০১. নিউজ ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জ
বিষবলয় – স্যার আর্থার কোনান ডয়েল
অনুবাদ : রকিব হাসান
প্রথম প্রকাশ : ১৯৮২
০১.
২৭ আগস্ট, শুক্রবার।
নিউজ ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জ মিস্টার ম্যাকারডলের কাছে তিন দিনের ছুটি চাইলাম। ছুটির কথা শুনে আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন তিনি। একপাশের লালচে হয়ে আসা চুলের গোছা আঙুলে পেঁচিয়ে আবার খুললেন। তারপর নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেন প্রকাশ করলেন অনিচ্ছাটা, কিন্তু এখন তো ছুটি দেয়া যাবে না। একটা জরুরী কাজ সারতে হবে তোমাকে। গল্পের প্লট জোগাড় করে আনতে হবে। আমার জানামতে সেটা তোমার চেয়ে ভাল আর কেউ পারবে না।
দমে গেলাম। গল্প লিখে লিখে তো বিরক্ত হয়ে গেছি। আর কত? একজনকে কথা দিয়ে ফেলেছি, যেতেই হবে। আমাকে ছাড়া যদি আপাতত চলে…
চলবে না, সাফ বলে দিলেন ম্যাকারডল।
খিঁচড়ে গেল মেজাজ। মুখের ভাব নির্বিকার রাখলাম। মনে মনে গাল দিলাম নিজের পেশাকে। কোন কুক্ষণে যে খবরের কাগজে ঢুকেছিলাম! যদি ঘুণাক্ষরেও জানতাম, সাংবাদিকের কোন ছুটি নেই, খবর ফসকে যাওয়ার ভয়ে চব্বিশ ঘণ্টা হুঁশিয়ার থাকতে হয়, তাহলে কোন পাগলে এ কাজ করত!
মনে মনে নিজের আর ম্যাকারডলের মুৎপাত করে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে জিজ্ঞেস করলাম, গল্প জোগাড়ের জন্যে কোথায় যেতে হবে?
রোদারফিল্ড।
মানে?
মানে প্রফেসর চ্যালেঞ্জার।
চ্যালেঞ্জার! আমি অবাক।
হ্যাঁ। ডেইলি কুরিয়ারের অ্যালেক সিম্পসন গিয়েছিল তার বাড়িতে। কথা বলতে। প্রফেসর কথা তো বললেনই না, বেচারার কোটের কলার চেপে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন বড় রাস্তায়, ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। তবে আমার ধারণা, তোমাকে কিছু বলবেন না চ্যালেঞ্জার।
তা বলবেন না, হালকা হয়ে গেল মন। প্রফেসরের সঙ্গে দেখা করার জন্যেই ছুটি চেয়েছিলাম। তিন বছর আগে হারানো পৃথিবী অভিযানের তৃতীয় বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্যে খবর পাঠিয়েছেন প্রফেসর। শুধু আমাকেই নয়, গত দুবারের মত প্রফেসর সামারলি আর লর্ড জনকেও। তারাও অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছেন। কিন্তু ম্যাকারডলের কাছে কথাটা ভাঙলাম না। পেয়ে বসবে তাহলে।
সেজন্যেই তোমাকে পাঠাতে চাই প্রফেসরের ওখানে, হাতে হাত ঘষছেন ম্যাকারডল। চশমার কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে উজ্জ্বল দুই চোখ। আমি জানি, কেউ যদি চ্যালেঞ্জারের পেটের কথা বের করতে পারে তো সে তুমি।
পেটের কথা। আবার কোন কাণ্ড করেছেন প্রফেসর?।
কেন, আজকের টাইমস দেখোনি? চ্যালেঞ্জারের লেখা অদ্ভুত একটা চিঠি ছাপা হয়েছে।
নাহ। সময় পাইনি, বিশেষ আগ্রহ বোধ করলাম না। যাচ্ছি তো প্রফেসরের কাছেই। জরুরী কোন ব্যাপার হলে তিনি নিজেই বলবেন।
মেঝেতে পড়ে থাকা কাগজটা নিচু হয়ে তুলে নিলেন ম্যাকারডল। ঠেলে দিলেন আমার দিকে। লাল দাগ দিয়ে রেখেছি। পড়ো। দেখো মাথায় কিছু ঢোকে কিনা।
চ্যালেঞ্জার যে ভাবে লিখেছেন, ঠিক সেভাবেই ছেপে দেয়া হয়েছে চিঠিটা:
ডিয়ার স্যার,
আপনার কাগজে সম্প্রতি প্রকাশিত জেমস উইলসন ম্যাকফেলের চিঠিটা পড়ে হাসব না কাদব বুঝতে পারলাম না। আহা, কি লেখা! গ্রহ এবং স্থির নক্ষত্রের বর্ণালীতে ফ্রনহোফার লাইন কেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, কি ব্যাখ্যাই না দিয়েছেন ভদ্রলোক! অকাট মূৰ্থ না হলে এ রকম ব্যাখ্যা দেয় কেউ। তার মতে কোন গুরুতুই নেই বিষয়টার। অথচ একটু যদি বুদ্ধি (আমার ধারণা সেই বুদ্ধিটা তার নেই) খরচ করতেন, আরেকটু তলিয়ে ভাবতে পারতেন, পিলে চমকে যেত। এই ঝাপসা হয়ে যাওয়ার ওপর নির্ভর করছে এখন পুরো পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। সবাই যাতে বুঝতে পারে সেজন্যে যতটা সম্ভব সহজ করে বলছি।
মহাশূন্যে ঘুরপাক খাচ্ছে আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলো, জানে সবাই। আমাদের পৃথিবীও ঘুরছে। সব দিক থেকে ঘিরে আছে একে ইথারের মহাসমুদ্র। ফ্রনহোফার লাইন আবছা হয়ে যাওয়া অথবা সরে যাওয়ার একটাই মানে, কোন ধরনের ব্যাপক মহাজাগতিক পরিবর্তন আসন্ন, এবং তার কারণ হলো এই ইথার-মহাসমুদ্রে মারাত্মক গোলমাল। কোন কারণে এর স্বচ্ছতা নষ্ট হয়েছে, যার জন্যে ঝাপসা দেখাচ্ছে লাইনগুলো। আমার বিশ্বাস, ভয়াবহ কোন বিপদে পড়তে যাচ্ছে পৃথিবী, যেটা থেকে কোন প্রাণীরই নিস্তার নেই। এর প্রমাণও পেয়ে গেছি আমি ইতিমধ্যে। মগজ থাকলে আমার বন্ধু মিস্টার জেমস উইলসন। ম্যাকফারসনেরও নজরে পড়ে যেত গণ্ডগোলগুলো।
আজকেই খবরের কাগজে বেরিয়েছে, সুমাত্রার আদিবাসীদের মাঝে একটা রহস্যময় রোগ অস্বাভাবিক দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। কেন, কি এর কারণ, কেউ কি কিছু ভেবেছেন? আমি ভেবেছি। সেটা আপাতত বলার দরকার মনে করছি না। বললে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না, হাসাহাসি করবে। তার চেয়ে যখন বিপদটা আসে, তখনই জানুক সবাই। অবশ্য বাঁচানোর কোন উপায় যদি আবিষ্কার করতে পারতাম, তাহলে এখনই বলতাম।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সুমাত্রার আদিবাসীদের মত কিংবা অন্য কোন রহস্যময় রোগ খুব শীঘ্রি আমাদেরও ধরতে পারে। আদিবাসীরা আগে আক্রান্ত হয়েছে তার কারণ ওরা সরল-সোজা মানুষ। ইউরোপের মানুষের মত জটিল, প্যাঁচাল চরিত্রের নয়। জটিল মানুষদের রোগে কাবু করতেও সময় লাগে বেশি।
একটা কথা নিশ্চিত জেনে রাখুন, বিপদ আসছে। ভয়ানক বিপদ। কল্পনাও করতে পারবেন না, এমনই ভয়ঙ্কর। আমি যে বাজে কথা বলি না, অতীতে এর বহু প্রমাণ পেয়েছেন। সাবধান করছি না। করে লাভ নেই। যে বিপদ আসছে, কোন উপায় নেই সেটা থেকে রেহাই পাওয়ার। বিদায়!
জর্জ এডোয়ার্ড চ্যালেঞ্জার
ব্রায়াস,
রোদারফিল্ড।
পড়া শেষ করে মুখ তুললাম।
কি বুঝলে? জিজ্ঞেস করলেন ম্যাকারডল।
কিছুই না। খুব সহজ ভাষায় স্পষ্ট করেই লিখেছেন প্রফেসর, ভাষা না বোঝার কোন কারণ নেই। কিন্তু কি যে বোঝাতে চেয়েছেন, সেটা তাকে জিজ্ঞেস করা ছাড়া বুঝতে পারব না। তা ছাড়া চিঠির শেষে বিদায় শব্দটাই বা লিখলেন কেন?
তোমার ধারণা; কি হতে পারে?
মহামারীতে আক্রান্ত হবে পৃথিবী। তাতে প্রফেসর চ্যালেঞ্জারসহ আমরা সবাই মারা পড়ব। পৃথিবীর কোটি কোটি লোক মারা যাবে। সেজন্যে আগেভাগেই বিদায় জানিয়ে রেখেছেন।
লোকটা আসলেই পাগল, চিন্তিত ভঙ্গিতে কাঁচের নলে সিগারেটের একমাথা ঢোকালেন, ম্যাকারডল। মুখ তুলে তাকিয়ে আচমকা ছুঁড়ে দিলেন প্রশ্নটা, ফ্রনহোফার লাইন কি জানো?
মাথা নাড়লাম, না, জানি না। জানার প্রয়োজনও মনে করি না।
আমিও করতাম না, যদি চ্যালেঞ্জারের চিঠিটা না পড়তাম। মনের মধ্যে খুতখুঁত করতে লাগল। চ্যালেঞ্জার পাগল হলেও অসম্ভব বুদ্ধিমান। বাজে কথা বলেন না। নিশ্চয় সৌরজগতে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, যেটা পৃথিবীর ক্ষতি করতে পারে। নেহাত কৌতূহলের বশে একজন পরিচিত বিজ্ঞানীকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম। ফ্রনহোফার লাইন সম্পর্কে অনেক কথাই বলল সে, কিছুই মাথায় ঢুকল না। এটুকুই কেবল মনে আসছে—সূর্যরশ্মির ব্যান্ড স্পেকট্রামে যে সব সঞ্চরমান কালো রেখা দেখা যায়, সেগুলোকে বলে ফ্রনহোফার লাইন। জার্মান পদার্থ বিজ্ঞানী জোসেফ ফন ফ্রনহোফার এই লাইনের আবিষ্কারক, তার নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে এর।
তা তো বুঝলাম, কিছুই না বুঝে বললাম, কিন্তু এর সঙ্গে মহামারীর সম্পর্ক কোথায়?
হাত ওল্টালেন ম্যাকারডল। আমি কি জানি! সেটা জানার জন্যেই তোমাকে পাঠাতে চাইছি চ্যালেঞ্জ৷রর কাছে।
সুমাত্রার ঘটনাটা কি? জানতে চাইলাম।
বিরক্ত হলেন ম্যাকারডল। নাহ, কোন খবরই রাখো না দেখছি! অথচ খবরের কাগজে কাজ করো…
সারাদিনই তো একটা না একটা কাজ দিয়ে রাখেন, মুখের ওপর বলে দিলাম। সেগুলো সারতেই জান কাবার। অন্য খবর রাখব কখন?
কাচের নলে ঠোঁট লাগিয়ে জোরে সিগারেটে টান দিলেন ম্যাকারডল। নাক দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, সুমাত্রার আদিবাসীদের নাকি এক আজব রোগে ধরেছে। কোন রকম ইঙ্গিত না দিয়ে মাথা ঘুরে হঠাৎ করে পড়ে যায়। কেউ হুঁশ ফিরে পায়, কেউ পায় না। মুহূর্তে শেষ। এর সঙ্গে মহাজাগতিক পরিবর্তনের যে কি সম্পর্ক, সেটা একমাত্র চ্যালেঞ্জারই বলতে পারেন। এ ঘটনার সঙ্গে মিলে যায় এ রকম আরেকটা অদ্ভুত খবর আছে। একটু আগে সিঙ্গাপুর থেকে টেলিগ্রাম এসেছে, সুন্দা প্রণালীর লাইট হাউসগুলো অচল। কারণ ওগুলোকে চালানোর মত কোন লোক নেই। সুমাত্রার আদিবাসীদের মতই হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। যারা হুশ ফিরে পেয়েছে তারাও অসুস্থ। ফলে গতরাতে অন্ধকারে পথ হারিয়ে ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা লেগে ধ্বংস হয়ে গেছে দুটো জাহাজ।
এর সঙ্গে ইথারের কি সম্পর্ক?
সেটাই জানতে হবে তোমাকে। প্রফেসরের কাছ থেকে গিয়ে জেনে এসো বিপদটা কি। পত্রিকায় ছেপে দেব। আগে থাকতে মানুষকে সাবধান করা গেলে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব হতে পারে।
কিন্তু প্রফেসর তো বললেন কোন উপায় নেই বাঁচানোর, থাকলে তিনি এখনই বলতেন।
তবু, গিয়ে দেখো না কি বলেন।
সম্পাদকের ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে এলাম। ডিসপ্যাচ ক্লার্ক একটা টেলিগ্রামের খাম ধরিয়ে দিল আমার হাতে। বাড়ির ঠিকানায় গিয়েছিল। সেখানে আমাকে না পেয়ে অফিসে দিয়ে গেছে পিয়ন। খুলে পড়লাম। মাত্র কয়েকটা শব্দ:
ম্যালোন, ১৭ হিল স্ট্রটি, স্ট্রেটহ্যাম
অক্সিজেন আনবে। চ্যালেঞ্জার।
অক্সিজেন আনব মানে! কোনও ধরনের রসিকতা? তাই বা কেন করবেন? যে ভঙ্গিতে চিঠি লিখেছেন পত্রিকার সম্পাদককে, তাতে বোঝা যাচ্ছে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। রসবোধ তার নেই, তা নয়, বরং অনেকের চেয়ে বেশিই আছে, তবু এ রকম একটা মুহূর্তে অকারণ রসিকতা প্রফেসর চ্যালেঞ্জার অন্তত করবেন না।
অক্সিজেন কেন নিতে বলেছেন বুঝতে পারলাম না। নতুন কোন পরীক্ষা করছেন নাকি? যে জন্যেই হোক, খবর যখন পাঠিয়েছেন, না নিয়ে পারব না। খালি হাতে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ানোর সাহস আমার নেই।
ঘড়ি দেখলাম। ট্রেন ছাড়তে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি। টেলিফোন গাইডবুকথেকে একটা অক্সিজেন কোম্পানির ঠিকানা টুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ট্যাক্সি ডেকে অক্সফোর্ড স্ট্রীটে যেতে বললাম ড্রাইভারকে।
নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে ট্যাক্সি থেকে নেমে দেখি সামনের বাড়িটার গেট দিয়ে বেরোচ্ছে দুজন লোক। একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার ধরাধরি করে নিয়ে আসছে। ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটা ঘোড়ার গাড়ি। সিলিন্ডারটা ওই গাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলল ওরা। ওরা বেরোনোর একটু পরই গেট দিয়ে বেরিয়ে এলেন যিনি, তাকে এখানে দেখে অবাক হয়ে গেলাম; তালপাতার সিপাই, শুকনো-ঢ্যাঙা দেই। মুখে ছাগল-দাড়ি। প্রফেসর সামারলি। হারানো পৃথিবী অভিযানে ইনিও আমাদের সঙ্গী হয়েছিলেন।
আপনমনে বকবক করতে করতে ঘোড়াগাড়িটার কাছে যাচ্ছেন সামারলি। আমার গায়ের ওপর এসে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন, কি হলো? দেখে চলতে পারেন না••আরে, একি, ম্যালোন যে! এখানে কি?
আমারও তো একই প্রশ্ন: আপনি এখানে?
ম্যালোনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন সামারলি, তোমাকেও অক্সিজেন নিতে বলেছে নাকি? টেলিগ্রাম পেয়েছ?
পেয়েছি।
ইচ্ছে ছিল না, তবুও নিচ্ছি। দেখা যাক কি করে। চ্যালেঞ্জারকে নিয়ে পারা গেল না আর। ওর বোঝা উচিত ছিল, আমি তার চেয়ে কম ব্যস্ত নই। আমাকে অক্সিজেন নিয়ে যেতে বলা…রীতিমত অন্যায়! কি বলো? ও নিজে অক্সিজেন কিনতে এলে কি ইজ্জত যেত?
হয়তো খুব বেশি জরুরী কোন কাজে ব্যস্ত তিনি। নিজের লোক মনে করে আমাদের কাঁধেই দায়িত্বটা চাপিয়েছেন।
হবে হয়তো। ঠিক আছে, নিয়ে যখন ফেলেছি, ফেলেছি। তবে তোমার আর নেয়ার দরকার নেই। বড়সড় দেখে নিয়েছি একটা। ওতেই চলে যাবে।
আমার তা মনে হয় না। তাহলে দুজনের কাছে টেলিগ্রাম পাঠাতেন না। অকারণে কিছু করেন না তিনি। কথামত দুটো না নিয়ে গেলে রেগে যাবেন।
হুঁ, বিরক্তিতে নাক কুঁচকালেন সামারলি। আনো তাহলে আরেকটা। আমার গাড়িতেই তোলো।
সিলিন্ডার নিয়ে এসে দেখি আপন মনে গজগজ করছেন প্রফেসর। আমাকে দেখে রেগে উঠলেন, অত দেরি? জলদি চলো! ট্রেন না ফেল করে বসি!
তার সঙ্গে এগোলাম। গাড়িতে উঠতে যাব, পেছন থেকে ডাক দিল আমার ট্যাক্সিওয়ালা, এই যে মিস্টার, চলে তো যাচ্ছেন! ভাড়াটা?
এহহে, মনেই ছিল না। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে টাকা বের করে দিলাম। অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্যে আসল ভাড়ার চেয়ে বেশি দিলাম। কিন্তু খুশি হলো না ও। বিড়বিড় করে কি যেন বলতে লাগল। মনে হলো গাল দিচ্ছে আমাকে।
কি বলছে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, ফিরে তাকাতে হলো সামারলির চিঙ্কারে। যে ছোকরা দুটো সিলিন্ডার বয়ে এনেছে, ওরা ঝগড়া করছে। পারিশ্রমিক যা দেয়া উচিত, তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রফেসর, তাতেও মন ভরছে না ওদের। ঠিক আমার ট্যাক্সিওয়ালার অবস্থা। এক কথা দুকথা থেকে শেষে ভীষণ চটে গেলেন প্রফেসর। ধরে মারেন আরকি দুই ছোকরাকে। ওরাও মারমুখো হয়ে উঠল।
একজন ভদ্রলোককে অপমান করবে দুই কুলি, এটা সহ্য করতে পারল না প্রফেসরের গাড়ির কোচোয়ান। লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল সে। চেপে ধরল এক ছোকরার শার্টের কলার। ঘুসি তুলে এগিয়ে এল আরেক কুলি।
তাড়াতাড়ি লাফ দিয়ে গিয়ে পড়লাম ওদের মাঝে। আরও খারাপ কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই বাধা দিলাম। অনেক কষ্টে থামালাম। দুই ছোরার হাতে আরও কিছু পয়সা গুঁজে দেয়ার পর সরে দাঁড়াল, তবে ফোঁসফোসানি থামল না ওদের। রাগ যেন কমতেই চায় না। ঘটনাটা কি? মেজাজ এমন গরম কেন আজ সবার? কথায় কথায় খেপে উঠছে!
প্রফেসর সামারলির গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি ছাড়ল কোচোয়ান। কুলির সঙ্গে গোলমাল করে তার মেজাজও গরম হয়ে গেছে। বকর বকর করছে আর অযথা চাবুক মারছে ঘোড়াগুলোকে। ভয়ঙ্কর গতিতে এলোপাতাড়ি ছুটছে জানোয়ারগুলো। লণ্ডন শহরের রাস্তায় এ ভাবে গাড়ি চালানো আত্মহত্যার সামিল। উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগলে আর রক্ষা নেই। অনেক বলেও ওর এই বেপরোয়া চালানো থামাতে পারলাম না।
রাস্তার আশেপাশেও শুধু গোলমাল আর গোলমাল। এক জায়গায় মারপিট বাধিয়েছে কয়েকজন। দল বেঁধে দাঁড়িয়ে দেখছে অনেকে, বাধা দেয়ার কেউ নেই। আরেক জায়গায় রাস্তার ওপরই মারামারি করছে কিছু লোক। গাড়ি যাওয়ার পথ রাখেনি। সরতে বললাম। সরল না। আক্রোশটা ঘুরে গেল আমার দিকে। ঘুসি মারার জন্যে গাড়ির পা-দানিতে লাফিয়ে উঠল একজন, ঠেলে ফেলে ফিলাম নিচে। অন্যেরা হই-হই করে উঠল। ছুটে এল দল বেঁধে। বেগতিক দেখে লোকজন মাড়িয়েই গাড়ি হাঁকাল কোচোয়ান। দুএকজন চাকার তলায় পড়ে আহত হলো, অন্যেরা লাফিয়ে সরে গেল।
এতসব গণ্ডগোলেই বোধহয় নেতিয়ে পড়েছেন প্রফেসর। বেশি উত্তেজনা সহ্য করতে পারছেন না। আমারই খারাপ লাগছে। আর তার তো বয়েস হয়েছে।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সুস্থ দেহেই স্টেশনে পৌঁছলাম। কুলি ডেকে সিলিন্ডার দুটো নামাতে বলে আমি আর প্রফেসর প্ল্যাটফর্মে ঢোকার গেটের দিকে এগোলাম।
গেটের ভেতরে একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন দীর্ঘদেহী এক লোক। হলদে সুটে মানিয়েছে বেশ। তীক্ষ্ণ চোখ, ছুরির মত ধারাল নাক। লালচে চুলে রূপালী চিহ্ন, কপালে বয়সের রেখা প্রকট। দুর্দান্ত শিকারী লর্ড জন রটন। হারানো পৃথিবী অভিযানের আরেক অভিযাত্রী।
আরে প্রফেসর যে! দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন জন। এগিয়ে এলেন এক পা। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ম্যালোন, কেমন আছ?
দুটো সিলিন্ডার বয়ে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকল কুলিরা। দেখে হেসে উঠলেন জন। মাথা দুলিয়ে প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে আপনারাও এনেছেন। আমারটা লাগেজ ভ্যানে তুলে দিয়েছি। ব্যাপারটা কি বলুন তো? অত অক্সিজেন দিয়ে কি করবেন চ্যালোর?
জানি না, গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলেন সামারলি।
জিজ্ঞেস করলাম, টাইমসে প্রফেসরের লেখা একটা চিঠি ছেপেছে। দেখেছেন নাকি?
কি চিঠি?।
রাবিশ! রুক্ষকণ্ঠে বললেন সামারলি, পাগলামির একটা সীমা থাকা উচিত!
আমার মনে হচ্ছে অক্সিজেন জোগাড়ের সঙ্গে ওই চিঠির কোন সম্পর্ক আছে, বললাম।
ঘোড়ার ডিম আছে! প্রায় মারমুখো হয়ে উঠলেন সামারলি। অতিরিক্ত খেপেছেন আজ। বিনা কারণে। সব হলো পাগলের পাগলামি!
ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টে উঠে বসলাম। পুরানো প্রিয় ব্রায়ার পাইপে তামাক ভরে আগুন ধরালেন সামারলি। তারপর কষে দিলেন টান। মুখ বন্ধ করে খাড়া উদ্ধত নাকের ফুটো দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলেন চুপচাপ।..
কয়েক মিনিট একটানা ধোঁয়া ছেড়ে দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপটা সরালেন তিনি। কথা বলে উঠলেন আচমকা। তীব্র ঝাঝাল কণ্ঠস্বর, লোকটা একটা আস্ত পাগল, লর্ড জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, চ্যালেঞ্জারের কথা বলছি। তবে বৃদ্ধি আছে স্বীকার করতেই হবে। মেজাজটা যদি আরেকটু ভাল হতো, পাগলামিটা কমাত, খারাপ লাগত না। মাঝে মাঝে উল্টোপাল্টা কথাও এত বেশি বলে ফেলে…এই যে দেখুন না, পত্রিকায় এক চিঠি ছেপে দিয়েছে, কোনও মানে হয় এর? মহাকাশের ইথারে নাকি গণ্ডগোল। ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে পৃথিবীটা ধ্বংস হওয়ার পথে। এগুলো হলো একধরনের স্টান্টবাজি, নিজেকে জাহিরের অপচেষ্টা। বুঝি না মনে করেছেন? খুব বুঝি। ও যদি চলে ডালে ডালে, আমি থাকি পাতায় পাতায়। ওর ভণ্ডামি ধরতে আমার এক মুহূর্ত লাগে না।
রাগ লাগল আমার। চ্যালেঞ্জারকে পছন্দ করি আমি। তার সম্পর্কে এমন কটুক্তি সহ্য হলো না। আমি কিছু বলার আগেই চাঁছাছোলা জবাব দিলেন লর্ড জন, কার সম্বন্ধে কি বলছেন, প্রফেসর? এর আগেও চ্যালেঞ্জারের সঙ্গে টক্কর দেয়ার চেষ্টা করেছেন আপনি। সুবিধে করতে পারেননি। আপনাকে কাত করতে দশটা সেকেন্ডও লাগেনি চ্যালেঞ্জারের। বিজ্ঞানী হিসেবে ওই লোক আপনার ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেন ঘাটাচ্ছেন? অহেতুক সমালোচনা না করে চুপচাপ থাকুন বরং। কিংবা অন্য কথা বলুন।
ঠোঁট শক্ত হয়ে গেল সামারলির। কাঁপতে লাগল ছাগুলে-দাড়ি। কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন লর্ড জনের দিকে। কথা বললেন না। গুম হয়ে রইলেন।
ভারি পরিবেশ সইতে পারেন না লর্ড জন। হালকা করার জন্যে এক চাপড় মেরে বসলেন প্রফেসরের পিঠে, রাগ করলেন? আসলে রাগানোর জন্যে বলিনি। প্রফেসর চ্যালেঞ্জার আপনার বন্ধু। একসঙ্গে কাজ করতে গেলে কথা কাটাকাটি হয়ই, তাই বলে তো আর শত্রু হয়ে যায় না।
লর্ড জনের কথাগুলো স্বাভাবিক মনে হলেও পিঠ চাপড়ে দেয়াটা বিসদৃশ ঠেকল আমার চোখে। আন্তরিক হওয়ার জন্যে এ রকম ছেলেমানুষী আচরণ সাধারণত করেন না লর্ড।
কিন্তু নরম হলেন না সামারলি। কিছুতেই যেতে চাইছে না রাগ! কঠিন হয়ে উঠেছে চোখ-মুখ। শক্ত করে কামড়ে ধরেছেন পাইপ। বাস্পীয় ইঞ্জিনের মত অনবরত ধোঁয়া বেরোচ্ছে নাকের ফুটো দিয়ে। পাইপটা দাতে চেপে রেখে শুকনো কণ্ঠে বললেন, মিস্টার লর্ড জন রটন, আপনি ঠিকই বলেছেন। প্রফেসর চ্যালেঞ্জার আমার শত্রু নয়। কিন্তু তার উদ্ভট সব বৈজ্ঞানিক যুক্তি আমিও বিজ্ঞানী হয়ে বিনা প্রতিবাদে মেনে নেব, এ কথা দুঃস্বপ্নেও ভাববেন না। তার যেমন মগজ আছে, আমারও আছে। একবার তার কাছে হেরেছি বলে যে বার বার হারব, এমন কোন কথা নেই। ফ্রনহোফার লাইন নিয়ে যে যা বলে সব বিশ্বাস করুনগে আপনারা, সেটা আপনাদের ব্যাপার। কিন্তু বয়েস যার আপনাদের চেয়ে বেশি, জ্ঞান-বুদ্ধিতেও বড়, তাকে অন্তত বিশ্বাস করতে বলবেন না। চ্যালেঞ্জারের কথা আমি বিশ্বাস করি না। ইথারে গোলমাল মানেটা কি? অক্সিজেন কমে যাওয়া, বিষাক্ত হয়ে যাওয়া কিংবা ওরকমই কোন ব্যাপার। তাহলে এতক্ষণে সেটা টের পেয়ে যেতাম আমরা। রক্তে বিষক্রিয়া শুরু হয়ে যেত। অস্থির হয়ে উঠতাম আমরা। হয়তো কষ্টও পেতাম। এর কোনটাই ঘটছে না। তাহলে ইথারে গোলমাল হলো কি করে?
গোলমাল তো শুরু হয়ে গেছে, বললাম। সুমাত্রায় আদিবাসীরা রহস্যময় রোগে আক্রান্ত। সুন্দা প্রণালীর লাইটহাউসের কর্মচারীরাও ভুগতে আরম্ভ করেছে…।
দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপটা হাতে নিয়ে নিলেন সামারলি। কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে, কি বলতে চাও?
ম্যাকারডল দুটো টেলিগ্রাম পেয়েছেন সিঙ্গাপুর থেকে। তাতে জানা গেছে, সুমাত্রার আদিবাসীদের মাঝে নাকি একটা রহস্যময় রোগ ছড়িয়ে পড়েছে…।
আমাকে কথা শেষ করতে দিলেন না সামারলি, তোমার কি ধারণা, বিষাক্ত ইথারের জন্যে হচ্ছে এ সব? আরে বুদ্ধ, সহজ কথাটা মাথায় এল না যে ইথার সব জায়গায়ই এক? বিষাক্ত ইথার পৃথিবীর দিকে থাকলে এদিকেও থাকবে? নাকি তোমার মনে হচ্ছে ইংলিশ ইথার আর সুমাত্রার ইথারে পার্থক্য আছে?
আপনি বিজ্ঞানী মানুষ, আপনিই সেটা ভাল বুঝবেন।
নরম হলেন সামারলি, বুঝি বলেই তো বলছি, ইথারের বিষে এ রকম হচ্ছে। যদি হতো, তাহলে সুমাত্রাবাসীদের মত আমরাও এতক্ষণে আক্রান্ত হয়ে পড়তাম। এত শান্তিতে বসে আর কথা বলা লাগত না এখন।
সত্যি কি একেক জায়গার, ইথার একেক রকম হতে পারে না? প্রকৃতিতে কত বিস্ময়কর ঘটনাই তো ঘটে। যদি এমন হয়…।
বিজ্ঞানে যদিদি বলে কোন কথা নেই। এর সব কিছুই অঙ্কের হিসেবের মত, দুইয়ে দুইয়ে শুধু চারই হবে, পাঁচ হবে না। আমি বলছি, লিখে রাখতে পারো, এই একটিবার অন্তত চ্যালেঞ্জারের ধারণা ভুল হতে বাধ্য।
বাজি ধরতে চান? ভুরু নাচালেন লর্ড জন।
কিসের ওপর?
ইধারে বিষ আছে কি নেই?
নেই।
আপনি ধরতে চান কিনা বলুন?
বললাম তো নেই।
তাহলে বাজি ধরতে আপত্তি কোথায়?
জুয়া খেলাকে আমি ঘৃণা করি।
আসলে আপনার আত্মবিশ্বাস নেই। মুখে বলছেন বটে চ্যালেঞ্জারের ধারণা ভুল, কিন্তু মনে মনে ভাবছেন-কি জানি, সত্যি যদি হয়েই যায়? ওই লোকের কোনও অনুমান আজ পর্যন্ত ভুল হয়নি, জানা আছে আপনার।
খোঁচা দিয়ে কথা বলাটা আপনার বদস্বভাব! রেগে গেলেন সামারলি।
আপনিও কি ট্রেনে ওঠার পর থেকে কোন ভাল কথা বলেছেন, চ্যালেঞ্জারের বদনাম করা ছাড়া? ভাল মানুষেরা কখনও পেছনে অন্যের সমালোচনা করে না। যে চ্যালেঞ্জারের সম্পর্কে এত খারাপ খারাপ কথা বলছেন, তিনিও কারও সমালোচনা করতে হলে মুখের ওপর করে দেন। সুতরাং নিজেই বিবেচনা করে, দেখুন আপনাদের দুজনের মধ্যে কে খারাপ।
খোঁচাটা হজম করতে কষ্ট হলো সামারলির। আমি ভাল কি মন্দ, সেটা আপনার মত নাম সর্বস্ব লর্ডের মুখ থেকে শুনতে চাই না।
প্রফেসর সামারলি! তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন লর্ড জন। রাগে শক্ত হয়ে গেছে শরীর। আপনি বয়স্ক মানুষ। শ্রদ্ধাটা এখনও একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। নইলে…
নইলে কি করতেন?
এক ঘুসিতে নাক ফাটিয়ে দিতাম!
স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। এ কি আচরণ শুরু করেছেন দুজন বিখ্যাত, বিশিষ্ট ভদ্রলোক! এ যে দুঃস্বপ্নেরও অতীত!
রাগে, অপমানে ভাষা হারিয়ে ফেলার কথা সামারলির। আগে হলে হয়তো তাই করতেন। কিন্তু এখন করলেন না। কাকের মত কর্কশ গলায় চেচাতে লাগলেন, আপনি আমার নাক কাটাবেন? আপনি? আপনার মত নাক ফাটানেওয়ালা কত লর্ড দেখলাম! চতুস্পদ কতগুলো জন্তু ওই যে খোয়াড়ে থাকে আর ব্যা-ব্যা করে তাদের সঙ্গে আপনাদের মত লর্ডদের কোন তফাৎ আছে নাকি?
বুঝলাম, আর ঠেকানো গেল না। মারপিট শুরু হয়ে যাবে এবার। কিন্তু আশ্চর্য, কিছুই করলেন না লর্ড জন। সামনে ঝুঁকে ঝগড়া করছিলেন, এবার হেলান দিয়ে আরাম করে বসলেন। যেন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। নাকি আরও ভয়ঙ্কর কিছুর পূর্বপ্রস্তুতি?
সকাল থেকেই আজ দেখছি অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটছে। সব অস্বাভাবিক। হারানো পৃথিবী অভিযানের সময় কি ভাল সম্পর্কই না ছিল জন আর সামারলির মাঝে! অথচ আজ এমন খেপে উঠলেন কেন?
মাথার মধ্যে আমারও যেন কেমন করে উঠল। কেঁদে ফেললাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। চেষ্টা করেও থামাতে পারছি না। আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন দুই বাঁকযোদ্ধা।
কাঁদছি কেন? তোমার আবার কি হলো? জিজ্ঞেস করলেন লর্ড।
এমনি কাঁদছি, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম। কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সেই ছেলেবেলার পর থেকে আর কাদিনি তো, তাই মনে হলো একবার কেঁদে দেখাই যাক না কেমন লাগে।
শরীরটা তোমার ভাল না, ম্যালোন, বুঝতে পারছি, সহানুভূতির সুরে বললেন লর্ড। এক কাজ করো, সরে জায়গা করে দিলেন তিনি, শুয়ে পড়ো। বিশ্রাম নাও। ঠিক হয়ে যাবে।
গম্ভীর মুখে মাথা নাড়তে নাড়তে সামারলি বললেন, হুঁ, বুঝেছি। এ জন্যেই অত দেরি করেছিলে সিলিন্ডার আনতে গিয়ে। তাই তো বলি, একটা সিলিন্ডার আনতে এত দেরি কেন? তা এই সময়ে কি মদ না খেলে চলছিল না?
মুহূর্তে কান্না থেমে গেল আমার। কঠোর কণ্ঠে বললাম, মানে! কি বলতে চান?
খুকখুক করে হাসলেন সামারলি; হাসলেন না কাশলেন ঠিক বোঝা গেল না, ধমক দিয়ে কথা বললেই ভেবেছ ঠাণ্ডা হয়ে যাব? সিলিন্ডার আনতে গিয়ে তুমি মদ খেয়ে আসোনি? নেশাটা এতক্ষণে ধরেছে। সেজন্যে কাঁদছ। এটা স্রেফ মাতলামির লক্ষণ।
বাজে কথা বলবেন না। মদ আমি খাইনি। এমনিতেই কাঁদতে ইচ্ছে করছিল।
এমনিতে কাবও কাঁদতে ইচ্ছে করে? তাও তোমার মত বয়স্ক মানুষের? একজন ঘোড়েল সাংবাদিকের?
করে, খাটি দার্শনিকের ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন লর্ড জন, মানুষমাত্রই কাদতে ইচ্ছে করে। অপনার করে না?
না করে না। তবে আমার এখন জন্তু-জানোয়ারের ডাক ডাকতে ইচ্ছে করছে। ছোটবেলায় খুব কার নকল করতে পারতাম। এখনও ভুলিনি। ডেকে দেখাব?
লাভটা কি হবে তাতে?
ম্যালোনের কান্না থেমে যাবে। হেসে উঠবে ও।
এমনিতেই থেমে গেছে ওর কান্না।
ওপরে ওপরে থেমেছে, ভেতরে এখনও মোলোআনা রয়ে গেছে ইচ্ছেটা। একটু সুযোগ দিলেই আবার কাঁদতে শুরু করবে। এমন কিছু করা দরকার, যাতে সারাপথ ওর হাসি বজায় থাকে। মোরগের ডাক দিয়েই শুরু করি, কি বলেন?
মোরগের ডাক জঘন্য লাগে আমার। হাসি তো আসেই না, ভোরবেলা ডেকে ডেকে ঘুম ভাঙিয়ে দিলে ঘাড় মটকাতে ইচ্ছে করে।
সেটা আপনার করে, লেনের তো আর করে না। কাদার ইচ্ছেটাও হয়েছে ওর, আপনার নয়। সুতরাং ওকে হাসাতেই হবে। আর কোন কথা না বলে মোরগের ডাক ডেকে উঠলেন সামারলি। তারপর একে একে নানা রকম জন্তু-জানোয়ারের ডাক নকল করে ডেকেই চললেন। ভাবভঙ্গিতে পরিষ্কার বোঝা গেল, মাথায় গোলমাল হয়ে গেছে। তাকে তো চিনি, এমন কাণ্ড জীবনেও করতে দেখিনি। আশ্চর্য!
আমার ভাবনাটাই যেন সংক্রমিত হলো লর্ড জনের মাঝে। খবরের কাগজের মার্জিনে কলম দিয়ে কি যেন লিখলেন। কাত করে দেখালেন আমাকে। লিখেছেন: মাথাটা একেবারেই গেছে! ট্রেন থেকে নেমেই পাগলা গারদে পাঠাতে হবে!
তার সঙ্গে আমিও একমত হলাম।
কিছুক্ষণ পর আমার দিকে সরে বসলেন লর্ড। শুরু করলেন বকর বকর। এটা তার স্বভাববিরুদ্ধ। জোর করেই আমাকে প্রেমের গল্প শোনাবেন। নায়িকা এক নিগ্রো মেয়ে আর নায়ক ভারতীয় রাজা। প্রচুর ঘটনা। কোনটারই কোন মাথামুণ্ড নেই। গল্পের ক্লাইম্যাক্স কখন এল লর্ড জন না বলে দিলে বুঝতাম না।
ওদিকে ডেকেই চলেছেন সামারলি। ক্যানারির ডাক নকল করছেন প্রফেসর। কানমাথা ঝা-ঝা করতে লাগল আমার। মনে হলো, ওঁরা দুজন ঠিকই আছেন, পাগল হয়ে গেছি আসলে আমি। অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে বাইরে লাফিয়ে পড়ব কিনা ভাবতে লাগলাম। এই সময় জার্ভিস বুক স্টেশনে ঢুকল ট্রেন। প্রাণে বাঁচলাম আপাতত।
.
আমাদের অপেক্ষায় প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। পরনে জমকাল পোশাক। দম্ভ ও অহঙ্কার ফুটে বেরোচ্ছে সমস্ত অবয়ব থেকে। তাকানোর ভঙ্গি দেখে মনে হয় আশপাশের মানুষগুলোকে যেন কৃপা করছেন। পাপী বান্দাদের দর্শন দিয়ে ধন্য করে দিচ্ছেন স্বয়ং ঈশ্বর। কুৎসিত চেহারা আরও কুৎসিত হয়েছে। দাড়িগোঁফের জঙ্গলে ছট পড়েনি বহুকাল।
আমাদের দেখেও যেখানে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। এক পা এগোলেন না। আমরাই এগিয়ে গেলাম। কাছে গেলে নিতান্ত অবহেলায় হাত মেলালেন আমাদের সঙ্গে।
লাগেজ ভ্যান থেকে তিনটে সিলিন্ডার নামিয়ে আনল কুলিরা।
আমাদের, অনুসরণের ইঙ্গিত করে আগে আগে হাঁটতে শুরু করলেন চ্যালেঞ্জার। স্টেশানের বাইরে বেরিয়ে দেখলাম তার মস্ত গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভার অস্টিন। নির্বিকার। কোন পরিবর্তন হয়নি ওর।আগের মতই আছে।
সবাই উঠে বসলাম গাড়িতে। সিলিন্ডারগুলোও তোলা হলো। এঞ্জিন স্টার্ট দিল অস্টিন।
ওর পাশে বসেছি আমি। পেছনের সীটে চ্যালেঞ্জার, সামারলি আর জন। মোষ শিকারের গল্প এরু করেলেন লর্ড। তাকে থামিয়ে দিয়ে ইথার নিয়ে পড়লেন সামারলি। তার খ্যাকখাকে গলা ছাপিয়ে চ্যালেঞ্জারের গুরুগম্ভীর কণ্ঠের প্রতিবাদ শোনা যাচ্ছে।
পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে উঠে যাচ্ছে গাড়ি। গতি কমিয়ে মাথাটা আমার। দিকে সামান্য হেলিয়ে ফিসফিস করে অস্টিন বলল, প্রফেসর চাকরি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন আমাকে।
গাড়ি তো ঠিকই চালাচ্ছ। বেহায়ার মত আছি। আজ সাতচল্লিশ বার বিদেয় করেছেন আমাকে। কিছু একটা বলা উচিত। কি বলব? জিজ্ঞেস করলাম, কতবারের বার যাবে?
যাব না।
জোর করে থাকবে?
থাকব।
অপমান লাগে না?
না।
দিনটাই যেন কেমন আজ। সবার মধ্যেই অস্বাভাবিক আচরণ। সাতচল্লিশবার চলে যেতে বলার পরও অপমান লাগে না অস্টিনের। প্রফেসর তোমাকে সারাক্ষণ দূর দূর করবেন, তা-ও তুমি থাকবে।
মন থেকে তো আর করেন না। আমি না থাকলে তার গাড়ি চালাবে কে?
অন্য ড্রাইভার দেখে নেবেন।
একদিনও কেউ টিকবে না। কে সইবে অত চোখেচি আর অপমান? এতদিন তার নুন খেয়েছি, আজ দুঃসময়ে তাকে ছেড়ে যাওয়ার মত বেঈমানী আমি করতে পারব না,যতই বকাঝকা করুন।
বুঝতে পারলাম না। দুঃসময় মানে?
কণ্ঠস্বর আরও নামিয়ে বলল অস্টিন, প্রফেসর এখন একেবারে পাগল হয়ে গেছেন। বদ্ধ উন্মাদ। আজ সকালে কি করেছে জানেন?
কি করেছে?
বাড়ির কাজের মেয়েটাকে কামড়ে দিয়েছেন।
কামড়ে দিয়েছেন!
হ্যাঁ, পায়ে।
বলো কি?
তাহলেই বুঝুন। বদ্ধ উন্মাদ ছাড়া এ রকম কাণ্ড কেউ করে? অন্য দিন যেমন-তেমন, আজ যেন অতিরিক্ত বেড়েছে পাগলামিটা। সকাল বেলা মারতে গেল এক পড়শীকে। সে-ও কি আর ছাড়ে? বুন্দুক নিয়ে তেড়ে এল। সাহেবও গেলেন বন্দুক আনতে। অনেক কষ্টে হাতেপায়ে ধরে ঠাণ্ডা করলাম পড়শীকে। সাহেব বন্দুক নিয়ে এসে দেখেন নেই। ভাবলেন ভয়ে পালিয়েছে। আমিও কিছু বললাম না।
ঝগড়াটা বাঁধল কি নিয়ে?
পড়শীকে বোক বলেছিলেন সাহেব। ও সাহেবকে গুহামানব বলে গাল দিল। আর কি রোখা যায়।
ভুল বলেনি পড়শী। হাসি পেল আমার। চেপে গেলাম।
মন্থর গতিতে উঠে যাচ্ছে গাড়ি। উপরে একটা বাঁক। বাঁক পেরোতে চোখে পড়ল প্রফেসরের বাড়ির সামনের নোটিশটা:
সাবধান।
সাংবাদিক আর ভিখারিদের এ দিকে আসা বারণ।
আদেশ অমান্যকারীকে ধরে বিনা বিচারে ঠেকানো হবে।
সর্বনিম্ন শাস্তি কানমলা।
জি. ই. চ্যালেঞ্জার
নোটিশটা দেখিয়ে অস্টিন বলল, ওই দেখুন, কাণ্ড! প্রফেসরের লেখা। কোন সুস্থ মানুষ এ ধরনের নোটিশ লিখতে পারে?
সাদা গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল গাড়ি। লাল সুরকি ঢালা পথ চলে গেছে। দুপাশে রডোডেনড্রনের ঝোপ। সামনে লাল ইটের বাড়ি। দরজা-জানালার রঙ ধবধবে সাদা। ছবির মত সাজানো। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন ছোটখাট মহিলাটি। হাসি হাসি মুখ।
গাড়ি থামতেই কামানের গোলার মত ছিটকে বেরোলেন চ্যালেঞ্জার। ছুটে গিয়ে দাঁড়ালেন স্ত্রীর কাছে। চেঁচিয়ে বললেন, নিয়ে এলাম।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি, কোমল স্বরে বললেন মিসেস চ্যালেঞ্জার। তা বাড়িতে ডেকে এনে অপমান করবে না তো?
তোমার কি মনে হয়?
আজ তোমার যা অবস্থা, কি যে করবে, ঈশ্বরই জানেন!
হেসে উঠলেন প্রফেসর। মনে হলো একটা গেরিলা ডেকে উঠল বিকট শব্দে। হোহ হোহ করে ভুড়ি নাচিয়ে হাসলেন খানিকক্ষণ। তারপর বললেন, সকালে ওই বিটলে পড়শীটাকে মারতে গিয়েছি বলে বলছ তো? পেটানোই উচিত ছিল। ভয়ে না পালালে আজ ওকে গুলি করে মারতাম আমি। আর সারার পায়ে কামড়ে দেয়ার ব্যাপারটা ছিল স্রেফ একটা পরীক্ষা। তা তুমি কিছু মনে করোনি তো?
না, করিনি। তবে মেহমানদের যদি এতটুকু অপমান করেছ, তো সত্যি খারাপ হবে বলে দিলাম।
না না, তা কি আর করি। তাহলে চিঠি দিয়ে ডেকে আনলাম কেন? ভুলে যদি করেও ফেলতে চাই তুমি আমাকে ঠেকাবে। তুমি থাকতে আমার ভয় কিসের? রোমশ বাহ দিয়ে স্ত্রীর কোমর জড়িয়ে ধরলেন প্রফেসর। আমার চোখে গরিলা আর এক হরিণীর ছবি ফুটে উঠল। সারা ফিরেছে?
মাথা নাড়লেন গৃহিনী। যে কান্ড করেছ, তারপরেও ওর ফেরার সাহস হবে?
বুক পর্যন্ত লম্বা দাড়িতে হাত বুলিয়ে মুচকি হাসলেন সাহব। আর ফিরেও লাভ নেই। বাঁচার জন্যে তো চাকরি। সেটার হয়তো আর প্রয়োজনই হবে না ওর কোনদিন।
প্রফেসরের কথাটা রহস্যময় লাগল আমার কাছে।
কোমর থেকে স্বামীর হাতটা সরিয়ে দিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন মিসেস। বললেন, আসুন আপনারা, ঘুরে আসুন। অনেক দূর থেকে এসেছেন। নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। হাতমুখ ধুয়ে কিছু মুখে দিয়ে নিন।
পরের পর্ব :
০২. ডাইনিং রূমে খাওয়া শেষ করে
০৩. মেকাপ রুমটা বেশি বড় না
০৪. আমি ঈশ্বরকে ডাকছি
০৫. সামুদ্রিক তাজা হাওয়া
০৬. রোদারফিল্ডে ফিরেছি
০৭. ডিসইনটিগ্রেশন মেশিন
০৮. ধরণীর চিৎকার