১১-১৫. পাশ্চাত্যের মানুষের সেতুর ধারণা
১১.
পাশ্চাত্যের মানুষের সেতুর ধারণার সাথে জাপানীদের ধারণার কোনও মিল নেই। যোগ্যতাসম্পন্ন এঞ্জিনিয়ার যে তাদের নেই, তা নয়। কিন্তু তারা সব রাজধানীর বাসিন্দা। সামান্য কজন যে এঞ্জিনিয়ারকে থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়েছে, দক্ষতা তাদের খুব কম। তা ছাড়া, সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসব এঞ্জিনিয়ারকে ঘোড়াই কেয়ার করে।
সৈন্যেরা প্ল্যান বা ডিজাইনের ধার ধারে না, তাদের কাছে প্রয়োজনটাই বড়। অর্থাৎ নিখুঁত জিনিস নিয়ে মাথা ঘামায় না তারা, কাজ চললেই হলো।
হয়তো একটা সেতু তৈরি করল তারা, যার ফুটপাতের বালাই নেই, পার হতে হয় বীমে পা দিয়ে–আর এই কাজে জাপানীরা ওস্তাদ।
হোঁচট খেতে খেতে হয়তো একটা ট্রেন পার হলো তার ওপর দিয়ে, এখানেসেখানে সরে গেল দুএকটা কাঠ, সাথে সাথে জাপানী সৈন্যরা মেরামত করে ফেলল সে-জায়গা। পরের ট্রেনটাও পার হয় একই কায়দায়। এসব সেতু টেকে কয়েকদিন, কয়েক সপ্তাহ, কখনও বা কয়েক মাস, তারপর বন্যা এসে পুরোটাকেই নিয়ে যায় ভাসিয়ে। প্রবল উৎসাহে আবার সেতু তৈরির কাজে লেগে পড়ে জাপানীরা, অফুরন্ত কাঠ জোগাতে জঙ্গল তো আছেই।
কিন্তু এ-ধরনের কাঁচা কাজ করতে চান না ক্যাপ্টেন রীভ।
রেললাইন বসানোর জায়গা মেজর হিউজেসকে দেখিয়ে দিয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন সেতুর প্ল্যান আর ডিজাইন নিয়ে।
দেখতে দেখতে ভারতে কাজ করার মতই আগ্রহী হয়ে উঠলেন রীভত্স। সেআগ্রহ আরও বেড়ে গেল কমান্ডিং অফিসারের আকস্মিক এক কথায়। _ এ-কাজের ব্যাপারে আমি তোমার ওপরেই সম্পূর্ণ ভরসা করে আছি, রীভস। এ-বিষয়ে তুমিই আমাদের একমাত্র বিশেষজ্ঞ বলে সবকিছুই ছেড়ে দিয়েছি তোমার হাতে। আমরা যে এই বুনোদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সেটা প্রমাণ করতেই হবে। অভিশপ্ত এই দেশে, যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায় না সেখানে কাজ করাটা যে কত কঠিন তা আমি জানি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কাজ করতে পারাটাই আসল যোগ্যতার চিহ্ন।
আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন, স্যার, বললেন রীভূস্। যেভাবে হোক রক্ষা করব আপনার মর্যাদা।
সারা জীবন ধরে এরকম একটা বড় কাজের জন্যে অপেক্ষা করে আছেন ক্যাপ্টেন রীভস, যেখানে বড় অফিসারদের চোখ রাঙানি বা হাস্যকর নাক গলানো থাকবে না। কমান্ডিং অফিসার হিসেবে কর্নেল নিকলসন একেবারে আদর্শ। বাজে খবরদারি তো দূরের কথা, এঞ্জিনিয়ারিং সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই–সেটা বলতেও দ্বিধাবোধ করেন না তিনি। সৃজনী প্রতিভা প্রকাশের জন্যে টগবগ করছেন রীভস। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব তিনি পূরণ করবেন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে।
প্রথমে কল্পনার চোখে দেখা একটা সেতুর স্কেচ করলেন। চার সারি পাইলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেতুটা–ওপর দিয়ে শুধু রেললাইনই যায়নি, পাশে রয়েছে যানবাহন চলাচলের রাস্তা আর ফুটপাথ।
এরপর শুরু হলো মূল ডিজাইন আর নানারকম হিসেব। মাঝেমাঝে পাশে বসে মুগ্ধ চোখে এসব কাজ দেখেন জাপানী এঞ্জিনিয়ার।
সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত খেটে চলেন রীভস। এমনই ডুবে থাকেন কাজের মাঝে, দিন খুব ছোট মনে হয়। শেষমেশ সাইতোকে বলে একটা বাতি জ্বেলে রাখার অনুমতি আদায় করেন। সন্ধ্যা গড়িয়ে যাবার পরেও চলে খুঁটিনাটি হিসেব, কখনও কখনও মধ্যরাত পর্যন্ত।
মনে রাখবার মত একটা সেতু তৈরি করার জন্যে নিজের সুখশান্তিকে বিসর্জন দেন ক্যাপ্টেন রীভস।
প্রস্তুতিমূলক এত খাটাখাঁটি প্রথমটায় বাড়াবাড়ি মনে হয় ক্লিপটনের কাছে। কিন্তু যখন মেজর হিউজেসের কাছে প্ল্যান হস্তান্তর করেন রীভস, তার মনে হয়, কোনও জিনিস না বুঝে হুট করে একটা ধারণার বশবর্তী হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
বু-প্রিন্টটা কর্নেল নিকলসনও পছন্দ করেন। শুধু বলেন, অতিরিক্ত খাটাটা উচিত হবে না।
ভাল থাকতে থাকতেই দেখবে, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছ একদিন। সেতুর কাজ পুরোপুরি নির্ভর করছে তোমার ওপর, কথাটা মনে রেখো, রীভূস্।
একটা ব্যাপার আমাকে খুব ভাবাচ্ছে, স্যার। বিষয়টার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল আমাদের। আপনি শুনে একটা মতামত দিলে ভাল হয়।
কি ব্যাপার, রীভস? জানতে চাইলেন কর্নেল।
কাঠগুলো এখনও স্যাতসেঁতে আছে, স্যার। এরকম কাজে কাঁচা কাঠ ব্যবহার করা উচিত নয়। গাছগুলো সদ্য কাটা হয়েছে তো, সুতরাং শুকোতে হবে রোদে।
কতদিন লাগবে ওগুলো শুকোতে?
কাঠের জাতের ওপর নির্ভর করে, স্যার। কোনও কোনওটার ক্ষেত্রে আঠারো মাস, এমনকী দুবছর পর্যন্ত লেগে যায় ভালভাবে শুকোতে।
এত দেরির তো প্রশ্নই ওঠে না, রীত! আমাদের হাতে মাত্র পাঁচ মাস সময় আছে।
মাথা ঝুলে পড়ল ক্যাপ্টেনের।
দুঃখিত, স্যার। আমি এটা জানি, আর জানি বলেই চিন্তা হচ্ছে।
কাচা কাঠ ব্যবহার করতে অসুবিধেটা কোথায়?
কোনও কোনও কাঠে চিড় ধরে, স্যার। কোনওটা আবার সংকুচিত হয়ে আসে। এলম কাঠের এসব বালাই নেই বললেই চলে। সেজন্যে অবশ্য এলম জাতীয় কাঠই বাছাই করেছি বেশি। লন্ডন ব্রিজের এলমের খুঁটিগুলো ছশো বছর ধরে টিকে আছে, স্যার।
ছশো বছর! বিস্ময় ফুটল কর্নেলের গলায়। নিজের অজান্তেই দৃষ্টি চলে গেল কওয়াই নদীর দিকে। ছশো বছর ধরে টিকে আছে! বলো কি, রীভস?।
ওটা অবশ্য ব্যতিক্রম, স্যার। এখানে আপনি বড়জোড় পঞ্চাশ বা ষাট বছর টেকার আশা করতে পারেন। কাঠ ভালভাবে না শুকোলে হয়তো তার চেয়েও কম।
ঝুঁকিটা আমাদের নিতেই হবে, রীভস, দৃঢ় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন কর্নেল। তাজা কাঠ দিয়েই কাজ চালাতে হবে তোমাকে। তা হলে কোনও ত্রুটি দেখা দিলে বলতে পারব, এতে আমাদের করার কিছু ছিল না।
ঠিক বলেছেন, স্যার। আর একটা কথা। ক্রিয়াজোট, ঘুণের হাত থেকে বীমগুলোকে বাঁচবার জন্যে…আমাদের বোধহয় ওটা ছাড়াই কাজ চালিয়ে নিতে হবে, স্যার। জাপানীদের কাছে ক্রিয়োজোট নেই। একটা বিকল্প অবশ্য তৈরি করা যায়…উড-অ্যালকোহল। এতে কাজ হবে, কিন্তু সময় লাগবে তৈরি করতে…না, থাক, তার চেয়ে বরং…
কেন, থাকবে কেন, রীভস? এসব খুঁটিনাটি প্রসঙ্গে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন কর্নেল।
এ-ব্যাপারে একটু মতভেদ আছে, স্যার। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কাঠ যথেষ্ট না শুকোলে ক্রিয়োজোট ব্যবহার না করাই ভাল। দ্রুত পচন ধরার একটা ঝুঁকি থাকে।
তা হলে ক্রিয়োজোট ছাড়াই আমাদের চালাতে হবে, রীভত্স। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেতু তৈরি করাটাই এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
এই বাধা দুটো ছাড়া, চমৎকার একটা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ আশাবাদী, স্যার।
এটাই তো চাই, রীভত্স, চমৎকার একটা সেতু। আর আগেই তো বলেছি, এব্যাপারে সম্পূর্ণ ভরসা করে আছি তোমার ওপর।
উপদেষ্টাকে পেছনে রেখে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগোলেন কর্নেল নিকলসন।
১২.
ফোর্স ৩১৬-এর সিয়ার্স–থাইল্যান্ডের প্রতিরক্ষা বাহিনী যাকে বলে এক নম্বরখুব ধীরস্থির মানুষ। যথাযথ প্রস্তুতি না নিয়ে তিনি কোনও আক্রমণ চালাতে চান না। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড প্রফেসর ওয়ার্ডেনের মাথাও ভীষণ ঠাণ্ডা। নিশ্চিত না হয়ে হঠাৎ একটা কিছু করে সব তালগোল পাকিয়ে ফেলার একেবারে বিরুদ্ধে তিনি। দলের তৃতীয়জন–জয়েস। কোর্স সদ্য শেষ করলেও যুবকটির হাবভাব দেখে মনে হয় যেন তার জন্মই হয়েছে এ-ধরনের কাজের জন্যে। তাই সিয়ার্স তার মতামতও খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন।
থাইল্যান্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বর্তমানে তারা আসন গেড়েছেন দুঘর বিশিষ্ট একটা কুটিরে। এক সন্ধ্যায় সেখানেই তাঁরা বসেছেন একটা ম্যাপ নিয়ে আলোচনা করতে।
এটাই রেলওয়ের সম্ভাব্য গতিপথ, স্যার, বলল জয়েস। রিপোর্টগুলো যাচাই করে দেখেছি আমি।
কলকাতায় প্লাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশনস কোম্পানির স্কুলে কোর্স করার আগে জয়েস ছিল একজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনার। বার্মা-থাইল্যান্ড রেলওয়ের এই ম্যাপটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছে সে।
এখানে এসে নিরাপদে নামার পর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে নানারকম। স্থানীয় অধিবাসীদের ভালবাসা পেয়েছেন তারা অকৃপণভাবে। যোগাযোেগ রাখছে থাইল্যান্ডের এজেন্টরা। সিয়ার্স সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে চান না, কিন্তু তিনিও ধীরে ধীরে এদের বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে শুরু করেছেন।
মিশনের প্রথম ভাগ সাফল্যের সাথেই এগিয়ে চলেছে। অসংখ্য গ্রামের মোড়লের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে গোপনে। সাহায্য করার জন্যে স্বেচ্ছাসেবীরা এক পায়ে খাড়া। তাদের এখন প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বিস্ফোরকের ব্যবহার সম্বন্ধে।
সেতু অনেক আছে, স্যার, বলে চলল জয়েস, কিন্তু তেমন উল্লেখযোগ্য সেতু বেশি নেই। তথ্য অনুসারে এই হলো ব্যাঙ্কক থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত যাবতীয় সেতুর তালিকা।
এই স্যার সম্বোধন মেজর সিয়ার্সের প্রতি। যদিও ফোর্স ৩১৬-এর শৃঙ্খলা খুবই কড়া, এ-ধরনের মিশনে এত নিয়মকানুন চলে না। তাই স্যার বলতে বেশ কয়েকবার নিষেধ করেছেন সিয়ার্স, কিন্তু জয়েসের অভ্যেস বদলাতে পারেননি।
তবু এখন পর্যন্ত তিনি জয়েসের মধ্যে যা কিছু লক্ষ করেছেন তার প্রায় সবই প্রশংসারযোগ্য। গোলকধাধার মত রিপোর্টগুলো সে যেভাবে বিশ্লেষণ করে, ভাবা যায় না। প্রফেসর ওয়ার্ডেনও তার কাজকর্মে মুগ্ধ।
জয়েসকে দলে নেয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করেছিল শিক্ষকেরা। প্রথম তাকে দেখে সিয়ার্সেরও মনে হয়েছিল, এরকম একটা ছেলেকেই যেন খুঁজছিলেন তিনি।
এধরনের একটা অস্ত্র কি তুমি নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে পারবে? একদিন জানতে চাইলেন সিয়ার্স।
তার হাতে একটা ক্ষুরধার ড্যাগার। স্পেশাল মিশনে গেলে ফোর্স ৩১৬-এর সবাই এই অস্ত্রটা সাথে রাখে। চোখের পাতাও কাঁপল না জয়েসের। বলল, অস্ত্রটার ব্যাপারে তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া অনুশীলনও চালাতে হয়েছে ডামির ওপর। সিয়ার্স পুনরাবৃত্তি করলেন প্রশ্নটার।
তুমি কেমন প্রশিক্ষণ নিয়েছ না নিয়েছ, সেটা আমি শুনতে চাইনি। আমি জানতে চাইছিলাম, অস্ত্রটা তুমি ঠাণ্ডা মাথায় ব্যবহার করতে পারবে কিনা। ব্যবহারের কায়দা অনেকেই জানে, কিন্তু প্রকৃত প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করতে পারে না।
এবার বুঝতে পারল জয়েস। চুপচাপ কয়েক মুহূর্ত ভেবে জবাব দিল সে গম্ভীর হয়ে:
প্রশ্নটা আমি নিজেই নিজেকে অনেকবার করেছি, স্যার।
নিজেই নিজেকে অনেকবার প্রশ্ন করেছ? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল সিয়ার্সের দৃষ্টি।
জী, স্যার, সত্যিই। আর প্রশ্নটা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। মাঝেমাঝে ভাবার চেষ্টা করেছি–
তা জবাব কি পেয়েছ?
ইতস্তত করল জয়েস, কিন্ত মাত্র এক মুহূর্তের জন্যে।
খোলাখুলি বলতে গেলে, স্যার, সেরকম প্রয়োজনের সময় আমি বোধহয় আপনাকে হতাশ করব না। কিন্তু নিশ্চিত হয়ে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপ্রাণ চেষ্টা করব, স্যার।
অর্থাৎ তুমি বলতে চাইছ, এখন পর্যন্ত ওটা ব্যবহার করার বাস্তব অভিজ্ঞতা তোমার হয়নি, তাই না?
ঠিক ধরেছেন, স্যার। তেমন প্রয়োজন পড়েনি এখনও, কথাটা জয়েস এমনভাবে বলল, যেন ক্ষমা চাইছে।
হেসে ফেললেন সিয়ার্স। ওয়ার্ডেন বললেন:
এই ছেলে বোধহয় ভাবছে, আমাদের পুরনো চাকুরি এ-ধরনের মিশনের পক্ষে খুব সহায়ক? প্রাচ্য ভাষার অধ্যাপক! আর আপনার কি মনে হয়–অশ্বারোহী বাহিনীর অফিসার!
আমি ঠিক তা বোঝাতে চাইনি, স্যার, চরম অস্বস্তিতে তোতলাতে শুরু করল জয়েস।
আমাদের এই ফোর্স ৩১৬ এমন একটা প্রতিষ্ঠান, বললেন সিয়ার্স, যেখানে অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট বা প্রাক্তন অশ্বারোহী অফিসারও মিশন নিয়ে যেতে পারে–সুতরাং যদি তারা পারে, একজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনার পারবে না কেন?
ওকে নিয়ে নিন, ইন্টারভিউ শেষে জয়েস বিদায় নেয়ার সাথে সাথে বললেন ওয়ার্ডেন।
সুতরাং মিশনের প্রথম থেকেই সিয়ার্স মনে মনে খুশি। জয়েসের মত একজন বাস্তববাদী ছেলেরই প্রয়োজন ছিল তার। বেশির ভাগ মানুষ নিজেকে হয় ওভারএস্টিমেট নয়তো আভার এস্টিমেট করে। তাই জয়েসকে পেয়ে সত্যিই তিনি খুশি। আর, প্রফেসর ওয়ার্ডেনের যোগ্যতার তো প্রশ্নই উঠতে পারে না।
ম্যাপে প্রত্যেকটা সেতু দেখিয়ে সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিতে শুরু করল জয়েস। মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন সিয়ার্স আর ওয়ার্ডেন। পাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশন কোম্পানির সদস্য মাত্রেরই সেতুর ব্যাপারে একটা আলাদা আগ্রহ আছে।
এসব সেতুর বর্ণনা আমরা শুনতে চাইনি, জয়েস, বললেন সিয়ার্স। আমাদের প্রয়োজন সত্যিকারের বড় টার্গেট।
আমি শুধু ওগুলোর উল্লেখ করেছি, স্যার, স্মৃতিটা একটু ঝালিয়ে নেয়ার জন্যে। যতদূর মনে হচ্ছে, আমাদের প্রয়োজন মেটাবার উপযুক্ত টার্গেট এখানে আছে মাত্র তিনটে।
জয়েস ঠিকই বলেছে, মন্তব্য করলেন ওয়ার্ডেন। গুরুত্বপূর্ণ সেতু এখানে মাত্র তিনটেই আছে। একটা ক্যাম্প থ্রী-র কাছে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, ওটা আমাদের বাদ দিতে হবে, বললেন সিয়ার্স। সেতুটার আশপাশ একেবারে ফাঁকা। তা ছাড়া, অঞ্চলটা সমতল। নিচু তীর। সহজেই মেরামত করে নিতে পারবে আবার।
আরেকটা ক্যাম্প টেন-এর পাশে।
টার্গেট হিসেবে এটা মন্দ নয়। কিন্তু জায়গাটা বার্মায়, স্থানীয় অধিবাসীদের কোনও সাহায্য পাব না। তা ছাড়া…।
তৃতীয়টা, স্যার, বলে উঠল জয়েস, খেয়াল নেই যে ঢুকে পড়েছে তার কমান্ডিং অফিসারের কথার মধ্যে, তৃতীয়টা হলো কওয়াই নদীর ওপরে। এ জায়গাটা ঝামেলামুক্ত। আশেপাশে কোনও জনবসতি নেই। পুরো অঞ্চলটাই জলে। নদীটা চারশো ফুট চওড়া, দুপাশেই খাড়া পাড়। এখান থেকে দুতিন দিনের হাঁটা পথ। সবার চোখ এড়িয়ে কাছে গিয়ে পৌঁছনো সম্ভব। সমস্ত সেতুর মধ্যে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট, চার সারি পাইল আছে।
এজেন্টের রিপোর্টগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছ মনে হচেছ, বললেন সিয়ার্স।
ওগুলো খুব পরিষ্কার, স্যার। সেতুটা মনে হয়…।
হ্যাঁ, টার্গেট হিসেবে কওয়াই সেতু উল্লেখযোগ্য, ঝুঁকে পড়লেন সিয়ার্স ম্যাপের ওপরে। নতুন হিসেবে তোমার বিশ্লেষণ খুব একটা খারাপ নয়। এই সেতু সম্বন্ধে ইতোমধ্যেই আমার কথা হয়েছে কর্নেল গ্রীনের সাথে। কিন্তু আরও তথ্য জোগাড় করতে হবে আমাদের আরও সহজে আক্রমণ করা যায়, এমন সেতুর খোঁজ মিলতে পারে। তা কথা শুনে তো মনে হলো, তুমি যেন ওটা নিজের চোখে দেখেছ–কতখানি কাজ হয়েছে ওই চমৎকার সেতুটার?
১৩.
কাজ বেশ ভালই এগোচ্ছে। ব্রিটিশ সৈন্যেরা খুব পরিশ্রমী। অফিসারের ওপর আস্থা থাকলে তারা কাজ করে চলে মুখ বুজে। সকাল হবার সাথে সাথে কাজ শুরু হয়ে যায় কওয়াই নদীর ক্যাম্পে। কয়েক দিনের মধ্যেই তারা প্রমাণ করেছে, এতদিন ইচ্ছেকৃত শয়তানি করেছে বটে, কিন্তু পরিশ্রমেও তাদের তুলনা মেলা ভার। ভুল বোঝাবুঝি দূর করার জন্যে প্রথমেই সবার উদ্দেশে একটা বক্তৃতায় কর্নেল নিকলসন পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে তিনি কী আশা করেন। তারপরেও যে দুএকজন উল্টোপাল্টা আচরণ করেছে, তাদের জন্যে হয়েছে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা।
একদিন ক্লিপটন আপত্তি জানিয়ে বললেন জানিয়ে যে, এমনিতেই বন্দীরা অপুষ্টিতে ভুগছে, এ-অবস্থায় এত খাঁটিয়ে নিলে তাদের স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি হবে।
তোমার চেয়ে আমি ওদের বেশি চিনি, জবাব দিলেন কর্নেল নিকলসন। গত তিরিশ বছর ধরে আমি দেখছিও ওদের। আলসেমি আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। আর আত্মবিশ্বাস নষ্ট হলেই ঘটে স্বাস্থ্যহানি। ওদের বসিয়ে রাখো, দেখবে, পুরো ইউনিট জুড়েই বেড়ে উঠছে একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কিন্তু সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করিয়ে নাও, মন খারাপ করার সময়ই পাবে না, রাতে ঘুমোবে ভাল, স্বাস্থ্যও থাকবে চমকার।
নিজের কাজ নিয়ে সুখে থাকো! বিদ্রুপ ফুটল ক্লিপটনের গলায়। এটাই জেনারেল ইয়ামাসিতার আদর্শ।
আদর্শটা কিন্তু খারাপ নয়, ক্লিপটন। শত্রুরও কোনও আদর্শ যদি ভাল হয়, সেটা নির্দ্বিধায় আমাদের গ্রহণ করা উচিত। ওদের হাতে কাজ না থাকলে নতুন কাজ আমি আবিষ্কার করতাম। আপাতত আমাদের নির্মাণ করতে হবে সেতুটা।
কোনও কথা খুঁজে না পেয়ে শেষমেশ ক্লিপটন বললেন:
হ্যাঁ, সেতুটা তো আমাদের নির্মাণ করতেই হবে।
জাপানী সৈন্যেরা এমনিতেই কঠোর পরিশ্রমী, তার ওপর কর্নেল সাইতো আবার হুমকি দিয়ে রেখেছেন যে শ্রমিক হিসেবে জাপানীরা বিট্রিশদের চেয়ে দক্ষ, যে কোনও মূল্যে এটা প্রমাণ করতে হবে। ফলে দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল নতুন রেললাইন বসানোর কাজ, বাসযোগ্য কুটির তৈরি হলো নতুন ক্যাম্পে। আর ঠিক এই সময়েই সূক্ষ্ম দুএকটা সংশোধন সেরে ফাইনাল প্ল্যানটা রীভত্স তুলে দিলেন মেজর হিউজেসের হাতে।
শ্রমিকদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে দিলেন হিউজেস। একদল গাছ কাটল, আরেক দল তক্তা বানাল, অন্য আরেকটা দল তৈরি করল বীম। সবচেয়ে বড়ো দলটা নিযুক্ত রইল পাইল পোঁতার কাজে। এ ছাড়াও কেউ কেউ ভারা বাঁধল, জিনিসপত্র জোগান দিল বা রক্ষণাবেক্ষণ করল যন্ত্রপাতির।
যাবতীয় কাজের মধ্যে পাইল পোতাটাই সবচেয়ে ক্লান্তিকর। দড়াম করে জেহ্যামার পড়ল, লোহার মত শক্ত মাটিতে পাইল ঢুকে গেল এক ইঞ্চির কয়েক ভাগের এক ভাগ, দড়ি বা পুলি দিয়ে টেনে তোলা হলো জেহ্যামার, আবার পড়ল দড়াম করে। জাপানীদের বিস্মিত চোখের সামনে চার সারি পাইল পানির ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল বাম তীরের দিকে।
হিউজেসের সযত্ন তত্ত্বাবধানে সেতুর কাজ এগোতে লাগল অঙ্কশাস্ত্রের নির্ভুলতায়।
কাজের অগ্রগতিতে কর্নেল নিকলসন সন্তুষ্ট। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হয়, সেটা যেন জন্ম নিচ্ছে প্রকৃতির কোল থেকে।
সেতুর দিকে তাকিয়ে গর্বিত বোধ করলেন ক্যাপ্টেন রীভস। থাইল্যান্ডের এই জঙ্গলের মাঝে অসাধারণ সেতুটাকে রূপ নিতে দেখে মনে হয়, তাঁর এতদিনের কঠোর পরিশ্রম তা হলে বৃথা যায়নি!
প্রতিদিনের অগ্রগতি দেখে অভিভূত হয়ে যান কর্নেল সাইতো। প্ল্যানের কিছুই বোঝেন না তিনি, ফলে অগ্রগতিটা মনে হয় জাদুর মত। অনেক বিতৃষ্ণা সত্ত্বেও মনে মনে ব্রিটিশ সৈনিকদের প্রশংসা না করে পারেন না।
ক্লিপটনও অভিভূত হন সেতুর কাজে। কর্নেল নিকলসনকে উপহাস করায় মনে মনে ভীষণ অনুতপ্ত হন তিনি, ক্ষমা চান নিঃশব্দে। নিজের সম্বন্ধে অযথা উচ্চ ধারণা পোষণ করেন তিনি, আসলে অনেক জিনিসের প্রায় কিছুই বোঝেন না। বন্দীদের স্বাস্থ্যহানি তো দূরের কথা, এমনকি যারা পাইল বসানোের মত বিশ্রী কাজ করছে, তাদের মধ্যেও ছড়িয়ে রয়েছে উৎফুল্ল একটা ভাব। না, অযথাই প্রত্যেকটা জিনিস বোেঝার ভান করেন তিনি।
প্রতিদিন কওয়াই সেতু হচ্ছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর, সুন্দর থেকে সুন্দরতর। দেখতে দেখতে ওটা পৌঁছে গেল নদীর মাঝামাঝি, আরও এগিয়ে গেল একসময়। সবাই বুঝতে পারছে, জাপানী হাই কমাভের নির্ধারিত তারিখের আগেই শেষ হয়ে যাবে সেতুর কাজ। তারপর যথাসময়ে একদিন এগিয়ে যাবে বিজয়ী বাহিনী।
চোদ্দ ঢকঢক করে মদের গ্লাসটা সাবড়ে দিল জয়েস। দুঃসাধ্য অভিযানের চিহ্নমাত্র তার চেহারায় নেই। থাইদের ছদ্মবেশ সে এতই নিখুঁত নিয়েছে সিয়ার্স আর ওয়ার্ডেনের পক্ষেও তাকে চেনা কঠিন হয়ে উঠেছিল। এই মুহূর্তে অভিযানের বর্ণনা দেয়ার জন্যে অস্থির হয়ে পড়েছে সে।
টার্গেটটা সত্যিই বড়, স্যার। ব্যাপারটা অবশ্য খুব সহজ হবে না, কিন্তু অসম্ভবও নয়–তবে টার্গেটটা সত্যিই বড়। চারপাশে ঘন জঙ্গল। নদীটাও চওড়া। তীরদুটো খাড়া সেতুর সাথে ট্রেন ধ্বংস করা হলে জায়গাটা পরিষ্কার করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
প্রথম থেকে শুরু করো, বললেন সিয়ার্স। নাকি গোসল সেরে নিতে চাও আগে?
আমি ক্লান্ত নই, স্যার।
ওকে সুযোগ দিন, বললেন ওয়ার্ডেন। দেখছেন না ও কথা বলতেই চায়, বিশ্রাম নয়।
সিয়ার্স হাসলেন। বলার জন্যে যেমন ছটফট করছে জয়েস, তাঁর শোনার আগ্রহও সে-তুলনায় কম নয়। সুতরাং যথাসম্ভব আরাম করে তারা বসলেন ম্যাপটার সামনে। জয়েসকে আরেক গ্লাস মদ এগিয়ে দিলেন ওয়ার্ডেন। পাশের ঘরে গ্রামবাসী পরিবেষ্টিত হয়ে অভিযানের বর্ণনা শুরু করেছে থাই দুই গাইড।
যাত্রাটা অবশ্য বেশ কঠিন, বলতে লাগল জয়েস। পুরো তিন রাত এগোতে হয় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। কিন্তু গাইড দুজন তুলনাহীন। ওরা আমাকে ঠিক নিয়ে গেল কওয়াই নদীর বামদিকের পাহাড়ে। ওখান থেকে সম্পূর্ণ উপত্যকা, ক্যাম্প আর সেটা দেখা যায়। পর্যবেক্ষণের জন্যে পাহাড়টা নিখুঁত।
আশা করি কেউ তোমাকে দেখেনি?
কোনও সুযোগই ছিল না, স্যার। আমরা হেঁটেছি শুধু রাতের বেলায়। অন্ধকার ছিল এতই গাঢ়, আমাকে হাত রাখতে হত গাইডের কাঁধে। দিনের বেলা আমরা শুয়ে কাটয়েছি ঘন ঝোপের মাঝে। কিন্তু এত সাবধানতার বোধহয় কোনও প্রয়োজন ছিল না। ওখানে পৌছার আগ পর্যন্ত একটা মানুষও আমাদের চোখে পড়েনি।
চমৎকার, বললেন সিয়ার্স। তারপর?
জয়েসকে পাঠাবার পেছনে একটা উদ্দেশ্য ছিল সিয়ার্সের। তিনি দেখতে চাইছিলেন, কোনও কাজ সম্পূর্ণ ছেড়ে দিলে ছেলেটা কিভাবে করে। হাবভাবে মনে হচ্ছে, কাজটা সে ভালভাবেই সম্পন্ন করতে পেরেছে। তা ছাড়া গাইড দুজনকেও দেখা যাচেছ ছেলেটার ওপর খুব খুশি–এটা আরেকটা ভাল লক্ষণ।
থাই গাইডেরা ভুল বলেনি, স্যার। টার্গেটটা সত্যিই বিরাট।
ক্রমেই এগিয়ে আসছে জিরো আওয়ার। ম্যাপ দেখে দেখে বার্মা-থাইল্যান্ড রেলওয়ের কোথায় কতখানি অগ্রগতি হচ্ছে, তা চিহ্নিত করে রাখছে জয়েস। কনস্ট্রাকশনের কাজগুলো চিহ্নিত করে রাখছেন ওয়ার্ডেন।
যতই তথ্য আসছে, ততই তাদের আগ্রহ বাড়ছে কওয়াই সেতুর প্রতি। সহজে আক্রমণ করা সম্ভব, এমন আরও অনেক সেতু নিয়ে আলোচনা করেছেন তাঁরা। কিন্তু ক্রমে ক্রমে সমস্ত মনোেযোগ গিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছে কওয়াই সেতুর ওপর। বড় টার্গেট হিসেবে এতদিন যা ছিল স্রেফ আবছা একটা ধারণা, ধীরে ধীরে যেন তা রূপ নিচ্ছে চরম বাস্তবে।
এই কাজ রয়্যাল এয়ারফোর্সের নয়, একদিন বললেন সিয়ার্স। আকাশ থেকে কাঠের এত বড় একটা সেতু ধ্বংস করা কঠিন। বোমা পড়ে হয়তো বড়জোর দুতিনটে আর্চ নষ্ট হবে। সামান্য বেঁকে যাবে বাদবাকিগুলো। চোখের পলকে সেসব মেরামত করে ফেলবে জাপানীরা, এ-ধরনের কাজে তারা ওস্তাদ। কিন্তু বিস্ফোরক ব্যবহার করে আমরা পাইলগুলোকেই শুধু শুইয়ে দিতে পারব না, সেতুটাকে ধ্বংস করতে পারব ঠিক কোনও ট্রেন পার হবার সময়। হুড়মুড় করে ট্রেনটা পড়ে যাবে নিচে, প্রত্যেকটা বীম অকেজো হয়ে যাবে। এরকম কাও আমি আগেও ঘটতে দেখেছি। সপ্তাহের পর সপ্তাহ বন্ধ থাকে রাস্তা। ভেবে দেখো, ক্রেন আনা সম্ভব এমন সভ্য জায়গাতেই যদি এই অবস্থা হয়, এখানে ব্যাপারটা কেমন হবে? পুরো সেতুটা নতুন করে তৈরি করা ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না। তা ছাড়া বুঝতেই পারছ, যুদ্ধের সাজসরঞ্জামের ক্ষতিটা কী পরিমাণ হবে! আমি আর ভাবতে পারছি না! সমস্ত কিছু যেন দেখতে পাচ্ছি একেবারে চোখের সামনে…
ধ্বংসযজ্ঞটা কল্পনা করতে বাকি দুজনেরও কোনও অসুবিধে হলো না। জয়েস তো স্বপ্ন দেখতে লাগল ঘন ঘন। ট্রেনটা উঠে পড়েছে সেতুর ওপরে, নিচে চকচক করছে কওয়াই নদী। তার হাত প্লঞ্জারে আর দৃষ্টি সেতুর মাঝামাঝি একটা নির্দিষ্ট জায়গার ওপর নিবদ্ধ। ক্রমেই দুরত্ব কমে আসছে ট্রেন আর সেই জায়গার মধ্যে। মাত্র কয়েক ফুট, আর এক ফুট। চোখের সামনে বিশাল সেতু, নিজের অজান্তেই সে চাপ দিল প্লারে…।
একদিন উদ্বিগ্ন হয়ে সে বলল, আশা করি আমাদের আগেই এয়ারফোর্স এসে নাক গলাবে না, স্যার।
আমি তো ইতোমধ্যেই নিষেধ করে মেসেজ পাঠিয়েছি ওদের, বললেন সিয়ার্স। সুতরাং চিন্তার কিছু আছে বলে মনে হয় না।
কর্মহীন অলস দিনগুলোতে তথ্য আসে অজস্র। তার মধ্যে কোনটা সত্য আর কোনটা গুজব, বিবেচনা করতে হয় তিনজনে মিলে। কওয়াই নদীর অদূরে একটা পাহাড়ের ওপর থেকে নজর রাখছে থাই এজেন্টরা। এঞ্জিনিয়ারিংয়ের কিছুই তারা বোঝে না। কিন্তু সেটা যে সাধারণ নয়, এটা বোঝার ক্ষমতা তাদের আছে।
হায় ঈশ্বর! মাঝেমাঝে চেচিয়ে ওঠেন সিয়ার্স। এজেন্টদের কথা সত্যি হলে তো বলতে হবে, দ্বিতীয় একটা জর্জ ওয়াশিংটন সেতু তৈরি করছে ওরা। আমেরিকানদের সাথে পাল্লা দিতে চাইছে!
থাইরা বলছে, সেতুর ওপরে রেললাইনের পাশাপাশি নাকি একটা যানবাহন চলাচলের পথ আছে, দুটো ট্রাক এগোতে পারে অনায়াসে।
আগুনের মত গনগনে সূর্যের নিচে একটানা খাঁটিয়ে নেয়া হচ্ছে বন্দীদের, এবর্ণনা শুনে তিনজনের মনই ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে স্বদেশীদের দুর্দশার কথা ভেবে।
ওরা যদি আমাদের কথা জানতে পারত, স্যার, বললেন জয়েস একদিন। যদি জানতে পারত এই সেতু জাপানীদের কোনও কাজেই লাগবে না, হয়তো বেড়ে যেত ওদের মনোবল।
হয়তো, জবাব দিলেন সিয়ার্স, কিন্তু ওদের সাথে যোগাযোগ আমরা করতে পারি না। প্রশ্নই ওঠে না, জয়েস। মিশনে নিরাপত্তার চেয়ে বড় আর কিছু নেই। যোগাযোগ করলে আমাদের সাহায্য করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠবে ওরা, নিজে থেকেই সেতু ধ্বংসের চেষ্টায় লেগে পড়াও বিচিত্র নয়। স্বাভাবিকভাবেই বিপদের গন্ধ পাবে জাপানীরা, যার ফলাফল হবে মারাত্মক। না, যোগাযোগের ঝুঁকি নেয়া কোনমতেই সম্ভব নয়। জাপানীদের সন্দেহের সম্ভাবনাও আমরা জাগাতে চাই না। একদিন হঠাৎ অবিশ্বাস্য তথ্যগুলোর সত্যতা যাচাই করার ইচ্ছে হলো সিয়ার্সের।
আমাদের মধ্যে একজনকে যেতে হবে ওখানে। যে-কোনও দিন শেষ হয়ে যাবে ওদের কাজ, সুতরাং শুধু এজেন্টদের ওপর নির্ভর করে থাকা চলবে না। তুমিই যাও, জয়েস। আমি জানতে চাই সেতুটা ঠিক কেমন, বুঝেছ? কত বড়? পাইল কতগুলো আছে? সঠিক সংখ্যা চাই। কীভাবে পৌছা যাবে সেতুর কাছে? নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন? আক্রমণ করার সম্ভাবনা কতটুকু? তবে যা-ই করো, খুব সাবধানে। কিছুতেই যেন তোমার উপস্থিতি ফাঁস হয়ে না পড়ে। ঈশ্বরের দোহাই, সেতুটা সম্বন্ধে আমাকে কিছু দরকারী তথ্য এনে দাও।
১৫.
বিনকিউলার দিয়ে সেতুটা পরিষ্কার দেখেছি, স্যার, ঠিক এখন যেমন দেখছি আপনাকে।
প্রথম থেকে শুরু করো, অধৈর্য জয়েসকে বাধা দিলেন সিয়ার্স। কিভাবে রওনা দিলে তোমরা?
এক রাতে দুই গাইডের সাথে রওনা দিল জয়েস। আফিম আর সিগারেট চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকায় দুজনেই এরকম নৈশ অভিযানে পুরোপুরি অভ্যস্ত। ওদের মতে, যে পথটা ওরা ব্যবহার করবে, সেটা সম্পূর্ণ নিরাপদ কি সঙ্গে কোনও ইউরোপিয়ান থাকাটা মোটেই নিরাপদ নয়। তাই বিশেষভাবে তৈরি বাদামী একটা রঙ জয়েস মেখে নিল শরীরে।
জঙ্গলের আসল শত্রু হলো মশা আর সেঁক। যতবার সে হাত দিল শরীরে, দেখল, জোক লেপটে আছে যেখানে সেখানে। আপাতত এই যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পাবার কোনও উপায় নেই ভেবে সে যথাসম্ভব ভুলে থাকতে চাইল ওগুলোর উপস্থিতি।
যাত্রাটা কঠিন ছিল?
বেশ কঠিন, স্যার। আগেই তো বলেছি, অন্ধকারের জন্যে একটা হাত রাখতে হত গাইডের কাঁধে। আর রাস্তা এতই খারাপ, নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব!
তিন রাত ধরে তারা কখনও পাহাড়ে উঠল, কখনও নামল, কখনও আবার এগিয়ে চলল পাথুরে নদীর তীর ধরে। মাঝেমাঝে পথরোধ করে দাঁড়াল পচা বুনো লতাপাতার গাদা, ওগুলোতে শরীর ঠেকা মাত্র ঝাপিয়ে পড়ল অজস্র জোক। হটা চলল একটানা। পুবের আকাশে ভোরের আলো ফুটতে তারা আত্মগোপন করল ঝোপে। ক্লান্তিমোচনের জন্যে কোনও গাছের নিচে বসে হুকো টানতে থাকল থাই দুজন রাত নামার আগ পর্যন্ত।
এত কষ্টের মধ্যেও শরীর চাঙ্গা রাখার খাতিরে ঘুম নষ্ট করল না জয়েস। ভোরে হাটা বন্ধ হবার সাথে সাথে তার প্রথম কাজ জোকগুলোর হাত থেকে রেহাই পাওয়া। কিছু কিছু জোক এতই রক্ত খায় যে খসে পড়ে আপনাআপনি। বাদবাকিগুলোর গায়ে ঠেসে ধরতে হয় সিগারেটের আগুন, খুলে পড়লেই পাথরের বাড়ি। আেঁকমুক্ত হয়ে দ্রুত সেদ্ধ ভাত আর মাংসের তরকারি খেয়ে নেয় জয়েস, তারপর মাটিতে শতরঞ্জি পেতে সোজা ঘুম। কিন্তু শান্তি খুব বেশিক্ষণ অব্যাহত থাকে না, গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে পিপড়ের দল।
শরীর থেকে ফোটায় ফোটায় পড়ে যে রক্তগুলো জমাট বেঁধে যায়, তার আকর্ষণেই ওরা আসে কালো আর লাল লম্বা সারি ধরে। স্পর্শেই জয়েস বুঝতে পারে কোটা কোন্ জাতের পিপড়ে, চোখ মেলার প্রয়োজন পড়ে না। লালগুলো কামড় অসহ্য, উঠে অন্য জায়গায় চলে যেতে হয়। কালোগুলো অত খারাপ নয়। কামড়ায় না, সুড়সুড়ি দেয় এখানে সেখানে।
দিন ফুরিয়ে একসময় আবার নামে রাত। পাহাড় ভাঙতে ভাঙতে হঠাৎ মনে হয় জয়েসের, তার এই অভিযানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে পুরো অপারেশনের সাফল্য।
তারপর একদিন বড়, খাড়া একটা পাহাড় পেরোতেই হঠাৎ তার চোখের সামনে ভেসে উঠল কওয়াই সেতু। রাতে একটু দেরি করে রওনা দেয়ায় অবজারভেশন পোস্টের কাছে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সূর্য উঠে পড়ল আকাশে। প্রথমটায় সেতু ছাড়া ক্যাম্প, জাপানী সৈন্য বা কর্মরত বন্দী–এসবের কোনও কিছুই জয়েসের চোখে পড়ল না।
সেতুটা পরিষ্কার দেখেছি, স্যার, ঠিক এখন যেমন দেখছি আপনাকে। থাইরা বাড়িয়ে বলেনি। টার্গেটটা সত্যিই বিরাট। গড়নটা নিখুঁত। জাপানী কোনও সেতুর সাথে ওটার মিল নেই। স্কেচ করে এনেছি কয়েকটা, এই যে।
স্বপ্নে যেমন দেখত জয়েস, তার সাথে খুব পার্থক্য নেই সেতুটার। পানি চকচকে নয়, বেশ ঘোলা। স্বপ্ন আর বাস্তবের এই দূরত্বে প্রথমটায় একটু আহত হলো সে। পরক্ষণেই ভাবল, ঘোলা পানি তাদের কাজে হয়তো বেশ কিছু সুবিধেই করে দেবে।
পুরো দুদিন ধরে বিনকিউলার দিয়ে চারপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সে। মনে মনে ঠিক করে নিল আক্রমণের সম্ভাব্য পরিকল্পনা। এ ছাড়া নোট নিল, স্কেচ করল ঝোপের মাঝে ছড়িয়ে থাকা পথ, ক্যাম্প, জাপানীদের কুটির, নদীর বাঁক, এমনকি এখানে-সেখানে মাথা উঁচিয়ে থাকা বড় বড় পাথরের।
স্রোত খুব তীব্র নয়, স্যার। পানি ঘোলা। ছোট একটা নৌকো নিয়ে কিংবা ভাল সাঁতারু হলে এই নদী অনায়াসে সাঁতরে পার হতে পারবে। মটর চলাচলের একটা পথ আছে ওপরে, পাইল আছে চার সারি। জেহ্যামার দিয়ে ওগুলো পুঁতছে ব্রিটিশ বন্দীরা পাইলগুলো পৌঁছে গেছে বাম তীরের কাছাকাছি। আমার মনে হয়, আর এক মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে সেতুর কাজ। মূল কাঠামোটা
এত তথ্য নিয়ে এসেছে জয়েস, গুছিয়ে বলা অসম্ভব হয়ে উঠল তার পক্ষে। কিন্তু সিয়ার্স কোনও বাধা না দিয়ে তাকে বলে যেতে দিলেন নিজের মত।
মূল কাঠামোটা দেখলেই বোঝা যায়, প্ল্যানটা ওস্তাদ লোকের কাজ। আমার মনে হয়, পানির নিচ দিয়ে পাইলগুলোর কাছে যাওয়াই ভাল। পানি ঘোলা থাকায় বিস্ফোরকগুলো কারও নজরে আসবে না। পুরো সেতুটাও ধসে পড়বে একসাথে।
চার সারি পাইল, বিড়বিড় করে বললেন সিয়ার্স। বুঝতেই পারছ, কাজটা খুব সহজ নয়। ওরা এই সেতুটা আবার অন্যগুলোর থেকে অত আলাদা করল কেন?
এক পাইল থেকে আরেকটার দূরত্ব কতখানি? সঠিক হিসেবটা জানতে চান ওয়ার্ডেন।
দশ ফুট।
এরপর সেতু ধ্বংসের জন্যে মনে মনে একটা হিসেব শুরু করে দিলেন সিয়ার্স আর ওয়ার্ডেন।
শেষমেশ ওয়ার্ডেন বললেন, যথেষ্ট সময় লাগবে।
কাজটা আমরা এক রাতেই সারতে পারব, স্যার, আমি নিশ্চিত। একবার সেতুর নিচে গিয়ে পৌঁছতে পারলে আর কোনও চিন্তা নেই। গা ঢাকা দেয়ার পক্ষে সেতুটা যথেষ্ট চওড়া। তা ছাড়া পানি যেভাবে আছড়ে পড়ছে পাইলগুলোর ওপর, তাতে অন্য সমস্ত শব্দ ঢাকা পড়বে। আমি ভালভাবেই জানি।
সেতুর নিচে গেলে কি হবে, সেটা তুমি জানলে কিভাবে? কৌতূহল ফুটে উঠল সিয়ার্সের চোখে।
এক সেকেন্ড, স্যার। পুরো গল্পটা এখনও শেষ হয়নি। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি।
নিচে গিয়েছিলে?
না গিয়ে উপায় ছিল না, স্যার। আপনি অবশ্য খুব কাছে যেতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু সঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্যে যেতেই হলো। অবজারভেশন পোস্ট থেকে ধীরে ধীরে গিয়ে নামলাম নদীতে। গাইড দুজন আমাকে নিয়ে গেল বুনো শুয়োর চলাচলের পথ ধরে…তিনজনকেই এগোতে হলো হামাগুড়ি দিয়ে।
কতক্ষণ লাগল পৌঁছুতে?
প্রায় তিন ঘণ্টা, স্যার। আমরা রওনা দিয়েছিলাম সন্ধ্যায়। আমি চেয়েছিলাম রাত নামার পরপরই জায়গামত পৌঁছুতে। বেশ ঝুঁকির ব্যাপার হলেও নিজের চোখে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল…
সত্যিকারের প্রয়োজনে মাঝেসাঝে এরকম ইচ্ছে জাগা খুব খারাপ নয়, এক নম্বর তাকালেন ওয়ার্ডেনের দিকে। তুমি ওখানে পৌঁছুতে পেরেছ–এটাই বড় কথা।
কেউ আমাকে দেখেনি, স্যার। আমরা গিয়ে পৌঁছেছি সেতুর সিকি মাইল উজানে। ওখানে ছোট একটা গ্রাম আছে; কিন্তু সবাই ছিল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গাইড দুজনকে বিদায় করে দিলাম। তারপর আস্তে পানিতে নেমে গা ভাসালাম স্রোতে।
রাতটা পরিষ্কার ছিল? জানতে চাইলেন ওয়ার্ডেন।
মোটামুটি। আকাশে চাঁদ ছিল না; তবে কোনও মেঘও ছিল না। সেতুটা অনেক উঁচু, একটা জিনিসও ওদের চোখে পড়বে না…।
গুছিয়ে বললো, বললেন সিয়ার্স। কিভাবে এগোলে সেতুর দিকে?
চিৎ হয়ে ভেসে গেলাম, স্যার, মুখ ছাড়া পুরো শরীরই ডুবে রইল পানিতে। আমার ওপরে…
একটা কথা জেনে রাখুন, সিয়ার্স, ওয়ার্ডেন সোল্লাসে বললেন, ভবিষ্যতে এমন মিশন আবার হাতে পেলে আমার কথা ভাবতে পারেন।
সবচেয়ে আগে ভাবব নিজের কথা, জবাব দিলেন সিয়ার্স।
জয়েসের বিবরণ এতই প্রাণবন্ত যে দুই সঙ্গীই আপসোস করতে লাগলেন নিজে না যাওয়ায়।
তিন রাতের ক্লান্তিকর পদযাত্রার পর অবজারভেশন পোস্টে পৌঁছেই কথাটা দোলা দিল জয়েসের মনে। এক মুহূর্ত নষ্ট করার উপায় নেই। সেতুটা যখন একেবারে নাগালের মধ্যে, কাছে গিয়ে ওটাকে ছুঁয়ে দেখতে হবে।
চিৎ হয়ে এগোতে লাগল সে। স্রোত যে অন্যদিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সে-কথা মাথায় একবারও এল না। চোখের সামনে শুধু ফুটে রইল প্রকাণ্ড সেতুটা, যেন আকাশের গায়ে লেপটানো কালো একটা অবয়ব। যতই এগোল জয়েস, ততই সেতু হলো প্রকাণ্ড থেকে প্রকাণ্ডতর।
সেতুর নিচে গাঢ় কালির মত অন্ধকার। একটা পাইল জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ ঝুলে রইল সে। পানি বেশ ঠাণ্ডা হলেও শরীর পুরোপুরি ঠাণ্ডা হয়নি এখনও। চোখ সয়ে আসতে জয়েস দেখল, চারপাশে মাথা উঁচিয়ে আছে শুধু পাইল আর পাইল।
টার্গেটটা সত্যিই বড়, স্যার। বিস্ফোরকগুলো একটা ভেলায় করে বয়ে নিয়ে যাওয়াই সবচেয়ে ভাল। কেউ দেখতে পাবে না। আমরা থাকব পানিতে। একবার সেতুর নিচে গিয়ে পৌঁছুতে পারলে আর কোনও চিন্তা নেই। স্রোত খুব তীব্র নয়, ফলে অনায়াসেই সাঁতরানো যাবে পাইলগুলোর মধ্যে দিয়ে। তবু, যদি ভেসে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়, আমরা বেঁধে রাখতে পারব আমাদের। বীমগুলো খুব মোটা নয়, স্যার। আমি মেপে দেখেছি। পানির নিচে অল্প বিস্ফোরক ব্যবহার করলেই কাজ হবে। পানিও খুব ঘোলা, স্যার।
তবু বিস্ফোরক বসাতে হবে অনেকটা নিচে, বললেন ওয়ার্ডেন। আক্রমণের দিনে পানি পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে।
প্রয়োজনীয় কোনও কাজই জয়েস বাদ দেয়নি। দুঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সে পরীক্ষা করেছে পাইলগুলোর গভীরতা, বেড় মেপে দেখেছে একটা ফিতা দিয়ে, পারস্পরিক দূরত্বের হিসেব করেছে, এ ছাড়া কোন কোন পাইল ধ্বংস করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে নোট নিয়েছে তার। মোটকথা, আক্রমণের পরিকল্পনায় সাহায্যে আসতে পারে, এমন প্রত্যেকটা কাজই সে করেছে। দুবার মাথার ওপর থেকে ভেসে এসেছে ভারী পদশব্দ। জাপানী এক প্রহরী হেঁটে গেছে প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে। একটা পাইলের গায়ে সেঁটে অপেক্ষা করেছে সে। নিয়মমাফিক যান্ত্রিকভাবে প্রহরীটা নদীর এদিকসেদিক পরীক্ষা করেছে একটা টর্চ দিয়ে।
টার্গেটের দিকে এগোবার সময় আমাদের মাথাব্যথার একটাই কারণ হতে পারে, স্যার, যদি ওরা কোনও বাতি জ্বালে। কিন্তু একবার সেতুর নিচে গিয়ে ঢুকতে পারলেই পদশব্দ শোনা যাবে অনেক দূর থেকে। পানিতে শব্দ ভেসে আসে। অনায়াসেই তখন কোনো যাবে প্রধান কোনও পাইলের আড়ালে।
নদীটা কি গভীর? জিজ্ঞেস করলেন সিয়ার্স।
ছফুটের বেশি, স্যার। ডুব দিয়ে দেখেছি।
তুমি কি পরিকল্পনা করেছ?
আমার মতে, স্যার, অটোমেটিক্যালি ডিটোনেটেড ফগ-সিগনালের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। চার্জগুলো লুকিয়ে রাহকা সম্ভব হবে না। সমস্ত কাজটা সারতে হবে পানির নিচে। লম্বা একটা তার নদীর পাশ দিয়ে নিয়ে গিয়ে তুলতে হবে তীরে–ডান তীরে, স্যার, আর লুকিয়ে রাখতে হবে ঝোপে। লুকোনোর পক্ষে আদর্শ একটা জায়গা বেছে রেখেছি। ওখান থেকে গাছপালার ফাঁক দিয়ে প্ল্যাটফর্মটাও নজরে আসে।
ডান তীর কেন? ভ্রুকুটি করলেন সিয়ার্স। ক্যাম্প তো ওদিকেই, অবশ্য রিপোর্টে যদি ভুল না থাকে। বাম তীরই তো সুবিধে, পাহাড়ের পাশে? তোমার রিপোর্ট অনুসারে, ওই তীরটা ঘন ঝোপঝাড়ে ঢাকা। তা ছাড়া আমাদের পালাতেও হবে এদিক দিয়েই।
তা ঠিক, স্যার। কিন্তু ম্যাপটা অনেক বার দেখুন। বিরাট একটা বাঁক নিয়ে সেতু অতিক্রম করার পরপরই বেড় দিয়ে নদীর পাশ দিয়ে রেললাইন চলে গেছে তার দিকে। লাইন আর তীরের মাঝখানে জঙ্গল পরিষ্কার করায় জাগাটা বেশ কাল। ফলে দিনের বেলা ওখানে লুকিয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব। লুকোতে হলে যেতে হবে বাঁধের উল্টোদিকে, পাহাড়ের পাদদেশে। কিন্তু এতে অনেকটা তাকে প্রয়োজন পড়বে, স্যার। তা ছাড়া রেললাইন অতিক্রম করার সময় তারটা লুকোনোও কঠিন, যদি না প্রচুর কাঠখড় পোড়ানো হয়।
পরিকল্পনাটা খুব পছন্দসই নয়, বললেন এক নম্বর। বাম তীর নয় কেন, সেতুর উজানে?
তীরটা খুব উঁচু, স্যার, তা ছাড়া একদম খাড়া। আর সামান্য এগোলেই পাওয়া যাবে ছোট সেই গ্রামটা। সমস্ত জায়গাটা ঘুরে দেখে এসেছি আমি। নদী পার হয় অতিক্রম করেছি রেললাইন। তারপর প্রহরীর চোখে ধূলো দেয়ার জন্যে ফিরে এসেছি ফিরে এসেছি বাঁক নিয়ে। ওদিক দিয়ে কোনমতেই হবে না, স্যার। এ-কাজের জন্যে একমাত্র উপযুক্ত না হলে ডান তীর।
হায় ঈশ্বর! বললেন ওয়ার্ডেন। তুমি নিশ্চয় সারাটা রাতই সেতুর চারপাশে ধুরে বেড়িয়েছ।
তা ঠিক। কিন্তু প্রথম ঊষার আলো ফুটতেই ঢুকে পড়েছি জঙ্গলে আর ভোরে পৌঁছেছি অবজারভেশন পোস্টে।
যে ছেলেটে ডান তীরে থাকবে, তার কথা কিছু ভেবেছ? জানতে চাইলেন সিয়ার্স। সে পালবে কিভাবে।
ভাল একজন সাঁতারু তিন মিনিটেই পার হয়ে যাবে নদীটা। আমার তা-ই লেগেছে স্যার। তা ছাড়া বিস্ফোরণের শব্দ জাপানীদের মনোযোগ সরে যাবে অন্যদিকে। পাহাড়ের পাদদেশে একটা দল বসিয়ে দিলে ওকে সাহায্য করতে পারবে পালাবার ব্যাপারে ফাঁকা জায়গাটা পার হয়ে হয়ে রেললাইনের এপারে আসতে পারলেই ও সম্পূর্ণ নিরাপদ। কোনও সার্চ পার্টির ক্ষমতা নেই ওকে জঙ্গলের ভেতর থেকে খুঁজে বের করে।
জয়েসের ম্যাপের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন সিয়ার্স।
প্ল্যানটা মন্দ নয়, বললেন তিনি অবশেষে। জায়গাটায় তুমি নিজে গেছ সুতরাং তুমিই সবকিছু ভাল বুঝবে। ঝুঁকি আছে, তবে ঝুঁকি নেয়ার মতই টার্গেট। এবার বলো, অবজারভেশন পোস্ট থেকে আর কি কি তুমি দেখলে।
আগের পর্ব :
০১-০৫. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানুষের মধ্যে যে অনতিক্রম্য ব্যবধান
০৬-১০. কাজের অগ্রগতির প্রশ্ন
পরের পর্ব :
১৬-২০. সারারাত না ফেরায় উদ্বিগ্ন
২১-২৫. কওয়াইয়ের কলধ্বনি