০৬. সূর্য উঠতে এখনও তিন ঘণ্টা বাকি
সূর্য উঠতে এখনও তিন ঘণ্টা বাকি। এক, দুই, তিন-সেকেন্ড গোনা শুরু করেছিল গডফ্রে, একঘেয়ে লাগায় এখন আর গুনছে না এক একটা মিনিট যেন একটা করে বছর! ঘুমিয়ে পড়া চলবে না, নিজেকে সাবধান করে দিল সে। নিজের সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করলে সময়টা কাটানো সহজ হবে! শখ চাপায় অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছে, এক-আধটু কষ্ট তো করতেই হবে! বিপদ যত ভয়ঙ্করই হোক, ঘাবড়ে যাওয়াটা পুরুষ মানুষের সাজে না।
আপাতত তার একটা আশ্রয় আছে। একটা পরিস্থিতিকে অনেকভাবে দেখা যায়। তার পায়ের তলায় মাটি আছে, এটা কম কথা নয়। সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে ডাঙায়, তবে ঢেউগুলো এখন আর তাকে সাগরে নিয়ে গিয়ে নাকানিচোবানি খাওয়াতে পারবে না। কিন্তু জোয়ারের সময় কি হবে? জোয়ারে যদি এই পাহাড়ের চূড়া ডুবে যায়?
জাহাজডুবি ঘটেছে ভরা জোয়ারের সময়, কাজেই আবার জোয়ার শুরু হতে দেরি আছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন একটাই-এটা কি সত্যি একটা পাহাড়ের চূড়া, আর শুধু চূড়াটাই পানির ওপর মাথা তুলে রয়েছে? নাকি এটা আসলে বিশাল একটা দ্বীপের কিনারা? এক এক করে আরও প্রশ্ন জাগছে মনে। লঞ্চ নিয়ে ক্যাপটেন টারকট কি এখানেই এসেছিলেন? এটা কোন মহাদেশের তীর নয় তো? তারপর গডফ্রের মনে পড়ল, ক্যাপটেন টারকট বলেছিলেন, আশপাশে কোন ডাঙা নেই। লঞ্চ নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েও তিনি কোন ডাঙার সন্ধান পাননি। তাহলে? এখানে সে কিসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে?
না, ডাঙা আছে, এবং সেই ডাঙাতেই সে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাপটেন আরেকটু খোঁজ করলে ঠিকই এটার সন্ধান পেতেন। সকাল হলে বোঝা যাবে এই ডাঙা আসলে মহাদেশ, পাহাড়চূড়া, নাকি কোন দ্বীপ।
গরম ওয়েস্টকোট আর ভিজে ভারী হয়ে ওঠা জুতো জোড়া খুলে ফেলল গডফ্রে। হঠাৎ প্রয়োজন দেখা দিলে সাগরে আঁপিয়ে পড়ার জন্যে তৈরি থাকা উচিত। আচ্ছা, জাহাজের বাকি সবাই কি সত্যি ডুবে গেছে? আবার ওদের নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করল সে। কিন্তু বৃথাই, কেউ সাড়া দিচ্ছে না।
হঠাৎ গডফ্রে খেয়াল করল, এত চিৎকার করছে সে, অথচ তার চিৎকার প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছে না। এটা খুবই খারাপ লক্ষণ। এর মানে হলো, আশপাশে কোন পাহাড় বা বাড়ি-ঘর নেই। তার চিৎকার কোথাও বাধা পাচ্ছে না।
নানা রকম দুশ্চিন্তা আর অমঙ্গল আশঙ্কার ভেতর দিয়ে তিন ঘণ্টা পার হলো। হিম ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছে গডফ্রে। শরীরটা গরম রাখার জন্যে কিছুক্ষণ হলো হাঁটতে শুরু করেছে সে। পায়ের নিচে পাথর। ভোরটা ঘন কুয়াশায় ঢাকা, এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। আরও এক ঘণ্টা পর কুয়াশা হালকা হতে শুরু করল। তার সামনে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে প্রকৃতি। কালো পাথর ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে গেছে। চারদিকে উদ্ভট আকারের অসংখ্য পাথর ছড়িয়ে রয়েছে। গডফ্রে আসলে একটা খুব বড় পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরও সামনে সাগরের পানি। পানির ওপারে আরও পাথর, সেগুলোও সব বিশাল আকারের, যেমন উঁচু তেমনি চওড়া। ঢেউগুলো ছুটে এসে যেভাবে ভাঙছে, সন্দেহ নেই সাগর এখানে খুব বেশি গভীর। সূর্যের অবস্থান আন্দাজ করতে পারায় দিক নির্ণয়ে কোন অসুবিধে হলো না। গডফ্রে পশ্চিম দিকে রয়েছে। রাশি রাশি পাথর খন্ডের মাঝখানে যে পানি দেখা যাচ্ছে, ওটা আসলে একটা খড়ি। খড়ি পেরুলেই যে শুকনো ডাঙা পাওয়া যাবে, তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
কুয়াশা আরও হালকা হলো। ধীরে ধীরে গড়ফ্রের সামনে উন্মুক্ত হলো শৈবাল ভরা সৈকত। তারপর চোখে পড়ল সারি সারি টিলা, তবে কোনটাই খুব বেশি উঁচু নয়, সবগুলো গ্র্যানিট পাথরে তৈরি। টিলাগুলো পুব দিগন্তটাকে আড়াল করে রেখেছে। ডাঙা! ডাঙা! উল্লাসে নেচে উঠতে ইচ্ছে করল গডফ্রের। হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করল সে, কৃতজ্ঞতা জানাল ঈশ্বরকে।
কোন সন্দেহ নেই, ডাঙাই। গডফ্রের সামনে দুমাইল লম্বা একটা সৈকত পড়ে আছে, ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে তীরে। উত্তর আর দক্ষিণে একটা করে খাড়া টিলা, দৈর্ঘ্যে একেকটা পাঁচ-ছয় মাইলের কম হবে না। গডফ্রে আন্দাজ করল, এটা সম্ভবত কোন অন্তরীপের শেষপ্রান্ত। সে যাই হোক, সাময়িক আশ্রয় হিসেবে জায়গাটা মন্দ নয়।
এবার সাগরের দিকে মনোযোগ দিল গডফ্রে, আশা জাহাজ বা জাহাজের লোকজনকে হয়তো দেখতে পাবে। কিন্তু না, স্বপ্নের কোন চিহ্নমাত্র নেই সাগরে। জাহাজটা নেই, লঞ্চটাকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সাগর ফাঁকা, কোথাও কেউ ভাসছে না। ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হলেও, বাস্তব সত্য হলো সে একাই বেঁচে আছে। এখন থেকে সাহস করে প্রতিটি বিপদ একাই তার সামলাতে হবে। বেঁচে থাকতে হলে ভয় পাওয়া চলবে না।
মূল ডাঙায় পৌঁছাতে হলে বড় আকৃতির পাথরগুলো টপকাতে হবে। পানি ভেঙে হাঁটছে গডফ্রে, কখনও লাফ দিয়ে পার হচ্ছে। পাথরে শ্যাওলা জমেছে, কিছু পাথরের কিনারা ছুরির ফলার মত ধারাল। কাজেই খুব সাবধানে, দেখেশুনে এগোতে হচ্ছে তাকে। এভাবে সিকি মাইল হেঁটে ডাঙায় পা রাখল সে।
আস্তে আস্তে সমস্যাগুলো মাথাচাড়া দিচ্ছে। শুকনো কাপড়চোপড় দরকার তার। খিদে পেয়েছে, খাবার দরকার। সঙ্গে কোন অস্ত্র নেই, হঠাৎ যদি কোন হিংস্র জানোয়ার বা কোন জংলী হামলা করে বসে, নিজেকে সে রক্ষা করবে কিভাবে?
নিজেকে তিরস্কার করল গডফ্রে। তার মত বোকা দুনিয়ায় আর বোধহয় দ্বিতীয়টি নেই। বাড়িতে বসে কি আরামের জীবনযাপন করছিল। মাথায় ভূত চাপল, বিশ্বভ্রমণে বেরুবে। অ্যাডভেঞ্চারের শখ হলো! এখন মজা বোঝো!
মামা কোল্ডেরুপ আর বাগদত্তা ফিনার মুখ ভেসে উঠল চোখের সামনে। আর কি কখনও ওদের সঙ্গে তার দেখা হবে। বুকটা কেমন টনটন করতে লাগল গডফ্রের। চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
শ্যাওলা ঢাকা পিচ্ছিল পথটুকু পেরিয়ে এল গডফ্রে। পিছনে পড়ল বালির ঢিবি, উঁচু-নিচু জমিন। চারদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। শুধু নিজের পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল করল, মাথার ওপর কয়েকটা গাঙচিল চক্কর দিয়ে উড়ছে।
কিছু একটা দেখে থমকে দাঁড়াল গডফ্রে। সামনে ওটা কি পড়ে আছে বুঝতে পারল না। সিন্ধুদানব? মাত্র ত্রিশ কদম দূরে, একটা বালির ঢিবির ওপাশে কুঁকড়ে পড়ে আছে। বোধহয় কোন জন্তুই হবে।
সাবধানে এগোল গডফ্রে। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। আরে, কি আশ্চর্য! কোথায় জন্তু! এ তো মানুষ। গডফ্রের মুখ থেকে অস্ফুটে দুটো শব্দ বেরুল, প্রফেসর টার্টলেট!
সামুদ্রিক দানব বলে যাকে ভুল করেছিল, সেটা আসলে তার নাচের মাস্টার অধ্যাপক টার্টলেট। ছুটে তাঁর পাশে চলে এল গডফ্রে। মনে মনে প্রার্থনা করছে, ঈশ্বর, ওঁকে বাঁচিয়ে রাখো!
প্রফেসর টাৰ্টলেট একচুল নড়ছেন না। হাঁটু গেড়ে তার পাশে বসল গডফ্রে। কোমরের লাইফ-বেল্টটা একটু ঢিলে করল, তারপর দুহাত দিয়ে অধ্যাপকের হাত-পা ডলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পেলেন টার্টলেট। শিক্ষকের নাম ধরে ডাকল গডফ্রে, স্যার, মি. টার্টলেট?
বিড়বিড় করে কি যেন বললেন টার্টলেট। তাকে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল গডফ্রে।
ধীরে ধীরে চোখ মেললেন টার্টলেট। স্যার, আমাকে চিনতে পারছেন? আমি আপনার ছাত্র-গডফ্রে!
টার্টলেট কথা না বলে একবার মাথা ঝাঁকালেন। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসলেন তিনি, চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখছেন। ক্ষীণ হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। সলিল সমাধি ঘটেনি, পায়ের তলায় শক্ত মাটা বুঝতে পেরেই হাসছেন তিনি। গডফ্রের সাহায্য ছাড়াই, নিজের চেষ্টাতে সিধে হয়ে দাঁড়ালেন। নাচুনে পা জোড়া সচল হলো। পকেট-বেহালার তারে ছড় টানলেন টার্টলেট। বেহালায় বেজে উঠল বিষণ্ণ একটা সুর।
ছাত্র ও শিক্ষক পরস্পরকে আলিঙ্গন করলেন।
যাক, ঈশ্বর যা করেন ভালই করেন, শেষ পর্যন্ত আমরা তাহলে বন্দরে পৌঁছলাম! বিরাট একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ছাত্রের মাথার চুল আদর করে এলোমেলো করে দিলেন তিনি।
বন্দর? এই বিপদেও মনে মনে হাসল গডফ্রে। তবে শিক্ষকের মন খারাপ হয়ে যাবে, তাই তার ভুল ধারণাটা ভেঙে দিতে মন চাইল না। বলল, লাইফ-বেল্টটা এবার খুলে ফেলুন, স্যার। ওটা কোমরে থাকলে হাঁটাচলায় অসুবিধে হবে। তারপর, বেহালাটা রেখে, চলুন চারপাশটা ঘুরে দেখি।
কিন্তু একটা শর্ত আছে, নেচে উঠে বললেন টার্টলেট। পথে প্রথম যে রেস্তোরা চোখে পড়বে, সেটাতেই ঢুকব আমরা। এত খিদে পেয়েছে, মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব। ডজনখানেক স্যান্ডউইচ আর দুএক গ্লাস শ্যাম্পেন এখুনি আমার চাই।
বেশ, তাই চলুন, প্রথমে একটা রেস্তোরাই খুঁজে বের করি, হাসি চেপে বলল গডফ্রে।
এখন সবচেয়ে জরুরী কাজ হলো তোমার মামাকে একটা টেলিগ্রাম পাঠানো, বললেন টার্টলেট। রেস্তোরার বেয়ারাকে কিছু বকশিশ দিলেই টেলিগ্রাম অফিসে ছুটবে সে। তার পেলে তোমার -মামা নিশ্চয়ই খরচা বাবদ টাকা-পয়সা পাঠাতে ইতস্তত করবেন না। আমার পকেট তো একবারে ফাঁকা মাঠ হয়ে গেছে।
ঠিক আছে। একান্তই যদি এ-দেশে টেলিগ্রাম অফিস না থাকে, বকশিশ দিয়ে কাউকে ডাকঘরে পাঠালেই চলবে, কি বলেন? চলুন, যাওয়া যাক।
বালির ঢিবিগুলো পেরুল ওরা। গডফ্রের মনে একটা আশা জাগল, জাহাজডুবির পর আরোহীরা এদিকটায় আশ্রয় নিয়ে থাকলে দেখা হয়ে যেতে পারে। পনেরো মিনিট পর উপকূলের সরু খাড়িগুলো পেরিয়ে ষাট-সত্তর ফুট উঁচু একটা ঢিবিতে চড়ল ওরা। এখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কোন বাধা না থাকায় পুব দিগন্তে চোখ বুলানো সম্ভব হলো। উত্তর দিকটা অন্তরীপের মত ক্রমশ সরু হয়ে গেছে, ওপাশে আরও কোন অন্তরীপ থাকলেও থাকতে পারে, তবে দেখা যাচ্ছে না। একটা ঝর্ণা দেখল ওরা, দক্ষিণ দিক থেকে নেমে এসেছে সৈকতে। এই ডাঙা হয়তো একটা উপদ্বীপ, সেক্ষেত্রে সংলগ্ন জমিন থাকতে পারে শুধু উত্তর বা উত্তর-পুবে। এদিকে প্রচুর গাছপালা, ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে পানির ক্ষীণ ধারা। ঘাসও আছে। তারপর গভীর বনভূমি আর পাহাড়। তবে কোন বাড়ি-ঘর বা মানুষজন দেখা যাচ্ছে না। মানুষের হাতে তৈরি, এমন একটা জিনিসও ওদের চোখে পড়ছে না। এই জায়গা তাহলে কি? এখানে কি আদৌ কোনকালে মানুষের পা পড়েছে?
কি হে, গডফ্রে? এ আমরা কোথায় এসে পড়লাম? অবাক হয়ে জানতে চাইলেন টার্টলেট। এদিকে তো আমি কোন শহর দেখতে পাচ্ছি না!
নেই, তাই দেখতে পাচ্ছেন না।
শহর না থাক, গ্রাম তো থাকবে? তাই বা কই?
তাও নেই।
তাহলে? এখন আমরা কি করব? হতাশায় প্রায় মুষড়ে পড়লেন টার্টলেট।
কি আর করব! আসুন, একজোড়া রবিনসন ক্রুসো বনে যাই।
একজোড়া রবিনসন ক্রুসো হয়ে যাব? বলেই ছাগল ছানার মত তিড়িং করে একটা লাফ দিলেন টার্টলেট। আমি? ক্রুসো? ক্রুসোর অ্যাডভেঞ্চারের কথা স্মরণ করে রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন তিনি। ওরকম বিপদে তিনি পড়তে চান না। না, গডফ্রে, ভুলেও তুমি এ-ধরনের ঠাট্টা করবে না আর!
ঠিক আছে, করব না। কিন্তু শুধু গল্প করলে কি চলবে? আসুন, কাজ শুরু করি। প্রথম কাজ, মাথাগোঁজার একটা ঠাঁই খোঁজা।
হ্যাঁ, অন্তত রাতের জন্যে নিরাপদ একটা আশ্রয় দরকার ওদের। তারপর খিদে মেটাবার জন্যে চাই খাবার। শুরু হলো খোঁজাখুঁজি। কিছুক্ষণ পর টার্টলেট বললেন, সত্যি কথা বলতে কি, চোখে অন্ধকার দেখছি আমি। এখানে কোন মানুষজন আছে বলে মনে হচ্ছে না। আমার সন্দেহ, জন্তু-জানোয়ারও নেই।
সৈকতে অবশ্য বেশ কিছু পাখি দেখা যাচ্ছে-গাংচিল, শঙ্খচিল, বালিহাঁস, বুনোহাঁস ইত্যাদি। গডফ্রে ভাবছে, পাখি যখন আছে, তখন পাখির বাসাও পাওয়া যাবে। পাখির বাসায় পাওয়া যাবে ডিম। একটু খুঁজতেই পাথরের খাঁজে-ভাঁজে বাসাগুলো দেখতে পেল ওরা। ছোট জলাশয়গুলোর কিনারায় সারস আর তিতির পাখিও দেখা গেল কয়েকটা। গডফ্রে ভাবছে, বন্দুক থাকলে পাখি শিকার করেও খাওয়া যেত। না, যেত না। পাখির মাংস খেতে হলে সেদ্ধ করতে হবে। আগুন কোথায় যে সেদ্ধ করবে?
না, ডিম খোঁজাই ভাল। আর ডিম খুঁজতে গিয়েই পেয়ে গেল ওরা অপ্রত্যাশিত উপহার। সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছে দশবারোটা মুরগি, সঙ্গে দুতিনটে মোরগ। ওদেরকে দেখেই কঁকর-কঁক করে অভিনন্দন জানাল। কাছেই, ঘাসের ওপর চরতে দেখা গেল পাঁচ-সাতটা ভেড়া আর ছাগলকে। মোরগ-মুরগি আর চারপেয়ে প্রাণীগুলো নিশ্চয়ই ওদের জাহাজ স্বপ্ন-র সম্পত্তি। জাহাজডুবির সময় সাঁতরে এখানে উঠেছে। মনে মনে ভারি খুশি হলো গডফ্রে। এখানে দীর্ঘ দিন থাকতে হতে পারে, সেক্ষেত্রে অবলা প্রাণীগুলোর জন্যে ঘর তৈরি করতে হবে। বেশি কষ্ট করতে হলো না, বালিহাঁসের একগাদা ডিম সংগ্রহ করল ওরা। টার্টলেট প্রশ্ন করলেন, ডিম কি কাঁচাই খেতে হবে?
আগুনটাই এখন সবচেয়ে বেশি দরকার। কার পকেটে কি আছে দেখল ওরা। টার্টলেটের পকেট থেকে তেমন কিছু বেরুল না, শুধু বেহালার জন্যে খানিকটা তার আর রজন। গডফ্রের পকেট থেকে পাওয়া গেল চামড়ায় মোড়া ছুরি, তাতে ফল ছাড়াও একটা হুক আছে, আছে দাঁতসহ খুদে করাত আর কর্ক-স্কু। জিনিসটা অনেক কাজেই লাগবে। কিন্তু আগুন জ্বালার কি ব্যবস্থা করা যায়?
শুকনো ডাল ঘষে আগুন জ্বালার চেষ্টা করল ওরা, কিন্তু কোন লাভ হলো না। অগত্যা বাধ্য হয়েই কাঁচা ডিম খেতে হলো। তারপর ওরা বেরুল আশ্রয়ের খোঁজে। টার্টলেট বিড় বিড় করে কি যেন বলছেন, সম্ভবত অভিশাপ দিচ্ছেন ভাগ্যকে।
বনভূমি থেকে একটু তফাতে বিশাল কয়েকটা গাছ পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে, গডফ্রের মনে হলো ওগুলোর কোটরেও আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। কিন্তু অনেক খুঁজেও সেরকম কিছু পাওয়া গেল না। সময় বসে নেই, দিনকে পিছন ফেলে রাত নেমে আসছে। আশ্রয়ের খোঁজে হাঁটাহাঁটি করায় আবার খিদে পেয়ে গেছে ওদের। উপায় নেই, আবার সেই কাঁচা ডিমই গলা দিয়ে নামাতে হলো। ওই গাছগুলোর নিচেই কাত হলো ওরা। অবসাদে ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর। শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙল মোরগের ডাকে। গডফ্রে সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারল কোথায় রয়েছে সে। কিন্তু টাৰ্টলেট বারবার চোখ রগড়ে বোকার মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। জাহাজডুবির কথা তাঁকে মনে করিয়ে দিতে হলো।
আজকের ব্রেকফাস্টও কি কালরাতে ডিনারের মত জঘন্য হবে? জিজ্ঞেস করলেন টার্টলেট।
হ্যাঁ, কাঁচা ডিম খাওয়া ছাড়া উপায় নেই, বলল গডফ্রে। তবে আশা করছি সন্ধে নাগাদ অবস্থার কিছু উন্নতি হবে।
আমি নাচ ভুলে যাচ্ছি, অভিযোগের সুরে বললেন টার্টলেট। ঘুম ভাঙা মাত্র চীনামাটির কাপ ভর্তি সোনালি চা আর মোটাতাজা স্যান্ডউইচ খেতে পাচ্ছিলাম, তোমার মামা আমাকে ভাঙা একটা জাহাজে তুলে নির্বাসনে পাঠালেন।
গডফ্রে বেশ ভালই বুঝতে পারছে, যা করার তাকে একাই করতে হবে, নৃত্যশিক্ষক কোন সাহায্যে আসবেন না। টার্টলেট মনে করিয়ে দেয়ায় কোল্ডেরূপের সঙ্গে ফিনার কথাও ভাবল সে। ওরা কি খবর পাবেন যে জাহাজটা ডুবে গেছে? মন থেকে এ-সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে পাখির ডিম বের করল সে, বলল, হাতের কাছে যা পাচ্ছেন আপাতত তাই খেয়ে প্রাণ বাঁচান, স্যার। কিছু না খাওয়ার চেয়ে এই বা মন্দ কি?
মুখ হাঁড়ি করে টাৰ্টলেট বললেন, আমার পেট খারাপ করলে তোমার মামা দায়ী থাকবেন।
গডফ্রে ভাবছে, আশ্রয়ের সন্ধানে আবার ওদেরকে বেরুতে হবে। আর জানার চেষ্টা করতে হবে এই ডাঙাটা প্রশান্ত মহাসাগরের ঠিক কোনখানে। সৈকতের আরেকদিকে লোকজন থাকতে পারে, থাকলে এখান থেকে ফেরার কোন একটা ব্যবস্থা ঠিকই করা যাবে। পুরো সৈকতটা ভাল করে দেখা দরকার। হয়তো একটা বন্দরই পেয়ে যাবে ওরা। সেক্ষেত্রে জাহাজে চড়েই ফিরতে পারবে। আর একান্ত যদি এই ডাঙায় কোন জাহাজ না থাকে, চলন্ত কোন জাহাজকে থামানোর চেষ্টাও করা যেতে পারে।
টিলার প্রথম সারিটা পার হয়ে দ্বিতীয় সারির মাথায় চড়ার সিদ্ধান্ত নিল গডফ্রে, ওখান থেকে আশা করা যায় পুরো সৈকতটা দেখা যাবে। দ্বিতীয় সারির কাছে পৌঁছাতে ঘণ্টা দুয়েকের বেশি লাগবে বলে মনে হয় না। মোরগদের সুখী পরিবারটি ঘাসের ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছে। ভেড়া আর ছাগলগুলো বনের ভেতর ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে আবার বেরিয়ে আসছে, যেন খুব মজার একটা খেলা পেয়েছে তারা।
এই মোরগ-মুরগি আর ছাগল-ভেড়াগুলো এখন আমাদের অমূল্য সম্পদ, টার্টলেটকে বলল গডফ্রে। আমি চলে গেলে আপনি এগুলোকে পাহারা দিয়ে রাখতে পারবেন তো?
মাথা ঝাঁকিয়ে রাজি হলেন টার্টলেট। তবে কাতরকণ্ঠে জানতে চাইলেন, কিন্তু তুমি যদি পথ হারিয়ে ফেলো, গডফ্রে?
আমি ঠিকই ফিরতে পারব, শুধু আপনি এই জায়গা ছেড়ে না নড়লেই হয়।
তোমার মামাকে টেলিগ্রাম পাঠাতে ভুলো না, কেমন? এ-ও বলবে যে আমাদের হাত একেবারে খালি!
টেলিগ্রাম বা চিঠি, দুটোই সমান, বলল গডফ্রে। শিক্ষকের ভুলটা এখনও সে ভাঙতে চাইছে না।
করমর্দন করে টার্টলেটের কাছ থেকে বিদায় নিল সে। জঙ্গলে ঢোকার পর দেখল, গাছপালাগুলো এমন গায়ে গায়ে লেগে আছে যে নিচে এতটুকু রোদ নামতে পারছে না। মাটিতে জীব-জন্তুর পায়ের দাগ আছে, তবে হাঁটাহাঁটির ফলে তৈরি পায়ে চলা কোন পথ নেই। ক্ষিপ্রগতিতে কি সব পাশ কাটিয়ে গেল তাকে। গডফ্রে আন্দাজ করল, হরিণই হবে। ভাগ্য ভাল যে হিংস্র কোন জানোয়ার এখনও দেখা যাচ্ছে না। গাছপালার ডালে ডালে কলোনি তৈরি করেছে অসংখ্য পাখি। বন-মোরগ, বুনো পায়রা, ঘুঘু, চেনা প্রায় সব পাখিই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ-সব পাখি এমন কোন বিশেষ জাতের নয় যে দেখে জায়গাটার অক্ষাংশ আন্দাজ করা যাবে। গাছপালাও কোন সাহায্য করছে না। এ-ধরনের গাছ নিউ মেক্সিকো ও ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রচুর দেখতে পাওয়া যায়-মেপল, বার্চ, ওক, ম্যাগনোলিয়া, জলপাই, চেস্টনাট। সবই নাতিশীতোষ্ণ এলাকার গাছ। এক জায়গায় জঙ্গল একটু ফাঁকা লাগল, নিচে রোদ নামতে পারছে। গাছের তলা দিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটছে গডফ্রে। অচেনা জায়গা, সাবধানে চলাফেরা করা উচিত, এই কথাটা সে একবারও ভাবল না।
গডফ্রে মনে মনে একটা হিসাব করল। সতেরো দিন সাগর পাড়ি দেয়ার পর স্বপ্ন ডুবে গেছে। সতেরো দিন চীন বা জাপানের কাছাকাছি পৌছে যাবার কথা। সূর্য যেহেতু সব সময় দক্ষিণ দিকেই ছিল, কাজেই এটা তো পরিষ্কারই যে ওরা বিষুবরেখা পেরোয়নি।
ঘুরপথে আসতে হলো বলে দুঘণ্টায় মাত্র পাঁচ মাইল পেরুতে পারল গডফ্রে। জঙ্গল ফাঁকা হয়ে এল, সামনে উঁচু টিলার সারি। ঢাল বেয়ে একটা টিলার মাথায় উঠছে সে। ওপর থেকে কি কোন শহর দেখা যাবে? একটা গ্রাম দেখতে পেলেও খুশি হয় গডফ্রে। কিন্তু যদি খাঁ খাঁ মরুভূমি দেখতে পায়?
ঢাল বেয়ে উঠতে খুব কষ্ট হচ্ছে। ব্যথায় টন টন করছে পা দুটো। ক্লান্তিতে শরীর যখন আর চলতে চাইছে না, চূড়ায় উঠে এল গডফ্রে।
কি দেখবে সে?
সামনে দিগন্ত পর্যন্ত অথৈ জলরাশি, শুধুই সাগর। দূরে সাগর আর আকাশ এক হয়ে মিশে আছে। ঘুরে চারপাশে তাকাল গডফ্রে। উত্তর-দক্ষিণ-পুব-পশ্চিম ডুবে আছে পানিতে। সীমাহীন। সাগরের মাঝখানে এটা ছোট্ট একটা ডাঙা! তারমানে ওরা একটা দ্বীপে এসে উঠেছে।
মনটা হতাশায় ভরে উঠল। সাগরের মাঝখানের এই দ্বীপ থেকে ওরা উদ্ধার পাবে কিভাবে? আবার সে ভাল করে চারদিকে তাকাল। উত্তর-দক্ষিণে বিশ মাইল হবে দ্বীপটা, পুব-পশ্চিমে খুব বেশি হলে বারো মাইল। জঙ্গলটা দ্বীপের ঠিক মাঝখানে। বাকিটুকু ঘাসজমি, পাথুরে সৈকত। দ্বীপের এখানে সেখানে বয়ে চলেছে বারনার বেশ কয়েকটা ধারা।
এই দ্বীপটার নাম কি? চারপাশের এই যে সাগর, এটার পরিচয়ই বা কে তাকে বলে দেবে? আবার একটা হিসাব শুরু করল গডফ্রে। সতেরো দিনে একশো পঞ্চাশ থেকে একশে আশি মাইল পাড়ি দিতে পারত স্বপ্ন, এই হিসাবে অন্তত পঞ্চাশ ডিগ্রী তো ওরা পার হয়েছেই। অথচ তারপরও বিষুবরেখা অতিক্রম করেনি। তাহলে ধরে নিতে হয় দ্বীপটার অবস্থান একশো ষাট থেকে একশো সত্তর ডিগ্রী পশ্চিম দ্রাঘিমার মধ্যে।
দ্বীপটার নাম জানা নেই তো কি হয়েছে! গডফ্রে নিজেই একটা নাম দিল–ফিনা আইল্যান্ড! ফিনার নামে দ্বীপটার নাম রেখে খুব আশাবাদী হয়ে উঠল সে। দেখা যাক, নামটা ওদের জন্যে সৌভাগ্য বয়ে আনে কিনা।
টিলার মাথা থেকে কোন বসতি দেখা যাচ্ছে না। তবে দ্বীপের সবটুকু এখান থেকে দেখতেও পাচ্ছে না গডফ্রে। এখুনি না হোক, এক সময় চারদিকটা ঘুরে দেখতে হবে তাকে। এখন টার্টলেটের কাছে ফিরে যাওয়াই উচিত। অনেকক্ষণ হলো একা আছেন তিনি।
টিলা থেকে নামার আগে চারদিকটা আরেকবার ভাল করে দেখে নিচ্ছে গডফ্রে। সাগর একেবারে খালি, যেন এদিক দিয়ে কখনও কোন জাহাজ আসা-যাওয়া করে না। দ্বীপের উত্তর দিকে তাকাল সে। বিশাল আকারের কয়েকটা গাছ তার দৃষ্টি কেড়ে নিল। গাছগুলো গায়ে গায়ে লেগে আছে। এরকম লম্বা গাছ আগে কখনও দেখেনি সে। গাছগুলোর ফাকে একটা ঝরনা আছে বলেও মনে হলো, দূর থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। কাল ওই জায়গাটা দেখে আসতে হবে, সিদ্ধান্ত নিল গডফ্রে। ওখানে হয়তো একটা আশ্রয় মিলতে পারে।
এবার দক্ষিণ দিকে তাকাল গডফ্রে। ওদিকটায় সৈকত একটু হলদেটে। পাথরগুলো অদ্ভুত আকৃতির। তারপর ঘাসজমি আর জঙ্গল। হঠাৎ চমকে উঠল গডফ্রে। ওদিকে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে কিসের? কয়েকটা উঁচু পাথরের আড়াল থেকে উঠছে কালো ধোঁয়াটা। আশায় ও উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে এল তার। তারমানে কি ওদের জাহাজের আরও কেউ আশ্রয় নিয়েছে এই দ্বীপে? কিন্তু না, তা কি করে হয়! মাত্র একদিনে দ্বীপের অতটা ভেতরে কারও পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাহলে ওদিকে কি জেলেদের গ্রাম আছে? জেলে, না আদিবাসি জংলী?
তারপর আর ধোঁয়াটা দেখা গেল না। হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। গডফ্রে ভাবল, সে কি তাহলে ভুল দেখল? দৃষ্টিভ্রম?
হতাশ হয়ে ঢাল বেয়ে টিলা থেকে নেমে এল সে। ক্লান্ত পায়ে জঙ্গল পেরিয়ে ফিরে এল টার্টলেটের কাছে।
এতক্ষণ দুটুকরো শুকনো কাঠ ঠুকে আগুন জ্বালার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলেন টার্টলেট। গডফ্রেকে দেখেই তিনি চিৎকার করে জানতে চাইলেন, টেলিগ্রাম পাঠিয়েছ তো?
টেলিগ্রাম অফিস এখনও খোলেনি, বলল গডফ্রে।
কিন্তু ডাকঘর?
সে-ও বন্ধ। ও-সব কথা থাক, আসুন আগে কিছু মুখে দিই। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে আমার।
আবার সেই কাঁচা ডিম? টার্টলেট প্রায় কেঁদে ফেললেন।
কোথায় গিয়েছিল, কি দেখে এল, বারবার এ-সব প্রশ্ন করায় বাধ্য হয়েই টার্টলেটকে কথাটা বলল গডফ্রে।
কি? এটা একটা দ্বীপ? শুনেই আঁতকে উঠলেন টার্টলেট।
হ্যাঁ, আমি দ্বীপটার নাম রেখেছি ফিনা আইল্যান্ড।
নামটা আমার পছন্দ হলো না, গডফ্রের মুখের ওপর বলে দিলেন টার্টলেট। মিস ফিনার সঙ্গে এটার মিল কোথায়? তার চারপাশে পানি নেই, শুধু ডাঙা। আর এই দ্বীপটার চারপাশে ডাঙা নেই, শুধুই পানি।
পরদিন সকালে আশ্রয়ের সন্ধানে বেরুল গডফ্রে। এবার তার সঙ্গে টার্টলেটও যাচ্ছেন। ওদের পোষা প্রাণীগুলোকেও সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। আজ সকালে শুধু ডিম নয়, একটা ছাগলকে ধরে খানিকটা করে দুধও খাওয়া হয়েছে, মন-মেজাজ তাই দুজনেরই বেশ ভাল।
সৈকত ধরে এগোলেও, সামনে মাঝে মধ্যে ঢিবি আর পাথর পড়ল। সাবধানে সেগুলো টপকে এল ওরা। সবার আগে রয়েছে গডফ্রে, ছোট্ট বাহিনীর সেই তো লীডার। গডফ্রের পিছনে রয়েছে পোষা প্রাণীগুলো। ওগুলোকে খেদিয়ে আনছেন টার্টলেট। কাজটা করতে গিয়ে নৃত্যচর্চাও হয়ে যাচ্ছে তার। শরীরটাকে বাঁকিয়ে কখনও তিনি মুরগির পিছনে ছুটছেন, কখনও ভেড়ার পিছনে। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল গডফ্রে। কয়েকটা গাছের ডালে কিছু ফল ঝুলছে। দেখেই চিনতে পারল, ক্যালিফোর্নিয়ায় রেড-ইন্ডিয়ানরা এই ফল খুব শখ করে খায়। আমাদের মেনুতে নতুন একটা আইটেম যোগ হলো। পাখির ডিম, ছাগলের দুধ, আর এখন থেকে এই ফল-ম্যানজানিলা।
এই ফল মানুষ খায়? জিজ্ঞেস করলেন টার্টলেট।
কয়েকটা ফল পাড়ল গডফ্রে। টার্টলেটকে বলল, খেয়ে দেখুন , অমৃত মনে হবে।
ফলে একটা কামড় দিলেন টার্টলেট। মাথা ঝাঁকিয়ে তারিফ করলেন। ম্যানজানিলা আসলে বুনো আপেল, সামান্য একটু টক, তবে খেতে খারাপ লাগে না।
খানিকপর বালির ঢিবিগুলোকে পিছনে ফেলে এল ওরা। ঘাসজমির ওপর এদিকে বেশ কিছু গাছপালা আছে, আর আছে একটা চঞ্চলা ঝরনা। আরও কয়েকশো গজ এগোতে সেই প্রকান্ড আকারের গাছগুলোর দেখা পাওয়া গেল, কাল যেগুলো টিলার মাথা থেকে দেখেছিল গডফ্রে। ইতিমধ্যে প্রায় চার ঘণ্টা হাঁটা হয়েছে, দূরত্ব পেরিয়েছে নয় মাইলের কম নয়। সময়টা এখন বিকেল।
ম্যানজানিলা ঝোপের গা ঘেঁষে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে প্রকান্ড গাছগুলো। গাছের তলায় নরম ঘাস, তবে ছোটখাট কিছু পাথর ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। তারই মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে ঝরনা। কাছেই সৈকত।
বিশাল গাছগুলো আসলে দেবদারু। সবচেয়ে বড় গাছটার গুঁড়িতে চার কি পাঁচ ফুট চওড়া একটা ফোকর দেখতে পেল গডফ্রে। প্রায় দশ ফুট উঁচু সেটা। রীতিমত একটা গুহার মতই লাগছে, ভেতরে ঢুকতে কোন অসুবিধে নেই। যাকে বলে একেবারে রেডিমেড বাড়ি। আসুন, মি. টার্টলেট, ভেতরে ঢুকে দেখা যাক।
ফোকরের ভেতর এক গাদা শুকনো পাতা আর শ্যাওলা জমে আছে। মেঝের পরিধি বিশ ফুটের কম হবে না। অন্ধকার তো, তাই ঠিকমত বোঝা গেল না ছাদটা কত উঁচুতে। গাছের ছাল ভেদ করে ভেতরে রোদ ঢুকতে পারে না। ঠান্ডা বাতাস বা বৃষ্টির ছাঁটও ঠেকিয়ে রাখে। গডফ্রে টার্টলেটকে বলল, এখন থেকে এটাই আমাদের আস্তানা, কি বলেন, স্যার?
চেহারায় নাখোশ একটা ভাব, টার্টলেট প্রতিবাদের সুরে বললেন, কিন্তু চিমনি নেই কেন?
চিমনি তো দরকার আগুন জ্বালার পর। আসুন, চেষ্টা করে দেখি আগুন জ্বালা যায় কিনা।
গাছের ফোকর থেকে বেরিয়ে চারপাশে একটা চক্কর দিচ্ছে গডফ্রে। মার্টল ঝোপ, ম্যানজানিলা ঝোপ পেরিয়ে একটা ঢালের কাছে চলে এল সে। এদিকে ওক, বীচ, সিকামোর আর কাঁটাঝোপ ভর্তি। সামনে আরও গাছপালা দেখা যাচ্ছে। গডফ্রে ঠিক করল, ওদিকটা কাল দেখে আসবে। এ পর্যন্ত যতটুকু দেখল, বেশ সন্তুষ্টই বোধ করল সে। তার চেয়ে বেশি খুশি দেখা গেল পোষা প্রাণীগুলোকে। প্রচুর ঝোপ আর ঘাস থাকায় খাদ্যের কোন অভাব হবে না ওদের। এরই মধ্যে মুরগির দলটা পোকামাকড় ধরে খেতে শুরু করে দিয়েছে।
রাতে ওরা পাখির ডিম, ছাগলের দুধ আর বুনো আপেল বেশ মজা করেই খেলো। শোয়ার আগে প্রকৃতিদত্ত আস্তানা অর্থাৎ প্রকান্ড দেবদারু গাছটার নামকরণ করল গডফ্রে–উইল-ট্রি মামার নাম উইলিয়াম ডব্লিউ কোন্ডেরূপ, উইলিয়ামের অংশবিশেষ উইল। তার এই নামকরণে টার্টলেট কোন মন্তব্য করলেন না, তবে তার খুব একটা আপত্তি আছে বলেও মনে হলো না।
জাহাজডুবির পর গডফ্রে অনেকটাই বদলে গেছে। চঞ্চল, আরামপ্রিয়, অলস গডফ্রেকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিপদ যতই কঠিন হোক, মাথা ঠান্ডা রাখতে শিখেছে সে। বুদ্ধিরও যেন ডালপালা গজাতে শুরু করেছে। এখন আর তার অভিধানে হতাশা বলে কোন শব্দ নেই। নিজের ওপর নির্ভর করতে শিখেছে, শিখেছে সহজাত উদ্ভাবনী শক্তিগুলোকে কাজে লাগাতে। নিজের ভেতর যে এত গুণ ছিল, জাহাজটা না ডুবলে তার অজানাই থেকে যেত। নিজেকে সে চিনতেই পারত না।
গডফ্রে প্রতিজ্ঞা করেছে, যত কঠিন বিপদেই পড়ক, কোনমতে হার মানবে না সে।
সকাল হলো। আজ ঊনত্রিশে জুন। কাজের একটা তালিকা তৈরি করল গডফ্রে। প্রতিটি দেবদারু গাছ ভাল করে পরীক্ষা করতে হবে! খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে নতুন কোন ফল পাওয়া যায় কিনা। টার্টলেট ঘুমাচ্ছেন, তাঁকে না জাগিয়েই ফোকরটা থেকে বেরিয়ে পড়ল সে।
হালকা কুয়াশায় সাগর আর সৈকত ঢাকা পড়ে আছে। উত্তর আর পুব দিকই শুধু খানিকটা পরিষ্কার। একটা গাছ থেকে ডাল ভেঙে ছড়ি বানাল গডফ্রে, তারপর সৈকত ধরে হাঁটা ধরল। যেতে যেতেই নাস্তা সেরে নিল সে। ঝিনুক, পাখির ডিম আর বুনো আপেল। ঝরনাটার ডান তীর ধরে সৈকতের দক্ষিণ-পুব দিকে যাচ্ছে। দূর থেকে এদিকটায় কিছু ঝোপ-ঝাড় দেখেছিল কাল।
দেড়-দুমাইল পেরিয়ে এল গডফ্রে। এদিকে ছোট একটা নদী দেখা যাচ্ছে। হরেক রকম হাঁস আর পাখি খেলা করছে পানিতে। মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছে কয়েকটা গাংচিল। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে গোটা এলাকা মুখর। একজোড়া মাছরাঙা ছোঁ দিল পানিতে, দুটো মাছ নিয়ে উড়ে গেল আরেক দিকে। নদীর দিকে মনোযোগ দিল গডফ্রে। স্বচ্ছ পানি, সেখানে রঙবেরঙের মাছ সাঁতরে বেড়াচ্ছে। বাহ্, ওরা তাহলে মাছ ধরেও খেতে পারবে!
আবার সেই আগুনের কথাটা ভাবতে হলো। নদীর কিনারা ধরে আরও সামনে এগোচ্ছে গডফ্রে। হঠাৎ তার বিস্ময়ের সীমা থাকল না। এদিকে ছোট একটা খেত রয়েছে, খেতে ফলেছে এক ধরনের যব। কিন্তু যব তো আর এমনি খাওয়া যাবে না, রান্না করতে হবে। আবার সেই আগুনের কথা মনে পড়ল। একটু পর আরও একটা জিনিস দেখে খুশি হয়ে উঠল গডফ্রে। জিনিসটা এক ধরনের ফল, নাম না জানা। তবে গডফ্রে এই ফল রেডইন্ডিয়ানদের খেতে দেখেছে। নিজেও একটা খেলো। বেশ সুস্বাদু। নিশ্চয়ই পুষ্টিকরও হবে।
উইল-ট্রির কাছে ফিরে এসে গডফ্রে দেখল টার্টলেট নাস্তা সারছেন। তাকে দেখেই চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন। কি কি আবিষ্কার করেছে, সব খুলে বলল গডফ্রে। কিন্তু আগুন? জিজ্ঞেস করলেন টার্টলেট। আগুন ছাড়া তুমি রাধবে কিভাবে?
হ্যাঁ, আগুন জ্বালার একটা ব্যবস্থা না করলেই নয় আর, চিন্তিত সুরে বলল গডফ্রে।
এই খাওয়াদাওয়ার সিস্টেমটা না থাকলে কি হত? মুখ বেজার করে বললেন টার্টলেট। ঈশ্বর ইচ্ছা করলে খিদে জিনিসটা না দিলেও পারতেন, তাই না?
একটা সময় আসবে যখন না খেয়েও বেঁচে থাকতে পারবে মানুষ, বলল গডফ্রে।
নাহ, তা কি করে হয়!
হয়। চেষ্টা করলে সব হয়। আমাদের বিজ্ঞানীরা তো শুনছি। এই বিষয়টা নিয়ে রাতদিন গবেষণা করছেন।
তোমার বা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আমি একমত হতে পারলাম না, বললে টার্টলেট। খাদ্য না দিয়ে জীব-জন্তুকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব, এ আমি বিশ্বাস করি না।
আসুন প্রকৃত সত্য আর যুক্তি দিয়ে ব্যাপারটা বিবেচনা করি, বলল গডফ্রে। আমরা যা খাই তার খানিকটা হজম হয়, বাকিটা শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। যেটুকু হজম হয় তা থেকে শরীরের তাপের চাহিদা মেটে। এখন ধরা যাক, রসায়নবিদরা এমন একটা জিনিস আবিষ্কার করল যা খেতে হয় না, নাক দিয়ে অক্সিজেনের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারি শরীরে, এবং তা থেকে আমরা পুষ্টি এবং অন্যান্য দরকারী জিনিস সবই পাব, তাহলে রোজ তিন বেলা খেতে বসার ঝামেলা থেকে রেহাই না পাবার কি কারণ আছে? ঘ্রাণে অর্ধভোজন বলে একটা কথা এখনই চালু, তখন বাস্তবে দেখা যাবে ঘ্রাণে পূর্ণভোজন হয়ে যাচ্ছে!
ফোঁস করে একটা বিশাল নিঃশ্বাস ছাড়লেন টার্টলেট। আহা, এমন চমৎকার একটা আবিষ্কার আগে কেন সম্ভব হলো না! তাহলে নাক দিয়ে বাতাস টেনেই ডজনখানেক স্যান্ডউইচ আর কড়া ঝাল দেয়া কাবাব খেয়ে নিতাম।
আসুন আমরা কাজে মন দিই, স্বপ্নচারী টার্টলেটকে তাগাদা দিল গডফ্রে। উইল-ট্রির ফোকরটাকে ওরা আস্তানা হিসেবে গ্রহণ করেছে ঠিকই, কিন্তু সেটাকে বাসযোগ্য করতে হলে খাটাখাটনি করতে হবে। টার্টলেটের জন্যে অপেক্ষায় না থেকে কাজে লেগে গেল গডফ্রে। প্রথমে মেঝেটা পরিষ্কার করল সে, ঝেটিয়ে বিদায় করল শুকনো পাতা আর শ্যাওলার স্তুপ। মেঝেটা আসলে শিকড়ের সমষ্টি, খানিকটা উঁচু-নিচু আর শক্ত। ফোকরের দুই কোণে শোয়ার ব্যবস্থা হবে। বিছানা হিসেবে নরম পাতা ফেলা হলো। গডফ্রে জানাল, ফার্নিচারও দরকার, সে-সব নিজেদেরকেই তৈরি করে নিতে হবে। বেঞ্চ, টুল, টেবিল বানাতে কাঠ লাগবে, জঙ্গলে তা যথেষ্ট পরিমাণেই আছে। সঙ্গে ছুরি-কাঁটা থাকায় ওগুলো তৈরি করতে কোন অসুবিধে হবে না।
ফোকর বা কোটর কতটা উঁচু, একটা বারো ফুট লম্বা ডাল দিয়ে মাপতে চেষ্টা করল গডফ্রে। কিন্তু ডালটা কোথাও ঠেকল না, অর্থাৎ ছাদের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না।
সূর্য অস্ত গেল। ওদের কাজ এখনও শেষ হয়নি। ক্লান্ত শরীর আর কতই বা সয়! খানিক বিশ্রাম নিয়ে খেতে বসল ওরা। তারপর আরও খানিক বিশ্রাম দিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকাল থেকেই আস্তানা গোছগাছ করতে ব্যস্ত থাকল ওরা। দিনটা যে কিভাবে কেটে গেল, দুজনের কেউই বলতে পারবে না। আজ ওরা যে যার পরনের কাপড়চোপড় ধুলো ঝরনার পানিতে।
জুলাইয়ের তিন তারিখ পর্যন্ত দিনগুলো শুকনো থাকল, একবারও ঝড়-বৃষ্টি হলো না। ইতিমধ্যে নতুন বাড়িটাকে রীতিমত ভালবেসে ফেলেছে ওরা। গাছের গায়ে বড় একটা গর্ত, সেটাকেই দুজন মিলে আরামদায়ক বাসস্থানে পরিণত করেছে। মন্টোগোমারি স্ট্রীটে গডফ্রের মামার যে প্রাসাদ আছে, আরামআয়েশের বিচারে সেটার চেয়ে কোন অংশে কম যায় না এটা, কাজেই সেই প্রাসাদের খুদে সংস্করণই বলতে হবে এটাকে।
যতই আরামে বসবাস করুক, অচেনা এই দ্বীপ থেকে দেশে ফেরার জন্যে মনটা সব সময় ব্যাকুল হয়ে থাকে গডফ্রের। ফিনা তার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, এই চিন্তাটা কোনভাবেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না সে। তাই রোজ একবার সৈকতে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, আশা সাগরে যদি কোন জাহাজকে দেখা যায়। কিন্তু ফেনা, ঢেউ আর স্রোত ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। গডফ্রে অবশেষে ধরে নিল, প্রশান্ত মহাসাগরের এদিকটায় কোন জাহাজ চলাচল করে না। ফিনা আইল্যান্ড সম্ভবত সমস্ত জলপথ থেকে অনেক অনেক দুরে। তবু, ঈশ্বরের ওপর ভরসা রাখে গডফ্রে। তার ধারণা, ভুল করে হলেও কোন জাহাজ এদিকে আসবে, ওরা সেই জাহাজ চড়ে দেশে ফিরে যাবার সুযোগ পাবে। ঈশ্বর দুর্বলকে সাহায্য করেন, এটা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করে সে।
অবসর সময়ে প্রায় রোজই আগুনের কথাটা ওঠে। আর আগুনের কথা উঠলেই টার্টলেট প্রায় হুমকি দেয়ার সুরেই ছাত্রকে বলেন, চোখের সামনে এমন নধর সব মোরগ-মুরগি, মোটাতাজা ছাগল-ভেড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ ও-সব বাদ দিয়ে খেতে হচ্ছে কাঁচা ডিম, কাঁচা দুধ, আর কাঁচা ফল। গডফ্রে, এ আর আমি সহ্য করতে রাজি নই।
মনমরা হয়ে চুপ করে থাকে গডফ্রে।
টাৰ্টলেট কিন্তু থামেন না। এ-সব কাঁচা জিনিস খেয়ে আমার পেট খেপে যাচ্ছে, গডফ্রে! সত্যি বলছি, পেট সরব প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তুমি যদি শিগগির আগুন জ্বালতে না পারো, ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছেন তিনি, পেটটাকে আমি সামলাতে পারব না! মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয় চোখ গরম করে ছাগলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি, তাতে যদি ওগুলোর গায়ে আগুন ধরে যায়!
তারপর একদিন গডফ্রে একটা চকমকি পাথর কুড়িয়ে পেল। ছুরির ফলাটা ইস্পাতের তৈরি, তাতে চমকি ঠুকে আগুন জ্বালবার চেষ্টা করল সে। ফুলকি ঠিকই ওঠে, কিন্তু সেগুলোর আয়ু এত কম যে শুকনো ঘাস পর্যন্ত পৌঁছবার আগেই নিভে যায়।
না, আগুন জ্বালার কোন উপায়ই করা যাচ্ছে না।
অবশেষে প্রকৃতিই আবার ওদেরকে সাহায্য করল। এক রাতে আকাশ ঢাকা পড়ে গেল কালো মেঘে। তারপর বেশ বড় একটা ঝড় উঠল। বজ্রপাতের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল ওদের এখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি। আকাশের অবস্থা দেখার জন্যে আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে এল গডফ্রে। বেরুতেই আবার বজ্রপাত হলো। অকস্মাৎ আকাশ ছোঁয়া দেবদারু গাছের মগডালগুলো দপ করে জ্বলে উঠল। গোটা দ্বীপ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার আলোয়।
জ্বলন্ত ডালপালা নিচে খসে পড়ছে। মাথায় পড়বে, এই ভয়ে তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়াল গডফ্রে। পরমুহূর্তে চিৎকার করে উঠল, আগুন! আগুন!
টার্টলেট কোটর থেকে সাড়া দিলেন, ঈশ্বরকে হাজারো ধন্যবাদ!
গডফ্রের দেখাদেখি তিনিও জ্বলন্ত একটা ডাল কুড়িয়ে নিলেন। সেই জ্বলন্ত মশালের সাহায্যে আস্তানার ভেতর স্থূপ করে রাখা শুকনো কাঠ আর পাতায় আগুন ধরাল ওরা। গডফ্রে বলল, আশ্চর্য কি জানেন, স্যার? পাশের গাছটায় বাজ পড়েছে, অথচ উইল-ট্রির কোন ক্ষতি হয়নি।
ঈশ্বরকে আরেকবার ধন্যবাদ। অনেক দিন পর আজ নাচতে শুরু করলেন টার্টলেট।
একটু পরই শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি।