১.৯ প্রফেসর ভ্যান হেলসিং
ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে
৭ সেপ্টেম্বর।
ঘরে ঢুকেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর ভ্যান হেলসিং, লুসির রোগের কথা বিস্তারিত লিখে জানিয়েছ মি. হোমউডকে?
না। আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি। তবে লুসি অসুস্থ এ-কথাটা জানিয়েছি ওকে।
বেশ করে। ওকে বিস্তারিত জানানর সময় আসেনি এখনও।
আসলে ব্যাপারটা কি, স্যার?
ব্যাপার একটা নিশ্চয়ই আছে। তবে আগে শিওর হয়ে নিই আমি, তারপর বলব।
এখনই বললে হয় না? আমরা সবাই মিলে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে প্রফেসরের মুখের দিকে চেয়েই থেমে গেলাম আমি।
দেখো, সবকিছু জানারই একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। তার আগে জানাও যেমন উচিত নয়, পরে জেনেও লাভ নেই। অতএব ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতেই হচ্ছে তোমাকে।
বুঝলাম, সময় না এলে সারাক্ষণ চাপাচাপি করেও এর বেশি একটা কথা বের করা যাবে না প্রফেসরের মুখ থেকে। অগত্যা আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে থাকলাম।
কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বললেন প্রফেসর, চলো, লুসিকে এবার দেখে আসি।
সম্মতি জানিয়ে উঠে পড়লাম। কথা বলতে বলতে লুসিদের বাড়ির দিকে এগিয়ে চললাম। আমার মুখে সুসির রোগের উপসর্গগুলোর বিস্তারিত বিবরণ শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন প্রফেসর। এরপর সারা পথটায় আর একটা কথাও বললেন না তিনি। গভীর চিন্তাৰিতভাবে পথ চলতে লাগলেন।
লুসির ঘরে পা দিয়েই চমকে উঠলাম ওর চেহারা দেখে। গতকালও তো এমন ছিল না ও। বিবর্ণ পাংশুটে মুখ, শুকনো ম্লান দুটো ঠোঁট, ঠেলে বেরিয়ে এসেছে চিবুকের হাড়। ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে ওর। প্রফেসরের দিকে চেয়ে দেখলাম পাথরের মত কঠিন দেখাচ্ছে ওঁর মুখ, লোমশ ভূ দুটো কুঁচকে লেগে রয়েছে একটার সাথে আর একটা। নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি লুসির রোগজীর্ণ শরীরটার দিকে। কয়েক সেকেণ্ড তেমনিভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে ইশারায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বললেন তিনি।
বাইরের বুল-বারান্দাটায় বেরিয়েই নিচু, গম্ভীর গলায় আমাকে বললেন, এক্ষুণি, এই মুহূর্তে ওকে রক্ত দিতে হবে, জন। এখন থেকে যেকোন মুহূর্তে রক্তের অভাবে মৃত্যু ঘটতে পারে ওর।
এত তাড়াতাড়ি তো বাইরে কোথাও থেকে রক্ত জোগাড় করা যাবে না। আমার রক্তের গ্রুপ ওর সাথে মেলে কিনা একবার দেখে নিন, স্যার।
এটা এমন একটা কেস, জন, যে এসব রোগীকে রক্ত দিতে হলে রক্তের গ্রুপ মেলাবার দরকার পড়ে না। যে-কোন গ্রুপের মানুষের রক্ত হলেই হল। এখন এসো আমার সাথে। যন্ত্রপাতির ব্যাগটা নিচে রেখে এসেছি।
চলুন।
নিচে নেমেই বুঝলাম কে যেন ড্রইংল্কমে দরজার কড়া নাড়ছে। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েই চমকে উঠলাম, চেহারায় গভীর উৎকণ্ঠার ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর্থার। আমাকে দেখেই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করল, খবর কি, জন। লুসি কেমন আছে? বলেই আমার পেছনে দাঁড়ানো প্রফেসরের দিকে চোখ পড়তে বলল, ইনিই বোধহয় প্রফেসর হেলসিং?
আমি সম্মতি জানাতেই প্রফেসরের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর একটা হাত চেপে ধরল আর্থার, আঃ, বাঁচালেন আমাকে, প্রফেসর। আপনি এসে পড়ায় সত্যিই নিশ্চিন্ত হচ্ছি আমি। ( ঠিক সময়েই এসে পড়েছ দেখছি তুমি। ভালই হল, বললেন প্রফেসর। কিন্তু মুখ দেখে আমার মনে হল আর্থারের উপস্থিতিতে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারছেন
প্রফেসর। বোধহয় তার কাজে বাধার আশঙ্কা করছেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর্থারের উদ্বেগ লক্ষ্য করে বললেন, এসময়ে তোমার সহযোগিতার দরকার আছে লুসির।
কি করতে হবে শুধু আদেশ করুন, প্রফেসর। লুসির জন্যে শরীরের শেষ রক্ত বিন্দুটুকু পর্যন্ত দিতে রাজি আছি আমি।
ভেরি গুড। তবে আপাতত সবটুকু রক্তের দরকার নেই, খানিকটা হলেই চলবে, বলে হাসলেন প্রফেসর।
প্রফেসরের কথাটা ঠিক বুঝেতে পারল না আর্থার। বুঝতে পেরে বললেন প্রফেসর, লুসিকে রক্ত দেয়া প্রয়োজন, আর্থার। একটু আগে জনই রক্ত দিতে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তুমি যখন এসেই পড়েছ…
আমি রাজি। এক্ষুণি কি দরকার?
এক্ষুণি দরকার। চলো, আর দেরি না করে প্রয়োজনীয় কাজটুকু সেরে ফেলি।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে আর্থারকে সতর্ক করে দিলেন প্রফেসর, সাবধান, আর্থার। অযথা হৈ-চৈ করে লুসির ঘুম ভাঙাবে না। আর যদি নিজে নিজেই ও জেগে ওঠে তাহলেও উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে এমন কোন কথা বলবে না লুসির সাথে।
নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন আপনি, প্রফেসর।
গুড।
তিনজনেই এসে দাঁড়ালাম লুসির ঘরের সামনের ঝুল-বারান্দায়। প্রফেসরের নির্দেশে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল আর্থার। আমরা দুজনে ঘরে ঢুকলাম। ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে তখন লুসি। আমাদেরকে ঘরে ঢুকতে দেখেও তার চেহারায় কোন ভাবান্তর হল না। নিরুৎসুক দৃষ্টিতে শুধু আমাদের দিকে চেয়ে থাকল।
ব্যাগ হাতে ধীরেসুস্থে এগিয়ে সুসির বিছানার পাশে বসলেন প্রফেসর। ব্যাগ থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে তাতে ওষুধ ভরে ইঞ্জেক্ট করে দিলেন লুসির শরীরে। কয়েক সেকেও পরই অতি ধীরে চোখের পাতা মুদে ফেলল লুসি। ভারি হয়ে এল ওর শ্বাস-প্রশ্বাস। আবার গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল সে।
আর্থারকে ডাকতে বললেন আমাকে প্রফেসর। আর্থার ঘরে ঢুকতেই বললেন, কোটটা খুলে ফেললা, আর্থার। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, জন, এসো, ওই টেবিলটা ধরে লুসির বিছানার পাশে নিয়ে আসি।
টেবিলটা বিছানার পাশে এনে রাখতেই, আর্থারকে তাতে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন প্রফেসর। আর্থার নির্দেশ পালন করতেই নিপুণ হাতে রক্ত বিনিময়ের পালা শেষ করলেন তিনি। আর্থারের হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে দেখলাম একটা সরু লিকলিকে কালো রেশমী ফিতে লুসির গলায় ঝুলিয়ে দিচ্ছেন প্রফেসর। ফিতেটায় লকেটের মত কি একটা বাঁধা। লকেটটা পরিয়ে দেবার সময় লুসির গলার কাছের কাপড়টা একটু সরিয়ে ছিলেন প্রফেসর। তখন পরিষ্কার চোখে পড়ল লুসির গলার কাছের ছোট্ট দুটো ক্ষত।
লকেটটা ঝোলানো শেষ হবার পরও অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন প্রফেসর, তার সাথে সাথে আমরাও। একটু একটু করে লুসির গালের লালিমা আবার ফিরে আসছে। আরও কিছুক্ষণ পর লুসির দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আর্থারের দিকে চেয়ে বললেন প্রফেসর, লুসিকে আজ নতুন জীবন দিলে, আর্থার। এবার পাশের ঘরে গিয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নাও। জন, ওকে পৌঁছে দিয়ে এসো।
কিন্তু বিশ্রাম নিল না আর্থার। কারণ রাতের গাড়িতেই আবার অসুস্থ বাবার কাছে ফিরে যাবে ও। আর্থারকে নিচে পৌঁছে দিয়ে আবার লুসির ঘরে ফিরে এসে দেখলাম, তখনও লুসির বিছানার পাশে বসে স্থির দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চেয়ে আছেন প্রফেসর। আমাকে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, লুসির গলার ওই দাগগুলো দেখেছ?
দেখেছি, তবে আজই প্রথম।
হুঁ, এবং ওই দাগগুলোর জন্যেই আজ রাতে আমস্টারডামে ফিরে যেতে হচ্ছে আমাকে। কয়েকটা বই আর দরকারি জিনিসপত্র আনতে হবে। আমি না আসা পর্যন্ত সারাক্ষণ এ-ঘরে থেকে লুসিকে পাহারা দিতে হবে তোমাকে, বিশেষ করে রাতের বেলা।
এক-আধজন নার্সের দরকার আছে?
আছে। তবে সে-কাজটা আপাতত তোমাকেই করতে হবে। তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, রাতের বেলা মুহূর্তের জন্যেও এ-ঘর ছেড়ে কোথাও যাবে না, বা ঘুমুবে না। চোখ-কান খোলা রাখবে। যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব আমি। এসেই আবার নতুন করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে লুসির।
আবার নতুন কি করবেন? একটু অবাক হয়েই জানতে চাইলাম।
পরে বলব, বলেই ব্যাগটা হাতে নিয়ে দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন প্রফেসর। দরজার গোড়ায় পৌঁছেই আবার ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, লুসিকে তোমার হাতে রেখে গেলাম, জন। মনে রেখো, লুসির যদি কিছু ঘটে তাহলে আমার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে তোমাকে, বলেই চলে গেলেন প্রফেসর।
৮ সেপ্টেম্বর।
সারাটা রাত লুসির পাশে জেগে বসে থাকলাম। দিন-রাতের প্রায় সারাক্ষণই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল লুসি। শুধু সাঁঝের দিকে একবার একটুক্ষণের জন্যে ঘুম ভেঙেছিল ওর। সে-সময় পরিচারিকাকে ডেকে ওকে রাতের পোশাক পরিয়ে দিতে এবং আমি না ফেরা পর্যন্ত লুসির পাশে থাকতে বলে নিচে নেমে এলাম লুসির মায়ের সাথে দেখা করার জন্যে। ওর সাথে কয়েক মিনিট কথা বলে লুসির অবস্থা জানিয়ে খাবার ঘরে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে কিছু খেয়ে নিলাম।
লুসির ঘরে ফিরে আসতেই আশ্চর্য সুন্দর চোখ দুটো মেলে আমার দিকে চাইল ও ওষুধের প্রক্রিয়ায় আবার ঘুমিয়ে পড়তে যাচ্ছে ও, চোখের পাতার সঙ্কোচন দেখেই তা আন্দাজ করা যায়। আমাকে দেখে প্রাণপণে চোখের পাতা খুলে রাখার চেষ্টা করল ও। মাথাটাকে এপাশ-ওপাশ নাড়িয়ে ঘুম তাড়াবার চেষ্টা করল বার দুয়েক।
মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলাম, ঘুমোতে ইচ্ছে করছে না, লুসি?
না, কেন যেন ভয় ভয় করছে।
কিসের ভয়?
ঠিক বোঝাতে পারব না তোমাকে, জন। রাতের বেলা, বিশেষ করে গভীর রাতে ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন দেখি আমি, আশ্চর্য, তখন ওগুলোকে সত্যি বলে মনে হয়।
আরে না, ওসব কিছু না। আসলে দুর্বল হয়ে পড়েছ তো, অল্পতেই ভয় পেয়ে যাও। শরীরে একটু বল ফিরে আসলেই দেখবে দুঃস্বপ্নটা কিছু থাকবে না।
আমার তা মনে হয় না, জন।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন ঘুমাও। তোমার পাশে বসেই পাহারা দেব আজ সারারাত। ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙে গেলে দেখবে ঠিক তোমার কাছেই বসে আছি আমি।
আহ্, বাঁচালে জন, বলেই ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মুদল লুসি। কয়েক সেকেণ্ডেই ঢলে পড়ল গভীর ঘুমে।
তারপর সারারাতে একবারের জন্যেও চোখ মেলেনি লুসি, এমনকি নড়েনি পর্যন্ত। বুঝলাম, সারারাতে একবারও দুঃস্বপ্ন দেখেনি সে।
ভোরবেলা মোরগ ডাকার সঙ্গে সঙ্গে পরিচারিকা এসে ঘরে ঢুকল। ওর হাতে সুসির ভার দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। প্রথমেই প্রফেসর এবং আর্থারকে দুটো তারবার্তা পাঠালাম। তারপর গোসল করে খেয়ে-দেয়ে কাজে মন দিলাম। কয়েকদিনের জমানো অজস্র কাজ আর নানান টুকিটাকি গোছগাছ করতে করতেই দিনটা কেটে গেল। কয়েকদিন ধরে রেনফিল্ডের খোঁজ নেয়াও হয় না, তাই বিকেলের দিকে একবার দেখতে গেলাম ওকে। মোটামুটি ভালই আছে রেনফিল্ড। রাতে খেতে বসে আমস্টারডাম থেকে পাঠানো প্রফেসরের তারবার্তা পেলাম, আজ রাতেও আমাকে লুসির পাশে বসে কাটাতে অনুরোধ করেছেন তিনি। রাতের গাড়িতেই রওনা দিচ্ছেন প্রফেসর, আগামীকাল ভোর নাগাদ পৌঁছে যাবেন এখানে।
৯ সেপ্টেম্বর।
পরপর দুরাত জেগে কাটিয়ে দারুণ ক্লান্তি বোধ করছি আজ। প্রায় টলতে টলতে এসে পৌঁছুলাম লুসিদের বাড়িতে। আজ বেশ সুস্থ মনে হচ্ছে লুসিকে। আমার মুখের দিকে চেয়ে উদ্বিগ্ন হল লুসি, বলল, আজ অত্যন্ত ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে, জন। আজ আর মিছিমিছি আমার পাশে জেগে বসে থেকে কষ্ট করতে হবে না তোমাকে। তার চেয়ে তুমি ঘুমাও, আমিই বরং তোমার পাশে জেগে বসে থাকি।
ওর কথায় আমার মন থেকে অনেকখানি দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। ওর কাছ থেকে কিছুক্ষণের জন্যে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে এলাম। বাওয়া-দাওয়ার শেষে পরপর দুকাপ গরম কফি খেয়ে বেশ চাঙা হয়ে ওঠল শরীরটা। আবার ফিরে এলাম লুসির ঘরে। ওর পাশের ঘরটা দেখিয়ে লুসি বলল, ও-ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো তুমি। মাঝখানের দরজাটা খোলাই থাক। দরকার হলে ডাকব তোমাকে।
প্রতিবাদ করলাম না। অবশ্য প্রতিবাদ করার মত মন বা শরীরের অবস্থাও আমার নেই। সোজা পাশের ঘরে এসে একটা বড় সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চোখের পাতায় নেমে এল রাজ্যের ঘুম।
১০ সেপ্টেম্বর।
ঘুম ভাঙল প্রফেসরের হাতের স্পর্শে। যে-কোন রকম অবস্থায়ই অবাক না হয়ে নিঃশব্দে জেগে ওঠার অভ্যাস আমার বহুদিনের, সেই প্রথম মেন্টাল হাসপাতালে কাজ করার সময় থেকে।
আমাকে চোখ মেলাতে দেখেই উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর, লুসি, লুসির খবর কি?
ভাল।
চলো, ওকে দেখে আসি একবার।
চলুন, বলে উঠে পড়লাম সোফা থেকে। মাঝখানের দরজার পর্দা সরিয়ে লুসির ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘর অন্ধকার। এগিয়ে গিয়ে পর্দাগুলো সরিয়ে জানালার পাল্লা খুলে দিতেই ঘরের মেঝেয় এসে ছড়িয়ে পড়ল ভোরের সোনালী রোদ। এমন সময় প্রফেসরের অস্কুট অথচ ক্রুদ্ধ আর্তস্বরে চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালাম। লুসির দিকে চাইতে ধক করে উঠল হৃৎপিণ্ডটা, মনে হল হাঁটু ভেঙে পড়ে যাব। লুসির বিছানার পাশে পাথরের মূর্তির মত অনড় দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর। অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেছে ওঁর মুখ।
বিছানার সাথে প্রায় মিশে গেছে লুসি। ঠোঁট দুটো মোমের মত সাদা, ঠেলে বেরিয়ে এসেছে চোয়ালের হাড়। এক রাতের মাঝেই দীর্ঘদিনের রোগজীর্ণ অবস্থা হয়েছে ওর। অবিশ্বাস্য! এমন তো হবার কথা নয়। কাল রাতে তো দিব্যি সুস্থ দেখলাম ওকে।
প্রচণ্ড মানসিক শক্তির বলে কয়েক মুহূর্তেই দুর্দমনীয় ক্রোধকে সামলে নিয়ে আমার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর, জলদি যাও, এখুনি ব্র্যাণ্ডি নিয়ে এসো একটু।
সাথেসাথেই ছুটলাম আমি। একছুটে নিচ থেকে একটা ব্র্যাণ্ডির বোতল এনে প্রফেসরের হাতে তুলে দিলাম। বোতলের মুখ খুলে লুসির রক্তশূন্য ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক করে ভেতরে একটু ব্র্যান্ডি ঢেলে দিলেন প্রফেসর। তারপর নাড়ি ধরে হৃৎপিণ্ডের কম্পন অনুভব করলেন, অবস্থা খুব খারাপ, তবে এখনও সময় আছে। আবার রক্ত দিতে হবে ওকে। জন, এবার তোমার পালা।
কথা বলতে বলতেই হাতের আস্তিন গুটিয়ে ব্যাগ থেকে যন্ত্রপাতি বের করে ফেললেন। তারপর আগের দিনের মত টেবিলটা লুসির বিছানার পাশে টেনে এনে আজ আর্থারের পরিবর্তে তাতে শুয়ে পড়লাম আমি। দক্ষ হাতে রক্ত বিনিময়ের কাজ শেষ করলেন প্রফেসর। আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে ক্ষতি হতে পারে, সেআশঙ্কায় আগের মতই লুসিকে একটা মরফিয়া দিলেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে আমার হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে বললেন, শরীরের ওপর প্রচণ্ড ধকল গেছে তোমার গত দুদিন। নিচে নেমে নাস্তা সেরে আরেকটু বিশ্রাম নাওগে।
টেবিল থেকে উঠে এগিয়ে গিয়ে দোরগোড়ায় পৌঁছুতেই পেছন থেকে ডাকলেন প্রফেসর, আর্থার যদি আজ এসে পড়ে ওকে কিন্তু আবার এসব কথা বলো না। তাতে লাভ হবে না কিছু, মাঝে থেকে শুধু শুধু ভয় পেয়ে যাবে ও।
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে নিচে নেমে এলাম। নাস্তা খাওয়া হলে আর বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করল না, তাছাড়া গত পুরো রাতটাই নাক ডেকে ঘুমিয়েছি। তাই আবার ওপরে ফিরে এলাম। মৃদু হেসে বললেন প্রফেসর, তোমাকে না শুয়ে থাকতে বলেছি। এইমাত্র রক্ত দিয়েছ, এখন নড়াচড়া করলে ক্ষতি হবে। যাও, ওঘরে সোফাটায় বসে থাকোগে কিছুক্ষণ। দরকার হলে ডাকব তোমাকে।
প্রায় জোর করেই ঘর থেকে বের করে দিলেন আমাকে প্রফেসর। অবশ্য ওঁর আদেশ অমান্য করার মত সাহসও আমার নেই। অগত্যা পাশের ঘরে ঢুকে সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। কিন্তু সহজে ঘুম এল না। এক রাতের মধ্যে লুসির দেহের সমস্ত রক্ত নিঃশেষ হল কি করে, ভেবে দারুণ অবাক লাগল। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই একটু তন্দ্রা মত এল, আর তার ঘোরে লুসির গলার দাগটা কেবলই ঘুরেফিরে বেড়াতে লাগল আমার অবচেতন মনে।
বিকেলে প্রফেসরের ডাকে ঘুম ভাঙল আমার। লুসির ঘরে এসে দেখি ওরও ঘুম ভেঙেছে। অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে সে। লুসিকে আমার জিম্মায় রেখে একটু বেড়াতে বেরোলেন প্রফেসর। নিচের হলঘর থেকে ভেসে এল ওর গলা–পোস্ট অফিসটা কোনদিকে, কাকে যেন জিজ্ঞেস করছেন উনি।
লুসির সাথে আলাপ করতে করতে বুঝতে পারলাম সকালের দুর্ঘটনার কথা জানে না লুসি। একটু পরেই ঘরে এসে ঢুকলেন লুসির মা আমাকে দেখে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন মহিলা, তোমাকে কিন্তু সত্যি অত্যন্ত ক্লান্ত আর রোগা লাগছে, ডাক্তার, তারপর মৃদু হেসে বললেন, আসলে এখন একটা বিয়ে করা উচিত তোমার, দেখাশোনার তো কেউ নেই।
ওঁর কথায় হেসে উঠেই লুসির দিকে চাইলাম। চকিতে লুসির গালে একটা রক্তিমাভা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। এই রকম হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়েই সব ঘনিয়ে এল। এই সময় বাইরে থেকে ফিরে এলেন প্রফেসর। এসেই বললেন, জন, আজ রাতে তোমার ছুটি। খেয়েদেয়ে ভাল করে ঘুমাওগে। লুসিকে আজ আমিই পাহারা দেব, একটু থেমে বললেন, আর একটা কথা, এই সময়ে তোমাকে আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কাজেই তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে কাহিল হয়ে পড়ব আমি। আর তুমি ছাড়া আমার গোপন চিকিৎসার কথা কাউকে জানতে দেয়া চলবে না, বুঝেছ? যাও এখন, গুড নাইট।
১২ সেপ্টেম্বর। গত রাত আর আজ সারাটা দিন কষে ঘুমিয়েছি। বিকেলে ঝরঝরে শরীর নিয়ে লুসিদের বাড়িতে এসে হাজির হলাম। লুসির ঘরে ঢুকে দেখলাম লুসির সাথে গল্প করছেন প্রফেসর। আমি ঢুকতেই হেসে অভ্যর্থনা জানালেন আমাকে, এসো, জন, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি।
আমি একটা চেয়ারে বসতেই টেবিলের ওপর রাখা একটা কাগজের প্যাকেট খুলে কয়েকটা জিনিস বের করলেন প্রফেসর। ধবধবে সাদা জিনিসগুলো দেখেই লুসি বলল, একটু আগে ওগুলোর কথাই বলছিলেন আমাকে?
হ্যাঁ। চাপা কৌতুকে চিকচিক করছে প্রফেসরের দুই চোখ। কিন্তু ভেবো না এগুলো সাধারণ জিনিস। অবশ্য অসাধারণ বলছি না। কিন্তু তোমার রোগের পক্ষে শুধু অসাধারণই নয়, দুর্মূল্য। এগুলোর একটার সাথে একটা গেঁথে মালা বানিয়ে আজ রাতে তোমার গলায় পরিয়ে রাখব। দেখবে, সমস্ত দুঃস্বপ্ন দূর হয়ে গেছে তোমার।
বাহ, আমার সাথে আবার ঠাট্টা করছেন আপনি। ওই সাধারণ রসুনের মালা গলায় ঝুলিয়ে দিলেই রোগ সেরে যায় নাকি?
কারও সঙ্গেই ঠাট্টা করি না আমি, লুসি। একটু গম্ভীর শোনাল প্রফেসরের কণ্ঠস্বর। আমার প্রত্যেকটা কাজের কোন না কোন উদ্দেশ্য থাকে। আগে থেকেই সাবধান করে দিচ্ছি তোমাকে, আমার কোন কাজকেই হেলার চোখে দেখবে না। তাহলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়াও বিচিত্র নয়। হঠাৎ খেয়াল করলেন, তাঁর কথায় একটু মনমরা হয়ে গেছে লুসি। হেসে পরিবেশটাকে হালকা করার চেষ্টা করে বললেন প্রফেসর, একটু কঠিন কথাই বলে ফেলেছি, লুসি, কিন্তু পরে বুঝবে তোমার ভালর জন্যেই বলেছি।
না বুঝে বলে ফেলেছিলাম, প্রফেসর, আমাকে মাফ করবেন।
গুড, এই তো লক্ষ্মী মেয়ের মত কথা, বলে আমার দিকে ফিরে বললেন প্রফেসর, জন, তুমি একটু বসে, আমি এক্ষুণি আসছি, বলে রসুনগুলো তুলে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
একটু পরই একটা রসুনের মালা বানিয়ে ফিরে এলেন প্রফেসর। নিজ হাতে লুসির গলায় পরিয়ে দিলেন ওটা। জানালাগুলো ভালমত বন্ধ করে চৌকাঠে ছড়িয়ে দিলেন রসুনের কোয়া। শার্সিগুলোতে ঘষে ঘষে লাগিয়ে দিলেন রসুনের রস। কাজ শেষ করে লুসির কাছে ফিরে এসে বললেন, লুসি, রাতের বেলায় দেখবে অত্যন্ত অস্বস্তি লাগছে তোমার। কিন্তু কিছুতেই গলা থেকে মালাটা বা কোন দরজা জানালা সামান্যতম সময়ের জন্যেও খুলবে না। মনে থাকবে?
থাকবে।
আর কথা না বাড়িয়ে আমাকে সহ লুসির কামরা থেকে বেরিয়ে এলেন প্রফেসর। হোটেলে ফেরার পথে বেশ খুশি খুশি গলায় বললেন তিনি, একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারব আজ রাতে। ট্রেন যাতায়াত, পড়াশুনা আর প্রচণ্ড উদ্বেগের জন্যে গত কয়েকটা দিন চোখের পাতা এক করতে পারিনি।
১৩ সেপ্টেম্বর।
আজ সকালটা ভারি চমৎকার। ভোরের বাতাসে শরতের মিঠে আমেজ। অবশ্য পাতা ঝরার মৌসুম শুরু হতে দেরি আছে এখনও।
সকাল আটটায় হোটেলের কামরা থেকে বেরিয়েই দেখলাম সদর দরজায় গাড়ি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। গতকালই গাড়ি তৈরি রাখার জন্যে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলাম হোটেলের মালিককে।
গাড়ি করে অল্পক্ষণেই লুসিদের বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। বাড়িতে ঢুকতেই একগাল হেসে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন লুসির মা। জানালেন, গত রাতে গভীরভাবে ঘুমিয়েছে লুসি। এখন পর্যন্ত ঘুম ভাঙেনি ওর।
মনে হচ্ছে, ওষুধ ধরেছে, বললেন প্রফেসর।
আমারও তাই মনে হয়, প্রফেসর। কাল রাতে লুরিস জন্যে অত্যন্ত ভাবনা হচ্ছিল, তাই মাঝ রাতের দিকে উঠে একবার দেখতে গিয়েছিলাম। ঘরে ঢুকে দেখলাম গভীরভাবে ঘুমাচ্ছে লুসি, আমার পায়ের শব্দে ঘুম ভাঙল না ওর। ঘরের ভেতর অসহ্য গুমোট, আর রসুনের অসহ্য গন্ধে বমি আসতে লাগল আমার। দরজা জানালাগুলোও দেখলাম সব বন্ধ। চাকর-বাঁকরগুলোর ওপর ভয়ানক রাগ হল আমার। অসুস্থ মেয়েটার ঘরটাও একটু পরিষ্কার রাখতে পারে না ওরা। অগত্যা নিজেই জানালাগুলো খুলে দিয়ে লুসির কপালে চুমো খেতে গেলাম। দেখে আরও বিরক্ত লাগল, একটা রসুনের মালা গলায় পরেছে সে। কি বিচ্ছিরি ব্যাপার দেখুন তো! মালাটা খুলে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছি আমি।
কে যেন এক দোয়াত কালি ঢেলে দিল প্রফেসরের মুখে, লুসির মার কথা শুনে দপ করে নিভে গেল ওর মুখের হাসি। ধপ করে পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লেন তিনি। প্রফেসরকে এত ভেঙে পড়তে জীবনে দেখিনি। কয়েক মিনিট গুম মেরে বসে থেকে হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর, বুঝেছি, সেই শয়তানই লুসির মার হাত দিয়ে দরজা জানালা খুলিয়েছে। কিন্তু হারামজাদার কাছে তো পরাজয় স্বীকার করতে পারব না আমি। চলো, কাজ শুরু করে দিই আমরা, বলেই এক এক লাফে দুটো করে সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে ওপরে উঠতে শুরু করলেন তিনি। পেছন পেছন আমিও।
লুসির ঘরে ঢুকে আবার মরার মত রক্তশূন্য অবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকতে দেখলাম লুসিকে। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বললেন প্রফেসর, এবার রক্ত দেবার পালা আমার। জন, তৈরি হয়ে নাও।
এবার রক্ত বিনিময়ের কাজ শেষ করলাম আমি। প্রফেসরের হাতটা ব্যাণ্ডেজ করে দিতেই উঠে বসলেন তিনি। উঠেই চোখ পড়ল লুসির মার ওপর। আমরা রক্ত বিনিময় নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময়ই কোন এক ফাঁকে ঘরে এসে ঢুকেছেন তিনি। তাকে দেখতে পেয়েই গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন প্রফেসর, দেখুন, মিসেস ওয়েস্টেনরা, যদি মেয়েকে বাঁচাতে চান, তাহলে আমার কথার একটু এদিক-ওদিক করতে পারবেন না। আমার বিনানুমতিতে সুসির ঘরেও ঢুকতে পারবেন না, জানালা দরজা বন্ধ থাকলে তা খুলতে পারবেন না। আর রসুনের মালা কেন, সারা ঘর রসুনে ভরে থেকে অসহ্য গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসলেও তা সরাতে যাবেন না। কারণ ওই রসুনই লুসির রোগের একমাত্র প্রতিষেধক, আর একমাত্র রসুনের গন্ধই দূরে সরিয়ে রাখতে পারে ওই ভয়ঙ্কর পিশাচটাকে।