দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কওয়াই: ১৬-২০. সারারাত না ফেরায় উদ্বিগ্ন

দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কওয়াই: ১৬-২০. সারারাত না ফেরায় উদ্বিগ্ন

১৬-২০. সারারাত না ফেরায় উদ্বিগ্ন

১৬.

সারারাত না ফেরায় উদ্বিগ্ন হয়ে ছিল দুই পাউন্ড। অনেকক্ষণ হলো সকাল হয়েছে। এক ঘণ্টা বিশ্রাম নেবে বলে শুয়ে পড়ল জয়ে, কিন্তু ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়।

যতদূর মনে হয়, রাতটাও কাটিয়েছ ঘুমিয়ে? খুব ভাল করেছ। পরদিন সকালে আবার ফিরে গেলে তোমার বাছাই করা সেই বিশেষ জায়গাটার?

জ্বী, স্যার। আরেকটা দিন কাটালাম োখানে। আরও অনেক কিছু দেখার ইচ্ছে ছিল আমার।

এ-যাবৎ সেতুর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিল সে, এবার ব্রিটিশ সৈন্যদের অবস্থা দেখে ভার হয়ে উঠল মন। জাপানীরা যুদ্ধবন্দীদের সাথে কেমন ব্যবহার করে, সে বিষয়ে অনেক রিপোর্ট পড়েছে জয়েস।

অপ্রীতিকর কিছু দেখেছ? জানতে চাইলেন সিয়ার্স।

না, স্যার; অন্তত সেদিন তেমন কিছু চোখে পড়েনি। কিন্তু মাসের পর মাস ওরা ওভাবে খাটছে, একথা ভাবতেই বুকটা ভেঙে চেয়েছে আমার। অর্ধাহারে থাকা, ওরকম কুটিরে বাস করা যেখানে আরামের বিন্দুমাত্র ব্যবস্থা নেই, তা ছাড়া শাস্তির ব্যাপারটা, স্যার, মানে–বুঝতে পারছেন নিশ্চয়!

বিনকিউলার দিয়ে প্রত্যেকটা বন্দীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে রীতিমত আতঙ্কিত হয়েছে সে।

আমাদের মন অত নরম হলে চলবে না, জয়েস, ভ্রূ কোঁচকালেন এক নম্বর।

জানি, স্যার। কিন্তু হাড় এবং চামড়া ছাড়া আর কিছুই নেই ওদের। বেশির ভাগ বন্দীর গায়েই দগদগে ঘা। কয়েকজন হাঁটতেই পারছে না প্রায়। কোনও সভ্য মানুষ এ-অবস্থায় কাউকে খাটানোর কথা কল্পনাও করতে পারে না। আপনি ওদের দেখলে কেঁদে ফেলতেন, স্যার। শেষ কয়েকটা পাইল পাইল বসানোর জন্যে স্লেজহ্যামারের দড়ি ধরে টানাটানি করছে একদল বন্দী–যেন জীবন্ত কঙ্কাল। ওরকম বীভৎস দৃশ্য আমি জীবনে দেখিনি। মানুষের সাথে এরকম ব্যবহার করা অপরাধ, স্যার, ভীষণ অপরাধ।

শান্ত হও, জয়েস, বললেন সিয়ার্স, শিগগিরই ওদের মুক্ত করব আমরা।

তবু ওদের প্রশংসা না করে পারিনি, স্যার। এত কষ্ট সত্ত্বেও সবার মনোযোগ অটুট রয়েছে। চালচলনের মধ্যে এমন একটা ভাব, যেন আশেপাশে জাপানীদের কোনও অস্তিত্ব নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যায় পর্যন্ত কাজ করছে, মাসের পর মাস, সম্ভবত একদিনও বিশ্রাম নেয়নি। কিন্তু ওদের মধ্যে হতাশার কোন চিহ্ন নেই। হাস্যকর পোশাক, স্বাস্থ্যের চরম অবনতি সত্ত্বেও মর্যাদাসম্পন্ন চালচলন ওদের ক্রীতদাসে পরিণত হতে দেয়নি।

তিনজনই ডুবে গেল নিজ নিজ চিন্তায়।

ইচ্ছে করলে ব্রিটিশ সৈন্যেরা সত্যিই দুঃসাহসী হতে পারে, শেষমেশ বললেন ওয়ার্ডেন।

আর কি দেখলে? জিজ্ঞেস করলেন সিয়ার্স।

অফিসারদের, স্যার, ব্রিটিশ অফিসার। তাদের খাটানো হচ্ছে না। নিজের লোকেদের তদারক করছেন তারা। পরনে পুরো ইউনিফর্ম?

ইউনিফর্ম!

জী, স্যার, ব্যাজসহ।

থাইয়েরা তা হলে ঠিকই বলেছে। আমিই বিশ্বাস করিনি। কোনও সিনিয়র অফিসার দেখেছ?

একজন কর্নেল, স্যার। সম্ভবত ইনিই সেই বিখ্যাত কর্নেল কিলসন, যার কথা আমরা বারবার শুনেছি। সারাদিন তিনি থাকছেন বন্দীদের সাথে, খুব সম্ভব জাপানীদের সাথে ব্রিটিশদের সংঘর্ষ এড়ানোর জন্যে। কর্নেল নিকলসনকে দেখলে মনে হয়, মানুষটির জন্মই হয়েছে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে।

তারই কারণে নিশ্চয় এখনও ভেঙে পড়েনি বন্দীরা, বললেন সিয়ার্স। হ্যাটস অফ টু হিম।

আবার জয়েস শুরু করল তার বিস্ময়কর গল্প।

একবার সেতুর অন্য পাশ থেকে এক বন্দী এল কর্নেলের সাথে দেখা করতে। রাইফেল উচিয়ে চিৎকার করতে করতে পেছন পেছন এল এক জাপানী প্রহরী। যতদূর মনে হয়, অনুমতি ছাড়া দলত্যাগ করেছিল বন্দীটা। কড়া চোখে কর্নেল তাকালেন প্রহরীর দিকে। তৎক্ষণাৎ সুড়সুড় করে কেটে পড়ল সে। অবিশ্বাস্য, তাই না? সন্ধ্যার আগে আগে সেতুর দিকে এলেন জাপানী এক কর্নেল। ইনিই সম্ভবত কর্নেল সাইতো, নিষ্ঠুরতার জন্যে যিনি কুখ্যাত। কর্নেল নিকলসনের কাছে আসতেই যেন বিনয়ের অবতার সাজলেন তিনি। কর্নেলই অবশ্য প্রথমে স্যালুট করলেন, এক মুহূর্ত দেরি না করে প্রত্যুত্তর দিলেন সাইতো। ওই একটা দৃশ্য আমার দুঃখ অনেকটা ভুলিয়ে দিল, স্যার।

তোমার গল্প শুনে আমার কিন্তু মোটেই দুঃখ হচ্ছে না, বিড়বিড় করে বললেন সিয়ার্স।

কর্নেল নিকলসনের উদ্দেশে, হঠাৎ হাতের গ্লাসটা ওপরে তুলে ধরলেন ওয়ার্ডেন।

ঠিকই বলেছ, ওয়ার্ডেন, কর্নেল নিকলসন এবং পাচ-ছশো হতভাগ্যের উদ্দেশে, সিয়ার্সও তুলে ধরলেন নিজের গ্লাস।

দুঃখের বিষয়, ওরা আমাদের কোনও সাহায্যে আসবে না।

উপায় নেই, ওয়ার্ডেন। যা কিছু করার আমাদেরই করতে হবে। কিন্তু–আবার ফিরে যাই সেতুর প্রসঙ্গে…

পুরো সন্ধ্যেটা তারা কাটালেন সেতু বিষয়ে কথাবার্তা বলে আর জয়েসের স্কেচম্যাপ দেখে। মাঝেমাঝে দুএকটা বিষয় জানতে চাইলেন, তৎক্ষণাৎ ব্যাখ্যা করল জয়েস। আক্রমণের প্রতিটা দিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখলেন, যাতে শেষ মুহূর্তে অতি সামান্য কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। আলোচনার পর ওয়াকিটকিতে মেসেজ গ্রহণ করার জন্যে পাশের ঘরে গেলেন ওয়ার্ডেন।

স্যার, হঠাৎ বলে উঠল জয়েস, আমাদের দলের তিনজনের মধ্যে আমিই সবচেয়ে ভাল সঁতারু, আর আমি নিজেই যেহেতু ওখানে গেছি…

সে-বিষয়ে পরে কথা হবে, বললেন এক নম্বর।

জয়েসকে টলতে টলতে বিছানার দিকে এগোতে দেখে সিয়ার্স বুঝতে পারলেন, ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে ছেলেটা। তিন দিন ঝোপের ভেতর শুয়ে শুয়ে পর্যবেক্ষণ শেষ করেই সে আবার রওনা হয়েছে ক্যাম্পের উদ্দেশে, খাবার সামান্য সময়টুকু ছাড়া কোথাও থামেনি। তা ছাড়া ফিরতি পথে সে এত জোরে হেঁটেছে, থাই দুই গাইডকে দৌড়োতে হয়েছে তার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্যে।

খানিকটা বিশ্রাম নেয়া উচিত তোমার, বললেন এক নম্বর। রওনা দেয়ার আগেই মারা পড়ার কোনও যুক্তি নেই। যথাসময়ে তোমাকে সুস্থ দেখতে চাই আমি। আর এত তাড়াহুড়ো করেই বা ফিরলে কেন?

সেতুর কাজ সম্ভবত এক মাসের আগেই শেষ হয়ে যাবে, স্যার।

দেখতে না দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল জয়েস, মেক-আপ তোলার কথাও খেয়াল রইল না। কাঁধ ঝাকিয়ে বসে পড়লেন সিয়ার্স! মনে মনে ভাবতে লাগলেন আর কদিনের মধ্যেই কওয়াই উপত্যকায় যে নাটক অভিনীত হতে যাচ্ছে, তাতে তাদের স্ব স্ব ভূমিকার কথা। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই ডিসাইফার করা কিছু মেসেজ হাতে ঘরে ঢুকলেন ওয়ার্ডেন।

হাবভাবে মনে হচ্ছে, বেলুন উড়তে আর দেরি নেই। হেডকোয়ার্টারস থেকে তথ্য এসেছে: রেলওয়ের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পাঁচ কি ছসপ্তাহের মধ্যেই হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সৈন্য আর ভিআইপি বোঝাই একটা ট্রেন আসবে। যুদ্ধের সাজসরঞ্জামও তাতে প্রচুর থাকবে হেডকোয়ার্টারস শুধু আপনার সমস্ত প্ল্যানই পাস করেনি, সর্বময় কর্তৃত্ব দিয়েছে। রয়্যাল এয়ারফোর্স নাক গলাবে না। এখন হেডকোয়ার্টারস থেকে প্রতিদিন তথ্য পাব আমরা। ছেলেটা ঘুমে তলিয়ে গেছে, তাই না?

হ্যাঁ। জাগিয়ো না ওকে। খানিকটা বিশ্রাম ওর প্রাপ্য। দায়িতুটা ভালভাবেই পালন করেছে ও। আচ্ছা, একটা কথা বলো দেখি, ওয়ার্ডেন, যে-কোনও জরুরী প্রয়োজনের সময় ওর ওপর ভরসা করা চলে?

জবাব দেয়ার আগে একটু ভেবে নিলেন ওয়ার্ডেন।

ওকে তো আমার উপযুক্তই মনে হচ্ছে। অবশ্য এসব ব্যাপারে আগে থেকে কিছুই বলা যায় না। তবে আমি বুঝতে পারছি, আপনি ঠিক কি জানতে চাইছেন। আপনি জানতে চান, মুহূর্তের মধ্যে বা তারও কম সময়ে সে গুরুত্বপূর্ণ কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কি-না। কিন্তু আপনার এরকম চিন্তার কারণ?

কারণ, একটু আগেই ও বলেছে আমাদের দলের তিনজনের মধ্যে আমিই সবচেয়ে ভাল সাঁতারু। কথাটা মিথ্যে নয়।

যখন আমি ফোর্স ৩১৬-তে প্রথম যোগ দিই, গলা চড়ালেন ওয়ার্ডেন, তখন কে জানত যে আমাকে একজন ওস্তাদ সাঁতারুতে রূপান্তরিত হতে হবে। অভ্যেসটা একটু ঝালাই করে নেব আগামী ছুটিতে।

আমার এই চিন্তার পেছনে একটা মনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। কোনও ব্যাপারে মাথা খাটাতে না দিলে নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে ও। তবে আগে থেকে কিছুই বলা যায় না, এটাই বাস্তব। সফল হতেও পারে। কয়েক দিনের মধ্যেই সব জানতে পারব। আগামীকাল থেকে এক কাজ করব আমরা। সেতুর প্রসঙ্গই আর তুলব না। আমি চাই না, বন্দীদের কথা ও বেশি ভাবুক। তুমি নিশ্চয় মানো, অনুভূতি মানুষের আচরণকে সবসময় প্রভাবিত করতে পারে না। কথাটা ঠিক। কিন্তু ছেলেটা একটু বেশি অনুভূতিপ্রবণ, এটাই যা অসুবিধে।

আমাদের কাজে কোনও বাধাধরা নিয়ম অনুসরণ করলে চলে না, বললেন ওয়ার্ডেন। কখনও কখনও অল্প চিন্তা, এমনকি অনুভূতিপ্রবণতাও ভাল ফল দিতে পারে। তবে সবসময় নয়, এটা ঠিক।

১৭.

বন্দীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখে কর্নেল নিকলসনও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। এব্যাপারে মেডিক্যাল অফিসারের সাথে আলোচন করার জন্যে একদিন তিনি এলেন হাসপাতালে।

এভাবে তো চলতে পারে না, ক্লিপটন, গম্ভীর গলায় প্রায় ধমকে উঠলেন কর্নেল। কেউ দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়লে কাজ করতে পারবে না, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সবকিছুর একটা সীমা আছে। তুমি অর্ধেক লোককে সিকলিস্টের অন্তর্ভুক্ত করেছ, তা হলে সেতুর কাজ এক মাসের মধ্যে শেষ হবে কিভাবে? কাজ অনেকটা এগিয়ে গেছে সত্যি, কিন্তু টুকিটাকি অনেক কিছু এখনও বাকি। অর্ধেক লোক না থাকায় কাজ তো ঢিলে হয়ে পড়েছেই, এদিকে যতটা কাজ করা উচিত ততটাও করছে না বাদবাকি বন্দীরা।

ওদের দিকে ভালভাবে চেয়ে দেখুন, স্যার, রাগে নিজের ওপর প্রায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন ক্লিপটন, অধস্তন অফিসারদের যে ব্যবহার কর্নেল মোটেই পছন্দ করেন না। পেশাগত বিবেকের ধার যদি ধারি, কিংবা স্রেফ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও যদি দেখি, তা হলে অর্ধেক নয় বরং সবাইকে ঘোষণা করতে হবে আনফিট হিসেবে, বিশেষ করে এ ধরনের কাজের জন্যে তো বটেই!

প্রথম কয়েক মাস সেতুর কাজ এগিয়ে চলেছে চমৎকারভাবে। মাঝেমধ্যে শুধু মেজাজ দেখিয়েছেন সাইতো। তাঁর মনে হয়েছে, কর্তৃত্ব না ফলালে নিজের ওজন বজায় থাকছে না। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে তার বাকি রইল না যে, নিষ্ঠুরতা শুধু কাজই ব্যাহত করবে। ফলে নাক গলানো তিনি একেবারেই ছেড়ে দিলেন। কাজও এগোতে লাগল তরতর করে। তবে মেজর হিউজেস এবং ক্যাপ্টেন রীভূস্-এর হিসেবের আগে আগে যে দৌড়োচ্ছিল কাজ, এর পেছনে জাপানী সৈন্যদের অবদান কম নয়, যদিও মাঝেমাঝে তাদের সংঘর্ষ বাধছিল ব্রিটিশ সৈন্যের সাথে। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে বন্দীরা হয়ে পড়ল দুর্বল থেকে দুর্বলতর।

হঠাৎ আশেপাশে থেকে কিনে আনা চামড়াসর্বস্ব দুএকটা বুড়ো গরু ছাড়া মাংসের সাথে সাক্ষাৎ তাদের হলো না। মাখন বা পাউরুটি তো দূরের কথা, কখনও কখনও কপালে জুটল শুধুই ভাত। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে তারা পরিণত হলো জীবন্ত কঙ্কালে। যারা পাইল বসাল, সারাদিন তাদের সইতে হলো জেহ্যামারের কানফাটানো শব্দের যন্ত্রণা। অন্য দলগুলোও স্বস্তিতে রইল না। বিশেষ করে যারা ভারায় উঠে পাইল ধরে দাঁড়িয়ে রইল কোমরপানিতে, তারাও রেহাই পেল না এই শব্দের হাত থেকে।

তবুও মনোবল তাদের একরকম অটুটই রইল। দৃষ্টান্ত স্থাপন করল লেফটেন্যান্ট হার্পারের মত অফিসারেরা। সারাদিন ধরে সে সৈন্যদের শোনাল উৎসাহব্যঞ্জক কথা। দুর্বল কাউকে অব্যাহতি দেয়ার প্রয়োজনে নিজে জ্যোমারের দড়ি ধরতেও দ্বিধা করল না। মাঝেমাঝে র-প্রিন্ট এবং ফুট-রুল, স্পিরিট-লেভেল ইত্যাকার স্বহস্তনির্মিত যন্ত্রপাতিসহ জীর্ণ ভারা বেয়ে ক্যাপ্টেন রীস ওঠেন বিশেষ কোনও মাপ নেয়ার জন্যে, পেছনে থাকেন ছোটখাট জাপানী এঞ্জিনিয়ারটি। রীভস-এর পায়ে পায়ে হাঁটেন তিনি, অনুকরণ করেন প্রতিটি ভঙ্গি, গম্ভীর মুখে হিসেব লিখে রাখেন নোটখাতায়–আর এসব দেখে নির্মল আনন্দ উপভোগ করে বন্দীরা।

তবে সব অফিসারের আদর্শ নিঃসন্দেহে কর্নেল নিকলসন। কর্নেলও সেব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন। নেতৃত্বে একধরনের গর্ববোধ আছে তাঁর, ফলে যেকোনও রকমের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে তিনি পিছ-পা নন।

ক্রমেই লম্বা হতে থাকা সিক-লিস্টই তার উদ্বেগের একমাত্র কারণ। প্রতিদিন চোখের সামনে ধীরে ধীরে কমে আসছে তার কাজের লোকের সংখ্যা।

অন্যান্য ক্যাম্পের মত এখানেও কলেরা জাতীয় মারাত্মক কোনও মহামারী দেখা দিতে পারে ভেবে আতঙ্কিত হয়েছিলেন ক্লিপটন। কড়া নিয়মকানুন মেনে চলার জন্যে সেরকম কিছু না ঘটলেও রেহাই পাওয়া যায়নি ম্যালেরিয়া, আমাশয় আর বেরিবেরির হাত থেকে। প্রতিদিন বেশ কিছু লোককে আনফিট ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি, ফলে ক্রমেই বেড়ে চলেছে সিক-লিস্ট। রেড ক্রসের কিছু কিছু পার্সেল জাপানীদের কৌতূহলী হাত এড়িয়ে হাসপাতালে এসে পৌঁছুচ্ছে বলে রোগীদের তিনি মোটামুটিভাবে উপযুক্ত খাবার দিতে পারছেন। জেহ্যামারের শব্দ শুনতে শুনতে অস্থির হয়ে ওঠা বন্দীরা অবশ্য কদিনের বিশ্রামেই সেরে উঠছে।

কর্নেল নিকলসন তার লোকেদের খুবই ভালবাসেন। তাই প্রথমদিকে রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যাপারে ক্লিপটনকে তিনি শুধু সাহায্যই করেননি, নাক গলানোর সাথে সাথে সামলেছেন কর্নেল সাইতোকে।

কিন্তু কয়েক দিন থেকে তার মনে হচ্ছে, ক্লিপটন কিছুটা বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন। ফলে ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্যে খোলাখুলিই মেডিক্যাল অফিসারকে অভিযুক্ত করেছেন কর্নেল নিকলসন। তার ধারণা, কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম এমন অনেক লোককে ক্লিপটন অন্তর্ভুক্ত করেছেন সিক-লিস্টে। আর এক মাসের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ করতে হবে; সুতরাং এখন অবহেলার সময় নয়। এবং তাই হাসপাতাল পরিদর্শন করতে এসেছেন তিনি স্বয়ং। সেই ফাঁকে ক্লিপটনের সাথে আলোচনাও সেরে নিতে চান এ-বিষয়ে। তবে যত রাগই হোক না কর্নেলের, এরকম নাজুক একটা বিষয় নিয়ে একজন স্টাফ অফিসারের সাথে যেভাবে আলাপ করতে হয়, সেই সৌজন্যবোধটুকু তিনি গুলিয়ে ফেলেননি।

এই ছেলেটার কি হয়েছে? একজন রোগীর সাথে কথা বলার জন্যে থামলেন কর্নেল নিকলসন। এই, তোর কি অসুবিধে হচ্ছে রে, বাবা?

দুসারি বাঁশের খাঁটিয়ায় শুয়ে আছে বন্দীরা, কর্নেল হাঁটছেন মাঝখান দিয়ে। রোগীদের কেউ কাপছে প্রচণ্ড জ্বরে, কেউ বা স্থির হয়ে আছে জ্ঞান হারিয়ে। শতচ্ছিন্ন কম্বলের নিচ থেকে বেরিয়ে আছে তাদের ফ্যাকাসে মুখগুলো।

১৪০ ডিগ্রী তাপ ছিল গত রাতে, স্যার, ম্যালেরিয়া।

হুঁ, তাই তো দেখছি, খানিকটা এগোলেন কর্নেল। আর এই ছেলেটার?

ঘা। গতকাল অপারেশন করেছি ওর পায়ে–সাধারণ একটা ছুরি দিয়ে; অন্য কোনও অস্ত্র নেই আমার। পায়ের ভেতর গলফ বলের সমান একটা গর্ত হয়ে গেছে, স্যার।

ও, তা হলে এই ব্যাপার, বিড়বিড় করে বললেন কর্নেল নিকলসন, গত রাতে একটা চিৎকার কানে এসেছে।

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। ওর চার বন্ধু ওকে ঠেসে ধরেছিল। ওর পা-টা হয়তো বাঁচাতে পারব, তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়, গলা নামালেন ক্লিপটন। আপনি কি সত্যিই চান, স্যার, আমি ওকে কাজে পাঠাই?

বাজে কথা বোলো না, ক্লিপটন। রোগীর ব্যাপারে তোমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কিন্তু বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া দরকার। অসুস্থ বা আহত কাউকে জোর করে বাটাবার কোনরকম ইচেছ আমার নেই। তবে বাস্তবের মুখোমুখি আমাদের হতেই হবে। সেতু তৈরি শেষ করার জন্যে হাতে আছে এক মাসেরও কম সময়! জানি, কাজটা অতিমানবিক, কিন্তু ওই জানা পর্যন্তই সার। তার ওপর যতবার তুমি একটা করে তোক হাসপাতালে ভর্তি করাচ্ছ, সবার পক্ষে কাজটা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। এই কথাটা তোমাকে সারা দিন মনে রাখতে হবে, বুঝেছ? একজন মানুষ পুরোপুরি, কর্মক্ষম না থাকলেও টুকিটাকি অনেক কিছু করতে পারে, যেমন: জিনিসপত্র গোছগাছ, সেতু ধুয়ে দেয়া বা ব্রাশ মারা।

যতদূর মনে হচ্ছে, সেটা আপনি রঙ করাতে চান, তাই না, স্যার?

এই ধরনের আজেবাজে চিন্তা কোরো না, ক্লিপটন, বললেন কর্নেল। বড়জোর আমরা একবার চুন টানতে পারি-যাতে রয়্যাল এয়ারফোর্সের কাছে এটা পরিণত হয় চমৎকার একখানা টার্গেটে! যুদ্ধ চলছে, কথাটা ভুলে গেছ নাকি!

ঠিক বলেছেন, স্যার, যুদ্ধ চলছে।

ব্যস, ওই পর্যন্তই। আমি চাই না, এখন যুদ্ধ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাক। আপাতত আমরা চাই হাতের কাজটা সুন্দরভাবে শেষ করতে। আর সে-কথা তোমাকে বলতেই আজ আমার এখানে আসা। তুমি সবাইকে বোঝাও যে ওদের যথাসাধ্য খাটতে হবে। এই ছেলেটা…

বিশ্রীভাবে জখম হয়েছে হাত, আপনার বিখ্যাত সেতুর বীম তুলে ধরতে গিয়েই আজ ওর এই অবস্থা, স্যার, ফেটে পড়লেন ক্লিপটন। ওই একই অবস্থা

অন্তত আরও বিশজনের। ক্ষত সারা তো দূরের কথা, বরং আরও পেকে উঠছে। এদিকে চিকিৎসা করার মত কিছুই আমার কাছে নেই…

ভেবে পাই না, ক্লিপটনের অশোভন ভাষা এড়িয়ে গিয়ে জেদী সুরে বললেন কর্নেল নিকলসন, কিছুতেই ভেবে পাই না, মুক্ত আলো বাতাস গায়ে না লাগিয়ে এই কুটিরে চুপচাপ শুয়ে থাকলে ক্ষতের বেশি উপকার হবে কীভাবে! তা ছাড়া হাতে আঁচড় লাগলেই তাকে হাসপাতালে নিতে হবে–এটা আমাদের কার্যপদ্ধতির মধ্যে পড়ে না।

তা অবশ্য পড়ে না, স্যার।

ভীষণ হতাশায় হাতদুটো ওপরে তুললেন ক্লিপটন। কর্নেল তাকে নিয়ে গেলেন পাশের ঘরে, যেটাকে সার্জারি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তারপর শুরু হলো বোঝানো। জোর তিনি খাটালেন না, কিন্তু একজন কমান্ডারের ঝুলিতে যতরকমের যুক্তি থাকে, তার কোনটাই প্রয়োগ করতে ছাড়লেন না। তারপরেও যখন দেখা গেল যুক্তি মানার কোনও সম্ভাবনা ক্লিপটনের নেই, শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলেন কর্নেল নিকলসন: মেডিক্যাল অফিসার যদি এমন জেদ ধরে থাকেন, জাপানীরা হাসপাতাল খালি করে দেবে।

কঠোর ব্যবস্থা নেবেন বলে আমাকে শাসিয়েছেন কর্নেল সাইতো, ব্যাখ্যা করলেন তিনি।

কথাটা নির্জলা মিথ্যে। হিংস্রতায় আর কোনও কাজ হবে না, এটা পরিষ্কার বুঝে সে-চেষ্টাই বাদ দিয়েছেন কর্নেল সাইতো। ব্রিটিশ বন্দীরা যেভাবে কাজ করছে সেতু নির্মাণের, শেষ পর্যন্ত সেভাবে চালিয়ে গেলেই তিনি খুশি। কথাটা বলতে অবশ্য বিবেকের দংশন অনুভব করলেন কর্নেল নিকলসন, কিন্তু যেখানে মাত্র একটা নিয়ম ভাঙলে কাজটা শেষ হতে পারে মসৃণভাবে, সেখানে আদর্শ আঁকড়ে বসে থাকা চলে না। তা ছাড়া তিনি তো জীবনে কখনও পরাজয় স্বীকার করেননি, শেষমেশ সম্মান হারাবেন বর্বর জাপানীদের কাছে? অসম্ভব! এই তো আর মাত্র কয়েকটা দিন কাজ শেষ হয়ে যাবে কওয়াই সেতুর।

মনে মনে কর্নেল নিকলসনকে অভিশাপ দিলেন ক্লিপটন, কিন্তু জেদটা আর বজায় রাখতে পারলেন না এই হুমকির মুখে। রোগীর সিকি ভাগ ছেড়ে দিলেন তিনি, অপরাধবোধে ভুগলেন রোগী বাছাইয়ের সময়। খোড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে চলল তারা। কোনমতে নিজেদের টেনে নিয়ে যেতে সমর্থ হলেও বেশির ভাগই ম্যালেরিয়ায় কাঁপছে থরথর করে।

একজন বন্দীও অভিযোগ করল না। কর্নেলের ওপর তাদের আস্থা এতই অগাধ, যেন তাঁর নির্দেশে হাসতে হাসতে তারা ঝাপ দিতে পারে মৃত্যুর মুখে। চুপচাপ গিয়ে হাজির হলো তারা নদীর তীরে। এক হাতে ব্যান্ডেজ সত্ত্বেও আরেক হাতে টেনে ধরল হোমারের দড়ি।

এই বাড়তি শক্তি যোগ হওয়ায় দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে গেল কওয়াই সেতু। আপাতদৃষ্টিতে কাজ শেষ হলেও অভিজ্ঞ চোখ ওদিকে তাকালে বুঝতে পারবে, এখনও বাকি রয়ে গেছে অতিক্ষুদ্র দুএকটা টুকিটাকি।

১৮.

সপ্তাহ দুই পর জয়েস যে পথে গিয়েছিল, ওই একই পথে অভজারভেশন পোস্টে পৌঁছলেন ক্যাপ্টেন ওয়ার্ডেন। সেতুটা তিনি স্বচক্ষে একবার দেখতে চান।

একবার চোখ বুলিয়েই ওয়ার্ডেন বুঝতে পারলেন, জয়েসের পর্যবেক্ষণ মন্দ নয়। শেষ হয়েছে কওয়াই সেতু নির্মাণের কাজ। সাথে আসা চার থাইকে তিনি জানিয়ে দিলেন, আপাতত তাদের কোনও প্রয়োজন নেই। ফলে চুপচাপ বসে তারা হুকো টানতে লাগল ওয়ার্ডেনের দিকে তাকিয়ে।

প্রথমে ওয়াকি-টকির এরিয়াল তুলে বিন্নি স্টেশনের সাথে যোগাযোগ কবুলেন ওয়ার্ডেন। শত্রু অধিকৃত এলাকার একেবারে ভেতরের একটা স্টেশন তাকে প্রতিদিন জানায় বার্মা-থাইল্যান্ড রেলওয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যে বিশাল ট্রেনটা ব্যবহৃত হবে, তার সংবাদ। আজকের সংবাদও যথারীতি খারাপ নয়, সব ঠিকঠাক আছে।

সংবাদ নেয়ার পর স্পঞ্জের একটা ব্যাগ খুলে শ্রীপিংব্যাগ আর মশারি বের বুলেন ওয়ার্ডেন। জয়েসের তুলনায় তিনি অনেক অভিজ্ঞই শুধু নন, দূরদর্শীও। তিনি জানেন, একজন শ্বেতাঙ্গের কাছে অনেক সময় টুব্রাশও কতখানি প্রয়োজনীয়। জানেন, সকালে স্রেফ এক কাপ চা-ও তাকে কতটা চাঙ্গা করে তুলতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, চূড়ান্ত অ্যাকশনের সময় সম্পূর্ণ কর্মক্ষম থাকা। নিজের সাজসরঞ্জামের কথা ভেবে বেশ আশ্বস্ত বোধ করলেন ওয়ার্ডেন। তারপর কিছু খেয়ে, শুয়ে পড়লেন তিনি। তিন ঘণ্টা পর ঘুম থেকে উঠে অবজারভেশন পোস্টে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে বসলেন মিশনের কথা।

জয়েসের প্ল্যান অনুসারেই অ্যাকশন নেয়া হবে–এক নম্বরের এই সিদ্ধান্তের পর ভাগ হয়ে গেছে ফোর্স ৩১৬-এর দল। দুজন থাই স্বেচ্ছাসেবক আর জয়েসকে নিয়ে সেতুর উজানে গেছেন সিয়ার্স, সাথে জিনিস বয়ে নেবার জন্যে কয়েকজন মুটে। যথাসময়ে ওই চারজন সেতুর কাছে নেমে আসবে ধ্বংসের জোগাড় করতে। জয়েস যাবে শত্রুপক্ষের তীরে। সিয়ার্স যোগ দেবেন ওয়ার্ডেনের সাথে। দুজন মিলে নিশ্চিত করবেন পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা।

অবজারভেশন পোস্টেই অবস্থান করবেন ওয়ার্ডেন। সেতুর আশেপাশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার পাশাপাশি রেডিও-যোগাযোগ রাখবেন তিনি। মিশনে তাকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছেন এক নম্বর।

অবস্থা বুঝে যে-কোনও ব্যবস্থা নিতে পারো তুমি, বলেছেন সিয়ার্স। শুধু খেয়াল রাখবে, ছোটখাট কিছু করতে গিয়ে আসল টার্গেটের সুযোগ যেন তালগোল পাকিয়ে না যায়। তোমার ওপর আমার পুরো ভরসা আছে।

এতখানি ক্ষমতা সিয়ার্স অযথা দেননি। ওয়ার্ডেনের যোগ্যতা তার বেশ ভালভাবেই জানা আছে।

সামান্য ভেবেই ওয়ার্ডেন ঠিক করলেন, দুটো হালকা মর্টার তিনি বসিয়ে দেবেন পাহাড়ের মাথায়, যার দায়িত্ব থাকবে দুই থাই স্বেচ্ছাসেবকের ওপর। এতে ট্রেন বিস্ফোরিত হবার পর তা থেকে পলায়মান সৈন্য এবং তাদের সাহায্যে ছুটে আসা সৈন্যেরা পড়ে যাবে অবিরাম গোলাবর্ষণের মুখে।

ওয়ার্ডেন যে সিদ্ধান্ত নিলেন, তা ফোর্স ৩১৬-এর নীতির বাইরে নয়। নীতিটা হচ্ছে: মূল লক্ষ্য অর্জিত হবার পরেও শক্রর যথাসাধ্য ক্ষতিসাধন করতে হবে। ট্রেন থেকে লাফিয়ে নামা সৈন্যদের মাঝে মর্টারের গোলা আঘাত হানবে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত। এতে মনোবল ভেঙে দিশেহারা হয়ে পড়বে তারা, সেই সুযোগে ধীরে-সুস্থে পালিয়ে যাবে জয়েস।

এবারে ফার্ন আর বুনো রডোডেনড্রনের মাঝখানে হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে এমন কয়েকটা জায়গা খুঁজে বের করলেন ওয়ার্ডেন, যেখানে আগ্নেয়াস্ত্র ফিট করা যায়। তারপর থাই স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে থেকে দুজনকে বেছে নিয়ে ভালভাবে বুঝিয়ে দিলেন, তাদের কি করতে হবে। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো, পরিকল্পনাটা পছন্দ হয়েছে ওদের।

প্রস্তুতি শেষ হতে হতে বিকেল চারটে বেজে গেল। পরবর্তী পদক্ষেপ সম্বন্ধে ভাবতে লাগলেন ওয়ার্ডেন, হঠাৎ কানে ভেসে এল বাদ্যযন্ত্রের শব্দ। অবজারভেশনে এসে বিনকিউলারে চোখ লাগালেন। সেতুর ওপরে কেউ নেই। নিশ্চয় কাজ শেষের আনন্দ উদযাপন করছে বন্দীরা। মাঝেসাঝে ওদের গানবাজনার অনুমতি দিয়েছেন মহামান্য সম্রাট, এ-রিপোর্ট অবশ্য তিনি পেয়েছেন কয়েকদিন আগে।

বাজনার প্রায় সাথে সাথেই ওয়ার্ডেন শুনতে পেলেন গান। কে যেন গাইছে পুরনো একটা স্কটিশ পল্লীগীতি। অবজারভেশনের একাকিতে করুণ ওই সুর শুনে ওয়ার্ডেনের চোখ প্রায় ভিজে উঠল। বিষণ্ণতা ভোলার জন্যে একমনে আবার তিনি ভাবতে লাগলেন মিশনের কথা।

সূর্যাস্তের আগে আগে মনে হলো, একটা ভোজ হতে যাচ্ছে। বন্দীরা গিয়ে ভিড় জমাল রান্নাঘরের পাশে। ওদিকে সাড়া পড়ে গেছে জাপানী কোয়ার্টারেও। ছুটোছুটি করছে ওরা, চিৎকার করছে, গড়িয়ে পড়ছে হাসিতে। কাজ শেষের আনন্দটা বোধহয় ওরাও উদ্‌যাপন করতে চায়।

হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল ওয়ার্ডেনের মাথায়। আজ অনেক কিছু করা সম্ভব। সাইতোর মত অ্যালকোহলিক যে দলের কমান্ডার, মাঝরাতের দিকে তারা সবাই যে পড় মাতাল হয়ে পড়বে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সুতরাং আজ রাতেই পাততে হবে অতিরিক্ত দু একটা ফাদ। শত্রুর বাড়তি ক্ষতি করার ব্যাপারে ফোর্স ৩১৬-এর সবারই একটা আলাদা টান আছে। কিন্তু ঝোকের মাথায় কিছু করে ফেলার পাত্র ওয়ার্ডেন নন। যুক্তিতর্ক দিয়ে বিষয়টা বিবেচনা করতে বসলেন তিনি। শেষমেশ ভাবলেন, এরকম একটা সুযোগ হাতছাড়া করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আর সুযোগ যখন এসেছে, তিনিই বা সেতুটাকে একবার কাছ থেকে দেখবেন না কেন?

মাঝরাতের খানিক আগে তিনি পৌঁছুলেন পাহাড়ের পাদদেশে। যা ভেবেছিলেন তা-ই হয়েছে জাপানীদের কোয়াটারে। ভেসে আসা বন্য চিৎকারে তিনি বুঝতে পারছেন ওদের অবস্থা। এখন অবশ্য বিরাজ করছে পরিপূর্ণ স্তব্ধতা। তবু দুই স্বেচ্ছাসেবকসহ রেল-লাইনের অদূরে গাছের সারির আড়ালে বসে শেষবারের মত কান পাতলেন ওয়ার্ডেন। না, কোনও শব্দ নেই কোথাও। সেতু অতিক্রম করে পর রেললাইন চলে গেছে নদীর পাশ দিয়ে। সঙ্গী দুজন থাইকে ইশারা করে তাদের সাথে নিঃশব্দে এগিয়ে চললেন ওয়ার্ডেন রেললাইন অভিমুখে।

পুরো অপারেশনটা নিরাপদে শেষ করার ব্যাপারে ওয়ার্ডেন সম্পূর্ণ নিশ্চিত। জঙ্গুলে এই অঞ্চলে বিপদের বোধ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে জাপানীরা। তবু এক থাইকে প্রহরী হিসেবে রেখে কাজে লেগে গেলেন তিনি।

মনে মনে ওয়ার্ডেন ভেবেছেন একটা টেক্সট-বুক অপারেশনের কথা। প্লাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশনস কোম্পানির স্পেশাল স্কুলে এই পাঠটাই দেয়া হয় প্রথমে। লাইনের দুপাশের নুড়ি সরিয়ে প্রাস্টিক চার্জ পুরে দিতে হবে। ভেবেচিন্তে জায়গামত বসাতে পারলে দুপাউড চার্জই শক্তিশালী ইস্পাতের বারোটা বাজিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট।

ডিটোনেটর থাকে প্লাস্টিকের মধ্যে; ওতে চাপ দেয়া মাখনের ভেতরে ছুরি চালানোর মতই সহজ। ডিটোনেটিং কর্ডের সাথে সংযুক্ত ছোট্ট একটা যন্ত্র পুরো ঘটনাটা ঘটায়। দুটো ফলা আছে যন্ত্রটায়, যাদের আলাদা করে রাখা হয় শক্তিশালী স্প্রিংয়ের সাহায্যে। ফলা দুটোর মাঝখানে থাকে প্রাইমার। একটা ফলাকে ঠেকিয়ে রাখা হয় লাইনে, আরেকটার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় পাথর। কর্ড থাকে মাটির নিচে। অভিজ্ঞ দলের পক্ষে এটা আধ ঘণ্টার কাজ। এবং সতর্কতার সাথে কাজ সারলে ফাদটা চোখে পড়ার কোনও সম্ভাবনাই থাকে না।

এঞ্জিনের একটা চাকা যন্ত্রটার ওপর ওঠার সাথেসাথে ফলা দুটো আঘাত হানবে পরস্পরের গায়ে; প্রাইমার ঘটিয়ে দেবে ডিটোনেশন, সেকেন্ডে কয়েক হাজার ফুট গতিতে গ্যাস ছুটবে কর্ডের ভেতর দিয়ে, এবং বিস্ফোরিত হবে প্লস্টিক। চোখের পলকে পাউডার হয়ে যাবে একটা নির্দিষ্ট এলাকার লাইন। ট্রেন লাইনচ্যুত হবে, ভাগ্য ভাল থাকলে উন্টেও যেতে পারে এঞ্জিন। এই প্রক্রিয়ার একটা বিরাট সুবিধে হলো, যেহেতু ট্রেনের চাকাই যন্ত্র চালু করে দেয়, এজেন্ট সেসময় থাকতে পারে এক মাইল বা তারচেয়েও বেশি দূরে। আরেকটা সুবিধে এই, কোনও জন্তু-জানোয়ারের দ্বারা এটা অসময়ে বিস্ফোরিত হবার ভয় নেই। যন্ত্রটা চালু করতে সত্যিকারের ভারি ওজন, যেমন ট্রেনের এস্ক্রিন বা বগির প্রয়োজন।

মনে মনে ব্যাপারটা সাজাতে লাগলেন ওয়ার্ডেন: ব্যাঙ্কক থেকে আসা প্রথম ট্রেনটা সেতুর সাথেই উড়ে গিয়ে পড়বে নদীতে। অচল হয়ে যাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়ার জন্যে দানবের মত খাটতে শুরু করবে জাপানীরা। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, কিংবা মাসের পর মাস অবিরাম পরিশ্রমের পর আবার নির্মিত হবে সেতু। প্রথম ট্রেনটা নির্বিঘ্নেই পার হয়ে যাবে, কিন্তু বিস্ফোরিত হবে দ্বিতীয় ট্রেনটা। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি তারা অনুভব করবে মানসিক চাপ। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি চার্জ ব্যবহার করলেন ওয়ার্ডেন। এখন সবকিছু ভালয় ভালয় ঘটলে এঞ্জিনসহ কয়েকটা বগি গিয়ে পড়বে পানিতে।

এসব কাজে ওয়ার্ডেন ওস্তাদ। ফলে খুব দ্রুতই শেষ হয়ে গেল প্রাথমিক স্তর। নতুন হলেও ভালই সাহায্য করল স্বেচ্ছাসেবক দুজন। ঊষার এখনও দেরি থাকায় সেতুর কয়েকশো গজ উল্টোদিকে একটু ভিন্ন ধরনের আরেকটা ফাঁদ পাতলেন ওয়ার্ডেন। মিশনে এসে এরকম রাতের সুযোগ গ্রহণ না করাটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

এবারেও দূরদর্শিতার পরিচয় দিলেন ওয়ার্ডেন। একই সেক্টরে দু-দুবার ক্ষগ্রিস্ত হবার ফলে খুব সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়বে শক্ররা। কিন্তু দুবার সফল আক্রমণ চালানো গেলে তৃতীয় বারই বা যাবে না কেন? দ্বিতীয় ফাঁদটা ওয়ার্ডেন এমনভাবে লুকিয়ে রাখলেন যে প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা না খুঁজলে সেটা চোখে পড়া অসম্ভব। তা ছাড়া জিনিসটা কাজ করে একটু দেরিতে। প্রথম ট্রেনের ওজনে বিস্ফোরিত হবার বদলে স্রেফ চালু হয়ে যাবে যন্ত্রটা। দুদুবার এভাবে আঘাত পেলে প্রথম ট্রেনটা সাধারণত পাঠানো হয় পাথর বা অন্য কোনও বাজে জিনিসে বোঝাই করে। তো, প্রথম ট্রেনটা দিব্যি পার হয়ে যাবার পর হাঁপ ছেড়ে শত্রুরা ভাববে, শেষ হয়েছে তাদের দুর্ভাগ্যের সময়, আর তার পরপরই উড়ে যাবে দ্বিতীয় অর্থাৎ আসল ট্রেনটা।

মূল টার্গেটে আঘাত হানার সাথেসাথে কখনোই ধরে নেবে না যে অপারেশন শেষ হয়েছে, বরাবর এই শিক্ষাই দিয়ে আসছে পাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। বরং তারপরেও শক্রর যথাসাধ্য ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করবে। শিক্ষাটা মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছেন ওয়ার্ডেন। আর তাই দ্বিতীয় ফাদটা খুঁজে পাবার আর কোনও সম্ভাবনা নেই, সে-বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন শক্রর আরও কোনও ক্ষতি করার কথা।

অ্যান্টি-পার্সোনেল কিছু অস্ত্র তাঁর কাছে আছে। এর ভেতরে থাকে একটা বুলেট, যা ফোটাতে একজন মানুষের ওজনই যথেষ্ট। পায়ের চাপ পড়ার সাথে সাথে বুলেট ছুটে গিয়ে ফুটো করে ফেলে পা, কিংবা সৌভাগ্যক্রমে, সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটলে আঘাত হানে কপালে। ফাঁদ পাতা রেললাইনের আশেপাশে এগুলো পুঁতে রাখার ব্যাপারে পূর্ণ অনুমোদন আছে পাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশনস কোম্পানির। বিস্ফোরণের পর টিকে থাকা গুটিকয় সৈন্য প্রাণভয়ে ছুটতে ছুটতে গিয়ে পড়ে এই ফাঁদে।

সবগুলোই ছড়িয়ে রাখতে পারলে, খুশি হতেন ওয়ার্ডেন, কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেন তিনি। স্রেফ সামান্য মজা পাবার খাতিরে মূল টার্গেটকে বিসর্জন দেয়ার ঝুঁকি নেয়া চলে না। হঠাৎ যদি কোনও প্রহরীর পা পড়ে ওখানে, তৎক্ষণাৎ চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করবে জাপানীরা।

প্রথম ঊষার আলো ফুটতে শুরু করেছে। ওয়ার্ডেন ফিরে চললেন অবজারভেশন পোস্টের দিকে।

১৯.

হঠাৎ চমকে উঠল এক স্বেচ্ছাসেবক। পাহাড়ের মাথায় যে ফার্নের জঙ্গল, সেখান থেকে একটা শব্দ ভেসে এসেছে তার কানে। চার থাই, একেবারে স্থির হয়ে রইল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। টমিগান আঁকড়ে ধরলেন ওয়ার্ডেন, আর ঠিক তখনই শোনা গেল নিচু তিনটে শিস। পাল্টা শিস দিল এক থাই, তারপর হাত নেড়ে ঘুরল ওয়ার্ডেনের দিকে।

এক নম্বর, বলল সে।

একটু পরেই স্থানীয় দুজন লোকের সাথে সিয়ার্স এসে হাজির হলেন অবজারভেশন পোস্টে।

জানতে চাইলেন, শেষ খবর কি?

সব ঠিক আছে। তিন দিন এখানেই আছি আমি। ঘটনা ঘটবে আগামীকাল। আজ রাতে কোনও এক সময় ট্রেনটা ব্যাঙ্কক ত্যাগ করে আগামীকাল বেলা দশটার দিকে এখানে এসে পৌছার কথা। আপনার খবর কি?

সব প্রস্তুত, বসে পড়লেন সিয়ার্স।

এতক্ষণে স্বস্তি পেলেন তিনি শুধু মনে হচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে জাপানীরা আবার প্রোগ্রাম পরিবর্তন করে না ফেলে। ওয়ার্ডেনও শান্তিতে ছিলেন না গত রাতে। জানতেন, বিস্ফোরক স্থাপন করা হবে সেতুতে। ক্ষীণতম শব্দ শোনার জন্যে উত্তর্ণ হয়ে ছিলেন তিনি। প্রার্থনা করছিলেন, কিছু যেন ওদের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। সুখের বিষয়, অস্বাভাবিক কোনও শব্দ কানে আসেনি। ভোরেই তার সাথে যোগ দেয়ার কথা ছিল সিয়ার্সের, কিন্তু দশটা পেরিয়ে গেছে।

তবু ভাল যে এলেন শেষমেশ। আমি তো রীতিমত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।

সারাটা রাত কেটেছে ওখানে।

ভালভাবে এবার ওয়ার্ডেন তাকালেন সিয়ার্সের দিকে। এক নম্বরের সারা শরীরে ক্লান্তির চিহ্ন। কাপড়-চোপড় এখনও স্যাতসেঁতে, চোখের নিচে কালি, মুখে খোচা খোচা দাড়ি। ব্র্যান্ডির ফ্লাস্কটা এগিয়ে দিলেন ওয়ার্ডেন। কাঁপা কাঁপা হাতে (সটা চেপে ধরলেন সিয়ার্স। দুহাতেই আচড় আর কাটার দাগ, আঙুলগুলো মড়ার মত সাদা। এবারে শুকনো একটা শার্ট আর হাফপ্যান্ট এগিয়ে দিলেন ওয়ার্ডেন।

তুমি শিওর। আজ আর নতুন কোনও খবর নেই? সিয়ার্সের উদ্বেগ পুরোপুরি দূর হয়নি।

সম্পূর্ণ নিশ্চিত। আজ সকালেও সঙ্কেত পেয়েছি।

এক ঢোক ব্র্যান্ডি খেয়ে ধীরে ধীরে হাত ম্যাসেজ করতে লাগলেন সিয়ার্স।

কঠিন কাজ, কেঁপে উঠল তার শরীর। ঠাণ্ডা ওই পানির কথা জীবনে ভুলব। তবে ভালয় ভালয় শেষ হয়েছে সবকিছু।

ছেলেটা কেমন আছে?

চমৎকার! এক মুহূর্তের জন্যে কাজে ঢিলে দেয়নি, তবু ক্লান্তির কোনও চিহ্ন নেই। ইতোমধ্যেই ডান তীরে পজিশন নিয়ে নিয়েছে। এখন থেকেই থাকতে চায় ট্রেনের অপেক্ষায়।

ওরা খুঁজে পাবে না তো?

মনে হয় না। ঝুঁকি অবশ্য আছে, কিন্তু সে-ঝুকি নেয়া যায় আমরা যা ভাবছি, ট্রেন তার চেয়ে অনেক আগে এসে পড়তে পারে অসতর্ক অবস্থায় অন্তত ধরা পড়ার কোনও সম্ভাবনা ওর নেই। যে ঝোপটায় ও আছে, নদী ছাড়া আর কোনওদিক থেকে সেখানে যাবার উপায় নেই। এখান থেকে সম্ভবত জায়গাটা দেখা যাবে। ঝোপের ভেতর থেকে সেতু ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না জয়েসের, কিন্ত এগিয়ে আসা ট্রেনের শব্দটা কানে যাবে ঠিকই।

আপনি সাথে গিয়েছিলেন? যা। পজিশনটা নিখুঁত। বিনকিউলার তুলে চোখে লাগালেন সিয়ার্স।

সঠিকভাবে ওর অবস্থান আন্দাজ করা অবশ্য কঠিন, বললেন তিনি। এখান থেকে সবকিছুই অন্যরকম লাগছে। তবে জায়গাটা খুব সম্ভব নদীর পানিতে ডাল ছুঁয়ে থাকা ওই বড় লাল গাছটার গজ দশেক পেছনে।

তার মানে, সব এখন নির্ভর করছে ওর ওপর।

হ্যাঁ। সব নির্ভর করছে ওর ওপর। এবং এ-ব্যাপারে পুরো আস্থা আছে আমার।

ছুরি সাথে নিয়েছে?

হ্যাঁ। এবং প্রয়োজনের সময় ওটা ব্যবহার করতে পারবে, সে-বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই।

এসব ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় না।

জানি। তবু আমি নিশ্চিত। পরে?

নদীটা পেরোতে আমার লেগেছে পাঁচ মিনিট। জয়েসের সঁতারের গতি আমার প্রায় দ্বিগুণ। তা ছাড়া সে সময় কাভার দেয়ার জন্যে আমরা তো আছিই।

এবারে নিজের নেয়া ব্যবস্থাগুলোর কথা সিয়ার্সকে জানালেন ওয়ার্ডেন। রাতের ওই কাজের আগে আঁধার নামার ঠিক আগেও একবার বেরিয়েছিলেন তিনি। হালকা মেশিনগান বসাবার উপযুক্ত একটা জায়গা নির্বাচন করেছেন

সেসময়, তা ছাড়া রাইফেলসহ কয়েকজন বাইকেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখার পরিকল্পনা করেছেন মনে মনে। দুই মর্টারের সাথে হালকা মেশিনগান আর রাইফেলগুলো যোগ হলে অনেকক্ষণ চলবে প্রতিরক্ষার কাজ।

ওয়ার্ডেনের পর নিজের কাজে বিবরণ দিতে শুরু করলেন সিয়ার্স। সব শুনে ওয়ার্ডেনের মনে হলো, ভাগ্যিস গত রাতে তিনি ওদের সাথে থাকেননি। আগামীকাল পর্যন্ত আর কিছুই করবার নেই। তা ছাড়া সব এখন নির্ভর করছে জয়েসের ওপর। এ-মুহূর্তে শত্রুপক্ষের তীরে ঝোপের ভেতরে শুয়ে থাকা নাটকের মুখ্য অভিনেতাটির ব্যাপারে উদ্বেগ ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন দুজনে।

প্ল্যানটা অনুমোদন করার পর অ্যাকশনে যার যার ভূমিকা বুঝিয়েই ক্ষান্ত হননি এক নম্বর। রীতিমত মহড়া দিয়ে নিয়েছেন, যাতে আসল কাজের সময় যেকোনও ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যে তৈরি থাকে সবাই।

পাইলগুলোতে নম্বর দেয়াসহ সেতুর একটা ছবি এঁকে কোন কোন পাইলের গায়ে চার্জ বসানো হবে, সেটা পর্যন্ত বুঝিয়ে দিয়েছেন ওয়ার্ডেন।

কিন্তু শুধু পেপার-ওয়ার্কে সন্তুষ্ট হবার বান্দা এক নম্বর নন। ক্যাম্পের অদূরেই ছিল একটা সরু-নদী। তার ওপরের পরিত্যক্ত সেতুটাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল নৈশকালীন মহড়া। বিস্ফোরকের ভূমিকা পালন করল বালির বস্তা। বিস্ফোরক বসাবার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত–সিয়ার্স, জয়েস আর স্থানীয় দুজন স্বেচ্ছাসেবক বাঁশের একটা ভেলা ঠেলতে ঠেলতে ভেসে চলল ধীরে ধীরে। বিচারক হিসেবে ওয়ার্ডেন এতই নির্দয় যে মহড়া একশো ভাগ নিখুঁত না হওয়া পর্যন্ত তিনি কাউকে ছাড়েননি।

পুরোপুরি ওস্তাদ হবার পর রওনা দিয়েছে দলটা। গাইডেরা তাদের নিয়ে এসেছে সেতুর অনেকটা উজানে, যাতে নিরাপত্তা ব্যাহত হবার কোনও সম্ভাবনা না থাকে। স্থানীয় বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক সাথে এসেছে মুটে হিসেবে।

বারো পাউন্ড করে চার্জ দিয়ে তৈরি হলো একেকটা বিস্ফোরক। প্রত্যেকটা সারিতে পরপর ছটা অর্থাৎ মোট চব্বিশটা পাইলের গায়ে বসানো হবে সেগুলো। চব্বিশটা বিস্ফোরকের আঘাতে ধুলো হয়ে যাবে প্রায় তিরিশ গজ এলাকার বীম, ট্রেনের ভার বহনে অক্ষম সেতু সোজা নেমে আসবে নিচে। দুর্ঘটনার কথা বিবেচনা করে বারোটা অতিরিক্ত বিস্ফোরক এনেছেন সিয়ার্স। দুর্ঘটনা না হলে ওগুলোর সাহায্যে জ্বালা বাড়ানো যাবে শক্রর। শ্রেষ্ঠ এজেন্ট হয়ে তিনি তো আর ফোর্স ৩১৬-এর মূলমন্ত্র ভুলে যেতে পারেন না!

একেকটা বিস্ফোরকে কতখানি করে চার্জ ব্যবহৃত হবে, সেই সিদ্ধান্তও ঝোঁকের মাথায় নেয়া হয়নি। জয়েসের পর্যবেক্ষণ অনুসারে চুলচেরা হিসেব করে দেখা গেছে, যে-কোনও ধাতুতে তৈরি বীম ওঁড়ো করে দেয়ার পক্ষে দুপাউন্ডের চার্জই যথেষ্ট। আর আট পাউন্ড দিলে তো কোনও কথাই নেই। কিন্তু তার পরেও চার্জ বাড়াবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এক নম্বর।

সিদ্ধান্তটা নেয়ার পেছনে অবশ্য যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। প্লাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশনস কোম্পানির আরেকটা নীতি হলো, টেকনিশিয়ানরা যে হিসেব দেয় সবকিছুই তার থেকে খানিকটা বাড়িয়ে ব্যবহার করা। স্কুলে থিয়োরেটিক্যাল ট্রেনিং শেষ হবার পর এ-বিষয়ে সংক্ষিপ্ত একটা ভাষণ দেন কর্নেল গ্রীন।

প্রয়োজনের সময়, বলেন তিনি, হিসেব মতই জিনিস নেবে, তারপর যোগ করবে সামান্য কিছু। শক্ত অপারেশনে প্রত্যেকটা বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া দরকার। যদি মনে কোনও সন্দেহ দেখা দেয়, এক পাউন্ড চার্চ কম দেয়ার চেয়ে একশো পাউন্ড বরং বেশি দেয়া ভাল। রাতের পর রাত ঘুম হারাম করে, নিজের এবং সঙ্গীদের জীবন ঝুঁকির মুখ ঠেলে দিয়ে ধ্বংসের যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়। সেটা যদি বানচাল হয়ে যায় কয়েক পাউন্ড চার্জ বাঁচাতে গিয়ে তার চেয়ে বিশ্রী ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না। হয়তো ক্ষতিটা হলো আংশিক–খানিকটা বেঁকে গেল বীম, যা খুব সহজেই মেরামত করে ফেলল শত্রুর। কথাগুলো বললাম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। আমার নিজেরই একবার এমনটা ঘটেছিল। মিশনে এটাই সবচেয়ে হতাশাজনক।

এরকম দুর্ঘটনার কথা সেয়ার্স পারেন না। তবে খুবই বেশি জিনিস সাথে নিয়ে নিজেদের চলাচলে ব্যাঘাত ঘটানোও আবার কোনও কাজের কথা নয়।

জিনিস বইতে অবশ্য খুব একটা অসুবিধেয় পড়তে হয় না। প্লাস্টিকের একটা বিরাট সুবিধে হলো, এর ঘনত্ব পানির সমান। ফলে একজন সাঁতারু অনায়সেই অনেক চার্জ বয়ে নিয়ে যেতে পারে।

ঊষাকালে তারা পৌঁছেছে কওয়াই নদীর তীরে। মুটেদের বিনয় করে ঝোপে ঢুকে অপেক্ষা করেছে রাত নামার।

সময় কাটতে চাইছে না, হঠাৎ বলে উঠলেন ওয়ার্ডেন। ঘুম পাচ্ছে আপনার?

মোটেই না। কাল থেকেই ঘুম হারাম হয়ে গেছে। জানোই তো, জিরো আওয়ারের আগে মনের অবস্থা হয়? সারাটা বিকেল গল্প করেছি আমি আর জয়েস। আসলে সেতুর ওপর থেকে ওর মনটা সরিয়ে রাখতে চাইছিলাম। সারাটা রাতই ও পাবে ওসব চিন্তা করার জন্যে।

কি গল্প করলেন আপনারা? কৌতূহল অনুভব করলেন ওয়ার্ডেন।

সিভিলিয়ান জীবনের কিছু কথা বলল ও। ছোকরার ভেতরে এক ধরনের বিষণ্ণতা আছে। কেরিয়ারটা মোটই উল্লেখযোগ্য নয়, অবশ্য সেরকম কোনও ভানও ও করেনি। বড় একটা এঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে ও ছল ড্রাফটম্যান—এরকমের উন্নতমানের অফিস বয় বলতে পারো। এ ধরনের চাকুরির ব্যাপারে আমার অন্তত সেরকমই ধারণা। ওয়ার্ক-রুমে সমবয়সী জনা চল্লিশেক ছোকরা সারাদিন ধরে ঝুঁকে আছে ড্রয়িং-বোর্ডের ওপর—দেখেননি? যখন আবার কাজ নেই, তখনও অঙ্ক কষা আছে। মোটকথা, উত্তেজনা বলতে কিছু নেই। কাজটায় ওর প্রাণও বাঁধা পড়েছিল বলে মনে হয় না, তাই যুদ্ধ শুরু হতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ডেস্কের জীবনে বন্দী একটা ছেলে ফোর্স ৩১৬-তে যোগ দিয়েছে, ভাবতে কেমন যেন অদ্ভুতই লাগে।

অদ্ভুত আর এমন কি, বললেন ওয়ার্ডেন, ফোর্স ৩১৬-তে ছোকরারাও আছে। হ্যাঁ, ওই ধরনের ছেলে আমি দেখেছি দুচারটে। খুব খারাপ নয় ওরা।

খুব ভালও নয়। আসলে খুব ভাল হওয়া ওদের সবার পক্ষে সম্ভবই নয়। তবে অতীতে জীবন নিয়ে ওর ভেতরে কোনও তিক্ততা নেই। খানিকটা বিষণ্ণতা অচ্ছে, এই যা।

জয়েস খুব ভাল ছেলে, আমি নিশ্চিত। তা কি ধরনের ড্রয়িং করত ও?

কাকতালীয় বলো আর যা-ই বলো, ফার্মটা কাজ করত সেতু নিয়। কাঠের সেতু নয়, অবশ্যই। আর কনস্ট্রাকশনের কাজও তারা করত না। ধাতুর তৈরি আর্টিক্যুলেটেড ব্রিজ। ভিন্ন ভিন্ন অংশ তৈরির পর তারা সরবরাহ করত কন্ট্রাক্টরকে–ঠিক মেকানো সেটের মত। অফিস থেকে ও বাইরে বেরোয়নি বললেই চলে। যুদ্ধের আগে দুবছর ধরে সে হাজার হাজার বার এঁকেছে একই অংশের ছবি। কাজটায় খুব কৌতূহল অনুভব করেছে ও, তা বলা যায় না। যে অংশটার ছবি আঁকত ও, সেটা খুব বড় নয়। ওর ভাষায়–গার্ডার। ওর ওপর ছিল এমন এক মডেল আঁকার দায়িত্ব, যা তৈরি হবে খুব হালকা ধাতুতে কিন্তু অনেকটা ভার বহনে সক্ষম। অন্তত ওর বর্ণনায় এমনটাই বুঝেছি আমি, তবে এ-ধরনের মডেলের কথা আগে কখনও শুনিনি। যাই হোক, এর সাথে জড়িত ছিল আর্থিক প্রশ্ন। উপকরণ নষ্ট করাটা ফার্ম একেবারেই পছন্দ করত না। তো, দুবছর ও কাটল এই করে–এই বয়সের একটা ছেলে! সেই গার্ডারের বর্ণনা তুমি যদি শুনতে! রীতিমত গলা কাঁপছিল ওর। আমার মনে হয়, ওয়ার্ডেন, সেই গার্ডারই ওকে এখনকার কাজটার প্রতি উৎসাহী করে তুলেছে।

হ্যাঁ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, বললেন ওয়ার্ডেন। সেতু ধ্বংসের ব্যাপারে এত উৎসাহী আমি আর কাউকে দেখিনি। আমার মনে হয়, সিয়ার্স এসব কাজে উৎসাহী মানুষের পক্ষে ফোর্স ৩১৬ একটা ঈশ্বর-প্রেরিত সুযোগ। অস্তিত্ব না না থাকলে আমরা বোধহয় এটাকে আবিষ্কার করতাম! আপনার কথাটাই ভাবুন না, নিয়মিত সেনাবাহিনীতে থাকতে থাকতে…

আরও তুমিও বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার দিতে দিতে… কারণ যাই হোক, যুদ্ধ শুরুর পরও গার্ডার নিয়েই রীতিমত ব্যস্ত হয়ে ছিল ও। দুবছর পরিশ্রমের পর দেড় পাউন্ড ধাতু বাঁচানো যায়, এমন একটা মডেল ও তৈরি করল। খুব খারাপ নয়, কিন্তু ফার্মের মতে, ও আরও ভাল করতে পারত। তারপর একদিন ফোর্স ৩১৬-এ খ কানে আসতেই অস্থির হয়ে উঠল ও। তবে আবার সেই কথাটাই মনে হচ্ছে আমার। গার্ডারের মডেল না আঁকলে এ-মুহূর্তে ও বোধহয় শত্রুর একশো গজ দূরে ঝোপের ভেতরে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে পারত না।

২০.

শুধু বিকেল নয়, আসলে সারাটা দিনই গল্প করেছিলেন সিয়ার্স আর জয়েস। থাই দুজন গলা নামিয়ে ছিল অভিযানের আলোচনা। মাঝেমাঝে দপ্ করে উঠছিল সিয়ার্সের মাথার ভেতরে। বুঝতে পারছিলেন না, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যে ছেলেটাকে নির্বাচন করাটা সঠিক হয়েছে, নাকি তিনি স্রেফ হাল ছেড়ে দিয়েছেন তার আন্তরিক অনুরোধের মুখে।

যে-কোনও পরিস্থিতিতে আমার বা ওয়ার্ডেনের মত ঠাণ্ডা মাথায় মুহূর্তের মধ্যে কাজ করতে পারবে তো? জানতে চাইলেন তিনি শেষবারের মত।

নিশ্চয় পারব, স্যার। সুযোগটা দিয়েই দেখুন না!

সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন সিয়ার্স। এ-বিষয়ে কোনও প্রশ্নই আর করলেন না তিনি।

আঁধার নামার কিছু আগে রওনা দিলেন তারা। নদীর তীর সম্পূর্ণ নির্জন। এসব ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না বলে বাঁশের ভেলাটা তারা তৈরি করেছেন নিজেরাই। দুভাগে ভেলাটা বিভক্ত, তাই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে আনার সময় সুবিধেও হলো বেশ। আস্তে করে পানিতে নেয়ে দুভাগ একত্র করে বাঁধলেন তারা দড়ি দিয়ে। তারপর একটা প্ল্যাটফর্ম মত তৈরি করে বিস্ফোরকগুলো বাঁধলেন তার সাথে। এ ছাড়া দড়ির গোছা, ব্যাটারি, বৈদ্যুতিক তার, জেনারেটর ইত্যাদির জন্যে রয়েছে আলাদা আলাদা পোঁটলা। ভঙ্গুর জিনিসপত্র মুড়ে নেয়া হলো ওয়াটারপ্রুফ কাগজে। একখানা অতিরিক্ত ডিটোনেটর নিয়ে এসেছেন সিয়ার্স। তাই দুজনে দুটো ডিটোনেটর বেঁধে ফেললেন কোমারে। তাবৎ জিনিসের মধ্যে এই দুটোই সবচেয়ে বিপজ্জনক।

কোমরের পোঁটলাটা নিয়ে যথেষ্ট অস্বস্তি অনুভব করছিলেন নিশ্চয় কালেম ওয়ার্ডেন।

তুমি তো জানোই, এ-ধরনের জিনিস সাথে থাকলে, সে-কথা ভুলে থাকতে হয়। যাই হোক, নদীতে নামার পর ভেবেছিলাম, যাত্রাটা এখন সহজ হয়ে আসবে, কিন্তু না।

স্থানীয় অধিবাসীদের তথ্য অনুসারে সিয়ার্স হিসেব করছিলেন, সবসুদ্ধ সময় লাগবে আধ ঘণ্টারও কম। তাই পানিতে নেমেছিলেন চারপাশ গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাবার পর। কিন্তু লেগে গেল এক ঘণ্টারও বেশি। সেতুর কাছে ছাড়া কওয়াই নদী সব জায়গাতেই খরস্রোতা। ফলে যাত্রা শুরুতেই ভেসে যার উপক্রম হলো। ভেলা আঁকড়ে কোনওমতে রক্ষা পেল সবাই।

নদীটার কথা যদি ঠিকমত জানতে পারতাম, তা হলে হয়তো আসলাম অন্য পথ ধরে, আর অত দূরে না নেমে নামতাম সেতুর কাছেপিঠে কোথাও। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, ওই স্রোতের মধ্যে দিয়ে সাবমেরিন নিয়ে যেতে কি পরিমাণ অসুবিধে হচ্ছিল।

সাবমেরিন হলো ভেলাটার নাম.। দুপ্রান্তে দুখণ্ড লোহা বেঁধে দেয়া বেশির ভাগ সময় ওটার অর্ধেক ডুবে ছিল পানির নিচে। তা ছাড়া এমনই ভারসাম্যের ব্যবস্থা করা হয়েছিল ভেলাটায়, যাতে স্রেফ আঙুলের চাপে ডুবিয়ে রাখা যায় পুরোপুরি।

ভীষণ গর্জন করছিল স্রোত। আমরা কখন কোনদিকে গেলাম তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। সামান্য নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে সবাইকে যে-কোনওভাবে শুধু আঁকড়ে থাকতে বললাম, ভেলা যেদিকে খুশি যাক। তা-ই করল ওরা। ভেলা ভেসে চলল আপন ইচ্ছেয়। কখনও কখনও আমরা এটাও টের পাচ্ছিলাম না যে সামনে যাচ্ছি নাকি পেছনে। মানে, জানি না অবস্থাটা ঠিক বুঝতে পারছ কিনা…

পারছি। ভেলায় দু অংশ একত্রে ছিল?

হ্যাঁ। অবিশ্বাস্য হলেও, মাত্র একবার ছাড়া আর কখনোই গোলমাল করেনি ওটা। পরিস্থিতিটা সামলেছে জয়েস। প্রথম বাঁক ঘোরার পর চোখে অন্ধকার যখন কেবল সয়ে আসছে, ভেলাটা ধাক্কা খেলো নদীর মাঝখানে মাথা উঁচিয়ে থাকা বিরাট এক পাথরের সাথে। শূন্যে উঠে গেলাম সবাই। ঢেউয়ের মাথায় উঠে পড়ে জয়েস আরেকটা ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে যাবার আগেই ধরে ফেলল ভেলাটা। পাথরটা আমার চোখে পড়েছিল মাত্র কয়েক ফুট দূরে থাকতে, যখন এড়াবার আর কোনও সময় নেই। আমি শুধু কয়েকবার পা ছুঁড়তে পারলাম, গোটাকতক বাঁশ ঢিলে হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই হলো না। থাই দুজন ভেসে গেল। সৌভাগ্যক্রমে তাদের খুঁজে পেলাম খানিকটা ভাটিতে। কিন্তু ছেলেটা কি করল জানো? চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল ভেলার ঠিক নিচে। কেন তা জানো, ওয়ার্ডেন? ভেলার দুটো অংশ যেন আলাদা হয়ে না যায়। ধাক্কায় দড়িগুলো আলগা হয়ে খুলে যেতে শুরু করেছিল ভেলাটা। ভাবার জন্যে মাত্র একটা মুহূর্ত পেয়েছিল জয়েস। সুতরাং দ্রুত বিবেচনার ক্ষমতা আছে ওর, সেই সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস। বাঁশগুলো আঁকড়ে থাকা অবস্থায় ওকে নিয়ে পানির নিচ থেকে বেরিয়ে এল সাবমেরিন, ঠিক স্যামন মাছ যেমন লাফিয়ে ওঠে ঢেউয়ের মাথায়। হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল ডিটোনেটরের কথা। ওর শরীর এখন যে অবস্থায় আছে, ভয়াবহ কিছু ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়। এই একবারই আমি সচেতন হয়েছি ব্বিক্ষোরক সম্বন্ধে। অই হোক, প্রায় সাথে সাখেই ঝেড়ে ফেললাম চিন্তাটা। ভয়ের কিছু নেই। ছেলেটা অসাধারণ, ওয়ার্ডেন। সফল ও হবেই।

নিখুঁত সিদ্ধান্ত আর চোখ ধাঁধানো রিফ্লেক্স-অ্যাকশনের চমৎকার উদাহরণ, সায় দিলেন ওয়ার্ডেন।

গলা নামিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন সিয়ার্স, সফল ও হবেই, ওয়ার্ডেন। কেউ ওকে ঠেকাতে পারবে না। বর্তমানে কাজটা ওর ওপর নির্ভরশীল, সেটা ও ভাল করেই জানে। আমরা দুজন এখন দর্শকমাত্র। তবে আমাদের উচিত কাজটা ওর পক্ষে যথাসম্ভব সহজ করে দেয়া।

ভেলার অংশদুটো ভালভাবে বেঁধে আবার রওনা দিল তারা। খানিকটা এগোতে চোখে পড়ল অনেকগুলো পাথর, যেখানে ধাক্কা খেয়ে সৃষ্টি হচ্ছে একটা ঘূর্ণিজ্ল। সেখানেও নষ্ট হলো মূল্যবান কয়েকটা মিনিট।

অবশেষে একসময় চওড়া হয়ে এল নদী। দলের সবার মনে হলো হঠাৎ যেন তারা এসে পড়েছে বিশাল কোনও শান্ত হ্রদে। দুএক মিনিট পরই দেখা গেল সেতুটা।

সিয়ার্স তাকালেন উপত্যকাটার দিকে।

এখান থেকে কী শান্তই না দেখাচ্ছে! অথচ রাতের বেলা ওখানে গেলে জায়গাটা লাগে সম্পূর্ণ অন্যরকম। কোথাও কোনও আলো নেই। ধীরে ধীরে আমরা গিয়ে পৌঁছুলাম সেতুর নিচে। তারপর প্রধান একটা পাইলের সাথে ভেলাটা বেঁধে লেগে গেলাম কাজে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় হাত-পা জমে যাবার জোগাড়।

আর বিশেষ কোনও অসুবিধে? জানতে চাইলেন ওয়ার্ডেন।

না, তেমন কিছু নয়।

সম্মোহিতের মত সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন সিয়ার্স, যেন সেতু ছাড়া আর কিছুই তার দৃষ্টিপথে নেই।

সবকিছুই এখন মনে হচ্ছে স্বপ্নের মত। এরকম অনুভূতি আমার আগেও হয়েছে, ওয়ার্ডেন। সমস্ত প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন হয়ে যায়, তখন মনে দোলা দেয় অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা। চার্জগুলো যথাস্থানে আছে তো? ঠিক সময়ে চাপ পড়বে তো প্লঞ্জারে? ওখানে, গাছের পেছনে, শত্রুর একশো গজের মধ্যেই রয়েছে জয়েস। সেতুর দিকে চেয়ে চোখজোড়া স্থির। বাজি রেখে বলতে পারি, আমি আসার পর ও এক ইঞ্চিও নড়েনি। তবু ভেবে দেখো, ওয়ার্ডেন, কত কী-ই না ঘটতে পারে আগামীকালের আগে! সাপ তাড়াতে তাড়াতে একজন জাপানী সৈন্য ঢুকে পড়তে পারে জঙ্গলে…না, ওকে রেখে আসাটা বোধহয় আমার উচিত হয়নি। ওর পজিশন নেয়া উচিত ছিল আজ সন্ধ্যায়।

ওর কাছে ছুরি আছে, বললেন ওয়ার্ডেন। যা ভাল বুঝবে, করবে। তারপর কি হলো, বলুন।

দীর্ঘক্ষণ পানিতে ডুবে থাকলে মানুষের চামড়া এত নরম হয়ে যায় যে শক্ত কিছুর সংস্পর্শেই কালশিরা পড়ে যায়। শরীরের মধ্যে হাত আবার সবচেয়ে স্পর্শকাতর। ভেলার সাথে বাধা জিনিসগুলোর গায়ে দড়ি এমনভাবে বসে গিয়েছিল যে বেশ কষ্ট হলো খুলতে।

এখন হয়তো ব্যাপারটা তত কঠিন মনে হচ্ছে না, ওয়ার্ডেন, কিন্তু যে পরিস্থিতিতে আমরা ছিলাম…তা ছাড়া পানির নিচে যখন কাজ করতে হয় নিঃশব্দে…আমার হাতের দিকে দেখো জয়েসেরও একই অবস্থা।

আবার তিনি দৃষ্টি মেলে দিলেন উপত্যকার দিকে। শত্রুপক্ষের তীরে অপেক্ষমাণ ওই ছেলেটির কথা সিয়ার্স মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারছেন না। হাতদুটো তুলে ক্ষতগুলো পরীক্ষা করলেন তিনি, তারপর কাঁধ ঝাকিয়ে আবার ফিরে গেলেন বর্ণনায়।

দুজনের কাছেই ছিল তীক্ষ্ণধার ছুরি, কিন্তু অবশ হাতে সেটা ব্যবহার করাই হয়ে দাঁড়াল সমস্যা। সিয়ার্স টের পেলেন, থাই দুজন আর কোনও কাজেই আসবে না।

এ-ধরনের অসুবিধের কথা আমার মাথায় অনেক আগে এসেছে। তাই রওনা দেয়ার আগেই জয়েসকে বলেছিলাম, হাত আমাদেরই লাগাতে হবে। তো, থাই দুজনের অবস্থা একেবারে কাহিল। একটা পাইল জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপছিল ওরা। তাই আমার জন্যে পাহাড়ের নিচে অপেক্ষা করতে বলে পাঠিয়ে দিলাম দুজনকেই। ওরা যাবার পর সমস্ত দায়িত্ব চাপল আমাদের দুজনের ওপর। তুমি তো জানোই, ওয়ার্ডেন, এসব কাজ শুধু স্ট্যামিনা দিয়ে হয় না। ছেলেটা কাজ করল চমৎকার; আমি কোনওমতে। বোধহয় বুড়িয়ে যাচ্ছি।

প্যাকেট খুলে একটা একটা করে বিস্ফোরক বের করে বসালেন তারা প্ল্যান অনুসারে। সবসময় স্রোত তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইল। পায়ের আঙুল দিয়ে পাইল চেপে ধরে বিস্ফোরক নামাতে হলো অনেকটা নিচে, যাতে ওপর থেকে চোখে পড়ার সম্ভাবনা না থাকে। দড়ির বাধন শক্ত করতে গিয়ে হাতের তালুতে রক্ত ফুটে উঠল। শেষের দিকে কাজটা তাদের সারতে হলো দাঁত দিয়ে।

কাজের এই অংশেই সময় লেগে গেল বেশি। পরের অংশটুকু অতখানি শ্রমসাধ্য না হলেও করতে হলো খুব সাবধানতার সাথে। ডিটোনেটরগুলোতে এমনভাবে সংযোগ দিতে হলো, যাতে একসাথে ঘটে সমস্ত বিস্ফোরণ। বিস্ফোরকের সার্কিট অনেকটা বৈদ্যুতিক সার্কিটের মত। প্রত্যেকটা উপাদান আলাদাভাবে রাখতে না পারলেই ঘটে যাবে ভয়াবহ ব্যাপার। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে অনেকখানি বেশি তার ব্যবহার করলেন সিয়ার্স।

অবশেষে সবকিছু তৈরি হয়ে গেল। কাজ আমরা খুব একটা খারাপ করেছি বলে মনে হয় না। শেষবারের মত পাইলগুলোকে একনজর দেখব ভেবেছিলাম। কিন্তু জয়েস সাথে থাকায় সে-চিন্তাও বাদ দিলাম। কোনও জিনিসই স্থানচ্যুত হবে না, আমার বিশ্বাস।

হাতের প্রত্যেকটা আঙুল ক্ষতবিক্ষত, শরীর কাঁপছে থরথর করে, তবু কাজ সমাপ্তির দিকে এগোতে দেখার একটা উত্তেজনা পেয়ে বসল তাদের। সাবমেরিন খুলে বশ ভাসিয়ে দিলেন তারা একটার পর একটা। এখন কাজ ভাটির দিকে যাওয়া। ডান তীর অভিমুখে ধীরে ধীরে সাতরে চললেন দুজনে। একজনের হাতে ওয়াটারপ্রুফ কেসে মোড়া ব্যাটারি, আরেকজন চলল তার ছাড়াতে ছাড়াতে। তীরটা অত্যন্ত খাড়া, বুনো লতাপাতা নেমে এসেছে পানির কিনারায়। ঝোপে তার লুকিয়ে রেখে, গজ বারো পথ কেটে তারা প্রবেশ করলেন জঙ্গলে। ব্যাটারি আর জেনারেটর ফিট করল জয়েস।

ওই যে ওখানে, আবার বললেন সিয়ার্স, নদীর পানিতে ডাল ছুঁয়ে থাকা বড় লাল গাছটার গজ দশেক পেছনে। হ্যাঁ, ওখানেই, কোনও সন্দেহ নেই।

সবকিছুই এখন মনে হচ্ছে আমাদের নিয়ন্ত্রণে, বললেন ওয়ার্ডেন। আজকের দিনটিও প্রায় শেষ হয়ে এল, এখনও ওকে কেউ খুঁজে বের করতে পারেনি। ওঁর ধারে-কাছে কেউ এলে এখান থেকে অবশ্যই দেখতে পেতাম আমরা। ক্যাম্পের আশেপাশেও খুব একটা যাতায়াত চোখে পড়ছে না। বন্দীরা তো গতকালই চলে গেছে।

বন্দীরা চলে গেছে।

অনেক বন্দীকে আমি ক্যাম্প ছাড়তে দেখেছি। ওরা নিশ্চয় কাজ শেষের আনন্দ উদযাপন করতে বেরিয়েছিল। তা ছাড়া জাপানীরাও নিশ্চয় চায় না, এতগুলো বন্দী হাত-পা গুটিয়ে স্রেফ বসে বসে খাক।

এটা তো খুব ভাল সংবাদ!

কিছু বন্দী রয়ে গেছে এখনও। ওরা খুব সম্ভব আহত, হাঁটার শক্তিও নেই। তা আপনি ওকে রেখে এসেছেন শত্রুপক্ষের তীরে, তাই না, সিয়ার্স?

হ্যাঁ, শত্রুপক্ষের তীরে রেখে এসেছি ওকে। আর কী-ই বা করার ছিল আমার? ভোর হয়ে আসছিল। আশা করি কেউ সন্ধান পাবে না ওর।

ওর কাছে ছুরি আছে, বললেন ওয়ার্ডেন। সবকিছুই ঘটে চলেছে চমৎকারভাবে। আলো কমে আসছে ধীরে ধীরে। ইতোমধ্যেই ছায়া ঘনিয়েছে কওয়াই উপত্যকায়। এখন আর কোনও দুর্ঘটনার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।

দুর্ঘটনার সম্ভাবনা সবসময়ই থাকে, ওয়ার্ডেন, বিশেষ করে কেউ যখন সেসম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়। কথাটা আমি যেমন জানি, তুমিও তেমনি জানো। এদুর্ঘটনা কেন ঘটে, তা বলতে পারব না। কিন্তু আজ পর্যন্ত এমন একটা মিশন পাইনি, যেখানে শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনামাফিক সবকিছু ঘটেছে।

হ্যাঁ। আমিও লক্ষ করেছি ব্যাপারটা।

ভাবছি, এবার আবার কোন দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। ডান তীরে যখন পৌঁছি, সাথে ছিল ছোট্ট এক ব্যাগ চাউল আর এক ফ্লাস্ক হুইস্কি–ওগুলাকে আমি রেখেছি ডিটোনেটর রাখার মত সাবধানে। এক ঢোক করে খেলাম। আমরা, তারপর ফ্লাস্কটা দিয়ে দিলাম ওকে। আমার কাছে এখন আছে শুধু চাউলের ব্যাগটা। আসার সময় আবার বলল, নিজের ওপর ওর পুরো বিশ্বাস আছে। সুতরাং সব দায়িত্ব ওর ওপর ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম আমি।

আগের পর্ব :
০১-০৫. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানুষের মধ্যে যে অনতিক্রম্য ব্যবধান
০৬-১০. কাজের অগ্রগতির প্রশ্ন
১১-১৫. পাশ্চাত্যের মানুষের সেতুর ধারণা
পরের পর্ব :
২১-২৫. কওয়াইয়ের কলধ্বনি

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত