স্কুল ফর রবিনসন্স: ০৫. আরাম-আয়েশের কোন অভাব নেই জাহাজে

স্কুল ফর রবিনসন্স: ০৫. আরাম-আয়েশের কোন অভাব নেই জাহাজে

০৫. আরাম-আয়েশের কোন অভাব নেই জাহাজে

আরাম-আয়েশের কোন অভাব নেই জাহাজে। নিজের কেবিনের যেদিকে সবচেয়ে বেশি আলো পড়ে সেদিকের দেয়ালে ফিনার ফটোটা ঝুলিয়েছে গডফ্রে। বিছানাটা তার বিশাল দোলনা। বাথরূমটা কেবিন সংলগ্ন। কেবিনে লেখাপড়ার জন্যে একটা টেবিল দেয়া হয়েছে। কাপড়চোপড় রাখার জন্যে একটা ওয়ার্ডোবও আছে। এত রকম সুযোগ-সুবিধে পেলে সারাজীবনই সে বেড়িয়ে কাটাতে পারে। গডফ্রের মনে ফুর্তি আর ধরে না। দিনগুলো তার বড়ই আনন্দে কাটছে।

কিন্তু টার্টলেটের দিনকাল তেমন ভাল যাচ্ছে না। গডফ্রের কেবিন থেকে তার কেবিন খুব একটা দূরে নয়, তবে আকারে তারটা বেশ ছোট। বিছানাটাও খুব শক্ত। কেবিনে মাত্র ছয় বর্গগজ মেঝে, নাচুনে একজোড়া পায়ের জন্যে এই জায়গা খুব কম হয়ে গেল না?

জুন মাসের আবহাওয়া অনুকূলই থাকল। উত্তর-পুব দিক থেকে শান্ত বাতাস বইছে। ক্যাপটেন টারকট পুরোদমে এঞ্জিন চালিয়ে ফুল স্পীড তুললেন, তারপর ওড়ালেন সবগুলো পাল, রাজহাঁসের মত দ্রুতবেগে পানি কেটে ছুটছে স্বপ্ন। সাগর শান্ত থাকায় সী-সিকনেস কাউকে কাবু করতে পারল না। দেখতে দেখতে মার্কিন উপকূল দিগন্তের আড়ালে হারিয়ে গেল।

প্রথম দুদিন উল্লেখ করার মত কিছুই ঘটল না। সূর্য যখন মধ্যরেখা পেরোয়, রোজই ক্যাপটেন টারকট তাঁর খাতায় সমস্ত তথ্য টুকে রাখেন। তারপর মেটকে নিয়ে নিজের কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। বদ্ধ ঘরের ভেতর ফিসফাস করেন তারা। কি বিষয়ে গোপন আলোচনা হয় বোঝা যায় না। কেবিন থেকে বেরিয়ে এলে দেখা যায়, দুজনেই দুশ্চিন্তায় কাহিল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু কি নিয়ে তাদের এত উদ্বেগ তা কাউকে বলেন না।

গডফ্রে অবশ্য এ-সব কিছুই খেয়াল করল না। জাহাজ চালানো সম্পর্কে তার তো কোন অভিজ্ঞতাই নেই। কিন্তু ক্যাপটেন আর জাহাজের আচরণে মাল্লারা খুবই বিস্মিত হলো। রওনা হবার পর এক হপ্তার মধ্যে, আবহাওয়া যখন শান্ত ও স্বাভাবিক, পরপর কয়েক রাত চুপিচুপি বদলে দেয়া হলো জাহাজের গতিপথ। ব্যাপারটা অত্যন্ত রহস্যময়, অথচ ক্যাপটেন বা মেটের কাছ থেকে এর কোন ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না।

তারপর বারো তারিখে জাহাজে অপ্রত্যাশিত একটা ঘটনা ঘটল। তখন সকাল। এক টেবিলে নাস্তা খেতে বসেছেন ক্যাপটেন টারকট, মেট ও গডফ্রে। হঠাৎ ডেক থেকে একটা গোলযোগের আওয়াজ ভেসে এল। এক মুহূর্ত পর ডাইনিংরূমের দরজা দড়াম করে খুলে গেল। দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে একজন মাল্লা। সে চিৎকার করে বলল, ক্যাপটেন টারকট!

টেবিল ছেড়ে ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়লেন ক্যাপটেন কী ব্যাপার?

জাহাজে এক চীনাকে পাওয়া গেছে!

কি বললে? জাহাজে চীনাম্যান?

হ্যাঁ, ক্যাপটেন! জলজ্যান্ত একটা চীনা লোক! অদ্ভুত ব্যাপার, লোকটা জাহাজের খোলে লুকিয়েছিল। হঠাৎ আমরা তাকে দেখতে পেয়েছি!

এ কিভাবে সম্ভব! একটা লোক জাহাজের খোলে লুকিয়ে থাকল, অথচ আমরা জানতেই পারলাম না?

কিভাবে জানতে পারব! লোকটা লুকিয়ে ছিল পাটাতনের তুলায়।

ব্যাটাকে তাহলে সাগরের তলায় চালান করে দাও, কঠিন সুরে নির্দেশ দিলেন ক্যাপটেন টারকট।

মাল্লা লোকটা চোখ বড় বড় করে মাথা ঝাঁকাল, বলল, জ্বী, হুজুর, আপনার নির্দেশ মতই কাজ হবে। ক্যালিফোর্নিয়ার লোকজন চীনাদের দুচোখে দেখতে পারে না, চীনদেশ সম্পর্কেও তাদের বিতৃষ্ণা প্রবল। মাল্লা লোকটা ক্যাপটেনের নির্দেশ খুশি মনেই পালন করবে।

তবে মাল্লার পিছু নিয়ে ক্যাপটেন টারকট সেই মুহূর্তে জাহাজের ফোরক্যাসলের দিকে ছুটে এলেন ব্যাপারটা সরেজমিনে তদন্ত করার জন্যে, তার সঙ্গে থাকল মেট ও গডফ্রে।

ইতিমধ্যে দুতিনজন খালাসী চীনা লোকটার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে। বেচারাকে একা পেয়ে দুচারটে কিল-ঘুনি মারতেও ছাড়ছে না। লোকটার বয়স খুব বেশি হলে চল্লিশ হবে। সুঠাম স্বাস্থ্য। চোখে-মুখে বুদ্ধির দীপ্তি। হাবভাব দেখে বোঝা যায়, লোকটা চটপটে। তবে আলো-বাতাসহীন খুপরিতে কয়েক দিন থাকায় বেশ কাহিল হয়ে পড়েছে। ক্যাপটেনের নির্দেশে খালাসীরা তাকে ছেড়ে দিল। লোকটাকে তিনি প্রশ্ন করলেন, কে তুমি? তোমার পরিচয় কি?

আমি সূর্যসন্তান।

নাম বলো।

আমার নাম সেংভু, লোকটা বলল। চীনা ভাষায় সেংডু অর্থ -যে বাঁচে না।

ব্যাখ্যা করো, এই জাহাজে তুমি কি করছ?

চেয়েছিলাম আপনাদের জাহাজে চড়ে সাগর পাড়ি দেব, ম্লান সুরে বলল সেংভু। আমি কারও কোন ক্ষতি করিনি।

জাহাজ ছাড়ার আগেই খোলের মধ্যে লুকিয়েছিলে, তাই না?

জ্বী, হুজুর।

বিনা পয়সায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনদেশে যাবার মতলব?

হুজুর যদি দয়া করে নিয়ে যান…

কিন্তু যদি দয়া না করি? যদি বলি, ওহে হলুদ ওরাংওটাং, তুমি সাঁতার কেটে নিজের দেশে ফিরে যাও?

যদি আমাকে সাগরে ফেলেই দেন, সেই চেষ্টাই করতে হবে আমাকে, বলল সেংভু। তবে তাতে সলিল সমাধি ঘটবার সম্ভাবনাই বেশি।

তুমি বোধহয় চাইছই আমরা তোমাকে সাগরে ফেলে দিই, যাতে শাস্তিটা এড়িয়ে যেতে পারো, ক্যাপটেন টারকট গম্ভীর হলেন। কিন্তু আমি তোমাকে এত সহজে পার পেতে দেব না।

এই পর্যায়ে ব্যাপারটায় নাক গলাল গডফ্রে। সে যুক্তি দিল, স্বপ্নে একজন চীনা থাকার অর্থই হলো ক্যালিফোর্নিয়ায় একজন চীনা কম থাকা। তারপর সে জিজ্ঞেস করল, ক্যাপটেন, আপনার কি মনে হয় না যে ক্যালিফোর্নিয়ায় চীনাদের সংখ্যা এমনিতেই খুব বেশি?

হ্যাঁ, খুব বেশি।

কাজেই এই লোকটা যখন স্বেচ্ছায় ক্যালিফোর্নিয়া ত্যাগ করেছে, ওকে আমাদের সাহায্য করা উচিত। ইচ্ছে করলে ওকে আমরা সাংহাই বন্দরে অনায়াসে নামিয়ে দিতে পারি।

যুক্তরাষ্ট্রে চীনাদের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে ব্যাপারটা নিয়ে মার্কিনীরা রীতিমত আতঙ্কিত। গডফ্রের প্রস্তাবে ক্যাপটেন টারকট অগত্যা রাজি হয়ে গেলেন। এরপর সেংভুকে জেরা করা হলো।

সানফ্রান্সিসকোয় ফরাসীদের অনেক থিয়েটার আছে, সেংভু এরকম একটা থিয়েটারে অভিনয় করে। সে আসলে কৌতুকাভিনেতা। কিন্তু লোক হাসিয়ে পেট ভরলেও, মনটা দেশে ফেরার জন্যে আকুলিবিকুলি শুরু করেছিল, সেজন্যেই গোপনে এই জাহাজে উঠে লুকিয়ে থাকে সে। আশা ছিল, কারও চোখে ধরা না পড়ে চীনদেশে পৌঁছাতে পারবে। সঙ্গে খাবারদাবার ছিল, সে-সব ফুরিয়ে গেলে জাহাজের খাবার চুরি করে খেত। ধরা পড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার অপরাধ এমন গুরুতর নয় যে মৃত্যুদন্ড দেয়া যেতে পারে।

সেংভুর সাজা মাফ হয়ে যাওয়ায় এখন আর তাকে খোলের ভেতর লুকিয়ে থাকতে হবে না। ডেকেই তার থাকার ব্যবস্থা হলো। তবে সে কারও সঙ্গে বিশেষ কথা বলে না। মাঝিমাল্লাদের পারতপক্ষে এড়িয়েই চলে। খায়ও নিজের খাবারই।

পরবর্তী তিন দিন তাপমাত্রা শুধু নামতেই থাকল। আবহাওয়াও খামখেয়ালী শুরু করেছে-হঠাৎ ঝম ঝম বৃষ্টি, কখনও বা এলোমেলো মাতাল বাতাস। বাতাসের দিকও বদলে গেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমে ছুটছে এখন। সুযোগ বুঝে বেয়াড়া হয়ে উঠেছে ঢেউগুলোও, স্বপ্নকে মাঝেমধ্যেই ফেনার মাথায় তুলে ধরছে, পরমুহূর্তে আবার সবেগে নামিয়ে আনছে দুই জলস্তম্ভের মধ্যবর্তী গভীর খাদে। এলোমেলো মাতাল বাতাসে পালগুলো কোন কাজে আসছে না, ওগুলো খুলে রাখা হয়েছে। স্বপ্ন এগোবার চেষ্টা করছে পুরোপুরি এঞ্জিনের ঘাড়ে চেপে। ক্যাপটেন এঞ্জিনটাকে পুরোদমে চালাতে নিষেধ করলেন, কারণ বয়লারের ওপর বেশি চাপ পড়লে সমস্যা হতে পারে।

এরকম আবহাওয়ায় স্বপ্ন ভাঙছে না, তবে খুব ঝাঁকি খাচ্ছে। জাহাজের অবিরাম দোল হাসিমুখেই মেনে নিল গডফ্রে। এরইমধ্যে সাগরকে ভালবেসে ফেলেছে সে, কাজেই এক-আধটু অত্যাচার সহ্য করতে তার আপত্তি নেই। কিন্তু অধ্যাপক টার্টলেটের দৃষ্টিতে সাগর হলো পরম শত্রু। ঢেউ আর বাতাস স্বপ্নকে নিয়ে যত বেশি খেলছে টার্টলেটও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তার দীর্ঘকালের অভ্যাস নৃত্যের তালে তালে পা ফেলে হাঁটাচলা করা, কিন্তু অশান্ত সাগরে সচল কোন জাহাজের ডেকে সেভাবে পা ফেলা সম্ভব নয়। প্রতিবারই যেখানে পড়ার কথা সেখানে পা ফেলতে ব্যর্থ হচ্ছেন তিনি। এরকম বৈরি পরিবেশে নিজের কামরায় যে শুয়ে থাকবেন তারও উপায় নেই। জাহাজের এই দুলুনি তাকে এমন অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে যে কোথাও তিনি স্থির হয়ে শুতে বা বসতে পারছেন না। এ এক অদ্ভুত উভয়সঙ্কটই বটে। না তিনি স্থির হতে পারেন, না অস্থির হতে। নিজের কামরায় দাঁড়িয়ে ভয় পাচ্ছেন তিনি, এবার নির্ঘাত জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন। অস্তিত্ব বিপন্ন হলে মানুষ অনেক অদ্ভুত কান্ড করে। টার্টলেট নিজের কেবিন থেকে ডেকে আশ্রয় পাবার আশায় ছুটে এলেন। কিন্তু এখানে আসার পর দেখা গেল জাহাজ যখন যেদিকে কাত হচ্ছে, তিনিও সেদিকে গড়াচ্ছেন-পালা করে একবার এদিক আসছেন, একবার ওদিক যাচ্ছেন। এভাবে গড়াতে থাকলে প্রাণবায়ুকে বেশিক্ষণ শরীরের ভেতর ধরে রাখা যাবে না, এটা উপলব্ধি করে একদিকের রেইলিং আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলেন টার্টলেট। তাতে ব্যর্থ হয়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে হাত বাড়ালেন দড়ি-দড়ার দিকে। কিন্তু সেগুলোও হাত থেকে এক সময় ছুটে গেল। জাহাজের ডেকে এই যে দাপাদাপি শুরু করেছেন তিনি, আধুনিক নৃত্যশিল্পের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়াটা নেহাতই বাতুলতা হবে।

টার্টলেট ভাবছেন, জাহাজ ও সাগরের এই অত্যাচার থেকে বাঁচার একটাই উপায়, বেলুনের মত তিনি যদি হুস করে আকাশে উঠে যেতে পারতেন! কোল্ডেরুপের প্রতি মনটা তাঁর বিরূপ হয়ে উঠল। এ তাঁর খামখেয়াল ছাড়া কী, এত থাকতে একজন নৃত্যশিক্ষককে ভাগ্নের সহযাত্রী করে পাঠিয়েছেন। দিনে অন্তত বিশ-পঁচিশবার ক্যাপটেন টারকটকে প্রশ্ন করছেন তিনি, এই বিচ্ছিরি আবহাওয়া কতদিন থাকবে?

ঠিক বলতে পারছি না, নির্লিপ্ত সুরে জবাব দেন ক্যাপটেন। সত্যি কথা বলতে কি, ব্যারোমিটারের ভাবসাব আমার সুবিধের মনে হচ্ছে না।

খুব তাড়াতাড়ি, মানে দুএকদিনের মধ্যে ডাঙায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা যায় না? কাতর কণ্ঠে জানতে চাইলেন টার্টলেট।

কি বললেন? দুএকদিনের মধ্যে ডাঙায় পৌঁছাতে চান? তিক্ত হাসি ফুটল ক্যাপটেনের মুখে। ও, বুঝেছি, আপনি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন!

সাগরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন টার্টলেট। হায়! অথচ একেই লোকে প্রশান্ত মহাসাগর বলে!

টার্টলেট শুধু যে সী-সিকনেসে আক্রান্ত হয়েছেন, তা নয়, তিনি জলাতঙ্কেও ভুগছেন। প্রতি মুহূর্তে তার ভয় লাগছে, পাহাড়ের মত উঁচু ঢেউগুলো স্বপ্নকে গ্রাস করবে, জাহাজের সঙ্গে তিনিও ডুবে যাবেন।

ক্যাপটেনের কাছ থেকে কোন রকম আশ্বাস না পেয়ে ছাত্রের কাছে ছুটে এলেন অধ্যাপক। শুনছ, গডফ্রে, আমাদের আসলে বেঁচে থাকার কোন আশা নেই। প্রশান্ত মহাসাগর যদি শান্ত না হয়, সবাইকে ডুবেই মরতে হবে।

শিক্ষককে নরম সুরে অভয় দিল গডফ্রে। আপনি শুধু শুধু আতঙ্কিত হচ্ছেন। আমি যেভাবে বলি সেভাবে ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখুন। নিজেকে প্রশ্ন করুন, জাহাজ কেন বানানো হয়?

নিজেকে প্রশ্ন করব? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন টার্টলেট। বেশ, করলাম-জাহাজ কেন বানানো হয়?

তারপর নিজেই উত্তর দিন–জাহাজ বানানো হয় ভেসে থাকার জন্যে।

জাহাজ বানানো হয় ভেসে থাকার জন্যে, আবৃতি করলেন টার্টলেট।

একটা জাহাজ কেন ভেসে থাকবে, এর পিছনে অনেক যুক্তি আছে।

একটা জাহাজ কেন ভেসে থাকবে, এর পিছনে অনেক যুক্তি আছে।

এবার, ছাত্র গডফ্রে পরামর্শ দিল, কল্পনাশক্তির সাহায্যে, মাথা খাটিয়ে যুক্তিগুলো খুঁজে বের করুন, মুখে উচ্চারণ করে নিজেকে শোনান। দেখবেন, সমস্ত অকারণ ভয় আপনার মন থেকে মুছে গেছে।

টাৰ্টলেট চিৎকার করে প্রতিবাদ জানালেন, বলা যায় মুহূর্তে তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন সব বাজে কথা, গডফ্রে! যে-কোন জাহাজের স্বাভাবিক পরিণতি ডুবে যাওয়া। জাহাজ না বানানো হলে ডোবার মত কিছু থাকত না, এটাই সহজ যুক্তি। যেহেতু বানানো হয়েছে, কাজেই ওটা ডুববে।

অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে চুপ করে থাকল গডফ্রে।

ছাত্রের চুপ করে থাকাটাকে হেরে গিয়ে চুপসে যাওয়া হিসেবে গণ্য করলেন টার্টলেট, এবং জাহাজ নির্ঘাত ডুববে ধরে নিয়ে কোমরে একটা লাইফ-বেল্ট বেঁধে নিলেন। সেই থেকে রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা শরীরে শোভা পাচ্ছে ওটা। সাগর ধমক দিলে বা হুমকি দিলে সেটাকে আরও আঁটো করে বাঁধেন, ফুঁ দিয়ে আরও একটু বেশি ফোলাবার চেষ্টা করেন বেলুনটাকে। কিন্তু যতই ফোলান, সেটা যথেষ্ট ফুলেছে বলে কখনোই তার মনে হয় না।

টার্টলেটের এই সাগর-ভীতি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখা উচিত। প্রথমবার যারা সাগর-পাড়ি দিচ্ছে তাদের পক্ষে ঢেউয়ের এই নিষ্ঠুর প্রলয়নৃত্য সহ্য করা সত্যি অত্যন্ত কঠিন।

আবহাওয়া কিন্তু সত্যি দিনে দিনে আরও খারাপের দিকেই যাচ্ছে। প্রচন্ড একটা ঝড় হবে, তার সমস্ত লক্ষণ ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে উঠছে। ক্যাপটেন টারকট সাবধানী মানুষ, এঞ্জিনের ক্ষতি এড়াবার জন্যে হাফ স্পীডে স্বপ্নকে চালাচ্ছেন তিনি। ঢেউ প্রতি মুহূর্তে জাহাজটাকে তুলে আছাড় মারছে। প্রপেলারগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে, পরমুহূর্তে আবার ঘুরতে ঘুরতে চারপাশে পানি ছিটিয়ে উঠে আসছে। জাহাজের খোল ম্যালেরিয়ার রোগীর মত সারাক্ষণ থরথর করে কাঁপছে!

একটা ব্যাপার খুব রহস্যময় লাগল গডফ্রের। অনেক চেষ্টা করেও এই রহস্যের কোন কিনারা করতে পারেনি সে। দিনের বেলা স্বপ্ন প্রচন্ড ঝাঁকি খায়, এমন দুলতে থাকে যে পেটের সমস্ত নাড়ীভুড়ি বেরিয়ে আসার যোগাড় হয়। কিন্তু রাতে এই ঝাঁকি আর দোল কি কারণে কে জানে অনেক কমে যায়। এই রহস্যের ব্যাখ্যা কি? সূর্য ডোবার পর আবহাওয়া শান্ত হয়ে যায়? প্রতিদিন? নাহ্, তা কি করে হয়!

একুশে জুন পার হয়ে যাচ্ছে। সেদিন রাতে রহস্যটা নিয়ে চিন্তা করছিল গডফ্রে, মাথাটা তার গরম হয়ে উঠল। জেদ চাপল, এর একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা তাকে পেতেই হবে। রোজকার মত আজও দিনের বেলা প্রচন্ড ঝাঁকি খেয়েছে স্বপ্ন, সারাক্ষণ দুলেছে। সারাটা দিনই বাতাসের গতি ছিল প্রবল। তখন একবারও মনে হয়নি যে রাতে অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু সন্ধে হতেই দেখা গেল সব ঠান্ডা হয়ে গেছে। বাতাসও কম, সাগরও উত্তাল নয়। অদ্ভুত নয়?

গরম কাপড়ে নিজেকে মুড়ে ডেকে বেরিয়ে এল গডফ্রে।

লুকআউট, অর্থাৎ পাহারাদাররা গলুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্যাপটেন টারকটকে দেখা গেল সিঁড়ির ধাপে। গডফ্রে লক্ষ্য করল বাতাসের গতি আগের মতই আছে, একটুও কমেনি, কিন্তু ঢেউগুলোকে দিনের বেলা যেমন ফণা তুলতে দেখা গিয়েছিল, এখন তেমন দেখা যাচ্ছে না। এর রহস্য কি? গডফ্রের জন্যে অবশ্য আরও একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। সে দেখল, জাহাজের চিমনি থেকে ওঠা ধোঁয়া একটা রেখা তৈরি করে পিছন দিকে সরে যাচ্ছে।

তারমানে কি বাতাস দিক বদল করেছে? আপনমনে বিড় বিড় করল গডফ্রে।

ক্যাপটেনের দিকে এগোল সে। ক্যাপটেন?

ক্যাপটেন টারকট প্রথমে গডফ্রেকে দেখতেই পাননি। হঠাৎ তাকে একেবারে গায়ের কাছে দেখে একটু যেন বিরক্তই হলেন। আপনি, মি. গডফ্রে? এত রাতে? খোলা ডেকে?

হ্যাঁ, ক্যাপটেন টারকট। আমি জানতে চাই…

কি? প্রশ্নটা যেন বোমার মত বিস্ফোরিত হলো। আমি জানতে চাই, বাতাস কি হঠাৎ দিক বদলেছে?

না তো, মি. গডফ্রে! সঙ্গে সঙ্গে কর্কশ সুরে জবাব দিলেন টারকট। অবশ্যই বাতাস দিক বদলায়নি। তবে এটুকু বলতে পারি যে প্রচন্ড একটা ঝড় আসছে।

বাতাস দিক বদলায়নি, ঠিক জানেন? তাহলে চিমনির ধোঁয়া জাহাজের পিছন দিকে ছুটছে কেন?

পিছন দিকে ছুটছে! কেমন যেন থতমত খেয়ে গেলেন ক্যাপটেন টারকট। ও, হ্যাঁ! যেন এই প্রথম ব্যাপারটা খেয়াল করলেন তিনি। রীতিমত বিচলিত দেখল তাঁকে। কিন্তু ধোঁয়া পিছন দিকে যাচ্ছে তো আমি কি করব? এতে আমার কোন দোষ নেই।

আপনার দোষ? আপনাকে কে দোষী করছে? আমি শুধু জানতে চাইছি, ধোঁয়াটা পিছন দিকে যাচ্ছে কেন?

কেন আবার, প্রচন্ড একটা ঝড় আসছে, সেই ঝড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্যে জাহাজকে আমি উল্টোদিকে নিয়ে যাচ্ছি।

সে কি! প্রায় আঁতকে উঠল গডফ্রে। তাহলে তো গন্তব্যে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে আমাদের।

তা একটু দেরি হবে বৈকি। তবে সকালে যদি দেখি সাগর শান্ত হয়ে এসেছে, তাহলে আবার আগের মত পশ্চিম দিকে জাহাজ চালাব। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠলেন ক্যাপটেন। মি. গডফ্রে, আপনি বরং নিজের কেবিনে ফিরে যান। আপনার জন্যে সেটাই সবদিক থেকে ভাল হবে। আমি আপনার ভাল চাই, তাই আমার পরামর্শ ফেলে দেবেন না–যান, কেবিনে শুয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করুন। তা না হলে…

তা না হলে কি? প্রায় চ্যালেঞ্জের সুরে জিজ্ঞেস করল গডফ্রে।

তা না হলে কাল সকালে নড়ার শক্তিও পাবেন না, অত্যন্ত কাহিল হয়ে পড়বেন।

ক্যাপটেন ফণা নামাতে গডফ্রেও আর কথা বাড়াল না, ফিরে চলল কেবিনের দিকে। ফেরার সময় লক্ষ্য করল, মেঘের মিছিল এত নিচে নেমে এসেছে, যেন হাত বাড়ালে ছোঁয়া যাবে, পড়িমরি করে ছুটছে উল্টোদিকে। গডফ্রের মনে হলো, ঝড় বোধহয় সত্যি একটা হবে। তাড়াতাড়ি কেবিনে ঢুকে শুয়ে পড়ল সে।

কিন্তু রাতে কোন ঝড় এল না। সকালে বাতাসের গতি বরং কমে গেল। দিক বদলে আবার পশ্চিমে ছুটছে স্বপ্ন।

পরবর্তী আটচল্লিশ ঘণ্টা এই অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটল-জাহাজ দিনে পশ্চিমমুখো ছোটে, রাতে ছোটে পুবমুখখা। ব্যারোমিটারের কাঁটা সামান্য ওপর দিকে উঠেছে, আশা করা যায় আবহাওয়ার দ্রুত উন্নতি ঘটবে, বাতাসও বইতে শুরু করবে উত্তরে।

ঘটলও তাই! পঁচিশ তারিখ সকাল আটটায় ডেকে এসে দাঁড়াল গডফ্রে। উত্তর থেকে পুব দিকে বইছে বাতাস, মেঘের মিছিলগুলোকে খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অকস্মাৎ চারদিকে আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে সূর্যও বেরিয়ে এল সাগরের রঙ গাঢ় সবুজ, রোদ লেগে ঝিকিয়ে উঠল। প্রায় শান্ত ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনার মুকুট। নিচের দিকের সবগুলো পাল টাঙিয়ে দিতেই বাতাসে ফুলে উঠল।

চোখে দূরবীন, মেট দাঁড়িয়ে আছে গলুইয়ের কাছে। এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়াল গডফ্রে। কালকের চেয়ে আজকের দিনটা বেশ শান্তই, কি বলেন? জিজ্ঞেস করল সে।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল মেট, মি. গডফ্রে। সাগরের শান্ত দিকটায় সরে এসেছি আমরা।

জাহাজ তাহলে তার নিজের পথ ধরেই এগোচ্ছে?

না, এখনও সেটা সম্ভব হচ্ছে না।

মানে? কি বলতে চান আপনি?

কেন, আপনি জানেন না, মি. গডফ্রে? কদিন কি রকম তীব্র বাতাস ছিল, লক্ষ্য করেননি? বাতাসের ধাক্কায় অনেকটা উত্তর-পুব দিকে সরে এসেছে জাহাজ। ঠিক পথ ধরতে হলে প্রথমে তো জানতে হবে এই মুহূর্তে কোথায় রয়েছি আমরা।

তা জানা কি এমন কঠিন! ভুরু কুঁচকে বলল গডফ্রে। আকাশে সূর্য রয়েছে, আলোর তো কোন অভাব নেই! দিগন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এটা একটা প্রশ্ন হলো-এই মুহূর্তে কোথায় রয়েছি!

সাগর কি এতটুকু একটা জিনিস যে আলো থাকলেই বোঝা যাবে কোথায় রয়েছি! গডফ্রের অজ্ঞতা দেখে হাসল মেট। সূর্য মাথার ওপর উঠুক, তখন বোঝা যাবে ঠিক কোথায় আমাদের অবস্থান। সেই অবস্থান জানার পরই কেবল জাহাজ চালাবার হুকুম দেবেন ক্যাপটেন টারকট।

এই প্রথম খেয়াল করল গডফ্রে, জাহাজ চলছে না! ঘাবড়ে গিয়ে সে জানতে চাইল, ক্যাপটেন কোথায়? তাকে কোথাও দেখছি না কেন?

ক্যাপটেন? ক্যাপটেন নেই।

নেই মানে? হাঁ হয়ে গেল গডফ্রে।

ও, আপনি তাহলে কিছুই জানেন না! আবার হাসল মেট। লুকআউট রিপোর্ট করল, পুবদিকে বিশাল সব ঢেউ দেখা যাচ্ছে। শান্ত সাগরে বিশাল ঢেউ মানে হলো, কাছাকাছি কোথাও সম্ভবত ডাঙা আছে। অথচ মানচিত্রে ডাঙার চিহ্নমাত্র নেই। তাই স্টীম লঞ্চ নিয়ে দেখতে গেছেন ক্যাপটেন টারকট। তাঁর সঙ্গে চারজন মাল্লাও আছে।

কখন গেছেন তিনি? কতক্ষণ আগে?

অনেকক্ষণই তো হলো। ঘণ্টা দেড়েকের কম নয়।

মুখ ভার করে গডফ্রে বলল, আমাকে একটা খবর দিতে পারতেন। তাহলে ওদের সঙ্গে আমিও যেতাম।

আপনি হয়তো তখন ঘুমাচ্ছিলেন, মি. গডফ্রে। ক্যাপটেন সম্ভবত আপনার ঘুম ভাঙাতে চাননি।

গডফ্রে জানতে চাইল, কোন দিকে গেল লঞ্চটা?

উত্তর-পুবে।

চোখে দূরবীন লাগিয়ে কি দেখছিলেন? লঞ্চটাকে?

খুঁজছিলাম, হ্যাঁ। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। অনেক দূরে চলে গেছে কিনা।

ফিরতে কি দেরি হবে?

না-না, ক্যাপটেন দেরি করবেন না। সাগরের মেজাজ, সূর্যের অবস্থান ইত্যাদি ওনাকেই তো সব দেখতে হবে–অবশ্যই দুপুরের আগে ফিরে আসবেন তিনি।

একটা দূরবীন নিয়ে গলুইয়ের একেবারে মাথার কাছে বসে পড়ল গডফ্রে। তাকেও সঙ্গে নেয়া হয়নি, সেজন্যে মন খারাপ ঠিকই, কিন্তু ক্যাপটেনের আচরণের পিছনে যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে সে। বড় আকারের ঢেউ কেন উঠছে, এটা জানা খুবই জরুরী। কাছাকাছি ডুবোপাহাড় থাকলে এরকম বড় ঢেউ উঠতে পারে। জাহাজের নিরাপত্তার দায়িত্ব যেহেতু ক্যাপটেনের, তাঁকেই তো সব দেখতে হবে।

পৌনে এগারোটার দিকে ফিরে এল লঞ্চ। ক্যাপটেন জাহাজে পা দিতেই ছুটে এল গডফ্রে। জিজ্ঞেস করল, কি দেখলেন, ক্যাপটেন?

হাসিমুখে ক্যাপটেন টারকট বললেন, গুডমর্নিং, মি. গডফ্রে।

আমি ঢেউগুলোর কথা জানতে চাইছি…

ও, ঢেউগুলো! নাহ্, ব্যাপারটা ঠিক বোঝা গেল না! লুকআউট সম্ভবত ভুলই করেছে!

এখন তাহলে আমরা নিজেদের পথে এগোব?

অবশ্যই। তবে তার আগে জেনে নিতে হবে ঠিক কোথায় রয়েছি আমরা।

মেটকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। ক্যাপটেনকে সে জিজ্ঞেস করল, স্যার, লঞ্চটা কি আমরা জাহাজে তুলব?

না, জাহাজের সঙ্গে বেঁধে রাখো, বললেন ক্যাপটেন। পরে কাজে লাগতে পারে।

দুপুর বারোটায় সেক্সটান্ট কম্পাসের সাহায্যে সূর্যের নিখুঁত অবস্থান নির্ণয় করলেন ক্যাপটেন, তারপর নির্দেশ দিলেন জাহাজ কোনদিকে যাবে। দিগন্তের দিকে একবার মাত্র চোখ তুলে তাকালেন তিনি, তারপর মেটকে ইঙ্গিতে পিছু নিতে বলে সোজা গিয়ে ঢুকলেন নিজের কেবিনে। মেট ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। বদ্ধ ঘরের ভেতর আবার তারা গোপন আলোচনায় বসেছেন।

দিনটা আজ শান্তিময়। ফুলস্পীডে ছুটছে স্বপ্ন। বাতাসে তেমন জোর না থাকায় পাল টাঙানো হয়নি। অনেকদিন পর অধ্যাপক টাৰ্টলেটকে ডেকে নাচতে দেখা গেল। তবে গডফ্রের শত অনুরোধেও কোমর থেকে লাইফ-বেল্টটা খুলতে রাজি হলেন না।

সন্ধ্যার দিকে ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেল চারদিক। গডফ্রের মনে একটা ভয় ঢুকল। একে রাত, তারপর কুয়াশা, জাহাজ যদি কোন কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খায়, নির্ঘাত ডুবে মরতে হবে। ক্যাপটেনের নির্দেশে সূর্য অস্ত যাবার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের সবগুলো লণ্ঠন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। মাস্তুলে ঝুলছে বড় আকারের একটা লণ্ঠন, সাদা আলো ছড়াচ্ছে। বাম দিকে জ্বলছে টকটকে লাল আলো, আর ডান দিকে গাঢ় সবুজ।

নিজের কেবিনে ফিরে শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পড়ল গডফ্রে।

রাত একটার দিকে প্রচন্ড একটা শব্দ হলো। ঘুমের মধ্যেই শিউরে উঠল গডফ্রে। পরমুহূর্তে ধড়মড় করে উঠে বসল বিছানায়। হৃৎপিন্ড এমন লাফাচ্ছে, মনে হলো বুকটা ফেটে যাবে। বিছানা থেকে নেমে দ্রুত কাপড় পরছে, শুনতে পেল ডেকে লোকজন চিৎকার করছে, জাহাজ ডুবে যাচ্ছে! জাহাজ ডুবে যাচ্ছে।

এক লাফে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল গডফ্রে। ডাইনিং রূমের মেঝেতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে কে যেন, আগে দেখতে না পাওয়ায় তার সঙ্গে ধাক্কা খেলো সে। ভাল করে তাকাতে চিনতে পারল-অধ্যাপক টার্টলেট!

জাহাজের সব লোক ছুটে বেরিয়ে এসেছে ডেকে। মেট আর ক্যাপটেনকে ছুটোছুটি করতে দেখল গডফ্রে। দুজনই খুব উত্তেজিত। কি হয়েছে? হড়বড় করে জিজ্ঞেস করল সে। কিসের সঙ্গে ধাক্কা লাগল?

কি করে বলব! অসহায় একটা ভঙ্গি করে কাঁধ ঝাকাল মেট। কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবে জাহাজটা ডুবে যাচ্ছে।

ডুবে যাচ্ছে? জাহাজ ডুবে যাচ্ছে? গডফ্রের কান্না পাচ্ছে।

কেউ তার প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। গডফ্রে আন্দাজ করল, নিশ্চয়ই কোন ডুবোপাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে জাহাজ। স্বপ্ন যে ডুবছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এরইমধ্যে ডেকের নাগাল পেয়ে গেছে পানি। তারমানে ইতিমধ্যে নিচের এঞ্জিন রূমে পানি ঢুকে পড়েছে।

লাফ দিন! ঝাঁপিয়ে পড়ুন! মি. গডফ্রে, দোহাই লাগে, এখুনি লাফিয়ে পড়ুন! চিৎকার করছেন ক্যাপটেন টারকট। দেখতেই তো পাচ্ছেন, স্বপ্নকে আমরা রক্ষা করতে পারব না। সময় থাকতে লাফ দিন। জাহাজ যখন ডুববে, পানিতে প্রচন্ড একটা ঘূর্ণি তৈরি হবে, লাফ দিতে দেরি করলে ওই ঘূর্ণিতে পড়ে তলিয়ে যাবেন…

গডফ্রে আতঙ্কে নীল হয়ে গেল। তবে নিজের কথা না ভেবে প্রথমেই সে তার নৃত্যশিক্ষক অধ্যাপক টার্টলেটের কথা ভাবল। মি. টার্টলেটের কি হবে?

আপনি আর দেরি করবেন না, প্লীজ, এখুনি লাফ দিন, বললেন ক্যাপটেন। মি. টার্টলেটকে আমি দেখছি। ডাঙা খুব কাছেই, একটু সাঁতার কাটলেই পৌছে যাবেন…

কিন্তু আপনি…আপনার? আপনাদের কি হবে?

সবাই লাফ দিয়ে ডাঙায় উঠবে, বললেন ক্যাপটেন। একা শুধু আমি শেষ পর্যন্ত জাহাজে থাকব। আমি ক্যাপটেন, কাজেই সব লোক নিরাপদে চলে যেতে পারল কিনা তা তো আমাকেই দেখতে হবে.‥লাফ দিন, ঝাঁপিয়ে পড়ুন!

গডফ্রে যে দক্ষ সাতারু, ক্যাপটেন টারকটের তা ভালই জানা আছে।

সাঁতার জানলে কি হবে, এখনও ইতস্তত করছে গডফ্রে। ইতিমধ্যে ডেকে পানি উঠতে শুরু করেছে। ক্যাপটেন গডফ্রেকে ইতস্তত করতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। এগিয়ে এসে হঠাৎ তার পিঠে ধাক্কা দিলেন তিনি। এক ধাক্কাতেই সাগরে ছিটকে পড়ল গডফ্রে।

ক্যাপটেন আসলে গডফ্রের উপকারই করলেন। আরেকটু দেরি হলে জাহাজডুবির ফলে সৃষ্ট ঘূর্ণাবর্তে পড়ত গডফ্রে, সেই সঙ্গে তলিয়ে যেত সাগরের তলায়। পানিতে পড়ে ডুব সাঁতার শুরু করল সে, ঘূর্ণির নাগাল থেকে অনায়াসে দূরে সরে এল। কয়েক মিনিট পরই নাবিক আর মাল্লারা আর্তনাদ শুরু করল। সাদা, লাল, সবুজ-জাহাজের সবগুলো লণ্ঠন নিভে গেল, সেই সঙ্গে গডফ্রের শেষ আশাও। স্বপ্ন ডুববে কি ডুববে না, সে প্রসঙ্গ এখন বাসি হয়ে গেছে। কারণ পানির ওপর সেটার আর কোন চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না। স্বপ্ন মিথ্যে হয়ে গেল, হারিয়ে গেল চিরকালের জন্যে।

খানিকটা সাঁতরাতেই ডাঙার নাগাল পেয়ে গেল গডফ্রে। চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার, নিজের হাত পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে না। নিয়তি এ কোথায় তাকে টেনে নিয়ে এল? এত চিৎকার করে ডাকছে, অথচ কেউ সাড়া দিচ্ছে না কেন? এটা কি কোন ডুবোপাহাড়ের চূড়া? নাকি কোন দ্বীপ? ভয় পেলেও গডফ্রে সাহস হারাল না। অধ্যাপক টার্টলেট, ক্যাপটেন টারকট আর মেটের নাম ধরে চিৎকার করছে সে।

কিন্তু ওরা কেউ সাড়া দিচ্ছে না। অন্ধকারে সাগরও দেখা যাচ্ছে না। তবে কি সে একা বেঁচে আছে, বাকি সবাই ডুবে গেছে জাহাজের সঙ্গে? ডাঙায় ওঠার পর কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না গডফ্রে। জানে কোন সাড়া পাবে না, তবু এখনও মাঝে মধ্যে ওদের নাম ধরে ডাকছে।

গডফ্রে বুঝতে পারল, সূর্য না ওঠা পর্যন্ত এখানেই তাকে অপেক্ষা করতে হবে।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত