রহস্যের দ্বীপ: ৩১. জাহাজের খোল তৈরির কাজ

রহস্যের দ্বীপ: ৩১. জাহাজের খোল তৈরির কাজ

৩১. জাহাজের খোল তৈরির কাজ

পনেরোই মে জাহাজের খোল তৈরির কাজ শেষ হয়ে গেল। আস্তে আস্তে আরও এগিয়ে চলল জাহাজের কাজ।

আবার শীত নামল লিঙ্কন দ্বীপে। শীতের পর বসন্ত। হঠাৎ সাতই সেপ্টেম্বরে ঘটল ঘটনাটা। ব্যাপারটা প্রথম ক্যাপ্টেনের চোখে পড়ল। ধোঁয়া বেরোচ্ছে ফ্রাঙ্কলিন হিলের চূড়া দিয়ে। সত্যিই তাহলে আবার জেগে উঠেছে আগ্নেয়গিরি। ক্রমশ বেড়েই চলল ধোঁয়ার পরিমাণ।

লিঙ্কন দ্বীপের সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটল পনেরোই অক্টোবর রাতে। খাওয়ার পর গল্প করছে সবাই। এমন সময় বেজে উঠল টেলিগ্রাফের বেল। স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই। আজকাল গ্রানাইট হাউসেই থাকে আয়ারটন। তাছাড়া এখন ওদের সাথেই গল্প করছে ও। তাহলে কে বাজাল বেল?

আবার বাজল বেল, আবার। পর পর তিনবার। উঠে গিয়ে টেলিগ্রাফের চাবি টিপলেন ক্যাপ্টেন—অর্থাৎ জিজ্ঞেস করলেন, কে আপনি? কি চান?

উত্তর এল, এখুনি খোঁয়াড়ে চলে এসো।

যাক, অ্যাদ্দিনে রহস্যের মীমাংসা হতে চলেছে, বলেই সবাইকে তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিলেন ক্যাপ্টেন। অল্পক্ষণেই তৈরি হয়ে, জাপ আর টপকে গ্রানাইট হাউসে রেখে বেরিয়ে এল সবাই।

ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। তার ওপর আকাশে মেঘ করেছে। একটা তাঁরা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না আকাশের কোথাও। কোন কথা না বলে দ্রুত এগিয়ে চলল সবাই।

হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হলো। গম্ভীর, ভীষণ আওয়াজ করে দুএকটা বাজ পড়ল এদিক ওদিক। ঝড় আসতে বেশি দেরি নেই। খোঁয়াড়ে পা দিতেই এসে গেল ঝড়।

ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল সবাই। আলো জ্বালল নেব কিন্তু কই? ঘরে তো কেউ নেই। টেবিলে রাখা চিঠিটা হার্বার্টের চোখে পড়ল চিঠিটা। তুলে ক্যাপ্টেনের হাতে দিতেই ভাজ খুলে পড়লেন তিনি, নতুন তার ধরে চলে এসো ।

সাথে সাথেই ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন ক্যাপ্টেন। খোঁয়াড় থেকে টেলিগ্রাফ করা হয়নি। পুরানো তারের মাথায় একটা নতুন তার লাগিয়ে নিজের আবাসস্থল পর্যন্ত নিয়ে গেছেন ত্রাণকর্তা। সেখানে বসেই ডেকে পাঠিয়েছেন অভিযাত্রীদের।

খোঁয়াড়ের বাইরে এসে মশালের আলোয় ক্যাপ্টেন দেখলেন, প্রথম খুঁটির পুরানো তারের সাথে একটা নতুন তার লাগানো রয়েছে। মাটির ওপর দিয়ে সোজা পশ্চিম দিকে চলে গেছে তারটা।

তারটাকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলল অভিযাত্রীরা। কখনও গাছের নিচু ডাল, কখনও মাটির ওপর দিয়ে চলে গেছে তারটা। উপত্যকায় এসেও শেষ হলো না তার। পাহাড়ের গা বেয়ে এগিয়ে গেল সাগরের দিকে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশে। বিকট শব্দে পাহাড়ের মাথায় বাজ পড়ল। একটা প্রলয়ের রাত যেন এটা।

রাত এগারোটায় দ্বীপের পশ্চিমে পৌঁছে গেল অভিযাত্রীরা। পাঁচশো ফুট নিচে পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ছে সাগর। এখান পর্যন্ত এসে একটা পাহাড়ের ফাটলের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে তারটা। দুর্গম জায়গা তবু তার মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চলল ওরা। পাহাড়ের ফাটল পেরিয়ে পানির ধারে চলে এল অভিযাত্রীরা, থমকে দাঁড়াতে হলো এখানে। সোজা পানিতে নেমে গেছে তার। ত্রাণকর্তা তাহলে পানির দেশের বাসিন্দা! কিন্তু কি করে যাওয়া যায় ওখানে? সবার মনোভাব বুঝতে পেরে আশ্বাস দিলেন ক্যাপ্টেন, ভাবনার কিছু নেই। ভাটার টানে পানি নেমে গেলেই আবার তারটাকে অনুসরণ করতে পারব আমরা।

হঠাৎ শুরু হলো অঝোর বর্ষণ। একটা গুহায় আশ্রয় নিল অভিযাত্রীরা। অনেক অনেকক্ষণ পর বৃষ্টি কিছুটা ধরে এলে বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। জোয়ারের পানি ততক্ষণে সরে গেছে।

ঠিকই বলেছিলেন ক্যাপ্টেন। একটু আগে যেখানে পানি ছিল সেখানে এখন একটা বিশাল সুরঙ্গ-মুখ দেখা যাচ্ছে। মশালের আলোয় তারটাকে অনুসরণ করে সুড়ঙ্গে ঢুকে গেল অভিযাত্রীরা। প্রায় আট ফুট উঁচু খিলানের মত গুহামুখের ভেতর ঢুকেই আবার দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। আর এগোনো যাবে না। ওদের সামনে আবার সাগরের পানি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটু দূরের পানিতে কালো মত কিছু একটা ভাসছে! আলো হাতে পানি ভেঙে আরও কয়েক পা এগিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন এবার চিনতে পারলেন কালো বস্তুটাকে—একটা নৌকো।

হাত বাড়িয়ে নৌকোর গলুই ধরে ওটাকে সঙ্গীদের কাছে টেনে নিয়ে এলেন ক্যাপ্টেন। লোহার পাত দিয়ে মোড়া নৌকোটায় দুটো দাঁড়। ওপাশের গলুইয়ে আটকানো শেকলের অন্য মাথা একটা পাথরের সাথে বেঁধে নৌকোটাকে যথাস্থানে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সবাইকে নৌকোয় ওঠার নির্দেশ দিলেন ক্যাপ্টেন। সবাই নৌকোয় উঠে বসল। আয়ারটন আর পেনক্র্যাফট দাঁড় টানতে শুরু করল। ধনুকের মত বেকে ওপরে উঠে গেল সুড়ঙ্গের ছাদ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে মশালের আলোয় দুরু দুরু বুকে সুড়ঙ্গের ভেতর এগিয়ে চলল অভিযাত্রীরা। তারা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। অনুমান করলেন ক্যাপ্টেন, সুড়ঙ্গের ভেতরেই কোথাও না কোথাও গিয়ে শেষ হয়েছে তার।

আর একটু সামনে গিয়েই আবার চোখে পড়ল তরটা। সুড়ঙ্গের গায়ের বেরিয়ে থাকা পাথরের খাঁজে ঝুলে ঝুলে এগিয়ে গেছে তারটা। আরও প্রায় আধ মাইল যাওয়ার পর ডান দিকে মোড় নিল সুড়ঙ্গ। মোড় ঘুরতেই অভিযাত্রীদের চোখে পড়ল অস্বাভাবিক উজ্জ্বল আলোটা ।

বিশাল কালো গহ্বরটার কোথাও এখন আর একরত্তি অন্ধকার নেই সব। ঝেটিয়ে বিদায় করেছে ওই অত্যুজ্জ্বল আলো।

এ কিসের আলো? জিজ্ঞেস করল হার্বার্ট।

ইলেকট্রিক আলো বলেই মনে হয়, উত্তর দিলেন ক্যাপ্টেন।

এখানেও শেষ হয়নি তার। এগিয়ে গেছে সামনে। এগিয়ে চলল অভিযাত্রীরাও। ক্রমশ চওড়া হতে হতে এক সময় শেষ হয়ে গেল সুড়ঙ্গ সামনে বিশাল হ্রদ। পাতালের হ্রদ। প্রকান্ড একটা তিমি ভাসছে হ্রদের পানিতে। এখানে তিমি এল কোথেকে? থামল না অভিযাত্রীরা। সাহস করে তিমিটার দিকেই এগিয়ে চলল আরও কাছে যাওয়ার পর বোঝা গেল ওটা তিমি নয়।

অনেকটা চুরুটের মত গড়ন ওটার। দুপাশে ছুঁচালো। মাথার দুপাশ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে উজ্জল বৈদ্যুতিক আলো। প্রায় আড়াইশো ফুট লম্বা দশ-বারো ফুট উঁচু কুচকুচে কালো প্রকান্ড বস্তুটা স্থির হয়ে ভাসছে হ্রদের পানিতে।

আরও এগিয়ে গেল স্তম্ভিত অভিযাত্রীরা। উত্তেজনায় হঠাৎ খপ করে স্পিলেটের হাত চেপে ধরলেন ক্যাপ্টেন! ফিস ফিস করে বললেন, বুঝেছি। এ হচ্ছে সেই লোক। কিংবদন্তীর মত প্রায়ই এঁর কথা কানে এসেছে আমার।

স্পিলেটের কানে কানে একটা নাম বললেন ক্যাপ্টেন। শুনে তড়িতাহতের মত চমকে উঠলেন স্পিলেট , ফিস ফিস করেই বললেন তিনি, কিন্তু…কিন্তু তিনি যে ক্রিমিনাল। ফেরারী আসামী। পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশে আইনের খাড়া ঝুলছে তার মাথার ওপর।

হ্যাঁ, তিনিই ডেকে পাঠিয়েছেন আমাদের, গম্ভীরভাবে বললেন ক্যাপ্টেন।

ভাসমান অতিকায় বস্তুটার গায়ে এসে নৌকো ভিড়ল। দলবল নিয়ে নৌকো থেকে ওটার ওপর নামলেন ক্যাপ্টেন। বস্তুটার ঠিক পিঠের ওপর একটা গোল ধাতব ঢাকনা। ঢাকনাটা তুলতেই দেখা গেল লোহার সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলেন ক্যাপ্টেন, পিছন পিছন অনুসরণ করল আর সবাই। একটা গোল চত্বরের মত জায়গায় শেষ হয়েছে সিঁড়ি। ইলেকট্রিক আলোয় ঝলমল করছে জায়গাটা। চত্বরের অন্যপ্রান্তের দরজাটা খুললেন ক্যাপ্টেন। সুসজ্জিত একটা ঘর। সেটার পরের ঘরটা লাইব্রেরি। লাইব্রেরির অন্য প্রান্তের দরজা খুলে বিশাল হলরুমে ঢুকলেন ক্যাপ্টেন। বিলাস বহুল বড় বড় যাত্রীবাহী জাহাজের সেলুনের চাইতেও দামী জিনিসে সাজানো ঘরটা।

ঘরের ভেতরে একটা দামী সোফায় আধশোয়া হয়ে আছেন একজন লোক। সোজা সেদিকে এগিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন। সোফায় শোয়া লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমরা এসেছি, ক্যাপ্টেন নিমো।

আগের পর্ব :
০১. ওপরে কি উঠছি আমরা
০২. গৃহযুদ্ধের তান্ডবলীলা চলছে
০৩. কোথায় গেলেন ক্যাপ্টেন
০৪. বিকেল নাগাদ নদীর জল কমে গিয়ে
০৫. চেঁচিয়ে বললেন স্পিলেট
০৬. বেলুন থেকে নামার পর
০৭. সকাল থেকে কোথাও পাওয়া গেল না নেবকে
০৮. ওরা ঢুকলেও ফিরে চাইল না নেব
০৯. হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পেনক্র্যাফট
১০. ধোঁয়া, মানে আগুন
১১. ভোর হলো
১২. পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই
১৩. পরদিন সকালে খাওয়া-দাওয়ার পর
১৪. মাপজোকের কাজ শুরু করলেন ক্যাপ্টেন
১৫. গহ্বরের মুখ
১৬. জুনের শুরুতেই শীত নামল
১৭. যেন ভূত দেখছে এমন ভাবে
১৮. জাহাজডুবি হয়ে সত্যিই কেউ দ্বীপে উঠেছে কিনা
১৯. দ্বীপের দক্ষিণ তীর ঘেঁষে চলা শুরু হলো
২০. একটু দূরে জঙ্গলের ধারে
২১. মার্চের আরম্ভেই শুরু হলো ঝড় বৃষ্টি
২২. আবার এল শীত
২৩. এখনও কি বাধা দেবেন
২৪. মার্সি নদীর মুখে এসে
২৫. জঙ্গলে আর ফিরে গেল না আগন্তুক
২৬. ভোর হতেই খোঁয়াড়ের দিকে রওনা দিল
২৭. এখনও প্রায় বিশ মাইল দূরে জাহাজটা
২৮. চোখের সামনে ভোজবাজীর মত
২৯. আস্তে আস্তে সেরে উঠতে লাগল হার্বার্ট
৩০. ফ্রাঙ্কলিন হিলের কোন গুহায়
পরের পর্ব :
৩২. ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন ক্যাপ্টেন নিমো
৩৩. সুড়ঙ্গ মুখে পৌঁছতে পৌঁছতে

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত