১০. ফতুর হয়ে গেলাম
মি. স্পেনলো ডোরার জন্মদিন উপলক্ষে এক পিকনিকে দাওয়াত করলেন আমাকে। আমি ফুল নিয়ে গেলাম ভোরার জন্য। ফুলগুলো ও সারাক্ষণ নিজের কাছে রাখল। ওর ছোট্ট কুকুর জিকে দিয়ে শোঁকাতে চেষ্টা করল। কিন্তু কুকুরটি গোঁ গোঁ করে শুকতে অনিচ্ছা জানাল। ডোরার সঙ্গ আনন্দে ভরিয়ে দিল আমার মন।
চারদিন পরে ডোরা আর আমি এনগেজড হলাম। তবে কথাটা আমরা কিছুদিনের জন্য ওর বাপকে জানাব না বলে স্থির করলাম। পেগোটি তার স্বামীর উইলের ব্যাপারে তখন লণ্ডনে ছিল। আমি তাকে বললাম এবং অ্যাগনেসকে চিঠি লিখে জানালাম।
একদিন পেগোটিকে নিয়ে বাসায় ফিরে আশ্চর্য হয়ে দেখি যে দরজা খোলা এবং ভেতরে কারা যেন কথা বলছে। দুজনে চোখাচোখি করে আমরা ঢুকলাম বসার ঘরে। বিস্মিত হয়ে দেখলাম কথা বলছেন আর কেউ নয়—আমার দাদী ও মি. ডিক! দাদী তার লাগেজ-এর ওপর বসে চা খাচ্ছেন। তার বেড়ালটা বসে আছে হাঁটুর ওপর। মি. ডিক প্রকাণ্ড একটা ঘুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আরও অনেকগুলো বাক্স-পেটরার মাঝখানে।
দাদী! বলে চেঁচিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। এ কি অপ্রত্যাশিত আনন্দ!
দাদীকে আমি ভাল করেই জানি। গুরুত্বপূর্ণ কোন কারণ ছাড়া তিনি লণ্ডনে আসেননি। কিন্তু কী সেই কারণ? ডোরার সঙ্গে আমার এনগেজমেন্টের কথা কি তিনি জেনে গেছেন? কিন্তু আমি তো তাকে এখনও জানাইনি! কোনভাবে তাঁর মনে কি আঘাত দিয়েছি? কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে আমি জানি যে যথাসময়ে তিনি নিজেই বলবেন ব্যাপারটা কি।
অবশেষে চা-পান শেষ হলো তার। তিনি বললেন, ট্রট, আমি আমার লাগেজ-এর ওপর কেন বসে আছি, জানো?
মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলাম—জানি না।
কারণ, এগুলোই আমার যথাসর্বস্ব। আমি ফতুর হয়ে গেছি! আমার যা কিছু আছে সবই এখন এই ঘরে। অবশ্য ডোভারের কটেজটি আছে। ওটা ভাড়া দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এতে আমাদের ঘাবড়ে গেলে চলে না। ট্রট, দুর্ভাগ্যের মধ্যেই বেঁচে থাকতে হবে আমাদেরকে। তোমাকে হতে হবে বলিষ্ঠ এবং স্বনির্ভর।
আমার জন্য এর চাইতে বড় আঘাত আর কি হতে পারে?
ডিক জানেন, শান্তভাবে বললেন দাদী আমার কাঁধে হাত রেখে। ডিক-এর জন্য আজ রাতের মত শোবার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আমার জন্য এখানেই একটা বিছানা পেতে দিতে পারো। এতে খরচ বাচবে। কোনরকমে শুতে পারলেই হবে। কেবল আজকের রাতটার জন্য।
দাদীর কথায় বিস্ময়ের ঘোর আমার কেটে গেল। বললাম আমার জানা এক জায়গায় মি. ডিক-এর জন্য একটা রুম ভাড়া নেয়া যাবে।
রাত হয়ে যাচ্ছে। মি. ডিককে নিয়ে চললাম রুম ভাড়া করতে। তিনি তার প্রকাণ্ড ঘুড়িটা পিঠে ঝুলিয়ে আমাকে অনুসরণ করলেন।
তাকে সেখানে রেখে ফিরে গেলাম আমার ফ্ল্যাটে। দেখলাম দাদী পায়চারি করছেন ঘরের মধ্যে। আমাকে বললেন যে তিনি আর পেগোটি ডোরার সঙ্গে আমার এনগেজমেন্ট নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
তুমি তাহলে মনে করছ যে ডোরার প্রেমে পড়েছ? বললেন তিনি।
মনে করছি মানে? চেঁচিয়ে উঠলাম লজ্জায় লাল হয়ে। ভোরাকে আমি মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসি! আমাদের বয়স কম। লোকে আমাদেরকে বোকা মনে করতে পারে। কিন্তু পরস্পরের জন্যে আমাদের ভালবাসাটা খাটি।
বিষণ্ণ হাসি হেসে দাদী বেটসি মৃদু কণ্ঠে বললেন, ভাল কথা। কিন্তু তোমাদের প্রেম বিফল হয়ে যেতে পারে। তবে, সফলও হতে পারে একদিন।
খুশি হলাম। অন্তত তাঁর কথায় আমাদের প্রতি মেহের আভাস পেলাম। তাই তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম।
কিন্তু ঘুম এল না দুচোখে। ভাবতে লাগলাম। আমার আর্থিক দুরবস্থা ও দারিদ্র্যের কথা শুনলে মি. স্পেনলো হয়তো আমাকে বিয়ে করার ব্যাপারে ডোরাকে অনুমতি দেবেন না। ট্রেনিং-এর সময় আমি কোন বেতন পাচ্ছি না। এ অবস্থায় ভোরার সঙ্গে কিভাবে মেলামেশা করব, দাদীকেই বা কেমন করে সাহায্য করব?
[একটা পেজ মিসিং, সরি!]
কে আমাকে এ পরামর্শ দিত? তুমি সব সময় আমার জন্য দেবদূত!
এখন তো ডোরা তোমার স্বর্গীয় দূত, আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল ও মৃদু হেসে।
নিজে কিছু রোজগার করব এটা ভেবে কী খুশিই না হয়ে উঠলাম! তখনি দেখা করার অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখলাম ড. স্ট্রংকে।
পরদিন গেলাম ড. স্ট্রং-এর কাছে। দেখলাম তিনি পায়চারি করছেন বাগানে।
কপারফিল্ড যে! বললেন তিনি। তুমি তো বেশ বড়ো হয়ে গেছ! কিছুক্ষণ আমরা আলাপ করলাম পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে, পুরানো বন্ধুবান্ধবদের সম্পর্কে। তারপর গম্ভীর হয়ে তিনি বললেন, কপারফিল্ড, তুমি চমৎকার ছাত্র ছিলে। অনেক কিছু করার মত শিক্ষা তুমি পেয়েছ। আমার সেক্রেটারি হবার মত সামান্য কাজ তুমি কেন নিতে চাও? বছরে সত্তর পাউণ্ডের বেশি তো দিতে পারব না।
ওতেই আমার চলবে। অবসর সময়ে আপনার কাজ করব। ওদিকে আমার ট্রেনিং এবং অধ্যয়নও চালিয়ে যেতে পারব।
ঠিক আছে, বললেন ড. স্ট্রং। তবে তোমাকে কথা দিতে হবে যে ভাল চাকরি পেলে গ্রহণ করবে এটা ছেড়ে দিয়ে।
কথা দিলাম, স্যার। বেশ, বেশ, বললেন ড. স্ট্রং।
আমরা ঠিক করলাম যে আমি প্রতিদিন সকালে দুঘণ্টা এবং রাতে তিন ঘণ্টা কাজ করব। শনিবার-রোববার ছাড়া। ওই দুদিন আমার ছুটি।
শুরু হলো আমার ব্যস্ত জীবন। ভোর পাঁচটায় ওঠা, ড. স্ট্রং-এর ওখানে যাওয়া। রাত নয়-দশটায় বাসায় ফেরা।
মি. ডিক মনমরা হয়ে রইলেন। নিজেকে তাঁর অকর্মণ্য মনে হলো। কারণ দাদী বেটসির সাহায্যের জন্যে তিনি কিছুই করতে পারছেন না। আমার তখন মনে পড়ল পুরানো বন্ধু টমি ট্র্যাডলস-এর কথা। ভাবলাম সে বোধহয় কোন বুদ্ধি দিতে পারবে। তার হয়তো মি. ডিককে সাহায্য করার মত ব্যবসায়িক যোগাযোগ আছে। দেখা গেল, সত্যিই সাহায্য করতে পারল ট্র্যাডস।
ট্র্যাডলস নিজেই মি. ডিককে কাজে লাগাতে পারবে। মি. ডিকের হাতের লেখা অসাধারণ সুন্দর। তাকে দিয়ে ট্র্যাডলস দলিলপত্র নকল করাবে। আমাকেও সে একটা পরামর্শ দিল। বলল আমি যদি শর্টহ্যাণ্ডটা শিখে নিতে পারি তাহলে খবরের কাগজের জন্য পার্লামেন্টের বিতর্কের রিপোর্ট তৈরির কাজ পেতে পারব।
ট্র্যাডলস আমাকে আরও কিছু খবর দিল। আমাদের পুরানো বন্ধু মি. মিকবারের এক চিঠি পেয়েছে সে। ট্র্যাডলস তাকে মাঝেমধ্যে টাকা ধার দিয়ে সাহায্য করে। মি. মিকবার লিখেছেন যে তিনি এখন ক্যান্টারবেরিতে একটা চাকরি পেয়েছেন। কাজ করছেন উরিয়া হীপের খাস কেরানী হিসেবে। বিস্মিত এবং কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে বসে রইলাম, কারণ উরিয়া হীপকে আমি বিশ্বাস করি না।