০১-০৫. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানুষের মধ্যে যে অনতিক্রম্য ব্যবধান
০১.
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানুষের মধ্যে যে অনতিক্রম্য ব্যবধান, অনেকের মতে সেটা স্রেফ দৃষ্টিভঙ্গির বিভ্রান্তি। যুগ যুগ ধরে এই ব্যবধানের কথা লেখা হচ্ছে। সেটা হয়তো নেহাতই প্রচলিত একটা জনপ্রিয় ধারণার সাথে লেখকদের একমত হবার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। গত বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ এবং জাপানী দুই পক্ষের কাছেই মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারটা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাহ্যিকদৃষ্টিতে দুই শত্রুর চালচলন যথেষ্ট বিসদৃশ হলেও মানসিক দিক দিয়ে তারা সত্যিই পরস্পরের কাছাকাছি। জাপানী কর্নেল সাইতোর সাথে তাঁর বন্দী কর্নেল নিকলসনের মানসিকতার কোনও ব্যবধান আছে বলে মনে হয় না।
কথাগুলো দোলা দিচ্ছিল মেজর ক্লিপটনের মনে। যে পাঁচশো যুদ্ধবন্দীকে জাপানীরা কওয়াই নদীর তীরবর্তী ক্যাম্পে জড়ো করেছে, তিনি তাদেরই একজন। ইংরেজ, অস্ট্রেলিয়ান, ডাচ ও আমেরিকান মিলে ষাট হাজার যুদ্ধবন্দীকে বিভিন্ন দলে ভাগ করে আনা হয়েছে বার্মা আর থাইল্যান্ডের এই জঙ্গলে অংশে। এখানে সভ্যতার ছোঁয়া নেই বললেই চলে। জাপানী সৈন্যদের যথেষ্ট মার, রাইফেলের কুঁদোর বাড়ি এবং অন্যান্য অকথ্য অত্যাচার কর্নেল নিকলসনের মর্যাদাসম্পন্ন চালচলনের কাছে ব্যর্থ হয়ে যায়। বন্দী হওয়া সত্ত্বেও কমান্ডিং অফিসারের এই ধরনের চালচলন মাঝে মাঝে ভীষণ রাগিয়ে তোলে মেজর ক্লিপটনকে। তখন সম্পূর্ণ ব্যাপারটা তিনি গভীরভাবে তলিয়ে দেখতে বসেন।
কর্নেল নিকলসনের কর্তব্যপরায়ণতা, আচারপরায়ণতা, শৃঙ্খলা বজায় রাখার বদ্ধ-সংস্কারকে এককথায় বলা যায়–উন্নাসিকতা। সামরিক উন্নাসিকতার তার চেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত আর নেই।
ক্লিপটন বরাবরই বাস্তববাদী মানুষ। যে-কোনও সমস্যাকে সম্ভাব্য সবরকম দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ক্ষমতা তার আছে। আর তাই সবদিক বিচার করার পর ধীরে ধীরে তার মাথা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। এরকম আচরণকে যদি উন্নাসিকতা বলা হয়, তা হলে মানুষের অনেক বড় বড় অনুভূতিও উন্নাসিকতার অন্তর্ভুক্ত। সত্যি বলতে কি, মায়ের অপত্যস্নেহ তা হলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উন্নাসিকতা।
আগে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে কর্নেল নিকলসনের শৃঙ্খলার প্রতি শ্ৰদ্ধার কথা লোকের মুখে মুখে ফিরত প্রবাদের মত। ১৯৪২ সালে মালয় আক্রান্ত হবার পর সেই শৃঙ্খলাপরায়ণতার প্রকাশ আবার দেখা গেল সিঙ্গাপুরে।–হেডকোয়ার্টারস থেকে যুদ্ধবিরতির নির্দেশ আসার পর তরুণ কিছু অফিসার ঠিক করল, উপকূলের দিকে গিয়ে একটা বোট দখল করে তারা পালিয়ে যাবে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজে। তাদের উদ্দীপনা আর সাহসের ভূয়সী প্রশংসা করলেন কর্নেল নিকলসন, কিন্তু তাদের কাজে বাধা দেয়ার কোনও চেষ্টাই বাদ দিলেন না।
প্রথমে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, তাঁর প্রতি যে নির্দেশ এসেছে, ব্যাপারটা হবে তার সরাসরি লন। যেহেতু কমান্ডার-ইন-চীফ পুরো মালয়েই আত্মসমর্পণ করেছেন, এখান থেকে যে-কোনও সৈন্যের পালিয়ে যাওয়াটা অবাধ্যতা বলে গণ্য হবে। সুতরাং এখন যে যেমন আছে তেমনি থেকে জাপানী কোনও সিনিয়র অফিসারের কাছে আত্মসমর্পণ করাটাই হবে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত।
অফিসারই যদি কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়, বললেন তিনি, তা হলে সাধারণ সৈন্যরা আর কী শিখবে!
যুক্তি দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলেন কর্নেল নিকলসন, সঙ্কটকালে যে কৌশল তিনি সবসময়ই ব্যবহার করেন। তাঁর দিকে একবার তাকালে পরিষ্কার বোঝা যায়, মানুষটিকে কখনও বিবেকের কাছে জবাবদিহি করতে হয়নি। ভারত মহাসাগরের মত তার শান্ত একজোড়া চোখ, লালচে গোঁফ আর টকটকে চেহারা দেখলেই ক্লিপটনের মনে পড়ে যায় কিংবদন্তির কথা। কিন্তু ইদানীং প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও কর্নেলের অতি শৃঙ্খলা দেখে বুঝতে পারছেন না, তার উপর রাগ করা উচিত, নাকি শ্রদ্ধা।
তরুণ অফিসারদের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করেছেন ক্লিপটন। বিরক্ত হয়ে কর্নেল বলেছেন, তিনি ভাবতেও পারেন না, মাঝবয়েসী একজন অফিসার কী করে মাথাগরম ছেলেদের এরকম দায়িত্বহীন কাজে উৎসাহ জোগাতে পারে!
এরপর নিজের মনোভাব ব্যাখ্যা করে রীতিমত আদেশ জারি করেছেন কর্নেল। অফিসার, নন-কমিশন্ড-অফিসার, সাধারণ সৈন্য এরা সবাই জাপানীদের কাছে আত্মসমর্পণ করার আগ পর্যন্ত এখন যেমন আছে তেমনি থাকবে। ব্যাটালিয়নের যাবতীয় দায়দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে নিতে চান।
বেশির ভাগ অফিসারই তার আদেশ মেনে নিল। এর পরেও সামান্য যে কজন অদৃশ্য হয়ে গেল জঙ্গলের মাঝে, তাদের ব্যবহারে মর্মাহত হলেন কর্নেল নিকলসন। এবং পরে ওই কজনকে তিনি টুকে রাখলেন পলাতক হিসেবে।
এবারে আত্মসমর্পণটা কীভাবে করবেন তার একটা প্রস্তুতি নিতে লাগলেন কর্নেল। অনেক ভেবেচিন্তে শেষমেশ ঠিক করলেন, আত্মসমর্পণের চিহ্নস্বরূপ রিভলভারটা তিনি দিয়ে দেবেন শত্রুপক্ষের কর্নেলকে। সহজ ভঙ্গিতে হোলস্টারসুদ্ধ রিভলভারটা বাড়িয়ে দেবেন কীভাবে, সেটাও ঠিক করলেন মহড়া দিয়ে দিয়ে। সবচেয়ে ভাল ইউনিফর্মটা পরলেন তিনি। লক্ষ রাখলেন, অন্য সবাই যেন যথাসম্ভব পরিপাটি থাকে। এরপর সৈন্যদের তিনি শেখালেন, কিভাবে স্তূপীকৃত করে রাখতে হবে অস্ত্রশস্ত্রগুলো।
সর্বপ্রথম শত্রুপক্ষের যে সৈন্যরা এল, তারা জাপানী ছাড়া অন্য কোনও ভাষাই জানে না। পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলেন কর্নেল নিকলসন। কিছুক্ষণ পর ট্রাকে করে এল এক নন-কমিশন্ড-অফিসার। অস্ত্রশস্ত্র ট্রাকে নিয়ে গিয়ে রাখার জন্যে সে ইশারা করল ব্রিটিশদের। সবাইকে চুপচাপ থাকতে বলে একজন সিনিয়র অফিসারের সাথে দেখা করতে চাইলেন কর্নেল। সিনিয়র বা জুনিয়র কোনও অফিসারই ছিল না জাপানীদের সাথে। উপরন্তু কথা বুঝতে না পেরে রেগে আগুন হয়ে গেল তারা। নন-কমিশন্ড অফিসারটি দাঁতমুখ খিচিয়ে আঙুল নির্দেশ করল ব্রিটিশদের রাইফেলগুলোর দিকে। কর্নেল আদেশ দিলেন যেন একজন সৈন্যও না নড়ে। এবারে সাবমেশিনগান তাক করল জাপানীরা, ধাক্কা দিল কর্নেলকে। নিজেকে সামলে আবার একই অনুরোধ জানালেন কর্নেল নিকলসন। মুখ শুকিয়ে গেল ব্রিটিশ সৈন্যদের। পরিস্থিতিটা ঘাবড়ে দিল ক্লিপটনকে, কর্নেল কি স্রেফ নিজের নীতির প্রতি অবিচল থাকার খাতিরে সবার মৃত্যু ডেকে আনতে চান! হঠাৎ বেশ কজন জাপানী অফিসারকে নিয়ে একটা কার এসে পৌঁছল। একজনের কাঁধে মেজরের ব্যাজ দেখে কর্নেল নিকলসন সিদ্ধান্ত নিলেন যে তার কাছেই আত্মসমর্পণ করবেন। নিজের সৈন্যদের অ্যাটেনশন হতে বলে স্যালুট করলেন তিনি, তারপর চোখের পলকে বেল্ট থেকে হোলস্টার খুলে বাড়িয়ে দিলেন সামনে।
চমকে উঠে প্রথমে এক ধাপ পিছু হটল মেজর, বিব্রত বোধ করল ভীষণভাবে, তারপর ফেটে পড়ল হিংস্র অট্টহাসিতে। দেখাদেখি হসিতে যোগ দিল অন্য অফিসারেরাও। কাঁধ ঝাঁকিয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন কর্নেল নিকলসন, কয়েক মুহূর্ত পরেই সৈন্যদের আদেশ দিলেন অস্ত্রগুলো ট্রাকে নিয়ে গিয়ে জমা করতে।
সিঙ্গাপুরের বন্দী শিবিরে থাকার সময়েই কর্নেল নিকলসন সারাক্ষণ লক্ষ রাখতেন, সৈন্যদের ব্যবহারে যেন এতটুকু বিচ্যুতি না ঘটে। এবং ক্লিপটন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেননি, এই ধরনের মানুষকে কী দেয়া উচিত–প্রশংসা নাকি অভিশাপ।
মাঝে মাঝে এদিক-সেদিক থেকে গরুর মাংসের দুএকটা টিন সগ্রহ করে আনত সৈন্যেরা। কর্নেল নিকলসন পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে এসব বন্ধ করতে হবে। কারণ, মর্যাদা হানিকর কোনও কাজ ব্রিটিশ সৈন্যদের মানায় না। শুধু আদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না কর্নেল, আদেশ পালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্যে পরিদর্শন করতে লাগলেন নিয়মিত।
জাপানীরা এখনও নির্দিষ্ট কোনও কাজ করতে দেয়নি। শঙ্কিত হয়ে কর্নেল নিকলসন একদিন ভাবলেন, এভাবে বসে থাকলে সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়বে। সুতরাং কিংস রেগুলেশন ব্যাখ্যা করে বোঝাতে লাগলেন তাদের। আর সেই রেগুলেশন মোতাবেক যারা সবচেয়ে ভাল কাজ দেখাতে পারল, পুরস্কার হিসেবে তাদের মধ্যে বিতরণ করতে লাগলেন যহস্ত স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট। কর্নেল বোঝালেন, বন্দী শিবিরে থাকলেও নিখুঁতভাবে স্যালুট করাটা খুবই জরুরী। মহা মুশকিলে পড়ে গেল সাধারণ সৈন্যরা। এমনিতেই জাপানী যেকোনও সৈন্যকে স্যালুট করতে হয় তাদের, এখন আবার তার সাথে যোগ হলো ব্রিটিশ অফিসারদের স্যালুট করা। শুধু তা-ই নয়, জাপানী সৈন্যদের লাথি-চড়ঘুসির পাশাপাশি নিখুঁতভাবে স্যালুট করতে না পারার অপরাধে কপালে জুটতে লাগল কর্নেল নিকলসনের দেয়া শাস্তি।
শৃঙ্খলার এই বাড়াবাড়ি অবশ্য মুখ বুজেই মেনে নিল সৈন্যেরা। কারণ, কর্নেলকে তারা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। দৃঢ়তা, অসীম সাহসের পাশাপাশি শত্রুপক্ষের যে-কোনও ধরনের মার নিঃশব্দে হজম করার ক্ষমতা তাদের সে-শ্রদ্ধা আরও বাড়িয়ে তুলল। অবশ্য জাপানী সৈন্যদেরকেও কর্নেল ছেড়ে কথা কইলেন না। আন্তর্জাতিক ব্যবহারবিধি লঙ্ঘন করার সাথে সাথে তাদের মুখের সামনে দোলাতে লাগলেন হেগ কনভেনশন অনুসারে তৈরি ম্যানুয়াল অভ মিলিটারি ল। আর এইজন্যেই একদিন বিশ্রীভাবে মার খেলেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর এক জাপানী প্রহরীর হাতে।
আসল ব্যাপার হলো, বর্তমান পরিস্থিতিতে সৈন্যদের সাথে বোধ হয় একটু নরম ব্যবহার করা উচিত–ক্লিপটনের এই পরামর্শের জবাবে বললেন কর্নেল, আসল ব্যাপার হলো, আমি চাই যে ছেলেরা মনে করুক, এখনও তারা আমাদের নির্দেশেই চলছে, ওই বেবুনগুলোর নির্দেশে নয়। যতদিন ওরা এই ধারণাটা আঁকড়ে রাখতে পারবে, ততদিন তারা সৈন্যই থাকবে, ক্রীতদাসে পরিণত হবে না।
ক্লিপটন অনুভব করেছিলেন, এ ব্যাপারে কিছু একটা বলা দরকার। কিন্তু এখন বুঝতে পারলেন, সৈন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে কর্নেলের সদ্গুণাবলীই যথেষ্ট।
০২.
বন্দীরা এখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিঙ্গাপুরের সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে। থাইল্যান্ডের এই দুর্গম অঞ্চলের চেয়ে ওখানকার জীবন ছিল হাজার গুণে ভাল। মালয়ের মাঝখান দিয়ে প্রায় অন্তহীন এক ট্রেন যাত্রা শেষে দীর্ঘ পদযাত্রার পর তারা এসে পৌঁছেছে এখানে। বাতাসে গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে যে এখানে তাদের আনা হয়েছে একটা রেললাইন তৈরি করতে। এই গুজব তাদের পরিশ্রান্ত মনকে আরও ক্লান্ত করেছে।
কর্নেল নিকলসনের ইউনিট এখানে এসেছে অন্যদের চেয়ে একটু দেরিতে। আর এসেই টের পেয়েছে, সিঙ্গাপুরের তুলনায় এখানকার জাপানী প্রহরীরা কত বেশি নিষ্ঠুর। ওখানকার জাপানীরা ছিল সদ্য বিজয়ের আনন্দে ভরপুর, ওরা নিষ্ঠুর হত মাঝেসাঝে। কিন্তু এরা নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে মুহূর্তের মধ্যে। এবং নিয়মিত ভাবে।
ব্যাটালিয়নের সবাইকে প্রথমে নিয়ে আসা হয় বিরাট একটা রিসেপশন সেন্টারে। মাত্র দুদিন ওরা থাকে সেখানে, কিন্তু ওই স্বল্প সময়েই বুঝতে পারে, কেমন কাটবে এখানকার দিনগুলো। প্রত্যেকটা সৈন্যকে খাটানো হলো ভারবাহী পশুর মত। যে কাজ তাদের দেয়া হলো, সেটা হয়তো স্বাভাবিক ভাল স্বাস্থ্যের একজন মানুষের পক্ষে অসম্ভব নয়, কিন্তু গত একমাসে সৈন্যদের যে অবস্থা হয়েছে তাতে কাজ শেষ করতে করতে সন্ধ্যা, এমনকি মাঝরাত হয়ে গেল। তার ওপর আবার সামান্য ভুল চোখে পড়ার সাথে সাথে চলল অকথ্য গালাগাল আর যথেচ্ছ মার। টু শব্দও করল না সৈন্যরা, বরং আতঙ্কিত হয়ে রইল আরও ভয়ঙ্কর শাস্তির আশঙ্কায়। তাদের শারীরিক অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলেন ক্লিপটন। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে ম্যালেরিয়া, আমাশয় আর বেরিবেরি। ক্যাম্পের মেডিক্যাল অফিসার জানালেন, মহামারী শুরু হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়, কিন্তু তার কাছে কোনও প্রতিষেধক নেই। সগ্রহ যে করা যাবে, সে-সম্ভাবনাও সুদূরপরাহত।
ভ্রুকুটি ছাড়া এখন আর কিছুই করেন না কর্নেল নিকলসন। তিনি তো এই ক্যাম্পের দায়িত্বে নেই! জাপানীদের নির্দেশে ব্রিটিশ একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ক্যাম্পটা চালাচ্ছেন। কর্নেল শুধু একদিন জানতে চাইলেন, মেজর পদের নিচের সবাইকে মজুরের মত খাটানোটা কি ঠিক হচ্ছে? মাথা ঝুলে পড়ল লেফটেন্যান্ট কর্নেলের। শেষমেশ বললেন, ব্যাপারটা বন্ধ করার চেষ্টা তিনি করেছেন, কিন্তু শাস্তির ভয়ে তাকে বিরত থাকতে হয়েছে। মাথা ঝাঁকালেন কর্নেল নিকলসন, কিন্তু, ব্যাখ্যাটায় সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে মনে হলো না।
এরই মধ্যে একদিন এসে উপস্থিত হলেন জেনারেল ইয়ামাসিতা, কোমরে তরোয়াল, হাতে ফিকে-ধূসর দস্তানা। ব্রিটিশ সৈন্যদের তৈরি প্ল্যাটফর্মে উঠে তিনি জানালেন, এখন থেকে মহামান্য সম্রাটের ইচ্ছে অনুসারে সবাইকে তার নির্দেশ মেনে চলতে হবে। এরপর জেনারেল জানালেন, তাদের কাছ থেকে তিনি কি আশা করেন।
বক্তৃতা চলল দুঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। বন্দীদের জাতীয় গর্বকে এমনভাবে খাটো করা হলো, প্রহরীদের গালি বা বুটের লাথির চেয়ে সেটা কোনও অংশে কম বেদনাদায়ক নয়। তিনি বললেন, ব্রিটিশ বন্দীদের সাথে জাপানীদের কোনও বিরোধ নেই। কারণ, তাদের ভরাডুবি ঘটেছে সরকারের মিথ্যাচারের জন্যে। সুতরাং তারা যতদিন ভদ্রলোক হয়ে থাকবে, ততদিন ভদ্র ব্যবহার করা হবে তাদের সাথেও। মহামান্য ম্রাট যে তাদের বাঁচার একটা সুযোগ করে দিয়েছেন, সেজন্য তাদের উচিত সম্রাটের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং আপ্রাণ পরিশ্রম করা। তা ছাড়া যে কাজটা তাদের দেয়া হচ্ছে, সেটা সর্বসাধারণের উপকারের জন্যে। তাদের তৈরি করতে হবে একটা রেললাইন। এরপর জেনারেল ইয়ামাসিতা জানালেন, চুল পরিমাণ শৃঙ্খলা ভঙ্গ কিংবা অবাধ্যতা তিনি বরদাস্ত করবেন না। আলস্য বা কর্তব্যে অবহেলা অপরাধ বলে গণ্য হবে। আর পালাবার কোনওরকম চেষ্টা করলে তার একটাই শাস্তি–মৃত্যুদণ্ড। প্রতিটি সৈন্যের ব্যবহার এবং দক্ষতার জন্যে ব্রিটিশ অফিসারেরা জাপানীদের কাছে দায়ী থাকবেন।
অসুখ-বিসুখের কারণে কাউকে অব্যাহতি দেয়া হবে না, বললেন জেনারেল ইয়ামাসিতা। শারীরিকভাবে সমর্থ থাকার জন্যে পরিমিত কাজের কোনও বিকল্প নেই। আর মহামান্য সম্রাটের জন্যে যারা প্রতিদিন জীবন দিয়ে খাটবে, আমাশয় তাদের আক্রমণ করার আগে দুবার ভাববে।
সবশেষে যে-কথাগুলো বললেন জেনারেল, তা শুনে মাথায় যেন আগুন ধরে গেল প্রতিটি বন্দীর।
নিজের কাজ নিয়ে সুখে থাকো, বললেন তিনি, এটাই আমার আদর্শ। এই মুহূর্ত থেকে এটা তোমাদেরও আদর্শ করে নাও। যারা এই আদর্শ মেনে চলবে,আমার বা জাপানী গ্র্যান্ড আর্মির কোনও অফিসারের তরফ থেকে তাদের বিন্দুমাত্র ভয় নেই।
বক্তৃতাশেষে ইউনিটগুলো ভাগ ভাগ করে পাঠিয়ে দেয়া হলো নিজের নিজের সেক্টরে নিজের ইউনিট নিয়ে কর্নেল নিকলসন চলে এলেন বার্মা সীমান্তের কয়েকমাইল দূরবর্তী কওয়াই নদীর ক্যাম্পে। এখানকার কমান্ড্যান্ট হলেন কর্নেল সাইতো।
০৩.
কওয়াই নদীর ক্যাম্পে প্রথম কয়েক দিনের মধ্যেই ঘটে গেল বেশকিছু অপ্রীতিকর ঘটনা।
কর্নেল সাইতো বললেন, সাধারণ সৈন্যদের পাশাপাশি অফিসারদেরও খাটতে হবে। সাথে সাথে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ জানালেন কর্নেল নিকলসন। বললেন, মজুরদের মত খাটা নয়, সৈন্যদের আদেশ করতেই ব্রিটিশ অফিসারেরা অভ্যন্ত।
মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনলেন সাইতো–লক্ষণটা ভাল মনে হলো কর্নেলের–সবশেষে বললেন যে ব্যাপারটা তিনি ভেবে দেখবেন। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর কর্নেল নিকলসন ফিরে এলেন তার বাঁশের কুটিরে। এখানে ক্লিপটনও থাকেন আর দুজন অফিসারের সাথে। সাইতোকে যেসব যুক্তি দেখিয়েছেন, তার মোটামুটি একটা বর্ণনা দিলেন তিনি এই তিনজনের সামনে। তার মতে প্রত্যেকটা যুক্তিই নিখুঁত, কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ যুক্তিটা হলো: মজুরদের মত কাজ করায় অফিসারেরা দক্ষ নয়, ফলে তারা যেটুকু কাজ করবে, তা একেবারেই তুচ্ছ। কিন্তু তারা যদি সাধারণ সৈন্যদের তদারকি করে, বাড়তি কাজ পাওয়া যাবে অনেকখানি। সুতরাং পুরো কাজটা ভালভাবে করার স্বার্থে অফিসারদের অব্যাহতি দেয়াটাই হবে জাপানীদের পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ।
কথাগুলো ঠিক বলেছি, নাকি ভুল? কর্নেল জানতে চাইলেন মেজর হিউজেসের কাছে। তুমি তো শিল্পপতি। তুমি কি মনে করো দায়িত্ববান এক্সিকিউটিভ ছাড়া এরকম কাজে সাফল্য সম্ভব?
বর্তমানে অফিসার বলতে ক্লিপটন ছাড়া এই দুজনেই সম্বল। সিঙ্গাপুরে আসার পর থেকে কর্নেল এঁদের সবসময় কাছে কাছেই রাখেন। কারণ, যেকোনও বিষয় ব্যাখ্যা করে এদের সাথে খোলাখুলি আলোচনায় বসতে তিনি আগ্রহী। দুজনের কেউই রেগুলার অফিসার নন। মেজর হিউজেস মালয়ের একটা মাইনিং কোম্পানির ডিরেক্টর ছিলেন। ব্যাটালিয়নে যোগ দেয়ার পরপরই কর্নেল টের পেয়েছিলেন, এই লোকটির প্রশাসনিক সামর্থ্যের তুলনা হয় না। ক্যাপ্টেন রীভস প্রথমে ভারতে গিয়েছিলেন পাবলিক ওয়ার্কস এঞ্জিনিয়ার হয়ে। পরে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন স্যাপার হিসেবে। যুদ্ধের সময় নিজের ইউনিট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে রীভসকে তুলে নিয়ে কর্নেল অন্তর্ভুক্ত করেন তাঁর উপদেষ্টা পরিষদে। সামরিক বেশির ভাগ অফিসারের মত কর্নেল নিকলসন মাথামোটা নন। তিনি জানেন, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়াতে দোষেরক ইছু নেই। টেকনিশ্যান আর এক্সিকিউটিভদের প্রতি শ্রদ্ধাও আছে তার।
আমার মনে হয় আপনি ঠিকই বলেছেন, স্যার, জবাব দিলেন মেজর হিউজেস।
আমারও তাই মনে হয়, বললেন ক্যাপ্টেন রীভূস্। রেললাইন আর সেতু তৈরির বেলায় কাঁচা কাজ চলে না।
আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে এ-ব্যাপারে তুমি একজন বিশেষজ্ঞ, বললেন কর্নেল নিকলসন। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ, কেন আমি আশাবাদী।
হ্যাঁ, সামান্য হলেও বোকাটার মাথায় যুক্তি ঢোকাতে পেরেছি।
তারপরেও যদি না বোঝে, কমান্ডিং অফিসারের চোখে চোখে তাকালেন ক্লিপটন, ম্যানুয়াল অভ মিলিটারি ল তো আছেই।
হ্যাঁ, সায় দিলেন কর্নেল নিকলসন। প্রয়োজন পড়লে ওটা দেখাতে হবে।
ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে কথা বলার যথেষ্ট কারণ রয়েছে ক্লিপটনের। কর্নেলের চেষ্টা খুব একটা ফলপ্রসূ হবে বলে তার মনে হয় না। রিসেপশন সেন্টারে থাকতেই সাইতো সম্বন্ধে অনেক কথা কানে এসেছে তার। স্বাভাবিক অবস্থায় লোকটা নাকি কখনও কখনও যুক্তিতর্ক মানে, কিন্তু মদ পেটে পড়লেই রূপান্তরিত হয় জানোয়ারে।
কর্নেলকে দেয়া কথামত ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বসলেন সাইতো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্দেহ দেখা দিল মনে, তাই মাথাটা পরিষ্কার করার জন্যে টেনে নিলেন মদের বোতল। ধীরে ধীরে মনে এই বিশ্বাস জন্মাল যে, যুক্তি দেখিয়ে কর্নেল তার। চরম সম্মানহানি করেছেন। তাঁর আদেশের পর কর্নেলের মুখ খোলাই উচিত হয়নি। রাগে অস্থির হয়ে উঠলেন কর্নেল সাইতো।
শেষমেশ ঠিক করলেন, একটা বক্তৃতা দেবেন সবার উদ্দেশে। একটু ক্ষমতা জাহির না করলে শয়তানগুলোকে সোজা করা যাবে না। বক্তৃতার প্রথম কয়েকটা শব্দ শুনেই বুঝতে কারও অসুবিধে হলো না যে অবস্থা মোটেই সুবিধের নয়।
ব্রিটিশদের আমি ঘৃণা করি…
এই বাক্যটি দিয়েই শুরু হলো তাঁর বক্তৃতা। এবং কিছুক্ষণ পরপরই বাক্যটি তিনি ব্যবহার করতে লাগলেন যতিচিহ্নের মত। বৃটেনের দখলকৃত কোনও এক রাজ্যে একসময় সামরিক অ্যাটাশে ছিলেন বলে তার ইংরেজি বেশ স্বাচ্ছন্দ। চাকুরিটা যায় অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্যে। তারপর বহাল হন বর্তমান পদে। এখান থেকে পদোন্নতির আর কোনরকম সম্ভাবনা নেই।
ব্রিটিশদের আমি ঘৃণা করি, বললেন কর্নেল সাইতো। এখানে তোমাদের আনা হয়েছে আমার অধীনে একটা কাজ করার জন্যে। এই কাজ জাপানী গ্র্যান্ড আর্মির বিজয়ের পেছনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে। আমি প্রথম ও শেষবারের মত তোমাদের সবাইকে বলে দিতে চাই যে আমার আদেশের ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন ভোলা একদম বরদাস্ত করা হবে না। ব্রিটিশদের আমি ঘৃণা করি। কেউ দ্বিমত পোষণ করলে তার শাস্তি হবে ভয়ঙ্কর। শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। কেউ মনে মনে বাধাদানের চিন্তা করে থাকলে শুধু এ-কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে তোমাদের জীবন মৃত্যুর সর্বময় ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়েছে। আর প্রয়োজনে সে-ক্ষমতা ব্যবহার করতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করব না। মহামান্য সম্রাট আমাকে যে-কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন, সে-কাজ আমি শেষ করব যে-কোনও মূল্যে। ব্রিটিশদের আমি ঘৃণা করি। কয়েকজন বন্দীর বাঁচা বা মরায় আমার চোখের পাতা পর্যন্ত কাঁপবে না। তোমাদের সবার মৃত্যু জাপানী গ্র্যান্ড আর্মির একজন সিনিয়র অফিসারের কাছে নেহাতই তুচ্ছ।
জেনারেল ইয়ামাসিতার মতই তাঁর হাতে ফিকেধূসর একজোড়া দস্তানা, তরোয়াল ঝুলছে কোমর থেকে। দিনে সাধারণত তিনি পায়ে দেন ক্যানভাসের জতো, কিন্তু এখন তার পরিবর্তে শোভা পাচ্ছে চকচকে রাইডিং-বুট।
কথাগুলো চুপচাপ শুনতে লাগলেন ব্রিটিশ অফিসারেরা। নিজের অজান্তেই হাত দুটো কখনও কখনও মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠলেও মুখভাব রইল পুরোপুরি শান্ত। প্রতিকূল অবস্থাতেও এরকম থাকার কৌশলটা তারা শিখেছেন কর্নেল নিকলসনের কাছে।
হঠাই একেবারে শান্ত হয়ে গেলেন কর্নেল সাইতো। হাবভাবে মনে হলো, এখন যে কথাগুলো বলবেন তাতে অন্তত সুস্থতার কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে।
এখন শোনো সবাই। ব্রিটিশ বন্দীদের কাছ থেকে মহামান্য সম্রাট কি কাজ আশা করেন, সেটা এতদিনে নিশ্চয় তোমাদের কানে এসেছে। থাইল্যান্ডের রাজধানীর সাথে বার্মার রাজধানীর একটা যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে আমাদের, যাতে জাপানী কনভয়গুলো এ-পথে স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে। এই রেলপথ ধরেই জাপানী সেনারা যাবে ভারতে, যাতে দ্রুত অবসান ঘটে যুদ্ধের। সুতরাং কাজটা আমাদের শেষও করতে হবে দ্রুত, ছমাসের মধ্যে। মহামান্য সম্রাটের এটাই আদেশ। অবশ্য এর সঙ্গে তোমাদের স্বার্থও জড়িত রয়েছে। যুদ্ধ শেষ হলে আমাদের সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তোমরা দেশে ফিরে যেতে পারবে।
আরও শান্ত হয়ে গেলেন কর্নেল সাইতো, যেন অ্যালকোহলের শেষ বিন্দুটুকুও রক্ত থেকে উবে গেছে।
এবার নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে হচ্ছে তোমাদের নির্দিষ্ট কাজ কোনটা। সেটা বলতেই আজ আমার এখানে আসা। ছোট্ট একটা রেলপথ তৈরি করতে হবে তোমাদের, যেটা গিয়ে যুক্ত হবে আরেকটা সেকশনের সাথে। কি তোমাদের মূল কাজ হলো কওয়াই নদীর ওপর একটা সেতু নির্মাণ করা। শুনে গর্ববোধ করতে পারো, পুরো পরিকল্পনার মধ্যে এই কাজটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বলা বাহুল্য, কাজটা হবে বিশেষজ্ঞ একজন জাপানী এঞ্জিনিয়ারের নির্দেশনায়। শৃঙ্খলার খাতিরে তোমরা সবাই থাকবে আমার এবং আমার অধস্তনদের অধীনে। ফলে প্রশাসনে কোনও ঘাটতি পড়বে না। আর সেজন্যেই ব্রিটিশ অফিসারদের আমি আদেশ দিয়েছি সাধারণ সৈন্যের পাশাপাশি কাজ করতে। আমি কাউকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারব না। যে আদেশ দিলাম, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে সবাইকে। নইলে…
মুহূর্তে আবার স্বরূপে ফিরে গেলেন কর্নেল সাইতো, হাত-পা ছুঁড়তে লাগলেন উন্মাদের মত।
নইলে আমাকে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। ব্রিটিশদের আমি ঘৃণা করি। অলসদের খাবার দেয়ার চেয়ে আমি বরং গুলি করে মারব। যদি প্রয়োজন হয়, সেতু তৈরি করব বন্দীদের মৃতদেহের ওপর। ব্রিটিশদের আমি ঘৃণা করি। কাজ শুরু হবে আগামীকাল ভোরে। বাশির শব্দ কানে যাবার সাথে সাথে সবাই হাজির হবে এখানে। অফিসারদের খাটতে হবে সাধারণ সৈন্যের মতই। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হবে যথাসময়ে আর প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেবেন জাপানী এঞ্জিনিয়ার। আমার আর কিছু বলার নেই। তবে সবশেষে মনে করিয়ে দিতে চাই জেনারেল ইয়ামাসিতার বাণী: নিজের কাজ নিয়ে সুখে থাকো। কথাটা সব সময় মনে রাখবে।
সাইতো ফিরে গেলেন হেডকোয়ার্টারসে। বন্দীরা ফিরে চলল নিজ নিজ লাইনের দিকে, মাথায় বাজছে সেই অসংলগ্ন বক্তৃতা।
আপনার যুক্তিগুলো বোধহয় ওর মাথায় ঢোকেনি, স্যার। সুতরাং ম্যানুয়াল অভ মিলিটারি ল দেখাতেই হচ্ছে, ক্লিপটন বললেন কর্নেল নিকলসনের উদ্দেশে।
তুমি ঠিকই বলেছ, ক্লিপটন, জবাব দিলেন গম্ভীর কর্নেল, অবস্থা খুব একটা সুবিধের মনে হচ্ছে না।
০৪.
অবস্থা যে সুবিধের নয়, সেটা ক্লিপটন দেখতে পেলেন পরদিনই। তবে যা ভেবেছিলেন, অবস্থা হলো তার চেয়ে অনেক মারাত্মক। মেডিক্যাল অফিসার বলে একমাত্র তাকেই যেতে হয়নি ইউনিটের সাথে। কিন্তু তথাকথিত হাসপাতালের বাঁশের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ঘটনাটা দেখে তার আতঙ্ক আরও বাড়ল।
অন্ধকার পুরোপুরি কাটার আগেই ঘুম ভাঙল বাশির শব্দ আর প্রহরীদের চেঁচামেচিতে। ইতোমধ্যেই অফিসার আর সৈন্যরা গিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে যথাস্থানে। নির্দেশ যা দেয়ার আগেই দিয়ে রেখেছেন কর্নেল নিকলসন।
মর্যাদা বজায় রেখে আমরা অবশ্যই সহযোগিতা করব ওদের সাথে, বলেছেন তিনি।
ঠাণ্ডা, স্যাতসেঁতে আবহাওয়ায় দাঁড়িয়ে রইল সবাই। সূর্য ওঠার পর জুনিয়র অফিসার পরিবেষ্টিত হয়ে এঞ্জিনিয়ারের ঠিক আগে আগে হেঁটে আসতে দেখা গেল কর্নেল সাইতোকে। মেজাজ মোটেই ভাল মনে হলো না, কিন্তু কমান্ডিং অফিসারের পেছনে ব্রিটিশ অফিসারদের চোখে পড়তেই আকৰ্ণবিস্তৃত একটা হাসি দিলেন তিনি।
তাঁদের পেছনে পেছনে এসে পৌঁছুল যন্ত্রপাতি বোঝাই একটা ট্রাক। এঞ্জিনিয়ার সেগুলো পরীক্ষা করতে লাগলেন, হঠাৎ কর্নেল নিকলসন এক ধাপ এগিয়ে কথা বলতে চাইলেন সাইটের সাথে। কিছু বললেন না সাইতো, কিন্তু মেঘ জমল মুখে। মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে আরও এগিয়ে গেলেন কর্নেল।
কয়েক মুহূর্ত পরেই তাঁকে ছোট্ট একটা বই দোলাতে দেখা গেল সাইতোর মুখের সামনে–নিশ্চয়ই ম্যানুয়াল অভ মিলিটারি ল-এর বিশেষ কোনও প্যারাগ্রাফের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে চাইছেন। হতচকিত হয়ে পড়লেন সাইতো। গতকালের বক্তৃতার পরেও কেউ তাকে কোনও যুক্তি দেখাতে চাইবে, ব্যাপারটা যেন কল্পনাও করতে পারছেন না। রেগে আগুন হয়ে গেলেন তিনি। কর্নেল নিকলসন কিন্তু এসবের কিছুই টের পেলেন না। প্রত্যেক লাইনে আঙুল দিয়ে দিয়ে তিনি তখন বইটা পড়ছেন মাথা নিচু করে। চিৎকার করে কমান্ডিং অফিসারকে সাবধান করে দিতে চাইলেন ক্লিপটন, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। থাবড়া দিয়ে বইটা উড়িয়ে দিলেন সাইতো, পরমুহূর্তেই চড় কষালেন কর্নেলের গালে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইলেন সাইতো, চোখদুটো যেন যে-কোনও মুহূর্তে বেরিয়ে পড়বে কোর্টর ছেড়ে, সেইসাথে ইংরেজি আর জাপানী মেশানো অকথ্য গালি ছুটেছে ঝড়ের বেগে।
বিস্মিত হওয়া সত্ত্বেও–যেহেতু এরকম আচরণ আশা করেননি–মাথা ঠাণ্ডা রাখলেন কর্নেল নিকলসন। কাদা থেকে বইটা তুলে নিয়ে খুব শান্ত স্বরে তিনি ঘোষণা করলেন:
জাপানী কর্তৃপক্ষ যখন সভ্য পৃথিবীর কোনও আইন মেনে চলতে চায় না, সেক্ষেত্রে আপনাকে শুধু একটা কথাই জানাবার আছে, কর্নেল সাইতো, যে আপনার কথা মান্য করা আর আমাদের কর্তব্যের আওতায় পড়ে না। এবারে আমি ওদের কি আদেশ দিয়েছি, সেটা আপনাকে জানানো উচিত। ব্রিটিশ কোনও অফিসার মজুরের মত পরিশ্রম করবে না।
একটা কথাও না বলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সাইতো, উন্মাদের মত ঘুসি চালাতে লাগলেন কর্নেলের মুখে।
পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। লাইন থেকে বেরিয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে এগিয়ে গেলেন কজন ব্রিটিশ অফিসার। ক্রোধের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল পুরো ইউনিটে। চিক্কার করে নির্দেশ দিল জাপানী নন-কমিশনড়-অফিসারেরা; তৎক্ষণাৎ রাইফেল কক করল সমস্ত সৈন্য। কর্নেল নিকলসন তার অফিসারদের বললেন যথাস্থানে গিয়ে দাঁড়াতে, সৈন্যদের আদেশ দিলেন একচুলও না নড়ার। মুখ বেয়ে রক্ত ঝরছে, কিন্তু তার কতত্ত্ব এতটুকু টোল পায়নি।
কয়েক ধাপ পিছিয়ে হাপাতে লাগলেন কর্নেল সাইতো, যেন রিভলভারটা এখনই টেনে বের করবেন হোলস্টার থেকে। শেষ মুহূর্তে কি যেন ভেবে তিনি সামলে নিলেন নিজেকে, আদেশ দিলেন অত শান্ত কণ্ঠে। সাথে সাথে জাপানী প্রহরীরা ঘিরে ধরল বন্দীদের, এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল নদীর দিকে। ব্রিটিশ অফিসারেরা শুধু দাঁড়িয়ে রইলেন কর্নেল সাইতোর সামনে।
একেবারে স্বাভাবিক ভাবে আবার কথা বলতে লাগলেন সাইতো। লক্ষণটা খুব ভাল মনে হলো না ক্লিপটনের। ধারণা যে ভুল নয়, তার প্রমাণও পেলেন প্রায় হাতেনাতে। কয়েকজন সৈন্য চলে গেল এবং ফিরল দুটো মেশিনগান নিয়ে। সাইলোর দুপাশে মেশিনগান দুটো বসাতেই হিম একটা স্রোত নেমে গেল ক্লিপটনের মেরুদণ্ড বেয়ে। ওদিকে শয্যা ছেড়ে এসে তার চারপাশে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে রোগীরা। কর্কশ চিৎকার করে উঠল তাদের একজন।
ডাক্তার, ওরা নিশ্চয়…না, না, তা কি করে হয়? অতো সাহস হবে না হলুদ বেবুনটার! কি বুড়ো যে গো ধরে আছে!
ক্লিপটনের ধারণা, সাহস ঠিকই পাবে হলুদ বেবুন। সিঙ্গাপুর পতনের পর ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। যন্ত্রপাতি নিয়ে অফিসারদের কাজ শুরু করার আদেশ দিলেন সাইতো।
সে-আদেশ মান্য করতে আবার অস্বীকৃতি জানালেন কর্নেল নিকলসন। এবারে আরেকটা আদেশ দিলেন সাইতো। গুলির বেল্ট পরানো হলো মেশিনগানে।
ডাক্তার, হাঁপাতে লাগল ক্লিপটনের পাশে দাঁড়ানো সৈন্যটা, ডাক্তার, বুড়ো কিছুতেই গো ছাড়বে না। আমাদের এই মুহূর্তে কিছু একটা করা দরকার।
সৈন্যটার কথায় যেন সংবিৎ ফিরে পেলেন ক্লিপটন। হা, কিছু একটা করা দরকার। বুড়োকে বলতে হবে যে স্রেফ নিজের নীতির প্রতি অবিচল থাকার খাতিরে তিনি ইউনিটের সবাইকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারেন না। অন্যান্য ক্যাম্পের সিনিয়র অফিসারেরা ইতোমধ্যেই পশু শক্তির কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছেন। সুতরাং ওই কাজ করলে কর্নেল নিকলসনের মর্যাদা ক্ষুন্ন হতে পারে না। ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেলেন মেজর ক্লিপটন।
এক মিনিট, কর্নেল; আমি ওকে বুঝিয়ে বলছি!
ভ্রুকুটি হানলেন কর্নেল নিকলসন।
আর কিছু বলার নেই, ক্লিপটন। যা করছি সে-সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ সচেতন।
স্কোয়াডের কাছে অবশ্য ক্লিপটন যেতে পারলেন না। দুজন প্রহরী জাপটে ধরল দুদিক থেকে। কিন্তু তাঁর হাত-পা ছোঁড়া দেখে অ্যাকশন নিতে একটু দ্বিধায় পড়ে গেলেন কর্নেল সাইতো। দ্রুত ইংরেজিতে কথা বলে চললেন ক্লিপটন, যাতে জাপানীদের অন্য কেউ বুঝতে না পারে।
সাবধান, কর্নেল, পুরো ঘটনাটাই আমি দেখেছি; সেই সাথে হাসপাতালের চল্লিশজন রোগী। আপনি কোনও ভাবেই পার পাবেন না।
মরিয়া হয়ে হাতের শেষ তাসটাই খেলে ফেললেন ক্লিপটন। এরকম অর্থহীন একটা হত্যাকাণ্ডের জাবাদিহি কর্নেল জাপানী কর্তৃপক্ষকেও দিতে পারবেন না। এখন বন্দীদের সাথে সমস্ত রোগী, এমনকি মেডিক্যাল অফিসারকেও মেরে ফেলতে হবে তার, নয়তো বাদ দিতে হবে প্রতিহিংসার চিন্তাটাই।
ক্লিপটন বুঝতে পারলেন, সাময়িক একটা বিজয় তার হয়েছে। রাগে কাঁপতে লাগলেন কর্নেল সাইতো, কিন্তু গুলি করার কোনও আদেশ দিলেন না।
আসলে কোনও আদেশই দিলেন না সাইতো। কারণ, সৈন্যদের চলে যেতে বললেও তার মর্যাদা হানি হবে। ফলে প্রায় দুপুর পর্যন্ত মেশিনগান নিয়ে বসে থাকতে হলো বেচারিদের।
ক্ষণস্থায়ী বিজয় অর্জন করেও খুশি হলেন ক্লিপটন। ভাগ্যে কি আছে, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে, তবু আপাতত তো বন্ধ করা গেছে নশংস কাটা! অফিসারদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো বন্দী শিবিরের দিকে। সাইরে বিশালদেহী দুই কোরিয়ান দেহরক্ষী এক রকম হেঁচড়েই নিয়ে চলল কর্নেল নিকলসনকে। নিজের অফিসে বন্দীকে ঢুকিয়েই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন সাইতো। পরমুহূর্তেই প্রচণ্ড মারের শব্দে শিউরে উঠলেন ক্লিপটন।
০৫.
আধঘণ্টা পেটানোর পর কর্নেলকে বন্দী করা হলো বিছানা আর চেয়ারবিহীন একটা কুটিরে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও যখন আর রইল না, স্যাতসেঁতে মাটির ওপরেই শুয়ে পড়তে বাধ্য হলেন তিনি। খাবার বলতে তাকে দেয়া হলো মাত্রাতিরিক্ত লবণ দেয়া এক বাটি ভাত। সাইতো সাবধান করে দিনেল যে তার আদেশ মানতে রাজি না হওয়া পর্যন্ত কর্নেলকে এখানেই আটকে রাখা হবে।
পুরো এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি দেখতে পেলেন শুধু গরিলার মত এক কোরিয়ান রক্ষীকে। শয়তানটা ভাতের সাথে আরও বেশি করে লবণ মেশায়। দাঁতে দাঁত চেপে কয়েক গ্রাস খেয়ে নেন তবু, তারপর গা এলিয়ে দেন মাটির ওপরে। কুটির ছেড়ে কোথাও যাবার অনুমতি নেই তার, ফলে নানারকম দুর্গন্ধে জায়গাটা পরিণত হয়েছে নরকে।
সপ্তাহ শেষে ক্লিপটনকে দেখা করতে দেয়া হয়। কিন্তু একটু আগে তাঁকে নিজের অফিসে ডেকে পাঠান সাইতো।
এসবের জন্যে আমি মোটেই দায়ী নই, বললেন, তিনি ঠাণ্ডা গলায়। নদীর ওপরে সেতুটা আমাকে তৈরি করতেই হবে। ওকে বুঝিয়ে বলল যে হার মানার পাত্র আমি নই। ধন্যবাদ জানাবে ওকে, ওর অফিসারদেরও জানাচ্ছি ধন্যবাদ। এরপরেও যদি উনি সন্তুষ্ট না হন, ওঁর বোকামির জন্যে ভুগতে হবে সাধারণ সৈন্যদের। এখন পর্যন্ত তোমার কোনও কাজে আমি হস্তক্ষেপ করিনি। যারা সিক লিস্টে আছে, তাদের অব্যাহতি দিয়েছি কাজ থেকে। কিন্তু উনি যদি মনোভাব না বদলান, তা হলে ধরে নেব, আমার দয়াকে উনি বিবেচনা করেছেন দুর্বলতা হিসেবে।
এরপর ক্লিপটনকে নিয়ে যাওয়া হলো বন্দীর কাছে। গত কদিনে কমান্ডিং অফিসারের স্বাস্থ্যের যে অবনতি হয়েছে, তা দেখে রীতিমত আঁতকে উঠলেন তিনি। গলা এমন বসে গেছে যে তার কথা শোনা যায় কি যায় না। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লিপটন বুঝতে পারলেন, পরিবর্তনটা শুধু বাইরে ঘটেছে। অন্তরের তেজ কর্নেলের এতটুকু কমেনি। যেসব যুক্তি তৈরি করে নিয়ে এসেছিলেন, সমস্ত তালগোল পাকিয়ে গেল। কর্নেল নিকলসন বললেন:
সবাইকে জানিয়ে দাও যে আমার মতে আমি অনডু আছি। কোনভাবেই ব্যাটালিয়নের একজন অফিসারকেও আমি মজুরের মত খাটতে দেব না।
কুটির থেকে বেরিয়ে এলেন ক্লিপটন। আবার তিনি পড়ে গেছেন সেই পুরনো দোটানায়। বুঝে উঠতে পারছেন না, কী করবেন? মহাবীর হিসেবে পুজো করবেন লেকটিকে, নাকি মহামূখ হিসেবে বাতিল করে দেবেন?অধীর আগ্রহে তার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন সাইতো। দেখার সাথে সাথে চোখ নাচালেন:
কি খবর?
জবাব দেয়ার আগে কর্নেলের মানসিক অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করলেন ক্লিপটন। তারপর ভাবলেন, ব্যাপারটা খোলাখুলি বলাই ভাল।
কর্নেল নিকলসন আপনার আদেশ মেনে চলতে রাজি নন। আর তাকে যেভাবে রাখা হয়েছে, তাতে আদেশ মানার পরামর্শ দেয়ার কোনও ইচ্ছেও আমার হয়নি।
কর্নেল নিকলসনের মতই হেগ কনভেনশনের উদ্ধৃতিসহ প্রতিবাদ জানালেন ক্লিপটন। বললেন, বন্দীকে যেভাবে রাখা হয়েছে তা হত্যকাণ্ডের শামিল। এরপর বিষয়টা তিনি বোঝাতে লাগলেন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। যেমনটা ভেবেছিলেন ক্লিপটন, তেমন কোনও আচরণ করলেন না সাইতো। বরং বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, এসব কিছুর জন্যে কর্নেল নিকলসনই দায়ী। তারপর হঠাৎ করে বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। ক্লিপটনের মনে হলো, সাইতো মানুষ হিসেবে খুব একটা খারাপ নন। কিন্তু কাজগুলো তাকে করতে হচ্ছে ভয়ে। সিনিয়র অফিসারেরা চাপ দিচ্ছেন সেতু তৈরির জন্যে, ওদিকে জুনিয়র অফিসারদের পক্ষে দেখা দিয়েছে মর্যাদা হারানোর সম্ভাবনা।
পরের সপ্তাহে সাইতো গেলেন কর্নেলের সাথে দেখা করতে। ভাবে জানতে চাইলেন, তিনি স্বাভাবিক আচরণ করতে চান কিনা। কর্নেল বললেন, এ-বিষয়ে আলোচনার তার কিছু নেই। তৎক্ষণাৎ সংযম হারিয়ে সাইতো রূপান্তরিত হলেন জানোয়ারে। প্রচণ্ড মার লাগালেন বন্দীকে, প্রহরীটাও বাদ গেল না। উদ্যত রিভলভার হাতে পায়চারি শুরু করলেন সাইতো। বললেন, শৃঙ্খলা রক্ষার খাতিরে এটা ব্যবহার করবেন তিনি নির্দ্বিধায়।
নাক গলাতে গিয়ে কয়েকটা ঘুসি খেলেন ক্লিপটন। চলনশক্তিরহিত রোগী ছাড়া আর সবাইকে নিয়ে গিয়ে লাগিয়ে দেয়া হলো ভারবহনের কাজে। বেশ কয়েক দিন আবহাওয়া থমথমে হয়ে রইল কওয়াই নদীর ক্যাম্পে।
সাইতোর ব্যক্তিত্ব অনেকটা ডাক্তার জেকিল আর মি, হাইডের মত। এমনিতে তিনি মোটামুটি ডাক্তার জেকিলের মতই থাকেন, কিন্তু মাঝেমাঝে পেরে ওঠেন না মি. হাইডের সাথে। কয়েক দিন পর আবার তিনি ঢুকে পড়লেন ডাক্তার জেকিলের খোলসে। পূর্ণ রেশন বরাদ্দ করা হলো কর্নেল নিকলসনের নামে। চিকিৎসা করার অনুমতি পেলেন ক্লিপটন। শুধু তা-ই নয়, সাইতো তাকে সাবধান করে দিলেন যে রোগীর কিছু হলে তার পুরো দায়দায়িত্ব মেডিক্যাল অফিসারকে বহন করতে হবে।
এক সন্ধ্যায় বন্দীকে নিজের ঘরে ডেকে এনে প্রহরীদের বিদায় করে দিলেন কর্নেল সাইতো। ড্রয়ার থেকে বেরোল এক টিন আমেরিকান কর্নড় বীফ, কিছু সিগারেট আর এক বোতল হুইস্কি। বললেন, সৈনিক হিসেবে তার আচরণের প্রশংসা না করে তিনি পারছেন না। কিন্তু যুদ্ধ যুদ্ধই, এর জন্যে কাউকে দায়ী করা চলে না। তা ছাড়া নিকলসন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, সাইতোরও ওপরঅলা আছে। সেই ওপরঅলাদের নির্দেশ, যত শিগগির সম্ভব সেতুটা নির্মাণ করতে হবে। সুতরাং যত বেশি সম্ভব লোক নিয়োগ না করে তার কোনও উপায় নেই। কর্নড় বীফ, সিগারেট, হুইস্কি কিছুই নিলেন না কর্নেল নিকলসন, কিন্তু কথাগুলো শুনলেন মনোযোগ দিয়ে। সবশেষে বললেন, এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ সম্পন্ন করার বিন্দুমাত্র যোগ্যতা সাইতোর নেই।
এরপর তর্কবিতর্ক শুরু হয়ে গেল দুজনের মধ্যে। হাবভাবে মনে হলো, এই তর্ক বুঝি আর শেষ হবে না। কিন্তু এক পর্যায়ে সাইতো চুপ করতেই কর্নেল বলে উঠলেন:
কাজের অগ্রগতি নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট, কর্নেল সাইতো?
বিদ্রুপাত্মক এই প্রশ্নে রাগে ফেটে পড়তে পারতেন সাইতো, কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। বিড়বিড় করে কী সব বললেন তিনি। তারপর বন্দীর হাতে এক গ্লাস হুইস্কি ধরিয়ে দিয়ে, নিজের গ্লাসটা ভরে নিয়ে স্পষ্ট করলেন গলা:
দেখুন, কর্নেল নিকলসন, আমি কিন্তু আপনাকে কাজ করার আদেশ দিইনি।
অন্য অফিসারদের…
আমার কোনও অফিসারই কাজ করবে না, গ্লাসটা কর্নেল নামিয়ে রাখলেন টেবিলের ওপর।
বিরক্তি গোপন করে মুখে শান্ত একটা ভাব ফুটিয়ে রাখলেন কর্নেল সাইতো।
বললেন, গত কদিন যাবৎ এ-কথাটাই ভাবছি। মেজর থেকে ওপারের অফিসারদের প্রশাসনিক দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। শুধু জুনিয়র অফিসারদের একটু…।
কোনও অফিসারই মজুরের মত খাটবে না, বললেন কর্নেল নিকলসন। অফিসারের কাজ হলো সৈন্যদের আদেশ দেয়া।
আর সামলাতে পারলেন না কর্নেল সাইতো।
রক্তাক্ত দেহ অথচ প্রফুল্ল মন নিয়ে ফিরে এলেন কর্নেল নিকলসন। বুঝতে তার বাকি নেই, শক্রর আত্মসমর্পণ করাটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
পরের পর্ব :
০৬-১০. কাজের অগ্রগতির প্রশ্ন
১১-১৫. পাশ্চাত্যের মানুষের সেতুর ধারণা
১৬-২০. সারারাত না ফেরায় উদ্বিগ্ন
২১-২৫. কওয়াইয়ের কলধ্বনি