১৩. কারেফিনোতু থামতেই
কারেফিনোতু থামতেই উইল-ট্রির আশপাশ কোথাও থেকে কয়েকটা বন্দুক গর্জে উঠল। পরমুহূর্তে শুরু হয়ে গেল অঝোর ধারায় তুমুল বৃষ্টি।
বৃষ্টি শুরু হওয়ায় খুশি হলো গডফ্রে, উইল-ট্রির আগুনটা দেখতে দেখতে নিভে গেল। কিন্তু নতুন যে ধাঁধাটা শুরু হয়েছে, তার কি ব্যাখ্যা দেবে গডফ্রে? কারেফিনোতু, যে কিনা এক বর্ণ ইংরেজিও জানে না, সেই কিনা চোস্ত মার্কিন উচ্চারণে কথা বলল। শুধু কি তাই? তাকে মি. গডফ্রে বলে সম্বোধনও করল। সেই সঙ্গে জানাল, উইল মামা নাকি ফিনা আইল্যান্ডে আজ আসবেন। সে থামল, অমনি কাছাকাছি কেথাও থেকে গর্জে উঠল কয়েকটা বন্দুক, যেন তার কথায় সায় দিয়েই। এ-সবের ব্যাখ্যা কি?
গাছপালার ফাঁক দিয়ে নিচে দেখা গেল কয়েকজন নাবিককে, ছুটে উইল-ট্রির দিকেই আসছে তারা। গডফ্রে আর দেরি করল না, সিড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে এল। কারেফিনোতুও তার পিছু নিল।
নিচে নামতেই দুজন মানুষের গলা ঢুকল গডফ্রের কানে। এ এমন কণ্ঠস্বর, হাজার বছর পর শুনলেও চিনতে পারবে গডফ্রে।
কী হে, ভাগ্নে? আছ কেমন? সহাস্যে জানতে চাইলেন কোল্ডেরুপ।
গডফ্রে! ফিনার গলায় আনন্দ ও উল্লাস।
উইল-মামা, তুমি! ফিনা, তুমি! গডফ্রে স্তম্ভিত।
ইতিমধ্যে ক্যাপটেন টারকটের নির্দেশ পেয়ে দুজন নাবিক উইল-ট্রির মগডালে উঠে পড়েছে। প্রফেসর টাৰ্টলেটকে তারা যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে, তবে আধ-কাঁচা ফলের মত পেড়ে আনল। গডফ্রে আবার বিড় বিড় করল, মামা? তুমি?
হ্যাঁ, দৃষ্টিভ্রম নয়, ঠিকই দেখতে পাচ্ছিস। আমিই। কিন্তু তুমি ফিনা আইল্যান্ডের হদিশ পেলে কিভাবে?
ফিনা আইল্যান্ড? প্রবল বেগে মাথা নাড়লেন উইলিয়াম ডব্লিউ কোল্ডেরুপ। কিসের ফিনা আইল্যান্ড! এই দ্বীপের নাম স্পেনসার আইল্যান্ড। হদিশ পেলাম কিভাবে? এটা কোন কঠিন প্রশ্ন হলো না। আমার দ্বীপ আমি খুঁজে পাব না তো কে খুঁজে পাবে। এই দ্বীপ আমি ছমাস আগে নিলামে কিনেছি।
স্পেনসার আইল্যান্ড-মানে?
গডফ্রে, তুমি কি এই দ্বীপের নাম দিয়েছ ফিনা আইল্যান্ড? মিষ্টি সুরে প্রশ্ন করল ফিনা হলানি।
আমার মেয়ের নামে যখন নামকরণ হয়েছে, এই নামটাই বহাল রাখতে হবে, কোল্ডেরুপ বললেন। তবে দ্বীপটার ভৌগোলিক নাম স্পেনসার আইল্যান্ড। খুব দূরে নয়, সান ফ্রান্সিসকো থেকে মাত্র তিন দিনের পথ। একটু কৌশলে আমিই তোমাকে এখানে পাঠিয়েছি। ভেবেছিলাম রবিনসন ক্রুসোকে অনুকরণ করার জন্যে এই দ্বীপটাই তোমার জন্যে আদর্শ হবে।
কি বললে, মামা? কি বললে? রবিনসন ক্রুসোকে অনুকরণ? তিক্ত হাসি ফুটল গডফ্রের ঠোঁটে। সত্যি কথা বলতে কি, কাজটা তুমি ঠিকই করেছ। কোন সন্দেহ নেই, আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। কিন্তু, মামা-জাহাজডুবির ঘটনাটা?
সাজানো নাটক, স্রেফ সাজানো নাটক, হেসে উঠে বললেন কোল্ডেরুপ, তার এমন হাসিখুশি চেহারা আগে কখনও দেখা যায়নি। ক্যাপটেন টারকটের ওপর আমার নির্দেশ ছিল, স্বপ্নকে অর্ধেকটার মত ডোবাবার ভান করতে হবে। তোমরা ভাবলে জাহাজটা পুরোপুরি ডুবে গেছে। তোমরা নিরাপদে দ্বীপে উঠেছ, এটা দেখেই টারকট জাহাজের পানি ঘেঁচে ফেলে দেয়, তারপর ফুলস্পীডে চালিয়ে সোজা ফিরে যায় সানফ্রান্সিসকোয়-তিন দিনের মধ্যে। এখন আবার উনিই আমাদেরকে স্পেনসার আইল্যান্ডে নিয়ে এলেন।
তাহলে নাবিক বা মাল্লারা কেউ মারা যায়নি?
না, কেন মরবে! তবে সেই চীনা লোকটার ভাগ্যে কি ঘটেছে তা বলতে পারি না। ওই যে, জাহাজের খোলে যে লোকটা লুকিয়েছিল। পরে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কিন্তু, মামা, ক্যানুটা? জংলীদের ক্যানুটা?
তা-ও সাজানো নাটক। ওই ক্যানুও আমার বানানো। ভাগ্নে, গোটা ব্যাপারটাই আসলে অভিনয়।
জংলীরা?
ওরা আসলে জংলীই নয়। ওদেরকে আমি জংলী সাজাই। ভাগ্যকে ধন্যবাদ, তোমাদের গুলি ওদেরকে লাগেনি।
আর কারেফিনোতু?
নাটকের একটা চরিত্র। ওর নাম কারেফিনোতু নয়, জাস ব্রাস। সে আমার অতি বিশ্বস্ত কর্মচারী। এখানে এসে দেখতে পাচ্ছি ক্রুসোর ফ্রাইডের ভূমিকায় বেড়ে অভিনয় করেছে সে।
তা ঠিক, মামাকে সমর্থন করল গডফ্রে। ভদ্রলোক দুদুবার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। একবার ভালুকের কবল থেকে, আরেকবার বাঘের কবল থেকে।
নকল! নকল! দুটোই নকল! একটাও জ্যান্ত ছিল না। গলা ছেড়ে হেসে উঠলেন কোল্ডেরুপ। দুটোর ভেতরই গাদা গাদা খড় ছিল। জাস ব্রাস আর তার সঙ্গীরা ও-দুটো নিয়েই দ্বীপে ওঠে।
কিন্তু নকল হলে থাবা নাড়ছিল কিভাবে?
স্প্রীঙ বসানো খেলনা যে! দুবারই তোমাকে ফাঁকি দিয়ে রাস্তায় ওগুলোকে রেখে আসে জাস ব্রাস। হে-হে-হে, সবই অভিনয়, বুঝলে!
কিন্তু কেন?
বাহ! দিব্যি নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছিলে দ্বীপে, উত্তেজনাকর কিছু একটা না ঘটলে ক্রুসোদের মানাবে কেন!
এবার মামার সঙ্গে ভাগ্নেও হেসে উঠল। কিন্তু, একটা প্রশ্ন, মামা। এখানে আমাদের জীবনযাপন তুমি যদি সহজ করতে নাই চেয়ে থাকো, তাহলে প্রয়োজনীয় জিনিস ভর্তি সিন্দুকটা পাঠালে কেন?
প্রয়োজনীয় জিনিস ভর্তি সিন্দুক? কোল্ডেরুপ আকাশ থেকে পড়লেন। আমি তো কোন সিন্দুক পাঠাইনি! তবে কি… কথা শেষ না করে ফিনার দিকে তাকালেন তিনি।
মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকাল ফিনা।
আচ্ছা, বুঝেছি! তাহলে এই ব্যাপার! ফিনাই কোন লোককে দিয়ে… কোল্ডেরুপ ক্যাপটেন টারকটের দিকে তাকালেন।
টারকট হেসে ফেলে বললেন, মিস ফিনার কথা কি আমি ফেলতে পারি, আপনিই বলুন, মি. কোল্ডেরুপ! চার মাস আগে আপনি যখন দ্বীপে এরা কি করছে জানার জন্যে আমাকে পাঠালেন, তখন ওই সিন্দুকটা…
ফিনা! তুমিই তাহলে সিন্দুকটা…? গডফ্রে হাসছে।
লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে ফিনা। ক্যাপটেন টারকট, আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন যে ব্যাপারটা গোপন রাখবেন…
তার কথা শুনে সবাই একযোগে হেসে উঠল।
কিন্তু কুমিরটা? আপনি কি বলতে চান, মি. কোল্ডেরুপ, আমাকে যে কুমিরটা ধাওয়া করেছিল সেটাও ছিল আপনার পাঠানো নকল কুমির? স্ত্রীঙ লাগানো? এই প্রথম মুখ খুললেন প্রফেসর টাৰ্টলেট।
কুমির!
হ্যাঁ, মি. কোল্ডেরুপ, বলল জাস ব্রাস ওরফে কারেফিনোতু। আস্ত ও জ্যান্ত একটা কুমির সত্যি সত্যি মি. টার্টলেটকে ধাওয়া করেছিল। ওটাকে কিন্তু আমি সঙ্গে করে আনিনি।
সে থামতেই মামাকে হিংস্র জন্তুদের কথা খুলে বলল গডফ্রে। শুনে কোল্ডেরুপ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সবাই জানে স্পেনসার আইল্যান্ডে কোন হিংস্র জন্তু-জানোয়ার নেই দলিলেও এ-কথা লেখা আছে-আমিষখোর কোন প্রাণী কখনোই দেখা যায়নি দ্বীপে। কোল্ডেরুপ নিজে ওই দলিল খুঁটিয়ে পড়েছেন।
গডফ্রে এরপর রহস্যময় ধোঁয়ার কথাটাও তুলল। এটারও কোন সমাধান পাওয়া গেল না। কোল্ডেরুপ স্বীকার করলেন, নাটকের প্রযোজক হিসেবে সব কিছু সুষ্ঠুভাবে সারতে পারেননি তিনি। তিনি নিজে যেখানে সব দেখে রায় দিয়েছিলেন যে দ্বীপে কোন হিংস্র প্রাণী বা ব্যাখ্যার অতীত কোন রহস্য নেই, সেখানে সাপ, সিংহ, হায়েনা, চিতা বা ধোঁয়া আসে কোত্থেকে? এ তাঁর এক ধরনের ব্যর্থতা তো বটেই।
প্রসঙ্গটা আপাতত ভুলে থাকলেন তিনি। গডফ্রেকে বললেন, দ্বীপ তোমাকে চিরকাল আকর্ষণ করে, তাই না? সে-কথা ভেবেই এই দ্বীপটা তোমাকে আমি দিয়ে দিয়েছি। এখন এটাকে নিয়ে যা খুশি করতে পারো তুমি। যদি চাও, রবিনসন ক্রুসো হয়ে সারাটা জীবন এখানেই কাটিয়ে দিতে পারো, কেউ আপত্তি করবে না।
রবিনসন ক্রুসো হব? এই আমি? মামা, মাফ চাই!
তাহলে চলো ফিরে যাই সানফ্রান্সিসকোয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি তোমাদের বিয়ে দিতে চাই। কালই আমরা রওনা হতে পারি, কি বলো?
ঘাড় কাত করে তখুনি রাজি হয়ে গেল গডফ্রে। তারপর সবাইকে নিয়ে বেরুল সে, দ্বীপটা ঘুরিয়ে দেখাবে।
উইল-ট্রির আশপাশে বুনো জন্তুরা কিছুই আস্ত রাখেনি, ভেঙে সব গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ওদের পোষা প্রাণী একটাও বেঁচে নেই, চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে তাদের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ। দলবল নিয়ে কোল্ডেরুপ সময়মত না পৌছালে এই ক্রুসোদের কপালে আরও অনেক খারাবি ছিল। উইল-মামা, হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় বলল গডফ্রে, দ্বীপের নাম তো ফিনা আইল্যান্ড, কিন্তু আমাদের এই আস্তানার নাম কি রেখেছি, জানো? উইল-ট্রি!
বেশ-বেশ, খুশি হলাম। উইল-ট্রির বীজ সানফ্রান্সিসকোয় নিয়ে যাব, পুঁতে দেব আমার বাগানে।
রাস্তা ধরে হাঁটছে ওরা, বুনো জন্তুদের অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল। অনেক লোকজন দেখে ভয়ে তারা কাছে এল না, ঝোপের ভেতর লুকিয়ে পড়ল। প্রসঙ্গটা আবার তুললেন কোল্ডেরুপএতগুলো হিংস্র জানোয়ার এই দ্বীপে কোত্থেকে এল? অনেক মাথা খাটিয়েও রহস্যটার কোন মীমাংসা পাওয়া গেল না।
রাতটা ওরা সবাই স্বপ্নে কাটাল।
স্বপ্ন রওনা হলো পরদিন, জানুয়ারি মাসের বিশ তারিখে। বেলা আটটার দিকে ডেক থেকে গডফ্রে দেখল দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে স্পেনসার ওরফে ফিনা আইল্যান্ড। বুকটা কি এক মায়ায় টনটন করে উঠল তার। দ্বীপটাকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এই ফিনা আইল্যান্ড ছমাসে অনেক কিছু শিখিয়েছে তাকে। সে শিক্ষা অমূল্য, জীবনটাকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে গড়ে তুলতে তাকে সব সময় সাহায্য করবে।
স্বপ্ন এবার সোজা পথ ধরে ফিরছে। দিনে একদিকে, রাতে আরেকদিকে নয়। কাজেই সানফ্রান্সিসকোয় খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেল ওরা। জাহাজ জেটিতে ভিড়তেই অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য এক ঘটনা ঘটল। এবার নিয়ে দ্বিতীয় বার জাহাজের খোল থেকে বেরিয়ে এল সেই চীনাম্যান সেংভু।
কোল্ডেরুপের সামনে এসে সেংভু বলল, মি. কোল্ডেরুপ, আশা করি আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। প্রথমবার আপনার জাহাজের খোলে লুকাবার কারণ ছিল, আমি ভেবেছিলাম স্বপ্ন সাংহাই যাবে। আর এবার স্বপ্ন থেকে নামছি সান ফ্রান্সিসকোয় ফিরে আসতে পারায়।
তার আকস্মিক আবির্ভাবে সবাই বিমূঢ়। কারও মুখে কথা ফুটছে না।
নিস্তব্ধতা ভাঙলেন কোল্ডেরুপ। গত ছমাস নিশ্চয়ই তুমি আমার জাহাজের খোলে লুকিয়ে ছিলে না?
জ্বী, না, তা ছিলাম না।
তাহলে কোথায় ছিলে?
দ্বীপে ছিলাম, স্যার। ফিনা আইল্যান্ডে।
কি বললে? গডফ্রে হাঁ হয়ে গেল। তুমি দ্বীপে ছিলে?
হ্যাঁ। তাহলে তুমিই আগুন জ্বালতে?
হ্যাঁ, আমিই। বেঁচে থাকতে হলে আগুন তো জ্বালতেই হবে।
তুমি আমাদেরকে দেখা দাওনি কেন? আমরা তো একসঙ্গেই থাকতে পারতাম।
সেংভু শান্ত গাম্ভীর্যের সঙ্গে জবাব দিল, চীনারা আসলে একা থাকতেই ভালবাসে। সব চীনাই নিজেকে রক্ষা করতে জানে। অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে আর কারও সাহায্য আমাদের দরকার হয় না।
দ্বিতীয়বার তুমি জাহাজে উঠলে কিভাবে?
সাঁতরে উঠি। জানুয়ারি মাসের উনিশ তারিখে। নুয়ে পড়ল সেংভু, সবিনয়ে সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে জেটিতে নামল, তারপর মিশে গেল লোকজনের ভিড়ে।
রবিনসন ক্রুসো হবার সব রকম যোগ্যতা একমাত্র ওরই আছে, কোল্ডেরুপ বললেন। ওর মত একা একটা দ্বীপে থাকতে পারবে তোমরা কেউ?
কঠিন একটা প্রশ্ন, সন্দেহ নেই, বলল গডফ্রে। যাক, অন্তত একটা রহস্যের সমাধান পাওয়া গেল। ধোঁয়াটা এখন আর কোন ধাঁধা নয়। বোঝা গেল, সেংভুই আগুন জ্বালত। কিন্তু বুনো জন্তুগুলো? ফিনা আইল্যান্ডে ওগুলো কিভাবে এল তা বোধহয় কোনদিনই জানা যাবে না।
আর আমার প্রতিদ্বন্দ্বী কুমিরটা? জানতে চাইলেন প্রফেসর টাৰ্টলেট। মরা কুমিরটাকে ফিনা আইল্যান্ডে রেখে আসেননি, জাহাজে তুলে নিয়েছেন। ওটারই বা কি রহস্য?
উইল-মামা একটু বিব্রতই হলেন। কিন্তু কুমির-রহস্য ভেদ করা এমন কি তার পক্ষেও সম্ভব নয়।
দিন কয়েক পরই খুব ধুমধামের সঙ্গে গডফ্রে আর ফিনার বিয়ে হলো। তারপর একদিন ছাত্র-ছাত্রী আর মি. কোল্ডেরুপকে নিজের বাড়িতে দাওয়াত দিলেন প্রফেসর টাৰ্টলেট।
প্রফেসরের বৈঠকখানায় ঢোকার পর চমকে উঠল সবাই। দূর থেকে দেখে একেবারে জ্যান্ত লাগছে স্টাফ করা কুমিরটাকে। কড়িকাঠ থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ওটাকে-মুখ খোলা, থাবা উদ্যত। গর্ব করে টাৰ্টলেট বললেন, এই কুমির আমার এই বৈঠকখানার অলঙ্কার।
সবাই তার রুচি ও বুদ্ধির প্রশংসা করতে লাগল।
টাৰ্টলেট সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, মি, কোল্ডেরুপ, বলতে পারবেন, কুমিরটা দ্বীপে কিভাবে এসেছিল?
না।
কেন, খেয়াল করেননি, কুমিরটার গলায় একটা লেবেল সাঁটা ছিল?
লেবেল সাঁটা ছিল? কি বলছেন!
ঠিকই বলছি। এই দেখুন সেই লেবেল, বলে কোল্ডেরুপের দিকে একটুকরো চামড়া বাড়িয়ে ধরলেন টার্টলেট।
সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল চামড়াটা দেখার জন্যে। তাতে লেখা রয়েছে—
হামবুর্গ থেকে হাগনবেক কোম্পানি কর্তৃক প্রেরিত
জনাব জে. আর, টাসকিনার বরাবরেষু
স্টকটন, আমেরিকা।
পড়া শেষ হতেই গলা ছেড়ে হেসে উঠলেন কোল্ডেরুপ। এতদিনে সব তিনি বুঝতে পারছেন। আচ্ছা, এ তাহলে তাঁর চিরশত্রু টাসকিনারের কীর্তি! নিলামে হেরে যাবার পর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠেন তিনি। বিভিন্ন দেশের চিড়িয়াখানা থেকে হিংস্র জন্তু-জানোয়ার আনিয়েছেন, তারপর সেগুলোকে জাহাজে তুলে ছেড়ে দিয়ে এসেছেন ফিনা আইল্যান্ডে। ভেবেছেন, এবার তার শত্রু ঠ্যালা সামলাক! প্রতিদ্বন্দ্বীকে শায়েস্তা করতে গিয়ে অনেক টাকা খরচ করেছেন তিনি।
সত্যি, লোকটার প্রশংসা করতে হয়, আবার হেসে উঠে বললেন কোল্ডেরুপ। হার মানতে জানেন না। আমার মাথায় কিন্তু এই বুদ্ধি কখনোই আসত না।
ফিনা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলল, কিন্তু ওই দ্বীপে আর তো যাওয়াই যাবে না! হিংস্র প্রাণীদের আমি সাংঘাতিক ভয় পাই।
আমরা অপেক্ষা করব, বললেন উইল-মামা শেষ সিংহটা শেষ বাঘকে খেয়ে ফেলুক, তারপর যাব।
ফিনাকে তো ওই দ্বীপে একবার আমি নিয়ে যাই, বলল গডফ্রে। কি ফিনা, যাবে তো? নাকি ভয় পাবে?
তুমি সঙ্গে থাকলে ভয় পাব কেন? মিষ্টি গলায় বলল ফিনা। যাব বৈ কি, অবশ্যই যাব।
***
রোমাঞ্চপ্রিয় গডফ্রের ইচ্ছে দুনিয়াটা দেখতে অভিযানে বেরুবে। নাচের শিক্ষক প্রফেসর টার্টলেটকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।
কিন্তু ওদের জাহাজ স্বপ্ন দিনে একদিকে যায়, রাতে যায় অন্য দিকে- রহস্যটা কি?
জাহাজডুবি ঠেকানো গেল না, সাঁতরে একটা নির্জন দ্বীপে উঠল ওরা। এখানে কোন মানুষ নেই, তাহলে আগুন জ্বালছে কে?
কাঠের প্রকান্ড সিন্দুকটাই বা কোত্থেকে এল? তাদের আন্তানায় হানা দিল হিংস্র একদল আমিষখোর জন্তু।
আশ্চর্য! ওগুলো আসছে কোত্থেকে?
কারেফিনোত লোকটাই বা কে?
বিশেষ সতর্কবানী- শেষ পাতাগুলো আগে পড়ে ফেললে কাহিনীটা উপভোগ্য হবে না।