২.০৬ আবার নতুন করে শুরু
জোনাথন হারকারের ডায়েরী থেকে
২৬ সেপ্টেম্বর।
আবার নতুন করে শুরু করতে হবে ভাবিনি, উপায়ও নেই না করে। এত আনন্দ কেমন করে চেপে রাখব আমি? গত রাতে খাবার টেবিলে প্রফেসর ভ্যান হেলসিং-এর সাথে সাক্ষাৎকারের কথা আমাকে বিস্তারিত বলেছে মিনা। প্রফেসরের আশ্বাসবাণীতে যেন নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছি আমি। স্বপ্ন আর বাস্তবতার এক গভীর সন্দেহ এতদিন কুরে কুরে খেয়েছে আর মনকে, তা থেকে কাল মুক্তি পেয়েছি। এখন থেকে আর কোন কিছুতেই ভয় পাব না, ভয় পাব না বয়ং কাউন্ট ড্রাকুলাকে দেখেও।
একটা জিনিস কিছুতেই বুতে পারছি না আমি। লণ্ডনে এসেই কি করে যৌবন ফিরে পে কাউন্ট ড্রাকুলা? যেভাবেই পাক, তা নিয়ে আর ভাবব না। প্রফেসর হেলসিং ওর বিরুদ্ধে লেগেছেন যখন, এর কারণ একদিন জানতে পাই।
আমরা আজ সকালে নাস্তা করতে বলার আগেই এসে হাজির হয়েছেন প্রফেসর। বলতে কি, আমার জীবনের এ এক স্মরণীয় মুহূর্ত। আমাকে দেখে যতটা খুশি হলেন প্রকেন, তাকে দেখে তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হলাম আমি। ঘরে ঢুকেই এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে চিবুকটা ধরে আলোর দিকে ফিরি বললে প্রফেসর, মিনা বলছিল তুমি অসুস্থ, কিন্তু কই, তার কোন লক্ষণ দেখছি না তো?
মিছে কথা বলেনি, মিনা, ওঁকে বসতে বলে মৃদু হেসে বললাম, আসলে গতকাল আপনার আগমন বার্তা শোনার আগে পর্যন্ত সত্যিই অসুস্থ ছিলাম আমি, প্রফেসর। আপনার আশ্বাসবাণী মিনার মুখ থেকে শোনার পর পরই সম্পূর্ণ ভাল হয়ে গেছি আমি।
ভেরি গুড। এরকম রোগী না হলে চিকিৎসা করে মজা কোথায়? হো হো করে হেসে উঠে বললেন প্রফেসর। ওঁর হাসির শব্দে প্রায় ছুটতে ছুটতে ঘরে এসে ঢুকল মিনা, আমার জন্যে ডিমের ওমলেট করে আনতে কিচেনে গিয়েছিল সে। মিনাকে ঢুকতে দেখেই ওর উদ্দেশ্যে বললেন প্রফেসর, কেমন মিনা, বলিনি, ভাবনার কোন কারণ নেই, ভাল হয়ে যাবে জোনাথন?
এর আগে অনেকের মুখেই শুনেছিলাম, প্রফেসর ভ্যান হেলসিং-এর চেহারা দেখেই রোগীর দেহ ছেড়ে রোগ পালায়, কথাটা দেখছি মিথ্যে নয়, হেসে জবাব দিল মিনা। তা এখন তাড়াতাড়ি বসে পড়ুন তো, প্রফেসর। আর একটা প্লেট নিয়ে আসছি আমি।
খাওয়া শেষ করে মোটা একটা চুরুট ধরালেন প্রফেসর। চুরুটে গোটা কয়েক টান দিয়ে বললেন, তোমার ডায়েরীতে বর্ণিত কাহিনীটা আমি পড়েছি, জোনাথন। কিন্তু সবটা ব্যাপার আবার এখন তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই আমি। কাহিনীর কোন কোন জায়গা এখনও দুর্বোধ্য ঠেকছে। সে সব জায়গাগুলো নিয়ে আলোচনা করলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে অনেক কিছু।
সব বলব, প্রফেসর। তবে তার আগে আমার ছোট্ট একটা প্রশ্নের জবাব দিন তো। কাউন্ট ড্রাকুলার অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশ্বাস করেন আপনি?
অবশ্যই। লুসিই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
প্রফেসরের কথা শুনে খুশিতে চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। সভ্য জগতের একজন অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন মানুষ আমার এই অবিশ্বাস্য অদ্ভুত কাহিনী বিশ্বাস করবে, স্বপ্নেও ভাবিনি। একথা কাউকে বলে বিশ্বাস করাতে পারব, এ চিন্তাটাই আসলে এতদিন আমাকে কুরে কুরে খেয়েছে। বললাম, তাহলে শুনুন, প্রফেসর। নড়ে চড়ে চেয়ারে আরাম করে বসলেন প্রফেসর। আর আমি বলে যেতে থাকলাম আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতার কথা, একটুও না বাড়িয়ে, একটুও না কমিয়ে।
বসে বসে আমার সব কথা শুনলেন প্রফেসর। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করে জেনে নিচ্ছিলেন এটা ওটা। আমার কথা শেষ হবার পরও কয়েক মিনিট চুপচাপ কিছু ভাবলেন প্রফেসর। তারপর হাতঘড়ির দিকে একবার চেয়েই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, অনেক, অনেকখানি এগিয়ে দিয়েই আমাকে তুমি, জোনাথন। সেজন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু এখন আমাকে আবার হুইটবিতে ফিরে যেতে হচ্ছে। সাড়ে দশটার ট্রেন ধরতে হলে আর দেরি করা যায় না।
আমার জীবনের ওই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা যদি আপনার সামান্যতম কাজেও লাগে তাহলে নিজেকে আমি ধন্য মনে করব, প্রফেসর। চলুন আপনাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি।
স্টেশনে যাবার পথে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর, তোমাকে যদি ইতিমধ্যে কখনো হুইটবিতে গিয়ে আমার সাথে দেখা করতে বলি, তাহলে তোমার কোন অসুবিধে নেই তো, জোনাথন?।
অসুবিধে? কিছুমাত্র না। যখনই খবর পাঠাবেন, দেখবেন, উড়ে গিয়ে হাজির হয়েছি।
সম্ভব হলে মিনাকেও নিয়ে যেয়ো।
সে অনুমতিই তো আপনার কাছে চাইতে যাচ্ছিলাম আমি।
স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে হল না। জানালার কাছেই সীট পেলেন প্রফেসর। ওঁর জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, এমন সময় একজন খবরের কাগজের হকার দেখে সেদিনকার এক কপি দি ওয়েস্ট মিনিস্টার গেজেট কিনলেন প্রফেসর। আমার সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকেই কাগজটা উল্টে পাল্টে দেখছিলেন, হঠাৎ কাগজের এক জায়গায় চোখ পড়তেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি, থমথমে কঠিন হয়ে গেল মুখ চোখ। আর একবার মনোযোগ দিয়ে সংবাদটা পড়লেন তিনি। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, এত কুৎসিত আর ভয়ঙ্কর পথ বেছে নেবে পিশাচটা, ভাবিনি। কি খবর পড়ে অমন চমকে উঠলেন প্রফেসর, উঁকি দিয়ে দেখতে গেলাম। ওদিকে হুইসল দিয়ে চলতে শুরু করেছে গাড়ি। কাজেই খবরটা পড়তে পারলাম না, কিন্তু হেডিংটা ঠিকই পড়লাম, হ্যাম্পস্টেড রহস্য। ঠিক করলাম এখুনি একটা কাগজ কিনে নিয়ে খবরটা পড়তে হবে।
ক্রমশঃ গতি বাড়ছে ট্রেনের। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে বললেন প্রফেসর, খুব শিগগিরই বোধহয় হ্যাম্পস্টেডে আসতে হতে পারে তোমাদের। তৈরি থেকো।
গাড়িটা স্টেশন ছেড়ে চলে যেতেই একটা দি ওয়েস্ট মিনিস্টার গেজেট কিনে খবরটা পড়লাম। পড়ে প্রফেসরের মতই চমকে উঠলাম আমিও। বিদ্যুৎ চমকের মত মনে পড়ে গেল কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদ দুর্গের তিন ডাইনীর কথা। এখনও পরিষ্কার কানে এসে বাজছে যেন ওই ডাইনীদের দিকে বাড়িয়ে ধরা কাউন্টের কাপড়ের পুটলির ভেতর মানব শিশুর কান্না!