০৩. মেকাপ রুমটা বেশি বড় না
মেকাপ রুমটা বেশি বড় না। তবে পাচ-ছয়জন মানুষের বসার জায়গা হয়ে যায় অনায়াসে। একদিকের দেয়ালে ছাতের ঠিক নিচে বিশাল এক ভেন্টিলেটার। কাঠের ফ্রেমে কাচের পাল্লা লাগিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে ওটা। তাতে দড়ি বাধা। ইচ্ছে করলে দড়ি টেনে খোলা এবং বন্ধ করা যায় পাল্লাটা। ঘরের এককোণে মাটির টবে কয়েকটা গাছ।
দুটো অক্সিজেন সিলিন্ডার আগেই এনে রাখা হয়েছে ঘরে। আমাদের তিনটাও ধরাধরি করে এনে তুললাম। সাজিয়ে রাখলাম একদিকের দেয়াল ঘেঁষে।
চ্যালেঞ্জার বললেন, বদ্ধ ঘরে থাকলে ইথারের বিষ না ঢুকলেও আরেকটা অসুবিধে আছে। আমাদের নিঃশ্বাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড। হাতে সময় থাকলে সেটা বের করে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারতাম। অক্সিজেনের বাজে খরচ কমে যেত তাহলে। কিন্তু বড়ই তাড়াহুড়া। সেজন্যে ওই গাছগুলো এনে রেখেছি, সামান্য হলেও কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নেবে। এবং সেটুকুই লাভ।
এই ঘরেও একটা বড় জানালা আছে। বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। স্টেশনের দিক থেকে একটা ঘোর গাড়ি আসতে দেখলা। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে গাড়ি টেনে নিয়ে ওপরে উঠতে কষ্ট হচ্ছে ঘোড়াগুলোর। মান্ধাতার আমলের ওসব ছ্যাকরা গাড়ি শহর থেকে বিদেয় হয়ে এসে ঠাঁই নিয়েছে গ্রামাঞ্চলে।
পাহাড়ের গোড়ায় পেরামবুলেটরে বসিয়ে বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছে একজন আয়া।
কটেজগুসোর চিমনি দিয়ে হালকা কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ধীর গতিতে ভেসে চলে যাচ্ছে মাঠের ওপর দিয়ে। মাঠে ফসল কাটছে চাষীরা। গলফ-ফিল্ডে গলফ খেলোয়াড়েরাও আছে। কই, বিষক্রিয়ার কোন লক্ষণ তো ওদের মাঝে দেখা যাচ্ছে না?
আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন লর্ড জন। চ্যালেঞ্জার যাতে শুনতে না পান, ফিসফিস করে বললাম, দেখুন ওদের। সবাই তো শান্ত। বিষ কোথায়?
জানি না। উঁচু অঞ্চল তো, এখনও তাই বিষের ক্রিয়া শুরু হয়নি ভালমত…
তীক্ষ্ণ শব্দে বেজে উঠল টেলিফোন। বিরক্ত হয়ে হাত নাড়লেন চ্যালেঞ্জার, দূর, এ সময়ে আবার কে ডাকে! ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। ফিরে এসে বললেন, মেয়র। জানতে চাইল, বিষের ক্রিয়া শুরু হতে আর কত দেরি।
কি জবাব দিলেন? সামারলির প্রশ্ন। বললাম, নিজের যখন দম আটকে আসবে তখনই বুঝবেন বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এত্তোবড় হাঁদা এই মানুষগুলো, সহজ জবাবটাও জানে না। ওদিকে মেয়র হয়েছে! গাধা কোথাকার! যতসব অপদার্থের দল পৃথিবী শাসন করছে বলেই মানুষের কোন শান্তি নেই।
হাতঘড়িতে দেখলাম বেলা তিনটা। হঠাৎ চাষীদের মাঝে চঞ্চলতা দেখা গেল। গলফ খেলোয়াড়েরাও অস্থির। খেলায় মন নেই। এদিক ওদিক ছুটোছুটি শুরু করেছে। কয়েকজন হাতের ব্যাট ফেলে বাড়িমুখো দৌড় দিল।
আবার বেজে উঠল টেলিফোন। বেরিয়ে গেলেন চ্যালেঞ্জার। কয়েক সেকেন্ড পর চিৎকার করে ডাকলেন, ম্যালোন, তোমার ফোন।
দৌড়ে গেলাম। লন্ডন থেকে ম্যাকারডল করেছেন। আমি রিসিভার কানে ঠেকিয়ে সাড়া দিতে ওপাশ থেকে ভেসে এল উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, ম্যালোন? কি খবর? এদিকে তো সাংঘাতিককাণ্ড শুরু হয়েছে। রাস্তায় দলে দলে পড়ে যাচ্ছে মানুষ। উঠছে না আর। চ্যালেঞ্জারকে জিজ্ঞেস করো তো ব্যাপার কি?
জিজ্ঞেস করার দরকার নেই, আমিই জানি। ঠিকই বলেছিলেন তিনি, ইথারে গোলমাল। মারাত্মক বিষাক্ত হয়ে গেছে। সেজন্যেই মারা পড়ছে মানুষ। পৃথিবীর সব প্রাণী ধ্বংস হয়ে যাবে। কেউ বাঁচবে না।
ঠেকানোর কোন উপায়ই কি নেই?
না। মরতে আমাদের হবেই। মাথাটা ভারি লাগছে আমার, মিস্টার ম্যাকারডল। আপনার কেমন লাগছে জানি না। আর কোনদিন দেখা হবে না আমাদের। বিদায়।
চ্যালেঞ্জারের ধারণাই তাহলে সত্যি হলো…সময়মতই বিদায় জানিয়েছিলেন…মাথা আমারও ভারি লাগছে…কয় মিনিট আর টিকব কে জানে! বিদায়, ম্যালোন… খট করে একটা আওয়াজ হলো। চিৎকার করে উঠলাম হ্যালো, হ্যালো বলে। জবাবে কেবল ঘড়ঘড়ে একটা শব্দ।. ম্যাকারডলের দম নিতে কষ্ট হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। রিসিভারটা ধরে রাখতে পারেননি, হাত থেকে খসে টেবিলে পড়াতে খট করে শব্দ হয়েছে।
আরও কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করলাম। কোন সাড়া নেই। আস্তে করে রিসিভারটা ক্রেডলে নামিয়ে রাখলাম। বেদনায় ভারি হয়ে গেল মনটা। ওই গলা আর কোনদিন শুনতে পাব না।
মেকাপ রূমে চললাম আবার। আজব এক অনুভূতি হচ্ছে পানিতে ডুব দিয়ে বেশিক্ষণ দম আটকে রাখলে যেমন হয় অনেকটা সেরকম। গলা টিপে ধরেছে যেন কেউ। বুকে তীব্র চাপ। আঁঝ করে উঠল কান।
আমার পাশ দিয়ে ঝড়ের গতিতে ছুটে গেলেন চ্যালেঞ্জার। ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাস ফেলছেন। চোখ টকটকে লাল। খাড়া হয়ে উঠেছে চুল। সংজ্ঞাহীন স্ত্রীর ছোট্ট দেহটা কাঁধে ঝুলছে। পাশের একটা ঘর থেকে নিয়ে এসেছেন। মেকাপ রূমে ঢুকে গেলেন তিনি। কয়েক সেকেন্ড পর বেরিয়ে এলেন আবার। চিৎকার করে বললেন, জলদি গিয়ে মেকাপ রূমে ঢোকো! আমি অস্টিনকে ডেকে নিয়ে আসি! এত করে বললাম তাড়াতাড়ি আসতে…
বুঝতে অসুবিধে হলো না ইথার-বিষের আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে প্রবলভাবে। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দৌড় দিলাম মেকাপ রুমের দিকে। পা টলছে। শেষ পর্যন্ত ঘরে ঢুকতে পারব কিনা জানি না। কোনমতে দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই আমার হাত ধরে একটানে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন লর্ড জন। ওইয়ে দিলেন কার্পেটের ওপর। কয়েক হাত দূরে পড়ে আছে মিসেস চ্যালেঞ্জরের অচেতন দেহ। প্রফেসর সামারলি দ্রুতহাতে একটা অক্সিজেন সিলিণ্ডারের মুখ খুলছেন।
হিসহিস করে বেরোতে আরম্ভ করল প্রচণ্ড চাপে ইস্পাতের বোতলে ভরে রাখা অক্সিজেন। আধমিনিট পর বুকের চাপ কমে যেতে লাগল। সহজভাবে শ্বাস নিতে পারলাম। নড়ে উঠলেন মিসেস চ্যালেঞ্জার। হাসি ফুটল সামারলির মুখে।
অক্সিজেনে কাজ হচ্ছে। চ্যালেঞ্জারের অনুমান ভুল হয়নি।
কিন্তু তিনি সেই যে গেছেন তো গেছেনই, ফেরার আর নাম নেই।
কয়েক মিনিট পর ফিরলেন, তবে ধুকতে ধুকতে। ঘরে ঢুকেই গড়িয়ে পড়লেন কার্পেটের ওপর। লর্ড জনকে ইঙ্গিত করলেন দরজাটা লাগিয়ে দিতে। ঘরের অক্সিজেন মেশানো বাতাসে লম্বা দম নিলেন কয়েকবার। গলা থেকে বেরোনো ঘড়ঘড় শব্দটা কমে এল। বিড়বিড় করে বললেন, গাধাটাকে এত করে বললাম সময়মত চলে আসতে, এল না!
কার কথা বলছেন? জিজ্ঞেস করলেন লর্ড জন।
অস্টিন। ওর জীবনীশক্তি একেবারেই কম। বিষের প্রথম ধাক্কায়ই বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল। কপাল ঠুকে গেছে গাড়ির বাম্পারে। নাড়ি দেখলাম। থেমে গেছে। আর এনে কি লাভ? গলাটা বোধহয় ধরে এল চ্যালেঞ্জারের। তাড়াতাড়ি সেটা চাপা দিলেন অন্য কথা বলে, আপনারা কেমন আছেন?
কেউ জবাব দেবার আগেই নড়েচড়ে উঠলেন মিসেস চ্যালেঞ্জার। গোঙানি বেরোল মুখ দিয়ে। চোখ খুললেন। উঠে বসলেন ধড়মড়িয়ে। অবাক হয়ে তাকাতে লাগলেন সবার দিকে।
আমি তাকিয়ে আছি চ্যালেঞ্জারের দিকে। মনিবকে ঠিকই চিনেছিল অস্টিন। মুখে যতই গালাগাল করুন, যত খারাপ ব্যবহারই করুন মানুষের সঙ্গে, ভেতরটা তার সত্যি কোমল। নইলে নিজের জীবন বিপন্ন করে অনাত্মীয় একজন ড্রাইভারের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে ছুটে যান!
আমাদের পাঁচজনের মধ্যে চ্যালেঞ্জারের জীবনীশক্তি বেশি। অক্সিজেন ফুসফুসে ঢুকতেই মুহূর্তে চাঙা হয়ে গেলেন তিনি। স্ত্রীকে ধরে তুলে সোফায় বসিয়ে দিলেন। ফুঁপিয়ে উঠলেন মিসেস, জর্জ, আর কত দেরি?
জানি না। এত করে বললাম তোমাদেরকে সময়মত মেকাপ রূমে চলে এসো…আরেকটু হলেই তো শেষ হয়ে গিয়েছিলে। এতগুলো বছর একসঙ্গে কাটিয়ে শেষ বিদায়ের সময় আলাদা হয়ে যাওয়া কি ভাল লাগে! যাব যখন একসঙ্গেই যাব…জানো, অস্টিন মরে গেছে! ছুটে গিয়েছিলাম। বাঁচাতে পারলাম না, চোখের কোণে পানি চিকচিক করে উঠল চ্যালেঞ্জারের। আড়াল করার চেষ্টা করলেন না।
নতুন এক চ্যালেঞ্জারকে দেখছি। উদ্ধত, গোয়ার, দুর্মুখ মানুষটার এ আরেক রূপ। এটাই আসল। ভয়ানক কুৎসিত চেহারার মানুষটিকে কেন প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন ওই মহিলা, এতদিনে বুঝলাম। এত অপমানের পরও অস্টিন কেন চাকরি ছেড়ে যায়নি, তা-ও বোঝা গেল।
হিসহিস করে বেরিয়ে যাচ্ছে অক্সিজেন। এতক্ষণে সেটা খেয়াল করলেন চ্যালেঞ্জার। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কারও কোন কষ্ট : হচ্ছে?
মাথা নাড়লাম সবাই।
তারমানে স্বাভাবিক অক্সিজেন আছে এখন ঘরে। অহেতুক গ্যাস ছেড়ে রাখার কোন মানে নেই। যতটা সম্ভব কম খরচ করে টিকে থাকার চেষ্টা করতে হবে। তাতে আয়ু বাড়বে। চুপচাপ বসে থাকুন সবাই। নড়াচড়া কম করবেন। তাতেও অক্সিজেন কম খরচ হবে। কারও কোন অসুবিধে হলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন।
সিলিন্ডারের মুখ বন্ধ করে দিলেন চ্যালেঞ্জার।
উত্তেজিত উল্কণ্ঠায় কাটল প্রায় পাঁচ মিনিট। যে যার অনুভূতি সম্পর্কে সজাগ। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস চ্যালেঞ্জার, উফ, আবার আটকে আসছে…দম নিতে পারছি না!
বুকে চাপ অনুভব করলাম আমিও।
সিলিন্ডারের মুখ খুলে আবার খানিকটা অক্সিজেন ছেড়ে দিলেন চ্যালেঞ্জার। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, সাবমেরিনে সাদা ইঁদুর রাখে নাবিকরা। পানির নিচে ডুবে থাকার সময় বাতাসে অক্সিজেনের অভাব ঘটলে মানুষের আগে টের পায় এই ইঁদুর। সঙ্গে সঙ্গে ভাসিয়ে তোলা হয় সাবমেরিন। তুমি এখন আমাদের সাদা ইঁদুর। অক্সিজেনের অভাব সবার আগে তুমি টের পাচ্ছ। এখন কেমন লাগছে?
ভাল।
তারমানে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ এখনকার মত রাখলেই চলবে। প্রতি মিনিটে কতখানি অক্সিজেন দরকার, হিসেবটা বের করা গেলে আর কয় ঘণ্টা বাঁচব বুঝতে পারব। শুরুতে তাড়াহুড়া আর উত্তেজনায় কিছুটা বেশিই খরচ হয়ে গেছে।
তাতে খুব একটা ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন লর্ড জন। দুই হাত প্যান্টের পকেটে। ঘুরে তাকালেন এদিকে। মরবই তো। কয়েক ঘণ্টা বেশি বেঁচে লাভটা কি? অহেতুক মানসিক কষ্ট।
তাঁর সঙ্গে সুর মেলালেন মিসেস, লর্ড মন্দ বলেননি। নিশ্চিত জানি যখন মরবই, যন্ত্রণাটা ভোগ করছি কেন?
কর্কশ স্বরে বলে উঠলেন সামারলি। নিশ্চিত বলাটা ঠিক হবে না।
ভুরু কুঁচকে সামারলির দিকে তাকালেন লর্ড জন, আপনার কি এখনও আশা বেঁচে যাবেন?
তা জানি না। তবে কয়েক ঘণ্টা বাঁচাটাও লাভ। আত্মহত্যা করতে যাচ্ছি না আমি।
আমার দিকে তাকালেন চ্যালেঞ্জার, ম্যালোন, তোমার কি বক্তব্য? জানালা খুলে দেব?
না। মৃত্যুকে আমার ভীষণ ভয়।
আমার ভয়ও নেই, মানসিক যন্ত্রণাও নেই, গম্ভীর কণ্ঠে চ্যালেঞ্জার বললেন, তবে অক্সিজেন না ফুরানো পর্যন্ত আমিও ইচেছ করে মরতে যাচ্ছি না। পৃথিবীর দুর্গতি দেখার এ সুযোগ সারা দুনিয়ায় আমরাই শুধু পেয়েছি। এটা নষ্ট করতে আমি রাজি নই।
চেয়ার টেনে জানালার কাছে বসলাম চারজনে। পেছনে সোফায় গা এলিয়ে রইলেন মিসেস চ্যালেঞ্জার। ঘরের বাতাস ভারি ঠেকতে আরম্ভ করেছে। কমে যাচ্ছে অক্সিজেন।
উঁকি দিয়ে দেখলাম, জানালার ঠিক নিচে ছোট্ট উঠানে দাঁড়িয়ে আছে চ্যালেঞ্জারের গাড়ি। ওটার পাশে হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে অস্টিন। এতদিনে সত্যি চাকরি শেষ হলো ওর। হাতে হোস পাইপটা ধরাই আছে। অনর্গল পানি বেরোচ্ছে পাইপের মুখ দিয়ে। উঠানটা ভিজে চুপচুপে। কোণের দিকে দুটো ছোট ছোট গাছ। গোড়ায় কয়েকটা পালকের বল পড়ে আছে। প্রতিটি বলের গা থেকে আকাশমুখখা হয়ে আছে ঘোট ঘোট এক জোড়া পা। মহামৃত্যুর পরশ থেকে ছোটবড় কেউ বাদ যায়নি। পাখিরাও রেহাই পায়নি।
স্টেশনে যাওয়ার পথটার দিকে তাকালাম। পথের পাশে এক জায়গায় ঘাসের ওপর পড়ে আছে সেই আয়াটা। পেরামবুলেটরে শিশুটা অনড়। ছ্যাকরা গাড়ির ঘোড়াগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মাটিতে। কোচবাক্সে বসা বুড়ো কোচোয়ানের দেহটা যেন একটা কাকতাড়ুয়া পুতুল, ঘাড় এলিয়ে পড়ে আছে। জানালার পাশে বসা তরুণ আরোহীকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দরজাটা ভোলা। এক হাত দরজার হাতলে। শেষ মুহূর্তে বাইরে বেরোনোনার চেষ্টা করেছিল।
ফসলের খেতে পড়ে আছে কয়েকজন চাষী। গলফ-ফিল্ডে পড়ে আছে খেলোয়াড়েরা। বাড়ি পৌঁছার কপাল আর হয়নি। আকাশে একটা পাখিও নেই। শেষ বিকেলে পড়ন্ত রোদের আলোয় এমনিতেই প্রকৃতি হয়ে যায় কেমন বিষণ্ণ। আজ আরও বেশি লাগছে। কোথাও কোন শব্দ নেই। নিথর, নিস্তব্ধ চারদিক।
বাইরে বিষাক্ত বাতাস। ঘরে অক্সিজেন আছে ঠিকই, কিন্তু বড়জোর আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা, তারপরই বাইরে পড়ে থাকা ওই মানুষগুলোর মত আমরাও শেষ হয়ে যাব। আমাদের প্রাণহীন দেহগুলো লুটিয়ে পড়বে চেরি রঙের কার্পেটে।
এই দেখো, আগুন! চ্যালেঞ্জারের কথায় কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। আঙুল তুলে দেখালেন।
একটা খামার বাড়িতে আগুন লেগেছে নিশ্চয় চুলা থেকে। নেভানোর কেউ নেই। ছড়িয়ে পড়ছে। আরও ছড়াবে। পোড়ানোর মত যা পাবে সব ভস্ম না করে দেয়া পর্যন্ত জ্বলবে। তা জ্বলুক। মানুষই যদি না থাকল বাড়িঘর দিয়ে কি হবে।
সামারলির দিকে তাকালেন চ্যালেঞ্জার, একটা ব্যাপার বুঝতে পারছেন? তাঁর কণ্ঠে উত্তেজনার আভাস।
ফিরে তাকালেন সামারলি, কি?
আগুন জ্বলছে!
সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
কিছু বুঝতে পারছেন না?
কপাল কুঁচকে গেল সামারশির, কি বুঝব?
এ জন্যেই মাথামোটা বলি আপনাকেও। কেন বুঝতে পারছেন না?
দেখুন, এ সময় ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না,কর্কশ কণ্ঠ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বিফল হলেন সামারলি। যা বলার পরিষ্কার করে বলে ফেলুন।
তাহলে স্বীকার করছেন আপনার চেয়ে আমার বুদ্ধি বেশি?
অন্য সময় হলে হয়তো খুব ধারাল একটা জবাব দিতেন সামারলি। কিন্তু এখন কি ভেবে তর্কাতর্কির মধ্যে গেলেন না। বেশি কি কম, জানি না। তবে আপনি কি বলতে চাইছেন, সেটা বুঝতে পারছি না।
এত সহজ কথাটা কেন যে মাথায় ঢুকছে না…যাকগে আমার মত ব্রেন তো আর সবার নেই। বলুন তো, আগুন জ্বলতে হলে কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি দরকার।
এইবার বুঝতে পারলেন সামারলি। চেঁচিয়ে উঠলেন, অক্সিজেন!
হ্যাঁ, অক্সিজেন। আগুন যখন জ্বলছে, বোঝা যাচ্ছে অক্সিজেন আছে বাতাসে। এ ভাবে মরে যাওয়ার কথা নয় মানুষ কিংবা অন্যান্য প্রাণীর। ইথারের বিষটা কোন পর্যায়ের পরীক্ষা করতে পারলে বোঝা যেত অঘটনটা কেন ঘটল।
এখন আর করেও কোন লাভ নেই। মৃত মানুষকে কোনভাবেই বাঁচিয়ে তোলা যাবে না।
জবাব দিলেন না চ্যালের। দাড়িতে আগুল চালাতে চালাতে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। বোঝা যাচ্ছে তার বিশাল খুলির ভেতরের ভারি মগজটায় এখন তুমুল গতিতে ভাবনা চলেছে। পৃথিবীবাসীকে বাঁচিয়ে তোলার কোন উপায় খুজছেন হয়তো।
জঙ্গলের মাথায় ধোঁয়া দেখা গেল। লাফিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন লর্ড জন, ট্রেনের ধোঁয়া! চলছে কি করে? ড্রাইভার মরেনি?
এঞ্জিনের গুমগুম আওয়াজটা ঘরে বসেও শুনতে পাচ্ছি। বিপুল গতিতে ছুটে চলেছে মেলট্রেন। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি স্টেশনে দাঁড়ানো একটা মালগাড়ি। এক্সপ্লেনটাও কোন রকম সিগন্যাল না পেয়ে থামছে না, একই লাইনে ছুটছে। এতক্ষণে তো মালগাড়িটাকে দেখে ফেলার কথা ড্রাইভারের। গতি কমানোর চেষ্টা করার কথা। করছে না। তারমানে মারা গেছে। আপনাআপনি ছুটছে ট্রেন। নিয়ন্ত্রণের জন্য কেউ নেই। তীব্র গতিতে ছুটে গিয়ে মালগাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা খেল; ভয়াবহ শব্দ। এতদূরেও থরথর করে কেঁপে উঠল বাড়িঘর। দেখতে পেলাম, চারদিকে ছিটকে পড়ল লাকড়ি, ইস্পাতের টুকরো, খণ্ডবিখণ্ড মানুষের দেহ। দুটো গাড়ির এঞ্জিন গেঁথে গেল পরস্পরের সঙ্গে। ফুলঝুরি হয়ে ঝরে পড়ল এগ্রিনের জ্বলন্ত কয়লা।
লর্ড জনের চিৎকার শুনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মিসেস চ্যালেঞ্জার। মর্মান্তিক দৃশ্যটা সহ্য করতে পারলেন না। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলেন, উফফ! এতগুলো মানুষ!
দুঃখ কোরো না, স্ত্রীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কোমল কণ্ঠে বললেন চ্যালেঞ্জার। মারা ওরা আগেই গেছে, ভিক্টোরিয়া স্টেশন থেকে রওনা দেয়ার পর। এখন শুধু লাশগুলোকে ছিটকে পড়তে দেখলে।
অনুমান করতে কষ্ট হলো না, এ ধরনের কাণ্ড এখন সারা পৃথিবীতেই ঘটছে। বাড়িঘরে আগুন লাগছে, ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট করছে, তীরের কাছে পৌঁছে যাওয়া চলমান জাহাজ গুতো খেয়ে চুরমার হচ্ছে, আরও কত ধরনের দুর্ঘটনা যে ঘটছে তার কোন সীমা-সংখ্যা নেই।
আমার মনের কথা পড়তে পেরেই যেন বিষণা শুকনো হাসি হাসলেন সামারলি। বললেন, কয়লা খনিতে শ্রমিকরা নিজেরাই কয়লা হয়ে যাবে। আজ থেকে বহু লক্ষ বছর পর এত মানুষের লাশ দেখে চমকে যাবে তখনকার ভূতত্ত্ববিদেরা। কার্বনিফেরাস স্তরে মানুষ কেন কয়লা হয়ে থাকবে, এ নিয়ে জোর আলোচনা চলবে বিজ্ঞানী মহলে। কেউ জানবে না কিছু। বুঝতে পারবে না। শুধুই অবাক হবে।
হবে না, লর্ড জন বললেন। আমরাই শেষ প্রজন্ম। পৃথিবীতে আর কোনদিন মানুষ জন্মাবে না। মরা গ্রহে পরিণত হবে এটা। কোন ধরনের একটি প্রাণীও যদি বেঁচে না থাকে, নতুন প্রাণ আসবে কোত্থেকে?
তুল বললেন লর্ড, জবাব দিলেন চ্যালেঞ্জার। পৃথিবীর জন্মের পর তো দীর্ঘদিন কোন প্রাণী সৃষ্টি হয়নি। তারপর কোটি কোটি প্রাণীতে ভরে গেল। আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছি বটে, কিন্তু প্রাচীন নিয়মে আবার প্রাণের সৃষ্টি হবে। অবশ্য যদি ইথারের বিষ বলয় থেকে বেরোতে পারে পৃথিবী।
সত্যি এ কথা বিশ্বাস করেন আপনি? সন্দেহ প্রকাশ করলেন সামারলি।
করি! গম্ভীর হয়ে গেলেন চ্যালেঞ্জার। যেটা করি না, সেটা বলি না। কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন সামারলির দিকে।
প্রমাদ গুণলাম। এই ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যেও দুজনের বাঁকযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে নাকি?
আমার আশঙ্কাই ঠিক হলো।
জন্মাবে যে তার কি প্রমাণ আছে? সামারলির গলায় তিক্ততা।
কোটি কোটি বছর আগে প্রাণশূন্য পৃথিবীতে যে প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছিল, সেটাই প্রমাণ।
এটা কোন প্রমাণ হলো না। স্রেফ চাপাবাজি।
কি শুরু করলেন আপনারা! রেগে গেলেন লর্ড জন। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিয়ে এখন চেঁচামেচি করে কোন লাভ আছে? অহেতুক অক্সিজেন খরচ।
তাতে আপনার কি? আরও খেপে গেলেন চ্যালেঞ্জার। আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। কোন কাণ্ড বাধিয়ে বসেন! একজন কিছু না জেনে না বুঝে আমার সঙ্গে তর্ক করতে থাকবে, আর আমি তার জবাব দেব না?
না, দেবেন না, শীতল কণ্ঠে বললেন লর্ড জন, কারণ এখন আর ওসবের কোন প্রয়োজন নেই। মরার পর আপনার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কোন কাজে আসবে না। বরং মৃত্যুর প্র সত্যি আর কোন জগৎ আছে কিনা সেটা নিয়ে মাথা ঘামান।
এ কথায় কাজ হলো। চুপ হয়ে গেলেন দুই বিজ্ঞানী। তবে বেশিক্ষণ মুখ বন্ধ রাখতে পারলেন না চ্যালেঞ্জার। আবার শুরু করলেন আগের আলোচনা, প্রফেসর সামারলি, গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। ওরা মরছে না। ইথার ওদের কোন ক্ষতি করতে যদি না পারে তাহলেই তো উদ্ভিদকোষ থেকে আবার প্রাণী জন্ম নেবে।
তাতে আমাদের কি? প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করল, আমরা তো আর তখন বেঁচে থাকব না। কিন্তু জানি রেগে যাবেন, এই ভয়ে চুপ করে রইলাম। বাইরে তাকালাম। পাহাড়ের ঢালে যে বাড়িটাতে আগুন লেগেছিল, বাতাস সেটা থেকে আগুন উড়িয়ে নিয়ে আরেকটাতে লাগিয়েছে। খড়ের গাদা পেয়েছে বোধহয়। দাউ দাউ করে জ্বলছে।
ভয়ঙ্কর অবস্থা! কম্পিত গলা লর্ড জনের। তাঁকে এমন বিহ্বল হয়ে পড়তে দেখিনি জীবনে।
খালি বাড়ি পুড়ছে, ভয়ঙ্করের আর কি হলো, আমি বললাম।
পুড়কগে, সেটা নিয়ে ভাবছি না। কি আগুন যে ভাবে ছড়াচেই, এদিকেও চলে আসতে পারে। এ বাড়িটায় আগুন লাগলে জ্যান্ত পুড়ে মরব। বেরোতে গেলে মরব ইথারের বিষে।
মিসেস চ্যালের বললেন, জর্জ, আমার মাথা আবার দপদপ করছে। শ্বস নিতে পারছি না।
অক্সিজেন কমে গেছে।
উঠে গিয়ে সিলিণ্ডারের মুখের চাবি ঘোরালেন চ্যালেঞ্জার। মিটারের দিকে তাকিয়ে বললেন, শেষ। এটা খালি। একটাতে তিন ঘণ্টা। এখন বাজে আটটা। বাকি চারটে সিলিণ্ডারে চলবে আরও বারো ঘণ্টা। রাতটা ভালই কাটবে আশা করছি। মরব কাল সকাল নাগাদ। জীবনে আর একবার মাত্র সূর্যোদয় দেখতে পাব।
এগিয়ে গিয়ে ছিটকানি খুলে দরজা সামান্য ফাঁক করলেন চ্যালেঞ্জার। বাইরের বাতাস ঢুকতেই শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেল সবার। আর্তনাদ করে উঠলেন মিসেস চ্যালেঞ্জার। ইথার এখনও বিষাক্ত। তাড়াতাড়ি দরজা লাগিয়ে দিলেন আবার চ্যালেঞ্জার। জোরে জোরে দম নিয়ে সোফায় হেলান দিলে আবার মিসেস। রক্ত ফিরে এল মুখে।
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন চ্যালেঞ্জার। বললেন, শুধু অক্সিজেন বাচিয়ে রাখতে পারে না মানুষকে। পেটও কিছু চায়।
ঘরে খাবার জমানো আছে। কয়েক মিনিট লাগল বের করতে। টেবিলে সাজিয়ে ফেললেন মিসেস চ্যালেঞ্জার। ঠাণ্ডা মাংস, কটি, আচার আর এক বোতল মদ। এতক্ষণ উত্তেজনায় চুপ করে ছিল পেট, খাবার দেখে চনমন করে উঠল। অস্বাভাবিক খিদে।
খেতে বসে কারণটা ব্যাখ্যা করে বোঝালেন চ্যালেঞ্জার, দারুণ আবেগউত্তেজনায় দেহের অণু জখম হয়। অতিরিক্ত দুঃখ অথবা আনন্দের পর তাই মানুষের খুব খিদে পায়।
সেজন্যেই বুঝি কেউ মারা গেলে তার শেষকৃত্যের পর ভোজের আয়োজন করে লোকে? জানতে চাইলাম।
হবে হয়তো।
ছুরি দিয়ে ঠাণ্ডা মাংস কাটতে কাটতে বললেন লর্ড জন, বুনো অসভ্যেরাও কিন্তু শোকতাপের পর বেশি খায়। আইনী নদীর তীরে একবার দেখেছি সর্দারকে মাটি চাপা দিয়ে এসে আস্ত এক জলহস্তী খেয়ে ফেলেছে গাঁয়ের লোকে। নিউগিনির জংলীরা শোকের তাড়নায় যার জন্যে শোক তার লাশটাই খেয়ে ফেলে। নিজের মাকেও বাদ দেয় না।
কোন কোন ক্ষেত্রে মানুষ পশুরও অধম, মন্তব্য করলেন সামারলি।
মায়ের কথায় আমার নিজের মার কথা মনে পড়ল। এতক্ষণ বেঁচে নেই, জানা কথা। কল্পনায় দেখলাম, আয়ারল্যান্ডের এক কটেজে জানালার ধারে পিঠউঁচু চেয়ারে নেতিয়ে আছে মা। গায়ে শাল জড়ানো। কোলে লেসের টুপি, পাশে চশমা আর বই। নিজের অজান্তেই চোখ দুটো ভিজে উঠল। দীর্ঘশ্বাস চাপতে পারলাম না। বাইরে রাত নেমেছে। অন্ধকারে ঢেকে গেছে পৃথিবী কালোর পটভূমিকায় দক্ষিণের গোলাবাড়িটার কমলা-লাল আগুনকে মনে হচ্ছে দোজখের আগুন। জীবনে তো ধর্মকর্ম কিছু করিনি। আর কয়েক ঘণ্টা পর পরপারের ওরকমই কোন অগ্নিকুণ্ডে গিয়ে প্রবেশ করতে হতে পারে, ভাবনাটা মাথায় আসতেই মায়ের দুঃখ ভুলে গেলাম। অজানা আতঙ্কে অসাড় হয়ে এল হাত-পা। কখনও যা করিনি সেটাই করলাম-মনে মনে ঈশ্বরের নাম জপ করতে লাগলাম।
আগের পর্ব :
০১. নিউজ ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জ
০২. ডাইনিং রূমে খাওয়া শেষ করে
পরের পর্ব :
০৪. আমি ঈশ্বরকে ডাকছি
০৫. সামুদ্রিক তাজা হাওয়া
০৬. রোদারফিল্ডে ফিরেছি
০৭. ডিসইনটিগ্রেশন মেশিন
০৮. ধরণীর চিৎকার