স্কুল ফর রবিনসন্স: ০৯. তাড়াতাড়ি ঝুঁকে লোকটাকে টেনে

স্কুল ফর রবিনসন্স: ০৯. তাড়াতাড়ি ঝুঁকে লোকটাকে টেনে

০৯. তাড়াতাড়ি ঝুঁকে লোকটাকে টেনে

তাড়াতাড়ি ঝুঁকে লোকটাকে টেনে দাঁড় করাল গডফ্রে। বিড়বিড় করে বলল, কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্যে ধন্যবাদ বলাই যথেষ্ট, পায়ে মাথা ঠেকাবার কোন দরকার নেই। তার কথা জংলী বুঝতে পেরেছে বলে মনে হলো না, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল শুধু।

লোকটার বয়স হবে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। পরনে শুধুই একটা কৌপীন বা নেংটি। চেহারা-সুরত আর মাথার আকৃতি দেখে গডফ্রের মনে হলো লোকটা পলিনেশিয়ান নয়, সম্ভবত আফ্রিকান। রঙটাও তার কুচকুচে কালো। হয়তো সুদান বা আবিসিনিয়ার লোক। কাফ্রি হবারই বেশি সম্ভাবনা। এ লোক জংলীদের হাতে বন্দী হলো কিভাবে সেটা একটা রহস্যই বটে। | জংলী যখন নয়, ইংরেজি বা অন্য কোন ইউরোপিয় ভাষার দুচারটে শব্দ হয়তো জানে লোকটা। কিন্তু যখন সে কথা বলল, একটা বর্ণও বুঝতে পারল না ওরা। প্রফেসর টাৰ্টলেট সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন, লোকটা হয়তো জংলীদের ভাষাতেই কথা বলছে।

ইংরেজিতে তাকে কয়েকটা প্রশ্ন করল গডফ্রে। বোকার মত চুপ করে তাকিয়ে থাকল কাফ্রি লোকটা, গডফ্রের কথা বুঝতেই পারছে না। গডফ্রে তখন আকার-ইঙ্গিতে তার নাম জানতে চাইল।

লোকটা এবার মুখ খুলল, কারেফিনোতু। এই একটাই শব্দ উচ্চারণ করল সে।

ওর নাম কারেফিনোতু! হেসে উঠে বললেন প্রফেসর। বড় খটমটে নাম, গডফ্রে। উচ্চারণ করতে কষ্ট হবে। আমি বলি কি, এসো, আমরা ওকে বুধবার বলে ডাকি।

গডফ্রে প্রতিবাদ জানাল। বুধবার একটা নাম হলো নাকি!

কিন্তু নামটার তাৎপর্য তুমি অস্বীকার করতে পারো না, যুক্তি দেখালেন টার্টলেট। রবিনসন ক্রুসোর ঐতিহ্য অনুসরণ করলে এই নামটাই রাখতে হয়। ওকে আমরা উদ্ধার করলাম আজ-বুধবারে। ক্রুসো ফ্রাইডেকে পেয়েছিলেন কি বারে? শুক্রবারে। সেজন্যেই তার নাম ফ্রাইডে রাখা হয়েছিল। এখন তুমিই বলো, ওকে কেন আমরা কারেফিনোতু বলে ডাকব?

যার যে নাম তাকে সেই নামেই ডাকা উচিত, বলল গডফ্রে। তা না হলে তাকে অপমান করা হয়। ধরুন আপনার জন্ম হয়েছিল সোমবার। এখন কেউ যদি সে-কথা মনে রেখে আপনাকে মানডে বলে ডাকে, আপনার কেমন লাগবে? জবাবের অপেক্ষায় না থেকে কারেফিনোতুর দিকে তাকাল সে। নিজের বুকে একটা আঙুল রেখে বলল, গডফ্রে।

কারেফিনোত অনেকবার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনমতেই গডফ্রে শব্দটা উচ্চারণ করতে পারল না। তার চেহারায় হতাশ একটা ভাব ফুটে উঠল। এক সময় হঠাৎ প্রফেসরের দিকে তাকাল সে, যেন তার নাম জানতে চাইছে।

আমি টার্টলেট, মিষ্টি গলায় নিজের নাম বললেন প্রফেসর!

টাৰ্টলেট! প্রফেসরের নামটা অনায়াসে উচ্চারণ করতে পারল কারেফিনোতু।

কারেফিনোতুর সাফল্যে এক দফা নেচে নিলেন টার্টলেট।

গডফ্রে ইঙ্গিতে দ্বীপটা দেখাল, যেন কারেফিনোতুর কাছে এই দ্বীপের নাম জানতে চাইছে। কারেফিনোতু প্রথমে তার প্রশ্নটা ধরতে পারল না। গডফ্রে ইঙ্গিতে দ্বীপের বন-জঙ্গল, ঘাসজমি, নদী, টিলা-পাহাড়, সৈকত ইত্যাদি আবার দেখাল। তার ভাবভঙ্গি অনুকরণ করল কারেফিনোতু। অবশেষে বলল, আরনেকা! আরনেকা!

মাটিতে আঙুল তাক করে গডফ্রে জিজ্ঞেস করল, আরনেকা?

মাথা ঝাঁকিয়ে কাফ্রি লোকটা জবাব দিল, আরনেকা!।

দ্বীপটার শুধু নাম জেনে গডফ্রের কোন উপকার হলো না। যদি জানতে পারত প্রশান্ত মহাসাগরের ঠিক কোথায় এই দ্বীপ, তাহলে একটা কাজের কাজ হত। আরনেকা নামটাও হয়তো জংলীদের দেয়া। দ্বীপটার ভৌগোলিক নাম নিশ্চয়ই অন্য কিছু হবে।

কারেফিনোতু পালা করে একবার গডফ্রে আর একবার অস্ত্রগুলোর দিকে তাকাচ্ছে। তার এই দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারল গডফ্রে। কারেফিনোতু বন্দুক আর রিভলভার এই প্রথম দেখছে। অস্ত্রগুলোর দিকে একটু ভয়ে ভয়েই তাকাচ্ছে সে। তার অবশ্য কারণও আছে। সে দেখেছে এগুলো থেকে আগুন ঝরে, শব্দ হয় বজ্রপাতের মত। সেই আগুন আর বজ্ৰই তো তাকে মুক্ত হতে সাহায্য করেছে!

বন্দুকের যে কি ক্ষমতা, সেটা দেখাবার জন্যে উড়ন্ত একটা বালিহাঁসকে গুলি করল গডফ্রে। আকাশের অনেকটা ওপরেই ছিল সেটা, কিন্তু গুলির শব্দ হওয়ামাত্র কাতর আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে গেল, গায়ে রক্ত লেগে রয়েছে।

গুলির আওয়াজ শুনে অকস্মাৎ বিরাট একটা লাফ দিল কারেফিনোতু। ভয় পেয়েছে সে, কিন্তু সে ভয় মুহূর্তে কাটিয়ে উঠল যখন দেখল আহত বালিহাঁস ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটছে। সেটাকে ধাওয়া করল কারেফিনোতু। ধরে গডফ্রের কাছে নিয়ে এল, মুখে দুকান বিস্তৃত হাসি।

হঠাৎ কৃতিত্ব দেখাবার একটা লোভ হলো প্রফেসর টার্টলেটের। ঈশ্বর তাদেরকে বজ্ৰ সৃষ্টি করার ক্ষমতা দিয়েছেন, এটা প্রমাণ করতে পারলে কারেফিনোতুর শ্রদ্ধা অর্জন করা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ, হাতের বন্দুকটা তুললেন তিনি। নদীর ধারের একটা গাছে বসে আছে নিরীহ মাছ রাঙা, সেটাকে ফেলার জন্যেই লক্ষ্যস্থির করছেন।

গডফ্রে বলে উঠল, না, স্যার, গুলি করবেন না!

টার্টলেট বিস্মিত হলেন। কেন?

বলা তো যায় না, ধরুন আপনার লক্ষ্য ব্যর্থ হলো, গুলি না লাগায় মাছরাঙাটা উড়ে গেল। তখন কি হবে?

কি হবে তখন?

ওর কাছে আমরা ছোট হয়ে যাব না?

কিন্তু আমার লক্ষ্য ব্যর্থই বা হবে কেন? যুদ্ধটা যখন শুরু হলো, জীবনে প্রথম গুলি করে আমি একজন জংলীকে আহত করিনি?

হ্যাঁ, করেছেন। লোকটা তো দড়াম করে পড়েই গেল। তবু আমার অনুরোধটা রাখুন, স্যার। সাবধানের মার নেই। শুধু শুধু ভাগ্যকে খেপিয়ে দেবেন না।

টাৰ্টলেট খুশি হতে পারলেন না, তবে আর কোন কথা না বলে নামিয়ে নিলেন বন্দুকটা। কারেফিনোতুকে নিয়ে উইল-ট্রির কাছে ফিরে এল ওরা।

দেখা গেল লোকটা শিশুর মত সরল আর অজ্ঞ। যা দেখে তাতেই সে অবাক হয়। ফিনা আইল্যান্ডে ওদের এই মেহমান সবচেয়ে বেশি অবাক হলো দেবদারু গাছের ভেতরে ওদের রাজকীয় বাসস্থান দেখে। গাছটাকে ঘিরে বার কয়েক চক্কর দিল সে, ভেতরে ঢুকে চারদিকে চোখ বোলাল, দরজাটা বারবার খুলল আর বন্ধ করল, ওপর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কোটরটার ছাদ বলে কিছু আছে কিনা।

তারপর ওদের সমস্ত যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য জিনিসপত্রের দিকে আঙুল তুলে বিচিত্র শব্দ করতে লাগল সে। অর্থাৎ জানতে চাইছে এগুলো কি, কি কাজে ব্যবহার করা হয়। গডফ্রে তাকে প্রতিটি জিনিসের ব্যবহার পদ্ধতি দেখিয়ে দিল। টার্টলেট বললেন, আমাদের সম্মানীয় মেহমান সভ্য মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করেনি।

তাঁর সঙ্গে একমত হলো গডফ্রে। কারণ দেখা গেল কারেফিনোতু এমন কি আগুনের ব্যবহারও ঠিকমত জানে না। গনগনে আগুনের ওপর লোহার কড়াই চাপানো হয়েছে, অথচ সেটায় আগুন ধরছে না, এটা দেখে বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠল তার চোখ। তারপর আয়নায় নিজের চেহারা দেখে জ্ঞান হারাবার অবস্থা হলো তার। সংবিৎ ফিরতে আয়নার পিছনে উঁকি দিল, দেখে নিল সেখানে কেউ লুকিয়ে আছে কিনা।

তার কান্ড দেখে টাৰ্টলেট আবার মন্তব্য করলেন, এ ঠিক মানুষ নয়। বন মানুষ।

স্যার, আপনার ধারণা ভুল, প্রতিবাদ করল গডফ্রে। বন মানুষের বুদ্ধি থাকে না। আয়নার পিছনে উঁকি মারায় প্রমাণ হলো, কারেফিনোতুর মাথায় বুদ্ধি আছে। ও সব কিছু যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে।

ঠিক আছে, মানলাম, লোকটা বনমানুষ নয়, গডফ্রের কথা মেনে নিয়ে বললেন টার্টলেট। কিন্তু ও কি আমাদের কোন কাজে আসবে?

অনেক কাজেই আসবে, স্যার, জোর দিয়ে বলল গডফ্রে।

কি কাজে আসতে পারে তার একটা নমুনা একটু পরই পাওয়া গেল। তার সামনে প্লেট ভর্তি নাস্তা ধরা হলো। এই একটা জিনিস দেখে মোটেও সে অবাক হলো না। প্লেটের ওপর এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল, ওটা যেন পালিয়ে যাবে বা তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হবে। ওদেরকে অবাক করে দিয়ে প্রায় চোখের পলকে প্লেট খালি করে ফেলল সে। বোঝা গেল খিদেতে তার পেটে আগুন জ্বলছিল।

এত দ্রুত খায়! অসন্তোষ প্রকাশ করলেন টার্টলেট। তারপর বললেন, ওর খাবার ভঙ্গিটা আমার ভাল লাগল না, গডফ্রে। সাবধান, হে, সাবধান! চোখ-কান খোলা রেখো। আমার সন্দেহ হচ্ছে।

কি সন্দেহ হচ্ছে? প্রায় চ্যালেঞ্জের সুরে জিজ্ঞেস করল গডফ্রে।

সন্দেহ হচ্ছে, লোকটা সম্ভবত মানুষখেকো।

হাসি পেল গডফ্রের। রসিকতা করে বলল, সে অভ্যাস যদি থেকেই থাকে, এখন ওকে তা ছাড়তে হবে।

ছাড়া কি এতই সহজ? লোকে বলে একবার যে মানুষের মাংস খেয়েছে, আবার খাবার জন্যে পাগল হয়ে থকে সে।

ওরা যখন যে-কথাই বলুক, কারেফিননাতুর চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। ভাষা না বুঝলেও, বক্তব্য বোধহয় আন্দাজ করে নিতে পারে সে। তা না হলে ওরা কথা বললেই সে-ও কেন হড়বড় করে কিছু বলার চেষ্টা করবে? কিন্তু ওরা তার কথার একটা বর্ণও বুঝতে পারে না।

কারেফিনোত শিশুর মত সরল হলেও, বোকা নয়। একবার কিছু শিখিয়ে দিলে আর ভোলে না। শেখেও খুব দ্রুত, মাত্র একবার দেখিয়ে দিলেই নিজে করতে পারে। গডফ্রে তাকে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গেই এক এক করে অনেক কাজ শিখিয়ে নিচ্ছে। পোষা প্রাণীগুলোর যত্ন নেয়া, ঝিনুক আর পাখির ডিম সংগ্রহ করে আনা, ফল পাড়া, ছাগল বা ভেড়ার মাংস কেটে টুকরো করা, বুনো আপেল নিঙড়ে রস বের করা।

টার্টলেট তাকে বিশ্বাস করতে রাজি নন, সব সময় সন্দেহের চোখে দেখছেন। কিন্তু গডফ্রে তাকে অবিশ্বাস করে না। লোকটাকে জংলীদের হাত থেকে বাঁচাতে পেরে নিজের ওপর ভারি খুশি সে।

গডফ্রের দুশ্চিন্তা কারেফিনোতুকে নিয়ে নয়, জংলীদের নিয়ে। ফিনা আইল্যান্ড চিনে গেছে তারা, জানে এখানে ওরা আছে, দল বড় করে আবার যদি তারা আসে, হামলা করে বসে?

গডফ্রে শুরু থেকেই উইল-ট্রির ভেতর মেহমানের শোয়ার ব্যবস্থা করেছে। তবে শুধু বৃষ্টি হলে গাছের ভেতর শোয় কারেফিনোতু। বৃষ্টি না হলে দরজার বাইরে রাত কাটায়। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে সে, যেন উইল-ট্রিকে পাহারা দেয়।

কারেফিনোতু দ্বীপে এসেছে আজ দুহপ্তা। এরইমধ্যে বেশ কয়েকবার গডফ্রের সঙ্গে শিকারে বেরিয়েছে সে। বন্দুক থেকে গুড়ম করে আওয়াজ হলেই অনেক দূরের জন্তুগুলো আহত হয়ে ছিটকে পড়ছে, এটা দেখে তার বিস্ময় বাঁধ মানে না। তবে ধীরে ধীরে সে নিজেও বন্দুক চালানো শিখে ফেলল।

দ্রুত সব কিছু শিখে ফেলার গুণেই গডফ্রের খুব প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল কারেফিনোতু। তবে একটা কাজে সে, একদমই সুবিধে করতে পারছে না। ইংরেজি ভাষার একটা শব্দও ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারে না সে। গডফ্রে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে, কিন্তু ফলাফল শূন্য।

এরমধ্যে একদিন সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে কাছিমের একটা আস্তানা আবিষ্কার করল কারেফিনোতু। গডফ্রে লক্ষ্য করল, ধাওয়া করে কাছিমগুলোকে চোখের পলকে চিৎ করে ফেলে সে। সেদিন অনেকগুলো কাছিম শিকার করল ওরা, শীতকালে রান্না করে খাওয়া যাবে। শীত আসতে আর খুব বেশি দেরিও নেই। অক্টোবরের মাত্র শুরু, এরইমধ্যে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া।

কাছিম শিকারের পর দ্বীপে ওদের জীবনযাত্রা আবার একঘেয়ে হয়ে পড়ল। রুটিন ধরে কিছু কাজ রোজই ওদেরকে করতে হয়। শীত শুরু হলে উইল-ট্রির মধ্যেই বন্দী থাকতে হবে সারাদিন, তখন যে সময়টা কি রকম বৈচিত্র্যহীন কাটবে, ভাবলেই গডফ্রের মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তবে মন খারাপ বলে জরুরী কাজগুলো অবহেলা করে না সে। রোজই সে দ্বীপটায় একটা চক্কর দিয়ে আসে। একেক দিন একেক দিকে যায়। শিকারেও প্রায় নিয়মিত বেরুচ্ছে। আজকাল সাধারণত কারেফিনোতুই তার সঙ্গে যায়। শিকারি হিসেবে দক্ষ নন, কাজেই টার্টলেট নিজেই যেতে চান না। তবে জীবনের প্রথম গুলিটা যে জাদু দেখিয়ে দিয়েছিল, এটা তিনি মাঝে মধ্যেই গডফ্রেকে স্মরণ করিয়ে দেন।

এই রকম একদিন শিকারে বেরিয়েছে ওরা। সেখানে এমন একটা ঘটনা ঘটল, উইল-ট্রির অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি পড়ে গেল।

দ্বীপের ঠিক মাঝখানে, টিলাগুলোর নিচে, হরিণ শিকার করতে এসেছে ওরা। এদিকের জঙ্গল খুব গভীর, সবটা এখনও গডফ্রের দেখা হয়নি। সকালে জঙ্গলে ঢুকেছে ওরা, সেই থেকে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘোরাফেরা করে মাত্র দুতিনটে হরিণকে ছুটে পালিয়ে যেতে দেখল। অনেকটা দূরে ছিল ওগুলো, ফলে গুলি করলে কোন লাভ হত না। তাছাড়া, খালি হাতে ফিরবে না, এরকম কোন প্রতিজ্ঞা বা জেদ নিয়ে আসেনি গডফ্রে। উইল-ট্রিতে বর্তমানে খাবারের কোন অভাব নেই। শিকারে বেরিয়েও মাঝে মধ্যে খালি হাতে ফিরতে তার খারাপ লাগে না।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। ইতিমধ্যে এক জায়গায় বসে খেয়ে নিয়েছে ওরা। খাবার পর আরও কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করল, কিন্তু মনের মত কোন শিকার চোখে পড়ল না। আস্তানায় ফেরার জন্যে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে এবার। আর ঠিক তখনই হঠাৎ আঁতকে ওঠার আওয়াজ করল কারেফিনোতু।

প্রকান্ড এক লাফ দিল সে, উড়ে এসে পড়ল সরাসরি একেবারে গডফ্রের ঘাড়ের ওপর। তার আঁতকে ওঠার শব্দে ছুটতে শুরু করেছিল গডফ্রে। দেখা গেল কারেফিনোতু তার কাঁধে সওয়ার হয়ে রয়েছে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে বিশ গজের মত ছুটে এল গডফ্রে, তারপর কাঁধের বোঝা সহ মাটিতে পড়ে গেল।

দুজন প্রায় একসঙ্গে সিধে হলো আবার। কারেফিনোতুর দিকে তাকাল গডফ্রে, চোখের দৃষ্টিতে একাধারে তিরস্কার ও প্রশ্ন। মুখে কিছু না বলে হাত তুলে কিছু একটা দেখাল কারেফিনোতু।

তার হাত অনুসরণ করে তাকাল গডফ্রে। তাকাতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল।

প্রকান্ড এক ভালুক! ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে এসে ওদের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে হিংস্র জানোয়ারটা, আর ঘন ঘন মাথা নাড়ছে। ওদের সঙ্গে এখন যদি প্রফেসর টাৰ্টলেট থাকতেন, তিনি হয়তো বেহালা বাজিয়ে ভালুকটাকে শান্ত করার বুদ্ধি দিতেন। কিন্তু গডফ্রের মাথায় কোন বুদ্ধিই এল না। ভয়ে দিশেহারা বোধ করছে সে। ভঙ্গি দেখে মনে হলো, ভালুকটা ওদেরকে তাড়া করবে।

জন্তুটার দিকে পিছন ফিরতে সাহস পাচ্ছে না গডফ্রে, তাই পিছু হটতে শুরু করল সে। ইঙ্গিতে কারেফিনোতুকেও তাই করতে বলছে। কিন্তু ঘটনাটা ঘটলই, ঠেকানো গেল না। ওদেরকে নড়তে দেখেই তেড়ে এল অতিকায় ভালুকটা।

নিজের জান বাঁচানোর চেয়ে উইল-ট্রির নিরাপত্তার কথাই বেশি ভাবছে গডফ্রে। ভালুকটা যদি তাদের পিছু নিয়ে আস্তানাটা দেখে ফেলে, সব ভেঙেচুরে একাকার করে ফেলবে। একবার সে ভাবল, অন্য কোন দিকে ছুটলে কেমন হয়, ভালুকটা তাতে উইলট্রি দেখতে পাবে না। কিন্তু ধারণাটা তখুনি বাতিল করে দিল সে। ওটার সঙ্গে দৌড়ে পারা যাবে না, একটু পরই ওদেরকে ধরে ফেলবে। আর একবার নাগাল পেলে বাঁচার কোন উপায় নেই।

ভালুক ছুটে আসছে। গডফ্রে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে। সে যেন একটা পাঁচিল, কোন অবস্থাতেই ভালুকটাকে উইল-ট্রির দিকে যেতে দিতে রাজি নয়। আতঙ্কিত কারেফিনোতুও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয় গডফ্রেকে ফেলে পালাতে মন চাইছে না তার, নয়তো নড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ইতিমধ্যে অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে এসেছে ভালুকটা। এই সময় নড়ে উঠল গডফ্রে। বন্দুক তুলেই গুলি করল সে।

গুলিটা লেগেছে কিনা, লাগলে কোথায় লেগেছে, কিছুই ওরা বলতে পারবে না। শুধু দেখল, ভালুকটা হঠাৎ পড়ে গেল। ওই দেখা পর্যন্তই, তারপর আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায়নি গডফ্রে, ঘুরেই ছুটতে শুরু করেছে। ভালুকটা মরল কিনা কে জানে। পরীক্ষা করে দেখবে, সে সাহস তার নেই। ভালুক শুধু হিংস্র জন্তুই নয়, অসম্ভব চালাকও। কে বলবে আহত হবার ভান করে পড়ে আছে কিনা! কাছে যাবার মত বোকামি করতে রাজি নয় গডফ্রে।

গডফ্রের দেখাদেখি কারেফিনোতুও ছুটছে। একটু পর দেখা গেল গডফ্রের একটা হাত শক্ত করে ধরে আছে সে। খানিকক্ষণ ছোটার পর পিছন ফিরে একবার তাকাল গডফ্রে। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। না, ভালুকটা ওদের পিছু নিয়ে আসছে না।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত