ড্রাকুলা : ২.০৮ বার্কলে গিয়ে হোটেলে

ড্রাকুলা : ২.০৮ বার্কলে গিয়ে হোটেলে

২.০৮ বার্কলে গিয়ে হোটেলে

২৯ সেপ্টেম্বর, ভোর।

সাড়ে নটা নাগাদ বার্কলে গিয়ে হোটেলে পৌঁছেছিলাম গত রাতে। দশটার একটু আগে এসে পৌঁছুল আর্থার আর মরিস। ওদেরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বসাতে বসাতে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর, তাহলে ঠিকমতই আমার টেলিগ্রাম পেয়েছিলে তোমরা?

হ্যাঁ। এবং পেয়েই ছুটে চলে এসেছি। ভাবলাম, আবার কি ঘটল কে জানে।

ঘটেনি, তবে ঘটবে। আর এজন্যেই ডেকে এনেছি তোমাদের।

ঘটবে? কি ঘটবে, প্রফেসর? জিজ্ঞেস করল মরিস।

ঘটবে ঠিক না, তবে ঘটাব? একটু গুছিয়ে বসলেন প্রফেসর। তারপর আবার বললেন, আর সেজন্যে তোমাদের সবার অনুমতি প্রয়োজন। হয়ত আমার প্রস্তাব শোনা মাত্র তোমরা বিরক্ত, এমনকি রেগেও যেতে পার। কিন্তু তার আগে আমার প্রস্তাবটা অন্তত বিবেচনা করে দেখবে।

কি করতে হবে কিছুই জানা নেই আমার, প্রফেসর, বলতে বলতে, হাতটা বাড়িয়ে দিল মরিস। জানার প্রয়োজনও বোধ করছি না। কারণ কাজটা করতে যাচ্ছেন আপনি। এবং আমি জানি, আর যাই করুন, অন্যায় কিছু করবেন না আপনি। অতএব আমি আপনার দলে।

আর আমার আত্মমর্যাদা বা ধর্মীয় বিশ্বাস ক্ষুন্ন না হলে জীবন দিয়ে হলেও আপনার কাজে সাহায্য করব আমি, প্রফেসর, বলল আর্থার।

ভেরি গুড। তোমাকে কথা দিচ্ছি, আর্থার, তোমার আত্মমর্যাদা বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কিছুমাত্র অবমাননা হবে না।

তাহলে এখন আমাদের কি করতে হবে বলে ফেলুন, সমস্বরে বলল আর্থার আর মরিস।

তোমাদের সবাইকে হ্যাম্পস্টেডের কবরখানায় যেতে হবে আমার সাথে। এবং আজ রাতে।

দপ করে মুখের হাসি নিভে গেল আর্থারের। অর্থাৎ, লুসির কবরে?

হ্যাঁ।

কেন?

লুসির কফিনের ডালাটা খুলব আমি। তোমাদের সবার সামনে।

কিন্তু কেন, প্রফেসর, কেন? আপনার কি এমন উদ্দেশ্য পূরণ হবে তাতে?

হবে। কিন্তু আগেভাগে সেকথা বলতে চাই না তোমাদের। বললেও বিশ্বস করবে না, ভরাট গম্ভীর গলায় বললেন প্রফেসর। যদি আজ রাতের মধ্যে তোমাদেরকে বোঝাতে না পারি, তাহলে আর কোনদিন বোঝাতে পারব কিনা সন্দেহ।

অর্থাৎ? আপনি কি বোঝাতে চাইছেন, প্রফেসর?

এক কথায় তা বলে বোঝান অসম্ভব, আর্থার। তবু যখন জানতেই চাইছ, বলছি, একবার কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন প্রফেসর। তারপর ধীর শান্ত গলায় বললেন, তোমরা সবাই জান, মারা গেছে লুসি, তাই না? কিন্তু আমি যদি বলি মরেনি ও…

প্রফেসরের কথার মাঝেই চেঁচিয়ে উঠলো আর্থার; কি সব আবোলতাবোল বকছেন, প্রফেসর? আপনি বলতে চান জীবন্ত অবস্থায়ই লুসিকে কবর…

না, তা বলতে চাই না। এবং লুসি জীবন্ত একথাও বলিনি কখনো। তবে ও জীবন-মৃতা হতে বাধা কোথায়?

জীবন-মৃতা! এ-ও কি সম্ভব?

এ পৃথিবীতে কি যে সম্ভব আর কি অসম্ভব, সঠিকভাবে কেউই বলতে পারে, আর্থার। এমন অনেক রহস্য আছে, শতাব্দীর পর শতাব্দী চেষ্টা করেও তার বিন্দুমাত্র উদ্ঘাটন করতে পারেনি মানুষ। আর তেমনি একটা রহস্যের সম্মুখীন হয়েছি আমরা। এবং এর হাত থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র উপায় মাথা কেটে ফেলতে হবে লুসির।

প্র-ফে-স-র! প্রায় ককিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো আর্থার। এ আপনি কি বলছেন? কেন করতে যাচ্ছেন কাজটা? আর আমার চোখের সামনে আমার প্রেমিকার লাশটা ছিন্ন ভিন্ন করবেন, আর আমি তাতে সায় দেব ভাবলেন কি করে? হয় আমি ভুল শুনেছি, না হয় পাগল হয়ে গেছেন আপনি।

হাত ধরে আর্থারকে আবার চেয়ারে বসিয়ে বলল মরিস, না, আর্থার, প্রফেসর পাগল হয়ে যাননি। আমি জানি, সময় বিশেষে এ ধরনের নিষ্ঠুর কাজ করতে হয় মানুষকে এবং তা করতে হয় সমাজের আরো দশজন মানুষের কল্যাণার্থে। জীবনে বহু দেশ ঘুরেছি আমি, দেখেছিও অনেক। সেজন্যেই প্রফেসরের কথায় বিন্দুমাত্র অবাক হচ্ছি না আমি। আপনি বলে যান, প্রফেসর, আমরা শুনছি।

তোমাকে ধন্যবাদ, মরিস, একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন প্রফেসর, দৃঢ় আত্মবিশ্বাস তার কণ্ঠে। আর্থার অন্যের প্রতি, তোমার প্রতি, মৃতের প্রতি মানুষ হিসেবে আমারও একটা পবিত্র কর্তব্য আছে এবং যত বাধাই আসুক, ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি আমি তা পালন করবই। কিন্তু তার আগে তোমাদেরকে যথাসম্ভব বোঝাতে চেষ্টা করব আমি। শেষ পর্যন্তও যদি তোমাদেরকে পথে আনতে না পারি, আমার কাজ আমি করবই। তবে আমার মনে হয় সব মিজের চোখে দেখলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে তোমাদের কাছে। আমার একান্ত অনুরোধ, আগে থেকে না বুঝেশুনে ঝট করে কিছু করে বসো না। তার ফল আদৌ শুভ হবে না। এই বৃদ্ধ বয়সেও কেন ওই ভয়ঙ্কর পথে পা বাড়াচ্ছি আমি বলতে পার? বাড়াচ্ছি নিষ্ঠুর পৈশাচিক পরিণতির হাত থেকে তোমাদের বাঁচাতে আজ যদি আমি সরে দাঁড়াই এই পৈশাচিকতার হাত থেকে কেউ পরিত্রাণ পাবে না তোমরা; তুমি, জন, মরিস কেউ না, কারণ তোমরা তিনজনই লুসির বন্ধু। এবং তোমাদের পরও এই পরিণতির শিকার হবে হ্যাম্পস্টেড এবং তার আশেপাশের এলাকার অসংখ্য যুবক যুবতী। তুমি কি তাই চাও আর্থার? তোমাদেরকে ভাল না বাসলে কখনও ওই ভয়ঙ্কর পথে পা বাড়াতে যেতাম না আমি।–লুসি অসুস্থ, জনের কাছ থেকে এ খবর পেয়ে পাগলের মত ছুটেও আসতাম না, নিজের দেহের রক্ত দিয়ে লুসিকে বাঁচানোর চেষ্টাও করতাম না। জীবন-মৃতা লুসির গলা কাটতে কি আমার হাত বিন্দুমাত্র কাঁপবে না বলতে চাও? কাঁপবে। হয়ত তোমাদের চেয়ে একটু বেশিই কাপবে। কারণ ও আমার মেয়ের মত। তবু কেন করতে যাচ্ছি কাজটা? করতে যাচ্ছি এক অভিশপ্ত পৈশাচিক জীবন থেকে ওর আত্মাকে মুক্তি দিতে। ওকে স্বাভাবিক মৃত্যুর দেশে পাঠাতে। তাতে শান্তি পাবে লুসির আত্মা। শান্তি পাব আমরা সবাই।

প্রফেসরের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসে তার হাত দুটো চেপে ধরল আর্থার, বলল, না বুঝে আপনাকে ব্যথা দিয়েছি। প্রফেসর, আমাকে মাফ করুন।

উত্তরে শুধু হাসলেন প্রফেসর, সে-হাসিতে উপচে পড়ল স্নেহ আর ভালবাসা।

হ্যাম্পস্টেডের কবরখানায় এসে পৌঁছলাম রাত বারটায়। কখনো ঘন কালো মেঘের ফাঁক থেকে বেরিয়ে এসে চারদিকে ধূসর আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে চাঁদ, কখনো গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে ঢুকে পড়ছে ভেতরে। এদিকে ওদিকে টিপটিপ করে জ্বলছে জোনাকির দীপ। একটানা কর্কশ শব্দে ডেকে চলেছে ঝিঝিগুলো। কবরখানার গেট খুলে ভেতরে ঢুকলেন প্রফেসর পেছন পেছন আমরা তিনজন। লুসির কফিনের কাছে বসে মোমবাতি জ্বাললেন প্রফেসর। তারপর আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল যখন আমার সাথে এখানে এসেছিলে তুমি, লুসির লাশটা ছিলো কফিনে?

আর্থার আর মরিসকে উদ্দেশ্য করে বললেন প্রফেসর, শুনলে তো তোমরা? এখন দেখ…

বলেই কফিনের ডালাটা তুলে ধরলেন প্রফেসর। খালি কফিন। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল আর্থার আর মরিস। কয়েক সেকেণ্ড পর নীরবতা ভাঙল আর্থার, কাজটা কে করল প্রফেসর, আপনি?

আমি করিনি। আজ থেকে দুদিন আগেও রাতের বেলা এখানে এসেছিলাম আমি আর জন। সেদিনও কফিন খুলে দেখেছিলাম লুসি নেই। অবশ্য কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসেছিল সে।

ফিরে এসেছিল?

হ্যাঁ। কি, ঠিক বলিনি, জন?

হ্যাঁ।

কিন্তু এখন কফিন খালি। কেন বালি, কোথায় গেল লুসি সব আজ তোমরা চাক্ষুষ দেখতে পাবে। কোন সন্দেহই আজ তোমাদের মনে রাখব না আমি। চল, বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করি।

কফিনের ডালাটা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে দিলো প্রফেসর। তারপর সবাই বাইরে বেরিয়ে এলাম। সামাধিকক্ষের রুদ্ধ বাতাসে দম বন্ধ হয়ে আসছিল এতক্ষণ, এখন বাইরে বেরিয়ে এসে খোলা হাওয়ায় হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। মেঘের ফাঁক থেকে আবার বেরিয়ে এসেছে চাদ। কৃষ্ণপক্ষের ঘোলাটে চাঁদের আলোয় কেমন যেন ভৌতিক লাগছে চারপাশের সবকিছু। অস্বাভাবিক নিঝুম মনে হচ্ছে আশপাশটা। কেন? এতটা নীরব মনে হয়নি তো একটু আগেও? হঠাৎ বুঝলাম কারণটা। চুপ করে গেছে ঝিঝি পোকাগুলো।

একটা সিগারেটের জন্য আনচান করে উঠল বুকটা। কিন্তু প্রফেসরের সামনে ধরাই কি করে? বাইরে বেরিয়েই ব্যাগ হাতড়ে বিস্কুটের মত কি যেন একটা বের করলেন প্রফেসর। একটা সাদা রুমালে জড়িয়ে চাপ দিয়ে ভেঙে গুঁড়ো করলেন তিনি জিনিসটাকে, তারপর ময়দার তালের মত কিসের সাথে সেই গুড়ো মিশিয়ে দুহাতের চেটো দিয়ে ঘষে ঘষে সরু সরু ফালি বানিয়ে, সমাধিকক্ষের বন্ধ কপাটের ফাঁকে ঠেসে ঠেসে গুঁজে দিলেন ওগুলো। অবাক লাগল ব্যাপারটা। কৌতূহলী হয়ে উঠল আর্থার আর মরিসও। শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম, ওটা কি করলেন, স্যার?।

জীবন-মৃতা ডাইনীটার ভেতরে ঢোকার পথ রুদ্ধ করে দিলাম।

ওই সামান্য ময়দার লেচি আটকে রাখতে পারবে ডাইনীটাকে? মরিসের কণ্ঠে অবিশ্বাস।

অবশ্যই, দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জবাব দিলেন প্রফেসর।

ময়দার তালের সাথে ওটা কি মেশালেন, স্যার? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

ধুনো। ছোট্ট এক কথায় জবাব দিয়ে মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে ফেলে আমাদেরকে ওখান থেকে সরে যেতে বললেন প্রফেসর। তাড়াতাড়ি তিনটা সমাধিস্তম্ভের আড়ালে গিয়ে লুকালাম আমি, আর্থার আর মরিস। প্রফেসরও গিয়ে লুকালেন একটার আড়ালে। অপেক্ষাকৃত হালকা মেঘের আড়ালে গিয়ে ঢুকেছে এখন চাঁদ। তাই নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে যেতে পারেনি পৃথিবী। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না কিছুই। প্রত্যেকটা জিনিসের হালকা একটা অবয়ব চোখে পড়ছে কেবল। পূর্ব অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও অন্যদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে কি এক অজানা আতঙ্কে শিরশির করে উঠল শরীরটা।

মাটির সমান্তরালে উবু হয়ে থেকেও দেখলাম ধোঁয়াটে অন্ধকার আকাশের পটভূমিকায় সারি সারি কবরগুলো আশ্চর্য রকম সাদা দেখাচ্ছে, আর ঠিক তেমনি আশ্চর্য রকমের কালো দেখাচ্ছে সাইপ্রেস, জুনিপার, ইউক্যালিপটাস গাছগুলোকে। মাঝে মধ্যে লোকালয় থেকে ভেসে আসছে দুএকটা রাত জাগা কুকুরের ডাক। ওই দূরাগত ডাক আর আশপাশের গাছের শুকনো পাতার হালকা মর্মর ধ্বনি মিশে এত ভয়াবহ শব্দের সৃষ্টি করতে পারে, না শুনলে ভাবতে পারবে না কেউ। এই বিশাল কবরখানায় নিথর নিঝুম হয়ে আছে পৃথিবী, স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন সময়ের গতি। ঠিক এই সময় কাছেই একটা কবরের পাশে লুকিয়ে থাকা প্রফেসরের চাপা অস্ফুট ডাকে চমকে উঠলাম। তেমনি চাপা গলায় দিক নির্দেশ করে আমাদেরকে তাকাতে বললেন প্রফেসর।

প্রফেসরের নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দূর থেকে ইউক্যালিপটাস-এর ছায়া মাড়িয়ে ধীরে ধীরে এদিকে এগিয়ে আসছে একটা সাদা ছায়ামূর্তি। চলতে চলতেই হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ালো মূর্তিটা। ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল চাঁদ। ঘোলাটে চাদের আলোয় দেখলাম ধবধবে সাদা লাশ ঢাকার পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। বুকের কাছে ধরা কি একটা জিনিসের ওপর ঝুঁকে থাকায় তরুণীর মুখটা ভালমত দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ শব্দ করে ককিয়ে কেঁদে উঠল তরুণীর বুকের কাছে ধরা প্রাণীটা। মানব শিশুর উচ্চকিত কান্না। শিশুটা কেঁদে উঠতেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আবার এগিয়ে আসতে শুরু করল তরুণী। পরিষ্কার চিনতে পারলাম এবার লুসিকে। আমাদের তিন নায়কের গভীর ভালবাসার পাত্রী মিস্ লুসি ওয়েস্টেনরা। এই মুহূর্তে আশ্চর্য রকম বদলে গেছে লুসি। তার চেহারায় সমস্ত কোমলতা আর মাধুর্য মুছে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠেছে এক ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা।

চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ্য করলাম সমাধিস্তম্ভের আড়াল থেকে অতি ধীরে বেরিয়ে আসছেন প্রফেসর। ফিসফিস করে আমাদেরকেও আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে বললেন তিনি। ততক্ষণে আরও এগিয়ে এসেছে লুসি। ওর ঠোঁটের কষা বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে কালচে মত কি যেন। সে-গাঢ় তরল পদার্থ ফোটায় ফোঁটায় ওর সাদা পোশাকে ঝরে পড়ে কালো করে দিয়েছে বুকের কাছটায়। কেউ বলে না দিলেও বুঝতে পারলাম ঝরে পড়া তরল পদার্থটা রক্ত, মানুষের রক্ত। চাঁদের আলোয় রক্তের স্বাভাবিক রঙ বদলে গিয়ে কালো দেখাচ্ছে। প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, পাথরের মূর্তির মত স্থির দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আমার পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে আর্থার। টলছে ও। হাত বাড়িয়ে আমি ওকে ধরে না ফেললে পড়েই যেত হয়ত।

অত্যধিক নড়াচড়া করাতেই বোধহয় আমাদেরকে দেখতে পেয়ে তীব্র আক্রোশে ফুসে উঠল লুসি। সরাসরি চাইল সে আমার চোখের দিকে। চমকে উঠলাম। কোথায় ওর সেই গভীর নীল চোখ? তার বদলে সেখানে জ্বলজ্বল করছে যেন দুটো জ্বলন্ত অঙ্গার। গভীর বিতৃষ্ণায় ভরে গেল আমার বুকের ভেতরটা। লুসির জন্যে সামান্য ভালবাসা যা তখনও আমার মধ্যে অবিশিষ্ট ছিল ওই ভয়ঙ্কর চোখ দুটো দেখার পর তা একেবারে শেষ হয়ে গেল। হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে শিশুটার ঠ্যাং ধরে তাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল লুসি। নরম ঘাসের ওপর আছড়ে পড়ে প্রচণ্ড শব্দে চেঁচিয়ে উঠল শিশুটা। কচি গলার তীক্ষ্ণ আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠল নৈশ বাতাস। সেদিকে বিন্দুমাত্র কান না দিয়ে আর্থারের দিকে কামার্ত দৃষ্টি হেনে মদালসা ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে থাকল লুসি। আর্থারের কাছ থেকে মাত্র দুগজ দূরে দাঁড়িয়ে হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে আহ্বান করল সে, তুমি ওদের সাথে কেন, প্রিয়তম? এসো, আমার কাছে এসো। কতদিন থেকে তোমার বাহুপাশে ধরা দেবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছি আমি। জলতরঙ্গের মত সুরেলা আওয়াজের মত বেজে উঠল যেন লুসির কণ্ঠর। ঝড় তুলল শরীরের প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রীতে। সে মায়াবী আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারা যায় না কিছুতেই। মন্ত্রমুগ্ধের মত সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল আর্থার। ঠিক সেই মুহূর্তে ঝড়ের বেগে ছুটে এলেন প্রফেসর। লুসি আর আর্থারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে একটা ছোট্ট সোনার কুশ তুলে ধরলেন লুসির দিকে। যেন জীবন্ত বৈদ্যুতিক তারে পা দিয়েছে এমন ভাবে আর্তনাদ করে পেছনে ছিটকে পড়ল লুসি। পরমুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজেদের কবরখানার দিকে ছুটল। কিন্তু কবরখানার গেটের সামনে গিয়েই আবার থমকে দাঁড়াল, ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে ভেতরে ঢোকার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। গেটের ফাঁক ছিল যেখানে, সেখানে ধুনো মেশান ময়দার ফালি দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন প্রফেসর, সেখানে বার কয়েক উঁকি ঝুঁকি মেরে ঢোকার পথ না পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল লুসি। ক্রুদ্ধ সংহার মূর্তি এখন ওর। কোন রূপসী তরুণীর মুখ এতটা বীভৎস হতে পারে কল্পনাও করবে না কেউ। কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে জ্বলজ্বলে লাল দুটো চোখ, আধ-খোলা ঠোঁটের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে সাদা দাঁত, চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে পিঠে, মুখে, বুকে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে মেডুসার মত লাগছে এখন ওকে। আতঙ্কে থর থর করে কেঁপে উঠলাম আমি। তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম সেদিক থেকে। ঠিক এই মুহূর্তে ওই হিংস্র ডাইনীটাকে হত্যা করতে পারলে বোধহয় অনেকটা স্বস্তি পেতাম।

সমাধিকক্ষের বদ্ধ দরজা আর মাথার ওপর কুশ তুলে ধরা প্রফেসরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড রাগে ফুঁসতে থাকল লুসি। কিন্তু এগোতে পারল না কিছুতেই। প্রফেসরের হাতের ওই পবিত্র কুশের কাছে সে সম্পূর্ণ অসহায়, প্রায় আধ মিনিট চুপচাপ ওই অবস্থায়ই দাঁড়িয়ে থাকলেন প্রফেসর, তারপর বললেন, আধার, আর কোন সন্দেহ নেই তো তোমার? আমার কাজে এরপর আর বাধা দেবে না তুমি?

দুহাতে মুখ ঢেকে অস্ফুট কান্নায় ভেঙে পড়ল আর্থার।

মেয়েমানুষের মত কাঁদলে তো চলবে না, আর্থার। কিছু একটা বল। আমাকে অপেক্ষা করিয়ে রেখো না শুধু শুধু।

আপনার যা খুশি করুন, প্রফেসর। আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। শুধু ওই ডাইনীটাকে চলে যেতে বলুন আমার সামনে থেকে। আমি আর সইতে পারছি না ওকে। অবস্থা দেখে মনে হল যে-কোন মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে পারে আর্থার। এগিয়ে গিয়ে দুপাশ থেকে ওকে চেপে ধরে রাখলাম আমি আর মরিস। আশ্চর্য! আমাদের তিনজনের মাঝে কোন ভাবান্তর নেই একমাত্র মরিসের। বরং এই ভয়ঙ্কর ঘটনা দেখে যেন মজা পাচ্ছে ও। ওর দুর্ধর্ষতা আর সাহসিকতার কথা কেবল শুনে এসেছিলাম এতদিন, আজ স্বচক্ষে দেখলাম।

কুশটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রেখে মোমবাতি জ্বাললেন প্রফেসর। তারপর এগিয়ে গিয়ে দুআঙুলে চিমটি দিয়ে দিয়ে গেটের ফাঁক ফোকরে লাগান ধুনো মেশান ময়দার ফালিগুলো তুলে ফেলতে লাগলেন। সবগুলো ফালি তোলা হয়ে গেলে গেটের কাছ থেকে সরে এলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই গেটের দিকে ছুটে গেল ডাইনীটা। চোখের সামনে অবস্থা হতে হতে একেবারে মিলিয়ে গেল ওর অবয়ব। এক মুহূর্ত আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল লুসি, সেখানে দেখা গেল এখন রূপোর মত চিকচিকে একটা ধুলোর ঘূর্ণি। ঘুরতে ঘুরতেই গেটের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল ঘূর্ণিটা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা।

লুসি সমাধিকক্ষের ভেতর ঢুকে যেতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন প্রফেসর, এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। চলো তো দেখি, শিশুটার কি অবস্থা।

এগিয়ে গিয়ে ঘাসের ওপর থেকে বাচ্চাটাকে তুলে নিলেন প্রফেসর। মোমের আলোয় বাচ্চাটার গলার সূক্ষ্ম ক্ষত দুটো পরীক্ষা করে দেখলেন তিনি, নাড়ীও দেখলেন। তারপর বললেন, বাচবে বলেই মনে হয়।

আগের কায়দায়ই বাচ্চাটাকে টহলদারী পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম আমরা। চলতে চলতেই বললেন প্রফেসর, বুঝলে আর্থার, আজ যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে, ভবিষ্যতে কখনও যদি পেছন ফিরে তাকাও তাহলে বুঝতে পারবে কত প্রয়োজন ছিল এ অভিজ্ঞতার।

বাড়িতে পৌঁছে আমাদের সবাইকে নির্দেশ দিলেন প্রফেসর, এখন একটু ঘুমিয়ে নাও সবাই। দুপুর বারটার পর আবার কাজে নামতে হবে সবাইকে।

২৯ সেপ্টেম্বর, রাত।

চং ঢং করে গির্জার পেটা ঘড়িতে বেলা বারটা বাজতেই আবার হাম্পস্টেডের কবরখানার দিকে রওনা দিলাম আমরা। ইচ্ছে করেই সবাই শোক প্রকাশের কালো পোশাক পরেছি। তাতে দল বেঁধে কবরে ঢুকতে দেখলেও কিছু টের পাবে না লোকে। দেড়টা নাগাদ উপত্যকাটায় এসে পৌঁছলাম আমরা। কবরখানার দারোয়ানের চোখকে ফাঁকি দেবার উদ্দেশ্যে অনির্দিষ্টভাবে খানিকক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে একসময় টুক করে রেলিং টপকে ঢুকে পড়লাম কবরখানার ভেতর।

ঝোপঝাড়ের আড়ালে আড়ালে হেঁটে এসে পৌঁছুলাম লুসিদের কবরখানায়। পকেট থেকে চাবি বের করে গেটের তালা খুললেন প্রফেসর। একে একে সমাধিকক্ষের ভেতর ঢুকলাম আমরা সবাই। হাতে করে আজ একটা নতুন ব্যাগ নিয়ে এসেছেন প্রফেসর। বেশ বড়সড় ব্যাগটা, বোধহয় অনেক জিনিসপত্র আজ নিয়ে এসেছেন তিনি এতে করে। ব্যাগ থেকে তিনটা বড় বড় মোমবাতি বের করে জ্বালিয়ে দুটো বসিয়ে দিলেন দুটো কফিনের ওপর, তৃতীয়টা আমার হাতে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে লুসির কফিনের ডালাটা তুলে ধরলেন প্রফেসর। প্রায় একসাথে কফিনের ওপর ঝুঁকে দাঁড়ালাম আমি, আর্থার আর মরিস। সাথে সাথেই বাতাসে দোলানো বেতস লতার মত থর থর করে কেঁপে উঠল আর্থার। বুক ভেঙে বেরিয়ে এল একটা দীর্ঘশ্বাস। মাত্র দিন দুয়েক আগে দেখে গেছি আমি লুসিকে। এই দুদিনেই সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে ওর। কিন্তু আজ আর ওর জন্যে বিন্দুমাত্র ভালবাসা নেই আমার বুকে। গতরাতের কথা মনে পড়তেই আবার বিষিয়ে উঠল মনটা। চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম, সামলে নিয়েছে আর্থার। ক্রমশঃ রুক্ষ কঠিন হয়ে উঠছে ওর মুখ চোখ। কুঁচকে ছোট হয়ে আসছে ভূ দুটো। কঠিন গলায় প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করল সে, প্রফেসর, একি আমার প্রেমিকা, লুসি, না গতরাতের ডাইনী লুসি?

দুটোই। দিনেরবেলা ও তোমার প্রেমিকা, রাতে হয়ে ওঠে নরকের ঘৃণ্য কীট।

কফিনের ভেতর শায়িত লুসিকে ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে এখন আমার কাছে। ওর রূপ লাবণ্য আর বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারছে না আমার মনকে। কেবলই ভেসে উঠছে মনের পর্দায়, ওর ঝকঝকে তীক্ষ্ণ ধারাল দাঁত, রক্তমাথা কামার্ত মুখ, আর অসংখ্য বিষাক্ত নাগিনীর মত জট পাকান কালো চুল।

ওদিকে ব্যাগ খুলে প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসপত্র সাজিয়ে ফেলেছেন প্রফেসর। তার মধ্যে আছে ছোট একটা মাটির প্রদীপ, মাথা মোটা কয়েকটা পেরেক, একটা লোহার হাতুড়ি, একটা মাংস কাটার বড় ধারাল ছুরি আর ফুট তিনেক লম্বা একটা একমুখ চোখা কাঠের গজাল।

জিনিসগুলো একে একে মাটিতে সাজিয়ে রেখে প্রদীপটা ধরিয়ে নিলেন প্রফেসর। ওতে কিসের তেল ব্যবহার করেছেন প্রফেসর বলতে পারব না, কিন্তু স্নিগ্ধ নীলাভ একটা আভা ছড়িয়ে পড়ল সমাধিকক্ষের ভেতর। রীতিমত অবাক হলেও অসীম ধৈর্যের সাথে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল আর্থার আর মরিস। প্রস্তুতি পর্ব শেষ করে মুখ তুলে তাকালেন প্রফেসর। বললেন, কাজ শুরু করার আগে দুএকটা কথা বলে নিতে চাই তোমাদের। জীবন-মৃত আত্মাদের নিয়ে দীর্ঘদিন যারা চর্চা করেছেন, সেইসব প্রাচীন বিশেষজ্ঞদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অনুসরণ করেই একাজে হাত দিয়েছি আমি। কারও আত্মা জীবন-মৃততে পরিণত হবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় তার অমরত্ব পাবার এক তীব্র লালসা। সম্পূর্ণ ভাবে কেউই মরে না এরা, অমরত্বও পায় না, অথচ শতাব্দীর পর শতাব্দী মৃতদের সংখ্যা কেবল বাড়িয়েই চলে। কোন সুস্থ মানুষ এরকম জীবন-মৃতদের হাতে মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও হয়ে ওঠে জীবন-মৃত, শিকারের জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে নতুন জীবন-মৃত আত্মাও। এমনি ভাবেই সে আদিমকাল থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কেবল বেড়েই চলেছে জীবন-মৃতদের সংখ্যা। আর্থার, লুসির মৃত্যু শয্যায় তুমি লুসিকে চুমু খেতে যাচ্ছিলে না, যদি তা করতে তাহলে তোমার বিরুদ্ধেও আজ আমাদের এমনি করেই দল পাকাতে হতো। আজ যদি লুসিকে আমরা হত্যা না করি, আজ হোক, কাল হোক বা কদিন পরে হোক তোমাদের জীবন-মৃততে পরিণত করে ছাড়বেই সে। এ থেকে কিছুতেই নিষ্কৃতি নেই তোমাদের। কারণ লুসি জানে তোমরা তিনজনই ওকে ভালবাস। তাই বলছিলাম…

প্রফেসরের কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠলো আর্থার, আর আমাদেরকে বোঝনোর দরকার নেই, প্রফেসর কাল রাতেই সব বুঝে গেছি আমরা। এখন শুধু কি করতে হবে তাই বলুন।

ভেরি গুড, খুশি হয়ে আর্থারের কাঁধ চেপে ধরে প্রচণ্ড এক ঝাকুনি দিলেন প্রফেসর। একটা অত্যন্ত কঠিন কাজ করতে হবে তোমাকে, আর্থার। আমি লুসির মাথা কেটে মুখে রসুনের কোয়া পুরে দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরের নাম নিয়ে এই কাঠের গজালটা সম্পূর্ণ বিধিয়ে দিতে হবে লুসির হৃৎপিণ্ডে। পারবে?

পারব, আশ্চর্য শান্ত আর্থারের গলা। যেন লোহার শিক দিয়ে গেঁথে একটা ট্রাউট মাছ মারতে যাচ্ছে সে।

হ্যাঁ তুমি পারবে, আর্থার, বলে গজালটা এগিয়ে দিলেন প্রফেসর, নাও, ধরো। গজালের চোখা অংশটা ঠিক লুসির হৃৎপিণ্ড বরাবর ধরে আমি বলার সাথে সাথে এই হাতুড়ি দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত হানবে গজালের ভোতা অংশে। খবরদার, এক আঘাতেই যেন গজালটা লুসির হৃৎপিণ্ড ভেদ করে। আর মনে রেখো তোমার প্রেমিকাকে খুন করতে যাচ্ছ না তুমি, ওকে পাঠাতে যাচ্ছ স্বাভাবিক মৃত্যুর দেশে।

দৃঢ় হাতে গজাল আর হাতুড়িটা তুলে নিল আর্থার। বিন্দুমাত্র কাঁপছে না এখন ওর হাত। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ।

ডান হাতে মাংস কাটার ছুরিটা তুলে নিয়ে শান্ত পায়ে কফিনের কাছে এগিয়ে গেলেন প্রফেসর। বাঁ হাতে ওর কতগুলো রসুনের কোয়া। কফিনের ডালাটা তুলে শক্ত করে ধরে রাখল মরিস। মাটি থেকে প্রদীপটা তুলে নিয়ে লুসির মাথার দিকটায় দাঁড়ালাম আমি। গম্ভীর গলায় জোরে জোরে বাইবেলের স্তোত্রপাঠ শুরু করলেন প্রফেসর। তার সাথে গলা মেলালাম আমরা তিনজন। স্তোত্রপাঠ করতে করতেই বাঁ হাতের রসুনের কোয়াগুলো ঘুমন্ত রোগীর মুখে ট্যাবলেট গুঁজে দেয়ার মত করে গুঁজে দিলেন প্রফেসর লাশের মুখে, পরমুহূর্তে মাংস কাটা ছুরিটা দিয়ে গায়ের জোরে কোপ বসালেন লুসির গলায়। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল প্রলয় কাও। জীবন্ত মানুষের ধড় থেকে মাথাটা কেটে আলাদা হয়ে যাবার পর যা করে ধড়টা তেমনি ভাবে মোচড় খেতে শুরু করল লুসির ধড়। কাটা গলা দিয়ে ঝলকে ঝলকে বেরিয়ে এল তাজা রক্ত। কফিনের ভেতর রক্তের নদী বয়ে যাচ্ছে যেন। সেই রক্তের নদীতে ক্রমাগত মোচড় খাচ্ছে লুসির ধড়টা। হাত দুটো থাবা মারছে কফিনের গায়ে। যেন ঘুম ভেঙে গিয়ে অঙ্গারের মত টকটকে লাল চোখ মেলে চেয়ে আছে কাটা মাথাটা। ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হয়ে আসছে চোখের লালচে জ্যোতি। আর্থারকে তৈরি হতে নির্দেশ দিলেন প্রফেসর। নির্ধিধায় গজালটা লুসির হৃৎপিণ্ড বরাবর ধরে হাতুড়ি হাতে তৈরি হয়ে দাঁড়াল আর্থার। ক্রমশঃ নিভে আসছে চোখের জ্যোতি, তার সাথে তাল মিলিয়ে কমে আসছে ধড়টার নড়াচড়া। চোখের জ্যোতি একেবারে নিডে যেতেই ধড়টার নড়াচড়াও বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর, এইবার, আর্থার। চোখের পলকে হাতুড়ির এক আঘাতে জায়গামত গজালটা বসিয়ে দিল আর্থার। সবচেয়ে আশ্চর্য কাণ্ডটা ঘটল তখুনি। গজার মাছের মত বার দুয়েক শূন্যে লাফিয়ে উঠল কাটা মুণ্ডটা। তারপরই গলতে শুরু করল মুণ্ড আর ধড়। কয়েকদিনের গলিত শবে পরিণত হল ওগুলো। অসহ্য দুর্গন্ধে ভরে গেল সমাধিকক্ষটা। তাড়াতাড়ি কফিনের ডালা নামিয়ে দিতে বললেন প্রফেসর মরিসকে। তারপর গজালটা ছাড়া বাকি জিনিসপত্রগুলো ব্যাগে ভরে আমাদেরকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। সমাধিকক্ষের দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে চাবিটা আর্থারের হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন প্রফেসর, তোমার জিনিস তুমি নিয়ে নাও, আর্থার। আর, না জানিয়ে তোমার জিনিস রেখে দিয়েছিলাম বলে ক্ষমা চাইছি।

সাথে সাথে আঁটু গেড়ে প্রফেসরের পায়ের কাছে বসে পড়ে হাত জোড় করে বলল আর্থার, দয়া করে আর আমাকে লজ্জা দেবেন না, প্রফেসর। আমাকে আর লুসিকে নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার জন্যে চিরঋণী হয়ে থাকলাম আপনার কাছে।

হাত ধরে টেনে আর্থারকে দাঁড় করিয়ে বললেন প্রফেসর, তোমরা ছেলেমানুষ। তবুও আমাকে সাহায্য করতে গিয়ে যা করেছ, তোমাদের বয়সে আমি হলে কিন্তু তা পারতাম না।

এতক্ষণে মুখ খুলল মরিস, এই বয়সেই পৃথিবীর বহু দেশে ঘুরেছি আমি, বহু বিপদে পড়েছি, বহু অদ্ভুত জিনিস দেখেছি। কিন্তু আজ আপনি যা দেখালেন, প্রফেসর, তার তুলনা হয় না।

হয়েছে। চলো এখন যাওয়া যাক। ওদিকে বেলাও বেশি নেই, তাড়া লাগালেন প্রফেসর।

এতক্ষণে খেয়াল করলাম অস্ত যাচ্ছে সূর্য। গোধূলির আলোয় রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে পশ্চিমাকাশ। আমার মনে হল লুসির রক্ত ছড়িয়ে দিয়েছে কেউ ওখানে। নতুন করে আবার লুসির মৃত্যুর শোকটা অনুভব করতে শুরু করলাম এখন।

অস্তগামী সূর্যের হালকা নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে উপত্যকা জুড়ে। জানা অজানা অসংখ্য পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে আছে জুনিপারের ঝোপ। মনের আনন্দে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে এদিক ওদিক খেলে বেড়াচ্ছে খরগোশ। মনে হচ্ছে রাতের আঁধারে বিপদসংকুল দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যেন স্বর্গের নন্দন কাননে এসে হাজির হয়েছি আমরা।

এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে পাহাড়ী উপত্যকা বেয়ে নামতে লাগলাম আমরা। একসময় প্রফেসর বললেন, সহজ কাজটা শেষ করলাম আমরা, কিন্তু সবচেয়ে কঠিন কাজটাই বাকি রয়ে গেছে এখনো। এই সমস্ত দুর্ভাগ্যের মূল যে, সেই নাটের গুরুকে খুঁজে বার করতে হবে আমাদের, তাকেও লুসির মতই কফিনে ফেলে হত্যা করতে হবে। কিন্তু আগে খুঁজে বের করতে হবে পিশাচটাকে। এবং সেইটাই হবে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ এবং বিপজ্জনক কাজ। অবশ্য সূত্র একটা খুঁজে পেয়েছি আমি, এগোতে হবে সে-পথ ধরে। একা আমার পক্ষে তা করা একেবারেই অসম্ভব। আশা করি আমাকে সাহায্য করবে তোমরা?

করব মানে? এই অদ্ভুত ভয়ঙ্কর ব্যাপার চাক্ষুষ দেখার চেয়ে রোমাঞ্চকর আর কিছু আছে নাকি পৃথিবীতে। আমি একপায়ে খাড়া, প্রফেসর, সবার আগে বলল মরিস।

আর কিছুর জন্যে না হলেও, একটু আগে চাপিয়ে দেয়া ঋণের বোঝা কিছুটা হালকা করার জন্যে অন্তত আপনার সাথে এগিয়ে যাব আমি, প্রফেসর, গভীর আবেগের সঙ্গে বলল আর্থার।

আমি এখনও আপনার ছাত্র, স্যার, আপনার কাছ থেকে এখনও অনেক কিছু শেখার বাকি আছে আমার। যত বিপজ্জনক পথেই পা বাড়ান না কেন আপনি, শিখতে হলে তো আপনার সাথে থাকতেই হবে আমার, বললাম আমি।

আমাদের কথায় অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন প্রফেসর, তোমাদেরকে সাথী হিসেবে পেয়ে কি খুশি হয়েছি আমি বলে বোঝাতে পারব না। তাহলে এক কাজ কর, আর্থার, মরিস আগামী কাল সন্ধে সাতটায় জনের বাড়িতে আমার সাথে দেখা কর তোমরা। আজই একটা বিশেষ কাজে আমস্টারডামে যাচ্ছি আমি, অবশ্য কালই ফিরে আসব আবার। আর জন, তুমি এসো আমার সাথে। কথা আছে।

বিদায় নিয়ে লুসিদের বাড়িতে চলে গেল আর্থার আর মরিস। প্রফেসরের সাথে হোটেলে চললাম আমি। কামরায় ঢুকে টেবিলে রাখা একটা খাম পেলেন প্রফেসর। মিনার টেলিগ্রামঃ

আজ রাতের ট্রেনেই হুইটবি থেকে আপনার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছি আমরা। জরুরী কথা আছে।

মিনা হারকার।

সত্যি এই মহিলাটি একটি রত্ন, টেলিগ্রামটা পড়ে খুশি হয়ে উঠলেন প্রফেসর। কিন্তু ওরা তো ছিল এগজিটারে, হুইটবিতে এল কখন? আর এলই বা কেন?

বোধহয় কোন কাজ ছিল হুইটবিতে। যাকগে, ওসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই এখন, ওরা এলেই সব প্রশ্নের জবাব জানতে পারব, বললাম আমি।

ওরা তো আসছে, কিন্তু এখন ওদের রাখি কোথায়?

আমার বাড়িটার কথা ভুলে গেলেন, স্যার? ওখানেই তো স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবে ওরা।

হঠাৎ কি মনে হতেই ঘড়ি দেখলেন প্রফেসর। তারপর উদ্বিগ্ন ভাবে বললেন, রাতের ট্রেন আসতে তো আর বেশি দেরি নেই। তোমাকে তো তাহলে এখুনি স্টেশনে রওনা হতে হয়।

তাই যাচ্ছি, স্যার। আর আপনি?

আমিও আজ রাতের ট্রেনই ধরছি। হঁ্যা, ভাল কথা, যেজন্যে তোমাকে সাথে করে এনেছি, বলে টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা খাম বের করলেন প্রফেসর। ওটা আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, নাও, এটার ভেতর মিনার স্বামী জোনাথনের ট্রানসিলভেনিয়া ভ্রমণের এক অদ্ভুত কাহিনী লেখা আছে। জোনাথনের ডায়েরীর কপি এটা। অবসর সময়ে পড়ে দেখ, অজানা অনেক প্রশ্নের জবাব পাবে। হারিয়ে ফেলো না কিন্তু আবার। আমার কাছে এটা সোনার খনির চেয়েও মূল্যবান।

না, না, স্যার। সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আপনি। তাহলে, আমি এখন যাচ্ছি, স্যার?

এসো।

খামটা হাতে করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। হাতঘড়িতে দেখলাম ট্রেন এসে পড়ার সময় প্রায় হয়ে গেছে। হাতে সময় অল্প, যেভাবেই হোক এই অল্প সময়ের মধ্যেই স্টেশনে পৌঁছতে হবে আমাকে।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত