১.৭ হুইটবির স্যামুয়েল
হুইটবির স্যামুয়েল এফ বিলিংটন এণ্ড সলিসিটরস-এর লেখা একটা চিঠি পায় লণ্ডনের মেসার্স কার্টার প্যাটারসন অ্যাও কোং। চিঠিটা এই রকমঃ
১৭ আগস্ট।
ডিয়ার স্যার,
গ্রেট নরদার্ন রেলওয়ে কর্তৃক প্রেরিত মালপত্রের চালান দলা করে গ্রহণ করুন। মক্কেলের ইচ্ছানুসারে, কিংস ক্রস রেলস্টেশন থেকে কাঠের বাক্সগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে পারফ্লিটের কাছে কারফাক্সে পৌঁছে দেবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ওখানকার প্রাচীন গির্জা সংলগ্ন বাড়িটা খালিই পড়ে আছে এখন। চালনের সঙ্গে বাড়ির দুটো চাবির একটা পাঠালাম। পারিশ্রমিক বাবদ দশ পাউণ্ডের চেকের প্রাপ্তিস্বীকার করে চিঠির জবাব দেবেন।
আপনাদের বিশ্বস্ত,
স্যামুয়েল এফ বিলিংটন অ্যান্ড কোং।
চিঠি পাওয়ার পরপরই জবাব পাঠালেন মেসার্স কার্টার প্যাটারসন অ্যাণ্ড কোং।
২১ আগস্ট।
ভিয়ার স্যার,
নির্দেশ মোতাবেক আপনার মক্কেলের পঞ্চাশটা কাঠের বাক্স যথাস্থানে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আমাদের পারিশ্রমিক রেখে দশ পাউণ্ডের চেক থেকে উদ্ধৃত এক পাউণ্ড সতেরো শিলিং নয় পেন্স ফেরত পাঠালাম।
আপনাদের বিশ্বস্তু, কার্টার প্যাটারসন অ্যান্ড কোং।
ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে
১৯ আগস্ট।
গতরাত থেকেই অদ্ভুত একটা পরিবর্তন এসেছে রেনফিন্ডের মধ্যে। রাত আটটার পর থেকেই ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে সে। কুকুরের মত গন্ধ শুকে বেড়াতে থাকে চারদিকে। ওর এই আচরণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, তখনকার হাসপাতালে ডিউটিরত নার্স। রেনফিন্ডের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে সে। এমনিতে নার্সদের সাথে কখনও খারাপ ব্যবহার করে না রেনফিল্ড, কিন্তু গতরাতে ডিউটিরত নার্সের সাথে যথেষ্ট দুর্ব্যবহার করেছে সে। তার দুর্ব্যবহার গায়ে না মেখে বার বার প্রশ্ন করে গেছে নার্স। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলেছে রেনফিল্ড, দেখ, তোমার সাথে অযথা বকবক করবার এখন সময় নেই আমার। দেখছ না, স্বয়ং প্রভু এসে দাঁড়িয়েছেন আমার সামনে?
এর পরপরই আমাকে এসে খবর দিল নার্স। নটা নাগাদ রেন-ফিল্ডকে দেখতে গেলাম আমি। পাত্তাই দিল না আমাকে সে। আমিও ওকে না খুঁচিয়ে চুপচাপ ওর ভাবগতিক লক্ষ করতে থাকলাম। আমি যাবার পরও প্রায় আধঘণ্টা পর্যন্ত অস্বাভাবিক উত্তেজিত ভাবটা ছিল রেনফিন্ডের মধ্যে, তারপর ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসতে থাকে সে। আলতোভাবে মাথাটা এদিক-ওদিক দোলাতে দোলাতে বিছানার কাছে গিয়ে শান্তভাবে বিছানার এক প্রান্তে বসে পড়ে যোবা দৃষ্টি মেলে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল রেনফিল্ড। কোনকিছুর গতিবিধি লক্ষ্য করছে যেন সে।
ওর সাথে আলাপ জমাবার চেষ্টা করলাম, অবশ্য ওর প্রিয় পশু-পাখি পোকামাকড় দিয়েই। কিন্তু খেপে উঠে বলল রেনফিল্ড, বাজে বকবেন না, ডাক্তার।
এখন ওসব কথা শুনতে চাই না আমি।
বলছ কি, রেনফিল্ড। অবাক হবার ভান করে বললাম, এরই মাঝে মাকড়সা আর চড়ুইগুলোর কথা বেমালুম ভুলে গেলে?
ওদের জন্যে এখন আমার আর কিছুই করার নেই। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে জবাব দিল রেনফিল্ড। একটু মুচকে হেসে আবার বলল, আসলে ব্যাপারটা কি জানেন, কনে বিয়ের আসরে না পৌঁছানো পর্যন্ত হাসি আনন্দে উচ্ছল হয়ে থাকে তার সখীরা, কিন্তু কনে পৌঁছামাত্র বিষাদে ভরে যায় তাদের মন।
রেনফিডের এ হেঁয়ালিপূর্ণ কথার মাথামুও কিছুই বুঝলাম না। এখন আর ওর কাছ থেকে কোন সঠিক জবাব পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে নার্সকে ওর প্রতি কড়া নজর রাখতে বলে ফিরে এলাম আমি।
কেন জানি বড় ক্লান্ত, বড় বিষণ্ণ লাগছে আজ, লুসি। বারবার মনে পড়ছে তোমার কথা। বুঝতে পারছি ঘুম না এলে আজও মরফিয়া নিতে হবে, অবশ্য তোমার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হবার পর রোজ রাতেই মরফিয়া নিতে হয়, নাহলে দুচোখের পাতা এক করতে পারি না সারারাত। কিন্তু আমি ডাক্তার, আমি জানি এটা অত্যন্ত বাজে অভ্যাস। ভাবছি আজ আর কিছুতেই নেব না ওটা, তাতে যদি ঘুম না আসে না আসুক।
বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি করতে করতে দীর্ঘ বিদ্রি প্রহরগুলো কেটে যেতে থাকল। যেন এক এক যুগ পর পর ঘণ্টা বাজিয়ে সময় ঘোষণা করছে দেয়ালঘড়িটা। এভাবেই রাত একটা বাজল, তারপর দুটো। এই সময় এসে খবর দিল নাইট গার্ড, রেনফিল্ড পালিয়েছে। একলাফে বিছানা থেকে উঠে রেনফিল্ডের ওয়ার্ডের দিকে ছুটলাম। আমার জন্যেই অস্থিরভাবে অপেক্ষা করছিল নার্স। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কি, কি করে পালাল রেনফিল্ড?।
মাত্র দশ মিনিট আগেও তার বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখেছি রেনফিল্ডকে, স্যার। হঠাৎ একটা সন্দেহজনক শব্দ কানে যেতেই সেদিকে তাকিয়ে দেখে নাইট গার্ড, জানালার গরাদ বাঁকিয়ে সে-পথে বেরিয়ে যাচ্ছে রেনফিল্ড, একটু থেমে বলল নার্স, সাথে সাথে আমাকে এসে খবর দিল গার্ড। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে ছুট লাগালাম রেনফিল্ড যেদিকে গেছে সেদিকে। বাঁ দিক ঘুরে বাগানের মধ্যে ঢুকে সারি সারি গাছের মাঝখান দিয়ে ছুট লাগাল রেনফিল্ড। প্রাণপণে অনুসরণ করে চললাম ওকে। ছুটতে ছুটতে একসময় হাসপাতাল আর কারফাক্সের বাড়িটার মাঝখানে পাঁচিলের কাছে এসে মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল রেনফিল্ড। তারপর দেয়াল বেয়ে উঠে লাফিয়ে পড়ল ওপাশে। ফিরে এসে চার-পাঁচজন লোক নিয়ে নাইট গার্ডকে আমাকে অনুসরণ করতে বলেই আবার ছুটলাম। কোনমতে সেই পাঁচিলটা ডিঙিয়ে ওপারে গিয়ে দেখলাম ধীর পায়ে কারফাক্সের বাড়িটার দিকে এগোচ্ছে রেনফিল্ড। ওর অজান্তে আমিও অনুসরণ করে চললাম তাকে। পরিত্যক্ত, জীর্ণ বিশাল বাড়িটার শেষপ্রান্তের পুরানো গির্জাটার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল রেনফিল্ড, তার সাথে সাথে আমিও। আরাধনার ভঙ্গিতে গির্জার বিশাল এক কাঠের দরজার কাছে গিয়ে দরজার গায়ে মুখ ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে ভেতরের কার সাথে যেন কথা বলছে রেনফিল্ড, একটু দূরে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করতে লাগলাম আমি। ভক্তিভরে মন্ত্রোচ্চারণের মত ভরাট গলায় বলে চলেছে রেনফিলডঃ প্রভু, তোমার আদেশ পেয়েই এখানে এসেছি আমি। তোমার এ দীন-হীন ক্রীতদাসকে কৃতার্থ করো। দীর্ঘদিন ধরে তোমারই সাধনা করেছি আমি। আজ ডেকেছই যদি, পায়ে ঠেলে দিও না। তোমার করুণা ভিক্ষা চাইছি, শুধু তোমার করুণা পেলেই বর্তে যাব আমি।
এতক্ষণে লোজন নিয়ে সেখানে পৌঁছে গেছে নাইট গার্ড। আমার নির্দেশে দুদিক থেকে গিয়ে রেনফিল্ডকে চেপে ধরল ওরা। কিন্তু কুদ্ধ সিংহের মত গা ঝাড়া দিয়ে ওদের সব কজনের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল রেনফিল্ড। ওর মত স্বাস্থ্যের একজন লোক এত শক্তি কোথায় পেল বুঝতে পারলাম না।
কিন্তু কোথায় এখন ও? অধৈর্য হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।
হাতে-পায়ে শেকল দিয়ে বেঁধে হাসপাতালের ওদিককার একটা কয়েদখানায় আটকে রেখেছি। আঙুল তুলে ঘরটা আমাকে দেখিয়ে দিল নার্স। তারপর আবার বলল, ওকে বেঁধে নিয়ে আসার সময়ওঃ প্রভু, আমাকে ক্ষমা করো। করুণা করো, যতদিন না তোমার সময় হয় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করব আমি।-বলতে বলতে এসেছে রেনফিল্ড।
মিনা আরকারের ডায়েরী থেকে
বুদাপেস্ট, ২৪ আগস্ট।
হামবুর্গ পর্যন্ত জলপথে এসে ট্রেন ধরে শেষ পর্যন্ত ভালয় ভালয় বুদাপেস্টে এসে পৌঁছেছি। বুদাপেস্ট হাসপাতালে পৌঁছে জোনাথনের অবস্থা দেখে দুচোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এসেছে আমার। সাংঘাতিক রোগা হয়ে গেছে জোনাথন, শুধু ওর অপূর্ব সুন্দর চোখ দুটো আমার চেনা না থাকলে চিনতেই পারতাম না ওকে। ওর শরীর আর মনের ওপর দিয়ে যে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে তা দেখলেই অনুমান করা যায়। অতীতের কোনকিছুই এখন স্পষ্ট স্মরণ করতে পারছে না সে। অভিজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, এখন ওকে জোর করে কিছু ভাবানর চেষ্টা করলে ওর মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রীতে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। হাসপাতালের নার্স সিস্টার আগাথাকে জোনাথনের মানসিক আঘাতের কারণ যতবার জিজ্ঞেস করেছি ততবারই বুকে কুশ এঁকে চোখ বড় বড় করে বলেছেন, কোনকিছুর বিনিময়েই তা বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সিস্টার আগাথার মত মিষ্টি স্বভাবের মহিলার এ-আচরণ যথেষ্ট বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
এক সময় একলা পেয়ে ওর এ অবস্থার কারণ জিজ্ঞেস করলে একটা ছোট্ট খাতা আমার হাতে তুলে দিয়ে স্নান কণ্ঠে বলল জোনাথন, মিনা, এটা পড়ে দেবো, অনেক অবিশ্বাস্য অদ্ভুত ঘটনা জানতে পারবে। কিন্তু পড়ে আর সবার মত তুমিও ভুল বুঝো না আমাকে। ইচ্ছে করে ওই ভয়ঙ্কর তিন ডাইনীর সাথে প্রেম করিনি আমি, করেছি শুধু প্রাণের দায়ে। না হলে আমার শরীরের সমস্ত রক্ত শুষে নিয়ে আমাকে ছিবড়ে বানিয়ে নেকড়েদের মুখে ছেড়ে দিত পিশাচ কাউন্ট ড্রাকুলা।
জোনাথনের হাত থেকে ছোট্ট খাতাটা নিয়ে সেখানে বসেই পড়তে শুরু করলাম। পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই শিউরে উঠতে থাকলাম। পড়া শেষ হলে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু, জোনাথন, কাউন্ট ড্রাকুলা তোমাকে দিয়ে কি করিয়ে নিতে চেয়েছিল?
চেয়েছিল নয়, মিনা, বলো, করিয়ে নিয়েছে। ওর আকাঙ্ক্ষিত ইংল্যান্ডের সব কটা বাড়ি দালালি করে আমি ওকে কিনে দিয়েছি। ঈশ্বরই জানেন, কোন্ ভয়ঙ্কর উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যে ওই পুরানো পোড়ড়া বাড়িগুলো কিনেছে শয়তানটা। কথাগুলো বলে জিরিয়ে নেবার জন্যে একটু থামল জোনাথন। তারপর হঠাৎ আমার হাত দুটো ধরে বলল, মিনা, আমি আর দেরি করতে চাই না। চলো, তাড়াতাড়ি আমরা আমাদের বিয়েটা সেরে ফেলি।
জোনাথনের কথায় বেশ কয়েক সেকেণ্ড কোন জবাব দিতে পারলাম না। তারপর ধীরে ধীরে উবু হয়ে চুমো খেলাম ওর রক্তশূন্য শুকনো খসখসে ঠোঁটে।
ডাক্তার জন সেওয়ার্ডের ডায়েরী থেকে
২০ আগস্ট।
দিন দিন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে রেনফিল্ডের কেসটা। সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে প্রায় সপ্তাহখানেক পরে যখন-তখন সাংঘাতিক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে অসহ্য চেঁচামেচি জুড়ে দিত সে। কিন্তু তারপর গত পূর্ণিমার রাত থেকে হঠাৎ করেই একেবারে চুপ হয়ে গেছে সে, শুধু মাঝে মাঝে আপনমনেই বিড়বিড় করে আর চেঁচাব না আমি, প্রভু, এখন থেকে তোমার নির্দেশের অপেক্ষাই করব। তাতে যদি আমাকে আজীবন অপেক্ষা করতে হয়, তাও সই।
রেনফিল্ডের এই হঠাৎ শান্ত হয়ে যাওয়ার খবর শুনে সেদিন তাকে দেখতে গেলাম। আচ্ছন্ন ভাবটা ওর চেহারা থেকে সম্পূর্ণ মুছে গেছে, তার পরিবর্তে সেখানে ফুটে উঠেছে প্রসন্ন উজ্জ্বলতা। ওর এই অবস্থা দেখে খুশি হলাম, ভাবলাম বোধহয় সেরে যাচ্ছে ওর পাগলামি। নার্সকে ডেকে ওর পায়ের শেকল খুলে দিতে বললাম। আমার কথা শুনে রীতিমত আশ্চর্য হল নার্স। কিন্তু বিনা প্রতিবাদে আদেশ পালন করল। শেকল ভোলা হলে শান্ত ধীর পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এল রেনফিল্ড। নার্সের বিস্মিত মুখের দিকে ইঙ্গিত করে মৃদু হেসে বলল, ও ভেবেছে বাঁধন খুলে দিলেই পালাব আমি, ব্যাটা বুদ্ধ কোথাকার।
রেনফিল্ডের মত বদ্ধ পাগল চেহারা দেখে লোকের মনের কথা বলে দিতে পারে ভেবে অবাক লাগল। প্রসঙ্গ বদলাতে চেষ্টা করে বললাম, রেনফিড, বেড়াল চেয়েছিলে না তুমি? ভেবে দেখলাম আসলেই একটা বেড়াল তোমাকে দেয়া দরকার। তা ওটা কি আজই চাও নাকি?
আগের মত মৃদু হেসেই জবাব দিল রেনফিল্ড, না, ডাক্তার, বেড়ালের আর প্রয়োজন নেই আমার। এখন অনেক উর্ধ্বে উঠে গেছি আমি। ওসব সামান্য ব্যাপার নিয়ে ভাবার চেয়ে ধৈর্য ধরে শুধু অপেক্ষা করব এখন আমি।
কিসের অপেক্ষা করবে রেনফিল্ড? ভাবলাম, এটাও ওর এক ধরনের পাগলামি। আর কথা না বলে নিজের কামরায় ফিরে এলাম।
দিন দুয়েক আর কোন খবর নেই। তার পরদিন সকালে ছুটতে ছুটতে এল নার্স। আবার পাগলামি শুরু করেছে রেনফিল্ড, এবার আগের চেয়েও খেপে গেছে। জ্ঞান না হারানো পর্যন্ত একটানা চেঁচিয়ে লাফিয়ে হাসপাতালের কামরায় তুফান তুলে রাখে সে। পর পর তিন দিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। ওর এই আকস্মিক মানসিক পরিবর্তনের কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। ক্ষণে ক্ষণে এই রূপ বদলানর পেছনে কি কোন ভয়ঙ্কর অশুভ অদৃশ্য শক্তির হাত আছে? ভেবেচিন্তে একটা বুদ্ধি বের করলাম। রেনফিল্ডের সাথে একটু অভিনয় করতে হবে। ওকে পালানর সুযোগ করে দিতে হবে। তারপর আড়ালে থেকে লক্ষ্য রাখতে হবে ও কোথায় যায়, কি করে।
২৩ আগস্ট কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে, পালানর সব রকম সুযোগ পেয়েও পালাল বেনফিল্ড, অথচ হাসপাতাল কক্ষে থেকে থেকে তার উপদ্রব বেড়েই চলল। খোলা দরজা দিয়ে হঠাৎ করেই ধ করে বেরিয়ে এসে ডিউটিরত নার্সকে আক্রমণ করে বসে সে। ওর এই অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আবার ওকে জানালা বন্ধ করে কয়েদ করে রাখার আদেশ দিলাম। এবং তারপরই আরেক অবাক কাণ্ড করে বসল সে। অপ্রত্যাশিত ঘটনাও কখনও কখনও ঘটে।-ডিসরেইলির এই উক্তি সত্যি প্রমাণিত করে আবার পালাল রেনফিল্ড। এতদিন তাকে পালাবার সমস্ত সুযোগ দেয়া সত্ত্বেও পালাল না, অথচ এখন জোর করে পালাল। এটাও কি এক ধরনের পাগলামি? নাকি আমরা যে ওকে ইচ্ছে করে পালাবার সুযোগ দিয়ে অনুসরণ করার তালে আছি এটা আগে থেকেই কোন রহস্যময় উপায়ে জেনে যায় সে?
নার্সের কাছে পরে শুনলাম, ঘরের কোণে চুপচাপ তৈরি হয়ে বসে ছিল রেনফিল্ড, নার্স ঘরে ঢুকতেই তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে খোলা দরজা দিয়ে একছুটে বাইরে বেরিয়ে যায় পাগলটা।
রেনফিল্ড পালিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে এসে আমাকে খবর দিল নাইট গার্ড। একমুহূর্ত দেরি না করে কয়েকজন লোক নিয়ে রেফিন্ডকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম। খুঁজতে খুঁজতে কারফাক্সের সেই পুরানো বাড়িটায় গিয়েই পাওয়া গেল ওকে। আগের বারের মতই গির্জার বিশাল কাঠের দরজায় মুখ চেপে দাঁড়িয়ে আছে রেনফিল্ড। আমাদের দেখেই প্রচণ্ড আক্রোশে ফেটে পড়ল সে। দাঁত খিচিয়ে আমাকে আক্রমণ করতে ছুটে আসতেই ওকে ধরে ফেলল আমার লোকেরা। আবার ওর হাতে-পায়ে লোহার শেকল পরিয়ে হাসপাতালে রওনা দিলাম। লাফিয়ে চেঁচিয়ে আমাদের কান ঝালাপালা করতে করতে চলল রেনফিল্ড। চলতে চলতেই হঠাৎ যেন কার অঙ্গুলি হেলনে আচমকা থমকে দাঁড়াল রেনফিল্ড, চেঁচানোও বন্ধ হয়ে গেল ওর। অবাক হয়ে ওর দিকে চাইতেই দেখলাম মাথা তুলে স্থির দৃষ্টিতে আকাশের একদিকে চেয়ে আছে রেনফিল্ড। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় বিশাল একটা বাদুড় পশ্চিম আকাশের দিকে উড়ে চলেছে। রাতের বেলা বাদুড়েরা আকাশে উড়বে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, কিন্তু এ বাদুড়টার কাজকারবার অন্যান্য সাধারণ বাদুড়ের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। ডানা। ঝটপট করার মৃদু শব্দ তুলে একেবেঁকে উড়ে যাচ্ছে না ওটা। অনেক উঁচুতে চিল যেভাবে বাতাসে ডানা মেলে ভেসে থাকে তেমনি করে নিঃশব্দে উড়ে চলেছে। বাদুড়টা। আর প্রায় অস্পষ্ট একটা হালকা ধোঁয়ার রেখা রেখে যাচ্ছে পেছনে। এমন অদ্ভুত ব্যাপার দেখা তো দূরের কথা, কখনও কারও কাছে শুনিনি পর্যন্ত। আস্তে আস্তে পশ্চিম দিগন্তে মিলিয়ে গেল বাদুড়টা। যতক্ষণ দেখা গেল ওটা, স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকল রেনফিল্ড।
আশ্চর্য! তারপর কিন্তু আমাদের সাথে যেতে বিন্দুমাত্র আপত্তি করল না রেনফিল্ড। কোন অশুভ শক্তির প্রভাব পড়েছে ওর ওপর, ধারণাটা আরও বদ্ধমূল হল আমার মনে। চিন্তিতভাবে ফিরে এলাম হাসপাতালে।