দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কওয়াই: ২১-২৫. কওয়াইয়ের কলধ্বনি

দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কওয়াই: ২১-২৫. কওয়াইয়ের কলধ্বনি

২১-২৫. কওয়াইয়ের কলধ্বনি

২১.

একমনে কওয়াইয়ের কলধ্বনি শুনছিলেন সিয়ার্স। হঠাৎ তাকে পেয়ে বসল অদ্ভুত এক অস্থিরতা।

অস্বস্তি নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। বুঝতে পারলেন না, তবে অনুভব করলেন, আশেপাশেই ঘটে গেছে কী যেন একটা।

ব্যাপারটা অস্পষ্ট, কিন্তু ক্রমেই যেন তা স্পষ্ট একটা রূপ নিতে চাইছে। আশেপাশেই ঘটে গেছে কিছু একটা, মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল আবার।

কিছু একটা হয়েছে… ফিসফিস করে বারবার বলতে লাগলেন সিয়ার্স। পরিস্থিতি আঁচ করতে তার কখনও ভুল হয় না। আর সেজন্যেই ব্যাপারটা ধরতে না পেরে তার অস্থিরতা ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হলো সত্যিকারের উদ্বেগে। যুক্তি সাজাতে লাগলেন তিনি।

অবশ্যই কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তনটা স্বাভাবিক। অবস্থান বিশেষে শব্দ ভিন্নরকমের শোনাতেই পারে। এখন আমি পাহাড়ের পাদদেশে, জঙ্গলের মধ্যে আছি। এখান থেকে প্রতিধ্বনি যেমন শোনা যাবে, পাহাড়ের মাথা বা পানির মধ্যে থেকে নিশ্চয় তেমন শোনা যাবে না। আমি বোধহয় একটু বেশি বেশি ভাবছি…।

আবার তিনি তাকালেন ডালপালার ফাঁক দিয়ে। অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না। ঊষার আলোয় নদীটা দেখা যায় কি যায় না। উল্টোদিকের তীর এখন নিরেট একটা ধূসর তৃপ। জোর করে মনটা তিনি ঘুরিয়ে দিলেন লড়াইয়ের প্ল্যান আর অ্যাকশনের জন্যে অপেক্ষমাণ বিভিন্ন দলের দিকে। জিরো আওয়ার প্রায় এসে পড়েছে। রাতেই তিনি আর চার থাই অবজারভেশন পোস্ট থেকে নেমে পজিশন নিয়েছেন ওয়ার্ডেনের পছন্দ করা জায়গায়। অন্য দুই থাইয়ের সাথে ওয়ার্ডেন নিজে আছেন মর্টারের কাছে। জয়েস এখন সিয়ার্সের ঠিক উল্টোদিকে। ট্রেনের জন্যে সে অপেক্ষা করে আছে চব্বিশ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। সঙ্কেত এসেছে, ট্রেনটা ব্যাঙ্কক ত্যাগ করেছে রাতে।

কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে… হালকা মেশিনগান নিয়ে থাকা থাইটার মধ্যেও এখন ফুটে উঠেছে অস্বস্তি। উবু হয়ে একদৃষ্টে সে চেয়ে রয়েছে নদীর দিকে।

অস্বস্তিটা সিয়ার্স কিছুতেই দূর করতে পারলেন না। ধরা দিতে চেয়েও দিচ্ছে ব্যাপারটা। ভেতরে ভেতরে পাগল হয়ে উঠলেন তিনি ওই রহস্যভেদের জন্যে।

শপথ করে সিয়ার্স বলতে পারেন, প্রভেদ ঘটে গেছে শব্দে। গতকালও যেরকম শব্দ তুলে বইছিল কওয়াই, আজ সেভাবে বইছে না। নাকি বইছে? তার কানে গোলমাল দেখা দেয়নি তো? অন্যরকম শুনতে পাচ্ছেন নাকি সবকিছু?

কিন্তু একইসাথে থাইটার কানেও গোলমাল দেখা দিতে পারে না। কিছু একটা হতেই হবে। হঠাৎ আরেকটা ব্যাপার অনুভব করলেন সিয়ার্স। শুধু শব্দই নয়, গন্ধও পরিবর্তন হয়েছে কওয়াই নদীর। কাদার মত একটা স্যাতসেঁতে গন্ধ ঝাপটা মারছে নাকে।

নদীর পানি কমে গেছে! আঁতকে উঠল থাইটা।

প্রায় একই সময়ে সিয়ার্সও বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। লাল গাছটার ডাল আর পানি ছুঁয়ে নেই। রাতের মধ্যেই নেমে গেছে কওয়াই নদী। কতখানি? এক ফুট?

যে মুহূর্তে বুঝতে পারলেন, একটা ভার যেন নেমে গেল বুকের ওপর থেকে। প্রবৃত্তি তা হলে তাকে ভুল বোঝায়নি। এখনও ঠিকই আছে মাথাটা। নতুন বের হওয়া মাটি জন্ম দিয়েছে ওই গন্ধের।

দুর্ভাগ্য একবারে বোঝা যায় না। প্রবৃত্তি সেগুলো মানুষকে অনুভব করাতে থাকে একে একে।

কথাটা মনে পড়ল বিদ্যমকের মত। তার! বৈদ্যুতিক তারটা! তড়িঘড়ি করে বিনকিউলারটা চোখে লাগালেন সিয়ার্স।

হ্যাঁ, ওই তো পড়ে আছে তার। বিনকিউলার দিয়ে তিনি আগাগোড়া অনুসরণ করলেন তারটাকে।

সহজে অবশ্য ওটা কারও চোখে পড়বে না। তিনি দেখতে পেয়েছেন, তারটা ঠিক কোথায় আছে জানেন বলেই। কিন্তু যে তীরটা দুর্গম ছিল, পানি কমে সেখানে সিঁড়ির মত একটা খাক বেরিয়ে পড়েছে। তবে, ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা জাপানীরা নিচয় নদীর তীরে পায়চারি কতে আসবে না। কপালের ঘাম মুছলেন সিয়ার্স।

তা হলে এখানেও ঘটল দুর্ঘটনা! এক রাত পরে নয়, দুরাত আগেও নয়! যত সতর্কতার সাথেই প্ল্যান করা হোক না কেন, এ-দুর্ঘটনা যেন ঘটবেই। কখনও তা অতি ক্ষুদ্র, কখনও মাঝারি, কখনও অ-ত, আবার কখনও বা এতই বড়, যা মাখা ঘুরিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। পানি কমার সম্ভাবনার কথাটা তাঁর ভাবা উচিত ছিল।

ঘাসবিহীন নদীতীরটা যেন সত্যের মতই নয়। পানি নিশ্চয় অনেকটা নেমে গেছে। এক ফুট দুফুট? আরও বেশি? হায়!

মাথাটা ঘুরে উঠল সিয়ার্সের। একটা গাছের ডাল চেপে ধরলেন তিনি, হাতপা যে কাপছে তা থাইটাকে দেখাতে চান না। এত হতাশ জীবনে তিনি আর একবারই হয়েছেন। হঠাৎ আরেকটা আবহ চিন্তায় ঠাস্ত হয়ে আসতে চাইল তার শরীর।

পানি কি দুকুট নেমে গেছে নাকি আরও বেশি হয় ঈর। বিস্ফোরক! সেতুর পাইলগুলোর গায়ে বসানো পাষ্টিকের বিস্ফোরক! ওগুলো যে দেখা যাবে!

২২.

সিয়ার্স চলে যাবার পর কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে রইল জয়েস। এখন আর কেউ নেই যার ওপর আসা এ চলে, যা-কিছু করার এখন করতে হবে নিজেকে–উপলব্ধিটা তার মগজের ভেতরে আলোড়ন তুলল অ্যালকোহলের মত।

মাথাটা পরিষ্কার হতে প্রয়োজনীয় কয়েকটা পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিল সে। এই সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে প্লয়ারে হাত রেখে, গাছে হেলান দিয়ে, সে হয়তো বসেই থাকত সে দিকে চেয়ে।

উঠে পড়ে, কাপড়গুলো খুলে, ছুঁড়ে ফেলে ধীরে ধীরে সে ম্যাসেজ করতে লাগল জমে যাওয়া অঙ্গপ্রতঙ্গ। তারপর আবার জামা ও হাফপ্যান্ট পরে চাউল খেলো কয়েক মুঠা, লম্বা চুমুক দিল হুইস্কিতে। এখন আর পানি আনা সম্ভব নয়, আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে। ক্ষতগুলো স্পিরিট দিয়ে ধুয়ে আবার সে বসে পড়ল গাছের পেছনে। সেদিন কিছুই ঘটল না। ঘটার কথাও নয়। পরদিন সকালের আগে আসবে না ট্রেন; কিন্তু ধীরে ধীরে ফিরে আসছে আত্মবিশ্বাস।

বেশ কয়েকবার সেতুর ওপর জাপানী সৈন্য দেখল সে। ওরা কোনও সন্দেহ করেনি, ফলে একবারও তাকায়নি এদিকে। ট্রেনটা সেল ঠিক কোন জায়গায় এলে ধ্বংসলীলা চালাবে, সেটা আন্দাজ করে নিয়ে, তার খুলে ফেলে, বারবার সে চাপ দিতে লাগল প্লারে। অনুশীলন শেষে পারিটা মুছে পরিষ্কার করে ফেলল সে। খুবই ভাল অবস্থায় আছে যন্ত্রটা। তার বিয়েও কাজ করছে চমৎকারভাবে।

বেশ দ্রুত কেটে গেল দিনটা। আঁধার নামতে চুপিচুপি ঢাল বেয়ে নেমে, কয়েক ঢোক ঘঘালা পানি খেয়ে, বোতলটা ভরে, আবার ফিরে এল সে গাছের কাছে। হেলান দিতে তন্দ্রামত একটা ভাব হলো। চিন্তার কিছু নেই। ট্রেনের শব্দ তার কান এড়াবে না, এ-বিশ্বাস আছে। কয়েকটা দিন জঙ্গলে কাটালে বুনো জানোয়ারের সতর্কতা ভর করে খানিকটা।

নানারকম স্বপ্ন তাকে চমকে তুলল বারবার, যেসব স্বপ্নে মিশে আছে তারই অতীত আর বর্তমান।

গার্ডারের সামনে ঝুঁকে পড়ে হিসেব কষছে সে। বিচিত্র ধরনের, একের পর এক। দুবছরের অবিশ্রাম খাটুনির পর ইস্পাত বাঁচল দেড় পাউন্ড।

একসময় তার ওপর ফুটে উঠল বাদামী রঙের চৌকো সব বাক্স, যেমনটা ওয়ার্ডেন এঁকেছিলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কীভাবে পাইলের গায়ে বসাতে হবে বিস্ফোরক।

মাঝেমাঝে ঘুম ভাঙছে। অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ছে কওয়াই সেতু। অবাস্তবকে সরিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে বাস্তব।

উষাকালে সিয়ার্সের মতই অস্বস্তি অনুভব করল জয়েস। চোখের সামনে শুধু সেতুর প্ল্যাটফর্ম, নদী অদৃশ্য। তবু মনে হলো, কী যেন একটা পরিবর্তন হয়েছে কোথাও! ঝোপের ভেতর দিয়ে নদীতীরে আসতেই সে বুঝতে পারল অস্বস্তির কারণ। ঘাসের ফাঁকে এখানে সেখানে বেরিয়ে আছে তারটা।

সিয়ার্সের মত সেও অনুভব করল অপূরণীয় ক্ষতিটা। বিস্ফোরকগুলোর কথা মনে পড়তেই ঠাণ্ডা হয়ে আসতে চাইল শরীর। এখান থেকে বোধহয় দেখা যাবে পাইলগুলো।

প্রথমে প্রকৃত ক্ষতি নিরূপণের একটা চেষ্টা করল সে। কিন্তু শুধুই তাকে দুলতে হলো আশানিরাশার দোলায়। অনেকক্ষণ পর খানিকটা আশার আলো জ্বলে উঠল তার ভেতরে। বিস্ফোরকগুলো এখনও পানির নিচেই আছে।

কিন্তু এক মুহূর্ত পরেই সে আবার নিমজ্জিত হলো হতাশায়। এখান থেকে না হয় বিস্ফোরকগুলো দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ওপর থেকে? সেতুর ওপর থেকে? এখান থেকেই কি একেবারে অদৃশ্য? দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করল সে। ঢেউ এসে ঝাপিয়ে পড়ল একটা পাইলের ওপর। ঢেউ সরে যেতেই তার মনে হলো, কাঠের হালকা রঙের পাশে বাদামী একটা পোচ। প্রায় সাথে সাথেই অবশ্য সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল। সে খেয়াল করে দেখল, কিছুক্ষণ পরপর ওটা ভেসে উঠছে মাছের পিঠের পাখনার মত। খুব সম্ভব বিস্ফোরকগুলো এখন অবস্থান করছে পানিপৃষ্ঠের ঠিক নিচে। অর্থাৎ, ভাল কোনও প্রহরী প্যারাপেট থেকে ঝুঁকে পড়লেই সব শেষ।

তা ছাড়া, পানি যদি আরও কমে যায়? ওগুলো দেখার জন্যে কাউকে আর কষ্ট করতে হবে না! এই চিন্তাটা তাকে একেবারে অবশ করে ফেলল। এখন কটা বাজে? সূর্য তো উঁকি দিতে চাইছে উপত্যকার পেছন থেকে। পানি আরও নেমে যেতে আর কতক্ষণ লাগবে? ট্রেন তত দশটার আগে আসার কথা নয়। প্রকৃতির একটামাত্র খেয়ালে তাদের এতদিনের ধৈর্য, পরিশ্রম, উদ্বেগ, কষ্ট, সব আজ ব্যর্থতার মুখোমুখি।

কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকার পর জয়েসের মনে হলো, সবই এখন ভাগ্যের হাতে। চিন্তাটা কিছুটা হলেও শান্ত করল তাকে। প্রকৃতি যে দুর্ভাগ্যের সৃষ্টি করেছে, তা নিয়ে আশা বা নিরাশা, কোনওটাতেই দোলার কোনও মানে হয় না। বরং বিন্দুমাত্র উদ্যম ব্যয় না করে যত ক্ষুদ্র সম্ভাবনাই থাক, সেটুকু খতিয়ে দেখা ভাল।

বিস্ফোরকগুলো যদি জাপানীদের চোখে পড়ে, খানিকটা আগেই থেকে যাবে ট্রেন। সে ক্ষেত্রে শক্রর হাতে আবিষ্কৃত হবার অপেক্ষায় না থেকে সে চাপ দেবে পাঞ্জারে। সাফল্যটা আংশিক হবে জেনেও চুপ করে থাকা সম্ভব নয়।

তারটার কথা আলাদা। হাঁটতে হাঁটতে তীরের দিকে এলে ওটা যে-কারও চোখে পড়তে পারে। এক্ষেত্রেও ব্যবস্থা নেয়ার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে। সেসময় হয়তো সেতুর ওপর বা উল্টোদিকের তীরে কোনও সৈন্য থাকবে না। ফলে এখানে যে আসবে, কেউ তাকে দেখতে পাবে না। লোকটা তার দেখতে পাবার সাথেসাথে চিৎকার করে না উঠে দুএক মুহূর্ত নিশ্চয় চুপ করে থাকবে বিস্ময়ে। ওই সময়েই ব্যবস্থা নিতে হবে জয়েসকে, চোখের পলকে। এবং কাজটা করতে হলে একইসাথে নজর রাখা দরকার সেতু আর তীরের ওপর।

আগের জায়গায় ফিরে চিন্তা করতে বসল সে। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। জামা আর হাফপ্যান্ট খুলে ফেলল জয়েস, পরনে থাকল শুধুই জাঙ্গিয়া। এ-অবস্থায় তাকে কেউ দেখলে বন্দীদেরই একজন বলে ভুল করতে পারে। প্লারে আবার সংযোগ দিয়ে সে বের করল ছুরিটা। মিশনে গেলে প্রাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশনস কোম্পানির সবাইকে সাথে রাখতে হয় এই অস্ত্র। আরও আরাম করে বসল জয়েস। এবারে অপেক্ষা।

সময় বয়ে চলল শম্বুক গতিতে, যেন কওয়াইয়ের স্রোতের সাথে তার একটা সম্পর্ক আছে। সূর্যের আলো যতই প্রখর হলো, ততই গন্ধ ছাড়তে লাগল হাতের ক্ষতগুলো। সে-গন্ধ আকৃষ্ট কবুল হরেক রঙের পিপড়ের দলকে। কিন্তু শারীরিক কষ্ট আর যন্ত্রণা এখন তার চিন্তার ধারাকে ব্যাহত করতে অক্ষম।

চিন্তা করতে করতেই একটা আতঙ্ক পেয়ে বসল তাকে। জাপানী কোনও সৈন্য যদি হাঁটতে হাঁটতে এদিকে এসে পড়ে, উপযুক্ত ব্যবস্থা কি সে গ্রহণ করতে পারবে? তারটা চোখে পড়তেই বিস্মিত হয়ে থমকে দাঁড়াবে সৈন্যটা ঝুঁকে পড়ে তুলতে গিয়েও স্থির হয়ে রইবে দুএক মুহূর্ত। আর ঠিক তখনই আঘাত হানতে হবে জয়েসকে, বিদ্যুৎগতিতে।

প্রতিটা মাংসপেশী অসাড় হয়ে আসতে চাইল। এ কোন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হলো সে? পরীক্ষাটা একাধারে ঘৃণিত এবং আতঙ্কজনক।

স্কুলের নির্দেশগুলো সে মনে করল একে একে। কিন্তু এই আতঙ্ক তাকে ছেড়ে গেল না।

এতদিনে সে বুঝতে পারল, কমান্ডিং অফিসার কেন কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলেন সেই প্রশ্নটা: প্রকৃত প্রয়োজনের সময় এই অস্ত্রটা কি তুমি ঠাণ্ডা মাথায় ব্যবহার করতে পারবে? জটল সেই প্রশ্নের সঠিক কোন জবাব তার জানা নেই। প্রবৃত্তিগত প্রতিক্রিয়া আর ইচ্ছেশক্তির ওপর অবিশ্বাস এসে যাচেছ। বিস্ফোরক বসাবার জন্যে নদীপথে যাবার সময় সব ব্যাপারেই আত্মবিশ্বাসে টগবগ করছিল সে, অথচ এখন সবকিছুতেই দেখা দিয়েছে ঘোর সন্দেহ। সন্তর্পণে জয়েস তাকাল দুরিটার দিকে।

ফলাটা বেশ লম্বা, ক্ষুরধার। ধাতব হাতলটা খাটো হলেও মুঠো করে ধরার পক্ষে যথেষ্ট।

এই অস্ত্র ব্যবহারের সবরকম কৌশলই শেখানো হয়েছে স্কুলে। শক্ত সামনে থেকে এলে কি করতে হবে, পেছন থেকে কাপিয়ে পড়লে কি করতে হবে, এমনকি কাউকে টু শব্দ কসুতে দিতে না চাইলে কানের পাশে ছুরি চালিয়ে কিভাবে ফাঁক কৃরে দিতে হবে গলাটা–কিছুই বাদ যায়নি। অনুশীলনগুলো এক, দুই, তিন করে বার বিশেক এল সে। তবু নিশ্চিত হতে পারল না নিজের সম্বন্ধে। সারা শরীরে দেখা দিল বিন্দু বিন্দু ঘাম।

বাইরে থেকে কোনও সাহায্য? চারপাশে তাকাল সে। না, কেউ নেই কোথাও। অদ্ভুত এই শব্দ পরিবেষ্টিত জায়গায় সে অষণ রকমের একা। সেতু এখন নিপ্রাণ, অর্থহীন একটা ক মাত্র। পুরো কওয়াই উপত্যকাটাই যেন এখন প্রাগৈতিহাসিক হিস্র জন্ত। সাহায্যের কোনও রকম আশা নেই। খাবার বা পানীয়ও নেই। চিবুনোর মত কিছু একটা পেলেও বোধহয় খানিকটা ভাল লাগত।

আবার তাকাল সে চারপাশে। না, কেউ নেই কোথাও। শিউরে উঠল জয়েস। অথচ দুদিন আগেও এ থাকার জন্যে সে মরে যাচ্ছিল প্রায়। চাইছিল কারও সাহায্য না নিয়ে নিজে কাজটা করতে। এমনকি অনুমতি না পেলে এক নম্বরের ওপর বোধ হয় এই হত সে।

চকিতে কথাটা মনে পড়ে গেল। যা, আতঙ্ক ভুলে থাকার একটা পথ আছে। বলা যায়, একমাত্র পথ। আত্মসোহন। ডুবে যেতে হবে আত্মসম্মোহনে।

চুড়ান্ত মনঃসংযোগ করে চোখের সামনে গার্ডারের মডেল ফুটিয়ে তুলল জয়েস। তারপর বসে পড়ল তার সামনে হিসেব কষার জন্যে। ফলে সেতুর পাশে এসে দাঁড়ানো কয়েকজন জাপানী সৈন্য তার বিস্ময় জাগাতে পারল না।

২৩.

সিয়ার্সের চোখেও পড়েছে জাপানী সৈন্যগুলো।

বিস্ফোরকের ভয়াবহ চিন্তাটা মাথায় আসার পর ঢাল বেয়ে খানিকটা ওপরে উঠেছেন তিনি, যেখান থেকে সেতু আর নদী দুটোই দেখা যায়। পাইলগুলোর চারপাশ বিনকিউলার দিয়ে টিয়ে টিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেবলেন, বাদামী একটা রঙ ঢেউয়ের তালে তালে উঁকি দিচ্ছে আর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। মাথায় চিন্তা চলল ঝড়ের গতিতে। ফোর্স ৩১৬-এর কর্মকর্তারা বলেন, যখন মনে হয় আর কোনও উপায় নেই, তখনও থাকে ছোটটি উপায়। কি জীবনে এই প্রথম বারের মত সত্যিই তিনি কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। অসহায়ত্বের জন্যে নিজের ওপরেই রেগে গেলেন সিয়ার্স।

তীর ছোঁড়া হয়ে গেছে। আরও ওপরে অবস্থানরত ওয়ার্ডেনের চোখেও নিশ্চয় পড়েছে কওয়াইয়ের এই বিশ্বাসঘাতকতা। জয়েস? পরিবর্তনটা কি ও টের পায়নি? কে বলতে পারে, এই দুর্ভাগ্য মোকাবেলার একটা বুদ্ধি ওর মাথায় খেলে যাবে কিনা!

ধীরে ধীরে কেটে গেল অতি দীর্ঘ দুটো ঘণ্টা। জাপানীদের অস্থায়ী কুটিরগুলোও দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। পুরো ইউনিফর্ম পরে ঘোরাফেরা করছে জাপানী কয়েকজন সৈন্য। নদী থেকে একশো গজ দূরে পুরো একটা কোম্পানি ট্রেনের জন্যে অপেক্ষমাণ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এখন ওদের মনোযোগ সম্পূর্ণ দখল করে আছে? সিয়ার্স তেমনটাই আশা করলেন। কিন্তু জাপানী প্রহরীদের একটা দল এ-মুহূর্তে এগিয়ে আসছে সেতুর দিকে।

একজন সার্জেন্টের নেতৃত্বে সেতুর ওপর দিয়ে ওরা এগিয়ে চলল দুটো সারিতে বিভক্ত হয়ে। ওদের কাজ ট্রেন আসার আগে একটা চুড়ান্ত পরিদর্শন করা। কয়েক ধাপ পরপর ওরা ঝুঁকে পড়ল প্যারাপেট থেকে। এ-কাজে ওদের মন নেই, নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন সিয়ার্স। ব্যাপারটা অনেকটা বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকার মত। কাজ সেরে নিজেকে সান্তনা দেয়া যে, দায়িত্বে ফাঁকি দেয়া হয়নি। ওরা তাকাচ্ছে কিন্তু দেখছে না, বললেন সিয়ার্স মনে মনে। ওদের প্রত্যেকটা পদক্ষেপ যেন ধ্বনিত হচ্ছে তার মাথার ভেতরে। চোখ সরানোর সাহস তার হলো না। প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ করার পাশাপাশি তিনি প্রার্থনা করে চললেন ঈশ্বর, শয়তান বা রহস্যময় অন্যান্য শক্তির উদ্দেশে। ইতোমধ্যেই ওরা চলে গেছে সেতুর মাঝ বরাবর। প্যারাপেটের ওপর ঝুঁকে পড়ল সার্জেন্ট, নদীর দিকে নির্দেশ করে কি যেন বলল সামনের লোকটাকে। চিৎকার করে ওঠা থেকে নিজেকে বিরত রাখার জন্যে হাত কামড়ে ধরলেন সিয়ার্স। সার্জেন্ট হাসল। সম্ভবত নদীর পানি কমা নিয়ে কিছু একটা বলেছে সে। আবার এগিয়ে চলল দুজনে। সিয়ার্স ঠিকই ভেবেছেন: ওরা তাকাচেছ কিন্তু দেখছে না। শেষ প্রহরীটাও একসময় চলে গেল। কিছুই ওরা খেয়াল করেনি।

এবার ওরা এগোল তীরের পাশাপাশি। হঠাৎ ঝুঁকে পড়ল এক প্রহরী। লাফ দিয়ে উঠল সিয়ার্সের হৃৎপিণ্ড। কিন্তু না, সোজা হয়ে প্রহরীটা রওনা দিল আবার।

ওরা কিছু দেখেনি, ফিসফিস করে নিজেকেই শোনালেন সিয়ার্স, যেন এ ছাড়া আশ্বস্ত হবার কোনও উপায় তার আর ছিল না। প্রহরীদের দলটা অপেক্ষমাণ কোম্পানির সাথে গিয়ে যোগ না দেয়া পর্যন্ত ওদের ওপর থেকে তিনি চোখ সরাতে পারলেন না।

আমি ওদের একজন হলে, বিড়বিড় করে বললেন তিনি, এতটা অসতর্ক কিছুতেই হতাম না। যে-কোনও ব্রিটিশ সৈন্য ব্যাপারটা অবশ্যই বুঝতে পারত। আহ! ট্রেন আসতে আর বেশি দেরি নেই।

কর্কশ স্বরে আদেশ দিল কে যেন। চমকে উঠে চোখ তুলতেই সিয়ার্স দেখলেন, দূর দিগন্তে কালো একরাশ ধোঁয়ার আভাস। জেনারেল, সৈন্য আর বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসছে জাপানী কনভয়।

ভদ্রবীভূত হয়ে এল সিয়ার্সের হৃদয়। রহস্যময় সেই শক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতায় পানি গড়াল দুগাল বেয়ে।

আর কেউ আমাদের ঠেকাতে পারবে না, ফিসফিস করে বললেন তিনি। ভাগ্যের পরিহাস শেষ হয়ে গেছে। ট্রেনটা এসে পৌঁছুবে আর মিনিট বিশেকের মধ্যেই।

উত্তেজনা দমন করে ঢাল বেয়ে নেমে আসতে লাগলেন সিয়ার্স। তাই তিনি দেখতে পেলেন না, কর্নেলের পোশাক পরা একজন ব্রিটিশ উল্টোদিকের তীর ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছেন সেতুটার দিকে।

মাসের পর মাস কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে নির্মিত কওয়াই সেতুর ওপর দিয়ে কর্নেল নিকলসন একবার হাঁটতে চান।

বেশির ভাগ বন্দী এবং সমস্ত অফিসার চলে গেছে দুদিন আগে। প্রথমে তারা যাবে নির্দিষ্ট একটা স্থানে। সেখান থেকে হয় মালয় নয়তো জাপানে।

মহামান্য সম্রাটের আদেশে বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে কওয়াই সেতুর সমাপ্তি উৎসব। কিন্তু কওয়াই ক্যাম্পে যেটা হয়েছে, তার সাথে বুঝি কোনওটারই তুলনা চলে না।

প্রথমে ভাষণ দিলেন কর্নেল সাইতো। আনন্দের সঙ্গে কওয়াই সেতুর সমাপ্তি ঘোষণা করে, কাজের প্রতি বন্দীদের বিশ্বস্ততার উচ্চপ্রশংসা করলেন তিনি। তারপর কর্নেল নিকলসনের পালা। ব্রিটিশ সৈন্যদের আন্তরিক অভিনন্দন জানানোর পর তিনি বললেন, তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়নি। প্রতিকূল পরিবেশে তারা যেরকম আচরণ করেছে, জাতির জন্যে তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সবশেষে বললেন, এমন নিবেদিতপ্রাণ সৈন্যদের কমান্ডিং অফিসার হতে পেরে তিনি গর্বিত।

ভাষণ শেষে উৎসব। যে-কোনও ধরনের আনন্দ করার অনুমতিই শুধু দিলেন না, সে-আনন্দে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেন কর্নেল নিকলসন। ফলে বেশ কয়েকটা কনসার্ট, কৌতক পরিবেশন, বিচিত্র পোশাক পরে যেমন খুশি সাজো, এমনকী ব্যালে নৃত্যও বাদ গেল না।

দেখেছ, ক্লিপটন, বললেন কর্নেল, একবার তুমি আমার সমালোচনা করেছিলে, কিন্তু আমি আদর্শ থেকে সরে যাইনি যেভাবেই হোক, আত্মবিশ্বাস বজায় রাখতে চেয়েছিলাম ইউনিটে। সেটা পেরেছি!

চারপাশে নজর বোলালেন ক্লিপটন। কর্নেল ঠিকই বলেছেন। শারীরিক অবস্থা করুণ হওয়া সত্ত্বেও বন্দীদের মধ্যে যেন ফুর্তির বান ডেকেছে।

পরদিনই পাঠিয়ে দেয়া হলো বন্দীদের। গুরুতর অসুস্থ আর পরাই কেবল রয়ে গেল ক্যাম্পে। কওয়াই সেতুর ওপর দিয়ে প্রথম ট্রেনটা পার হবার দৃশ্য দেখতে না পাবার জন্যে আপসোস করলেন রীভত্স আর হিউজেস। অসুস্থ বন্দীদের সাথে থেকে যাবার অনুমতি পেলেন কর্নেল নিকলসন।

সেতুর ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কর্নেলের মুখে ফুটে উঠল তৃপ্তির একটা হাসি। কওয়াই সেতু এখন আর কল্পনার বস্তু নয়। ব্রিটিশ প্রতিভার এই স্বাক্ষর এখন এক গৌরবময় বাস্তব। খানিকটা এগোতেই তিনি টের পেলেন, সেতুটার কোথাও কোনও খুঁত নেই। তবু একবার পরিদর্শন করা দোষের কিছু নয়। জাপানী পেট্রলের রিপোর্টে তার মোটেই আস্থা নেই। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানেন, একেবারে নিরাপদ পরিস্থিতিতেও শেষ মুহূর্তে উঁকি দেয় বিপদ।

প্রতি পাঁচ-ছধাপ অন্তর অন্তর তিনি ঝুঁকে পড়ছিলেন প্যারাপেটের ওপর। সেতুর মাঝ বরাবর গিয়ে প্যারাপেটের ওপর কুঁকতে তার চোখ গেল একটা পাইলের দিকে। এবং প্রায় সাথে সাথে থমকে দাঁড়ালেন বিস্ময়াভিভূত কর্নেল।

পাইলটার গায়ে ঢেউ ভাঙছে অন্যগুলোর চেয়ে একটু বেশি। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করতে তার মনে হলো, কাঠের গায়ে লেপটে আছে বাদামী একটা পোঁটলা। কয়েক ধাপ এগিয়ে আবার ঝুঁকে পড়লেন তিনি। হ্যাঁ, এই পাইলের গায়েও বাদামী পোটলা।

তাজ্জব কাণ্ড, আপন মনে বললেন কর্নেল নিকলসন।

এবারে তিনি ঝুঁকলেন সেতুর উল্টো পাশে গিয়ে। এখানেও বাদামী একটা পোটলা দেখা যাচ্ছে পানির ইঞ্চিখানেক নিচে। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন কর্নেল নিকলসন। শেষমেশ সেতুর ওপর থেকে নেমে এসে জাপানী প্রহরীদের মত তিনিও এগোলেন তীর ধরে। হাঁটছেন আর বিড়বিড় করে কথা বলে চলেছেন নিজের সাথে

দুদিন আগে ওগুলো দেখা যায়নি। পানি অবশ্য তখন অনেক বেশি ছিল। হয়তো ঢেউয়ে ভেসে আসা নোংরা কোনও জিনিস লেগে গেছে পাইলগুলোর গায়ে। তবে…

অদ্ভুত এক সন্দেহ দেখা দিল তার মনে। ব্যাপারটা বিশ্বাস করা কঠিন, তবু সুন্দর সকালটা মাটি হয়ে গেল কর্নেল নিকলসনের। আবার তিনি উঠলেন সেতুর ওপরে। একটু পরেই নেমে এলেন হতভম্ব হয়ে।

না, এটা হতে পারে না, বললেন তিনি বিড়বিড় করে। যদি না চীনের কম্যুনিস্ট কোনও দল…

অন্তর্ঘাতমূলক কাজ তাঁর মতে একমাত্র দুবৃত্তদেরই সাজে।

না, এটা হতে পারে না, বললেন আবার, কিন্তু মনের ফুরফুরে ভাবটা বজায় রাখা সম্ভব হলো না আর।

ট্রেনটা এখন দেখা যাচ্ছে, তবে এখানে এসে পৌঁছুতে আরও অন্তত দশ মিনিট লাগবে। সেতু আর কোম্পানিটার মাঝখানে পায়চারি করছেন সাইতো। হঠাৎই মনস্থির করে কর্নেল নিকলসন গিয়ে দাঁড়ালেন তার পাশে।

কর্নেল সাইতো, বললেন তিনি, ব্যাপার খুব একটা সুবিধের মনে হচ্ছে না। ট্রেন যাবার আগে ভাল করে আমাদের বোধহয় একবার দেখা দরকার।

জবাবের অপেক্ষায় না থেকে নেমে এলেন তিনি পানির কিনারায়। ইচ্ছে, ওখানে বাধা ক্যান্টা নিয়ে যাবেন একেবারে পাইলগুলোর কাছে। কিন্তু নামতে না নামতেই তার চোখ পড়ল বৈদ্যুতিক তারটার ওপর। ঐ কুঁচকে কর্নেল নিকলসন এগিয়ে গেলেন সেই দিকে।

২৪.

ঢাল বেয়ে কর্নেল নিকলসনকে তীরের দিকে নামতে দেখে খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না সিয়ার্স। কিন্তু পেছনে কর্নেল সাইতোকে দেখার সাথে সাথে তিনি বুঝতে পারলেন, দুর্ভাগ্য এখনও তাদের পিছু ছাড়েনি। ওদিকে সেতুর ওপরে কর্নেলের ভাবভঙ্গি দেখে সতর্ক হবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি জয়েস। কিন্তু কর্নেলের পিছুপিছু তীরে সাইতোকে দেখার সাথে সাথে তার হাত চেপে বসেছে। ছুরির হাতলে।

সিয়ার্সের মনে হলো, জাপানী অফিসারটিকে একরকম টেনে নিয়ে চলেছেন কর্নেল নিকলসন। বিড়বিড় করে আপনমনে কথা বলতে লাগলেন তিনি:

আমাদের কর্নেল ওঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন! ইস, ব্যাপারটা যদি তাকে বুঝিয়ে বলতে পারতাম! এক মিনিট সময়ও যদি পেতাম কথা বলার!

ভেসে আসছে এঞ্জিনের ভুশভুশ ধোঁয়া ছাড়ার শব্দ। জাপানী সব সৈন্য নিশ্চয় এখন প্রেজেন্ট আর্মের জন্যে তৈরি। কর্নেল নিকলসন এবং সাইতোকে এখন ক্যাম্প থেকে দেখা যাবে না। অস্থির হয়ে উঠলেন এক নম্বর। এরকম পরিস্থিতিতে কি করতে হয়, তা প্লাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশনস কোম্পানির সবারই জানা আছে। তিনিও কোমর থেকে খুলে নিলেন ছুরিটা। অবশ্য এটা ব্যবহারের কোনও ইচ্ছে তার নেই। বরং উল্টোপাশের জয়েসকে তিনি স্মরণ করিয়ে দিতে চান এ-মুহূর্তের কর্তব্য।

তারের সামনে এসে থেমে গেলেন কর্নেল নিকলসন। পেছনে থপথপ করতে করতে এগিয়ে আসছেন সাইতা। সিয়ার্সের এ-মুহূর্তের অনুভূতি অবর্ণনীয়। মাথার ওপরে ছুরি ঘোরাতে ঘোরাতে তিনি কথা বলতে লাগলেন জোরে জোরে।

ওই ছেলে এ-কাজ পারবে না! প্রত্যাশার একটা সীমা আছে। অফিসে মডেল একে জীবন কাটানো মানুষের পক্ষে এ-কাজ অসম্ভব! সুতরাং দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হবে। না, এ-কাজ ছেলেটা পারবে না!

সাইতো এসে পাশে দাঁড়াতেই ঝুঁকে পড়ে তারটা তুলে নিলেন কর্নেল নিকলসন।

ওই ছেলে এ-কাজ পারবে না। আর মাত্র তিন মিনিট, তা হলেই এসে পৌঁছুবে ট্রেনটা। না, ছেলেটা পারবে না!

এক থাই রাইফেলের পাশে গুড়ি মেরে বসে আতঙ্কিত চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। ছুরিটা সামনে বাড়িয়ে পাথরের মত স্থির হয়ে আছেন সিয়ার্স।

না, ছেলেটা এ-কাজ পারবে না! সর্বশক্তিমান ঈশ্বর! ওর মাথাটা খারাপ করে দাও; রক্তের জন্যে উন্মাদ হয়ে উঠুক ও – মাত্র দশ সেকেন্ডের জন্যে!

বন্য এই প্রার্থনা শেষ হতে না হতেই জঙ্গলের মাঝে একটা নড়াচড়া লক্ষ করলেন সিয়ার্স। ধীরে ধীরে ফাঁক হয়ে গেল একটা ঝোপ। ছুরি হাতে সন্তর্পণ ঢাল বেয়ে নামছে জয়েস। উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল তার।

সাইতো এখন জঙ্গলের দিকে পেছন ফিরে আছেন, এক হাতে ধরা তাবুটা ইংরেজী কয়েকটা কথা কানে এল সিয়ার্সের:

ব্যাপারটা সত্যিই ভয়াবহ, কর্নেল সাইতো!

ক্ষণিকের স্তব্ধতা। তার ধরে টানছেন জাপানী কর্নেল। অলক্ষিতে জয়ে গিয়ে হাজির হলো দুজনের পেছনে।

হায় ঈশ্বর! চেঁচিয়ে উঠলেন কর্নেল, সেতুতে মাইন বসানো হয়েছে, কর্নে সাইতো! পাইলে যে জিনিসগুলো দেখেছি, ওগুলো বিস্ফোরক! আর এই তারটা…

জঙ্গলের দিকে তাকালেন কর্নেল নিকলসন। সাইলোর হাবভাবে মনে হলো, কথাগুলো তিনি এখনও পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেননি। পলকে চে আছেন সিয়ার্স। ডান থেকে বামে হাত ঝাঁকিয়ে ইশারা করলেন তিনি, প্রা সাথেসাথেই ঝলকে উঠল শাণিত ইস্পাত। পরিচিত পরিবর্তন তৎক্ষণাৎ লন্থ করলেন তিনি জাপানী অফিসারের দেহে।

তা হলে কাজটা ও পারল? হ্যাঁ, এবং পেরেছে খুব ভালভাবেই! এক এদিকওদিক হয়নি ছুরি ধরা হাতটা। মৃত্যুকালীন-আক্ষেপ রু হয়ে গে, সাইােের। জয়েসের বাম হাতটা নেমে এল সদ্য ফাঁক হয়ে যাওয়া গলার পাশে মুমূর্ষু অফিসারটির শ্বাসরোধ করতে চায় সে, সেইসাথে থামাতে চায় নিজে শরীরে শুরু হয়ে যাওয়া কাঁপুনি।

সাইলোর শরীর ওপরে পড়ায় রক্তে ভিজে গেছে জয়েস। হত্যাকাণ্ডটার কম মনে পড়তেই অসাড় হয়ে গেল সে। ঝোঁকের মাথায় প্রথম রাউন্ডটা জিতে গেলে, বুঝতে পারল না, এখন কি করা উচিত। শেষমেশ একটা জোর ধাক্কা দিল সে আধপাক ঘুরে পানিতে গিয়ে পড়ল নিপ্রাণ দেহটা।

চারপাশে একবার দৃষ্টি বোলাল জুয়েস। দুই তীরে কেউ নেই। জয়। হয়েছে, কিন্তু আতঙ্ক এখনও দূর হয়নি। হাটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে সাধারণ দুচারটে টুকিটাকি এখনও বাকি। তার মধ্যে প্রথম হলো, এই ব্যাপার ব্যাখ্যা করা। তবে দুটো কথা বললেই সম্ভবত যথেষ্ট হবে! নিল দাড়ি আছেন কর্নেল নিকলসন, ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি হতভম্ব হয়ে গেছেন।

অফিসার! ব্রিটিশ অফিসার, সার! বিড়বিড় করে বলল জয়েস। সেতু ধ্বংস করা হবে। সরে দাঁড়ান!

নিজের কণ্ঠ অপরিচিত ঠেকল তার কাছে। প্রত্যেকটা শব্দ উচ্চারণ করুন কষ্ট হলো ভীষণ। তবু ইনি যেন সে কথাগুলো শুনতে পর্যন্ত পাচ্ছেন না!–

ব্রিটিশ অফিসার, সার! বলল সে আবার। কলকাতা থেকে ফোর্স ৩১৬ কমান্ডাে। সেতু উড়িয়ে দেয়ার আদেশ।

সামান্য একটু নড়ে উঠলেন কর্নেল নিকলসন। অদ্ভুত এক আলোয় জ্বল লাগল তাঁর চোখজোড়া। দুএক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কঁাকা স্বরে বললেন:

সেতু উড়িয়ে দেবে?

চলে যান, স্যার। ট্রেন আসছে। নইলে ওরা ভাববে, আপনিও ঘটনার সাথে জড়িত আছেন।

স্থির হয়ে রইলেন কর্নেল নিকলসন।

আর কথা বলার সময় নেই। পরিষ্কার কানে আসছে এঞ্জিনের ধোঁয়া ছাড়ার শব্দ। জয়েসের মনে হলো, যে-কোনও মুহূর্তে এখন বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে পা দুটো। আসল কাজটা এখনও বাকি। ঝোপে ফিরে যাবার জন্যে হামাগুড়ি দিয়ে সে উঠতে লাগল ঢাল বেয়ে।

সেতু উড়িয়ে দেবে? আবার বললেন কর্নেল।

এক ইঞ্চিও নড়েননি তিনি। অগ্রসরমান জয়েসের দিকে তাকিয়ে যেন বুঝতে চাইছেন কথাটার অর্থ। হঠাৎ তিনি দ্রুত অনুসরণ করলেন জয়েসকে। ডালপালা সরিয়ে এগোতে এগোতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল জয়েস জেনারেটরে ধাক্কা লেগে। তবু চোখের পলকে তার হাত চলে গেল প্লাঞ্জারের ওপর।

সেতু উড়িয়ে দেবে! আবারও বললেন কর্নেল।

ব্রিটিশ অফিসার, স্যার! তোতলাতে লাগল জয়েস প্রায় বিলাপের ভঙ্গিতে। কলকাতা থেকে ব্রিটিশ অফিসার…আদেশ…

কথাটা জয়েস শেষ করতে পারল না। চিৎকার ছেড়ে কর্নেল নিকলসন ঝাপিয়ে পড়লেন তার ওপর:

বাঁচাও!

২৫.

দুজন লোক মারা গেছে। কিছু ক্ষতি সাধিত হয়েছে, কিন্তু ব্রিটিশ কর্নেলের বীরত্বের জন্যে অক্ষত রয়েছে সেতুটা।

কলকাতায় সংক্ষিপ্ত এই রিপোর্ট পাঠিয়েছেন ক্যাপ্টেন ওয়ার্ডেন, মিশনের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি।

রিপোর্টটা পড়েই কর্নেল গ্রীনের মনে হলো, অদ্ভুত এই ঘটনা সম্বন্ধে এখনও অনেক বিষয় জানার আছে। ফলে ব্যাখ্যা চেয়ে পাঠালেন তিনি। ওয়ার্ডেন জবাব। দিলেন, তার আর কিছুই বলার নেই। এবারে কমান্ডিং অফিসার সিদ্ধান্ত নিলেন, ওয়ার্ডেনকে ওখানে রাখাটা আর মোটেই উচিত হবে না, সম্ভবত পুরো জঙ্গলে কভু তাশি চালাবে জাপানীরা। বাই স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে যোগাযোগ করার। জলে জল থেকে খানিকটা সরে ড্রপ করা হলো দ্বিতীয় একটা দল। তারপর বঙ্গোপসাগরের এক নির্জন দ্বীপে পাঠিয়ে দেয়া হলো একটা সাবমেরিন। দুসপ্তাহ হেঁটে সেখানে পৌঁছুলেন ওয়ার্ডেন। আরও তিন দিন পর তাঁকে দেখা গেল কলকাতায়।

কর্নেল গ্রীনের সামনে বসে প্রথমে আক্রমণের প্রস্তুতি সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত একটা বিণ দিলেন তিনি, তারপর এসে পড়লেন মূল অপারেশনে। সহজাত শান্ত গলায় বর্ণনা দিয়ে চললেন ওয়ার্ডেন, একটা ঘটনাও বাদ গেল না। কিন্তু গল্প যতই এগোল, পরিবর্তিত হলো তাঁর গলা। গত এক মাস থাই স্বেচ্ছাসেবকদের মাঝে তিনিই ছিলেন একমাত্র শ্বেতাঙ্গ। নাটকের প্রতিটি দৃশ্য তখন টুকরো টুকরো হয়ে আলোড়ন তুলেছে মগজের মধ্যে, যেন ওগুলোকে একত্র করা আর কিছুতেই সম্ভব নয়। কিন্তু তার যুক্তিবাদী মন সবসময় খুঁজে ফিরেছে ব্যাখ্যা।

মানসিক এই অস্থিরতার ফলেই সম্ভবত শুষ্ক সামরিক রিপোর্টে সীমাবদ্ধ থাকতে চাইলেন না ক্যাপ্টেন ওয়ার্ডেন

ফোর্স ৩১৬-এর অফিসে বসে এই রিপোের্ট দেয়ার পাশাপাশি তিনি নিজের ভয়, উদ্বেগ, সন্দেহ আর ক্রোধও যেন প্রকাশ করতে চান। তবে কোনও অবস্থাতেই যুক্তিকে বিসর্জন দেয়ার ইচ্ছে নেই তার।

রিপোর্ট শুনতে শুনতে কর্নেল গ্রীন অনুভব করলেন, বিখ্যাত যুক্তিবাদী প্রফেসর ওয়ার্ডেনকে যেন ঠিক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবু অসীম ধৈর্যের সাথে শুনে গেলেন তিনি, খুব একটা বাধা দিলেন না তাকে। আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও যারা মিশনে চরম ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে, তাদের মানবিক অনুভূতি প্রকাশের খানিকটা সুযোগ দেন ফোর্স ৩১৬-এর কমান্ডার।

আপনি হয়তো বলবেন, স্যার, ছেলেটা বোকার মত কাজ করেছে। হ্যাঁ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে ওই অবস্থায় ওর চেয়ে ভাল করতেও পারত না আর কেউ। ওর প্রত্যেকটি কাজ আমি লক্ষ করেছি। চোখ সরাইনি এক মুহূর্তের জন্যে। ব্রিটিশ কর্নেলকে ও কি বলছে, তাও মোটামুটি আন্দাজ করতে পারছিলাম। ট্রেন প্রায় পৌঁছে গেছে, ঠিক সেই সময় কর্নেল ঝাপিয়ে পড়ল ওর ওপর। একটা ব্যাপারই জয়েস বুঝতে পারেনি। জাপানী বুড়োটার গলা কেটে কোনও লাভ হয়নি। কাটতে হত আসল গলাটা। তাই না, স্যার?

একটা জিনিসের অভাব ছিল ওর–অন্তর্দৃষ্টি। ওই জিনিসটি থাকলেই ও বুঝতে পারত, আসল শত্রু কে। সেতুর ওপরে বুড়ো শয়তানটাকে হাটতে দেখলে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন কোনও মানুষ সহজেই বুঝত যে, নিজের তত্ত্বাবধানে তৈরি চমক্কার সেতুটার ধ্বংসের কথা চিন্তা করাও বুড়োর পক্ষে অসম্ভব। বিনকিউলারের ভেতর দিয়ে বুড়োর পায়চারি দেখতে দেখতে আমার শুধু আপসোস হচ্ছিল, এটা রাইফেলের টেলিস্কোপ হলো না কেন! পায়চারি করতে করতে বুড়োর মুখে ফুটে উঠল প্রায় পবিত্র একটা হাসি। ফোর্স ৩১৬-তে আমরা যাকে ম্যান অভ অ্যাকশন বলি, স্যার, বুড়ো তার নিখুঁত উদাহরণ। স্রেফ দুর্ভাগ্য ভাকে ডুবিয়ে দেবে, এচিন্তাও বুড়ো করতে পারে না। হাল ছেড়ে দেয়া তার ধাতেই নেই। বুড়োই তো চিকার ছেড়েছিল জাপানীদের উদ্দেশে!

নীল-চোখো ওই বুড়ো শয়তান সম্ভবত সারা জীবন ধরে স্বপ্ন দেখেছে এমন দীর্ঘস্থায়ী কিছু একটা তৈরি করার। শহর বা ক্যাথিড্রাল তৈরির সুযোগ যেহেত নেই, অতএব লাগো সেতুর পেছনে। আর তাই এটা ধ্বংসের চিন্তা করাও তার পক্ষে কঠিন।

সারা জীবন ধরে এই লোকটা কর্তব্যপরায়ণতায় ছিল অটল। কোনও কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন হতে দেখার চেয়ে আনন্দের তার কাছে আর কিছু ছিল না। মোটকথা, সে ছিল অ্যাকশনের পাগল–ঠিক যেমন আপনি, স্যার, ঠিক যেমন আমরা। টাইপিস্ট থেকে আমাদের জেনারেলেরা পর্যন্ত অ্যাকশনের পেছনে ছুটেছে বুঝতে পারি না, এই অ্যাকশনপূজা শেষমেশ কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের। গত এক মাস ধরে আমি শুধু এসব কথাই ভাবছি, স্যার। ভাবছি, ওই বুড়ো গর্দভটা খুবই ভাল ছিল কি মানুষ হিসেবে? খাঁটি একটা আদর্শ ছিল তার? সে-আদর্শ আমাদের আদর্শের মতই পবিত্র? এবং একইরকম? এসব কথাই আমি ভাবছি, স্যার, গত এক মাস ধরে। অ্যাকশনের এই পাগলামি মানুষের বচারবুদ্ধিকে ভোঁতা করে দেয়, যার ফলাফল মারাত্মক হতে বাধ্য। যেমন, আমাদের মারাত্মক একটা ভুল হলো, প্রাচ্যের মানুষকে প্লাস্টিকের সাহায্যে ট্রেন আর সে ওড়াতে শেখানো। তো…

শেষে কি হলো, বলো, শান্ত গলায় বললেন কর্নেল গ্রীন। অ্যাকশন ছাড়া আর কিছুতেই আমার মাথাব্যথা নেই, কথাটা সবসময় মনে রাখবে।

অ্যাকশন ছাড়া আর কিছুই যখন শুনতে চান না, স্যার…গুপ্ত আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এল জয়েস। গতি সাবলীল। আঘাত হানল সে নিখুঁতভাবে। হ্যাঁ, একচুলও এদিকওদিক হয়নি। আরেকটু বিচারবুদ্ধির প্রয়োজন ছিল ওর। তা হলেই বুঝতে পারত, আসল শুক্র কে। বুড়ো এমন দ্রুতভাবে ছুটে গেল ওর দিকে, তারপর বুজনেই গড়াতে লাগল ঢাল বেয়ে। পানির কিনারে গিয়ে থামল। খালি চোখে দেখলে মনে হবে, দুজনেই বুঝি চুপচাপ পড়ে আছে। কিন্তু বিনকিউলার দিয়ে আমি দেখেছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কর্নেল ছিল জয়েসের ওপরে। কর্নেল ওকে পিষে ফেলতে চাইছিল ভারী শরীরের চাপে, ওদিকে জয়েসের দুহাত চেপে বসেছিল কর্নেলের গলায়। সবকিছুই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম পরিষ্কারভাবে। দুজনেই জাপটাজাপটি করছিল সাইতোর লাশের পাশে। হঠাৎই, সার, ও বুঝতে পারল নিজের ভুল। পরিষ্কার দেখতে পেলাম আমি। বুঝতে পারল, আঘাত হানা উচিত ছিল কর্নেল নিকলসনকে।

আমি দেখলাম, ওর হাত আঁকড়ে ধরল ছুরির হাতল। তারপর শক্ত হয়ে গেল ও। মাংসপেশীগুলোর নড়াচড়া পর্যন্ত যেন টের পাচ্ছিলাম আমি। মুহূর্তের জন্যে ভাবলাম, ও বোধহয় মনস্থির করে ফেলেছে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে শক্তি বলে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই ওর। আর কোনও কাজ করতে ও অক্ষম–অথবা বলা যায় অনিচ্ছুক। ছুরিটা পড়ে গেল ওর হাত থেকে। পুরোপুরি আত্মসমপর্ণ, স্যার। নিজেকে যেন নিয়তির হাতে সঁপে দিল ও। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল একটামাত্র শব্দ। কোনওদিন কেউ জানবে না, কী ছিল ওটা। শখ, প্রার্থনা, নাকি চরম হতাশার কোনও উচ্চারণ। রক্তের নেশা ওর ছিল না, স্যার, থাকলেও অন্তত বোঝা যায়নি কখনও। ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সবসময় শ্রদ্ধা করুত ও আমার বা সিয়ার্সের সাথে কথা বলা শুরু করতেই অ্যাটেনশন হয়ে যেত। আমরা প্রায়ই নিষেধ করতাম। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, ওর উচ্চারিত শব্দষ্টা ছিল–স্যার। হাল ছেড়ে দেয়ার আগে নিশ্চয় ওর কথাটাই বলেছিল জয়েস। সবকিছুই নির্ভর করছিল ওর ওপর। সুতরাং বারোটা বেজে গেল কাজে।

তারপর একসাথে ঘটল অনেকগুলো ঘটনা। আমার মাথার ভেতরে সেসব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল, তবে পরে সেগুলো আলাদা করতে পেরেছি। এগিয়ে আসছে ট্রেন। প্রতি মুহূর্তে বেড়ে চলেছে এঞ্জিনের শব্দ। কিন্তু সে-শব্দ ওই উন্মাদের চিৎকার ছাপিয়ে উঠতে পারছে না। গলা ফাটাচ্ছে সে জাপানীদের উদ্দেশে; ঠিক যেমন গলা ফাটানো হয় প্যারেড গ্রাউন্ডে।

এ-সবই আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম, স্যার, আর ওই দেখা পর্যন্তই। অবশ্য ওর জায়গায় থাকলে আমিও হয়তো ওরকমই করতাম। ওর চেয়ে ভাল কিছু করতে পারতাম না এটা নিশ্চিত; কেউই পারত না–শুধু, সম্ভবত, সিয়ার্স ছাড়া। সিয়ার্স! হ্যাঁ, হঠাৎ করেই টের পেলাম, কর্নেলের চিৎকারের পাশাপাশি অন্য একটা চিৎকার ভেসে আসছে। গলাটা সিয়ার্সের। সারা উপত্যকায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তার তীব্র কণ্ঠস্বর। ঘোর উন্মাদের কণ্ঠস্বর, স্যার। দুটো শব্দই শুধু বোঝা যাচ্ছিল: ছুরি চালাও! ভুলটা তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন, এবং আমার আগেই। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে।

কিছুক্ষণ পর একজন মানুষকে দেখলাম পানিতে। তীরবেগে সাঁতরে চলেছে। শত্রুপক্ষের তীর অভিমুখে। চিনতে পেরে চমকে উঠলাম। সিয়ার্স! অ্যাকশনের জন্যে একেবারে পাগল হয়ে উঠেছিলেন। আমার অবস্থাও তাই। সেদিন সকালের ঘটনাগুলোই ছিল আসলে মানুষকে পাগল করে দেয়ার মত। বুঝতে পারলাম, কোনও সুযোগই পাবেন না সিয়ার্স। মনে হলো, তখনই ছুটে যাই। কিন্তু অবজারভেশন পোস্ট থেকে তাঁর কাছে পৌঁছুতে লেগে যাবে দুঘণ্টারও বেশি।

কোনও সুযোগই ছিল না তার। অত জোরে সঁতরে যাওয়া সত্ত্বেও বেশ কয়েক মিনিট কেটে গেল ওপারে পৌঁছুতে। ট্রেন তখন, স্যার, প্রায় উঠে পড়েছে কওয়াই সেতুর ওপরে! আর ঠিক সেসময় – ঠিক সেসময় আমি খেয়াল করলাম, চিৎকার শুনে ঢাল বেয়ে পড়িমরি করে ছুটে আসছে জাপানী সৈন্যেরা।

পানি থেকে উঠতেই ওরা ধরে ফেলল সিয়ার্সকে। ডানে বামে দুবার ছুরি চালালেন তিনি। তৎক্ষণাৎ খতম হয়ে গেল দুজন সৈন্য। সবকিছুই পরিষ্কার। দেখেছি আমি। জ্যান্ত অবস্থায় ধরা দেয়ার ইচ্ছে ছিল না সিয়ার্সের। কিন্তু রাইফেলের একটা কুঁদো এসে পড়ল তার মাথার পেছনে। সাথে সাথে লুটিয়ে পড়লেন জ্ঞান হারিয়ে। জয়েসও স্থির হয়ে শুয়ে আছে মাটিতে। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল কর্নেল। সৈন্যেরা কেটে দিল তারটা। করার আর আমাদের কিছুই রইল না, স্যার।

যখন মনে হয় আর কোনও উপায় নেই, তখনও থাকে ছোটখাট উপায়, মন্তব্য করলেন কর্নেল গ্রীন।

জ্বী, স্যার, ছোটখাট উপায় তখনও থাকে…তারপর শোনা গেল একটা বিস্ফোরণের শব্দ। অদম্য ভঙ্গিতে ছুটে চলা ট্রেনটা উড়ে গেল অবজারভেশন পোস্টের ঠিক নিচে এসে। নিজের হাতে বসানো বিস্ফোরকটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম বেমালুম। লাইনচ্যুত হয়ে এঞ্জিন আর দুতিনটে বগি নদীতে গিয়ে পড়ল। ডুবে গেল কয়েকজন লোক। নষ্ট হলো বেশকিছু খাদ্য আর অস্ত্রশস্ত্র; তবে ক্ষতিগুলো কয়েক দিনেই সামলে ওঠা যাবে–সবসুদ্ধ এই আমাদের ফলাফল। কিন্তু এত অল্প ক্ষতি সত্ত্বেও উত্তেজনাটা ভালই সৃষ্টি হয়েছিল উল্টোদিকের তীরে।

নিশ্চয় চমৎকার জমে উঠেছিল দৃশ্যটা, সান্তনা দিলেন কর্নেল গ্রীন।

জ্বী, স্যার, খুব জমেছিল, বিশেষ করে ওসব দৃশ্য যারা দেখতে ভালবাসে তাদের জন্যে তো বটেই। তাই ভাবতে লাগলাম, কীভাবে আরও জমানো যায় দৃশ্যটা। ফোর্স ৩১৬-এর নীতি আমি ভুলিনি, স্যার। আর কি কি ক্ষতি করা সম্ভব, সে-সম্বন্ধে মাথায় টগবগ করে ফুটতে লাগল চিন্তা।

ইচ্ছে থাকলেই ক্ষতি বাড়িয়ে তোলা যায়, স্বপ্নাচ্ছন্ন কণ্ঠে ভেসে এল কর্নেল গ্রীনের মন্তব্য।

ইচ্ছে থাকলেই…সবাই যখন বলে, কথাটা নিশ্চয় সত্য। ওটাই ছিল সিয়ার্সের আদর্শ।

এক মুহূর্তের জন্যে থামলেন ওয়ার্ডেন; তারপর আবার বলে চললেন অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায়।

মাথাটা খাটাতে লাগলাম, স্যার। খাটাতে লাগলাম যতদূর সম্ভব। ওদিকে দলে দলে সৈন্যেরা তখন ঘিরে ধরেছে জয়েস আর সিয়ার্সকে। নিশ্চল পড়ে থাকলেও দুজনেই তখনও জীবিত।

অ্যাকশন নেয়ার সম্ভাব্য একটা পথই দেখতে পেলাম, স্যার। দুই থাই তখনও বসেছিল মর্টারের কাছে। খুব সহজেই তারা গোলাগুলি বর্ষণ করতে পারবে সেতু কিংবা সৈন্যের দলের ওপর। ওদের যা বলার বলে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি। ওদিকে দুজনকেই তুলে নিয়ে রওনা দিল সৈন্যেরা। জীবিত অবস্থায় ওদের ধরে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে খারাপ আর কিছুই হতে পারে না। পেছনে পেছনে চলেছে কর্নেল নিকলসন, মাথাটা ঝুলে পড়েছে গম্ভীর চিন্তায়। বুড়োটা কি ভাবছে, তাই ভেবে অবাক হচ্ছিলাম আমি, স্যার। তারপর হঠাৎ মনস্থির করে ফেললাম, যদিও তখনও যথেষ্ট সময় ছিল হাতে।

ফায়ারের নির্দেশ দিলাম। তৎক্ষণাৎ দুই থাই শুরু করল কাজ। প্রশিক্ষণ আমরা ওদের ভালই দিয়েছিলাম, স্যার। গোলাগুলির দৃশ্যটা সত্যিই ছিল দেখার মত। মর্টারের দায়িত্ব নিজেই নিলাম। এবং খুব একটা খারাপ হাত আমার নয়।

ভাল ফল পেয়েছিলে? জানতে চাইলেন কর্নেল গ্রীন।

খুব ভাল, স্যার। প্রথম কয়েকটা শেল গিয়ে পড়ল সৈন্যদের ঠিক মাঝখানে। টুকরো টুকরো হয়ে গেল জয়েস আর সিয়ার্স। বিনকিউলার দিয়ে স্পষ্ট দেখেছি আমি। বিশ্বাস করুন, স্যার, কোনও কাজ আধাআধি করার পক্ষপাতী আমি নই। টুকরো টুকরো হয়ে গেল আসলে তিনজন। কর্নেলের কিছুই অবশিষ্ট রইল না। এক ঢিলে তিন পাখি। খুব খারাপ নয় নিশ্চয়!

তারপর? তারপর, স্যার, শেলগুলো উজাড় করে দিলাম আমি। হ্যান্ডগ্রেনেডগুলোও। আমাদের পজিশন নির্বাচন ছিল নিখুঁত। স্বীকার করছি, একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। থাই দুজনও। বাছবিচারহীনভাবে শত্রু খতম করে চললাম আমরা। চারপাশ ভরে উঠল আহতের চিৎকার আর মুমূর্ষুর আর্তনাদে। ক্যাম্প থেকে অন্য জাপানী সৈন্যেরা ছুটে এল লাইনচ্যুত ট্রেন আর সেতুর কাছে। পাল্টা গুলি চালাতে লাগল। দেখতে দেখতে ধূসর-রঙা ধোঁয়ার মেঘ ছেয়ে ফেলল পুরো উপত্যকা। চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল কওয়াই নদী। গোলাগুলি সমস্ত ফুরিয়ে গেল। কুয়াশার মত সেই ধোয়ার আড়ালে পালিয়ে এলাম আমরা।

ওই ঘটনার পর সিদ্ধান্তটা নিয়ে প্রায়ই ভেবেছি আমি, স্যার। অবশেষে নিশ্চিত হয়েছি, আমার আর কিছুই করার ছিল না। অ্যাকশন হিসেবে একমাত্র ওটাই ছিল যথাযথ।

হ্যাঁ, একমাত্র যথাযথ অ্যাকশন, সায় দিলেন কর্নেল গ্রীন।

আগের পর্ব :
০৬-১০. কাজের অগ্রগতির প্রশ্ন
১১-১৫. পাশ্চাত্যের মানুষের সেতুর ধারণা
১৬-২০. সারারাত না ফেরায় উদ্বিগ্ন
২১-২৫. কওয়াইয়ের কলধ্বনি

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত