স্কুল ফর রবিনসন্স: ১১. শুধু ভালুক নয়, দ্বীপে বাঘও আছে

স্কুল ফর রবিনসন্স: ১১. শুধু ভালুক নয়, দ্বীপে বাঘও আছে

১১. শুধু ভালুক নয়, দ্বীপে বাঘও আছে

শুধু ভালুক নয়, দ্বীপে বাঘও আছে, এ-কথা শুনে ম্যালেরিয়ার রোগীর মত কাঁপতে লাগলেন প্রফেসর টাৰ্টলেট। শুধু কাঁপছেন না, সেই সঙ্গে প্রলাপও বকছেন। এই দ্বীপে থাকতে হলে পাথরের দুর্গ চাই, পাথরের দুর্গ! তা না পেলে এখুনি আমি দেশে ফিরব-এখুনি!

দেশে তো আমিও ফিরতে চাই, শান্ত গলায় বলল গডফ্রে। কিন্তু কিভাবে যাব সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

আবার তোমাকে আমি প্রশ্ন করছি, গডফ্রে! চিৎকার করছেন প্রফেসর টার্টলেট। চারমাস হলো এই দ্বীপে আছি আমরা। এতদিন কোন হিংস্র জন্তু দেখিনি। আজ হঠাৎ কেন একের পর এক দেখতে পাচ্ছি?

এর উত্তর আমার জানা নেই, স্যার, সত্যি কথাই বলল গডফ্রে। ব্যাপারটা আমার কাছেও অত্যন্ত দুর্বোধ্য।

আমি বলি কি, দ্বীপ ছেড়ে পালানোর যখন কোন উপায় নেই, এসো, আমাদের এই আস্তানাকে আমরা দুর্ভেদ্য দুর্গ বানিয়ে ফেলি।

কিভাবে?

উইল-ট্রির চারপাশে আরও কয়েকটা দেবদারু গাছ রয়েছে, ঠিক? ওগুলোকে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে উইল-ট্রির চারপাশে একটা মজবুত বেড়া তৈরি করা যায়।

প্রস্তাবটা গডফ্রের মনে ধরল। কাজটায় যথেষ্ট খাটনি আছে, তবে খাটনিকে সে ভয় পায় না। তাছাড়া, তাকে একাই সব করতে হবে না-কারেফিনোতু আর টার্টলেট সাহায্য করবেন। দেরি না করে তখুনি ওরা কাজে লেগে গেল।

পাইন বনটা নদীর ধারে, ওদের আস্তানা থেকে এক মাইল দূরে। পাইনের ডালপালা দিয়ে বেড়াটা তৈরি করা হবে। রোজ সকালে রুটিন হয়ে দাঁড়াল কাজটা, কুড়ুল নিয়ে তিনজনই বেরিয়ে পড়ে। সঙ্গে খাবার থাকে, ফলে সন্ধের আগে আস্তানায় না ফিরলেও চলে। কাজটা ওরা যত কঠিন ভেবেছিল, হাত দেয়ার পর দেখা গেল তারচেয়েও কঠিন। পাইন বন থেকে কাঠ আর ডালপালা কেটে আনতেই সতেরো তারিখ পার হয়ে গেল। আকাশে আবার নতুন করে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দিয়েছে। মাথার ওপর প্রায় সব সময় মেঘ থাকে, মাঝে মধ্যে বৃষ্টিও হচ্ছে।

বেড়াটা তৈরি করতে আরও এক হপ্তা লেগে গেল। তৈরি হবার পর তিনজনই স্বীকার করল, তাদের ঘাম ঝরানো পরিশ্রম সার্থক হয়েছে-যে-কোন বিচারে অত্যন্ত মজবুত হয়েছে বেড়াটা। শুধু গাছগুলোকে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি, ওগুলোর মাঝখানে মোটা মোটা ডালও পোঁতা হয়েছে মাটিতে। বেড়াটা এত উঁচু, হিংস্র কোন জন্তুর পক্ষেও লাফ দিয়ে টপকানো সম্ভব নয়। গায়ের ধাক্কায় ভেঙে ফেলতেও পারবে না।

বেড়া তৈরি শেষ, বাকি শুধু বেড়ার মাঝখানে একটা দরজা বসানো। সাতাশ তারিখ সকালে সেই কাজটাই করছিল গডফ্রে। হঠাৎ এমন একটা রহস্যময় কান্ড ঘটল, ফিনা আইল্যান্ডের পুরানো ধাঁধাটা আরও জটিল হয়ে উঠল ওদের কাছে।

উইল-ট্রির মগডালে উঠেছে কারেফিনোতু, ওদের আস্তানার মাথার দিকের ফুটোগুলো বন্ধ করবে। হঠাৎ দুর্বোধ্য ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল সে। তাড়াতাড়ি দূরবীন নিয়ে গাছ বেয়ে মগডালে উঠে এল গডফ্রে। হাত তুলে তাকে উত্তর-পুব দিকটা দেখাল কারেফিনোতু। সেদিকে তাকাতেই বিষম একটা ধাক্কা খেলো গডফ্রে।

কুন্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উঠছে আকাশে।

আবার! বিড়বিড় করল গডফ্রে। ধোঁয়ার উৎস প্রায় মাইল পাঁচেক দূরে, দ্বীপের অন্য এক প্রান্তে। আগুনটা বেশ বড়ই হবে, কারণ বেশ মোটা একটা স্তম্ভের মত পাক খেতে খেতে উঠছে ধোঁয়াটা। এবার এই রহস্যের সমাধান আমাকে করতেই হবে, গডফ্রের গলায় জেদ। কারেফিনোতুকে নিয়ে দ্রুত গাছ থেকে নেমে এল সে। কিছু খাবারদাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়ল দুজন, প্রফেসর টার্টলেট থাকবেন আস্তানার পাহারায়।

সাঁকো পার হয়ে নদীর ডান তীরে চলে এল ওরা, তারপর ঘাসজমির ওপর দিয়ে সংক্ষিপ্ত পথ ধরে দ্রুত হাঁটতে লাগল। হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের ভয়ে সাবধানে এগোচ্ছে ওরা। সৈকতের প্রথম সারি পাথরগুলোর কাছে পৌঁছাতে বেলা বারোটা বেজে গেল। ইতিমধ্যে এক জায়গায় থেমে দুপুরের খাবারটা খেয়ে নিয়েছে। আকাশের গায়ে ধোঁয়ার কুন্ডলী এখন আরও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ওরা। আর সম্ভবত সিকি মাইল এগোলে ধোঁয়ার উৎসটা দেখতে পাবে।

কিন্তু দুমিনিট পর হঠাৎ করে ধোঁয়াটা অদৃশ্য হয়ে গেল। মনে হলো কেউ যেন তাড়াহুড়ো করে আগুনটা নিভিয়ে দিয়েছে। দেবদারু গাছের মাথা থেকে জায়গাটা অবশ্য চিনে রেখেছে গডফ্রে, খুঁজে নিতে কোন অসুবিধে হবে না। সে ধোঁয়া উঠতে দেখেছে তেকোনা একটা পাথরের আড়াল থেকে, পাথরটা পিরামিড আকৃতির।

পঞ্চাশ গজ দূর থেকে পিরামিডটা দেখতে পেল ওরা। ছুটল গডফ্রে কিন্তু কাছে এসে দেখল, কেউ নেই। শুধু আধ পোড়া কিছু কাঠ আর বেশ খানিকটা ছাই পড়ে আছে। কেউ না কেউ এখানে ছিল দুমিনিট আগেও ছিল। তার বা তাদের পরিচয় আজ আমাকে জানতেই হবে। বুক ভরে বাতাস নিল, গডফ্রে, তারপর চিৎকার করে ডাকল, কে তোমরা? সামনে এসো, দেখা দাও!

কেউ সাড়া দিচ্ছে না।

নিজের ভাষায় কারেফিনোতুও চিৎকার করে ডাকল। এবারও কেউ সাড়া দিল না। আশপাশের সবগুলো পাথরের আড়ালে খোঁজাখুঁজি করল ওরা। সৈকতের প্রতিটি গুহা, গর্ত, সুড়ঙ্গে তল্লাশী চালাল। কিন্তু কাউকে পাওয়া গেল না। অগত্যা বাধ্য হয়ে আস্তানায় ফেরার জন্যে ফিরতি পথ ধরল ওরা।

হাঁটতে হাটতে এটা-সেটা অনেক কথাই ভাবছে গডফ্রে। ফিনা আইল্যান্ডে তবে কি ভূত আছে? নাকি এই দ্বীপে লুকিয়ে আছে কোন জাদুকর? বারবার ধোঁয়া দেখতে পাবার কারণ কি? হঠাৎ করে হিংস্র জানোয়ারই বা আসছে কোত্থেকে?

হঠাৎ গডফ্রেকে প্রচন্ড এক ধাক্কা মারল কারেফিনোতু। ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল গডফ্রে। বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি, ধীরে ধীরে সিধে হচ্ছে, দ্রুত একটা সাপকে পালিয়ে যেতে দেখল। আশ্চর্য! বিহবল দেখাচ্ছে গডফ্রেকে! একের পর এক এসব কি হচ্ছে! প্রথমে ভালুক দেখলাম, তারপর বাঘ, এখন আবার সাপ!

সাপ পালাচ্ছে, কিন্তু কারেফিনোতু সেটাকে কোন মতেই পালাতে দেবে না। পিছু ধাওয়া করে সাপটার গায়ে কুড়ল দিয়ে কোপ মারল সে। একটা সাপ মরল, কিন্তু ঘাসের ভেতর আরও কয়েকটা সাপ দেখতে পেল ওরা। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল গডফ্রে। কারেফিনোতু, দৌড়াও! বলে নিজেও ছুটল সে। একের পর এক বিস্ময়ের ধাক্কায় তার মাথাটাই না খারাপ হয়ে যায়। হঠাৎ করে এত সাপ এল কোথেকে? গডফ্রের ভয় লাগছে-আরও কোন বিপদ ওত পেতে নেই তো?

আছে, বিপদ আছে। তা-ও ছোটখাট বিপদ নয়।

নদীর ধারে এসে থমকে দাঁড়াল গডফ্রে। উইল-ট্রির দিক থেকে একটা আর্তচিৎকার ভেসে আসছে। শুরু হবার পর চিৎকারটা থামছে না। গলাটা ওদের পরিচিত। জলদি, কারেফিনোতু, জলদি! বলেই ছুটল গডফ্রে। প্রফেসর টাৰ্টলেট নিশ্চয়ই কোন সাংঘাতিক বিপদে পড়েছেন!

সাঁকো থেকেই দেখা গেল প্রফেসরকে। মাত্র দশ-বারো গজ দূরে তিনি, নদীর কিনারা ধরে প্রাণপণে ছুটছেন। তাঁকে ধাওয়া করছে হাঁ করা প্রকান্ড একটা কুমির। গা ভেজা, তারমানে একটু আগেই ওটা পানি থেকে উঠে এসেছে। টার্টলেট যখন মনের আনন্দে ছোটেন, দেখে মনে হয় নাচতে নাচতে এঁকেবেঁকে ছুটছেন; কিন্তু এই মুহূর্তে আতঙ্কে এমনই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন যে সে-সব ভুলে নাক বরাবর সোজা ছুটছেন, ফলে তার নাগাল পাবার সম্ভাবনাটা অনেক বেড়ে গেছে কুমিরের। বিপদের ওপর বিপদ, অকস্মাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন তিনি। এবার আর তার রক্ষা নেই।

থমকে গেছে গডফ্রে, একচুল নড়ছে না। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের এই চরম বিপদের সময় মাথাটা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে সে। বন্দুকটা তুলে সাবধানে, গভীর মনোযোগ দিয়ে, লক্ষ্যস্থির করল। গুলি করতেই তড়াক করে একটা লাফ দিল কুমির, ছিটকে পড়ে গেল একপাশে। একটা ঝড়ের মত গডফ্রেকে পাশ কাটাল কারেফিনোতু, ঝট করে প্রফেসর টাৰ্টলেটকে নিজের কাঁধে তুলে নিল।

সন্ধে ছটা, সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সঙ্গীদের নিয়ে আস্তানায় ফিরল গডফ্রে। আজকের আলোচ্য বিষয় বাঘ-ভালুক-সাপ-কুমির আর ধোঁয়া। ফিনা আইল্যান্ডে এসব কি ঘটছে! কে বা কারা বারবার রহস্যময় আগুন জ্বালছে? হঠাৎ করে হিংস্র জন্তু-জানোয়ারগুলোই বা আসবে কোত্থেকে?

কে জানে আরও কত রকম বিপদ ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে।

প্রফেসর টাৰ্টলেট বারবার সেই পুরানো কথাটাই বলছেন, গডফ্রে, এখানে থাকলে ভয়েই আমার হার্ট বন্ধ হয়ে যাবে। যেভাবে পারো এই দ্বীপ থেকে অন্য কোথাও নিয়ে চলো আমাকে। এখানে আমি আর এক মুহূর্তও থাকতে চাই না।

তাকে অভয় দিয়ে কিছু বলা দরকার। কিন্তু গডফ্রে বোবা হয়ে বসে থাকল।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত