০৬-১০. কাজের অগ্রগতির প্রশ্ন
০৬.
কাজের অগ্রগতির প্রশ্ন তুলে কর্নেল নিকলসন সাইতোর বড় নাজুক জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছিলেন। তার এ ধারণাও সঠিক যে, প্রয়োজনের কাছে জাপানীদের শেষ পর্যন্ত হার মানতে হবে।
কাজ তো মোটেই এগোয়নি, বরং প্রাথমিক প্রস্তুতির ব্যাপারগুলো সারতে গিয়ে বন্দীরা এমন সব কাণ্ড করে রেখেছে, যেগুলো সংশোধন করতেই লেগে যাবে বেশকিছু সময়।
কমান্ডিং অফিসারের প্রতি দুর্ব্যবহার রাগিয়ে তুলেছে বন্দীদের। সে-রাগ আরও বেড়েছে তাদের ক্রীতদাসের মত খাঁটিয়ে নেয়ায়। ফলে কাজে কে কতটা গাফিতি আর ভুল করতে পারে, তারই একটা অঘোষিত প্রতিযোগিতা যেন শুরু হয়ে গেছে তাদের মধ্যে।
কোনও শাস্তিই তাদের এসব করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ছোটখাট জাপানী এঞ্জিনিয়ার প্রচণ্ড হতাশায় কেঁদে ফেলেছেন মাঝেমাঝে। বন্দীদের ওপর নজর রাখার জন্যে যে প্রহরী নিয়োগ করা হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তা ছাড়া বন্দীদের অবহেলা ধরতে পারার মত যথেষ্ট বুদ্ধিও তাদের মাথায় নেই। একবার ছোট একটা গর্ত খুঁড়তে বলা হলো বন্দীদের, প্রহরীদের সামনেই তারা প্রায় একটা জ্বালামুখ কেটে ফেলল। এঞ্জিনিয়ার এসে এই কাণ্ড দেখে পাগলের মত পেটাতে লাগলেন প্রহরী আর বন্দীদের। প্রহরীরা বুঝতে পারল তাদের বোকা বানানো হয়েছে আরেকবার, কিন্তু ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে ততক্ষণে।
একবার বন্দীদের দেয়া হলো গাছ কাটার কাজ। বেছে বেছে সবচেয়ে। বাকাচোরা আর ভঙ্গুর গাছ কেটে আনতে লাগল তারা; অথবা অনেক পরিশ্রম করে এমন প্রকাণ্ড একটা গাছ কাটল, নদীতে পরে যেটা হারিয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে; অথবা সারা জঙ্গল খুঁজে কেটে আনল পোকায় খাওয়া গাছ।
প্রত্যেকদিন অন্তত একবার তদারকি করতে আসেন সাইতো। এসব কাণ্ড দেখে রেগে আগুন হয়ে যান, আরেক দফা শাস্তির ব্যবস্থা হয় বন্দীদের। অকথ্য গালি খেয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় এঞ্জিনিয়ারের। পরিষ্কার জানিয়ে দেন, শয়তানের দল নিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। ক্ষতি করার সময় যে বন্দীরা হাতেনাতে ধরা পড়ল, গাছের সাথে বেঁধে তাদের পেটানো হলো কাঁটার ডাল দিয়ে, তারপর ন্যাংটো করে ফেলে রাখা হলো প্রখর সূর্যের নিচে। সন্ধ্যায় তাদের বয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে ক্লিপটনের হাসপাতালে। সারা শরীর জুলে পুড়ে যাচ্ছে, অনেক জায়গা ফুলে উঠেছে পিপড়ের কামড়ে, পিঠে দগদগে ক্ষত। দুপায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই তাদের আবার লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে কাজে।
সৈন্যগুলোর শাস্তি গ্রহণ করার ক্ষমতা দেখে যেমন বিস্মিত হলেন ক্লিপটন, তেমনি চোখে পানি এসে গেল তাদের দুর্দশা দেখে।
কোনও শাস্তিই তাদের দমাতে পারল না। কর্নেল নিকলসন তাদের সামনে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যার ফলে এসব শাস্তি তাদের কাছে যেন তুচ্ছ হয়ে গেছে।
শাস্তি দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে এবং নতুন শাস্তি উদ্ভাবন করতে ব্যর্থ হয়ে নানারকম প্রতিশ্রুতি দিতে লাগলেন সাইতো। কিন্তু সে-প্রলোভনে বন্দীরা ভুলল না।
একদিন বেশি খাটুনি হয়ে যাচ্ছে, এই দোহাই দিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ বন্ধ করে দিলেন সাইতো। সবার মধ্যে বিতরণ করা হলো চালের পিঠে আর ফল। সাইতো বললেন, অফিসাররা পাশাপাশি হাত লাগালে তাদের কাজ কত সহজ হয়ে যেত সেটা তিনি বোঝেন। আর এজন্যে অফিসারদের ওপর তাদের মনে কিরকম ঘৃণা জন্মেছে, সে-কথা জানতেও তাঁর বাকি নেই। তাই সবদিক বিবেচনা করে সহানুভূতিশীল হয়ে তিনি এসেছেন তাদের কাজের বোঝা কমিয়ে দিতে। এঞ্জিনিয়ার দেড় ঘনগজ বললেও আজ থেকে তাদের সবাইকে মাটি কাটতে হবে এক ঘনগজ করে।
এরকম ওকালতি করা সত্ত্বেও পরদিন দেখা গেল, মাথাপিছু দেড় ঘনগজ বা তারও কিছু বেশি মাটি কেটেছে বন্দীরা।
ক্রমাগত প্রতিরোধের মুখে শেষমেশ হাল ছেড়ে দিলেন কর্নেল সাইতো। অবশ্য ঘটনার একদিন আগেও কোণঠাসা জানোয়ারের মত তিনি ছুটে বেড়ালেন ক্যাম্পের আশেপাশে। এমনকি ক্যাপ্টেনের নিম্নপদস্থ তরুণ অফিসারদের বললেন তাদের ইচ্ছেমত কাজ বেছে নিতে, লোভ দেখালেন নানা সুযোগসুবিধে আর বাড়তি রেশনের। কিছুতেই কিছু না হওয়ায় এবং অচিরেই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। একটা জাপানী পরিদর্শক দল আসার কথা থাকায় আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনও পথ তিনি খুঁজে পেলেন না।
১৯৪২ সালের ৭ ডিসেম্বর কর্নেল নিকলসনের সাথে দেখা করে তিনি জানালেন, অফিসারদের আর মজুরদের মত কায়িক পরিশ্রম করতে হবে না, প্রতিদানে তারা নিশ্চয় সাধারণ সৈন্যদের কাজ ভালভাবে তদারক করবে।
কর্নেল নিকলসন জবাব দিলেন, যথাসাধ্য চেষ্টা তিনি করবেন। যেহেতু পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে সংবিধান অনুসারে, শত্রুপক্ষের কর্মসূচীতে বাধা দেয়ার আর কোনও কারণ থাকতে পারে না। বলা বাহুল্য, পৃথিবীর সমস্ত সভ্য সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈন্যদের যাবতীয় কাজকর্মের জন্যে অফিসারেরা দায়ী থাকেন।
সেদিন রাতে বিজয়োৎসব পালিত হলো ব্রিটিশ ক্যাম্পে। ওই একই রাতে প্রতিদিনের চেয়ে অনেক আগে নিজের ঘরে ঢুকে চুপিচুপি কাঁদতে লাগলেন কর্নেল সাইতো, তারপর বোতলের মাঝে সান্ত্বনা খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে লুটিয়ে পড়লেন বিছানায়।
০৭.
কর্নেল নিকলসন তাঁর দুই উপদেষ্টা মেজর হিউজেস আর ক্যাপ্টেন রীকে নিয়ে গেলেন কওয়াইয়ের তীরে।
হাঁটছেন তিনি খুব ধীরে ধীরে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। কারণ, অন্যায় শাস্তি দেয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে নিজের এবং অফিসারদের জন্যে চার দিন ছুটি নিয়েছেন। আরও দেরির কথা ভেবে হাত মুষ্টিবদ্ধ করেছেন কর্নেল সাইতো, কিন্তু ছুটি দিয়েছেন শেষমেশ। শুধু তা-ই নয়, নির্দেশ প্রচার করেছেন যেন কেউ কখনও বন্দীদের সাথে দুর্ব্যবহার না করে।
শুধু শারীরিক শক্তি ফিরে পাবার জন্যেই ছুটি নেননি কর্নেল নিকলসন। কাজটা কিভাবে করা যায়, এই চারদিন সেটা ভাবতে চান ঠাণ্ডা মাথায়, পরামর্শ করতে চান উপদেষ্টাদের সঙ্গে। না ভেবেচিন্তে কোনও কাজ করার চেয়ে ঘৃণার আর কিছু নেই কর্নেলের কাছে।
সৈন্যরা ইচ্ছেকৃত যেসব ভুল করেছে, সেগুলো খুঁজে পেতে খুব একটা দেরি হলো না তার। হিউজেস আর রীভস সেগুলো দেখে চিৎকার করে উঠলেন নিজেদের অজান্তেই।
রেললাইনের উপযুক্ত একটা বাধই হয়েছে বটে! বললেন হিউজেস। সত্যি, স্যার, শয়তানগুলো যেসব কাণ্ডকারখানা করেছে তা বাঁধিয়ে রাখার মত। ওই রেললাইনের ওপর দিয়ে ভারী অ্যামুনিশন ট্রেন যাচ্ছে, ব্যাপারটা একবার ভাবুন তো!
গম্ভীর হয়ে রইলেন কর্নেল।
চমৎকার কাজ, স্যার, বললেন ক্যাপ্টেন রীভস। পাগল ছাড়া ওই আঁকাবাঁকা জায়গার ওপর কেউ রেললাইন বসাতে চাইবে না।
মুখভাবের কোনও পরিবর্তন হলো না, কর্নেল জানতে চাইলেন:
টেকনিশিয়ান হিসেবে তোমার কি মত, রীভস, ওটা কোনও কাজে লাগানো যাবে?
মনে হয় না, স্যার, জবাব দিলেন রীভস। জায়গাটা বাতিল করে দিয়ে লাইনটা সামান্য ওপরের দিকে নিয়ে যাওয়া উচিত।
মাথা নাড়াতে নাড়াতে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন কর্নেল। কোনও মতামত প্রকাশ করার আগে পুরো জায়গাটা তিনি ঘুরে দেখতে চান।
জনা পঞ্চাশেক বন্দীর একটা দল কাজ করছে নদীর কাছে। কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে একজন প্রহরী পায়চারি করছে তাদের সামনে দিয়ে। কয়েকজন দূরে মাটি খুঁড়ছে, সেই মাটি বাঁশের ঝুড়িতে করে বয়ে এনে ফেলা হচ্ছে সাদা খুঁটি দিয়ে নির্দিষ্ট করা একটা রেখার দুপাশে। খুঁটিগুলো ছিল তীরের সমকোণে, কিন্তু বন্দীদের কল্যাণে এখন সেগুলো হয়ে গেছে সমান্তরাল। নদীর ওপারে আরেক দল বন্দীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি সহকারে কি যেন বোঝাচ্ছেন এঞ্জিনিয়ার।
খুঁটিগুলো কে পুঁতেছে? জানতে চাইলেন কর্নেল।
উনি, স্যার, লাফিয়ে উঠে এঞ্জিনিয়ারের দিকে আঙুল নির্দেশ করল ব্রিটিশ কর্পোরাল। তবে উনি চলে যাবার পর আমি ওখানে খানিকটা উন্নতি বিধান করেছি।
প্রহরী এদিকে তাকিয়ে না থাকায় চোখ পিটপিট করল কর্পোরাল, কিন্তু ইশারাটা কর্নেল খেয়াল করলেন না।
হুম, কণ্ঠ তার বরফের মত ঠাণ্ডা।
সামান্য এগিয়ে আরেকজন কর্পোরালের সামনে দাঁড়ালেন কর্নেল কয়েকজন বন্দীর সাহায্যে বড় বড় শেকড় বের করছে সে মাটি খুঁড়ে, কিন্তু সেগুলো তীরে নামিয়ে না দিয়ে তুপ করে রাখছে একটা ঢালের মাথায়।
আজ এই দলে কতজন কাজ করছে? জানতে চাইলেন কর্নেল।
হাঁ করে রইল প্রহরী। লাফিয়ে উঠে একটা জবাব দেয়ার চেষ্টায় তোতলাতে লাগল কর্পোরাল।
বিশ কিংবা পচিশজন, স্যার, আমি ঠিক বলতে পারছি না। আসার পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়ল একজন। কেন তা বলতে পারব না, স্যার। সকালে একদম সুস্থ ছিল। তিন-চারটে ছেলে আবার তাকে বিয়ে নিয়ে গেল হাসপাতালে। এখনও ফেরেনি। ও-ই দলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। ফলে আজকের জন্যে নির্ধারিত কাজ আমরা এখনও শেষ করে উঠতে পারিনি। মনে হয় এই রেললাইনটার ওপর কোনও অভিশাপ আছে।
একজন কর্পোরালের জানা উচিত, বললেন কর্নেল, তার অধীনে ঠিক কতজন লোক কাজ করছে। যাই হোক, মাথাপিছু কতখানি মাটি কাটতে হচ্ছে তোমাদের?
এক ঘনগজ করে, স্যার, সেগুলো আবার ফেলে দিয়ে আসতে হয় দূরে। কিন্তু এতসব শেকড়বাকড় থাকায়, স্যার, কাজটা খুব একটা সহজ নয়।
হুম, আরও ঠাণ্ডা শোনাল কর্নেলের কণ্ঠ। বিড়বিড় করতে করতে আবার পা বাড়ালেন তিনি। হিউজেস আর রীভূস্ পেছনে পেছনে।
ধীরে ধীরে তারা এসে পৌঁছুলেন একটা ঢিবির মাথায়। কওয়াই নদী এখানে একশো গজেরও বেশি চওড়া, দুদিকের তীর পানির প্রান্ত থেকে উঠে গেছে বেশ খানিকটা উঁচুতে। চারপাশ খুঁটিয়ে দেখে কর্নেল ফিরলেন তাঁর উপদেষ্টাদের দিকে।
এই জাপানীরা, কিছুদিন আগেও একেবারে বুনো ছিল। ওরা আমাদের পদ্ধতিগুলো নকলের চেষ্টা করছে, কিন্তু সে-পদ্ধতি বোঝার ক্ষমতা ওদের নেই। স্রেফ মডেলটা নিয়ে নাও, মাথা খারাপ হয়ে যাবে। এই উপত্যকার কাজটা নিয়েই ওরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে, অথচ এটা করতে খুব বেশি বুদ্ধির দরকার নেই। পরিকল্পনা করে কাজে নামলে যে অনেক সময় বাঁচে, এটুকুও বোঝে না ওরা। তোমার কি মনে হয়, রী? রেললাইন আর সেতুর কাজ তো তোমার আওতায় পড়ে, তাই না?
আপনি ঠিকই বলেছেন, স্যার, বললেন ক্যাপ্টেন। এই ধরনের অন্তত বারোটা কাজ আমি করেছি ভারতে। এখানে যেসব যন্ত্রপাতি এবং যত লোক আছে, তার সাহায্যে যোগ্যতাসম্পন্ন একজন এঞ্জিনিয়ার এরকম একটা সেতু তৈরি করে ফেলতে পারে ছমাসেরও কম সময়ে। ওদের বোকামি দেখে আমার রক্ত শুধু টগবগ করে ফুটছিল।
হ্যাঁ, সায় দিলেন হিউজেস। মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমারও। ওদের প্রত্যেকটা বোকামি চোখে পড়তেই মনে হচ্ছিল চিৎকার দিয়ে উঠি। ভাবতে যত সহজ আসলে তো আর তত
আর আমি? বলে উঠলেন কর্নেল। ওদের কাজে খুশি হয়েছি ভেবেছ? আজ সকালে যা যা দেখলাম, তাতে আমি রীতিমত আতঙ্কিত।
তো, স্যার, হাসলেন রীভস, এই রেললাইনের ওপর দিয়ে যদি ওরা ট্রেন নিয়ে যাবার কথা ভেবে থাকে, তা হলে ভারতের জন্যে আমাদের উদ্বিগ্ন না হলেও চলে!
আবার চিন্তায় ডুবে গেছেন কর্নেল নিকলসন, কিন্তু নীল চোখজোড়া সঙ্গী দুজনের ওপর নিবদ্ধ।
অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এগোতে হবে আমাদের। প্রথমে সৈন্যদের আনতে হবে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। অযত্নে আর অবহেলায় এরা ব্রিটিশ সৈনিকের যোগ্যতা হরিয়েছে। কিন্তু সেজন্যে এরা দায়ী নয়–কথাটা মনে রাখা দরকার। অধৈর্য না হয়ে ধীরে ধীরে আবার এদের সুশৃঙ্খল করে তুলতে হবে। জাপানীদের আমরা দেখাব, মানুষকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
এক মুহূর্ত থেমে আবার বলে চললেন কর্নেল:
সৈন্যদের ব্যাপার আমরা যথাসাধ্য বিবেচনা করব, কিন্তু তাই বলে কখনোই দুর্বলতা প্রকাশ করব না। সৈন্যদের সাথে আমি নিজে কথা বলব। এত দিন যা করার করেছে, কিন্তু আজ থেকেই ওসব বাদ দিতে হবে। নামমাত্র ছুতো দেখিয়ে কেউ অনুপস্থিত থাকতে পারবে না। যে কোনও প্রশ্ন করলে চটপটু, পরিষ্কার জবাব দিতে হবে প্রত্যেক নন-কমিশনড়-অফিসারকে। কেউ অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করলে বা অযথা রোগের অজুহাত দেখালে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে তার বিরুদ্ধে। রেললাইন এগিয়ে যাবে দিগন্তবরাবর সোজা, বাকাচোরা হবে না মোটেও–খাঁটি কথাই বলেছ তুমি, রীভস…
০৮.
কলকাতায় বসে একটা রিপোর্ট পড়ছেন ফোর্স ৩১৬-এর কমান্ডার কর্নেল গ্রীন। রিপোর্টটার মার্জিনের নিচে মন্তব্য করেছে মিলিটারি আর প্যারা-মিলিটারির গোটা ছয়েক গুপ্ত সংস্থা। ফোর্স ৩১৬, দ্য প্লাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশনস কোম্পানি লিমিটেড নামেই বেশি পরিচিত। ইতোমধ্যেই তারা সক্রিয় আগ্রহ দেখিয়েছে অধিকৃত মালয়, বার্মা, থাইল্যান্ড আর চীনের জাপানী ওঅর এস্টাবলিশমেন্টগুলোর ব্যাপারে। তাদের সাজসরঞ্জমে যে ঘাটতি আছে, সেটা তারা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে দক্ষ এজেন্টের মাধ্যমে।
এই প্রথম ওদের সবাই একমত হলো আমার সাথে, বিড়বিড় করে বললেন কর্নেল গ্রীন। সুতরাং কিছু একটা করতেই হবে।
গুপ্ত সংস্থাগুলো ফোর্স ৩১৬-এর সহযোগী হলেও সবার স্বতন্ত্র কার্যপ্রণালী রয়েছে। ফলে তাদের সিদ্ধান্তে যে প্রায়ই আকাশ পাতাল ফারাক দেখা দেয়, তা চোখে পড়ার সাথে সাথে মাথায় আগুন ধরে যায় কর্নেল গ্রীনের। কারণ, যাবতীয় অপারেশনের পরিকল্পনার দায়িত্বে আছেন তিনি স্বয়ং। নিজস্ব কার্যপদ্ধতিতে ঝামেলা না পাকানো পর্যন্ত থিয়োরেটিক্যাল আলোচনা করতেও তিনি আগ্রহী নন। সমস্ত স্টাফেরই এসব জানা আছে, যেহেতু দিনে অন্তত একবার নিজের অভিমত ব্যক্ত না করলে তিনি সুখ পান না। এ ছাড়া দিনের সিংহভাগ সময় তাঁর কাটে এসব রিপোর্ট থেকে সত্য ঘেঁকে বের করার কাজে।
খাঁটি, মহান, বিখ্যাত, এক এবং অদ্বিতীয় ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলাকে কর্নেল গ্রীন দুচোখে দেখতে পারেন না। অপারেশনাল স্টাফের কোনও সাহায্যেই আসে না এরা। অতি গোপনীয়তার দোহাই দিয়ে মহামূল্যবান দলিলপত্র এরা লুকিয়ে রাখে লোহার সিন্দুকে। বহু বছর পর যখন বের করা হয়, তখন সেগুলো কার্যকারিতা হারিয়ে বসে আছে। দলিলগুলো প্রকাশও হয় অভিনবভাবে। মরার আগে আগে স্মৃতিকথা লেখার তাগিদ অনুভব করেন ইন্টেলিজেন্সের কোনও চাই। বিস্মিত হয়ে জাতি জানতে পারে, নির্দিষ্ট কোনও দিনের নির্দিষ্ট সময়ে তাঁদের সার্ভিস কী কাণ্ডটাই না ঘটিয়েছে। তা ছাড়া শক্রর পরিকল্পনা এবং আক্রমণের ব্যাপারে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, তার তো কোনও তুলনাই নেই।
বর্তমান পরিকল্পনাটা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হওয়ায় মহাখুশি কর্নেল গ্রীন আবার পড়তে লাগলেন রিপোর্টটা।
বার্মা-ভাইল্যান্ড রেলওয়ের কাজ এগিয়ে চলেছে। মিত্রবাহিনীর ষাট হাজার বন্দীকে জাপানী শ্রম শিবিরগুলোতে রেখে খাটানো হচ্ছে জঘন্য পরিস্থিতির মধ্যে। বর্তমানে, কয়েক মাসের মধ্যে সম্পন্ন হতে পারে, এই ধরনের এমন একটা কাজ তারা হাতে নিয়েছে, যা প্রভূত সাহায্য করবে শত্রুপক্ষকে। খসড়া একটা মানচিত্র দেয়া হলো।
মুচকি হেসে আবার পড়তে লাগলেন কর্নেল গ্রীন:
থাইল্যান্ডের জনসাধারণ বিজয়ী বাহিনীর ওপর মোটেই খুশি নয়। বিশেষ করে রেলওয়ের আশেপাশের কৃষকেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। থাইল্যান্ড সেনাবাহিনীর অনেক সিনিয়র অফিসার এবং রাজপরিবারের কেউ কেউ সম্প্রতি যোগাযোগ করেছেন মিত্রবাহিনীর সাথে। বর্তমানে জাপানীদের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালানোর জন্যে তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। অসংখ্য কৃষক এব্যাপারে সাহায্য করতে এক পায়ে খাড়া। যত শিগগির সম্ভব অস্ত্রশস্ত্র আর কমান্ডার পাঠাবার অনুরোধ জানিয়েছে সবাই।
হ্যাঁ, একটা দল ওখানে অবশ্যই পাঠাব, সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন কর্নেল গ্রীন।
সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তিনি ভাবতে বসলেন, এরকম একটা অভিযানের কমান্ডার হতে গেলে তার কি কি গুণ থাকা দরকার। একের পর এক সম্ভাব্য প্রার্থীদের বাতিল করার পর তিনি ডেকে পাঠালেন মেজর সিয়ার্সকে। মাত্র যেকজন এজেন্টের জন্যে ফোর্স ৩১৬-এর সুনাম ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, তাদের মধ্যে অশ্বারোহী বাহিনীর এই প্রাক্তন অফিসারটি অন্যতম। ইউরোপে বেশ কয়েকটা শক্ত মিশন শেষ করার পর ভারতে আসতেই লম্বা একটা ইন্টারভিউ নিয়ে তাকে ফোর্স ৩১৬-এর অন্তর্ভুক্ত করে নেন কর্নেল গ্রীন। সিয়ার্স আসার পর তাঁকে যাবতীয় তথ্য দিয়ে মিশনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলেন তিনি।
সাথে জিনিসপত্র কিন্তু খুব একটা নিয়ে যেতে পারবে না, বললেন গ্রীন, যা যা প্রয়োজন পাঠিয়ে দেয়া হবে যথাসময়ে। আর অপারেশন কীভাবে চালাতে হবে, সেটা তুমি ঠিক করবে স্পটে গিয়ে। তবে আমার মনে হয়, ছোট ছোট আক্রমণ চালিয়ে নিজেদের প্রকাশ করার ঝুঁকি না নিয়ে রেললাইন বসানো শেষ হবার পর কাজটা একবারে সারাই ভাল।
অপারেশনে কি জিনিস ব্যবহার করা হবে, সেটা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। দ্য গাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড নামটার মধ্যেই রয়েছে তার পরিচয়।
প্রথমে থাইল্যান্ডবাসীদের বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে হবে সিয়ার্সকে। তারপর ট্রেনিং শুরু।
তিনজনের একটা দল হলেই চলবে তোমাদের, বললেন কর্নেল গ্রীন, অন্তত এখনকার মত। তোমার কি মনে হয়?
ঠিকই বলেছেন, সার, সায় দিলেন সিয়ার্স। আপাতত তিনজনই যথেষ্ট। বেশি লোক নিয়ে শত্রুর চোখে পড়ে যেতে চাই না।
তা হলে ওই কথাই রইল। সাথে কাকে নিতে চাও?
ওয়ার্ডেন হলে ভাল হয়, সার।
ক্যাপ্টেন ওয়ার্ডেন? মানে প্রফেসর ওয়ার্ডেন? তুমি নিশ্চয় ছোটখাট ব্যাপারে বিশ্বাসী নও, সিয়ার্স। তুমি আর ওয়ার্ডেনই আমাদের সবচেয়ে ভাল দুজন এজেন্ট।
মিশনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সার, নির্বিকারভাবে জবাব দিলেন মেজর সিয়ার্স।
হ্যাঁ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক দিক থেকে তো বটেই, এমনকী অপারেশনাল দিক থেকেও এই মিশন খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আর এই কাজে ওয়ার্ডেনই সবচেয়ে উপযুক্ত, সার। প্রাচ্য ভাষার অধ্যাপক ছিল সে। থাই ভাষাটা ভাল জানা আছে তার। ওটা খুবই কাজে লাগবে ওখানে।
বেশ, ওয়ার্ডেনকে তুমি পাবে। তৃতীয় কাকে নিতে চাও?
একটু ভাবতে হবে, সার। সম্ভবত কেবল কোর্স শেষ করা তরুণদের কাউকে। ওদের বেশ কজনকে সম্ভাবনাময় মনে হয়েছে আমার। কাল জানাব আপনাকে।
ফোর্স ৩৬১ একটা স্কুল স্থাপন করেছে কলকতায়, সেখানে ট্রেনিং দেয়া হয় তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদের।
ঠিক আছে। এই নাও ম্যাপ! আমি সম্ভাব্য গুপ্ত আশ্রয়গুলো চিহ্নিত করে রেখেছি। থাইদের ধারণা, ওসব জায়গায় লুকিয়ে থাকলে মানুষ তো দূরের কথা, কাক-পক্ষীটিও টের পাবে না। আকাশ থেকে পরিদর্শনের কাজটাও ইতোমধ্যে সেরে রেখেছি আমরা।
সিয়ার্স ঝুঁকে পড়লেন ম্যাপ আর এরিয়াল ফটোগ্রাফগুলোর ওপর। প্রত্যেকবার নতুন অভিযানে অজানা ভূখণ্ডের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ার আগে বেশ উত্তেজনা অনুভব করেন তিনি। এবার সে-উত্তেজনা আরও বাড়ল জঙ্গলাবৃত্ত পাহাড়শ্রেণী দেখে। ফোর্স ৩১৬ যেসব মিশন নির্বাচন করে, তার ধাচই আলাদা।
আত্মগোপন করে থাকার উপযুক্ত বেশ কয়েকটা জায়গা আছে, বললেন কর্নেল গ্রীন। বার্মা সীমান্তের কাছাকাছি বিচ্ছিন্ন এই ছোট্ট গ্রামটার কথাই ধরো না, ট্রেন থেকে নামার পর দুই বা তিন দিনের পায়ে হাটা পথ। স্কেচ-ম্যাপ অনুসারে রেললাইন ওখানে একটা নদী অতিক্রম করেছে–কওয়াই নদী, অবশ্য ম্যাপটা যদি ঠিক থাকে। ওখানকার সেতুটাই সম্ভবত সবচেয়ে বড়।
কমান্ডিং অফিসারের দেখাদেখি সিয়ার্সও হাসলেন এই চিন্তা করে যে, অসংখ্য সেতু ছড়িয়ে রয়েছে জায়গাটার আশেপাশে।
ওই সেতুটাই সবচেয়ে বড় কিনা, সেটা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে, সার। তবে আপাতত আমার মনে হচ্ছে, হেডকোয়ার্টারস হিসেবে জায়গাটা হবে। নিখুঁত।
ঠিক। এখন ড্রপ করতে হবে তোমাকে। তিন বা চার সপ্তাহের মধ্যে সেব্যবস্থাও হয়ে যাবে আশা করি, যদি থাইরা রাজি থাকে। প্লেন থেকে ঝাঁপ দিয়েছ কখনও?
না, স্যার। আমি ইউরোপ থেকে আসার পর কোর্সে প্যারাশুটিং যোগ করা হয়। ঝপ বোধহয় ওয়ার্ডেনও দেয়নি।
একটু থাম। এক্সপার্টেরা তোমাদের জন্যে ট্রেনিং জাম্পের ব্যবস্থা করতে পারে কিনা দেখি।
টেলিফোনটা তুলে নিলেন কর্নেল গ্রীন। রয়াল এয়ারফোর্স অফিসে জানালেন, কি তার প্রয়োজন। চুপচাপ কিছুক্ষণ কথা শুনলেন তিনি। তার মুখ দেখে মনে হলো না, খুব একটা খুশি হয়েছেন।
এটাই তা হলে আপনাদের চুড়ান্ত মতামত? জানতে চাইলেন কর্নেল গ্রীন।
জবাব শুনে জ কুঁচকে গেল তার, নামিয়ে রাখলেন রিসিভারটা। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বললেন:
এক্সপার্টদের মতামত জানতে চাও? ওরা বলল: আপনি যদি আপনার ছেলেদের ট্রেনিং জাম্প করানোর জন্যে জেদ ধরেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমরা নিতে পারি। কিন্তু দুমাসের কোর্স করার আগে এ-পথে পা না বাড়ানোই ভাল। এই ধরনের দেশে ড্রপিং মিশনের ফলাফল হয়েছে এরকম: একটা জাম্প দিলে আহত হবার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। দুটো জাম্প দিলে সে-সম্ভাবনা দাঁড়াবে আশি ভাগে। আর তিনটে জাম্প দিলে দুর্ভাগ্য এড়ানোর কোনও উপায়ই থাকবে না। সুতরাং একটা জাম্প দিয়ে সবচেয়ে ভাল ফলের আশা করাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। সব খুলে বললাম। এখন সিদ্ধান্ত নেবে তুমি।
আধুনিক সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় সুবিধে হলো, একেবারে শান্তভাবে জবাব দিলেন সিয়ার্স, আমাদের সাহায্য করার জন্যে রয়েছেন বিভিন্ন ধরনের এক্সপার্ট। সুতরাং তাদের পরামর্শ নিয়ে একটা জাম্পই দেব আমরা, আর আশা করব সবচেয়ে ভাল ফলের।
০৯.
মেজাজ মোটেই ভাল নেই তোমার মনে হচ্ছে, রীভ? বললেন কর্নেল নিকলসন রয়াল এঞ্জিনিয়ারস-এর মুখ গোমড়া করে থাকা ক্যাপ্টেনের উদ্দেশে। ব্যাপারটা কি?
আর ব্যাপার! এভাবে কাজ করা সম্ভব নয়, স্যার। কোনওমতেই না। গতকালই এ-বিষয়ে আপনার সাথে কথা বলব ভেবেছিলাম। আজ আবার আমাকে তাগাদা দিলেন মেজর হিউজেস।
ব্যাপারটা কি? কুটি করলেন কর্নেল নিকলসন।
রীভস-এর সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত, স্যার, বললেন হিউজেস। এভাবে চলতে পারে না।
কি চলতে পারে না?
অব্যবস্থা, সার। জীবনে এরকম চরম অব্যবস্থা আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা অন্য কোথাও দেখিনি। একের পর এক পরস্পরবিরোধী আদেশ দিয়ে চলেছে সবাই। মানুষ নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে এতটুকু ধারণাও জাপানীদের নেই। ওরা নাক গলালে এই কাজ কোনওদিনই শেষ হবে না।
বৃটিশ অফিসারেরা বন্দীদের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে সত্যি, কিন্তু সেটাকে কোনওভাবেই সন্তোষজনক বলা চলে না।
তোমাদের বক্তব্য ব্যাখ্যা করো। প্রথমে তুমি, রীভস।
সার, পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে বললেন ক্যাপ্টেন, আমি শুধু সবচেয়ে মারাত্মক ভুলগুলো নোট করেছি; নইলে এই তালিকা আর শেষ হত না।
বলে যাও। তোমাদের যে-কোনও যুক্তিসম্মত অভিযোেগ আমি শুনব, বিবেচনা করব যে-কোনও পরামর্শ। বুঝতে পারছি কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে।
সেটা আমাকে জানানো তোমাদের কর্তব্য।
প্রথমত, সার, সেতুটা এই জায়গায় তৈরি করার চেয়ে বোকামি আর কিছু হতে পারে না।
কেন?
জায়গাটা পানি আর কাদায় ভরা, স্যার। এরকম জায়গার ওপর সেতু তৈরির কথা কেবল এদের মত বর্বরেরাই চিন্তা করতে পারে। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, স্যার, ওপর দিয়ে একবার ট্রেন গেলেই পুরো সেতুটা ধসে পড়বে।
ব্যাপারটা সাংঘাতিক, রীভস, বললেন কর্নেল। খুব সাংঘাতিক, স্যার। আর এ-কথাই আমি বোঝাতে চাইছিলাম জাপানী এঞ্জিনিয়ারকে। এঞ্জিনিয়ারই বটে; ঈশ্বর! আনাড়িপনারও একটা সীমা থাকে! অবশ্য সয়েল রেজিস্ট্যান্স সম্বন্ধে যার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, প্রেশার টেবলের কথা শুনলে হাঁ করে থাকে, তার কাছে আর কি আশা করা যায়? তবু ধৈর্য ধরে বোঝাবার, সবরকম চেষ্টা আমি করেছি, স্যার। এমনকী ডেমনস্ট্রেশনও বাদ দিইনি। কিন্তু শুধু আমার সময়ের অপচয়। এই জলাভূমির ওপরেই সেতু বানাবে সে।
ডেমনস্ট্রেশন, রীভস? আগ্রহী হয়ে উঠলেন কর্নেল।
একেবারে সোজা, স্যার। একটা বাচ্চাও বুঝবে। পানির মধ্যে ওই পাইলটা দেখতে পাচ্ছেন, তীরের কাছে? ওটা আমি নিজ হাতে বসিয়েছি। অনেকখানি বসে গেছে ওটা, কিন্তু এখনও শক্ত তল খুঁজে পায়নি। অর্থাৎ ধীরে ধীরে আরও বসে যাবে। একটা ট্রেন এদিক দিয়ে গেলে বসে যাবে সমস্ত পাইল। এখানে দরকার কংক্রিটের ভিত, কিন্তু উপযুক্ত মালমশলা আমাদের হাতে নেই।
কর্নেলের কথায় ডেমনস্ট্রেশনটা আবার করে দেখালেন রীভূস্। মাথায় জেহ্যামার পড়তেই অনেকখানি বসে গেল পাইল।
দেখেছেন, স্যার, চেঁচিয়ে উঠলেন রীভ। যতবার মার মারবেন, বসে যেতেই থাকবে। শেষমেশ তলিয়ে যাবে পানির নিচে।
হ্যাঁ, বললেন কর্নেল। এখন কতখানি বসে গেছে পাইলটা?
নোটখাতা দেখে সঠিক জবাব জানিয়ে দিলেন রী। সেইসাথে বললেন, জঙ্গলের সবচেয়ে বড় গাছও তল খুঁজে পাবে না এখানে।
বঠিক, সন্তুষ্টির চিহ্ন ফুটে উঠল কর্নেলের মুখে। একটা বাচ্চাও বুঝবে, ঠিকই বলেছ তুমি। এই ডেমনস্ট্রেশনও এঞ্জিনিয়ারের মনে এতটুকু ছাপ ফেলেনি? আমার ফেলেছে–আর সেটাই সবচেয়ে জরুরী। তো এটার সমাধান কি?
সেতু তৈরির জায়গাটাই সরিয়ে ফেলা, স্যার। মাইলখানেক দূরে বোধহয় ভাল একটা স্পট আছে। দেখতে হবে
দেখো, বললেন কর্নেল, ভালভাবে দেখে খুঁটিনাটি জানাও আমাকে, যাতে ওদের সামনে বলতে পারি।
বিষয়টার একটা নোট নিয়ে জানতে চাইলেন কর্নেল:
আর কিছু, রীভস?
সেতুর কাজে লাগানোর জন্যে গাছ কাটা, স্যার। বড় গাছ চোখে পড়লেই কাটার নির্দেশ দিচ্ছে এঞ্জিনিয়ার। ভেবেও দেখছে না, গাছটা নরম না শক্ত, ভার বহন করার ক্ষমতা আছে কি না।
আবার নোট নিলেন কর্নেল নিকলসন।
তারপর, রীভস?
আপাতত আর কিছু নেই, স্যার। জায়গার ব্যাপারটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি নিজেই একবার দেখুন না, নদী এখানে একশো গজেরও বেশি চওড়া। তীর দুপাশেই উঁচু। সুতরাং প্ল্যাটফর্মটা হতে হবে পানি থেকে একশো ফুটেরও বেশি ওপরে, তাই না? ব্যাপারটা ছেলেখেলা নয়। অনেকবার ওঅর্কিং প্ল্যানটা দেখাতে বলেছি এঞ্জিনিয়ারকে। কথা খুঁজে না পেলে যা করে জাপানীরা, মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেছে অন্যদিকে। হয়তো বিশ্বাস করবেন না, স্যার, আসলে তার কাছে কোনও প্ল্যানই নেই! তৈরির প্রয়োজনও বোধ করে না। তার ধারণা, গোটাকতক পাইল বসিয়ে ওপরে কয়েকটা তক্তা আটকে দিলেই সেতু হয়ে যাবে। এটা দাঁড়াতেই পারবে না, স্যার। এরকম অন্তর্ঘাতমূলক একটা কাজে অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে ভেবে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার।
তার ক্ষোভ এতই খাঁটি যে সান্ত্বনা না দিয়ে পারলেন না কর্নেল নিকলসন।
অত ভেব না, রীভস। ভালই হলো, কথাগুলো বলে অনেকটা হালকা করে নিলে নিজেকে। তোমার ব্যাপারটা আমি সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারছি। নিজের কাজ নিয়ে গর্ববোধ সব মানুষের মধ্যেই আছে।
ঠিক বলেছেন, স্যার। এরকম উদ্ভট একটা কাজ করার চেয়ে যে কোনও শাস্তি মাথা পেতে নিতে রাজি আছি আমি।
তোমার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত, শেষ নোট নিলেন কর্নেল। এসব অনিয়ম চলতে দেয়া যেতে পারে না। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব খুব শিগগির, কথা দিচ্ছি। এবার তোমার পালা, হিউজেস।
অভিযোগ করতে এসেছেন হিউজেস, এটা খুবই আশ্চর্য ব্যাপার। খুব সহজে বিরক্ত হবার পাত্র তিনি নন।
সার, কোনও কাজে শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। যতদিন পর্যন্ত জাপানী প্রহরীরা আমাদের আদেশের মধ্যে মাথা গলাবে, ততদিন গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজ করা সম্ভব নয়। আপনি একবার তাকিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন, স্যার। যতসব অপদার্থের দল! আজ সকালে তিন ভাগে ভাগ করেছি আমার দলটাকে। এক দল মাটি খুঁড়বে, আরেক দল সেই মাটি ফেলে দিয়ে আসবে, তৃতীয় দল সমান করবে বাধটা। আমি, স্যার, সবার কাজের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বিধান করতে চাই।
হুঁ, আগ্রহী হয়ে উঠলেন কর্নেল। এক ধরনের স্পেশালাইজেশন সিস্টেম, তাই না?
ঠিক ধরেছেন, স্যার। নিজের সম্বন্ধে অন্তত এটুকু বলতে পারি যে মাটির কাজ আমার জানা আছে। ডিরেক্টর হবার আগে আমি ছিলাম ওঅকস ম্যানেজার। তিনশো ফুটের চেয়েও গভীর কুয়ো খোড়ার অভিজ্ঞতা আছে। যাই হোক, সকালে কাজ শুরু করল ওরা। নিয়মমাফিক কাজ এগোচ্ছে, হঠাৎ এসে হাজির হলো এক বেবুন। চিৎকার করে একত্র হতে বলল তিনটে দলকে, স্রেফ নজর রাখার সুবিধের জন্যে। তারপর যা হবার তা-ই হলো। বারোটা বেজে গেল কাজের। দেখুন না, কেমন গাদাগাদি করে রয়েছে সবাই। ওহ, চিন্তা করতেও মাথাটা ঘুরে যাচ্ছে।
যা, ঠিকই বলেছ, বন্দীদের লক্ষ্য করে সায় দিলেন কর্নেল। শৃঙ্খলার কোনও বালাই নেই।
আরও আছে, স্যার। মাথাপিছু প্রত্যেককে মাটি কাটতে বলা হয়েছে এক ঘনগজ করে। গাধাগুলো একবারও ভাবেনি যে বন্দীদের নিয়ে আরও বেশি মাটি কাটিয়ে নেয়া সম্ভব। এক ঘনগজ মাটি কাটার সাথে সাথে ছুটি দিয়ে দেয়া হচ্ছে ওদের। এ-অবস্থায় আমি যদি বেশি কাটতে বলি, ওরা কি ভাববে?
অর্থাৎ তুমি বলতে চাইছ, কাজ কম হচ্ছে? জানতে চাইলেন কর্নেল নিকলসন।
খুবই কম, স্যার, মাঝখান থেকে বলে উঠলেন রীভস। ভারতে থাকতে কুলিদের অনায়াসেই দেড় ঘনগজ করে মাটি কাটতে দেখেছি, অথচ ওখানকার আবহাওয়া থাইল্যান্ডের মত হলেও মাটি অনেক শক্ত।
ব্যাপারটা আমিও ভাবছিলাম, বললেন কর্নেল। একবার একটা রাস্তা তৈরি করার দায়িত্ব পেয়েছিলাম আফ্রিকায়। ওখানে অনেক বেশি খাটছিল আমার লোকেরা। যাই হোক, একটা কথা পরিষ্কার, এসব অনিয়ম আর বরদাস্ত করা চলবে না। অভিযোগগুলো আমাকে জানিয়ে খুব ভাল করলে তোমরা।
নোটগুলো আরেকবার দেখে এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন কর্নেল, তারপরেই বলে উঠলেন আবার:
এখন শোনো, তোমরা দুজনেই। এতসব ঝামেলার মূলে কি আছে জানো? মাত্র একটা জিনিস: সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বলতে একেবারেই কিছু নেই। আমি জানি, দোষী আমিই হব সবচেয়ে আগে। কারণ, আমার চোখেই সবচেয়ে আগে পড়া উচিত ছিল ত্রুটিটা। সুতরাং এখন সেটার ওপরেই আমাদের জোর দিতে হবে সবচেয়ে বেশি।
জ্বী, স্যার, সায় দিলেন হিউজেস। তা না হলে এ-ধরনের কাজ ব্যর্থ হতে বাধ্য।
একটা কনফারেন্স ডাকাই ভাল, বললেন কর্নেল নিকলসন। কথাটা আগেই ভাবা উচিত ছিল আমার। খোলাখুলি আলোচনা হবে আমাদের আর জাপানীদের মধ্যে। যাই, এখনই কথা বলে আসি কর্নেল সাইতোর সাথে।
১০.
কনফারেন্স বসল কয়েক দিন পর। সাইতো অবশ্য বুঝতে পারেননি ব্যাপারটা কি, তাই ব্যাখ্যা চেয়ে বোকা সাজতেও চাননি। জানিয়ে দিয়েছেন যথাসময়ে তিনি উপস্থিত থাকবেন সেখানে।
লম্বা যে কুটিরটাকে ডাইনিং রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়, কনফারেন্সের আলোচ্য বিষয়সূচি নির্ধারণের পর অফিসারদের নিয়ে সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগলেন কর্নেল নিকলসন। সাইতো এলেন তার এঞ্জিনিয়ার, কয়েকজন দেহরক্ষী আর তিনজন ক্যাপ্টেনকে নিয়ে। ক্যাপ্টেন তিনজনকে আনা হয়েছে স্রেফ দল ভারী করার জন্যে, একবর্ণ ইংরেজিও বলতে পারে না তাদের কেউই। সাইতোকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন ব্রিটিশ অফিসারেরা। নিখুঁত এক স্যালুট দিলেন কর্নেল নিকলসন। শত্রুপক্ষের আদবকায়দা দেখে একটু দমে গেলেন সাইতো।
স্বাভাবিক ভদ্রতার খাতিরে অপেক্ষা করতে লাগলেন কর্নেল নিকলসন, যাতে উদ্বোধনী ঘোষণাটা সাইতো দিতে পারেন। একজন চেয়ারম্যান ছাড়া তো আর কনফারেন্স হতে পারে না। কিন্তু চেয়ারম্যান হবার কোনওরকম ইচ্ছে সাইতোর নেই। সভ্যজগতের রীতিনীতি সম্বন্ধে বিশেষ ধারণা তার নেই। তাই উল্টোপাল্টা কিছু একটা করে অধস্তনদের সামনে তিনি অপ্রস্তুত হতে চান না।
সাইতো উঠে শুধু বললেন যে কর্নেল নিকলসনের বক্তব্য তিনি শুনতে চান। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর কর্নেল যখন বুঝলেন যে সাইতো আর আপাতত মুখ খুলবেন না, বাধ্য হয়ে তাকে দিতে হলো উদ্বোধনী ঘোষণা। তারপর খুব অল্প কথায় প্রস্তাব পেশ করলেন কর্নেল। কওয়াই নদীর ওপর সেতু তৈরির কাজে তিনি পুরোপুরি শৃঙ্খলা দেখতে চান এবং প্রত্যেকের দায়িত্ব বণ্টন করে দিতে চান পরিষ্কারভাবে। মেজর ক্লিপটনও উপস্থিত ছিলেন কনফারেন্সে। অবাক হয়ে তিনি লক্ষ করলেন, কমান্ডিং অফিসারের ব্যক্তিত্ব সাইতোকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে।
সংক্ষিপ্ত একটা ভূমিকার পর মূল বক্তব্যে চলে এলেন কর্নেল।
অন্য কোনও প্রসঙ্গের আগে, কর্নেল সাইতো, আমাদের উচিত সেতুর অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা। আমার মতে, এ সিদ্ধান্তটা একটু তড়িঘড়ি করে নেয়া হয়েছে। মনে মনে ভাটির দিকে মাইলখানেক দূরের একটা জায়গা আমরা নির্বাচন করে রেখেছি। এর অর্থ আরও খানিকটা রেললাইন বসানো, ক্যাম্পটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া আর নতুন কোয়ার্টার তৈরি করা। কিন্তু এর অর্থ কোনওভাবেই কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়।
ঘোৎ করে উঠলেন সাইতো। ক্লিপটন ভাবলেন, যে-কোনও মুহূর্তে এখন মেজাজ খারাপ করে দানব হয়ে উঠবেন কর্নেল। তার মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। এক মাসেরও বেশি সময় কেটে গেছে, কিন্তু কাজের কাজ বলতে কিছুই হয়নি এখনও। ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন সাইতো, মুঠি করে ধরলেন তরোয়ালের হাতল। কিন্তু তাঁকে কথা বলার সুযোগ দিলেন না কর্নেল নিকলসন।
এক মিনিট, কর্নেল সাইতো, বলে উঠলেন তিনি। এ-বিষয়ে আমার সহকর্মী, ক্যাপ্টেন রীভূস্-এর সাথে আলোচনা করেছি। সেতু তৈরির ব্যাপারে সে একজন বিশেষজ্ঞ। তার সিদ্ধান্ত হলো…
দুদিন আগে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে জাপানী এঞ্জিনিয়ারের কাজ লক্ষ করার পর তাঁর অযোগ্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন কর্নেল নিকলসন। মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে উপদেষ্টার বাহু ধরে তিনি বলেছেন:
শোনো, রীভ। যে আনাড়ি সেতু সম্বন্ধে আমার চেয়েও কম বোঝে, তাকে দিয়ে কিছু হবে না। তুমি একজন এঞ্জিনিয়ার, ঠিক তো? বেশ, পুরো কাজটার দায়িত্ব নিয়ে আমরা শুরু করব গোড়া থেকে। ওই এঞ্জিনিয়ারের ধ্যানধারণা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন নেই। প্রথমে একটা উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বের করো, যেখানে সেতু নির্মাণ করা যেতে পারে। তারপর দেখা যাবে…
কাজ পেয়ে খুশি হয়ে উঠলেন রী। সতর্কতার সাথে বিভিন্ন জায়গা পরীক্ষা করার পর একটা জায়গা পেলেন তিনি, যেটা সেতুর ভার বহনে সক্ষম।
নিজের বিরক্তি প্রকাশ করার জন্যে যথাযথ ভাষা সাইতো খুঁজে পাবার আগেই রীভসকে ডাকলেন কর্নেল। এগিয়ে গিয়ে তথ্য প্রমাণের মাধ্যমে রীড়স বুঝিয়ে দিলেন যে এই জলাভূমির ওপরে সেতু নির্মাণ করলে সেটা ধসে পড়তে বাধ্য। বক্তব্য শেষ হতে সবার পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কর্নেল বললেন:
এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কর্নেল সাইতো, দুর্ঘটনা এড়াতে হলে সেতুর অবস্থান পরিবর্তন করতেই হবে। এ-বিষয়ে আপনার সহকর্মীর কিছু বলবার আছে?
এঞ্জিনিয়ারের কাছে মতামত জানতে চাইলেন সাইতো। কিছুক্ষণ রীভস-এর কাগজপত্র পরীক্ষার ভান করার পর এঞ্জিনিয়ার বললেন, কয়েক দিন আগে তিনি নিজেও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। রাগে কাঁপতে লাগলেন সাইতো। মুখে কিছু না বলে সম্মতি জানালেন মাথা ঝাকিয়ে। আবার বলতে লাগলেন কর্নেল:
তা হলে এ-বিষয়ে আমরা সবাই একমত হলাম, কর্নেল সাইতো। ফলে এপর্যন্ত করা কাজের আর কোনও মূল্যই রইল না। আবার শুরু করতে হবে একেবারে গোড়া থেকে।
যত সব রদ্দি শ্রমিকের দল, বললেন সাইতো। দুসেকশন রেললাইন বসানোর কাজ জাপানী সৈন্যরা সেরে ফেলত পনেরো দিনেরও কম সময়ে।
জাপানী সৈন্যের পক্ষে ভাল কাজ করাই স্বাভাবিক, যেহেতু তারা অফিসারদের আদেশ মেনে চলতে অভ্যস্ত। কিন্তু খুব শিগগির ব্রিটিশ সৈন্যদের যোগ্যতা আমি আপনাকে দেখাতে পারব বলে আশা রাখি, কর্নেল সাইতো। আপনাকে তো বলা হয়নি, ইতোমধ্যেই আমি আমার লোকদের মাথা পিছু কাজের পরিবর্তন করেছি।
পরিবর্তন করেছেন। চিৎকার করে উঠল সাইতো।
বাড়িয়ে দিয়েছি, শান্তভাবে জবাব দিলেন কর্নেল, এক ঘনগজ থেকে দেড় ঘনগজ। সবার স্বার্থেই এই পদক্ষেপ নিয়েছি। আশা করি আপনিও আপত্তি করবেন না এতে।
একেবারে বোকা বনে গেলেন কর্নেল সাইতো। সেই সুযোগে আবার কথা বলে উঠলেন কর্নেল নিকলসন।
এ-কথা আপনাকে বুঝতে হবে, কর্নেল সাইতো, যে প্রত্যেক সেনাবাহিনীরই নিজস্ব কার্যপদ্ধতি আছে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে আমরা সে-পদ্ধতির মূল্য প্রমাণ করে দেব। এ-ধরনের কাজের সাফল্য নির্ভর করে সাংগঠনিক শৃঙ্খলার ওপর। যেহেতু বিষয়টার ওপর আলোচনা শুরু হয়েছে, আমি কয়েকটা পরামর্শ দিতে চাই।
উপদেষ্টা পরিষদের সাহায্যে গত দুদিন খেটে তৈরি করা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ প্ল্যানটা বুঝিয়ে দিলেন কর্নেল নিকলসন। পুরো কাজটার মূল দায়িত্বে থাকবেন তিনি নিজে, এবং প্রত্যেকের জন্যে জাপানীদের কাছে দায়ী থাকবেন ব্যক্তিগতভাবে। প্রাথমিক ও তত্ত্বীয় কাজের পাশাপাশি টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারের দায়িত্ব পালন করবেন ক্যাপ্টেন রীভস। মেজর হিউজেস থাকবেন চীফ ফোরম্যান হিসেবে। ছোট ছোট দলে ভাগ করা সৈন্যদের দায়িত্বে নিয়োজিত প্লাটুন অফিসারেরা কাজ করবে তার অধীনে। এ ছাড়া থাকবে একটা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিপার্টমেন্ট, যার প্রধান হিসেবে নিয়োজিত করা হবে সেরা কর্পোরাল ক্লার্ককে। তার প্রধান দায়িত্ব যোগাযোগ রক্ষা, আদেশ যথাস্থানে পৌঁছে দেয়া, কাজ নির্ধারণ, যন্ত্রপাতি বন্টন এবং রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি।
এই বিভাগটি একান্তই জরুরী, ব্যাখ্যা করলেন কর্নেল। আমার পরামর্শ হলো, কর্নেল সাইতো, এক মাস আগে সরবরাহ করা যন্ত্রপাতিগুলো আপনার নিজের চোখে একবার দেখা উচিত। ওগুলোর অবস্থা কিন্তু সত্যিই খুব শোচনীয়…
এই পরিকল্পনা অনুমোদনের ব্যাপারে আমি জোরালভাবে সুপারিশ করছি, নতুন আরও কি কি যন্ত্রপাতি লাগবে, সে-বিষয়ে বিশদ বিবরণ দেয়ার পর আবার মাথা তুললেন কর্নেল নিকলসন। মোটামুটি যা বলার বললাম। এরপরেও যদি বোঝার কিছু থাকে, ডাকবেন, যে-কোনও সময়ে বুঝিয়ে দিতে বাধ্য থাকব আমি। নতুন পরামর্শ থাকলে সেটাও দেখব বিবেচনা করে। তো, আমি যে পরামর্শগুলো দিলাম তার সাথে কি আপনি একমত?
সাইতো অবশ্য আরও ব্যাখ্যা আশা করেছিলেন, কিন্তু মুখে সেকথা না বলে আবারও সম্মতি জানালেন মাথা ঝাঁকিয়ে। মর্যাদাহানির ব্যাপার আর তার মাথায় নেই। এই কাজের ওপরে তাঁর জীবন-মরণ নির্ভর করছে। সুতরাং পাইলগুলো সেতুর ভার বহনে সক্ষম হয়েছে–এই দৃশ্যটি তিনি দেখতে চান যে-কোনও মূল্যে।
প্রাথমিক সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আবার বলে চললেন কর্নেল নিকলসন;
গুরুত্বপূর্ণ আরেকটা বিষয় আছে, কর্নেল সাইতো–সময়। বুঝতেই পারছেন, নতুন রেললাইন বসাতে প্রয়োজন হবে অনেকখানি বাড়তি কাজের। তা ছাড়া নতুন ক্যাম্প তৈরির প্রশ্নটা তো আছেই।
নতুন ক্যাম্প আবার কেন? প্রতিবাদ জানালেন সাইতো। মাইল দুই রাস্তা বন্দীরা হেঁটেই যেতে পারবে।
আমার সহকর্মীরা বিষয়টা উভয় দিক থেকেই ভেবে দেখেছে, বললেন কর্নেল। তাদের সিদ্ধান্ত হলো…।
রীভস আর হিউজেস হিসেব করে দেখছেন যে প্রত্যেকদিন যাতায়াতে যত সময় ব্যয় হবে, তার চেয়ে অনেক কম সময়ে নতুন ক্যাম্প তৈরি করে ফেলা সম্ভব। এ-যুক্তির বিপক্ষেও কোনও কথা খুঁজে পেলেন না সাইতো। ফলে আবার মুখ খুললেন কর্নেল:
ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে এক মাসেরও বেশি সময়। আমার পরামর্শমত কাজ করলে অবশ্য সেতু তৈরিতে খুব বেশি দেরি হবে না। একটা দল গাছ কাটবে, আরেক দল রেললাইন পাতবে, এবং অন্য আরেকটা দল তৈরি করবে নতুন ক্যাম্প। কিন্তু এসব কাজের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মেজর হিউজেসের ধারণা, এত কিছু করার মত যথেষ্ট লোকবল আমাদের নেই।
অস্বস্তিকর নীরবতার মাঝে কেটে গেল কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর আবার কথা বলে উঠলেন কর্নেল নিকলসন:
তাই এ-ক্ষেত্রেও আমার একটা পরামর্শ আছে, কর্নেল সাইতো। বলছিলাম যে বেশির ভাগ ব্রিটিশ সৈন্য খাটুক সেতুর পেছনে। বাদবাকি যারা থাকবে তাদের সাথে জাপানী সৈন্য যোগ দিয়ে দ্রুত সেরে ফেলুক রেললাইন বসানোর কাজ। আর নতুন ক্যাম্প তৈরির দায়িত্ব সম্পূর্ণ থাকুক আপনার লোকেদের ওপর। বাঁশের কাজে আপনার সৈন্যেরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অভ্যস্ত।
কর্নেলের বক্তব্যের প্রথমদিকে গলা টিপে ধরার ইচ্ছে হলেও এখন তাঁকে শ্রদ্ধা না করে পারলেন না ক্লিপটন। গভীর একজোড়া নীল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হলো, আপাত সাধারণ ওই মানুষটির মাথায় রয়েছে সূক্ষ্ণ বুদ্ধির প্যাঁচ।
এবারে তিনি চাইলেন সাইতোর মুখের দিকে। সত্যিই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন জাপানী অফিসারটি।
জাপানী ভাষায় অত্যন্তু দ্রুত নিজের অফিসারদের কিছু নির্দেশ দিলেন সাইতো, যা তিনি নিজে ছাড়া আর কেউ বুঝল বলে মনে হলো না। সাইতো থামার পর খুব সাবধানে শেষ প্রসঙ্গটা উত্থাপন করলেন কর্নেল নিকলসন।
আপনার লোকেদের মাথা পিছু কাজ নির্ধারণ করাটা বাকি আছে এখনও। যাতে বেশি ক্লান্ত হয়ে না পড়ে সেজন্যে এক ঘনগজের কথাই ভেবেছিলাম প্রথমে। কিন্তু ব্রিটিশ সৈন্যদের সমান মাটি কাটাটাই কি ভাল দেখাবে না? তা হলে দুদলই কাজ করতে পারবে প্রতিযোগিতামূলক একটা মনোভাব নিয়ে…
জাপানী সৈন্যেরা মাটি কাটবে দুঘনাজ করে, গলা চড়ালেন সাইতো। আমি তো আদেশ জারি করে ফেলেছি!
সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকালেন কর্নেল নিকলসন।
তা হলে তো খুব দ্রুত অগ্রগতি হবে আমাদের। আর কিছু বলার নেই, কর্নেল সাইতো। কারও যদি কোনও প্রশ্ন না থাকে, কনফারেন্স শেষ করা যেতে পারে এখানেই। আগামীকাল সকাল থেকে আমরা কাজ শুরু করব আজকের আলোচনার ভিত্তিতে।
উঠে পড়ে আবার এক স্যালুট দিয়ে কর্নেল পা বাড়ালেন নিজের কুটিরের উদ্দেশে, পেছনে পেছনে ক্লিপটন।
ওরা কি দারুণ বোকা, স্যার! কর্নেলের চোখে চোখে চেয়ে বললেন তিনি। জলাভূমির ওপর সেতু তৈরি করলে ধসে পড়ে কী কেলেঙ্কারিই না হত!
কিন্তু কর্নেলের মুখ স্ফিংক্সের মতই নির্বিকার। ওই মুখের রহস্য ভেদ করার সাধ্য ক্লিপটনের নেই।
হ্যাঁ, ওরা বোকাই, শেষমেশ জবাব দিলেন কর্নেল নিকলসন। কিছুদিন আগেও ওরা বুনো ছিল। এরকম সেতু নির্মাণের ক্ষমতা ওদের নেই। ওরা বড়জোর তৈরি করতে পারে বুনো লতার সাঁকো।
আগের পর্ব :
০১-০৫. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানুষের মধ্যে যে অনতিক্রম্য ব্যবধান
পরের পর্ব :
১১-১৫. পাশ্চাত্যের মানুষের সেতুর ধারণা
১৬-২০. সারারাত না ফেরায় উদ্বিগ্ন
২১-২৫. কওয়াইয়ের কলধ্বনি