মবি ডিক : হারমান মেলভিল
অনুবাদ/রূপান্তর : খসরু চৌধুরী
তিমি শিকারে যাবে বলে ন্যানটাকেট বন্দরে এল ইসমাইল, পরিচয় হল বর্বর, নরখাদক কুইকেগের সাথে। জাহাজে নাম লেখালো ওরা, একদিন রওনা হয়ে গেল সাগরে। তখন কি ওরা জানত, সাধারণ তিমি নয়, পেকোডের ক্যাপ্টেন শিকার করতে চান মবি ডিক নামের ভয়ঙ্কর এক সাদা তিমি? আসুন, পাঠক, আমরাও রহস্যময় বিশাল সাগরে ইসমাইলের সঙ্গী হই, নৌকা নামিয়ে ধাওয়া করি তিমির পিছে!
————-
০১-১০. আমাকে আপনারা ইসমাইল বলেই ডাকুন
০১.
আমাকে আপনারা ইসমাইল বলেই ডাকুন। পেশায় আমি নাবিক, সমুদ্র আমার ধ্যান-জ্ঞান। সাগরের বিশাল ব্যাপ্তি, অতুল গাম্ভীর্য আর গভীর রহস্যময়তা আমাকে অমোঘ আকর্ষণে টানে, ডাকে হাতছানিতে।
আমি যাত্রী হিসেবে সাগরে কখনও যাইনি। কারণ, যাত্রী হতে গেলে তার কাছে মানিব্যাগ থাকতে হবে, অবশ্য ভেতরে টাকা না থাকলে মানিব্যাগও যা ন্যাকড়াও তা। তাছাড়া যাত্রীরা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে, ঝগড়া করে নিজেদের মধ্যে, রাতে ভাল ঘুম হয় না–মোট কথা, সাগর ভ্রমণ কিভাবে উপভোগ করতে হয়, সে-বিষয়ে তাদের তেমন একটা জ্ঞান নেই। কমোডর কিংবা ক্যাপটেন হয়েও আমি সাগরে যাইনি কখনও। পাচক হিসেবেও নয়। অবশ্য পাচকের কাজের মধ্যে অবমাননাকর কিছুই নেই, জাহাজে সে প্রায় একজন অফিসারের মতই। যদি মুরগির ঝোলের সঙ্গে চমৎকারভাবে মেশাতে জানে মাখন, লবণ আর ঝাল, মানুষ তাকে সম্মানের চোখেই দেখে। প্রাচীন মিশরে যে-পাচক আইবিসের জন্ন্য ভাল ঝোল বা জলহস্তীর রোস্ট করতে পারত, মিশরীয়রা তাকে পূজা করত। তবু কেন যেন ঝোল রান্না করার ইচ্ছে আমার কোনদিনই হয়নি।
আমি সাগরে যাই সাধারণ নাবিক হিসেবে। কখনও দাঁড়িয়ে থাকি মাস্তুলের সামনে, কখনও নেমে যাই ফোরক্যাসলে, আবার কখনও উঠি মাস্তুলের মাথায়। এটা সত্যি যে কখনও কখনও আমাকে অন্যের আদেশ পালন করতে হয়। লাফাতে হয় এক কাষ্ঠদণ্ড থেকে আরেক কাষ্ঠদণ্ডে, ঠিক যেমন মে মাসে তৃণভূমিতে লাফায় ঘাসফড়িং। প্রথম প্রথম এসব সত্যিই খুব খারাপ লাগত। সব মানুষেরই লাগার কথা, বিশেষ করে সে যদি আসে সম্রান্ত কোন পরিবার থেকে। আপনি যদি হন কোন গ্রামের স্কুলমাস্টার, তাহলেও এসব আদেশ হজম করা কঠিন হবে আপনার পক্ষে। স্কুলের সবচেয়ে লম্বা, ষণ্ডা মার্কা ছেলেটাকেও যিনি দাঁড় করিয়ে রাখতে অভ্যস্ত, তার জন্যে অন্যের আদেশ পালন করা খুব সহজ ব্যাপার নয়।
আমি যদি কোন বুড়ো ক্যাপটেনের কথামত ডেক ঝাড় দিই, কী ক্ষতি হয় তাতে? আপনি কি মনে করেন, আদেশ পালন করতে আমার যেরকম মনোভাব হয়, স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের অনুভব তার চেয়ে খুব বেশি কিছু আলাদা ছিল? পৃথিবীতে কে ক্রীতদাস নয়? বলুন আমাকে। বুড়ো ক্যাপটেন আমার ওপর আঙুল নাচায় সত্যি, কিন্তু তারও রয়েছে আঙুল নাচানোর লোক।
নাবিক হিসেবে সাগরে যাবার আরও একটা কারণ আছে আমার। আদেশ পালন করতে গিয়ে যে-কষ্ট হয়, তার বিনিময়ে টাকা পাই আমি। কিন্তু যাত্রীদের একটা পয়সা দেয়ার কথাও আমি শুনিনি কখনও, বরং যাত্রীরাই জাহাজে চড়ার জন্য টাকা দেয়। এখানেই পৃথিবীর যাবতীয় পার্থক্য–কেউ দেয় আর কেউ নেয়। কাউকে টাকা দেয়াটাই বোধহয় মানুষের জন্যে সবচেয়ে অস্বস্তিকর কাজ। কিন্তু নেয়াটা, একে কীসের সঙ্গে তুলনা করা যায়? টাকা নেয়ার সময় মানুষের ভাব যেমন গদগদ হয়ে ওঠে, তা সত্যিই অপূর্ব!
নাবিক হিসেবে সাগরে যাবার আরও একটা কারণ আছে আমার। চমৎকার ব্যায়াম হয়, ফোরক্যাসল ডেকে দাঁড়িয়ে পাওয়া যায় খাটি বাতাস। কোয়ার্টার ডেক থেকে কমোডর যদিও মনে করে যে বাতাস প্রথমে সে-ই পাচ্ছে, আসলে তা নয়। সে পায় আমাদের গায়ে পরশ বুলিয়ে যাওয়া পুরানো বাতাস। এভাবেই সাধারণ মানুষ অনেক সময় সন্দেহ না জাগিয়ে নেতৃত্ব করে নেতাদের ওপর। যাই হোক, ব্যবসায়ীদের জাহাজে অনেক বার গেছি বলে ঠিক করলাম, এবার সাগরে যাব তিমি শিকারীদের সঙ্গে।
জানি না, এত পথ থাকতে নিয়তি আমাকে এ-পথে দাঁড় করাচ্ছে কেন। প্রকাণ্ড এই রঙ্গমঞ্চে মানুষের কত রকমারি ভূমিকা! কেউ অসাধারণ অভিনয় করছে বিয়োগান্ত নাটকে, কেউ অপেক্ষকৃত সহজ অভিনয় করছে মিলনান্তক নাটকে, আবার কেউ স্রেফ মজা পাবার জন্যে অভিনয় করছে প্রহসনে। কিন্তু আমিও তো একজন বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, আমিই বা কেন নিজেকে ঠেলে দিচ্ছি এই তিমি শিকার অভিযানে?
প্রধান কারণ তিমি নিজেই। আকর্ষণীয়, রহস্যময় প্রাণীটা আমার যাবতীয় কৌতুহল জাগিয়ে তুলেছে। বন্য, দূর সমুদ্রে ওরা ঘুরে বেড়ায় দ্বীপের মত শরীর নিয়ে। অন্য মানুষের হয়তো এমন মনে হবে না, কিন্তু দূরের প্রতি আমার আকর্ষণ চিরকালের। আমি ভালবাসি নিষিদ্ধ সাগরে যেতে, নামতে ভালবাসি বর্বরদের দেশে। হয়তো ভাবছেন, তাহলে কি বর্বরদের ভয় পাই না আমি? নিশ্চয় পাই, আর দশটা মানুষের মত আমারও রয়েছে আতঙ্কের বোধ। তবে কিনা আমি মিশতে পারি বর্বরদের সঙ্গেও, একবার ওদের দেশে নেমে পড়লে মেশার চেষ্টা করাই ভাল।
সুতরাং সব দিক ভেবে তিমি শিকার অভিযানে যাওয়াই ঠিক করলাম। খুলে গেল আশ্চর্য এক জগতের দরজা, অন্তরের গভীর সাগরে সারি বেঁধে ভেসে আসতে লাগল তিমির পর তিমি, মাঝখানে ভৌতিক একটা পূর্ণ অবয়ব–বাতাসে ঝুলে থাকা বরফ পাহাড়ের মত।
০২.
পুরানো কার্পেট-ব্যাগে গোটা দুই জামা ঢুকিয়ে, ব্যাগটা বগলের নিচে গুঁজে কেপ হর্ন আর প্রশান্ত মহাসাগরের উদ্দেশে রওনা দিলাম আমি। ডিসেম্বরের এক শনিবার পৌঁছুলাম নিউ বেডফোর্ড। কিন্তু শুনে খুবই হতাশ হয়ে পড়লাম যে ন্যানটাকেটগামী ছোট্ট জাহাজটা ছেড়ে গেছে ইতিমধ্যে। আগামী সোমবারের আগে সেখানে যাবার আর কোন উপায় নেই।
বেশির ভাগ তরুণ এই নিউ বেডফোর্ডে বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়ে তিমি শিকার অভিযানে, কিন্তু আমার তা জানা ছিল না। ন্যানটাকেটগামী জাহাজে উঠে পড়ার কথা ছাড়া আর কিছু আমি ভাবতে পারিনি। পুরানো ওই বিখ্যাত দ্বীপটার প্রাণচাঞ্চল্য আমাকে আকর্ষণ করে। তিমি ব্যবসার দিক থেকে নিউ বেডফোর্ডের তুলনায় ন্যানটাকেট যদিও এখন অনেক পিছিয়ে আছে, তবু ন্যানটাকেট ন্যানটাকেটই। আমেরিকার মধ্যে এখানেই প্রথম একটা তিমি আটকা পড়েছিল চড়ায়, এখানেই একটা জাহাজ নুড়ি পাথরে বোঝাই করা হয়েছিল তিমির গায়ে ছোড়ার জন্যে–এমনি আরও অনেক গল্প আছে ন্যানটাকেটকে ঘিরে।
একটা রাত, একটা দিন এবং আরও একটা রাত আমাকে থাকতে হবে নিউ বেডফোর্ডে। কিন্তু এই সময়টা আমি কাটাব কোথায়? খাবই বা কি? নিরানন্দ, বিশ্রী রাতটা তার ঠাণ্ডা বাহুতে জড়িয়ে নিতে চাইল আমাকে। এখানে কাউকে চিনি না আমি। উদ্বিগ্ন হয়ে হাত ঢোকালাম পকেটে, বেরিয়ে এল কয়েকটা রৌপ্য মুদ্রা। ব্যাগ কাঁধে নির্জন এক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে উত্তরের আঁধারকে আমি তুলনা করে দেখতে লাগলাম দক্ষিণের সঙ্গে। নিজেকে বললাম, ইসমাইল, আজ রাতে যেখানেই শোয়ার বন্দোবস্ত করো না কেন, সেখানে ঢোকার আগে ভাড়াটা একবার জিজ্ঞেস করে নিও।
ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম। চোখে পড়ল দ্য ক্রস্ড্ হারপুনস্-এর সাইনবোর্ড, কিন্তু জায়গাটাকে খুব বেশি ব্যয়বহুল মনে হলো। খানিক পর দেখলাম, লাল জানালা দিয়ে সোর্ড ফিশ ইন-এর আলো এসে পড়েছে রাস্তায়, মনে হচ্ছে সে-আলোতে পুরু বরফ গলে গিয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে মোহময় এক দৃশ্য। কিন্তু এই সরাইখানাটাকেও মনে হলো বেশ দামী। কান পাতলাম, ভেতর থেকে ভেসে আসছে গ্লাসের টুং টাং শব্দ। এগোও, ইসমাইল, এগোও, শুনতে পাচ্ছ না? এ-জায়গা তোমার জন্যে নয়। অগত্যা প্রায় বারোটা বেজে যাওয়া বুটের তলায় আটকানো বরফ ঝেড়ে পা বাড়ালাম। নিজের অজান্তেই পানির প্রান্তে গেছে এমন সব রাস্তা ধরে এগোলাম। তীরের সরাইখানাগুলো এতটা আনন্দদায়ক না হলেও সস্তা নিশ্চয়ই হবে।
কী নির্জন সব রাস্তা! গোরস্থানের মত এখানে-সেখানে দেখা যাচ্ছে দুএকটা মোমবাতি। শহরের এই অংশে জনমানুষের চিহ্নও নেই। হঠাৎ চোখে পড়ল চওড়া, নিচু একটা বিল্ডিং। ধোয়ার মত একটা আলো সেখানে, খোলা দরজাগুলো যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। বিল্ডিংটায় যত্নের কোন চিহ্ন নেই, সম্ভবত এখানে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার অবাধ। ঢুকতে গিয়েই ছাইয়ের একটা বাক্সে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম আমি, মেঘের মত চারপাশে উড়তে লাগল ছাই। ভেতর থেকে ভেসে এল মোটা একটা স্বর। উঠে ছাই ঝেড়েঝুড়ে আরেকটা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
একশো একটা কালো মুখ চেয়ে রয়েছে আমার দিকে, তাদের সামনে বিশালদেহী এক লোক মোটা একটা বই হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুলপিটে। সরাইখানা ভেবে নিগ্রোদের একটা গির্জায় ঢুকে পড়েছি আমি।
এগোতে এগোতে এবার বন্দরের প্রায় কাছে এসে চোখে পড়ল একটা সাইনবোর্ড। সাদা হরফে লেখা রয়েছে–দ্য স্পাউটার ইন-পিটার কফিন।
কফিন? স্পাউটার? গাঢ় অন্ধকার এই রাতে কেমন যেন অশুভ ঠেকল নামগুলো। কিন্তু ন্যানটাকেটে এই ধরনের নাম অহরহই দেখা যায়। মালিক ওই পিটার খুব সম্ভব অন্য জায়গা থেকে এসে আস্তানা গেড়েছে এখানে। স্বল্পালোকিত কাঠের ঘরগুলো দেখলে মনে হয়, পুরো সরাইখানাটাকেই বুঝি তুলে আনা হয়েছে অন্য কোন দেশ থেকে। সাইনবোর্ডটার অবস্থাও খুব খারাপ। তবে আমি যা খুঁজছিলাম পেয়ে গেছি। নিশ্চয় এখানে সস্তায় থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম বেশ কয়েক মিনিট, রাজ্যের চিন্তা ভিড় করল মাথায়। তারপর সমস্ত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বুটের তলা থেকে বরফ পরিষ্কার করতে লাগলাম। দেখা যাক, এই স্পাউটার জায়গাটা কেমন।
০৩.
সরাইখানার প্রথম ঘরটার এক পাশের দেয়ালে প্রকাণ্ড এক অয়েল-পেইন্টিং। কিন্তু নানারকম ময়লা আর বছরের পর বছরের সঞ্চিত ধুলোয় সেটার এমন অবস্থা যে বোঝা কঠিন, কীসের ছবি ওটা। তবে খুব ধৈর্য ধরে লক্ষ করলে বোঝা যায়, শিল্পী একেছেন মাঝরাতের ঝড়ে উথাল-পাতাল কৃষ্ণসাগর। আরেক পাশের দেয়ালে ঝুলছে বিশাল সব গদা আর বর্শা।
অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটা পেরিয়ে এগোতেই পাবলিক রূম। মাথার ওপরে কাঠের কড়ি, পায়ের নিচে কাঠের জীর্ণ পাটাতন। পাবলিক রূমটার এক প্রান্তে একটা গুহামত জায়গা–সরাইখানার বার। বারটা তৈরি করা হয়েছে রাইট হোয়েলের মাথার অনুকরণে। অনুকরণটা যদিও অক্ষম; বারে রাখা আছে একটা তিমির চোয়াল, ওটার ভেতর দিয়ে অনায়াসেই যাতায়াত করতে পারবে একটা বাস।
ধুলোভরা পুরানো সব তাকে সাজানো পুরানো ডিক্যান্টার, বোতল আর ফ্লাস্ক। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে এক বুড়ো, টাকার বিনিময়ে বিক্রি করছে ঘোর আর মৃত্যু মদ এখানে খুবই সস্তা, মাত্র এক শিলিংয়ে পাওয়া যায় পুরো এক গ্লাস।
অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা টেবিল ঘিরে বসে রয়েছে কয়েকজন নাবিক। সরাইখানার মালিককে খুঁজে বের করে বললাম, রাতে থাকার জন্যে আমার একখানা ঘর চাই। সে জানাল, ঘর নেই, সব ইতিমধ্যেই ভাড়া হয়ে গেছে। তারপর কপালে টোকা দিয়ে বলল, তবে আপনার বোধহয় কোন হারপুনারের সঙ্গে থাকতে আপত্তি নেই, নাকি আছে? হাবভাবে তো মনে হচ্ছে তিমি শিকারে যাচ্ছেন, এই ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচয় থাকা ভাল।
জবাব দিলাম, অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার ব্যাপারটা আমি পছন্দ করিনা। তবে যদি আর কোনও উপায় না থাকে এবং হারপুনার লোকটা ভীষণ আপত্তিকর না হয়, তাহলে এই শীতের রাতে অপরিচিত একটা শহরে ঘোরাঘুরি করার চেয়ে আমি বরং তার সঙ্গে কম্বল ভাগাভাগি করতেই রাজি আছি।
আমি সেরকমটাই ভেবেছিলাম। বসুন, রাতের খাবার এক্ষুণি রেডি হয়ে যাবে।
বসে পড়লাম একটা বেঞ্চে। পাশে এক মাতাল নাবিক তার ছুরি নিয়ে ঝড়ে পড়া জাহাজ সামলানোর ভান করছে। অবশেষে আমাদের চার পাচজনকে খাবার জন্যে ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো পাশের ঘরে। জায়গাটা আইসল্যাণ্ডের মত ঠাণ্ডা, কোন আগুনের ব্যবস্থা নেই, এক পাশে জ্বলছে চর্বির দুটো মোমবাতি। সরাই মালিক জানাল, আগুনের বিলাসিতা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কাঁপা কাঁপা হাতে আমরা তুলে ধরলাম গরম চায়ের কাপ। খাবারের মধ্যে চা ছাড়া রয়েছে মাংস, আলু আর ডাম্পলিং। হায় ঈশ্বর! সাপারের জন্যে ডাম্পলিং! সবুজ বক্স-কোট পরা এক তরুণ নাবিক ভয়ঙ্কর চোখমুখ করে বকাবকি করতে লাগল ডাম্পলিংগুলোকে।
বাছা, বলল সরাই মালিক, আজরাতে তুমি নিশ্চিত দুঃস্বপ্ন দেখবে।
সরাইখানার মালিককে জিজ্ঞেস করলাম আমি, এই কি সেই হারপুনার?
আরে না না, বীভৎস এক আনন্দ,পাবার মত মুখ করে বলল সরাই মালিক, হারপুনারের গায়ের রঙ গাঢ়। তাছাড়া সে কখনও ডাম্পলিং খায় না। শুধু স্টেক খায়।
কিন্তু সে গেছে কোথায়? জানতে চাইলাম আমি।
ঘুরতে বেরিয়েছে, এসে পড়বে, সরাই মালিক জবাব দিল।
খাবার শেষ করে সবাই ফিরে গেল বারে। হাতে কোন কাজ নেই বলে আমি দেখতে লাগলাম তাদের কার্যকলাপ।
হঠাৎ ভেসে এল একটা হট্টগোলের শব্দ। সরাই মালিক উত্তেজিত স্বরে বলল, গ্রাম্পাস-এর নাবিক, টাটকা খবর পাওয়া যাবে ওদের কাছ থেকে।
প্রবেশপথের মুখে পাওয়া গেল সী-বুটের শব্দ, দড়াম করে দুপাশে খুলে গেল দরজা, হৈ হৈ করে ভেতরে ঢুকে পড়ল এক দল নাবিক। পরনে তাদের ওয়চ কোট, মাথা ঢাকা পশমী মাফলারে, দাড়ি থেকে ঝুলছে পেরেকের মত বরফ। কাউন্টারের বুড়ো ব্যস্ত হয়ে মদ ঢালতে লাগল টাম্বলারে। এক নাবিক বলল, তার মগজের ভেতরটা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তার দিকে জিন আর চিটা গুড়ের একটা পিচের মত কালো মিশ্রণ এগিয়ে দিল বুড়ো।
দেখতে দেখতে মদ দখল করে নিল তাদের মগজ, দারুণ হৈ চৈ জুড়ে দিল নাবিকের দল।
একজনকে দেখলাম দল ছেড়ে একটু সরে বসে আছে। অবশ্য সঙ্গীদের আনন্দ নষ্ট করতে চায় না সে, কিন্তু এত হৈচৈও যেন করতে চায় না। কৌতূহলী হয়ে পড়লাম লোকটার ব্যাপারে। লম্বায় পুরো ছয় ফুট, চওড়া কাঁধ, সুগঠিত বুক, সারা শরীরে কিলবিল করছে অসংখ্য পেশি। মুখমণ্ডল তামাটে, ঝিকমিক করছে দাঁতের সারি, চোখের অতলে যেন বিষণ্ণতার ছায়া। স্বর কানে আসতেই বুঝতে পারলাম দক্ষিণের লোক সে, খুব সম্ভব এসেছে ভার্জিনিয়ার অ্যালেগানিয়ান পার্বত্য অঞ্চল থেকে। সঙ্গীদের হট্টগোল তুঙ্গে উঠতে আস্তে করে বার থেকে বেরিয়ে গেল সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সঙ্গীরা লক্ষ করল ব্যাপারটা। সোরগোল উঠল তাদের মধ্যে–বালকিংটন! বালকিংটন! বালকিংটন কোথায়? তার খোঁজে বার থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল সবাই।
প্রায় নটা বাজে। নাবিকেরা বেরিয়ে যেতে পিন পতন নীরবতা নেমে এল, বারে। একটা চিন্তা দোলা দিল আমার মাথায়।
সম্ভবত কোন মানুষই আরেকজনের সঙ্গে বিছানা ভাগাভাগি করে শুতে চায় না। সত্যি বলতে কি, নিতান্ত নিরুপায় না হলে আপন ভাইয়ের সঙ্গে ঘুমানোর ব্যাপারেও আপত্তি করবেন আপনি। এর কারণ আমি জানি না, খুব সম্ভব ঘুমানোর সময় সব মানুষই গোপনীয়তা পছন্দ করে। তাহলে অপরিচিত কোন শহরে যদি ঘুমাতে হয় অপরিচিত কোন মানুষের সঙ্গে বিশেষ করে সে-মানুষ যদি আবার হয় কোন হারপুনার, আপত্তির পরিমাণ বাড়বে বই কমবে না। আর সরাই মালিক যে বলল, নাবিকদের একত্রে ঘুমানোর অভ্যাস করা ভাল, তারও কোন যুক্তি নেই। নাবিকরা এক ঘরে শোয় সত্যি, কিন্তু সবার থাকে আলাদা হ্যামক, আলাদা কম্বল।
যত ভাবলাম ততই আরও বেশি আপত্তিকর মনে হলো হারপুনারের সঙ্গে শোয়ার ব্যাপারটা। শেষমেশ চেচিয়ে উঠলাম সরাই মালিকের উদ্দেশে, ওই হারপুনারের ব্যাপারে আমি মত বদল করেছি। বরং এখানকার বেঞ্চটাতেই শুয়ে পড়ি।
যা আপনার খুশি, জবাব দিল লোকটা।
কিন্তু বেঞ্চটা ঘরের এক কোণে টেনে নিয়ে শুতেই বাধল বিপত্তি। জানালার পাল্লার ফাঁক দিয়ে আসছে হাড়কাঁপানো বাতাস।
মনে মনে যাচ্ছেতাই সব গালি দিতে লাগলাম অদেখা সেই হারপুনারকে। আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয়–আমি লুকিয়ে থাকব দরজার আড়ালে, তারপর হারপুনার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলে লাফিয়ে পড়ব বিছানার ওপর। মন্দ হয় না, কিন্তু আরেকটা চিন্তা আসায় বাতিল করতে হলো এই পরিকল্পনা। এমন আচরণ করলে হয়তো আগামীকাল সকালে আমার মাথায় বাড়ি দেয়ার জন্যে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকবে হারপুনার!
চারপাশে নজর বুলিয়ে মনে হলো, অন্য কারও সঙ্গে বিছানা ভাগাভাগি না। করলে দুর্দশার এই রাত শেষ হবে না। তাছাড়া আমি যে অযথা ভয় পাচ্ছি না, তা-ই বা কে বলতে পারে। হয়তো দেখা যাবে, হারপুনার লোকটা ভাল মানুষ, হয়তো তার সঙ্গে গড়ে উঠবে নিবিড় বন্ধুত্ব কে জানে!
কিন্তু অন্য সব বাসিন্দারা যখন ফিরে এল একজন দুজন করে, তখনও হারপুনারের কোন পাত্তা নেই।
সরাই মালিকের কাছে জানতে চাইলাম, কী ধরনের লোক সে সবসময় কি এমন গভীর রাত করে ফেরে সে? ঘড়িতে এখন প্রায় বারোটা।
খুক খুক করে চাপা একটা হাসি দিল লোকটা। না। দেরি তো সে করে না। বুঝতে পারছি না, আজ এত দেরি করছে কেন। হয়তো মাথা বিক্রি করতে পারেনি।
মাথা বিক্রি করতে পারেনি?–এ কোন গল্প শোনাতে চাইছেন আমাকে? রাগ লাগল আমার। আপনি কি বলতে চান, শনিবারের এই রাতে সে শহরে গেছে মাথা ফেরি করতে?
একদম ঠিক বুঝেছেন, বলল ব্যাটা, কিন্তু আমি আগেই বলেছিলাম, বিক্রি সে করতে পারবে না। বাজার এখন ওই জিনিসে ভর্তি।
কী জিনিসে? চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
মাথায়। আবার কিসে?
দেখুন, মিস্টার, আজেবাজে গল্প বলে আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করবেন
আমি কাচা মানুষ নই।
হুঁ, লম্বা একটা কাঠি চেঁছে টুথপিক তৈরি করতে করতে বলল সে, তবে মাথা নিয়ে আজেবাজে কথা বলছেন জানতে পারলে ওই হারপুনার কিন্তু আপনাকে ছাড়বে না।
ওর মাথা আমি ফাটিয়ে ফেলব, সরাই মালিকের তালগোল পাকানো গল্পের কিছুই এখনও বুঝতে পারিনি আমি।
সেটা তো ইতিমধ্যেই ফেটে গেছে, বলল সে।
ফেটে গেছে? আপনি সত্যি বলতে চাইছেন যে ফেটে গেছে?
হ্যাঁ। সেজন্যেই তো বিক্রি করতে পারছে না।
দেখুন, তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি, এখনই আপনার সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া হওয়া দরকার। আমি আজ রাতে থাকার জন্যে আপনার কাছে একটা ঘর চেয়েছিলাম। আপনি বললেন, পুরো ঘর দিতে পারবেন না, সেখানে একজন হারপুনার থাকে। সে-হারপুনারকে আমি এখনও দেখিনি, কিন্তু আপনি তার সম্বন্ধে আজগুবি সব গল্প বলে চলেছেন। পরিষ্কার করে বলুন, হারপুনার লোকটা কেমন, তার সঙ্গে থাকা নিরাপদ কিনা। মাথার গল্পটা যদি সত্যি হয় তাহলে বুঝতে হবে, ওই লোক বদ্ধ পাগল। কোন পাগলের সঙ্গে এক বিছানায় রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা আমার নেই, আর সে-অভিজ্ঞতা আমি অর্জন করতেও চাই না। আপনি জেনেশুনে এরকম একটা ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে আমাকে ঠেলে দিতে চাইলে দেশের অপরাধ আইনে আপনার বিচার হওয়া উচিত।
থামুন, লম্বা করে শ্বাস টানল লোকটা, যথেষ্ট বক্তৃতা হয়েছে। হারপুনার লোকটা সদ্য ফিরেছে দক্ষিণ সাগর থেকে, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে নিউজিল্যান্ডের এম্বামিং করা কয়েকটা মাথা, আর সেগুলোই সে বিক্রি করছে। নিশ্চয় জানেন, এম্বামিং করা মাথার দারুণ চাহিদা রয়েছে কিউরিও হিসেবে। বিক্রি করা প্রায় শেষ, শুধু একটা মাথা সে এখনও বিক্রি করে উঠতে পারেনি। আগামীকাল রোববার বলে আজ গেছে সেই মাথাটা বিক্রি করতে। গির্জায় প্রার্থনা করতে যাওয়া লোকজনের সামনে দিয়ে মাথা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো খুব স্বস্তিকর দৃশ্য নয়। গত রোববারে আমি বাধা দিয়েছিলাম, সে তো প্রায় বেরিয়েই পড়েছিল কোমরে চারটে মাথা ঝুলিয়ে।
এতক্ষণে বোঝা গেল, আমাকে বোকা বানাবার কোনরকম ইচ্ছে সরাই মালিকের নেই।
বললাম, ঐ হারপুনার বিপজ্জনক লোক।
কিন্তু ভাড়া দেয় নিয়মিত, জবাব দিল সরাই মালিক। আসুন, রাত অনেক হয়ে গেছে। যে-খাটে থাকতে দেব, দুজনে শুয়েও হাত-পা ছুঁড়তে পারবেন। আসুন, আসুন, কী হলো?
এক মুহূর্ত ভেবে পা বাড়ালাম। লোকটাকে অনুসরণ করে ওপরতলার একটা ঘরে এলাম। দারুণ ঠাণ্ডা, তবে খাট সম্বন্ধে মিথ্যে কথা বলেনি সে। দুজন কেন চারজন লোকও অনায়াসে থাকতে পারবে।
ওই যে, পুরানো একটা সী চেস্টের ওপর মোমবাতি রেখে বলল পিটার, ওখানে এবার আরাম করে শুয়ে পড়ুন। গুডনাইট। খাটের দিক থেকে চোখ ফেরাবার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
শুজনি উঠিয়ে ভাল করে দেখলাম বিছানাটা, আরামদায়ক না হলেও একেবারে খারাপ নয়। এবার নজর বোলালাম ঘরটার চারপাশে। আসবাবপত্রের বালাই নেই বললেই চলে, শুধু জীর্ণ একটা শেলফ আর একটা ফায়ারপ্লেস। এক কোণে পড়ে রয়েছে একটা হ্যামক আর বড়সড় একটা নাবিকের ব্যাগ। হারপুনারের যাবতীয় পোশাক-আশাক নিশ্চয় ওটার মধ্যেই আছে। শেলফের ওপর মাছের হাড়ের কয়েকটা বড়শি, বিছানার মাথার দিকটায় দাঁড় করানো রয়েছে বিরাট এক হারপুন।
বিছানার এক পাশে বসে ভাবতে লাগলাম অদেখা হারপুনারের কথা। তারপর উঠে ঘরের মাঝখানে গিয়ে মাঙ্কি জ্যাকেটটা খুলে ফেলে ভাবতে লাগলাম আবার। কিছুক্ষণ পর খুলে ফেললাম কোট। শুধু শার্ট পরে থাকায় দেখতে দেখতে কাপন শুরু হলো শরীরে। মোমবাতিটা নিবিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
বেশ কিছুক্ষণ ঘুম এল না। তারপর কেবল যখন তন্দ্ৰামত এসেছে, প্যাসেজ থেকে ভেসে এল ভারী পদশব্দ, আলো চোখে পড়ল দরজার নিচ দিয়ে।
ধক করে উঠল বুকের ভেতরটা, নিশ্চয় সেই হারপুনার! নিশ্চল হয়ে রইলাম, বাধ্য না হলে কথা বলব না। এক হাতে একটা মোমবাতি আরেক হাতে নিউজিল্যাণ্ডের এম্বামিং কুরা মাথা নিয়ে ঘরে ঢুকল হারপুনার। বিছানার দিকে দৃষ্টিপাত না করেই মোমবাতিটা রাখল ঘরের এক কোণে, তারপর খুলতে বসল নাবিকদের সেই ব্যাগ। মুখটা দেখার জন্যে কৌতূহলী হয়ে উঠলাম, কিন্তু অনেকক্ষণ পর্যন্ত তা দেখা গেল না। যখন দেখলাম, চমকে উঠলাম আমি। হায় ঈশ্বর! এ কী মুখ! রঙ তার লালচে হলুদ, এখানে-সেখানে আবার বড় বড় কালচে চৌকো দাগ। যা ভেবেছিলাম তা-ই, আমার এই সঙ্গীটি ভয়াবহ না হয়েই যায় না। নিশ্চয় কারও সঙ্গে লড়াই করে কেটেকুটে গেছে, এখন সোজা ফিরছে সার্জনের কাছ থেকে। কিন্তু না, আলো সরাসরি মুখের ওপর পড়তে দেখলাম, ওগুলো স্টিকিং-প্লাস্টার নয়। প্রথমটায় বুঝতে পারলাম না দাগগুলো কিসের, তারপর একটা কথা দোলা দিল মাথায়। একজন তিমি শিকারীর গল্প শুনেছিলাম, নরখাদকদের দেশে যাবার পর নরখাদকরা তার সারা গায়ে এঁকে দিয়েছিল উল্কি। এই হারপুনারেরও নিশ্চয় সেরকম কোন অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু গায়ের ওই রঙ কি সূর্যতাপের ফল? দক্ষিণ সাগরে অবশ্য কখনও যাইনি আমি, তাই বলে শ্বেতাঙ্গ কোন মানুষ সূর্যতাপে এমন লালচে হলুদ হয়ে যায়, সে-কথাও শুনিনি কখনও। হারপুনারটা আমাকে এখনও লক্ষ করেনি। ব্যাগ খুলে একটা টোমাহকের মত পাইপ আর সীলের চামড়ার একটা ওয়ালেট বের করল সে, ভেতরে ঢুকিয়ে রাখল শুকনো মাথাটা। এবার সে মাথা থেকে খুলে ফেলল নতুন বীভার হ্যাট। চমকে উঠলাম আবার। তার লালচে হলুদ মাথাজোড়া টাকটাকে মনে হচ্ছে ছাতা পড়া কোন নরকঙ্কালের খুলি। হারপুনার যদি আমার আর দরজার মাঝখানে দাঁড়িয়ে না থাকত, নিশ্চিত ঝেড়ে দৌড় দিতাম আমি।
তবু জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাবার কথা ভাবলাম একবার। কাপুরুষ আমি নই, কিন্তু হারপুনারের চেহারা যে এতটা ভয়ঙ্কর, স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। মনে হলো, গভীর রাতে স্বয়ং শয়তান যেন ঢুকে পড়েছে আমার ঘরে। এত ভয় পেলাম যে গলায় স্বর ফুটল না।
ধীরে ধীরে কাপড় ছাড়ছে সে। মুখের মত তার বুক আর বাহুতেও চৌকো চৌকো দাগ, যেন তিরিশ বছর যুদ্ধ করে এইমাত্র ছাড়া পেয়েছে সে। পায়েও তার একইরকম দাগ। আর সন্দেহ নেই, এই লোক বর্বর-নরখাদক। কে জানে, মাথাটা তার আপন ভাইয়েরই কিনা। আমার ওপরেও চোখ যে পড়বে না, সেটাই বা কে বলতে পারে। ব্যাটার টোমাহকটা চোখে পড়লেই পিলে চমকে ওঠে।
কিন্তু চমকে ওঠারও সময় নেই। তার এবারের কার্যকলাপে নিশ্চিত হলাম যে সে বিধর্মী। চেয়ারে ঝোলানো পোশাকের পকেট থেকে আবলুস কাঠের মত চকচকে একটা পিঠ কুঁজো মূর্তি বের করল সে, বসিয়ে দিল ফায়ারপ্লেসের ওপর। মূর্তিটা যেন অবিকল কঙ্গোর একটা দিন তিনেকের শিশু।
চোখ সরু করে দেখতে লাগলাম, এবার ব্যাটা কী করে। প্রথমে পোশাকের পকেট থেকে চাছা কাঠের মুঠো দুয়েক পাতলা ফালি বের করে সাবধানে রাখল মূর্তিটার সামনে, তারপর সেগুলোর ওপর কয়েকটা বিস্কুট রেখে আগুন ধরিয়ে দিল। একটু পরেই বিস্কুটগুলো বের করে রাখল মূর্তির সামনে, নিবিয়ে দিল আগুনটা। কিন্তু অতি শুকনো এই নৈবেদ্য বুঝি পছন্দ হলো না দেবতার, খাওয়া তো দূরের কথা, ঠোঁটও ফাঁক করল না সে। ওদিকে গদগদ হয়ে তার ভক্ত আউড়ে চলেছে বিধর্মীদের প্রার্থনা-সঙ্গীত। পূজা শেষে মূর্তিটাকে অবহেলাভরে আবার রেখে দিল পকেটে, ঠিক যেমন শিকারী তার ব্যাগে ছুঁড়ে দেয় গুলির ঘায়ে মৃত বনমোরগ।
অদ্ভুত এসব কাণ্ডে আমার অস্বস্তি বেড়ে চলল। টোমাহকটা তুলে নিয়ে মোমবাতির আলোয় পরীক্ষা করল সে। তারপর ধরিয়ে গলগল করে খানিকটা ধোয়া ছেড়ে, দাঁতে কামড়ে ধরে এক লাফে এসে পড়ল বিছানার ওপর। অজান্তেই চিৎকার কোরে উঠলাম আমি। বিস্মিত একটা ঘোৎ শব্দ ছেড়ে বিছানা হাতড়াতে লাগল সে।
তোতলাতে তোতলাতে গড়ান দিয়ে সরে গেলাম দেয়ালের কাছে। তারপর তাকে অনুরোধ করলাম শান্ত হবার জন্যে।
তুমি আবার কোন শয়তান? বলল সে। কী, কথা বলবে, নাকি খতম করে দেব? টোমাহক নাচাতে লাগল হারপুনার।
পিটার, ঈশ্বরের দোহাই, পিটার কফিন! চেঁচালাম আমি। মি. পিটার! দেখুন কী কাণ্ড! কফিন! হে ঈশ্বর, রক্ষা করো!
বলো কে তুমি! কথা না বললে খুন করে ফেলব! তার টোমাহকের নাচনে ছিটকে ছিটকে পড়তে লাগল গরম ছাই। আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম, কাপড়ে না আবার আগুন ধরে যায়। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, মোমবাতি হাতে ঘরে এসে উপস্থিত হলো সরাই মালিক। বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে ছুটে গেলাম তার পাশে।
ভয় পাবেন না, মুচকি হাসল সরাই মালিক। কুইকেগ আপনার কোন ক্ষতি করবে না।
থামুন! গলা চড়ালাম আমি, কেন আগে বলেননি যে এই হারপুনারটা একজন নরখাদক?
আমি ভেবেছিলাম, আপনি জানেন, কুইকেগের দিকে ঘুরল সরাই মালিক, ইনি আজরাতে তোমার সঙ্গে থাকবেন, ঠিক আছে?
বিছানায় বসে পাইপ টানতে লাগল কুইকেগ।
এসো, অবশেষে বিছানার দিকে নির্দেশ করল সে। নরখাদক হলেও খুব ভাল মানুষ সে। অযথাই এতক্ষণ ভয় পেয়েছি তাকে। নরখাদক তো রক্ত-মাংসের আর দশটা মানুষের মতই। আমি যদি তাকে ভয় পাই, সেও আমাকে ভয় পেতে পারে। মাতাল কোন খ্রিস্টানের চেয়ে স্র একজন নরখাদকের সঙ্গে ঘুমানোই ভাল।
মি. পিটার, বললাম আমি, টোমাহকটা ওকে সরিয়ে রাখতে বলুন, বন্ধ করতে বলুন ধূমপান।
সরাই মালিকের মুখে কথাটা শুনতেই পাইপ নিবিয়ে দিল কুইকেগ, তারপর বিছানার এক পাশে যথাসাধ্য সরে গিয়ে নরম সুরে আবার ডাকল আমাকে।
গুডনাইট, পিটার কফিন, বললাম আমি, এখন আপনি যেতে পারেন। সে চলে যেতেই বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সেরাতের চেয়ে ভাল ঘুম আমার জীবনে আর কখনও হয়নি।
০৪.
পর দিন সকালে ঘুম ভাঙতে দেখলাম, আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে কুইকেগ। ওর হাতটা সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ঘুমের মধ্যেই আরও জোরে জড়িয়ে ধরল আমাকে।
কুইকেগ! ডাকলাম আমি জোর ধাক্কা দিয়ে। জবাবে ভীষণ জোরে নাক ডেকে উঠল দুবার। গড়িয়ে সরে গেলাম এক পাশে। শুজনিটা খানিক উঠিয়ে টোমাহকটাকে শিশুর মত পাশে শুইয়ে রেখেছে ও।
কুইকেগ, ওঠো, কুইকেগ! আবার ডাকলাম আমি। ঘোঁৎ করে উঠল ও। জোরে জোরে আরও বেশ কয়েক বার ডাকার পর নড়ল কুইকেগ। সারা শরীর ঝকাল পানি থেকে ওঠা নিউফাউণ্ডল্যাণ্ড কুকুরের মত। বসে চোখ কচলে এমনভাবে তাকাল, যেন আমি এখানে কিভাবে এলাম বুঝতে পারছে না। তারপর ধীরে ধীরে চোখে ফুটল পরিচয়ের চিহ্ন। আমি চুপচাপ চেয়ে রইলাম, অদ্ভুত এই জিনিসকে অবশ্যই ভালভাবে জানা দরকার। অবশেষে আমার কথা পুরোপুরি মনে পড়ে গেল ওর। এক লাফে বিছানা থেকে নিচে নামল কুইকেগ। নানারকম অঙ্গভঙ্গী করে বোঝাল, আগে ও কাপড় পরতে চায়, তারপর আমার জন্যে ছেড়ে দেবে ঘরটা। কোন বর্বরের পক্ষে এই আচরণ দারুণ সভ্য মনে হলো, আমিই বরং গত রাতে রুক্ষ ব্যবহার করেছি ওর সঙ্গে। কৌতূহল আরও বহু গুণ বেড়ে গেল আমার। তবে এটা নিশ্চয় আপনারা স্বীকার করবেন যে কুইকেগের মত মানুষ প্রতি দিন দেখা যায় না।
প্রথমে লম্বা বীভার হ্যাট মাথায় দিল কুইকেগ, তারপর ট্রাউজারস না পরেই তুলে নিল বুটজোড়া। এরপর যে-কাণ্ডটা ঘটল, তার জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না আমি। ধপাস করে বসে পড়ল মেঝেতে, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে সোজা বিছানার তলায়। ফোঁসফেঁসানি আর নড়াচড়ার ধরনে বুঝতে পারলাম, কুইকেগ এখন বুট পরার কঠিন কাজে ব্যস্ত। ওর এই আচরণ অদ্ভুত হলেও অর্থ কিন্তু পরিষ্কার। কুইকেগ এখন রয়েছে রূপান্তরের স্তরে, না সভ্য না বর্বর। পুরো সভ্য হলে বুট পরার মত সাধারণ একটা বিষয় নিয়ে মাথাই ঘামাত না, তেমনি বর্বরের রেশ রয়ে না গেলে বুট পরার জন্যে ঢুকত না বিছানার নিচে। বেশ কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এল কুইকেগ, ঘরের এক পাশ থেকে আরেক পাশে পায়চারি করতে লাগল খোড়াতে খোড়াতে।
ঘরটার জানালায় কোন পর্দা নেই, ফলে কাছের বাড়িগুলো থেকে পুরো ঘরটা দেখা যায়। ভেবে দেখুন, এই অবস্থায় কুইকেগ পায়চারি করছে শুধু বীভার হ্যাট আর বুট পরে। তাড়াতাড়ি টয়লেট সেরে ওকে প্যান্ট পরতে বললাম আমি। এতক্ষণে ব্যাপারটা ওর মাথায় ঢুকল। সকালে যে-কোন খ্রিস্টান মুখ ধােয়, কিন্তু কুইকেগ কাজ সারল বুক, বাহু আর হাতে পানি দিয়ে। এরপর ওয়েস্টকোট পরে, শক্ত একটা সাবান ঘষে ফেনা লাগাল মুখে। মনে মনে কেবল ভাবছি, রেজর রেখেছে কোথায়, তখনই ঘটল আরেক কাণ্ড। সাবান ঘষা শেষ করে ছোট্ট একটা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও, কাঠের হাতল খুলে ফেলে রেজরের কাজ চালাতে লাগল হারপুন দিয়ে। তখন হাসি পেলেও পরে জেনেছি, দারুণ ধার হারপুনের মাথায় আর সেটা তৈরি হয় সেরা ইস্পাতে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল ওর টয়লেটের কাজ। মাঙ্কি জ্যাকেট পরে, মার্শালদের ব্যাটনের মত করে হারপুন নাচাতে নাচাতে গর্বিত পদক্ষেপে বেরিয়ে এল কুইকেগ।
০৫.
ঝটপট পোশাক পরে নেমে এলাম বার-রূমে। মি. পিটার এক গাল হাসল আমাকে দেখে। তার ওপর কোন রাগ নেই আমার, তবে হারপুনারকে নিয়ে রহস্য করায় খানিকটা বিরক্ত হয়েছিলাম। যাই হোক, প্রাণখোলা হাসি একটা দারুণ ভাল জিনিস। প্রাণ খুলে হাসতে পারলে খারাপ অনেক কিছুই দূরে সরিয়ে রাখা যায়।
বার-রূম এখন গত রাতে আসা বোর্ডারে ভর্তি। প্রায় সবাই তিমি শিকারের সঙ্গে যুক্ত। চীফ মেট, সেকেণ্ড মেট, থার্ড মেট, ছুতোর, কুপার, কামার, হারপুনার, শিপ কীপার। সবার পরনে লোমঅলা মাঙ্কি জ্যাকেট।
চিবুকের রঙ দেখলে অনায়াসেই বলে দেয়া যায়, কে কত বেশি দিন সাগরে থেকেছে। কিন্তু কুইকেগের মত রঙবেরঙের চিবুক কি আর কোন লোকের আছে? শুধু রঙ বৈচিত্রই নয়, তার চিবুকের গঠনটাও দেখবার মত। চিবুক তো নয় যেন আণ্ডিজ পর্বতমালার পশ্চিম ঢাল।
কই, এসো! একটা দরজা খুলে চেঁচাল সরাই মালিক। নাস্তা করার জন্যে হুড়মুড় করে এগোল সবাই।
টেবিলে বসে মনে মনে আশা করলাম, এবার শুনতে পাব তিমি শিকারের গরম গরম গল্প। কিন্তু আমাকে দারুণ অবাক করে দিয়ে একদম চুপ মেরে রইল সবাই। ব্যাপারটা কিছুতেই মেলাতে পারলাম না। অসমসাহসী যে-সব লোক তিমির মুখখামুখি হতেও ভয় পায় না, নাস্তার টেবিলে বসে তারা মুখ খোলা তো দূরের কথা, খানিকটা যেন অস্বস্তিবোধ করছে।
নির্লিপ্তভাবে টেবিলের এক মাথায় বসে রয়েছে কুইকেগ। কিন্তু নাস্তার টেবিলে হারপুন সঙ্গে করে আনাটা বোধ হয় তার সবচেয়ে বড় ভক্তও মেনে নেবে না। তবে কিনা বেশির ভাগ লোকেরই ধারণা, নির্লিপ্ত হয়ে থাকাটাই ভদ্রতার প্রকাশ।
কুইকেগের নাস্তা করার বিশদ বিবরণ আমি দিতে যাচ্ছি না। কফি বা হট রোল ছুঁয়েও দেখল না ও, মনোযোগ যা কিছু রইল বীফস্টেকের ওপর। নাস্তা সেরে আর সবার সঙ্গে সেও গেল পাবলিক রূমে, পাইপ ধরিয়ে ধোয়া ছাড়তে লাগল গলগল করে। শহরটায় একটা চক্কর লাগাবার জন্যে সরাইখানা থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমি।
০৬.
নিউ বেডফোর্ডের কয়েকটা রাস্তায় ঘুরতেই কুইকেগের কথা ভুলে গেলাম। এই শহরের একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। কেবল হোয়েলম্যানই নয়, এখানে রয়েছে খাটি নরখাদক। এমনও অনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যাদের কোমরে ঝোলানো হাড়ে এখনও লেগে রয়েছে মাংস, আগন্তুককে তাদের দিকে একবার তাকাতেই হবে ঘাড় ফিরিয়ে।
প্রতি সপ্তাহে এখানে অনেক লোক আসে ভারমন্ট আর নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে। বেশির ভাগই যুবক কাঠুরে, কুঠার ফেলে দিয়ে হাতে তুলে নিতে চায় তিমি শিকারের বর্শা। ওই যে দেখুন একজন! মাথায় বীভার হ্যাট আর পরনে টেইল কোট। এই যে এইমাত্র আরেকজন এসে উপস্থিত হলো সুওয়েস্টার আর বোম্বাজাইন ক্লোক পরে।
কিন্তু এটা ভাববেন না যে নিউ বেডফোর্ডে শুধু হারপুনার, নরখাদক আর গেঁয়ো লোকই রয়েছে। কানানের মত অতটা না হলেও যথেষ্ট তেল রয়েছে এখানে। খেতে ফলে চমকার শস্য, পাওয়া যায় স্বাদু ওয়াইন। দুধ আর ডিম খুব একটা মেলে না সত্যি, কিন্তু সারা আমেরিকায় আর কোথায় রয়েছে এখানকার মত অভিজাত বাড়ি, সমৃদ্ধ সব পার্ক আর বাগান?
যে-ফুলে এই বাগানগুলো ভরা, সেসব এসেছে প্রশান্ত, আটলান্টিক আর ভারত মহাসাগর থেকে।
আলোকসজ্জা কাকে বলে দেখতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে নিউ বেডফোর্ডের কোন বিয়েতে। শোনা যায়, প্রত্যেকটা বাড়িতে নাকি রয়েছে তেলের একটা করে বিশাল মজুত। এখানকার লোক যথেচ্ছ জ্বালায় স্পার্ম তিমির চর্বির মোমবাতি, কারণ, হিসেবের প্রয়োজন তাদের নেই।
গরমে এই শহর ভরে ওঠে চমৎকার মেপলে, অগাস্টের বাতাসে নাচে হর্সচেসনাট আর ক্যাণ্ডেলাব্রা-ওয়াইজ।
আর নিউ বেডফোর্ডের মেয়েরা ফোটে নিজেদেরই লাল গোলাপের মত। কিন্তু গোলাপ তো ফোটে শুধুই গরমে, তাদের গণ্ডদেশ সারা বছরই ফুটে থাকে সপ্ত আসমানের সূর্যালোক হয়ে। এই রঙ কেবল সালেম ছাড়া অন্য কোথাও আপনি পাবেন না। নিউ বেডফোর্ডের তরুণীদের নিশ্বাসে নাকি ভাসে কস্তুরীর গন্ধ, প্রেমিক নাবিকের দল দূর থেকেই বুঝতে পারে চোখের সামনে আর কতক্ষণ পর ভেসে উঠবে তটরেখা।
০৭.
নিউ বেডফোর্ডে রয়েছে হোয়েলম্যানদের একটা চ্যাপেল। ভারত বা প্রশান্ত মহাসাগরগামী মৎস্য শিকারীরা রোববারে সেখানে যেতে খুব কমই ভুল করে।
সকালের পায়চারি সেরে ফিরে আবার বেরিয়ে পড়লাম সেই চ্যাপেলের উদ্দেশে। ইতিমধ্যে পরিষ্কার, রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ ভরে গেছে কুয়াশায়, শনশন করে বইছে হিমেল বাতাস। চ্যাপেলের ভেতরে ঢুকতে দেখলাম, ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে নাবিক আর নাবিকদের বৌ, বিধবারা। গোপনে শোক পালন করাই সম্ভবত বিচ্ছিন্ন হয়ে বসার কারণ। চ্যাপলেন এখনও আসেননি। পুলপিটের দুপাশেই কালো বর্ডার দেয়া মার্বেল পাথরের বেশ কয়েকটা ফলক। তার মধ্যে তিনটের ভাষা নিম্নরূপ:
ক্যাপটেন ইজেকিয়েল হার্ডির পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশে–
জাপান উপকূলে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন এক স্পার্ম তিমির আক্রমণে।
তারিখ: অগাস্ট ৩, ১৮৩৩।
স্মৃতিফলক নির্মাণে: তাঁর বিধবা।
জন ট্যালবটের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশে–
১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর মাত্র আঠারো বছর বয়সে পাটাগোনিয়ার আইল অভ ডেজোলেশন-এর নিকটে জাহাজ থেকে পানিতে পড়ে তিনি নিহত হয়েছিলেন। নিহতের স্মৃতিতে ফলক নির্মাণ করেছেন তাঁর বোন।
রবার্ট লং, উইলিস এলারি, নাথান কোলম্যান, ওয়াল্টার ক্যানি, সেথ মেসি এবং স্যামুয়েল গ্রেইগ-এর পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশে–
প্রশান্ত মহাসাগরের এক অভিযানে এঁরা ছিলেন এলিজা জাহাজের নাবিক। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর এক তিমি তাদের নৌকো টেনে নিয়ে চলে গিয়েছিল দৃষ্টিসীমার বাইরে। নিখোঁজদের স্মৃতিতে এই ফলক নির্মাণ করেছেন তাঁদের জাহাজের জীবিত সঙ্গীগণ।
দরজার কাছে বসে মাথা ঘোরাতে পাশেই কুইকেগকে দেখে আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। পরিবেশের ভাবগাম্ভীর্যে কৌতূহল নিয়ে চুপ করে তাকিয়ে রয়েছে ও। যাদের স্মৃতিতে তৈরি হয়েছে এখানকার ফলকগুলো, জানি না তাদের কোন আত্মীয়-স্বজন আজ উপস্থিত আছে কিনা। খোঁজ নেই এমন অনেক দুর্ঘটনাই ঘটে চলেছে মহাসাগরে। একটা ব্যাপার অনুভব করলাম। যাদের হৃদয়ের ক্ষত এখনও শুকায়নি, ফলকগুলোর দিকে তাকিয়ে তাদের হৃদয় হবে নতুন করে রক্তাক্ত।
ওখানে লেখা রয়েছে আমার আগে মহাসাগরে গমনকারী হোয়েলম্যানদের নিয়তি। হ্যাঁ, ইসমাইল, ওই একই নিয়তি তোমারও হতে পারে। তবু মনটা আমার প্রফুল্ল হয়ে উঠল। হ্যাঁ, তিমি শিকার অভিযানে রয়েছে পদে পদে মৃত্যু চোখের পলকে জলজ্যান্ত একজন মানুষ চলে যেতে পারে অনন্তলোকে। কিন্তু তারপর? আমার মনে হয়, জীবন আর মৃত্যুর ধারণাতেই বিরাট ফাঁক রয়েছে আমাদের। পৃথিবীতে মানুষ যেটাকে আমার ছায়া বলে, সেটাই আসল আমি। আমার শরীর আসলে আমারই বাইরের একটা ঢাকনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
০৮.
আমি বসার পরপরই ভেতরে ঢুকলেন মোটাসোটা এক দীর্ঘদেহী লোক। এক নজরেই বুঝতে পারলাম, ইনিই চ্যাপলেন। ফাদার মেপল হোয়েলম্যানদের খুবই প্রিয়। যৌবনে ফাদার ছিলেন হারপুনার। লক্ষ করলাম, তার সঙ্গে ছাতা নেই, মবি ডিক অর্থাৎ, তিনি ক্যারিজে চড়ে আসেননি। তেরপলের হ্যাটের ওপর গলে যাচ্ছে। বরফ, পানির ভারে পাইলট ক্লথ জ্যাকেটটা মেঝেতে প্রায় নুইয়ে ফেলতে চাইছে। তাকে। যাই হোক, একে একে হ্যাট, জ্যাকেট, জুতো খুলে এক কোণায় রেখে, চমৎকার একটা সুট পরে পুলপিটে এসে দাঁড়ালেন তিনি।
পুরানো আর সব পুলপিটের মত এটাও বেশ উঁচু। সিঁড়ি থাকলে ছোট এই চ্যাপেলটা আরও ছোট হয়ে যাবে বলে সম্ভবত চ্যাপলেনের কথামতই খাড়াভাবে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে দড়ির একটা মই। তবে মইটাই এই চ্যাপেলের একমাত্র অদ্ভুত দৃশ্য নয়। পুলপিটের দুপাশে যে মার্বেল পাথরের সেনোটাফ, তার পেছনের দেয়ালে ঝুলছে বিশাল এক পেইন্টিং। শিল্পী এঁকেছেন এক জাহাজের ছবি। কালো পাথরের এক উপকূলে আছড়ে পড়ছে বরফ-সাদা ঢেউ, সেই উপকূলের সামনে তীব্র ঝড়ের বিরুদ্ধে লড়ছে জাহাজটা। কালো মেঘের অনেক ওপরে ভাসছে রৌদ্রালোকিত এক ছোট্ট দ্বীপ, আর তারই আড়ালে উঁকি দিয়ে হাসছে স্বর্গীয় এক দূত। যেন বলছে, লড়াই করো, জাহাজ, লড়াই চালিয়ে যাও আর কিছুক্ষণ। ওই দেখো, সূর্য বেরিয়ে এসেছে! পেছনে সরে যাচ্ছে কালো মেঘ, শান্ত নীলাকাশ খুব বেশি দূরে নেই।
০৯.
ধীর অথচ কর্তৃত্বপূর্ণ স্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উপাসনাকারীদেরকে একত্রিত হয়ে বসতে বললেন ফাদার মেপল।
বেঞ্চের সারিগুলোর মাঝে উঠল ভারী সী বুটের শব্দ আর ফাঁকে ফাঁকে মহিলাদের জুতোর মৃদু খসখস, তারপর আবার নেমে এল নীরবতা। সবার দৃষ্টি ফাদার মেপলের ওপর গভীরভাবে নিবদ্ধ।
সামান্য থেমে হাঁটু গেড়ে বসলেন তিনি, বাদামী হাত দুটো বুকের ওপর রেখে দারুণ ভক্তিভরে একটা প্রার্থনা করলেন।
প্রার্থনার পর সুর করে একটা স্তোত্র আওড়াতে লাগলেন ফাদার, প্রায় সবাই যোগ দিল তার সঙ্গে। স্তোত্রের পর স্বল্প বিরতি। বাইবেলের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে নির্দিষ্ট একটা পাতায় এসে ফাদার বললেন, জোনার প্রথম অধ্যায়ের শেষ পংক্তিটা মনে করার চেষ্টা করুন সবাই–ঈশ্বর প্রকাণ্ড এক মাছকে প্রস্তুত করলেন জোনাকে গিলে ফেলার জন্যে।
মুহূর্তের বিরতি। এই ঘটনার মাত্র চারটে অধ্যায় আর সেখানে উপদেশ রয়েছে দুরকম। একটা আমাদের পাপী মানুষদের প্রতি, আরেকটা ঈশ্বরের প্রচারক হিসেবে আমার প্রতি। নবী হওয়া সত্ত্বেও ঈশ্বরকে না মেনে অপরাধ করেছিলেন জোনা, কিন্তু তার চেয়েও অনেক বড় অপরাধ করেছিলেন ঈশ্বরের হাত থেকে পালাবার চেষ্টা করে।
এরপর তিমি মাছ কিভাবে জোনাকে খেয়ে ফেলেছিল এবং শেষমেশ তিনি উদ্ধার পেয়েছিলেন, তার একটা বিশদ বর্ণনা দিয়ে তিনি বললেন, কিন্তু আপনাদের চেয়ে অনেক বড় পাপী আমি। তাই বাইবেলের এই ঘটনা আপনাদের চেয়ে আমাকে শিক্ষা দেয় অনেক বেশি। ঈশ্বরের যে-ভার আপনাদের ওপর, তার চেয়ে অনেক বেশি ভার তিনি দিয়েছেন আমাকে। খুব ভাল হত যদি আপনাদের কেউ এই পুলপিটে এসে ঘটনাটা শোনাতেন, আর বেঞ্চে বসে শুনতে পারতাম আমি। ওহ, এই ভার বহন করা সত্যিই বড় কঠিন। তবে কিনা, অদ্ভুত এক আভা ফুটে উঠল তার মুখে পাপের পেছনেই থাকে পুণ্য, ঠিক যেমন আলো থাকে গাঢ় অন্ধকারের আড়ালে।
আশীর্বাদের ভঙ্গীতে কয়েক মুহূর্ত দুলিয়ে, দুহাতে মুখ ঢাকলেন ফাদার মেপল। তাকে ওই অবস্থায় একাকী রেখে, ধীরে ধীরে সবাই বেরিয়ে গেল গির্জা থেকে।
১০.
চ্যাপেল থেকে স্পাউটার-ইন-এ ফিরতে একাকী পেলাম কুইকেগকে, খুব সম্ভব চলে এসেছে ফাদারের আশীর্বাদ শুরু হবার খানিক আগে। আগুনের সামনে একটা বেঞ্চে বসে আছে ও। ওর কড়া নজর নিবদ্ধ এক হাতে ধরা কাঠের নিগ্রো দেবতার ওপর, আরেক হাতে ধরা ছুরি দিয়ে খোঁচা মারছে মূর্তির নাকে, সেইসঙ্গে কণ্ঠে গুনগুনানি সুর।
আমাকে দেখে মূর্তিটা তুলে রাখল কুইকেগ, তারপর টেবিলের ওপর থেকে মোটা একটা বই এনে গুনতে লাগল সেটার পৃষ্ঠা। যত দূর মনে হচ্ছে, গোটা পঞ্চাশেক পৃষ্ঠা গোনার পর একবার করে থামছে ও, গলা থেকে বেরিয়ে আসছে বিস্মিত শিস, তারপর গুনছে পরবর্তী পঞ্চাশ পৃষ্ঠা। হয়তো একবারে পঞ্চাশের বেশি সংখ্যা গুনতে শেখেনি, তাজ্জব হয়ে যাচ্ছে একটামাত্র বইয়ে এতগুলো পৃষ্ঠা রয়েছে দেখে।
দারুণ আগ্রহ নিয়ে আমি লক্ষ করতে লাগলাম ওর কার্যকলাপ। বর্বর হলেও কেমন যেন একটা আকর্ষণ রয়েছে ওর মধ্যে। বাহ্যিক রূপ যেমনই হোক না কেন, মানুষ তার আত্মা লুকিয়ে রাখতে পারে না। ওর ওই উক্তি এবং অন্যান্য অদ্ভুত আচরণের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে সরল, সৎ একটা মন। আরেকটা ব্যাপার হয়তো হাস্যকর মনে হবে, কিন্তু ওর মাথা দেখলেই আমার মনে পড়ে যাচ্ছে জেনারেল ওয়াশিংটনের কথা–অন্তত আবক্ষ মূর্তিতে ওয়াশিংটনের যেরকম মাথা দেখা যায়, তার সঙ্গে ওর মাথার যথেষ্ট মিল রয়েছে। কুইকেগ যেন নরখাদকরূপে বেড়ে ওঠা জর্জ ওয়াশিংটন।
আমি গভীরভাবে লক্ষ করলেও কুইকেগ কিন্তু একবার তাকানো ছাড়া আর কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, ও ব্যস্ত রয়েছে মোটা সেই বই নিয়ে। ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভুত। তবে এটাও ঠিক যে বর্বরেরা খানিকটা অদ্ভুতই হয়। স্বাভাবিক থাকতে থাকতে হঠাৎ ওরা কি করে বসবে, বলা খুব সহজ নয়। তবে কুইকেগের ব্যাপারে একটা কথা ভেবে বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। প্রায় বিশ হাজার মাইল দূরের এক দেশ থেকে এসে উপস্থিত হয়েছে সে এমন এক দল লোকের মাঝখানে, ওর দৃষ্টিতে যে-পরিবেশ হয়তো বৃহস্পতি গ্রহের মত।
ধীরে ধীরে ঘনিয়ে এল সন্ধ্যা। নিঃশব্দ আলোড়ন উঠল আমার ভেতরে। টানছে, ওই বর্বর আমাকে টানছে অপ্রতিরোধ্য এক আকর্ষণে। মুখোশে আড়াল করা কোন ভণ্ডামি নেই ওর মধ্যে। হ্যাঁ, ওই বিধর্মীর সঙ্গে বন্ধুত্বের একটা চেষ্টা করব। খ্রিস্টানদের দয়া যে ফাঁকা সৌজন্যমাত্র, তা ইতিমধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেছে। বেঞ্চ টেনে ধীরে ধীরে গিয়ে বসলাম ওর পাশে, নানারকম অঙ্গভঙ্গী করতে লাগলাম বন্ধুত্ব প্রকাশের জন্যে। গত রাতে ওর সদয় ব্যবহারের কথা মনে করিয়ে দিতে কুইকেগ জানতে চাইল, আজরাতে ওর সঙ্গে থাকব কি না। থাকব শুনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চোখজোড়া, যেন হঠাৎ করে পেয়ে গেছে অপ্রত্যাশিত কোন উপহার।
এরপর মোটা বইটা আমরা ওল্টাতে লাগলাম একসঙ্গে। ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম মুদ্রণের উদ্দেশ্য, বুঝিয়ে দিলাম ছবিগুলোর অর্থ। দেখতে দেখতে কৌতুহলী হয়ে উঠল কুইকেগ। গল্প শুরু হয়ে গেল আমাদের বিখ্যাত এই শহরকে ঘিরে। ধূমপানের প্রস্তাব দিলাম আমি। পাইপ আর তামাক বের করে ওখান থেকেই আমাকে ধূমপানের অনুরোধ করল ও। সুতরাং একই পাইপ হস্তান্তরের মাধ্যমে শুরু হলো আমাদের যৌথ ধূমপান।
আমার সম্বন্ধে সন্দেহের শেষ যে-বরফটুকু ছিল ওই বর্বরের মনে, তাও যেন গলে গেল এই ধূমপানের মাধ্যমে। ধূমপানের পালা শেষে আমার কোমর জড়িয়ে ধরল ও, কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল, এই মুহূর্ত থেকে বিয়ে হয়ে গেল আমাদের ওর দেশীয় ভাষায় যে-কথার অর্থ, এখন থেকে আমরা দুজন অন্তরঙ্গ বন্ধু; প্রয়োজনে আমার জন্যে জীবন দেবে ও। গ্রামের দিকে অবশ্য লোকে প্রায়ই বলে এমন জীবন দেয়ার কথা, যার মধ্যে বিশ্বাস্য কিছুই নেই। কিন্তু ওই বর্বর এখনও জানে না যে কথা আবার বানিয়ে বলা যায়।
রাতের খাবার সেরে, আরও কিছুক্ষণ গল্প করে ঘরে গেলাম আমরা। এম্বামিং করা মাথাটা আমাকে উপহার দিল কুইকেগ। তারপর টোবাকো ওয়ালেট খুলে, তামাকের নিচ থেকে হাতড়ে বের করল তিরিশটা রূপোর ডলার। টেবিলের ওপর ডলারগুলো ছড়িয়ে সমান দুভাগে ভাগ করল ও, এক ভাগ আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল যে ওগুলো আমার। আপত্তি করতে গেলাম আমি, কিন্তু বাধা দিয়ে ডলারগুলো ও রেখে দিল আমার পকেটে। তারপর সান্ধ্য পুজো সারার জন্যে কাঠের নিগ্রো দেবতাকে বের করে বসিয়ে দিল ফায়ারপ্লেসের মাথায়। কিছুক্ষণ পর ভাবভঙ্গীতে বুঝতে পারলাম, ওর সঙ্গে যোগ না দেয়ায় অস্বস্তিবোধ করছে কুইকেগ। আমিও পড়ে গেলাম দারুণ অস্বস্তিতে–ওর ইচ্ছেটাকে সম্মান দেয়া উচিত হবে কিনা বুঝতে পারলাম না।
আমি একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান, শৈশব থেকেই বেড়ে উঠেছি গির্জার শিক্ষায়। তাহলে কীভাবে আমি এক বর্বর পূজারীর সঙ্গে তার কাঠের মূর্তি পূজায় সামিল হতে পারি? কিন্তু পূজা জিনিসটা আসলে কী? ভাবলাম আমি। তোমার কি মনে হয়, ইসমাইল, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধিকর্তা প্রভু গুরুত্বহীন এক কালো কাঠের টুকরোর প্রতি ঈর্ষান্বিত হতে পারেন? অসম্ভব! তাহলে পূজা জিনিসটা কী? ঈশ্বরের ইচ্ছেনুসারে কাজ করাটাই পূজা। ঈশ্বরের ইচ্ছে কি–সঙ্গীর প্রতি সেই কর্তব্য করা, যা প্রয়োজনে সেও করবে আমার প্রতি। কুইকেগের কাছ থেকে কি আশা করি আমি? আশা করি ও আমার সঙ্গে পূজা অর্থাৎ উপাসনা করবে খ্রিস্টান ধর্মের নিয়মানুসারে। তাহলে, বলাই বাহুল্য, ওই একইরকম আশা ও-ও করতে পারে আমার কাছে। সুতরাং আগুন জ্বালিয়ে দিলাম কাঠের চিলতেয়, তারপর কুইকেগের সঙ্গে ওর দেবতাকে দিলাম পোড়া বিস্কুটের নৈবেদ্য। পূজা শেষে গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়, কিন্তু আরও খানিকক্ষণ গল্প করার আগে ঘুম এল না।