২.১৩ চ্যারিং ক্রস
জোনাথন হারকারের ডায়েরী থেকে
১৫ অক্টোবর, ভার্না।
চ্যারিং ক্রস অতিক্রম করলাম আমরা ১২ অক্টোবর সকালে, এবং প্যারীতে এসে পৌঁছুলাম সেদিনই রাতে। আগেই আসন সংরক্ষিত করা ছিল ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে, তাই বেশ আরামেই এসেছি সারাটা পথ। ট্রেন থেকে নেমেই তাঁর নামে কোন তারবার্তা এসেছে কিনা বাণিজ্য প্রতিনিধির দফতরে খোঁজ নিয়ে তা জানতে গেছেন লর্ড গোডালমিং। আমরা গিয়ে উঠলাম ওডেসাস হোটেলে।
সমস্ত শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে আবার তার স্বাভাবিক উচ্ছলতায় ফিরে এসেছে মিনা। প্রায়ই ভোরের আগে ওকে সম্মোহন করে কাউন্ট ড্রাকুলার খোঁজ জেনে নেন প্রফেসর। তবে এ পর্যন্ত জাহাজের গায়ে ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি ছাড়া আর কিছু বলছে না সে। অর্থাৎ এখনও মাঝ দরিয়ায় রয়েছে জারিনা ক্যাথেরিন।
১২ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত চারদিনে আসা চারটে টেলিগ্রাম নিয়ে একটু পরই হোটেলে ফিরে এলেন লর্ড গোডালমিং। লণ্ডন ছেড়ে আসার আগেই লয়ার্ড জাহাজ কোম্পানীর সাথে বন্দোবস্ত করে এসেছিলেন তিনি, জারিনা ক্যাথেরিনের খবরাখবর জানিয়ে যেন ওকে রোজ একটা করে টেলিগ্রাম করা হয়। কথা রেখেছে লয়ার্ড কোম্পানী। এ পর্যন্ত পাওয়া চারটে খবরই এক-ভার্নার বন্দরে পৌঁছতে এখনও দেরি আছে জারিনা ক্যাথেরিনের। জাহাজ বন্দরে না ভেড়া পর্যন্ত কিছুই করার নেই আমাদের। তবে এর ভেতর সহকারী বাণিজ্য দূতের সাথে দেখা করে যেভাবেই হোক তার কাছ থেকে বাক্সটা পরীক্ষা করে দেখার একটা অনুমতিপত্র নিতে হবে। লর্ড গোডালমিং আশ্বাস দিলেন, কাজটা করতে পারবেন তিনি।
১৬ অক্টোবর।
লয়ার্ড কোম্পানীর তারবার্তায় জানা গেল দারদানেলস অতিক্রম করেছে জারিনা ক্যাথেরিন।
১৭ অক্টোবর।
বাণিজ্য দূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাক্সটা খুলে দেখার অনুমতিপত্র জোগাড় করে ফেলেছেন লর্ড গোডালমিং। এমনকি জাহাজটা বন্দরে ভেড়ার আগে আমাদেরকে খবর দেবার ব্যবস্থা করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাণিজ্য দূত। আমাদের মধ্যে আলোচনার পর ঠিক হয়েছে, বাক্স খোলর পর কাউন্ট ড্রাকুলাকে পাওয়া গেলেই তাকে হত্যার দায়িত্ব নেবেন প্রফেসর স্বয়ং, এবং ডাক্তার সেওয়ার্ড তাঁর সহকারী। মরিস, লর্ত গোডালমিং আর আমি থাকব পাহারায়। প্রয়োজন মনে করলে আমাদের কাজে বাইরের অনধিকার চর্চাকারীকে আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে ঠেকিয়ে রাখব। কারণ এবার সুযোগ হারালে শয়তানটাকে আবার হাতের মুঠোয় পাওয়া সহজ হবে না।
২৪ অক্টোবর।
পুরো এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে, এখনো জারিনা ক্যাথেরিনের কোন খবর নেই। অথচ দারদালেস থেকে ওটার ভার্না পৌঁছতে চব্বিশ ঘণ্টাও লাগার কথা নয়।
২৫ অক্টোবর।
আজও কোন খবর নেই। সম্মোহিত অবস্থায় মিনা জানাল, এখনো ঢেউয়ের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না সে। অর্থাৎ এখনো দূর সাগরেই রয়ে গেছে জারিনা ক্যাথেরিন।
২৬অক্টোবর।
লয়ার্ড কোম্পানীর তারবার্তায় জানা গেল জারিনা ক্যাথেরিনের সাথে ওদের সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রফেসরের ধারণা, প্রচণ্ড কুয়াশার জন্যে মাঝ সাগরের কোথাও আটকে পড়েছে জাহাজটা।
২৭ অক্টোবর।
খবর নেই আজও। উত্তেজনা আর হতাশায় মরিয়া হয়ে উঠেছি সবাই। সবচেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন প্রফেসর। তার ধারণা, আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে জারিনা ক্যাথেরিনকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে ড্রাকুলা। এক রাতে বেশ কয়েকবার মিনাকে সম্মোহিত করেও তেমন কিছু জানা যায়নি।
২৮ অক্টোবর।
লয়ার্ড কোম্পানীর তারবার্তায় আজ খোঁজ পাওয়া গেছে জারিনা ক্যাথেরিনের। আজ দুপুর একটায় নাকি গালেজ-এ প্রবেশ করবে জাহাজটা। কিন্তু গালেজ-এ যাবার তো কথা ছিল না ওটার।
.
ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে
২৮ অক্টোবর।
জারিনা ক্যাথেরিন গালেজ-এ ঢাকায় খুব একটা অবাক হলাম না, যদিও গালেজ-এ যাবার কথা ছিল না ওটার। আসলে এমনি একটা অভাবনীয় কিছু ঘটার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমরা। খবর শুনে শান্তভাবে মিনাকে বললেন প্রফেসর, দেখ তো মা, গালেজ-এ যাবার ট্রেন কটায়?
রেলওয়ে টাইম টেবল-এর পাতা উল্টে দেখে নিয়ে বলল মিনা, চব্বিশ ঘণ্টায় মাত্র একটা ট্রেন, রাত একটা ছত্রিশ মিনিটে।
ওতেই যাব, জিনিসপত্র গোছগাছ করে নাও তুমি। জোনাথন, টিকিট কাটার ভার তোমার ওপর। আর্থার, জাহাজ দপ্তরের প্রতিনিধির সাথে দেখা করে একটা অনুমতিপত্র নিয়ে আসবে, যাতে গালে-এ বাক্সটা পরীক্ষা করে দেখতে আমাদের কোন অসুবিধা না হয়। মরিস, সহকারী বাণিজ্য দূতের সাথে দেখা করে আর একটা অনুমতিপত্র সংগ্রহ করবে তুমি, তাহলে বাক্সটা খুলতে আর কেউ বাধা দিতে পারবে না আমাদের। জন আর আমি আগামীদিন কি করে কি করব তার একটা প্ল্যান তৈরি করে ফেলছি।
মিস্টার হারকার, আর্থার আর মসি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর মিসেস হারকারকে বললেন প্রফেসর, মিনা, যাও তো মা, জোনাথনের ট্রানসিলভেনিয়া ভ্রমণ কাহিনী লেখা আসল ডায়েরীটা নিয়ে এসো। গলেজ থেকে কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদ পর্যন্ত যাবার একটা সংক্ষিপ্ত পথের নকশা বের করে ফেলতে চাই। আর… সরাসরি মিসেস হারকারের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন প্রফেসর, তার সঙ্গে যদি তোমার হাতের তৈরি একটু কফি হয়…।
এখুনি যাচ্ছি আমি, বলে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন মিসেস হারকার।
উনি চলে যেতেই আমার দিকে ফিরে বললেন প্রফেসর, একটা কথা হয়ত তোমাকে পরে বলার সুযোগ নাও পেতে পারি, জন, আগে থেকেই বলে রাখছি, বার বার মিনাকে সম্মোহিত করেছি আমি এবং করেছি রাতের বেলা। ড্রাকুলা জেনে গেছে যে মিনাকে সম্মোহিত করে আমরা তার খোঁজ নেবার চেষ্টা করছি, আর জানাটা তার পক্ষে স্বাভাবিক। কারণ মিনার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে সে, আমরাও করছি। তোমার জানা আছে একই দেশে দুই রাজা রাজত্ব করতে পারে না, তেমনি একই জায়গায় দুটো শক্তি প্রয়োগ করলে দুর্বলটা হটে যেতে বাধ্য। কাউন্টের শক্তি আমাদের চাইতে দুর্বল হয়ে পড়েছে মিনার সঙ্গে সঙ্গে রাখা কুশ আর ধুনোর জন্যে। ও দুটোকে দারুণ ভয় পায় কাউন্ট, অথচ আমাদের শক্তির উৎসই হল জিনিস দুটো, সুতরাং ক্ষমতার যুদ্ধে হেরে গিয়ে বুঝে গেছে পিশাচটা আসল ব্যাপার, কি করে আমরা তার খোঁজখবর করছি। তাই নিজেকে বাঁচানোর জন্যে দারদানেলস-এ প্রবেশ করার পর প্রচণ্ড কুয়াশার সৃষ্টি করে জারিনা ক্যাথেরিনের গতিপথ ভুল করিয়ে গালেজ-এ নিয়ে ফেলেছে সে জাহাজটাকে। তাহলে তুরস্কের মধ্যে দিয়ে সহজেই তার এলাকায় ঢুকে যেতে পারবে সে। আর ওর এলাকায় একবার ঢুকে যেতে পারলে অনেক অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়বে পিশাচটা।
এই সময় কফি আর ডায়েরী বুকটা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন মিসেস হারকার। কফি খেতে খেতে ভবিষ্যৎ প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম আমরা।
২৯ অক্টোবর!
ট্রেনে করে ভার্না থেকে গালেজ-এর দিকে চলেছি আমরা। যার যার ওপর দায়িত্ব দেয়া কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করে সন্ধ্যার দিকে আবার আমরা সবাই মিলিত হয়েছিলাম গতকাল, সেই সময়ই একবার মিসেস হারকারকে সম্মোহন করলেন প্রফেসর। মিসেস হারকার বললেন, ঢেউয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে না আর। তার বদলে দূরে বহু মানুষের কাটা কাটা কথা শোনা যাচ্ছে। অস্পষ্ট আলোর রেখা চোখে পড়ছে…হঠাৎ এলোমেলো ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করেছে…দূর থেকে ভেসে আসছে এক আধটা নেকড়ের গর্জন…এই সময়ে বেশিক্ষণ মিসেস হারকারকে সম্মোহিত করে রাখলে নতুন কোন পদ্ধতিতে তার ওপর অশুভ প্রভাব ফেলে বসতে পারে কাউন্ট ড্রাকুলা, এই ভয়ে তাড়াতাড়িই তাকে সম্মোহন মুক্ত করে দিলেন প্রফেসর। মিসেস হরকারের ছাড়া ছাড়া কথাগুলোকে বিশ্লেষণ করে মন্তব্য করলেন তিনি, এখন নৈশ ভ্রমণে বেরিয়েছে কাউন্ট ড্রাকুলা।
৩০ অক্টোবর, সকাল।
গালেজ-এর খুব কাছাকাছি এসে পড়েছি। এখন সাতটা বাজে। প্রায় তিন ঘণ্টা লেট করেছে ট্রেন, নাহলে ভোর চারটায়ই গালেজ-এ পৌঁছে যাবার কথা। ভোরের আগে একবার মিসেস হারকারকে সমোহিত করে জানা গেল, আমার চারদিকে এখন গাঢ় অন্ধকার কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেবল চাকার একটানা ঘড় ঘড় শব্দ…চাবুকের শন শন…হ্রেষাধ্বনি ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না.. ভীষণ দুলছি…কে যেন জঘন্য ভাষায় গালাগাল দিল একটা… এর পরই মিসেস হারকারকে সম্মোহন মুক্ত করে দিয়েছিলেন প্রফেসর।
হঠাৎ ধীরে ধীরে কমতে লাগল ট্রেনের গতি। কুলিদের হাঁক-ডাকও আবছা ভাবে কানে এসে বাজছে। তাহলে গালেজ-এ পৌঁছে গেছে ট্রেন।