২.০৩ ঝড়ের গতিতে এগজিটারের দিকে
মিনা হরকারের ডায়েরী থেকে
২২ সেপ্টেম্বর।
ঝড়ের গতিতে এগজিটারের দিকে ছুটে চলেছে ট্রেন। জানালার পাশে বসে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে অতীতের কথা ভাবছি। এই তো ক দিন আগে হুইটবিতে ছিলাম। সেদিন আমার কাছ থেকে অনেক, অনেক দূরে ছিল জোনাথন। আর আজ? আজ সে আমার স্বামী, সুপ্রতিষ্ঠিত একজন আইনজীবী। এই তো আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছ সে। কত ঘটনই না ঘটে গেল এর মধ্যে, কত পরিবর্তন হয়ে গেল পারিপার্শ্বিক অবস্থার।
সুচারু রূপেই মিস্টার হকিন্সের শেষকৃত্য সমাধা হয়েছে। আমি আর জোনাথন ছাড়াও ওঁর কয়েকজন বিশিষ্ট বন্ধু, যাঁরা এগজিটারেই থাকেন এবং তার লণ্ডনস্থ একজন মক্কেল স্যার জন প্যাটনও কবর দেবার সময় উপস্থিত ছিলেন। পৌরহিত্য করালেন স্যার প্যাক্সটনই। ভারাক্রান্ত চোখে সারাক্ষণ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আমাদের পিতৃস্থানীয় মিস্টার হকিন্সের কবর দেয়া দেখলাম আমি আর জন।
কাজ শেষ হলে ঘোড়া গাড়িতে চেপে শহরে ফিরে এসেছিলাম আমরা। গাড়ি থেকে নেমে অনিশ্চিত ভাবে এদিক ওদিক ঘুরতে শুরু করলাম দুজনে। শেষ পর্যন্ত জনের ইচ্ছায়ই হাইড পার্কের এক নির্জন কোণে একটা ভাল জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়লাম আমরা। একটু পরই সাঝ ঘনিয়ে এল। খানিকক্ষণ পরই ভীষণ নিস্তব্ধ হয়ে এল জায়গাটা, মেন যেন বিষণ্ণও। আর বসে থাকতে ভাল লাগল না, তাই উঠে পড়লাম। পিকাডিলির পথ ধরে পাশাপাশি হাটছি। সেই পুরনো দিনের মত আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিড়ি করে ধরে রেখেছে জোনাথন।
চারদিকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছি, হঠাৎ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বিরাট ঘোড়ার গাড়িতে একটা মেয়েকে বসে থাকতে দেখেই ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। চমকে ওঠার কারণ হল গুচ্ছ গুচ্ছ সোনালী চুলের ওপর একটা সুন্দর সাদা হ্যাট পরে একজন লোকের পাশে বসে আছে আমার প্রিয় বান্ধবী লুসি। এপাশ থেকে লোকটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না ভালমত। এক ঝটকায় জোনাথনের মুঠো থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গাড়িটার দিকে দৌড়ে গেলাম। আমার পেছন পেছন ছুটে এল জন। গাড়ির কাছে পৌঁছে নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকলাম সিকে। ধীরে ধীরে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল লুসি, সঙ্গে সঙ্গে লোকটাও। এতক্ষণে লোকটার চেহারা ভালমত নজরে পড়ল আমার। ওর ঈগলের মত বাকানো নাকের নিচে ছুঁচালো এক জোড়া গোঁফ, আর অদ্ভুত লাল দুটো চোখ। গাড়ির ভেতরের আবছা আলোয় আঙ্গারের মত ধ্বক ধক করে জ্বলছে সে চোখ। ঠিক এই সময় অফুটে আর্তনাদ করে উঠল জোনান।
কি হলো? বলে উৎকণ্ঠিত ভাবে জোনাথনের দিকে ফিরে চাইলাম আমি।
আঙুল তুলে ঘোড়াগাড়িটার দিকে নির্দেশ করে বলল জোনাথন, এ সে-ই! ওকে চিনতে পারছ না তুমি, মিনা?
জোনাথনের কথার অর্থ ঠিক বুঝতে না পেরে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার চাইলাম গাড়িতে বসা লোকটার দিকে। সামনের দিকে এখন একটু ঝুঁকে বসায় রাস্তার পাশের একটা দোকানের আলো তেরছা ভাবে এসে পড়েছে লোকটার মুখে। সে আলোয় লোকটার চেহারা ভালমত নজরে পড়ল আমার। সঙ্গে সঙ্গেই শিউরে উঠলাম আতঙ্কে। কারণ এ মুখের সাথে আমার চাক্ষুষ পরিচয় না থাকলেও বার বার শুনে শুনে আর পড়ে ও-চেহারা এখন আমার মুখস্থ। পাথরের মত রুক্ষ কঠিন লোকটার মুখ। টুকটুকে লাল ঠোঁটের কোণ থেকে উঁকি মারছে ককে সাদা দুটো তীক্ষ্ণ দাঁত। চোখের দৃষ্টিতে ওর রাজ্যের লালসা, দেখলেই ঘিন ঘিন করে ওঠে সারা গা। ঠিকই বলেছে জোনাথন। এ সে-ই! কিন্তু ওর পাশে লুসি কেন? তবে কি…
একটা অজানা আতঙ্কে ধ্বক করে উঠল হৃৎপিণ্ডটা।
এই সময় হঠাৎ চলতে শুরু করল গাড়িটা। ওটা আমার সামনে দিয়ে বেরিয়ে যেতেই ঘুরে দাঁড়ালাম। এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে চলমান গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে জোনাথন! আমি ফিরে দাঁড়াতেও কোন কথা বলল না সে। চলতে চলতে মোড় নিয়ে একসময় চোখের আড়ালে চলে গেল গাড়িটা।
গাড়িটা চলে যাবার পর জোনাথন আমার দিকে চাইতেই জিজ্ঞেস করলাম, লোকট কাউন্ট ড্রাকুলা না?
হ্যাঁ, কাউন্ট ড্রাকুলাই। কিন্তু এরই মাঝে এত তরুণ হয়ে গেল কি করে ও? আর ওর পাশের মেয়েটাই বা কে?
হঠাৎ হাসপাতালের ডাক্তারের কথা মনে পড়ে গেল আমার। এসব ব্যাপার নিয়ে জোনাথনের স্নায়ুতে চাপ পড়লে ক্ষতি হতে পারে ওর, বলেছিল ডাক্তার, তাই আর কোন কথা না বলে তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে সে-জায়গা থেকে সরে পড়লাম। কিন্তু বাড়ি ফিরে যেতে মন চাইছে না। অগত্যা গ্রীন পার্কের একটা বেঞ্চিতে এসে বসলাম দুজনে, পাশাপাশি। কিন্তু সেখানেও বেশিক্ষণ ভাল লাগল না। শেষ পর্যন্ত দুত্তোর বলে উঠেই পড়ল জোনাথন, সাথে সাথে আমিও।
আবার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম আমরা। মন জুড়ে ভিড় করে আছে আমার ড্রাকুলার চিন্তা। শুধু ড্রাকুলা হলেও না হয় কথা ছিল, কিন্তু তার সাথে লুসি কেন? হাঁটতে হাঁটতেই একসময় বাড়ির কাছে এসে পড়লাম। কিন্তু বাড়িতেও মন টিকবে না। মিস্টার হকিন্সের অনুপস্থিতি অসহ্য পীড়া দেবে মনকে। তবুও জোনাথনের বিশ্রামের কথা ভেবে ঢুকে পড়লাম বাড়িতে।
নিজের ঘরে এসে ঢুকতেই একটা টেলিগ্রাম দিয়ে গেল চাকরটা। বোবার টেলিগ্রাম করতে গেল আমার কাছে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে খুললাম খামটা। লেখাটা পড়েই কেঁপে উঠলাম থর থর করে। ধপ করে বসে পড়লাম বিছানার ওপর।
কি হলো, কি হলো? উদ্বিগ্ন ভাবে জিজ্ঞেস করল জোনাথন। নিঃশব্দে ওর হাতে তুলে দিলাম টেলিগ্রামটা। শব্দ করে পড়ল জোনাথন, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, পাচদিন আগে মারা গেছেন মিসেস ওয়েস্টেনরা, লুসিও মারা গেছে গত পরশু। আজই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে ওদের-প্রফেসর ভ্যান হেলসিং।
জোনাথনের পড়া শেষ হতেই বললাম, জানো, আজ কাউন্ট ড্রাকুলার পাশে বসে থাকা মেয়েটা কে ছিল? স্বয়ং লুসি। এখন বুঝতে পারছি লুসির মৃত্যুটা অস্বাভাবিক। যে-কোন রহস্যময় উপায়েই হোক সুসিকে নিজের দলে টেনে নিয়েছে শয়তান, পিশাচ কাউন্ট ড্রাকুলা। আর আজ সন্ধ্যার পর ঘোড়া গাড়িতে বোধহয় কাউন্ট ড্রাকুলার সাথে নৈশ অভিসারেই বেরিয়েছিল লুসি। ঈশ্বর, এ-ও দেখতে হলো আমাকে।
.
ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে
২২ সেপ্টেম্বর।
সমস্ত কাজ শেষ হয়ে যাবার পর রিং-এ ফিরে গেছে আর্থার, সাথে করে নিয়ে গেছে কুইনসে মরিসকে। এ কদিন ছায়ার মত আমাদের সাথে সাথে থেকে সব কাজে সাহায্য করেছে মরিস। আশ্চর্য! ওর মুখ দেখে একবারও মনে হয়নি লুসির মৃত্যুতে সামান্যতম ব্যথা পেয়েছে সে। আসলে ব্যথা সে ঠিকই পেয়েছে, ও-ও তো ভালবাসত লুসিকে, কিন্তু প্রচণ্ড সহনশীলতা ওর। অন্তরে সারাক্ষণ জ্বলে পুড়ে মরেছে, কিন্তু বিন্দুমাত্র বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি তার।
আজ রাতের গাড়িতে আমস্টারডামে ফিরে যাবেন প্রফেসর ভ্যান হেলসিং, তবে আগামীকালই আবার ফিরে আসবেন তিনি। ওখানে নাকি কয়েকটা ব্যক্তিগত কাজ শেষ করতে হবে তাকে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। হ্যাম্পস্টেড গির্জার চূড়াটা পরিষ্কার চোখে পড়ছে এখান থেকে। নির্জন পাহাড়ী উপত্যকার ওই রকম এক গির্জা সংলগ্ন উন্মুক্ত আঙিনার কাছের কবরখানায় নিজের আত্মীয় স্বজনের পাশে এখন চিরদ্রিায় নিদ্রিত লুসি। ভোরের সোনালী আলোয় ঝলমল করছে সারাটা উপত্যকা। ওদিক থেকে বয়ে আসা ঝিরঝিরে দখিনা হাওয়ায় ভর করে ভেসে আসছে নাম না জানা বুনো ফুলের গন্ধ।
আগামীকাল প্রফেসর ফিরে না আসা পর্যন্ত করার কিছুই নেই। এ সময়টা কি করে কাটাব ভাবছি। দারুণ উত্তেজনায় কি করে কেটে গেছে গত কটা দিন টেরই পাইনি। এখন সমস্ত উত্তেজনার শেষে দিন রাতের প্রতিটা মুহূর্তকে অসম্ভব দীর্ঘ বলে মনে হচ্ছে।
হঠাৎ মনে হল, তাই তো, এমন সুন্দর একটা দিন, কাটানর অসুবিধে কোথায়? সুসির কবরখানায় চলে গেলেই হয়। ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটানর এক বিচিত্র জায়গা ওটা। কথাটা মনে হতেই উঠে পড়লাম।
এক কথায় অপূর্ব হ্যাম্পস্টেডের ওই পাহাড়ী উপত্যকাটা। চারদিকে গাছে গাছে ফুটে আছে অসংখ্য মাম না জানা বুনো ফুল, ওগুলোর গন্ধে ভুরভুর করছে এলাকাটা। আর ওসব ফুলের আশেপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার প্রজাপতি। বিচিত্র ওদের রঙ, কোনটা গাঢ় নীল, লাল বা হলুদ, কোনটার কাল পাখার ওপর সাদা ছাপ, কোনটা মাখন রঙা আর কোনটা রামধনুর সাত রঙ গায়ে নিয়ে উড়ছে বিচিত্র কায়দায়।
পায়ের নিচের লম্বা সবুজ ঘাসের ভেতর ছুটোছুটি করছে অসংখ্য মেঠো ইঁদুর। প্রায়ই একটা বাদাম বা ওই জাতীয় কিছুতে ভাগ বসাতে গিয়ে তুমুল মারপিট বাধাচ্ছে ওরা। প্রকৃতির এতসব আশ্চর্য জিনিস দেখতে দেখতে ভুলেই গেলাম লুসির কথা।
দুপুর পর্যন্ত একটানা ঘুরে বেড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে এসে শুয়ে পড়লাম একটা বিশাল ওকের ছায়ায়। আমি শোয়র মাত্র মিনিটখানেক পরই ছোট ছোট প্রাণীর আনাগোনায় জ্যান্ত হয়ে উঠল আমার আশপাশটা। ঝোপের ভেতর থেকে সুড়ুৎ করে বেরিয়ে আসছে খরগোশ। গাছ থেকে অতি সাবধানে নেমে আসছে কাঠবিড়ালী। সারাক্ষণ কান খাড়া হয়ে আছে ওদের। সামান্যতম বিপদের আভাস পেলেই ছুটে পালিয়ে যাবে নিরাপদ আশ্রয়ে। পরিষ্কার নীল আকাশের কোথাও একরত্তি মেঘ নেই। বই ওপরে, স্থির শান্ত ভঙ্গিতে ডানা মেলে দিয়ে ভাসছে একটা চিল। দেখতে দেখতে দুচোখ জড়িয়ে এল ঘুমে।
ঘুম ভাঙল গির্জার সান্ধ্য ঘণ্টাধ্বনিতে। ওরে বাবা, এতক্ষণ ঘুমিয়েছি। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। পশ্চিমাকাশে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। তার টকটকে লাল আভায় রঙিন হয়ে গেছে ওদিককার আকাশ। আর দেরি করা যায় না। উঠে দাঁড়িয়ে রওনা হলাম বাড়ির দিকে। পেছনে বিষঃ একঘেয়ে ঢং ঢং শব্দে বেজেই চলল হ্যাম্পস্টেড গির্জার ঘণ্টা।