২.০৯ হারকার দম্পতি
ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে
৩০ সেপ্টেম্বর।
গত রাতে হারকার দম্পতিকে নিয়ে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। সদ্য ঘুম থেকে উঠে মুখ হাত ধুয়ে অপেক্ষা করছি এমন সময় ঘরের দরজায় টোকা পড়ল, আসতে পারি? মিসেস হরকারের কণ্ঠস্বর।
নিশ্চয়ই! আসুন! সানন্দে অভ্যর্থনা জানালাম।
হাসিমুখে ঘরে এসে ঢুকলেন হারকার দম্পতি। আপনার সাথে একটু গল্প করার লোভ সামলাতে পারলাম না। তা খুব ব্যস্ত নাকি? জিজ্ঞেস করলেন মিসেস হারকার।
আরে না-না। আসলে আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম আমি। গতকাল রাতেই আলাপ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় সে ইচ্ছে ত্যাগ করতে হল। আরে, দাঁড়িয়ে রইলেন যে, বসুন না?
চেয়ারটা টেনে নিয়ে এসে ঠিক আমার মুখোমুখি বসলেন মিসেস হারকার। পরিচ্ছন্ন ঘরোয়া পোশাকে অপূর্ব লাগছে ওকে। কোণের দিকের একটা চেয়ারে, বসলেন মিস্টার হরকার।
এর আগে আপনাকে না দেখলেও আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছি লুসির মুখে, বললেন মিনা হারকার। রোগের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লুসির শয্যাপার্শ্বে ছিলেন আপনি। কিছু মনে না করলে আপনার মুখ থেকেই সে-সম্পর্কে সব কথা শুনতে চাই।
না, না, মনে করার কি আছে। তবে… মিসেস হরকারের চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলাম হঠাৎ।
মিষ্টি করে হাসলেন মিসেস হারকার, থামলেন কেন? বলুন।
বলতে বাধা নেই, মিসেস হারকার, কিন্তু সব কথা বিশ্বাস করবেন কিনা সন্দেহ।
নিঃসংকোচে বলতে পারেন, ডাক্তার সেওয়ার্ড।
তাহলে নিন, টেবিলের ড্রয়ার থেকে আমার ডায়েরীটা বের করে মিসেস হারকারের দিকে এগিয়ে দিলাম। সময় মতো পড়ে দেখবেন এটা। সব কথা জানতে পারবেন।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, ডাক্তার, ডায়েরীটা পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন মিসেস হারকার।
এই সময় চাকর এসে জানাল, টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে ডাইনিং রুমের দিকে পা বাড়ালাম আমরা।
খেতে খেতেই আলাপ জমে উঠল মিস্টার হরকারের সঙ্গে। কথায় কথায় জানা গেল স্যামুয়েল এফ বিলিংটন অ্যাণ্ড সন-কে লেখা চিঠির জবাব পেয়েই কাঠের বাক্সগুলো পাঠানোর তদন্ত করতে হইটবিতে গিয়েছিলেন ওঁরা।
ওখানকার কাজ শেষ হয়েছে আপনার?
হয়েছে, পাইপে তামাক ঠাসতে ঠাসতে বললেন মিস্টার হারকার। শুধু বিলিংটনই নয়, কিংস ক্রস রেলস্টেশন, এমনকি মেসার্স কার্টার অ্যাণ্ড প্যাটারসন কোম্পানীতেও হানা দিয়েছি আমি। এতে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেছে, কাউন্ট ড্রাকুলার পাঠানো মাটি ভর্তি পঞ্চাশটা কাঠের বাক্স ডিমেটার জাহাজে করে ঠিকমতই ভার্না থেকে হুইটবিতে গিয়ে পৌঁছেছিল। অবশ্য বাক্সগুলো এখন কোথায় জানি না আমি।
চকিতে একটা সম্ভাবনার কথা মনে পড়ে গেল আমার। আমার হাসপাতালের নার্সের কাছে শুনেছিলাম, গত পরশু কারফাক্সের পুরানো গির্জা থেকে কয়েকটা বাক্স ঠেলাগাড়ি করে সরিয়ে নেয়ার সময় ঠেলাঅলা দুজনকে খুন করে ফেলতে যায় রেনফিল্ড। তাহলে বাক্সগুলো কোথায় সরিয়ে নেয়া হচ্ছে জানে কি নার্স?
আমার বাড়ির আশপাশের জায়গাটা একটু ঘুরে দেখবেন বলে উঠে পড়লেন হারকার দম্পতি। পড়ার ঘরে ফিরে এসে প্রফেসরের দেয়া মিস্টার হরকারের ডায়েরীর টাইপ করা কপিটা পড়তে বসলাম, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অদ্ভুত এক জগতে প্রবেশ করলাম আমি। পড়তে পড়তে কোন্ দিক দিয়ে যে সময় কেটে গেল টেরই পেলাম না। পড়া শেষ হলেও অনেকক্ষণ গুম মেরে বসে বসে ভাবতে থাকলাম। কাউন্ট ড্রাকুলার আশ্চর্য কাহিনী পড়ার পর কতগুলো অদ্ভুত চিন্তায় পেয়ে বসল আমাকে। পুরানো গির্জায় গিয়ে কার সাথে কথা বলে রেনফিল্ড? স্বাভাবিক বাদুড়ের মত ওড়ে না, জ্যোৎস্না রাতে দেখা ওই বাদুড়টার সাথে কোন সম্পর্ক আছে কি কাউন্ট ড্রাকুলার? লুসির মৃত্যুর জন্য দায়ী কি ওই রক্তলোভী পিশাচটাই? হঠাৎ মিসেস হারকারের দরজায় টোকা দেবার শব্দে চমক ভাঙল আমার, ফিরে এসেছেন ওঁরা।
বিকেলের দিকে আমাকে ধরলেন মিসেস হারকার, ডাক্তার সেওয়ার্ড, দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর আপনার ডায়েরীটা পড়ে জানতে পারলাম অনেক কিছুই। কিন্তু এখন আমার একটা অনুরোধ রাখতে হবে আপনাকে। রেনফিল্ড সম্পর্কে দারুণ কৌতূহল বোধ করছি আমি। চলুন না, দয়া করে পাগলটাকে একবার দেখাবেন আমাকে।
আপত্তি নেই, চলুন।
মিসেস হারকারকে নিয়ে ঢাকার আগে মজা করার জন্যে আমি একা একবার রেনফিন্ডের কাছ থেকে অনুমতি নিতে ঢুকলাম ওর ঘরে। বিছানায় চিৎ হয়ে সটান শুয়ে আছে রেনফিল্ড। আমাকে ঢুকতে দেখে গম্ভীর ভাবে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। ওকে বললাম, একজন মহিলা দেখা করতে চান তোমার সাথে, রেনফিল্ড।
ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল সে, কেন?
এমনি, হাসপাতাল পরিদর্শন করতে এসেছেন উনি। হাসপাতালের জ্ঞানী লোকদের সাথে পরিচিত হবার তার ভারি ইচ্ছে।
ঠিক আছে, নিয়ে আসুন, অনুমতি দিল রেনফিল্ড। হঠাৎ তড়াক করে উঠে পড়ল সে বিছানা থেকে। না, দাঁড়ান, ঘরটা পরিষ্কার করে নিই একটু। বলেই অদ্ভুত কায়দায় ঘর গোছাতে শুরু করল রেনফিল্ড। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর বাক্স খুলে সবকটা মাছি আর মাকড়সা মুখে পুরে গিলে ফেলল সে। ঘরের এখানে ওখানে ভালমত খুঁজে পেতে দেখল আর কোন মাছি, মাকড়সা বা ওই জাতীয় কোন জীবন্ত প্রাণী আছে কিনা। নেই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে বিছানার ওপর থেকে একটা বালিশ এনে ওর বাক্সটার ওপর বিছিয়ে গম্ভীর ভারিক্কি চালে ওটার ওপর গিয়ে আরাম করে বসল রেনফিল্ড। তারপর অনেকটা হুকুমের মত করে বলল আমাকে, যান নিয়ে আসুন ওকে। রেনফিল্ডের রকমসকম দেখে ভীষণ হাসি পেল কিন্তু ও আবার দুঃখ পাবে মনে করে হাসলাম না।
আমার সাথে রেনফিল্ডের ঘরে ঢুকেই অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে রেনফিন্ডের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে হেসে বললেন মিসেস হারকার, আপনার সাথে
পরিচিত হয়ে দারুণ খুশি হলাম, মিস্টার রেনফিল্ড।
সঙ্গে সঙ্গে মিসেস হারকারের কথার জবাব দিল না রেনফিল্ড, বাড়িয়ে ধরা হাতের দিকেও হাত বাড়িয়ে দিল না। বরং গভীর পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে মিসেস হারকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আপন মনেই বলল সে, হ, ভয়ঙ্কর বিপদ এগিয়ে আসছে দেখতে পাচ্ছি।
কিসের বিপদ, কার বিপদ, রেনফিল্ড? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
বিজ্ঞের মত মাথা দোলাল রেনফিল্ড। কিন্তু আমার কথার জবাব দিল না। মিসেস হারকারের দিকে চেয়ে বলল, এখানে এসেছেন কেন?
আপনাকে দেখতে, মিষ্টি হেসে জবাব দিলেন মিসেস হারকার।
মস্ত ভুল করেছেন আপনি, মিসেস হারকার। আজ রাতেই উনি আসবেন আমার এখানে। আপনার গায়ের গন্ধও পেয়ে যাবেন। তারপর, তারপর আপনাকে খুঁজে বের করতে কিছুমাত্র বেগ পেতে হবে না তাকে।
কে আসবেন, কেন আসবেন, রেনফিল্ড? আর মিসেস হারকারের নামই বা জানলে কিভাবে তুমি? বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
হে হে করে সেঁতো হাসি হেসে বলল রেনফিল্ড, কে আসবেন? বললে চিনবেন নাকি তাকে? আর মিসেস হরকারের নাম জানলাম কিভাবে জিজ্ঞেস করছেন? এ সাধারণ কথাটা জানতে না পারলে মিছিমিছিই এতদিন সাধনা করলাম?
রেনফিন্ডের কথার মাথামুও কিছুই বুঝতে পারলাম না। বুঝলাম ওর পাগলামিটা আবার রড়তির দিকে। ওর সাথে আর কথা বলে লাভ নেই ভেবে বেরিয়ে আসতে ইশারা করলাম মিসেস হারকারকে। হাসিমুখে রেনফিন্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি, আচ্ছা, চলি মিস্টার রেফিন্ড, সময় করে আবার দেখা করব আপনার সাথে।
যেন আঁতকে উঠল রেনফিল্ড, না, না, ভুলেও আর এখানে আসবেন না আপনি। আজ যদি ভালোয় ভালোয় ওঁর অসাধারণ ঘ্রাণশক্তি থেকে রক্ষা পেয়ে যেতে পারেন তাহলেই মনে করবেন মস্ত ফাঁড়া কেটে গেছে। অবশ্য সে সম্ভাবনা খুবই কম। অত্যন্ত সাবধানে থাকবেন, মিসেস হারকার। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ওঁর ব্যাপারে আপনারাও একটু হুঁশিয়ার থাকবেন, ডার।
রেনফিন্ডের কথায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। কি বোঝাতে চাইছে রেনফিল্ড? অবশ্য বেশিক্ষণ ভাবলাম না সেকথা। পাগলের প্রলাপ ভেবে দূর করে দিলাম চিন্তাটা মন থেকে।
.
মিনা হারকারের ডায়েরী থেকে
৩০ সেপ্টেম্বর, গভীর রাত।
সন্ধ্যার পর ডাক্তার সেওয়ার্ডের পড়ার ঘরে জরুরী বৈঠক বসল আমাদের। গোল টেবিলটা ঘিরে বসেছি আমি, জোনাথন, লর্ড গোডালমিং, মিস্টার মরিস, ডাক্তার সেওয়ার্ড আর প্রফেসর ভ্যান হেলসিং। একবার কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে কথা শুরু করলেন প্রফেসর, আজ এক বিশেষ প্রয়োজনে সবাই এখানে জমায়েত হয়েছি আমরা। এক ভয়ঙ্কর অদৃশ্য শত্রু প্রতিনিয়ত আমাদের পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাকে কোথায়, কখন, কিভাবে ঘায়েল করব সে বিষয়েই আজ আলোচনা করব। কিন্তু তার আগে শক্রর চরিত্র সম্পর্কে কিছু বলে নেয়া প্রয়োজন তোমাদের। আমাদের মধ্যে কেউই ভ্যাম্পায়ার বা রক্তচোষা বাদুড়ের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারবে না। এই রক্তচোষা বাদুড়ের সাথে তুলনা করা যায় আমাদের শত্রুকে। জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও ব্যাপারটা সম্পর্কে প্রথমে নিশ্চিন্ত হতে পারিনি আমি। অশরীরী এক পিশাচ লুসির রক্ত খেয়ে দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে, এটা প্রথমেই ধরতে পেরেছিলাম, কিন্তু কোন আকৃতিতে সে আসে যায় সেটা বুঝতে যথেষ্ট সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাকে।
ভয়ঙ্কর এই পিশাচেরা যে-কোন মুহূর্তে যে-কোন প্রাণীর আকৃতি ধারণ করতে পারে। ঝড়, বৃষ্টি, বজের মত যে-কোন প্রাকৃতিক শক্তিকেও ব্যবহার করতে পারে চোখের পলকে। হতে পারে ছোট বড় যা খুশি। সাধারণতঃ নেকড়ে বা বাদুড়ের রূপ নিতেই বেশি ভালবাসে ওরা। ড্রাকুলার প্রাসাদ দুর্গে জ্যোৎস্না প্রাবিত গভীর রাতে ধূলিকণা থেকে তাদের মানুষে রূপ নিতেও দেখেছে জোনাথন। নিজেদের চারপাশে ঘন কুয়াশা বা ঝড়ের পরিমণ্ডল সৃষ্টি করতে পারে এই অশুভ শক্তিরা, ডিমেটার জাহাজের ঘটনা এর জ্বলন্ত প্রমাণ। শুধু তাই নয়, যখন যেখানে খুশি অবাধে যাতায়াত করতে পারে এরা, এমন কি ডারি ডালাবন্ধ কফিনের মধ্যে থেকেও এই পিশাচদের ভীষণ অমানুষিক শক্তি যে কতটা হতে পারে তা আমাদের কল্পনারও বাইরে।
কিন্তু, এত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এরা স্বাধীন নয়! সুনির্দিষ্ট কতগুলো প্রাকৃতিক নিয়মের আওতার ভেতরে এদেরকে থাকতে হয়। কেউ যেচে তাকে না ডাকলে বা অনুকূল পরিবেশ না পেলে কখনও কোথাও অনুপ্রবেশ করতে পারে না এরা। কফিনে বা এরকম কোন জায়গায়, নির্দিষ্ট একটা আধারের কেন্দ্রে এদেরকে বাস করতে হয়। সূর্যাস্তের পর থেকে ভোরে মোরগ ডাকার আগ পর্যন্ত বাইরের পৃথিবীতে চলাফেরা করে বেড়াতে পারে এরা, তারপরই সুড়সুড় করে ফিরে যেতে হয় নিজেদের বাসস্থানে। রসুন, ধুনো এবং পবিত্র কুশকে যমের মত ভয় করে এরা। এমন কি কফিনের ওপর বুনো গোলাপের ডাল বিছিয়ে রাখলেও তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না পিশাচেরা।
আর বয়স? দিন কালের পরিধি দিয়ে এই শয়তানদের বয়স মাপা যায় না। জীবন্ত প্রাণীদেহ থেকে রক্ত পান করে করে শতাব্দীর পর শতাব্দী বেঁচে থাকতে পারে এরা। মাসের পর মাস কিছু না খেয়েও থাকতে পারে। তখন মনে হয় বয়স বেড়ে গেছে এদের, আবার রক্ত খেয়ে নিলেই আগের মত তরুণ হয়ে যায়। ঘোড়াগাড়িতে লুসির পাশে তরুণ ড্রাকুলাকে দেখে চমকে যায় জোনাথন, আসলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। লুসির রক্ত, সেই সাথে লুসির ধমনীতে প্রবেশ করানো আমাদের কয়েকজনেরও রক্ত খেয়ে খেয়ে ওরকম তরুণ হয়ে গিয়েছিল ড্রাকুলা।
এই ভয়ঙ্কর শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে কিভাবে সংগ্রাম করতে পারি আমরা, কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে তাকে, এ সম্পর্কে ভালমত ভেবে দেখতে হবে আমাদের। কাজটা অত্যন্ত দুরূহ এবং বিপজ্জনক। একবার হেরে গেলে তার পরিণতি-নিশ্চিত মৃত্যু। এবং এই মৃত্যুই এর শেষ নয়। শয়তানের শিকার হয়ে মৃত্যুর পর তারই মত এক ভয়ঙ্কর প্রেতাত্মা হয়ে রাতের অন্ধকারে আত্মগোপন করে বেড়াতে হবে, আর অতি প্রিয়জনদের শরীরের রক্ত পান করতেও তখন বিন্দুমাত্র দ্বিধা হবে না আমাদের।
তবু নিজের জীবন তুচ্ছ করেও আত্মীয়স্বজন এবং পৃথিবীর অগুণতি মানুষের মুখ চেয়ে এই শয়তানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে আমাদের। এ পবিত্র কর্তব্য থেকে কিছুতেই সরে দাঁড়াতে পারি না আমরা। কারণ এ না করলে মুত্যুর পর একদিন যখন সৃষ্টিকর্তার সামনে গিয়ে দাঁড়াব, তখন তার কাছে কি জবাব দেব আমরা? দিনের পর দিন মানুষের জীবন থেকে তার দেয়া আলো, গান, ভালবাসাকে ছিনিয়ে নেবে এক অন্ধকারের পিশাচ, সব জেনেশুনেও আমরা তার প্রতিকার না করে গেলে কি আমাদের ঘৃণার চোখে দেখবেন না ঈশ্বর? আমি বৃদ্ধ হয়েও যদি এই ভয়ঙ্করের বিরোধিতা করতে এগিয়ে যাই, তোমরা তরুণ হয়ে কি বসে থাকবে? বল? জবাব দাও, আবেগে, উত্তেজনায় গমগম করে উঠল প্রফেসরের ভরাট কণ্ঠস্বর।
ধীরে ধীরে টেবিলের ওপর হাত বিছিয়ে দিল জোনাথন। তার হাতের ওপর হাত রাখলাম আমি। দুজনের হয়ে জোনাথন বলল, আমাদের দুজনকে আপনার বিশ্বস্ত সহযোগী ধরতে পারেন, প্রফেসর।
তিনজনের দিকেই তিনজনে নীরব দৃষ্টি বিনিময় করলেন ডাক্তার সেওয়ার্ড, লর্ড গোডালমিং আর মিস্টার মরিস। তারপর একে একে আমাদের হাতের ওপর হাত রাখলেন ওঁরা তিন বন্ধু। তিনজনের হয়ে বললেন মিস্টার মরিস, আমাদের কথা তো আগেই আপনাকে জানিয়েছি, প্রফেসর।
ভেরি গুড! ভেরি গুড! তোমাদের সাহস আর আমার ওপর বিশ্বাস দেখে ভারি খুশি হলাম, বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে একটু সামনে ঝুঁকে আমাদের পাঁচজনের হাতগুলো দুহাতে চেপে ধরলেন প্রফেসর। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে আবার বসে পড়লেন চেয়ারে। আমরাও টেবিলের ওপর থেকে আমাদের হাত তুলে আনলাম। সবার মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন প্রফেসর, আমাদের এই সম্মিলিত শক্তি নিয়ে এবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কিভাবে? প্রথমেই খুঁজে বার করতে হবে নাটের গুরু কাউন্ট ড্রাকুলার বাসস্থানটা। জোনাথন আর মিনার ডায়েরী পড়ে এবং অন্যান্য জায়গায় খোঁজখবর করে আমি জানতে পেরেছি, ড্রাকুলার প্রাসাদ দুর্গ থেকে পঞ্চাশটা কাঠের বাক্স কারফাক্সের পুরানো গির্জায় পৌঁছানর পর কয়েকটা কাঠের বাক্স আবার ঠেলাগাড়িতে করে কোথাও সরিয়ে নেয়া…।
প্রফেসরের কথার মাঝেই হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মিস্টার মরিস। ব্যাপার কি ভাবছি, এমন সময় বাইরে থেকে ভেসে আসা পিস্তলের গুলির শব্দে চমকে উঠলাম সবাই। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঘরের একপাশের জানালার কাচের শার্সি ভেঙে ঝন ঝন শব্দে ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। দারুণ ভয় পেয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। একলাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সবাই। এই সময় পিস্তল হাতে ঘরে ঢুকলেন মিস্টার মরিস। উত্তেজিত ভাবে বললেন, আপনার কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ ওই জানালাটার দিকে চোখ পড়ে যায় আমার, প্রফেসর। দেখলাম কালো মত কি একটা উড়ে বেড়াচ্ছে জানালার কাছে। ব্যাপারটা দেখার জন্যে বাইরে বেরোতেই দেখি জানালার কাঁচের শার্সির গায়ে এসে বসার চেষ্টা করছে একটা প্রকাণ্ড বাদুড়। সাথে সাথেই কোমর থেকে পিস্তল তুলে গুলি করলাম…।
ওটার গায়ে গুলি লেগেছে? মৃদু হেসে জানতে চাইলেন প্রফেসর।
এটাই আশ্চর্য, প্রফেসর। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না আমার নিশানা, হলপ করে বলতে পারি আজও হয়নি। অথচ গুলি খেয়েও দিব্যি উড়ে চলে গেল বাদুড়টা, যেন গুলিটা লাগেইনি ওটার গায়ে। আর বাদুড়টার ওড়ার কায়দাও অদ্ভুত।
ওটা বাদুড় নয়, মরিস। কাজেই তোমার গুলি লাগলেও মরবে কেন ওটা? আসলে রাতের বেলা মারা যায় না ওদের, গুলি ছুঁড়ে তো নয়ই। শয়তানটাকে মারতে হলে সবার আগে ওটার আস্তানা খুঁজে বার করতে হবে আমাদের। এবং সেজন্যে ভোর হলেই কারফাক্সের পুরানো গির্জায় হানা দিতে চাই আমি। প্রথমে গুণে দেখতে হবে পঞ্চাশটার ভেতর কটা কফিন অবশিষ্ট আছে ওই গির্জায়, তারপর জানতে হবে কোথায় সরিয়ে নেয়া হয়েছে বাকিগুলো। তারপর সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, এই সময়ের মধ্যে কফিনের ভেতরই হত্যা করতে হবে হারামীটাকে।
ঠিক, অত্যন্ত উৎসাহের সাথে বলে উঠলেন মিস্টার মরিস। অযথা সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। তা মিসেস হারকারও কি যাবেন আমাদের সাথে?
দরকার নেই, নিষেধ করলেন প্রফেসর। এই অজানা বিপদের মধ্যে ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে লাভ কি?
ওদের সাথে যাবার প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রতিবাদ করতে পারলাম না।
হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বললেন মিস্টার মরিস, যথেষ্ট রাত হয়েছে, এখন একটু জিরিয়ে নিলে হয় না? সেই ভোরে উঠে তো আবার বেরিয়ে পড়তে হবে আমাদের।
হ্যাঁ, যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো সবাই, আদেশ দিলেন প্রফেসর।
ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম আমি আর জোনাথন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল জোনাথন। কিন্তু আমার চোখে ঘুম এলো না কিছুতেই। কেবলই মনে হতে লাগল রেনফিল্ডের কথা। আমাকে বার বার হুঁশিয়ার করছিল কেন সে? ওই পাগলটার কথার ভেতর কি সত্যতা কিছু আছে?
কতক্ষণ জেগে শুয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ জানালার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠে বসলাম। হালকা জ্যোৎস্নায় চোখে পড়ল জানালার কাছে বার বার উড়ে আসছে বাদুড়টা, লাল জ্বলজ্বলে দুটো চোখ ওটার। আশ্চর্য! বেশ কিছুদিন আগে লুসির ঘরের জানালায় বসে থাকতে দেখেছিলাম আমি এটাকেই। হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে একটা বালিশ তুলে নিয়েই ওটার দিকে ছুঁড়ে মারলাম আমি। জানালার গায়ে চাপা থ্যাপ শব্দ করে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেল বালিশটা। সে-শব্দে ঘুম ভেঙে গেল জোনাথনের।
কি হল? বলে একলাফে বিছানার ওপর উঠে বসল জোনাথন।
ওই বাদুড়টা! আঙুল দিয়ে জানালার দিকে নির্দেশ করতে গিয়েই দেখলাম নেই ওটা ওখানে। চলে গেছে।
চিন্তিত ভাবে জানালার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল জোনাথন, তারপর আমাকে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলে নিজেও শুয়ে পড়ল আবার। কিন্তু জানি বাকি রাতটা আর কিছুতেই ঘুম আসবে না আমার। অগত্যা বাতি জ্বেলে ডায়েরী লিখতে বসলাম।