স্কুল ফর রবিনসন্স: ০৭. ছাত্র ও শিক্ষক প্রতিজ্ঞা করল

স্কুল ফর রবিনসন্স: ০৭. ছাত্র ও শিক্ষক প্রতিজ্ঞা করল

০৭. ছাত্র ও শিক্ষক প্রতিজ্ঞা করল

ছাত্র ও শিক্ষক প্রতিজ্ঞা করল, প্রকৃতির দান হিসেবে আগুন যখন পাওয়া গেছে, এটাকে কোনভাবেই নিভতে দেয়া যাবে না। কিন্তু কাঠ আর শুকনো পাতা যতক্ষণ যোগান দেয়া যাবে ততক্ষণই জ্বলবে ওটা, তারপর নিভে যাবে। সারা রাত জেগে কি এই কাজ করা সম্ভব? টার্টলেট বললেন, অবশ্যই সম্ভব। তুমি ঘুমাও, আমি আগুনটাকে জিইয়ে রাখব। শুধু যে মুখে বললেন তা নয়, কাজটা করেও দেখালেন। আগুনের শিখার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রাতটা কাটিয়ে দিলেন তিনি। একা নন, গডফ্রেও তাঁর সঙ্গে জেগে থাকল। টার্টলেট মনের আনন্দে অনেক কথাই বলে গেলেন, তার মধ্যে দুএকটা কথা রীতিমত হাসির বোমা। এই যেমন একবার তিনি আগুনের শিখার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন, গডফ্রে, ওরা দেখছি আমার চেয়েও ভাল নাচে!

আপনার চেয়ে ভাল নাচে? কারা? গডফ্রে অবাক।

দেখছ না কেমন কোমর দোলাচ্ছে, ঠ্যাং বাঁকাছে, হাত নাড়ছে, মাঝে মধ্যে তড়াক করে লাফও দিচ্ছে। ভাল করে লক্ষ্য করো, গডফ্রে। দেখে শেখো। ওরাই তোমার উপযুক্ত শিক্ষক হতে পারে।

আপনি কাদের কথা বলছেন? গডফ্রে হতভম্ব। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

আগুনের শিখা, গডফ্রে! আগুনের শিখা! এত সুন্দর নাচ আমি আগে কখনও দেখিনি!

হেসে উঠে আগুনটার আরও কাছে সরে এল গডফ্রে, গা গরম করার ইচ্ছে। তবে গা গরম করার চেয়েও জরুরী কাজে আগুনটাকে ব্যবহার করল ওরা। সকাল হতেই রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে উঠল দুজন।

ডিম সেদ্ধ করা হলো। খেতে গিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেললেন টার্টলেট। শুধু ডিমে কিন্তু আমার রসনা তৃপ্তি হবে না। দুচারটে মুরগি রোস্ট করার ব্যবস্থা করো, গডফ্রে। ভেড়ার একটা ঠ্যাংও চাই। আর চাই ছাগলের সের পাঁচেক মাংস। তুমি বললে কয়েকটা পাখি আর কিছু মাছও ধরে আনি।

রয়েসয়ে, স্যার, রয়েসয়ে, সাবধান করে দিয়ে বলল গডফ্রে। একসঙ্গে এত সব খেতে শুরু করলে পেট খারাপ করবে যে! তাছাড়া, গোগ্রাসে সব সাবাড় করে ফেললে, ভবিষ্যতে কি হবে? একজোড়া মুরগিই আপাতত যথেষ্ট বলে মনে করি, স্যার। মুরগির মাংসের সঙ্গে যব দিয়ে তৈরি রুটি দারুণ লাগবে।

এই প্রস্তাবে রাজি হলেন টার্টলেট, ফলে একজোড়া মুরগি প্রাণ হারাল। টার্টলেট আগুনে মুরগি ঝলসাচ্ছেন, ওদিকে গডফ্রে যব থেকে আটা তৈরি করতে ব্যস্ত। সকালের নাস্তাটা আজ ওরা খুব আয়েশ করে খেলো।

সারা দিন নানা কাজে ব্যস্ত থাকল ওরা। সবচেয়ে জরুরী কাজ যে আগুনটাকে টিকিয়ে রাখা, ওরা তা জানে। তাতে প্রচুর কাঠ এনে ফেলা হলো। রাতের বেলা আগুনের পাশে, তবে নিরাপদ দূরত্বে ঘুমাল ওরা।

শেষ রাতের দিকে ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল গডফ্রের। ঠান্ডা বাতাসের রহস্যটা কি? কোত্থেকে আসছে? খেয়াল করার পর সে আন্দাজ করল, বাতাস আসছে ফোকরের ওপর দিক থেকে। উইল-ট্রির ডালপালা যেখানে শুরু হয়েছে, নিশ্চয়ই সেখানে আরও একটা ফোকর আছে। কে জানে, পুরো গাছটাই হয়তো ফাঁপা। সমস্যা হলো, মাথার ওপর ফুটো বা গর্ত থাকলে শুধু বাতাস ঢুকবে না, বৃষ্টিও পড়বে। এ কেমন আস্তানা যে বৃষ্টির সময় ভিজতে হবে? গডফ্রে ঠিক করল, ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখতে হবে। সত্যি যদি গর্ত থাকে, সেটা বন্ধ করা দরকার।

ব্যাপারটা নিয়ে যতই চিন্তা করল সে ততই রহস্যময় লাগল। গত কয়েকদিন এই ঠান্ডা বাতাস কোথায় ছিল? তাহলে কি সেদিন যে বাজটা পড়েছিল, এই গাছেও তা আঘাত হানে?

মনটা খুঁত খুঁত করছে গডফ্রের। আস্তানা থেকে বাইরে বেরিয়ে এল সে। গাছের ওপর দিকে তাকিয়ে রহস্যটা কি বোঝার চেষ্টা করছে। একটু পরই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল। হ্যাঁ, বজ্রপাতের চিহ্ন স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। মগডাল থেকে কান্ড পর্যন্ত একেবারে ঝলসে দিয়েছে। কান্ডের খানিকটা বাকলও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। গর্তটাও তৈরি হয়েছে ওখানে। ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথাটা নত হয়ে এল গডফ্রের। বাজটা যদি গাছের ভেতর ঢুকে পড়ত, সেই দুর্যোগের রাতে ওরা কেউ বাঁচত না।

বাকল পুড়ে যাওয়ায় ওখানে একটা গর্ত তৈরি হয়েছে, আর সেই গর্ত দিয়ে গাছের ভেতর বাতাস ঢুকছে। তারমানে কি পুরো গাছটাই ফাঁপা? নিশ্চয়ই তাই। এত বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে শুধু বাকলের ওপর ভর করে। নিজের ধারণা সঠিক কিনা পরীক্ষা করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠল গডফ্রে।

পাইনের ডাল দিয়ে লম্বা একটা মশাল বানাল সে। কোটরের ভেতর ঢুকে মশালটা জ্বলল। লালচে আলোয় ভেসে গেল ভেতরটা। মেঝে থেকে প্রায় পনেরো ফুট ওপরে এবড়োখেবড়ো একটা ছাদ দেখা যাচ্ছে। মশালটা আরও খানিক উঁচু করতে ছাদের গায়ে গর্তটাও এবার আবছামত দেখতে পেল সে। হ্যাঁ, তার ধারণাই ঠিক। গাছটা আগাগোড়া খালি, পুরোপুরি ফাঁপা।

গাছের ভেতরের দেয়ালগুলোয় অনেক খাঁজ আর ভাঁজ আছে। সেগুলোয় পা রেখে ওপরে ওঠা সম্ভব। ছাদের গর্তটা ভাল করে পরীক্ষা করার জন্যে সাবধানে উঠতে শুরু করল গডফ্রে। গর্ত যখন একটা আছে, সেটাকে বন্ধও তো করতে হবে। ভয় শুধু ঠান্ডা বাতাস আর বৃষ্টিকে নয়, ভয় জংলীদেরকেও। আদিবাসিরা যদি হঠাৎ হামলা করে বসে, ওই গর্ত ওদের পালাবার পথ হতে পারে। গডফ্রে এখন তাই ভাবছে, গর্তটা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া উচিত হবে না।

একজোড়া শিকড়ের মাঝখানে মশালটাকে আটকে রেখে ওপরে উঠছে গডফ্রে। তিন মিনিটের মধ্যে প্রায় ষাট ফুট উঠে এসেছে সে। কী সাংঘাতিক, গাছটা সত্যি আকাশছোঁয়া! একটানা উঠতে পারছে না সে, খানিকটা উঠে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। গর্তটা এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। আর বিশ-পঁচিশ ফুট দূরে।

ঠান্ডা বাতাস এখন রীতিমত গডফ্রের মুখে ঝাপটা মারছে। যত ওপরে উঠছে সে, গাছের ভেতরটা ততই ক্রমশ সরু হয়ে আসছে। এক সময় গর্ত থেকে মাথাটা বাইরে বের করে দিল গডফ্রে। তার মুখের চারপাশে এখন ঘন পাতায় ঢাকা মগডালই শুধু দেখা যাচ্ছে। সন্দেহ নেই, গাছটার আশপাশ থেকে মুখ তুলে ওপর দিকে কেউ তাকালে তাকে কেউ দেখতে পাবে না। অথচ গডফ্রে দ্বীপের চারদিক অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। চারপাশে চোখ বোলাচ্ছে, হঠাৎ একদিকে মোচড় খেয়ে ওঠা ধোঁয়া দেখে বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেল গডফ্রে।

কোন ঝোপ-ঝাড় থেকে নয়, ধোঁয়া উঠছে সৈকত থেকে।

ওদিকে কোন গাছপালা নেই, কাজেই আগুনটা বাজ পড়ার ফলে সৃষ্টি হয়নি। তা যদি হত, বৃষ্টি হওয়ায় নিভে যাবার কথা। রহস্যটা কি তাহলে?

তরতর করে নিচে নেমে এল গডফ্রে। গাছের ভেতর থেকে বেরিয়ে হন হন করে সৈকতের দিকে যাচ্ছে সে। ধোঁয়া মানেই আগুন, সেই আগুনের রহস্য তাকে জানতেই হবে। এর আগেও ধোঁয়া দেখেছে সে, কিন্তু রহস্যটার কোন কিনারা আজও করতে পারেনি। আজ সে গোটা ব্যাপারটা ভালভাবে তদন্ত করে দেখতে চায়।

কিন্তু সৈকত চষে ফেলেও কোন লাভ হলো না। ধোঁয়া বা আগুন, কিছুই নেই কোথাও। আশপাশে কোন লোকজন আছে কিনা বোঝার জন্যে চিৎকার শুরু করল সে, গলা চড়িয়ে ডাকছে, কেউ কি আছ? কোন ভয় নেই, সাড়া দাও! কিন্তু কেউ সাড়া দিল না।

ব্যাপারটা চোখের ভুল বলে মানতে পারছে না গডফ্রে। তার মনে প্রশ্ন জাগল, তবে কি উষ্ণ কোন প্রস্রবণ আছে সৈকতের আশপাশে? পাক খেয়ে ওঠা ধোঁয়াটা কি সেই প্রস্রবণ থেকে উঠেছে? কিন্তু তা যদি থাকেই, চোখে পড়ছে না কেন?

প্রায় চার ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর ব্যর্থ হয়ে উইল-ট্রির কাছে ফিরে এল গডফ্রে। ইতিমধ্যে ঘুম ভেঙেছে প্রফেসর টাৰ্টলেটের। পকেট বেহালায় সুর তুলছেন, মাঝে মধ্যে উসকে দিচ্ছেন আগুনটা।

বিছানার শুকনো ঘাস আর পাতা কয়েকদিন পরপরই বদলে ফেলছে গডফ্রে। আরামে বাস করতে হলে পরিশ্রম না করলে চলে না। ছুরি দিয়ে মোটা একটা শিকড় চেঁছে কোটরের ঠিক মাঝখানে একটা টেবিল বানিয়েছে সে। বাইরে থেকে গাছের গুঁড়ি নিয়ে এসে তৈরি করেছে টুল। সেগুলোকে আরামকেদারা হয়তো বলা যাবে না, তবে বসার কাজ ভালভাবেই চলে। ঝড়-বৃষ্টির দিনে এখন ওদেরকে হাঁটুর ওপর খাবার রেখে খেতে হবে না, টেবিলে বসে খেতে পারবে।

ঠান্ডার দিনে কি পরবে, এই নিয়ে বেশ চিন্তায় আছে গডফ্রে। এখন সময়টা গরমকাল, অর্ধনগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াতে অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু শীতকালের জন্যে গরম কাপড় চাই। প্যান্ট, শার্ট আর ওয়েস্টকোট এখনও পরা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যেভাবে ছিড়ে যাচ্ছে তাতে আর বেশিদিন পরা যাবে না। শেষ পর্যন্ত হয়তো গাছের ছাল আর ছাগল-ভেড়ার চামড়াই পরতে হবে ওদেরকে।

টাৰ্টলেট ঘোষণা করেছেন, গডফ্রে হলো এই দ্বীপের প্রধানমন্ত্রী। খাদ্যদফতরটা প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতেই রেখেছেন। রোজ সকালে সুস্বাদু শেকড় আর ফল সংগ্রহ করতে বেরিয়ে পড়ে গডফ্রে। এই কাজে কয়েক ঘণ্টা করে বেরিয়ে যায় তার। মাঝে মধ্যে মাছ ধরতেও যায় সে। মাছ বা মাংসের কোন অভাব নেই, কিন্তু হাঁড়ি-পাতিল না থাকায় রান্না করাটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগুনে ঝলসানো মাছ-মাংস খেতে কতদিন আর ভাল লাগে।

ভেতরে কোটর আছে, এরকম আরও একটা দেবদারু গাছ আবিষ্কার করেছে গডফ্রে। অবশ্য ওদের আস্তানার মত অত বড় নয় সেটা। দ্বিতীয় গাছটার ভেতর মোরগ-মুরগিরা থাকছে। মুরগিগুলো ওখানেই ডিম পাড়ে। ইতিমধ্যে অনেক বাচ্চাও ফুটেছে।

ভেড়া আর ছাগলের জন্যেও একটা আস্তানা দরকার। তবে শীত আসতে এখনও বেশ দেরি আছে, কাজেই গডফ্রের কোন তাড়া নেই। ওগুলোর শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভালই যাচ্ছে, দ্বীপে আসার পর আগের চেয়ে মোটাতাজা হয়েছে সবগুলো। ইতিমধ্যে বংশবিস্তারও মন্দ হয়নি।

সব মিলিয়ে অনেকগুলো প্রাণী, সবাই বেশ সুখেই আছে। ফিনা আইল্যান্ডে এখন পর্যন্ত কোন হিংস্র জন্তুর দেখা পাওয়া যায়নি। থাকলে অবশ্যই ছাগল-ভেড়ার ঘাড় মটকাবার জন্যে হানা দিত।

দিনগুলো বেশ শান্তই কাটছে ওদের। জুন মাসের ছাবিবশ তারিখে হঠাৎ একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। সেদিন হাঁটতে হাঁটতে দ্বীপের উত্তরপ্রান্তে চলে এল গডফ্রে। এদিকে আগে কখনও আসেনি সে। সৈকতের কিনারায় একটা বালির ঢিবি দেখতে পেল সে, পানি থেকে খুব কাছে। ঢিবিটার কাছে সামুদ্রিক আগাছার একটা স্থূপ রয়েছে। স্থূপটার পাশে অদ্ভুত আকৃতির একটা পাথর পড়ে আছে। যেন একটা আজব জন্তু গুড়ি মেরে বসে আছে, পাহারা দিচ্ছে সাগরকে।

পাথরটা কি মন্ত্র জানে? তা না হলে গডফ্রেকে এভাবে টানছে কেন? কাছে এসে গডফ্রে হতভম্ব হয়ে পড়ল। কোথায় পাথর, এটা ততা দেখা যাচ্ছে প্রকান্ড একটা সিন্দুক!

এত বড়, এত ভারী একটা সিন্দুক এখানে এল কিভাবে? এটা কি ওদের জাহাজের সম্পত্তি, জাহাজডুবির পর স্রোতের টানে সৈকতে উঠে এসেছে? নাকি অন্য কোন জাহাজ ডুবেছে এদিকটায়, এটা সেই জাহাজের সম্পত্তি?

সিন্দুক যারই হোক, এটা যে ওদেরকে ঈশ্বর দান করেছেন তাতে আর সন্দেহ কি। এই দ্বীপে ওরা ছাড়া আর যখন কেউ নেই, এটা ওদেরই প্রাপ্য। এখন দেখা দরকার সিন্দুকের ভেতর কি আছে।

প্রথমে সিন্দুকটা ভালভাবে পরীক্ষা করল গডফ্রে। নাম-ঠিকানা কিছুই লেখা নেই গায়ে ঢাকনিটা অত্যন্ত শক্তভাবে বসানো হয়েছে, খুলতে সমস্যা হবে। লোহার নয়, কাঠের তৈরি সিন্দুক, কিনারাগুলো তামার পাত দিয়ে মোড়া।

সৈকত থেকে ওদের আস্তানা চার মাইল দূরে, এত ভারী একটা জিনিস সেখানে বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ঢাকনি খোলার আগে তালা খুলতে হবে, তাই সেটাকেই আগে পরীক্ষা করল গডফ্রে। কোন যন্ত্রপাতি নেই, অগত্যা বড় একটা পাথর তুলে তালার গায়ে বাড়ি মারতে শুরু করল সে।

তালা ভেঙে গেল। ঢাকনি খুলে গডফ্রে দেখল, সিন্দুকের ভেতরটা দস্তার পাত দিয়ে মোড়া। ভেতরে এতটুকু পানি ঢুকতে পারেনি। দস্তার পাত সরাতেই গডফ্রের চোখ জোড়া আনন্দে চকচক করে উঠল। এটা যে কোন সংসারী লোকের সিন্দুক তাতে কোন সন্দেহ নেই। একটা সংসার করতে যা যা লাগে সব এতে আছে। জিনিসগুলো এলোমেলো না করে কি কি আছে দেখে নিচ্ছে গডফ্রে। মুখে মুখে তালিকা তৈরি করছে সে–প্যান্ট-শার্ট, টেবিলক্লথ, চাদর, জানালার পর্দা, পশমী গেঞ্জি, পশমী মোজা, সুতি মোজা, মখমলের ড্রেসিং গাউন, হাতে বোনা ওয়েস্টকোট; লোহার কড়াই, কেটলি, কফির পাত্র, চায়ের জন্যে আলাদা কেটলি, ছুরি, কাঁটা-চামচ; আয়না, চিরুনি; কয়েক পাত্র ব্র্যান্ডি, কয়েক পাউন্ড করে ভাল চা ও কফি; যন্ত্রপাতির মধ্যে পাওয়া গেল করাত, তুরপুন, পেরেক, আঙটা, শাবল, কুড়াল, কোদাল ইত্যাদি। এখানেই শেষ নয়। বেশ কিছু অস্ত্র ও আছে–চামড়ার খাপে মোড়া একজোড়া বিশাল ভোজালি, একটা দোনলা ও একটা একনলা বন্দুক, তিনটে রিভলভার, বারো পাউন্ড কার্ট্রিজ ও গুলি, কয়েকশো বুলেট। সব অস্ত্রই একটা ব্রিটিশ কোম্পানির তৈরি। সিন্দুকের ভেতর দিকে পাওয়া গেল ওষুধের ছোট একটা বাক্স, একটা দূরবীন, একটা কম্পাস, একটা ক্রনোমিটার। এক কোণে রয়েছে ইংরেজিতে লেখা কয়েকটা বই, কয়েক দিস্তা কাগজ, কলম, পেন্সিল, একটা পঞ্জিকা, নিউ ইয়র্কে ছাপা একটা বাইবেল ও একটা রান্না শেখার সচিত্র বই।

অশ্চর্য ব্যাপার! ঠিক যা যা ওদের দরকার, সিন্দুকটায় শুধু সে-সব জিনিসই রয়েছে। একেই বলে ভাগ্য। ফিনা আইল্যান্ডে এখন আর ওদের কোন জিনিসেরই অভাব থাকবে না।

সব জিনিস এখুনি আস্তানায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অস্ত্র ও অন্যান্য দুএকটা জিনিস নিয়ে, প্রফেসর টার্টলেটের কাছে ফিরে এল গডফ্রে। তার হাতে লোহার কড়াইটা দেখে টাৰ্টলেট এমন নাচ শুরু করলেন, থামাতে ঘেমে উঠল গডফ্রে। সব কথা শোনার পর গডফ্রেকে মাথায় তুলে আরেক দফা নাচলেন তিনি। এতদিন তিনি তাঁর পকেট-বেহালায় শুধু করুণ সুর বাজিয়েছিলেন আজ এই প্রথম ছড় টেনে তুললেন আনন্দ আর উল্লাসের সুর।

দুপুরের খাওয়া কোনমতে সেরে গডফ্রে আবার রওনা হলো, এবার তার সঙ্গে টাৰ্টলেটও রয়েছেন। সৈকতে এসে সিন্দুকটা দেখলেন তিনি। ঢাকনি খুলে থরে থরে সাজানো জিনিসগুলোর ওপর পরম মমতায় হাত বুলালেন।

দুজন মিলে যতটা পারা যায় সিন্দুকের জিনিস-পত্র আস্তানায় বয়ে নিয়ে এল ওরা। যাবার আগে কড়াইয়ে স্টু চাপিয়ে গিয়েছিল, সেটা খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলল।

পরদিন আবার ভোর হতেই ছুটল সৈকতে। আরও তিনবার আসা-যাওয়া করে বাকি জিনিস-পত্র আনতে হলো। আগস্টের এক তারিখে খালি সিন্দুকটাও দুজন ধরাধরি করে নিয়ে এল সেই থেকে সিন্দুকটাকে ওরা ওয়াড্রোব হিসেবে ব্যবহার করছে।

সিন্দুকের ভেতর এতসব জিনিস-পত্র পেয়ে গডফ্রের চেয়েও বেশি খুশি মনে হলো প্রফেসর টাৰ্টলেটকে। উচ্ছ্বাস আর আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে বারবার তিনি বলছেন, ফিনা আইল্যান্ডে আমাদের ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছে খুবই উজ্জ্বল।

সেদিন সন্ধের দিকে ছাত্রের সামনে দাঁড়ালেন তিনি, হাতে পকেট-বেহালা। গডফ্রে, আবার তোমার নাচ শেখাটা শুরু করা দরকার। এসো, আজ তোমাকে একটা নতুন নাচ শেখাই।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত