একটা প্রতারক, ভাবলাম আবার।

২০.

দিন দুয়েকের মধ্যেই সাড়া পড়ে গেল পেকোডে। পুরানো পাল মেরামত করা হলো, নতুন পাল এল, এল ক্যানভাস, দড়াদড়ি। ক্যাপটেন পেলেগ তাবু ছেড়ে বেরোয় না বললেই চলে, কর্মচারীদের ওপর তার তীক্ষ্ণ নজর। ওদিকে ক্যাপটেন বিলদাদ ব্যস্ত ভাড়ারের জিনিসপত্র কেনা নিয়ে।

কুইকেগের কাগজ সই করার পর দিন সরাইখানায় নাবিকরা বলাবলি করতে লাগল, যার যার সিন্দুক আজরাতের মধ্যেই তুলে ফেলতে হবে জাহাজে। জাহাজ ছাড়তে নাকি আর বেশি দেরি নেই। অবশ্য এসব জাহাজ ছাড়বে ছাড়বে করেও দিনের পর দিন পার করে দেয়। তবে এই দেরি ইচেছকৃত নয়। দূর সাগরে দীর্ঘ অভিযানের জন্য কত জিনিস যে লাগে।

শুধু বসবাসের জন্যেই লাগে বিছানা, সসপ্যান, ছুরি, কাঁটাচামচ, বেলচা, চিমটে, গামছা, আঁতিসহ আরও নানা টুকিটাকি। এছাড়াও রয়েছে হোয়েলিংয়ের একশো এক রকম জিনিস। শেষ সময়েও দেখা যায় প্রয়োজনীয় কোন জিনিস সঙ্গে নেয়া হয়নি। মহাসাগরে নেই কোন মনোহারী দোকান, ব্যাঙ্কার, ডাক্তার বা রুটিঅলা। তাই সাথে নিতে হয় বাড়তি জিনিস। বাড়তি নৌকো, বাড়তি কাষ্ঠদণ্ড, বাড়তি রশি, বাড়তি হারপুন, বাড়তি আরও অনেক কিছু–কেবল বাড়তি ক্যাপটেন আর বাড়তি জাহাজ নেয়া অসম্ভব।

আমরা ন্যানটাকেটে আসার সময়েই পেকোডে ভাড়ারের জিনিস নেয়া প্রায় শেষ হয়েছিল। কিন্তু শুধু গরুর মাংস, পাঁউরুটি, পানি, জ্বালানি, লোহার আঙটা, পেরেক নিলেই তো চলবে না, জাহাজে লাগে নির্দিষ্ট জিনিসের বাইরে ছোট বড় আরও অনেক কিছু।

যেখানে যেটা প্রয়োজন সেটার দিকে নজর রাখতে ক্যাপটেন বিলদাদের বৃদ্ধা বোনের কোন জুড়ি নেই। এখনই হয়তো তাকে দেখা যাবে স্টুয়ার্ডের জন্যে এক বয়াম আচার হাতে, আবার একটু পরেই হয়তো পালকের কলম নিয়ে যেতে দেখা যাবে চীফ মেটের ডেস্কের জন্যে। এমনকি পিঠে বাত হয়েছে, এমন কারও জন্যে পশমি কাপড় নিতেও ভুল হয় না বুড়ির। পেকোডের সবাই অযথাই তাকে আন্ট চ্যারিটি বলে ডাকে না। প্রিয় ভাইটির সাহায্যে লাগে, এমন কাজ করতে কোন ক্লান্তি নেই আন্ট চ্যারিটির। বোনের জন্যে ক্যাপটেন বিলদাদ খুবই উপকৃত হয়, আর এই উপকার করার ফলে বোনের হাতে আসে দশ বিশটা ডলার।

গতকালই তো এক হাতে একটা তেল তোলার হাতা, আরেক হাতে একটা তিমি মারার বর্শা নিয়ে কী ব্যস্তই না ছিল বুড়ি। ক্যাপটেন পেলেগও তাঁবুর ভেতর–বার করছিল নাবিকদের গালি দিতে দিতে।

প্রস্তুতির এই দিনগুলোতে আমি আর কুইকেগ প্রত্যেকদিন আসি আর জানতে চাই ক্যাপটেন আহাবের সংবাদ। বার বার শুনি একই জবাব–ক্রমেই আরোগ্য লাভ করছে ক্যাপটেন, যে-কোন দিন এসে উপস্থিত হবে ডেকে। এখন ভাবলে অবাক লাগে, যে-মানুষ খোলা সাগরে জাহাজের একনায়ক বিশেষ, তাকে এক নজরও না দেখে আমি পেকোডে যেতে রাজি হয়েছিলাম কীভাবে। আসলে মানুষ যখন ভুল করেছে বলে সন্দেহ করে, তখন ভুলটা চাপা দেয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সেসময় ক্যাপটেন আহাব সম্বন্ধে আমার প্রশ্নগুলো ছিল নিছক প্রশ্নই, গভীরভাবে মাথা ঘামাবার চেষ্টা করিনি।

অবশেষে একদিন ঘোষণা দেয়া হলো, আগামীকাল কোন এক সময়ে জাহাজ অবশ্যই ছাড়বে। সুতরাং পরদিন বেশ সকাল সকালই রওনা দিলাম আমি আর কুইকেগ।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত