রহস্যের দ্বীপ: ৩৩. সুড়ঙ্গ মুখে পৌঁছতে পৌঁছতে

রহস্যের দ্বীপ: ৩৩. সুড়ঙ্গ মুখে পৌঁছতে পৌঁছতে

৩৩. সুড়ঙ্গ মুখে পৌঁছতে পৌঁছতে

সুড়ঙ্গ মুখে পৌঁছতে পৌঁছতে ভোর হয়ে গেল। নৌকোটাকে সুড়ঙ্গ মুখের একটা পাথুরে তাকে রেখে বাইরে বেরিয়ে এল অভিযাত্রীরা। গুপ্ত গহ্বরটার নাম রাখা হলো ডাক্কার গহ্বর। বিষণ্ণ মনে গ্রানাইট হাউসে ফিরে চলল সবাই।

বড় নৌকোটা তৈরির কাজে এবার জোর দিল পেনক্র্যাফট। সবাই সাহায্য করল ওকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করে ফেলতে হবে নৌকোর কাজ। ট্যাবর আইল্যান্ডে গিয়ে নোটিস না রেখে এলে, এসে ফিরে যাবে ডানকান।

দেখতে দেখতে আবার এল জানুয়ারি মাস। মাসের প্রথম তারিখেই যেন খেপে গেল লিঙ্কন দ্বীপের প্রকৃতি। এল উন্মত্ত ঝড়, ভেঙেচুরে উড়িয়ে দিয়ে গেল অসংখ্য গাছপালা।

জানুয়ারির তিন তারিখে ফ্র্যাঙ্কলিন হিলের চূড়া থেকে আবার ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল উপরের আকাশ।

ব্যাপার দেখে সবাইকে ডেকে বললেন হার্ডিং, কথাটা আর গোপন করে লাভ নেই। ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি।

মাটিতে কান পেতে শুনল আয়ারটন, প্রচন্ড গুম গুম শব্দ হচ্ছে মাটির তলায়। শুনছ নাবিক, খেপে গেছে ফ্র্যাঙ্কলিন হিল।

জাহান্নামে যাক ফ্র্যাঙ্কলিন হিল। খেপে গেছে পেনক্র্যাফটও। ধোঁয়া বেরোক চাই আগুন বেরোক। নৌকোর কাজ বন্ধ করা যাবে না।

পাহাড়ের চূড়ায় আগুন দেখা গেল, সন্ধের পর। যেন একটা অতিকায় মশাল জ্বলছে পাহাড়ের মাথায়। ছাই, বাষ্প আর ধোঁয়ায় আড়াল হয়ে গেছে তারাজ্বলা আকাশ। মাঝে মাঝে অনেকগুলো মেশিনগানের একটানা আওয়াজের মত শব্দ আসছে পাহাড়ের দিক থেকে।

সর্বনাশ! সব দেখে শুনে বললেন হার্ডিং, এত জলদিই শুরু হয়ে গেল!

আরও একটা উপসর্গ দেখা দিল কিছুক্ষণ পর। ভূমিকম্পের মত কাপছে দ্বীপের মাটি।

পরের তিনদিন একনাগাড়ে ধ্রূম উদগীরণ করে চলল ফ্র্যাঙ্কলিন হিল। তবে নৌকো তৈরির কাজও চলল একটানা। এরই মাঝে সময় করে খোঁয়াড়ের জানোয়ারগুলোকে খাবার দিয়ে এলেন হার্ডিং আর আয়ারটন।

চতুর্থ দিনে আকাশ থেকে ঝুর ঝুর করে ঝরতে লাগল কয়লার গুড়োর মত কালো একরকম উড়ো। দেখতে দেখতে মাটি ঢেকে গেল কয়েক ইঞ্চি পুরু গুঁড়োয়। আগ্নেয়গিরির মুখ দিয়ে ধোঁয়ার সাথে আকাশে উঠে যাচ্ছে ঝামার গুড়ো, তাই আবার ঝরে পড়ছে নিচে। আগুনে পোড়া ধাতুর পরিত্যক্ত মল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। অগ্নুৎপাতের বেশি দেরি নেই আর।

আগ্নেয়গিরির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে বেরোনেন ক্যাপ্টেন হার্ডিং। রেডক্রীক পেরিয়ে গন্ধকের ঝর্নার কাছে গিয়ে দেখলেন আমুল পরিবর্তন হয়ে গেছে গোটা এলাকার। আশেপাশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে আরও অনেক প্রস্রবণ। ভেতর থেকে, যেন দুরমুশের ঠেলায় ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে উপরের মাটির স্তর। দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস, কার্বনিক অ্যাসিড আর ঘন বাস্পের জন্যে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তবে লাভার স্রোত নামেনি এখনও।

সেদিন সকাল দশটা নাগাদ আয়ারটনকে নিয়ে ডাক্কার গহ্বরের দিকে চললেন ক্যাপ্টেন। জায়গামত পৌঁছে পাওয়া গেল নৌকোটা। হালকা নৌকোটা পাথরের তাক থেকে নামিয়ে আনল আয়ারটন।

নৌকোয় করে বিশাল পাতালের লেকটার শেষ প্রান্তে চলে গেল দুজনে। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সাথে আনা মশালের আলোয় পথ দেখে চলতে হচ্ছে ওদের। মৃত্যুপুরীর মত নিস্তব্ধ পাতালের গহ্বরে মাঝে মাঝে গম্ভীর গুরু গুরু মেঘ গর্জনের মত শব্দ হচ্ছে।

দাঁড়ের মাথায় মশাল বেঁধে সুড়ঙের ছাদ পরীক্ষা করলেন ক্যাপ্টেন। ফেটে চুরচুর হয়ে গেছে পাথরের ছাদ। আগ্নেয়গিরির কেন্দ্রস্থলকে ঢেকে রেখেছে পাথরের দেয়াল। কতটা পুরু এ দেয়াল? দশ, বিশ, একশো ফুট? কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এক সময় যথেষ্ট পুরু থাকলেও এখন আর ততটা পুরু নেই পাথরের দেয়াল। তাছাড়া ফেটে যাওয়া দেয়ালের ফাঁক দিয়ে গ্যাস বেরিয়ে এসে ক্রমে দূষিত করে তুলছে সুড়ঙ্গের বাতাস। পানির মাত্র তিন চার ফুট উপরে নেমে এসেছে একশো ফুট উঁচু ছাদ। স্তম্ভিত হয়ে দৃশ্যটা দেখলেন ক্যাপ্টেন। আয়ারটনকে বললেন, তোমাদেরকে বের করে দিয়ে এই বিপদের কথাটাই আমাকে জানিয়ে গেছেন ক্যাপ্টেন নিমো তোমরা শুনলে যদি আবার ভয় পেয়ে যাও, তাই আগে থেকে শোনাতে নিষেধ করে গেছেন তিনি।

আবার সুড়ঙ্গ মুখে ফিরে এল দুজনে।

পরদিন আটই জানুয়ারি সবাইকে ডেকে বিপদের কথাটা জানালেন ক্যাপ্টেন। বললেন, মৃত্যুর আগে একটা খবর দিয়ে গেছেন ক্যাপ্টেন নিমো খবরটা হলো, যে-কোনদিন সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে যেতে পারে লিঙ্কন আইল্যান্ড। আগ্নেয়গিরির কেন্দ্রস্থল আর সাগরের পানি এ দুটোর ভেতর ব্যবধান শুধু একটা দেয়ালের, ডাক্কার গহ্বরের দেয়াল। ভেতরের লাভাস্রোত প্রচন্ড চাপ দিচ্ছে দেয়ালের গায়ে। দেয়ালটা ভেঙে গেলে সাগরের পানি গিয়ে ঢুকবে আগ্নেয়গিরির ভেতর। ফলটা কি দাঁড়াবে, বলতে পারো?

নিভে যাবে আগুন। নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল পেনক্র্যাফট ।

না, পেনক্র্যাফট, ব্যাপারটা অত সহজ হলে ভাবনার কিছু ছিল না। উত্তপ্ত লাভার ওপর পানি পড়লে মুহূর্তে তা বাষ্পে পরিণত হবে এই বাষ্প বেরোবার পথ না পেয়ে প্রচন্ড চাপে ফাটিয়ে দেবে সমস্ত পাহাড়টা। কিন্তু তখনও ঠান্ডা হবে না লাভাস্রোত। হু হু করে সাগরের পানি পড়বে গিয়ে ওতে, আরও বাষ্প তৈরি হবে, বোমা মেরে উড়িয়ে দেবার মত চুরমার হয়ে যাবে লিঙ্কন দ্বীপ।

এবার বুঝল অভিযাত্রীরা, কি সাংঘাতিক বিপদ ঘনিয়ে আসছে ওদের সামনে। ডাক্কার গহ্বরের পাথুরে দেয়াল যতক্ষণ উত্তপ্ত লাভার প্রলয়ঙ্করী চাপ সহ্য করে টিকে থাকতে পারবে, ততক্ষণ আয়ু আছে ওদের। কিন্তু আর কয়দিন টিকবে ডাক্কার গহ্বরের দেয়াল? কয়েক মাস কয়েক দিন, না কি কয়েক ঘন্টা?

এখন খেটেখুটে জাহাজটা তৈরি করে ফেলতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। সব ভুলে জাহাজ তৈরির কাজে মন দিল অভিযাত্রীরা।

জাহাজের ডেক তৈরির কাজ শেষ হলো তেইশে জানুয়ারি। মাঝখানের কটা দিন নতুন কোন উৎপাত করেনি আগ্নেয়গিরি, কিন্তু সেদিন রাত দুটোয় একটা ভয়ঙ্কর শব্দে কানে তালা লেগে গেল অভিযাত্রীদের। সেই সাথে শুরু হলো প্রচন্ড ভূকম্পন।

গ্রানাইট হাউসের জানালা দিয়ে উঁকি দিল সবাই। ফ্র্যাঙ্কলিন হিলের চুড়োটা উড়ে গেছে। সেখান দিয়ে বেরিয়ে আসছে লকলকে আগুনের শিখা। বিশাল একটা দাবানল জ্বলছে যেন পাহাড়ের মাথায়। সেই সাথে নেমে আসছে উত্তপ্ত লাভাস্রোত। লক্ষ জিহ্বা মেলে, প্রলয়ের বিষাণ বাজিয়ে নাচতে নাচতে খোয়াড়ের দিকে এগিয়ে চলেছে তরল আগুনের স্রোত। তক্ষুণি গাড়ি নিয়ে খোঁয়াড়ের দিকে ছুটল অভিযাত্রীরা। খোঁয়াড়ে পৌঁছেই গেট খুলে দিয়ে দূরে সরে এল ওরা। একছুটে খোঁয়াড় থেকে বেরিয়ে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকল ভীত জাননায়ারের দল। পরক্ষণেই খোঁয়াড়ের উপর দিয়ে বয়ে গেল ফুটন্ত লাভার স্রোত! আতঙ্কিত দৃষ্টিতে দেখল অভিযাত্রীরা, পেছনের ঝর্নাটায় উত্তপ্ত লাভা পড়তেই ছাৎ করে বাস্প হয়ে উড়ে গেল ঝর্নার সমস্ত পানি; পুড়ে ছারখার হয়ে গেল খোঁয়াড়টা ।

ভোর হতে হতেই জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল গলিত লাভা। আগুন লেগে গেল বনে। সাতটা নাগাদ আর থাকা গেল না সে অঞ্চলে। হ্রদের পাড়ে সরে এল অভিযাত্রীরা। কিছুটা সময় অন্তত ওই তরল আগুনকে ঠেকিয়ে রাখবে হ্রদের পানি।

মুহুর্মুহু বজ্র গর্জনের মত প্রচন্ড গর্জনে কাঁপছে চারদিক, চ্যাপ্টা টেবিলের মত বিশাল দুটো জ্বালামুখ দিয়ে এক নাগাড়ে বেরিয়ে চলেছে আগুন, ছাই, লাভা। হ্রদের পাড়ে প্রায় পৌঁছে গেছে লাভাস্রোত।

পেনক্র্যাফট! চেঁচিয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন, জলদি যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে এসো। বাঁধ দিয়ে ঘুরিয়ে দিতে হবে লাভাস্রোত সমস্ত লাভাটাই পানিতে গিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

সাথে সাথেই ছুটল পেনক্র্যাফট। ডকইয়ার্ড থেকে কুড়াল গাঁইতি এনে কাঠ কাটতে শুরু করল। ফুট তিনেক উঁচু একটা বাঁধ তৈরি শেষ হলো। পরিশ্রমে কুকুরের মত জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে সবাই।

আর একটু পরই যাত্রাপথের সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বাঁধের কাছে পৌঁছে গেল লাভার স্রোত। সামনে বাধা পেয়ে মোড় ঘুরে পানির দিকে চলে গেল লাভা। প্রায় বিশ ফুট উপর থেকে জলপ্রপাতের মত হ্রদের পানিতে ঝরে পড়ছে লাভাপ্রপাত। শুরু হয়ে গেল প্রলয়কান্ড হাজার হাজার স্টীম এঞ্জিন একসাথে ফুসছে যেন।

নিচে পড়েই সেখানকার পানিকে বাম্পাকারে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে জমে যাচ্ছে লাভা। জমাট বাঁধা লাভার উপর পড়ছে আরও তরল লাভা, এগিয়ে যাচ্ছে, সামনের পানিতে বাধা পেয়ে জমে যাচ্ছে। আবার ওগুলোর ওপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আরও পেছনের লাভাস্রোত। হ্রদের পানিকে আকাশে ওড়াতে ওড়াতে বিরামহীন ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে ওই অপরাজেয় তরল আগুন। শেষ পর্যন্ত হেরে গেল হ্রদের পানি। এককালের বিশাল হ্রদের সমস্ত চিহ্ন মুছে দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে গেল জমাট লাভার দেয়াল। চোখের সামনে দৃশ্য পরিবর্তন দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল অভিযাত্রীরা।

রাতেও জাহাজ তৈরির কাজ চালিয়ে গেল অভিযাত্রীরা। আলোর অভাব নেই। সারারাত অতিকায় মশাল জ্বালিয়ে এলাকাটাকে দিনের মত করে রাখে আগুনে পাহাড়। আপাতত লাভা বেরোনো বন্ধ হয়েছে। তবে আবার বেরোনোর আশঙ্কাটা রয়েই গেছে।

পঁচিশ থেকে তিরিশে জানুয়ারি—ছদিনে বিশ দিনের কাজ করে ফেলল অভিযাত্রীরা। মার্সি নদীর তীরে এসে ঠাঁই নিয়েছে ওরা, গ্রানাইট হাউসে থাকা এখন আর নিরাপদ নয়।

লিঙ্কন দ্বীপের আগের সেই চেহারা আর নেই। এককালে যা নিবিড় সবুজে ঢাকা ছিল এখন তা ধূসরতায় ছেয়ে গেছে। হ্রদ, নদী-সব গ্রাস করেছে লাভাস্রোত। খাবার পানির অভাব দেখা দিয়েছে সমস্ত দ্বীপ জুড়ে।

সবচেয়ে করুণ অবস্থা হয়েছে দ্বীপের পশ্চিম অংশের। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বিশাল বনভূমি। এখানে ওখানে ভূতের মত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কালো পোড়া গাছের কান্ড। জাগুয়ার, ক্যাপিবারা, পেকারি, কোয়ালা আর অন্যান্য সব বুনো জানোয়ারের দল প্রাণ ভয়ে পালিয়েছে জলাভূমির দিকে।

আরও বিশ দিন পেরিয়ে গেল। আর মাসখানেক কাজ করতে পারলেই সাগরে ভাসানো যাবে জাহাজ। কিন্তু এই এক মাস টিকে থাকবে তো টলমল লিঙ্কন আইল্যান্ড!

আরও দিন গেল। আর মাত্র দশদিন টিকে থাকতে পারলেই এ যাত্রা বেঁচে যাবে অভিযাত্রীরা। কিন্তু সময় দিল না আগ্নেয়গিরি। মার্চের প্রথম সপ্তাহেই তান্ডব কান্ড শুরু করে দিল সে। এবার আরও প্রলয়ঙ্করী রূপে পিচকারি দিয়ে পানি ছিটানোর মত সবেগে আকাশে উঠে গেল তরল লাভার স্রোত। সেখান থেকে হাজার হাজার কাচের সুতোর মত ঝরে পড়তে লাগল নিচে। কিন্তু এই করেই ক্ষান্ত হলো না আগুনে পাহাড়। জ্বালামুখ দিয়ে আবার গড়িয়ে এল বিরামহীন লাভার স্রোত, এবার আগের চাইতেও বেশি। পোলট্রি হাউস ছাড়িয়ে লাভার স্রোত গিয়ে পৌঁছল প্রসপেক্ট হাইট পর্যন্ত।

পোলট্রি হাউসের মাথায় ছানা আর ডিমের শোকে হাহাকার করে উড়ে বেড়াতে লাগল পাখির দল। প্রসপেক্ট হাইটের ওপর থেকে লাভার স্রোত জলপ্রপাতের আকারে নামতে লাগল সাগরে, আর আশা নেই। এই অসমাপ্ত জাহাজকেই সাগরে ভাসাতে হবে। ঠিক হলো পরদিন ভোরে নামানো হবে জাহাজ। কিন্তু ভোর হবার আগেই ঘটে গেল চুড়ান্ত অঘটন।

মাঝ রাতের দিকে হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে ভলকে ভলকে কালচে বাষ্প বেরিয়ে এল আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ দিয়ে। একটু পরই রাশি রাশি পাথর ছিটকে পড়ল আকাশে। ফেটে গেছে ডাক্কার গহ্বরের দেয়াল।

প্রচন্ড বিস্ফোরণ হলো আবার… আবার.‥ আবার। আকাশ বাতাস থরথর করে কেঁপে উঠল কানে তালা লাগানো শব্দে। দেখতে দেখতে ভেঙে গুড়িয়ে গেল ফ্রাঙ্কলিন হিল। কিন্তু থামল না বিস্ফোরণের শব্দ। পরিষ্কার টের পেল অভিযাত্রীরা, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে লিঙ্কন আইল্যান্ড।

ভোর হতে হতে অদৃশ্য হয়ে গেল লিঙ্কন আইল্যান্ডের সীমারেখা। একদিন যেখানে ছিল একটা বিশাল দ্বীপ, সেখানে এখন উথালপাতাল নাচছে সাগরের ঢেউ।

বিশাল সাগরের মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট একটা পাথুরে দ্বীপ। লম্বায় তিরিশ ফুট, চওড়ায় বিশ ফুট আর সমুদ্র সমতল থেকে বড়জোর ফুট দশেক উঁচু হবে এই গ্রানাইটের দ্বীপটা– লিঙ্কন দ্বীপের একমাত্র ধ্বংসাবশেষ।

ওটার ওপরই ঠাঁই নিয়েছেন অভিযাত্রীরা। অগ্নুৎপাতের ফলে মারা গেছে দ্বীপের সমস্ত জন্তু জানোয়ার। অবিশ্বাস্য ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছে ছজন লোক আর একটি কুকুর। বিস্ফোরণের সময় পাথর চাপা পড়ে মারা গেছে জাপ। তখন মার্সি নদীর পাড়ে তাঁবুর ভেতরে ছিল অভিযাত্রীরা। হঠাং ওরা টের পেল তাঁবুতে পানি ঢুকছে। দেখতে দেখতে বেড়ে গেল পানি। তাঁবু থেকে ছুটে বেরিয়ে এল সবাই। কিন্তু যাবে কোথায়? চারদিকে থই থই করে নাচছে সাগরের ঢেউ। পানির তলায় চলে গেছে লিঙ্কন দ্বীপ। শুধু গ্রানাইট হাউসের ওই ধ্বংসাবশেষটুকু এখনও জেগে আছে পানির ওপর। সাঁতরে গিয়ে ওটাতে উঠেই কোনমতে প্রাণ বাঁচাল অভিযাত্রীরা।

এই পাথরের টুকরোর ওপরই একে একে কাটাল ওরা দীর্ঘ নয়টি দিন। খাদ্য নেই, পানি নেই। শুধু পাথরের খাঁজে আটকা পড়া পানিটুকু ছিল ওদের সম্বল। এখন তাও ফুরিয়েছে।

ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে জাহাজটা। কঠিন পাথরের টুকরোর ওপর বসে বসে মৃত্যুর দিন গোনা ছাড়া করার কিছুই নেই। কেটে গেল আরও পাঁচটা দিন। তৃষ্ণায় অনাহারে কাহিল হয়ে পড়েছে ওরা। শেষ পর্যন্ত উঠে বসার শক্তিটুকুও রইল না কারও শরীরে।

প্রলাপ বকতে শুরু করেছে নেব আর হার্বার্ট। বড় জোর আর একটা দিন টিকবে ওরা। ওদেরকে একটু সান্তনা দেয়ার জন্যে বহু কষ্টে উঠে বসল আয়ারটন। ঠিক সেই সময় ওর চোখে পড়ল জিনিসটা।

আকাশ আর সাগরের সঙ্গমস্থলে দেখা যাচ্ছে একটা কালো বিন্দু। আস্তে আস্তে বিন্দুটা বড় হলে, বড় হতে হতে একটা জাহাজের রূপ নিল। এদিকেই আসছে জাহাজটা।

ক্ষীণ কণ্ঠে উচ্চারণ করল আয়ারটন, ডানকান! উঠে দাঁড়াতে গিয়েও পারল সে, পড়ে গেল জ্ঞান হারিয়ে অন্যরা জ্ঞান হারিয়েছে আগেই।

ডানকানের সুসজ্জিত কেবিনে জ্ঞান ফিরল অভিযাত্রীদের। জ্ঞান ফিরে পেতেই জাহাজের ক্যাপ্টেনের খোঁজ করলেন হার্ডিং। খবর পেয়ে কেবিনে এসে ঢুকলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন।

জাহাজটার নাম কি, ক্যাপ্টেন? জাহাজের ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করলেন হার্ডিং।

ডানকান।

ডানকান, মানে লর্ড গ্লেনারভনের জাহাজ, ডানকান? বিস্মিত হলেন হার্ডিং।

হ্যাঁ,আমি লর্ড গ্লেনারভনের ছেলে রবার্ট গ্র্যান্ট। উত্তর দিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন।

কিন্তু আপনার তো আয়ারটনের খোঁজে ট্যাবর আইল্যান্ডে যাবার কথা। দেড়শো মাইল উত্তর-পুবে এসেছেন কি করতে?

আপনাদের খোঁজে, ক্যাপ্টেন হার্ডিং।

আমাদের খোঁজে? আমরা এখানে আছি কে বলল আপনাকে? আমার নামই বা জানলেন কি করে?

মানে? অবাক হলেন গ্র্যান্ট, টাবর আইল্যান্ডে আপনারা যে নেটিস রেখে এসেছেন ওতেই তো আপনাদের নাম, ধাম, লিঙ্কন আইল্যান্ডের অবস্থান সব রেখে এসেছেন। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলেন তিনি। এগিয়ে নিলেন হার্ডিংয়ের দিকে, এই যে, এটা আপনারা রেখে আসেননি?

হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিলেন হার্ডিং, একনজর দেখেই বুঝতে পারলেন বোতলে পাওয়া কাগজের লেখা আর এ লেখা একই হাতের। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, হু, বুঝেছি আমাদের এই উপকারটুকুও করে গেছেন ক্যাপ্টেন নিমো। মাথা আঁকাল পেনক্র্যাফটও। বলল, আমিও বুঝেছি বন-অ্যাডভেঞ্চারের দড়ির বাঁধনে অন্য গিট ছিল কেন। আসলে বন-অ্যাডভেঞ্চারে করেই ট্যাবর দ্বীপে গিয়ে নোটিস রেখে এসেছিলেন ক্যাপ্টেন নিমো। ফিরে এসে আবার যথাস্থানে নৌকোটাকে বেঁধে রেখেছিলেন তিনি। গিটটা তাই আমার দেয়া গিটের চেয়ে অন্যরকম ছিল।

নিজে সাংঘাতিক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আর একবার প্রাণ বাঁচিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন নিমো। এসো তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে ঈশ্বরের কাছে দোয়া চাই আমরা। বলে নিজের মাথার টুপি খুলে নিলেন হার্ডিং। আর সবাই তাই করলে হাতজোর করে গভীর কণ্ঠে বললেন ক্যাপ্টেন, May the God mercy have had pity on the soul of Captain Nemo, our benefactor. (মঙ্গলময় ঈশ্বর আমাদের উপকারী বন্ধু ক্যাপ্টেন নিমোর আত্মার মঙ্গল করুন।)

হঠাৎ কি মনে পড়তেই পকেট থেকে একটা ছোট্ট বাক্স বের করে হার্ডিংয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরল আয়ারটন। ক্যাপ্টেন নিমোর সেই হারের বাক্সটা। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পড়েও বাক্সটার কথা ভোলেনি সে, সযত্নে রক্ষা করেছে। হাত বাড়িয়ে আয়ারটনের হাত থেকে বাক্সটা নিলেন হার্ডিং। হঠাৎ তার নজর পড়ল রবার্ট গ্রান্টের ওপর। গ্র্যান্টের কথা যেন ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি। এবার নজর পড়তেই বললেন হার্ডিং, দেখুন, ক্যাপ্টেন, এক মহাপাপীকে রেখে গিয়েছিলেন ট্যাবর আইল্যান্ডে। সেই একযুগ আগে রেখে যাওয়া আয়ারটনের সাথে আজকের আয়ারটনের কোন তুলনা হয় কি?

কোন উত্তর দিতে পারলেন না ক্যাপ্টেন রবার্ট গ্র্যান্ট। প্রশান্ত মহাসাগরের গভীর নীল জলরাশি ভেদ করে তখন আমেরিকার দিকে এগিয়ে চলেছে ডানকান।

* * *

আগের পর্ব :
০১. ওপরে কি উঠছি আমরা
০২. গৃহযুদ্ধের তান্ডবলীলা চলছে
০৩. কোথায় গেলেন ক্যাপ্টেন
০৪. বিকেল নাগাদ নদীর জল কমে গিয়ে
০৫. চেঁচিয়ে বললেন স্পিলেট
০৬. বেলুন থেকে নামার পর
০৭. সকাল থেকে কোথাও পাওয়া গেল না নেবকে
০৮. ওরা ঢুকলেও ফিরে চাইল না নেব
০৯. হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পেনক্র্যাফট
১০. ধোঁয়া, মানে আগুন
১১. ভোর হলো
১২. পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই
১৩. পরদিন সকালে খাওয়া-দাওয়ার পর
১৪. মাপজোকের কাজ শুরু করলেন ক্যাপ্টেন
১৫. গহ্বরের মুখ
১৬. জুনের শুরুতেই শীত নামল
১৭. যেন ভূত দেখছে এমন ভাবে
১৮. জাহাজডুবি হয়ে সত্যিই কেউ দ্বীপে উঠেছে কিনা
১৯. দ্বীপের দক্ষিণ তীর ঘেঁষে চলা শুরু হলো
২০. একটু দূরে জঙ্গলের ধারে
২১. মার্চের আরম্ভেই শুরু হলো ঝড় বৃষ্টি
২২. আবার এল শীত
২৩. এখনও কি বাধা দেবেন
২৪. মার্সি নদীর মুখে এসে
২৫. জঙ্গলে আর ফিরে গেল না আগন্তুক
২৬. ভোর হতেই খোঁয়াড়ের দিকে রওনা দিল
২৭. এখনও প্রায় বিশ মাইল দূরে জাহাজটা
২৮. চোখের সামনে ভোজবাজীর মত
২৯. আস্তে আস্তে সেরে উঠতে লাগল হার্বার্ট
৩০. ফ্রাঙ্কলিন হিলের কোন গুহায়
৩১. জাহাজের খোল তৈরির কাজ
৩২. ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন ক্যাপ্টেন নিমো

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত