১৪. আমার বাচ্চা-বৌ
সপ্তা, মাস, বছর গড়িয়ে গেল। আইনগতভাবে আমি সাবালক হলাম, অর্থাৎ আমার একুশ বছর পূর্ণ হলো। আমার আর ভোরার বিয়ে হয়ে গেল।
ঘর-সংসার সম্পর্কে একজোড়া পাখির বাচ্চাও বোধহয় আমাদের দুজনের চাইতে কম জানে না। একজন পরিচারিকা রেখেছিলাম। কিন্তু তাকে সামলাতে গিয়ে আমরা হিমশিম খেলাম। ডিনার দিতে তার দেরি হয়ে যায়, কিংবা দেয়ই না। মাংস থেকে যায় একদম কাচা, কিংবা পুড়ে ছাই। আমাদের রূপোর বাসনপত্র যায় উধাও হয়ে। তাকে কিছু বলা কিংবা শাসানি দেয়ার মত শক্ত হতে পারে না ডোরা।
অগত্যা, প্রিয় ডোরার সঙ্গে ঝগড়া না করে আমাদের অগোছাল সংসারের সব ঝামেলা নিজের কাঁধেই তুলে নিলাম। ডোরা হেসে খেলে দিন কাটাতে লাগল।
দাদীর সঙ্গে ভোরার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। মিস বেটসি এসব সাংসারিক ব্যাপারে আমাকে ধৈর্যশীল হবার উপদেশ দিলেন। আমি তাকে বললাম সংসার কিভাবে চালাতে হয় সে ব্যাপারে ভোরাকে উপদেশ দিতে। তিনি অস্বীকার করলেন।
এখনও সময় হয়নি। সবে তো শুরু। তুমি বিয়ে করেছ একটি পরমা সুন্দরী মেয়েকে। মেয়েটির হৃদয়ভরা ভালবাসা। তোমার কর্তব্য হচ্ছে ওর ভাল গুণগুলো দিয়ে ওকে বিচার করা। যে-গুণ ওর নেই সেগুলো দিয়ে নয়। তুমি ওর মধ্যে ওসব গুণ বিকাশের চেষ্টা করো। তোমার ভবিষ্যৎ তোমাদের দুজনের মধ্যে-তোমাদের সমস্যা নিজেদেরকেই সমাধান করতে হবে।
দাদীর উপদেশের জন্য তাকে ধন্যবাদ দিলাম।
শিক্ষা ও কাজে কঠোর শ্রম দিতে লাগলাম। সন্ধ্যার অবসরে কিছু কিছু লিখতেও শুরু করলাম। আমার লেখা গল্পগুলোর বেশ কাটতি হলো। ফলে ডক্টর স্ট্রং-এর কাজটা ছেড়ে দিলাম। আমার বাচ্চা-বৌটাকে ভালবাসলেও এক এক সময় ভাবি, বৌটা চরিত্রগতভাবে যদি আরেকটু দৃঢ় হত, আমার কাজকর্মের সহযোগী হত তাহলে কি সুখীই না হতাম। কিন্তু তা তো হবার নয়। সুখী যে ছিলাম না, তা নয়। তবে যেরকম আশা করেছিলাম তেমন সুখী হতে পারিনি। কি যেন নেই, কিসের যেন অভাব। কিন্তু ডোরা সব সময় হাসিখুশি, আর আনন্দে ভরপুর।
বছর শেষ হতে না হতেই দেখা গেল যে ডোরা দুর্বল হয়ে পড়ছে। আমার বাচ্চা-বৌ নারী হয়ে উঠছে না। ওকে আগের মত হাসিখুশি দেখালেও পা দুটো ওর অবশ অচল হয়ে যাচ্ছে। এই পা দুটোই কি চঞ্চল ছিল, জি-এর চারপাশে ঘুরে ঘুরে কতই না নেচে বেড়াত। অথচ এখন ওগুলো অচল।
প্রতিদিন সকালে পাজাকোলা করে ওকে নিচতলায় নামাতে লাগলাম। প্রতিরাতে তেমনি করে আবার দোতলায় নিয়ে যাই। জিপ ঘেউ ঘেউ করে ঘুরপাক খায় আমাদের চারদিকে। আমার দাদী হয়ে গেলেন ওর নার্স। তিনি আমাদেরকে অনুসরণ করেন এক বোঝা শাল আর বালিশ নিয়ে। এখন ডোরাকে বহন করতে গিয়ে অনুভব করি যে দিনে দিনে ও হাল্কা হয়ে যাচ্ছে। একটা ভয় জাগে আমার মধ্যে। শূন্যতায় ভরে যায় মনটা।