স্কুল ফর রবিনসন্স: ১০. প্রফেসর টার্টলেট ভয় পাবেন ভেবে

স্কুল ফর রবিনসন্স: ১০. প্রফেসর টার্টলেট ভয় পাবেন ভেবে

১০. প্রফেসর টার্টলেট ভয় পাবেন ভেবে

প্রফেসর টার্টলেট ভয় পাবেন ভেবে ভালুকটার কথা বলবে কিনা এই নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিল গডফ্রে। নানা দিক চিন্তা করে বলবারই সিদ্ধান্ত নিল সে। কিন্তু বলবার পর উপলব্ধি করল, বিরাট একটা ভুলই করে ফেলেছে।

ভালুক! আঁতকে উঠে তিনটে লাফ দিলেন প্রফেসর টার্টলেট। কি বললে? ভালুক? হঠাৎ ফিনা আইল্যান্ডে ভালুক আসবে কোত্থেকে? তুমি নিশ্চয়ই ভুল দেখেছ! আতঙ্কে তাঁর মুখ নীলচে দেখাচ্ছে।

মাথা নেড়ে গডফ্রে বলল, না, ভুল দেখিনি। ওটা ভালুকই ছিল। তবে গুলি করার পর পড়ে যেতে দেখেছি, কাজেই আপনার এত ভয় পাবার কোন কারণ নেই।

ভয় পাবার কারণ নেই? টার্টলেট বিস্মিত। একটা ভালুক থাকলে দশটা থাকতে অসুবিধে কি? আর ভালুক যদি থাকে, কি করে বুঝব যে নেকড়ে, জাগুয়ার, বাঘ, সিংহ বা পাইথনও নেই? ভয়ে ভয়ে এমনভাবে চারদিকে তাকাচ্ছেন তিনি, যেন বিশাল কোন চিড়িয়াখানার সমস্ত জীব-জন্তুকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, তারা দল বেঁধে ওদের ওপর হামলা করতে ছুটে আসছে।

গডফ্রে তাকে শান্তভাবে বোঝাবার চেষ্টা করল, এত অস্থির হবার কিছু নেই।

কিন্তু তার কথায় কান না দিয়ে টাৰ্টলেট বললেন, আগে তুমি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। এতদিন দ্বীপে কোন হিংস্র প্রাণী দেখা যায়নি, আজ হঠাৎ কেন একটা ভালুক দেখা গেল?

গডফ্রে স্বীকার করল, হ্যাঁ, এই ব্যাপারটা আমার কাছেও খুব আশ্চর্য লাগছে। আমিও এর কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না। তবে ভালুক একটা দেখা গেছে বলেই এটা ধরে নেয়া চলে না যে ফিনা আইল্যান্ডে আরও অনেক ধরনের হিংস্র প্রাণী আছে।

নেই যে তারই বা প্রমাণ কি? আবার প্রশ্ন করলেন টার্টলেট।

এ নিয়ে তর্ক করে কোন লাভ নেই, বলল গডফ্রে। এখন যেটা উচিত, আমাদের সাবধানে থাকতে হবে। অস্ত্র ছাড়া বাইরে ঘোরাফেরা করা চলবে না।

অর্থাৎ আমরা খুব বিপদের মধ্যে আছি। প্রফেসর ভয়ে একেবারে কুঁকড়ে গেলেন। দ্বীপে আসার পর এই প্রথম বাড়ি ফেরার প্রচন্ড তাগাদা অনুভব করলেন তিনি। ঢের হয়েছে, গডফ্রে! যথেষ্ট হয়েছে। এবার পৈত্রিক প্রাণটা আমাকে বাঁচাতে হবে। জীবনের প্রতি আমার মায়া আছে, এটাকে হিংস্র জানোয়ারের মুখে তুলে দিতে পারি না। যেভাবেই হোক, দেশে ফিরতে হবে আমাকে। ফিরতেই হবে!

ফিরতে হবে বললেই কি ফেরা যায়? একই কথা বারবার বলছেন টার্টলেট। কিন্তু কিভাবে ফিরবেন তা তার মাথায় আসছে না। তার জন্যে দুঃখই হলো গডফ্রের। বিপদের ভয় টাৰ্টলেটের চেয়ে তার কম নয়। কিন্তু ভয় পেয়ে চুপ করে বসে থাকলে তো চলবে না। বিপদ এলে যাতে ঠেকানো যায় তার ব্যবস্থা করা দরকার। গডফ্রে চিন্তা করছে। শুধু যে জঙ্গলের দিক থেকে আক্রমণ আসতে পারে, তা নয়। যে-কোন দিক থেকে আসতে পারে। উইল-ট্রিও ওদের জন্যে নিরাপদ আস্তানা নয়। গডফ্রে সিদ্ধান্ত নিল, আস্তানার দরজাটা আরও মজবুত করতে হবে। পোষা প্রাণীগুলোর ওপরই সম্ভবত প্রথম হামলাটা আসবে। ওগুলোর জন্যেও মজবুত একটা খোঁয়াড় বানাতে হবে।

কিন্তু ভাল একটা খোঁয়াড় বললেই কি বানানো যায়? দেবদারু তলায় ডালপালা পড়ে আছে, সেগুলো কুড়িয়ে কোন রকমে একটা খাঁচামত তৈরি করা হলো, আপাতত এখানেই থাকবে ছাগল আর ভেড়ার পাল। মোরগ-মুরগির ঘর যথেষ্ট মজবুত, শুধু দরজাটা নতুন করে বসানো হলো।

কারেফিনোতুকে নিয়ে একটা সমস্যায় পড়েছে গডফ্রে। ইশারায় বারবার মানা করা সত্ত্বেও আগের মত বাইরে শুচ্ছে সে। এমন কি টানা-হঁচড়া করেও কোন লাভ হলো না। উল্টে সে আকার-ইঙ্গিতে গডফ্রেকে বোঝাতে চেষ্টা করল, ভালুক যদি আসেই, ওদেরকে সময় থাকতে সাবধান করতে পারবে সে। তার প্রাণ বাঁচানো হয়েছে, সেই ঋণ এভাবেই সে শোধ করতে চাইছে।

ভালুক দেখার পর এক হপ্তা কেটে যাচ্ছে, হামলার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। গডফ্রে খুব সাবধান হয়ে গেছে, আস্তানা ছেড়ে দূরে কোথাও যায় না। ছাগল-ভেড়াগুলো ঘাস খেতে এদিক সেদিক যায় বটে, কিন্তু ওগুলোকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখে কারেফিনোতু। রাখালের ভূমিকায় কালো কাফ্রিটাকে মানিয়েছেও বেশ। তার হাতে অবশ্য বন্দুক থাকে না, থাকে ধারাল একটা ভোজালি আর একটা কুড়ুল। গডফ্রেকে সে আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে, এই দুটো অস্ত্র সঙ্গে থাকলে বাঘের সঙ্গেও লড়তে পারবে।

ভালুক বা অন্য কোন হিংস্র জন্তু হামলা না করায় আগের সাহস আবার ফিরে পেয়েছে গডফ্রে। এখন আবার সে আগের মত শিকারে বেরুচ্ছে। তবে খুব বেশি দূরে যায় না, বিশেষ করে টিলাগুলোর নিচের গভীর জঙ্গলটাকে সযত্নে এড়িয়ে চলে। মাঝে মধ্যে কারেফিনোতুকেও সঙ্গে নেয় সে।

তবে টাৰ্টলেটের ভয়-ভীতি এখনও দূর হয়নি। হামলার ভয়ে সারাক্ষণ সন্ত্রস্ত থাকেন তিনি। ভালুকের কথা শোনার পর থেকে দেবদারুর আস্তানা থেকে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বেরুচ্ছেন না। কোটরের ভেতর সশস্ত্র অবস্থায় বসে থাকেন। তবে অলস সময় কাটান না। কারেফিনোতুর কোন কাজ না থাকলে তাকে ইংরেজি শেখাবার চেষ্টা করেন।

কিন্তু অধ্যাপকের অধ্যাপনা কোন কাজেই আসছে না। যতই তিনি চেষ্টা করুন, কারেফিনোতু একটা শব্দও শিখতে পারছে না। এক সময় বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দিতে হলো তাকে। অবশ্য বললেন, তুমি যখন আমার ছাত্র হতে পারলে না, দেখা যাক আমি তোমার ছাত্র হতে পারি কিনা। এসো, আমাকে তোমার ভাষা শেখাও।

শুনে হেসে ফেলল গডফ্রে। বলল, ওর ভাষা শিখে আমাদের কি লাভ?

এখন বোঝা না গেলেও, লাভ একটা নিশ্চয়ই আছে, বললেন টার্টলেট।

শিক্ষকের বক্তব্য মেনে নিয়ে চুপ করে থাকল গডফ্রে!

শুরু হলো ক্লাস। হাতে যে-কোন একটা জিনিস নেন টার্টলেট, ইঙ্গিতে সেটার নাম বলতে বলেন কারেফিনোতুকে। এভাবে চলল তার ভাষা শেখার চেষ্টা। পনেরো দিন পর দেখা গেল পনেরোটা শব্দ শেখা হয়েছে। পলিনেশিয়ান ভাষায় আগুনকে বলে বিরসি, আকাশকে আরাদোরে, সাগরকে মেরভিরা, বৃক্ষকে ডোউরা এরকম সব মিলিয়ে পনেরোটা শব্দ শিখে গর্বে তার মাটিতে পা পড়ে না। নিজের ঢাক নিজেই তিনি পেটাতে লাগলেন। ছাত্র হিসেবে নিশ্চয়ই আমি মেধাবি। কারেফিনোতু যেখানে একটা শব্দও শিখতে পারল না, সেখানে মাত্র পনেরো দিনে আমি কিভাবে পনেরোটা শব্দ শিখলাম?

গডফ্রে বলল, ভাষা শেখাতে পারছেন না তো কি হয়েছে, আপনি ওকে নাচ শেখাচ্ছেন না কেন?

ব্যস, নতুন আরেকটা নেশা পেয়ে বসল টার্টলেটকে। সেই থেকে রোজই তিনি কারেফিনোতুকে নাচের তালিম দিচ্ছেন। কথাটা কৌতুক করে বলেছিল গডফ্রে, ওদের দুজনের কান্ড দেখে এবার হাসতে হাসতে দম বেরিয়ে যাবার অবস্থা হলো তার। নাচতে গিয়ে এমন দাপাদাপি করে কারেফিনোতু, কিছুক্ষণ পরই ঘামে নেয়ে ওঠে, হাঁপাতে শুরু করে হাপরের মত ঘাম ঝরে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ে, লাফালাফি হয়, কিন্তু নাচের একটা মুদ্রাও শেখা হয় না। কারেফিনোতুর উৎসাহ প্রবল, কিন্তু তার কাঁধের হাড় অসম্ভব শক্ত, হাজার চেষ্টা করলেও বুকটা সামনে আনতে পারে না, হাঁটু জোড়াকে ঠিকমত বাঁকা করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু সহজে হাল ছাড়তে রাজি নন টাৰ্টলেট, তারপরও তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

দেখে শেখ রে গন্ডমূর্খ, দেখে শেখ! দাঁতে দাঁত চাপেন টাৰ্টলেট, তারপর নিজেই নেচে দেখান। পা জোড়া সামনে বাড়া, আরও সামনে! পায়ের গোড়ালি কাছাকাছি নিয়ে আয়। ওরে গর্দভ, ওভাবে নয়, ওভাবে নয়- এভাবে! দূর বোকা, দূর আহাম্মক, হাঁটু দুটো আরও ফাঁক করতে পারিস না? মাথা সোজা রাখ, কাঁধ পিছিয়ে নে, কনুই দুটো বাঁকা কর…নাহ্, তুই সত্যি একটা গবেট। তোর দ্বারা আসলেও কিছু হবে না।

গলা ছেড়ে হেসে উঠল গডফ্রে। তারপর বলল, এ আপনার অন্যায় অবদার, স্যার। আপনি ওকে অসম্ভবকে সম্ভব করতে বলছেন!

কেন, অনম্ভব হবে কেন? কারেফিনোতু তো অন্য সব কাজে যথেষ্ট বুদ্ধির পরিচয় দেয়। বুদ্ধিমান লোকের জন্যে কোন কাজই অসম্ভব নয়।

কিন্তু ওর শরীরের গড়নটা লক্ষ করেছেন? লক্ষ্য করেছেন হাড়গুলো কি রকম শক্ত?

অতশত বুঝি না, নাচ ওকে শিখতেই হবে, জেদ ধরলেন প্রফেসর টাৰ্টলেট। আমরা যখন এই দ্বীপ থেকে সভ্য জগতে ফিরব, আমাদের সঙ্গে ও-ও তো যাবে, তাই না? ওকে তো আমরা এখানে ফেলে রেখে যেতে পারব না। ভেবে দেখেছ, তখন কি হবে? ভদ্রলোকদের পার্টিতে ওকে যেতে হবে না? নাচ না জানলে লোকে হাসবে যে! বলবে, এ আবার কি অসভ্যতা!

সভ্য জগতে যাওয়া, ভদ্রলোকদের পার্টিতে অংশগ্রহণ, এ-সব ওর কপালে আছে বলে মনে হয় না, মন্তব্য করল গডফ্রে।

কি বললে? ওর ভাগ্যে কি আছে না আছে তুমি তা কিভাবে বলো? রেগে গেলেন প্রফেসর। তুমি কি ভবিষ্যৎ দেখতে পাও?

টার্টলেটের সঙ্গে কোন আলোচনা সুষ্ঠুভাবে করা যায় না। চূড়ান্ত একটা মন্তব্য করে সব আলোচনাই থামিয়ে দেন তিনি। তাঁর কথার ওপর আর কেউ যাতে কথা বলতে না পারে, আলোচনার মাঝখানে হঠাৎ পকেট-বেহালা বের করে বাজাতে শুরু করে দেন। কারেফিনোতু তো বুঝতেই পারে না কি নিয়ে তর্ক হচ্ছে, সে বেহালার টু-টাং শুনে চিংড়ি মাছের মত তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে শুরু করল। এই লম্ফঝম্পকেই সে না বলে জানে। পলিনেশিয়ান নাচ আর কি!

ভালুকটার কথা ওরা কেউ ভোলেনি। এ নিয়ে প্রায় রোজই আলোচনা হচ্ছে। কোন হামলা হয়নি দেখে টাৰ্টলেটও ইদানীং সাহস ফিরে পেয়েছেন। তার ধারণা, গডফ্রে কোন ভালুক দেখেনি।

কিন্তু আমি তো একা নই, কারেফিনোতুও দেখেছে, বলল গডফ্রে। ভালুকটা রীতিমত ধাওয়া শুরু করেছিল আমাদের। নাহ্, ভুল দেখার কোন প্রশ্নই ওঠে না। ভুল দেখলে গুলি করলাম কাকে?

ধরে নিলাম ওটা ভালুকই ছিল, এবং সেটাকে তুমি গুলি করে মেরেও ফেলেছ, বললেন টার্টলেট। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থাকে। এই দ্বীপে ভালুক যদি থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই একটা নেই। প্রশ্ন হলো, বাকি ভালুককে আমরা দেখতে পাচ্ছি না কেন? ভালুক থাকলে অন্য আরও হিংস্র জন্তুও থাকবে। সেগুলোই বা কোথায়?

গডফ্রে স্বীকার করল, গোটা ব্যাপারটা তার কাছেও মস্ত একটা ধাঁধার মত লাগছে।

ধাঁধাটা আরও জটিল হয়ে উঠল পরদিন। এতদিনে সাহস করে সেই জঙ্গলের দিকে ঘুরতে গেল গডফ্রে। ভালুকটাকে যেখানে ওরা দেখেছিল সেখানে কিছুই নেই। অনেক খুঁজেও লাশটা পাওয়া গেল না। এমন অবশ্য হতে পারে যে যেখানে গুলি খেয়েছে সেখানে ভালুকটা মরেনি। আহত অবস্থায় অন্য কোন দিকে চলে গেছে, তারপর মারাও যেতে পারে, আবার সুস্থ হয়েও উঠতে পারে।

কিন্তু গুলি তো লেগেছিল, তাই না? তাহলে গাছতলায় রক্তের দাগ নেই কেন? নাহ, এই রহস্যের কোন কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না।

নভেম্বর মাসে শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। এই দ্বীপ কোন দ্রাঘিমায় তা ওদের জানা নেই, কাজেই এই বৃষ্টি বর্ষার সূচনা কিনা বলা সম্ভব নয়। একবার শুরু হবার পর থামাথামির নাম নেই, ঝম ঝম করে ঝরছে তো ঝরছেই। এই বৃষ্টির মধ্যেই হয়তো শীত চলে আসবে। শীতের মধ্যে এভাবে বৃষ্টি পড়তে থাকলে বেঁচে থাকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠবে। গডফ্রে সিদ্ধান্ত নিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের আস্তানার ভেতর একটা ফায়ারপ্লেস তৈরি করা দরকার। ফায়ারপ্লেস থাকলে হাত-পা গরম করা যাবে, বৃষ্টির দিনে রান্না করাও যাবে। কিন্তু ধোঁয়া বের করার কি উপায়?

লম্বা একটা বাঁশ কেটে নল তৈরি করা যায়, গিঁটগুলো চেঁছে নিলেই হবে। গডফ্রে ভাবল, এ-ব্যাপারে কারেফিনোতু হয়তো তাকে সাহায্য করতে পারে। আকার-ইঙ্গিতে অনেকক্ষণ ধরে বোঝানো হলো তাকে ঠিক কি চাইছে গডফ্রে। বুঝতে সময় নিল সে, কিন্তু একবার বোঝার পর কাজটা করে দিল খুব দ্রুত-বাঁশের ভেতর দিকের গিটগুলো নিখুঁতভাবে চেঁছে বের করে ফেলল। আগুন জালার পর দেখা গেল সমস্ত ধোঁয়া সদ্য তৈরি চিমনি দিয়ে কোটরের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। তবে খেয়াল রাখতে হলো বাঁশে যাতে আগুন ধরে না যায়।

বুদ্ধি করে চিমনিটা তৈরি করেছিল বলে রক্ষা, তা না হলে সাংঘাতিক ভুগতে হত ওদেরকে। নভেম্বরের তিন থেকে দশ তারিখ পর্যন্ত কোন বিরতি ছাড়াই ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ল। এই কদিন বাইরে আগুন জ্বালা সম্ভব ছিল না। উইল-ট্রির ভেতর থেকে একবারও কেউ বেরুল না ওরা। ভেতরে আগুন জ্বলছে, কাজেই রান্নাবান্নার কাজে কোন সমস্যা হলো না। ঠান্ডাও ঠেকিয়ে রাখা গেছে। তবে অন্য একটা সমস্যা হলো-যব থেকে আটা বানিয়ে রেখেছিল ওরা, তাতে টান পড়ে গেল। অতিরিক্ত যবও ছিল না যে আটা বানিয়ে নেবে। দশ তারিখে গডফ্রে জানাল, বৃষ্টি একটু কমলেই কারেফিনোতুকে নিয়ে বেরুবে সে, খেত থেকে বেশি করে যৰ নিয়ে আসবে।

সেদিন সন্ধের খানিক আগে পশ্চিমা বাতাস আকাশের সমস্ত মেঘকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল। এক সময় সূর্যকেও দেখা গেল কয়েক মুহূর্তের জন্যে।

রাতে আকাশ ভরা তারা উঠল। খাওয়াদাওয়া শেষ হতে কারেফিনোতু জানাল, আজ থেকে আবার আস্তানার বাইরে শোবে সে। গডফ্রে আপত্তি করল, বলল, বুনো জানোয়ারকে নাহয় সে ভয় করে না, কিন্তু ভেজা মাটিতে শুলে যে তার ঠান্ডা লেগে জ্বর আসবে! কিন্তু কারেফিনোতুর একই জেদ, বাইরেই শোবে সে, কারণ উইল-ট্রির ভেতর শুলে তার ঘুম আসতে চায় না। অগত্যা রাজি হতে হলে গডফ্রেকে।

পরদিন সকালে সূর্য উঠল। দিনটা সোনালি আলোয় ঝলমল করছে। দুটো থলে নিয়ে গডফ্রে আর কারেফিনোতু যব খেতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বেরুবার সময় প্রফেসর টাৰ্টলেটকেও সঙ্গে নিতে চাইল গডফ্রে, তিনজন গেলে বেশি করে যব আনা যাবে। কিন্তু কাদায় পা ডোবাতে রাজি হলেন না তিনি।

নদীর তীর ধরে ওরা দুজন যব খেতে পৌঁছাল। দ্রুত হাতে কাজ শুরু করলেও, থলে দুটো ভরতে তিন-চার ঘণ্টা লেগে গেল ওদের। এগারোটার দিকে থলে দুটো কাঁধে ফেলে ফেরার জন্যে রওনা দিল ওরা। দুজনেই খুব সাবধান, চারপাশে নজর রেখে হাঁটছে পরস্পরের ভাষা বোঝে না, তাতে একটা সুবিধে হলো–কথা না হওয়ায় চারপাশে অখন্ড মনোযোগ দিতে পারছে।

নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানটায় গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কটা গাছ। হঠাৎ সেদিকে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল গডফ্রে। আতঙ্কে নীল হয়ে গেল তার মুখ। হাত তুলে এবার সে-ই গাছতলাটা দেখাল। মাংসখেকো এক ভয়ঙ্কর জন্তু! চোখগুলো আগুনের মত জ্বলছে।

বাঘ! বাঘ! চিৎকার দিল গডফ্রে, মনে নেই তার ভাষা কারেফিনোতু বোঝে না।

ব্যাপারটা দৃষ্টিভ্রম নয়। সত্যি ওটা মস্ত একটা বাঘ। পিছনের দুপায়ে ভর দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে একেবারে তৈরি হয়ে আছে।

গডফ্রের কাঁধ থেকে খসে পড়ল ভারী থলে, আরেক কাঁধের বন্দুক চলে এল হাতে। লক্ষ্যস্থির করতে যেটুকু সময় লাগল, ট্রিগার টানতে এক সেকেন্ডও দেরি করল না।

এবার কোন সন্দেহ নেই, এক গুলিতেই পাক খেয়ে ছিটকে পড়ল বনের রাজা। পড়ল ঠিকই, কিন্তু মারা গেল কিনা বলা মুশকিল। আহত বাঘ সাক্ষাৎ আজরাইল। নাগালের মধ্যে পেলে। একেবারে ফেড়ে ফেলবে। আবার গুলি করার জন্যে বন্দুক তুলল গডফ্রে। কিন্তু চোখের নিমেষে ঘটে গেল আরেক ঘটনা। গড়ফ্রে আঁতকে উঠে বাধা দেয়া সত্ত্বেও কারেফিনোতু তার কথায় কান দিল না, খাপ খোলা ভোজালি হাতে বাঘের দিকে ছুটে গেল সে চিৎকার করে তাকে ফিরে আসতে বলছে গডফ্রে। শুনেও না শোনার ভান করছে কারেফিনোতু। উপায় না দেখে তাকে ধরার জন্যে গডফ্রেও এবার বাঘের দিকে ছুটল।

নদীর বাঁকে পৌছে গডফ্রে দেখল বাঘটার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে কারেফিনোতু। চোখে দেখেও গডফ্রের বিশ্বাস হতে চাইল না–এক হাতে বাঘের গলা পেঁচিয়ে ধরেছে সে, অপর হাতের ভোজালিটা হাতল পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিল ওটার বুকে। তারপর পিছিয়ে এল কারেফিনোতু। ঢাল থেকে গড়িয়ে নদীতে পড়ে গেল বাঘ। পানিতে ভীষণ স্রোত, পাক খেতে খেতে ছুটছে। সেই পানির ঘূর্ণিতে পড়ে ডুবে গেল জন্তুটা, স্রোতের টানে ভেসে গেল সাগরের দিকে।

প্রথমে ভালুক দেখল ওরা, আজ আবার বাঘ! আশ্চর্যই বলতে হবে যে হঠাৎ ফিনা আইল্যান্ডে এক এক করে হিংস্র জন্তুদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। কি যেন গভীর রহস্য আছে এ-সবের মধ্যে, কিন্তু সেটা যে কি ঠাহর করা যাচ্ছে না। যা কিছু ঘটছে, স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে মন চাইছে না গডফ্রের। দ্বীপটা যে নিরাপদ নয়, এখন আর তাতে কোন সন্দেহ নেই।

কাছে এসে গডফ্রে দেখল, বাঘের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে আহত হয়েছে কারেফিনোতু। কালো কুচকুচে কাফ্রির শরীরের বেশ কয়েক জায়গায় রক্তভরা আঁচড়ের দাগ।

গডফ্রে খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। ফেরার সময় কারেফিনোতুকে কিছু বলল না সে। কারেফিনোতুর আচরণও যে অত্যন্ত রহস্যময়, এটা সে বুঝতে পারছে। বারণ করা সত্ত্বেও একটা বাঘের সঙ্গে কেন সে লড়তে গেল? ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, বাঘটাকে সে এতটুকু ভয় পাচ্ছে না। ব্যাপারটা কি?

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত