১৬. দুই রহস্যের জালে
একদিন সন্ধ্যায় বেড়িয়ে ঘরে ফিরছিলাম মিসেস স্টিয়ারফোর্থের বাড়ির সামনে দিয়ে আসার সময় একজন চাকরানী ছুটে এসে আমাকে ডাকল। বলল, মিসেস স্টিয়ারফোর্থ এখন লণ্ডনের ওই বাড়িতে আছেন। তিনি আমাকে ডাকছেন। গেলাম।
এমিলিকে পাওয়া গেছে? জিজ্ঞেস করলেন তিনি ক্রুদ্ধভাবে।
না, বললাম আশ্চর্য হয়ে ও কি জেমস-এর সঙ্গে নেই?
ক্রূর হাসি হেসে তিনি বললেন, আমার ছেলের কাছ থেকে সে পালিয়ে গেছে। হয়তো তাকে আর কখনও খুঁজে পওয়া যাবে না। হয়তো সে মরে গেছে।
এমিলির ব্যাপারে আপনি কি জানেন? জিজ্ঞেস করলাম। ওর পরিবার আর বন্ধুবান্ধব অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ওর জন্য।
মিসেস স্টিয়ারফোর্থ বললেন, জেমস আর তার চাকর লিটিমারের সঙ্গে সে ইওরোপে ছিল। কিছুদিন জেমস ওর মোহে আচ্ছন্ন ছিল যেসব দেশে তারা গেছে সব দেশের ভাষা ও শিখে নিয়েছিল। বলতে পারত অনর্গল। সব জায়গায় খুব প্রশংসা পেয়েছে ও। তারপর মেজাজ বিগড়ে গেল মেয়েটির। জেমস ক্লান্ত হয়ে পড়ল ওকে নিয়ে। জেমস ওকে বলল ওর উচিত তার চাকর লিটিমারকে বিয়ে করা। কারণ ওরা দুজন একই সামাজিক স্তরের লোক। লিটিমারের জিম্মায় ওকে রেখে জেমস চলে যায় ইতালীতে।
হায় এমিলি! দুঃখী মেয়ে! ওপরে ওঠার-লেডি হবার মিথ্যে মোহে, অভিজাত ঘরের ছেলের মিথ্যে প্রতিশ্রুতিতে ভুলে কি হেনস্তাই না হলো তোমার! ভাবলাম মনে মনে।
মিসেস স্টিয়ারফোর্থ বলে গেলেন, জেমস চলে যাবার পরে ভীষণ খেপে গেল এমিলি। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। লিটিমার বাধ্য হলো ওকে ঘরের মধ্যে তালা মেরে আটকে রাখতে। কিন্তু জানালাপথে ও পালিয়ে যায়। হয়তো সাগরে ঝাঁপ দিয়ে মরেছে। তাই করবে বলে হুমকি দিয়েছিল। মোট কথা, ও পালিয়ে গেছে। এর পরে ওকে আর কোথাও দেখা যায়নি। কোন খবরও মেলেনি ওর। জেমস এখন স্পেনের উপকূলে নৌ-বিহার করছে।
তাহলে আমাকে ডেকেছেন কেন? কি চান আমার কাছে? জিজ্ঞেস করলাম তাকে।
তোমাকে ডেকেছি হতভাগা মেয়েটি কোথায় তা জানো কিনা জিজ্ঞেস করতে। আমি চাই না আমার ছেলে ওর খপ্পরে আবার পড়ুক! ওই মেয়ে টাকাপয়সা খসাক ওর কাছ থেকে।
ম্যাডাম, বললাম ভদ্রভাবে, ছেলেবেলা থেকে এমিলির পরিবারকে আমি জানি। ওরা গরীব, সাধারণ মানুষ, একথা ঠিক। কিন্তু আমি জোর দিয়ে আপনাকে বলতে পারি যে ওই পরিবারের মেয়ে এমিলি আপনার ছেলের কাছ থেকে কখনও কিছু নেবে না। কথাগুলো বলেই আমি বেরিয়ে আসলাম ওই বাড়ি থেকে।
পরদিন সন্ধ্যায় বেরুলাম মি. পেগোটিকে খুঁজতে। তিনি সব সময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লণ্ডনে আমি তাঁকে দেখেছি রাস্তায়, প্রতিটি বাড়ির দরজায় এমিলিকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
তাকে পেয়ে গেলাম জঁর ভাড়া করা ঘরটিতে। বললাম সব খবর। শুনে তার মুখটা সাদা হয়ে গেল।
ভয়ার্তকণ্ঠে তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, ও কি বেঁচে আছে মনে করেন?
হ্যাঁ, বললাম আমি। ও যদি লণ্ডনে ফিরে এসে থাকে, আমার বিশ্বাস একটি মাত্র মানুষের সঙ্গে ও যোগাযোগ করতে পারে। মানুষটি হচ্ছে ওর বন্ধু মার্থা। আমি জানি মার্থা লণ্ডনে আছে। কারণ আপনার সঙ্গে শেষ যেবার আমার দেখা হয় তখন সরাইয়ের বাইরে তাকে আমি দেখেছি।
আমিও তাকে দেখেছি রাস্তাঘাটে, বললেন মি. পেগোটি। কিন্তু এমিলি তার কাছে কেন যাবে? আমি সব সময় মনে করেছি এমিলির মেলামেশা করার উপযুক্ত মেয়ে মার্থা নয়।
এমিলি মার্থার সঙ্গে যোগাযোগ করবে এজন্য যে মার্থা বাড়ি ছেড়ে চলে আসার আগে তাকে এমিলি একবার টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিল, বুঝিয়ে বললাম বুড়োকে।
আমি বোধহয় জানি কোথায় খুঁজলে মার্থাকে পাওয়া যাবে, বললেন মি. পেগোটি। চলুন যাওয়া যাক।
ব্ল্যাক ফ্লেয়ার্স ব্রিজের কাছাকাছি যেতেই মি. পেগোটি ঘুরে দাঁড়ালেন। হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলেন একটি মেয়েকে। আমরা চললাম ওর পিছু পিছু নদীর ধারে একটা নির্জন এলাকার দিকে। বুনো ঘাস, লতাপাতা, ঝোপঝাড়ে ভরা জলাময় জায়গা ওটা। এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে আছে অসমাপ্ত ও পরিত্যক্ত বাড়িঘরের কাঠামো। চারদিকে ছড়িয়ে আছে স্টীম বয়লারের টুকরো, পরিত্যক্ত পাইপ, চাকা, ফার্নের্স, মাটিতে বসে-যাওয়া নৌকা, আর রাজ্যের যত জঞ্জাল। আমার কাঁপন ধরে গেল। জায়গাটার মধ্যে ভয়ঙ্কর কিছু আছে বলে মনে হলো আমার।
যাকে অনুসরণ করছিলাম সেই মেয়েটি থামল। ওই পরিত্যক্ত জঞ্জালের মধ্যে একা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল নদীর পানির দিকে। আমি নিশ্চিত যে ও ডুবে মরতে চায়। ছুটে গিয়ে ওর বাহু ধরে ডাক দিলাম মার্থা!
চিৎকার করে উঠল সে। ধস্তাধস্তি করল নিজেকে ছাড়াবার জন্য। মি. পেগোটি ওর অন্য হাতখানা ধরে ফেললেন। শেষ পর্যন্ত ও চিনতে পারল আমাদেরকে। লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। আমরা ওকে পাজাকোলা করে নিয়ে চললাম। নদী থেকে দূরে।
অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল হিস্টিরিয়া রোগীর মত। ও শান্ত হবার পর এমিলির খবর জানালাম।
মার্থা আবার কেঁদে ফেলল। বলল, আমার প্রতি সব সময় টান ছিল ওর। ও বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর আমি ভয় করেছিলাম লোকে ভাববে আমার সঙ্গে মেলামেশার ফলেই ও নষ্ট হয়ে গেছে। এমিলির সুনাম ফিরিয়ে আনার জন্য জীবন দিতেও তৈরি ছিলাম আমি।
মি. পেগোটি তাকিয়ে ছিলেন মাটিতে বসা মেয়েটির দিকে। তিনি মার্থার শালটা জড়িয়ে দিলেন ওর গায়ে। হাত ধরে ওঠালেন। বললেন, মার্থা, আমার প্রাণের ভাইঝিকে খুঁজতে দুনিয়ার প্রায় শেষ প্রান্ত পর্যন্ত গিয়েছি। আমি ওকে ভালবাসি। কিন্তু ও এখন কলঙ্কিত। মাস্টার ডেভি এবং আমার ধারণা, ও লণ্ডনে ফিরে আসবে একদিন। তুমি দয়া করে আমাদেরকে সাহায্য করো, যাতে ওকে খুঁজে পাই।
চোখ তুলে মার্থা শপথ করে বলল, আমি বিশ্বস্তভাবে এ কর্তব্য পালন করব। খুঁজে পেলে ওর সেবাযত্ন করব, সঙ্গে সঙ্গে আপনাদেরকে জানাব।
মি. পেগোটি আমার কানে কানে বললেন ওকে কিছু টাকাকড়ি দেবেন কিনা। কথাটা আমারও মনে এসেছিল। তাই পার্সটা বের করলাম। কিন্তু টাকা ও নিল। না। অনেক বুঝিয়েও টাকা নিতে রাজি করাতে পারলাম না। বললাম, ওর যা অবস্থা তাতে নিজের ক্ষমতায় এমিলিকে খোজা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু। আমাদের কারও কথায় টলল না মার্থা।
একটা কাজটাজ হয়তো পেয়ে যাব, আমি চেষ্টা করব, বলল ও।
কাজ পাওয়ার আগের জন্য অন্তত কিছু সাহায্য নাও, বললাম ওকে।
আমি যা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা পয়সার জন্য নয়। উপপাসে মরলেও এ কাজের জন্য পয়সা নিতে পারব না। আমাকে পয়সা দেয়া মানে অবিশ্বাস করা। এ কাজটি করব বলেই আমি নদীতে ডুবে মরব না। টাকা নিলে মরার সঙ্কল্প আবার আমাকে পেয়ে বসবে, বলল মার্থা।
মরার কথা মুখেও এনো না। সবাই মিলে আমরা এখনও অনেক ভাল কাজ করতে পারি।
আপনারা দয়ার বশে এ দুর্দশাগ্রস্ত জীবকে উদ্ধার করতে চান। কিন্তু বেঁচে থেকে আমার কোন লাভ হবে না। এ যাবৎ যা কিছুই করেছি তার ফল খারাপ ছাড়া ভাল হয়নি। কেবল দুর্ভাগ্যই ডেকে এনেছি নিজের ওপর। জীবনে এই প্রথমবার আপনারা আমাকে একটা কাজের মত কাজের দায়িত্ব দিলেন। এর বেশি আমি আর কিছু চাই না, জানি না।
চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে গেল মার্থা। কিছুদূর আমরাও গেলাম ওর পিছু পিছু।
মাঝরাতে বাড়ি ফিরলাম।
এ সময়টায় ট্র্যাডস আর আমি আতঙ্কজনক চিঠি পেতে লাগলাম মিকবারদের কাছ থেকে। তারপর একদিন মি. মিকবার নিজেই এসে হাজির হলেন। তাঁর মুখ থমথমে, চোখে ক্লান্তির ছাপ।
আমাকে আর ট্র্যাডলসকে সম্বোধন করে তিনি বললেন, ভদ্রমহোদয়রা, আপনারা আমার প্রকৃত বন্ধু, বিপদের বন্ধু। আপনারা এখন একজন বিধ্বস্ত মানুষকে দেখছেন। আমার মনে অশান্তির আগুন। আমি আত্মসম্মান হারিয়ে ফেলেছি। এবং এ সবকিছুর জন্যই দায়ী উরিয়া হীপের শয়তানী, ধোকাবাজি, জালিয়াতি আর ষড়যন্ত্র।
পাগলের মত প্রলাপ বকতে লাগলেন মিকবার। এ জীবন আমি আর রাখব! ওই নরকের কীটের চাকরি নিয়ে আমি অশুভ মায়াজালে পড়ে গিয়েছিলাম। ওই ঘণ্য সাপ হীপকে আমি টুকরো টুকরো করে ফেলব! ওই শয়তান প্রতারক ও মিথ্যকের গলা টিপে কোটর থেকে ওর চোখ বের করব। ভিসুভিয়াসের জুলন্ত লাভাস্রোত নামিয়ে আনব বদমাশ হীপের মাথার ওপর। বেঈমান হীপের মুখোশ আমি খুবই খুলব!
মি. মিকবার এতটা রেগে গেছেন যে তিনি দম নিতে পারছেন না। আমার ভয় হলো তিনি ওখানেই দম ফেটে মারা যাবেন। অবশেষে দম নেয়ার জন্য একটা চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি। আমাকে, ট্র্যাডস, দাদী বেটসি ও মি. ডিককে এক সপ্তার মধ্যে ক্যান্টারবেরির একটি হোটেলে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। হীপের চক্রান্ত ফাঁস করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি তিনি ওখানে নিয়ে আসবেন। যেমন এসেছিলেন তেমনি ঝড়ের বেগে বেরিয়ে চলে গেলেন মি. মিকবার।